“স্মৃতি” – কলমে: যারিন সুবাহ।

0
700

#গল্পপোকা_ছোটগল্প_প্রতিযোগিতা_আগস্ট_২০২০

ছোটগল্প: “স্মৃতি”
শব্দসংখ্যা: ৯৮৭
ক্যাটাগরি: ভৌতিক, রহস্যময়।

কলমে: যারিন সুবাহ।
______________________________________

“বাবাই আজ একটা গল্প শুনাও না আমায়?”
১৫ বছরের ছেলের মুখে এমন আবদার শুনে পেপার থেকে চোখ তুলে তাকান রহমান সাহেব। বিছানায় আধশোয়া হয়ে তিনি খবরের কাগজ পড়ছিলেন।
বাচ্চা মানুষ গল্প শোনার আবদার করলে মানায়, এই বয়সি ছেলেপুলেরা তো আবার আজকাল বাবা মায়ের সাথে ভালো মতো কথাই বলতে চায় না। সেখানে তার ছেলে গল্প শুনতে চাচ্ছে। মুচকি হেসে রহমান সাহেব ছেলে নিদুলকে বললেন,
__”তো কী গল্প শুনতে চাচ্ছেন আপনি?”
ছেলেও বাবার হাসির উত্তরে একফালি হাসি ঝুলিয়ে দেয় ঠোঁটে, উত্তরে বলে,
__”তোমার যেমন ইচ্ছে বাবাই।”
__”আচ্ছা তাহলে আজকে হঠাৎ বাবার কাছে গল্প শুনতে চাওয়ার কারণটা কী জানতে পারি আমি?”
বিছানার পাশে দাঁড়ানো নিদুল পাপোশে পা মুছে বিছানায় উঠে পড়ে, বাবার পাশে শুতে শুতে বলে,
__”বাবাই, সবাই বলে বেশী বেশী আব্বু আম্মুর সাথে থাকা উচিত, আম্মু তো…।”
চোখ ভিজে আসে রহমান সাহেবের। সুবোধ পুত্রের কথায় তিনি আবেগাপ্লুত হোন, ছেলেটা তার বড়ো বুঝের!
__”আচ্ছা, তাহলে আমার জীবনের একটি ঘটনা তোমাকে শুনাই। মনোযোগ দিয়ে শুনবে!”
নিদুল পাশ ফিরে বাবার পেটের উপর হাত রেখে বলে,
__”শুনতেই তো এলাম, মনোযোগ দিবো না কেন?”
রহমান সাহেব গলা ঝেড়ে কেশে তার গল্প শুরু করেন,
__”তখন আমার বয়স ছিল এই চব্বিশ কি পঁচিশ। বন্ধুরা মিলে ফন্দি আঁটলাম, আমরা কোনো ভুতুড়ে বাংলোতে গিয়ে রাত কাটাবো। যেই ভাবা সেই কাজ! আমাদের গ্রুপে একজন ছিল খুব ভীতু, ছেলেটার নাম ছিল হৃদ। আমাদের সময়ে এতো আধুনিক নাম কেউ রাখতো না কিন্তু ওর নামটা খুব আধুনিক এবং আমার কাছে খুব পছন্দের ছিল। ও আমাদের খুব মানা করে, “যাস না, যাস না” বলে খুব অনুরোধ করে কিন্তু আমরা ওকে ওর বাসায় রেখেই প্রস্তুতি নেই ভূতুড়ে বাংলোতে যাওয়ার। অমাবস্যার রাত ছিলো সেদিন, গ্রাম এলাকা বিধায় সন্ধ্যে সন্ধ্যে যেন মাঝরাত নেমে আসে। আমরা সবাই একসাথে পথ ধরি। কিছুদূর পেরিয়েই সেই বাংলো ছিল, আশে পাশের মানুষরা বলাবলি করতো যে ওখানে খারাপ কিছু আছে। আর সেটা কী আছে তা দেখার জন্যই আমরা সেদিন রাতে যাই। বাংলোটা ছিল জঙ্গলের কাছাকাছি, বাংলোর গেটটায় পর্যন্ত জঞ্জাল দিয়ে ভরা ছিল। বিশাল বড় গেট, আমরা ছিলাম পাঁচজন। আমাদের দলের প্রথমে দু’জন সাহসী ছেলেকে আমরা গাইড হিসেবে রাখি যাতে কোন সমস্যা না হয়। তারা ছিল, রফিক ও শফিক দুই ভাই। তারা দু’জনই প্রথমে গেটের কাছে এগিয়ে গিয়ে জঞ্জাল সরিয়ে গেট খুলে দেয়, সাথে সাথে ক্যাঁচ ক্যাঁচ আওয়াজ যে কী! নিস্তব্ধ রাতে এই আওয়াজই আমাদের শরীরের পশম দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। আমরা পাঁচজন ভিতরে ঢুকে পড়ি, বাংলোটা ছিল খুব পুরোনো। দোতলা বাংলোর সদর দরজার সামনে গিয়ে আমরা দাঁড়াই। সদর দরজার পাশে দু’টো জানালায় কেমন আঁচর কাটা ছিল। আমিই টর্চের আলো জ্বালিয়ে তাদেরকে দেখাই সেটা, সাথে সাথে অনুভব করি কেউ আমার কানের কাছে কিছু একটা বলে গেল। আমি ঘাড় ঘুড়াতেই কাউকে দেখিনা, আবারও আমার মস্তিষ্ক আমাকে জানান দেয় আমার কনুইতে খুব জোরে কেউ খামচি দিল। কনুইয়ে তাকাতেই দেখি, কাঁচের উপর যেমন আঁচড় কাটা ঠিক তেমনটি আমার হাতে। প্রচণ্ড ভয় পাই আমি, পাশে জামালের শার্ট চেপে ধরে বলি, এখানে খারাপ কিছু আসলেই আছে। আমার হাতে দেখ! কিন্তু জামাল সঙ্গে সঙ্গে বলে, “ধুর কোথায় কী?”
এইতো এখানে বলেই নিজের কনুইয়ে চোখ রাখতেই আমি দেখি আঁচড় নেই, উধাও! আমি চুপ হয়ে যাই তৎক্ষণাৎ আর কিছু বলি না কাউকে। সবাই সদর দরজা রেখে জানালা ভেঙে ভিতরে ঢুকি, বিশাল বড় তালা খোলা আমাদের জন্য সহজ ছিল না বৈকি। আমি ভয়ে ভয়ে ছিলাম যে কখন না কী হয়ে যায়। ভিতরে ঢুকতেই আমরা একে একে পুরো বাড়ি ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকি। বলা বাহুল্য, যিনি এই বাড়ি বানিয়েছিলেন তার রুচি খুবই মার্জিত ছিলো। আমরা শুনেছিলাম, এ বাড়ির মালিকের মেয়ে বিদেশ থেকে এখানে আসে বেড়াতে। আসার পর থেকেই নাকি তার আচরণ সব অদ্ভুত দেখায়, ভিতরে বাহিরে রটনা রটতে থাকে যে, তাকে ধরেছে কিছু। মালিক পাত্তা দেয় না কিন্তু কিছুদিন পরেই বাড়ির পিছনের ঘাটে মেয়ের অর্ধ খাওয়া লাশ পাওয়া যায়, কেউ যেন খুবলে খুবলে খেয়েছে।
যাই হোক এর পর থেকে মালিক আর এখানে থাকেনি, আর এসব ঘটনার পর থেকে কেউ আর আসার সাহস ও পায়নি। অথচ মূলত মেয়েটার সাথে কী হয়েছিল কেন হয়েছিল কেউ জানার চেষ্টা করেনি। দোতলা সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে নেয় জামাল, পিছনে রফিক থাকে। পুরো অন্ধকার বাড়ি, হাতের টর্চের আলোয় কতটুকুই বা দেখা যায়। দোতলার সিঁড়িতে উঠার শেষ সিঁড়িতে পা দিতেই সদর দরজা খোলার আওয়াজ পাই সবাই। পিছন ফিরে জামাল আর রফিক। নিচে দাঁড়ানো আমি, শফিক আর কৃষ্ণ থমকে দাঁড়াই। কারণ আমাদের সামনে ছিল হৃদ! হঠাৎ করে হৃদ বলতে থাকে,
“এখনো সময় আছে চলে যা তোরা। এখনো অনেক সময় আছে।”
আমরা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি হৃদের দিকে, বিশ্বাসযোগ্য ছিল না বিষয়টি যে হৃদ এখানে আসার সাহস করবে। আমার তখনো ভয় ছিল প্রচণ্ড, আমি সবাইকে বলি, “হ্যাঁ চল।আমরা চলে যাই। আমার সাথে খারাপ কিছু ঘটে গিয়েছে ইতিমধ্যে!”
কীভাবে যেন সবাই রাজি হয়ে যায় বের হতে অথচ সবাই একেবারে কসম কেটে বসেছিল কেউ ভুলেও বের হবে না বাংলো থেকে। আমরা সদর দরজা লাগিয়ে দেই, পিছনে ঘুরতেই হৃদ কে দেখতে পাই না আমরা। এই মুহূর্তে সবার ভিতরে ভয় কাজ করে। আমরা একজন আরেকজনের হাতে হাত ধরে পথ চলতে শুরু করি। তবে সবচেয়ে অবাক করা বিষয় ছিল, আমরা আসার সময় বেশ কিছু কুকুরের দেখা পাই আর কুকুরগুলো কেন যেন আমাকে দেখেই ভয় পাচ্ছিল। আমরা কেউ এটাকে তেমন না ঘেঁটে দ্রুত চলে আসি। পরেরদিন থেকে হৃদের দেখা কোথাও পাওয়া যায় না। আমরা পাঁচজনই শিউরে উঠি, হ্রদ ছিল আমার সবচেয়ে কাছের। কারণ ও মানুষটাই ছিল তেমন। ওর নামটা যেমন সুন্দর ছিল তেমন ছিল ওর ব্যবহার। ছোট ছোট দু’টো নীল চোখের অধিকারী ছিল সে আর ছিলো দুধে আলতা গায়ের রং!
__”এইটুকুই?”
রহমান সাহেব চুপ হয়ে ছিলেন এটুক বলে, তার কল্পনায় যেন হৃদের চেহারা ভাসছিল। ছেলের কথায় সম্বিৎ ফিরে পান তিনি, ছেলের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকান তিনি। হুম, ছেলেটা তার দুধে আলতা রঙের, ছোট ছোট দু’জোড়া নীল চোখ তার। পুরো মুখে তার হৃদের জীবন্ত অস্তিত্বের চাপ যেন! ঘন নিঃশ্বাস ফেলেন রহমান সাহেব।
__”বাবাই আমার নাম যদি হৃদ হতো?”
রহমান সাহেব উত্তর দেন না, ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
__”ঘুমিয়ে পড় বাবা। অনেক রাত হয়েছে।”
নিদুল কথা বাড়ায় না আর, চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়ে। রহমান সাহেব দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়েন, চোখের পলকে তিনি যেন হৃদকে সামনে দেখতে পেলেন।
মনে মনে রহমান সাহেব বললেন, “সেদিন ভুল ছিল তোকে একা বাসায় রেখে যাওয়া। সত্যিটা তো আমরা পাঁচজন ছাড়া কেউ জানে না হৃদ, তোর অস্তিত্ব কীভাবে যেন আমি নিদুলের মাঝে পাই। এটা কি ভাগ্যক্রমে মিলে গেল নাকি তুই আছিস আমার আশে পাশেই?”

“সমাপ্ত”

“এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এখানে ক্লিক করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে