বাড়ির উঠানে আমাকে ঘিরে কিছু মানুষের জটলা। খেঁজুর পাতার পাটি বিছিয়ে আমাকে বসানো হয়েছে। মাঝবয়সী এক মহিলা ঘাড়ের কাছে তাল পাতার পাখা দিয়ে বাতাস করছে। ডাক্তার আমার চোখ দেখলেন, জিভ দেখলেন। বাম হাত ধরে রক্ত চলাচল দেখলেন। অথচ আমার কাছে মনে হচ্ছে আমি সম্পূর্ণ সুস্থ আছি। ডাক্তার আমার দিকে ঝুকে এসে প্রশ্ন করলো, এবার বলো তো তোমার নাম কী? তোমার বাবা মা কে? আর কোথায় তোমার বাড়ি?
আমি ডাক্তারের প্রশ্ন শুনে ডানে বামে তাকালাম। কোনো পরিচিত মুখ চোখে পড়ছে না। এমন কি মস্তৃষ্কেও কোনো পরিচিত মানুষের ছবির অস্তিত্ব খুঁজে পাচ্ছি না। আমি সহজ হবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছি। উৎসুক মানুষগুলোর সবার দৃষ্টি আমার দিকে। আমি বললাম, আমার শুধু বাসের কথাটুকু মনে আছে।
ডাক্তার কৌতূহল বশত একটু এগিয়ে এসে বললেন, মনে করার চেষ্টা করো। বাসে কোথায় যাচ্ছিলে? নিশ্চয় তোমার বাড়িতে। বাড়ি কোথায় তোমার?
আমি বললাম, আমার শুধু মনে আছে আমি বাসের জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছি। আমার সাথে এক যুবক বসে ছিল। কিছুক্ষন পর আমার মুখে একটি রুমাল চেপে ধরলো। তারপর আমার কিছু মনে নেই। বাসের কন্ট্রাকদার আমাকে ডেকে তুললেন ঘুম থেকে। বললো, বাস তো আর যাবে না। আপনি নামবেন না? আমি নামলাম। পকেটে হাত দিয়ে দেখি মোবাইল, মানিব্যাগ কিছু নেই। একদম খালি পকেট। এই জায়গা আমার অপরিচিত। একজনের কাছ থেকে জানলাম জায়গার নাম দেবীগঞ্জ, পঞ্জগড় জেলা। আমি নিজের বাড়ির কথা বারবার মনে করার চেষ্টা করেও পারলাম না। বাজারের কাছেই নদীর উপর ব্রীজ। নিচে নদীতে ভাটা চলছে। আমি ব্রীজে উঠার চেষ্টা করতেই পেছন থেকে দুই লোক আমাকে টেনে ধরে জানতে চাইলেন আমি লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করব নাকি? কিন্তু আমি উপরে উঠে বসতে চেয়েছিলাম। বাড়ি কোন গ্রামে জানতে চাইলে আমি কিছুই বলতে পারিনি। তারপর তারা আমাকে একটি মাছের আড়ৎ এর কাছে নিয়ে উনার কাছে সব বললেন। উনি কী মনে করে যেন আমাকে বাড়ি নিয়ে আসলেন, আপনাকে খবর দিলেন।
পাশ থেকে এক মাঝবয়সী লোক আমার দিকে আঙ্গুল তুলে বললো,
“এই ছেলে, তোমাকে বাড়ি এনে অন্যায় করেছি? বাড়ি ঘর চিনো না, নিজের নামই বলতে পারো না। আমি বাড়ি না আনলে রাস্তাঘাটে ঘুরাঘুরি করতে। মানুষ চোর ডাকাত ভেবে গণপিটুনি দিয়ে মেরে ফেলতো।”
ডাক্তার বললেন, “সরকার সাহেব আপনি শান্ত হোন। আমি দেখছি বিষয়টা। আমার বিশ্বাস ছেলেটা কয়েকদিন বিশ্রামে থাকলে আস্তে আস্তে সব মনে পড়বে তার। অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়েছে। রুমালে অজ্ঞান করার মেডিসিন ছিল। কিন্তু স্মৃতি হারালো কেন বুঝতে পারছি না। আপনি একবার তাকে নিয়ে কিছু পরীক্ষা করিয়ে আনলে ভালো হয়। আল্লাহ আপনাকে অনেক দিয়েছে সরকার সাহেব। মানুষ এক নামে চিনে বাহাদুর সরকার নামে। লোকটি বিপদে যেহেতু পড়েছে, একটু উপকার করুন।”
সরকার সাহেব বললেন, আচ্ছা ঠিক আছে। আপাতত দুয়েক দিন বিশ্রাম করুক। তারপর দেখি কী করা যায়। এই মরিয়মের মা, তোমরা খেয়াল রেখো। আমি ডাক্তার সাব’কে এগিয়ে দিয়ে আড়ৎ এ যাব। দুপুরের আগেই ফিরে আসব। ডাক্তার ও সরকার সাহেব উঠে গেলেন। মরিয়মের মা নামক মহিলাটি একটু এগিয়ে এলেন। আমার কপালে হাত দিয়ে বললেন, বাবা তোমার কিছু মনে পড়ছে না? তোমার বাবা মা, বাড়ি ঘর কিছুই না?
আমি মাথা নেড়ে জবাব দিলাম না চাচী, আমার কিছু মনে পড়ছে না। তিনি চুলে বিলি কেটে বললেন, তুমি চিন্তা করো না। যতদিন মনে না পড়বে তুমি আমাদের বাড়িতেই থাকবে।
লোকজন কমতে শুরু করলো। এখন খেয়াল করলাম, মস্ত বড় এক উঠান। একটি ফুটবল খেলার মাঠের মতো। চতুর্দিকে অনেকগুলো ঘর। আমি বললাম, আমি একটু ঘুমাবো। ছোট এক ছেলে বালিশ এনে দিলো। আমার চোখে আবারো রাজ্যের ঘুম।
চোখ মেলে তাকিয়ে দেখি একটি মেয়ে দরজায় দাঁড়ানো। মনে হচ্ছে কোনো বিজ্ঞাপনের মডেল। যেভাবে দাঁড়িয়ে আছে এভাবে শাড়ির বিজ্ঞাপন করে। যদিও মেয়েটির গায়ে শাড়ি নেই। মেয়েটিকে আমি চিনি না। আমি কি তাহলে অন্য জগতে আছি? নতুন এক জগৎ। অজ্ঞান পার্টি বাসে রুমাল চেপে ধরার আগে এক জগতে ছিলাম। বাহাদুর সরকার এর বাড়িতে আরেকটি জগৎ। এই জগতে অপরিচিত একটি মেয়ে। কিন্তু বাহাদুর সরকার এর বাড়িতে থাকতে আগের জগতের কথা ভুলে ছিলাম। এখনো সরকার বাড়ির জগতের কথা ভুলে যাওয়ার কথা। কিন্তু আমার সব মনে আছে। দেবীগঞ্জ বাজারের মাছের আড়ৎ থেকে আমাকে নিয়ে এসেছিল সরকার সাহেব।মেয়েটি পিছনে ফিরে ডেকে বললো, মা, লোকটির ঘুম ভেঙ্গেছে। বলে একটু এগিয়ে এলো। একটি চেয়ার টেনে বসে জানতে চাইলো, সত্যিই কি আপনার কিছু মনে নেই? মানুষ নিজের নাম কিভাবে ভুলে যায়? আমার কিন্তু হাসি পাচ্ছে। আপনি হাসতে পারেন? নাকি হাসতেও ভুলে গেছেন?
মেয়েটির কথায় আমার হাসতে ইচ্ছে হলেও আমি হাসিনি। চুপ করেই রইলাম। মেয়েটি আবার বললো, আচ্ছা আপনি কী পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন? আমি কিন্তু কলেজে পড়ি।
আমি বললাম, আমার কিছু মনে নেই। মেয়েটি আবারো হাসলো। বললো, কী পর্যন্ত পড়েছেন সেটা মনে নেই। পড়াও ভুলে গেছেন? আচ্ছা নেন, দেখেন তো পত্রিকা পড়তে পারেন নাকি?
মেয়েটি টেবিল থেকে পত্রিকা এগিয়ে দিলো। আমি হাতে নিয়ে পত্রিকায় চোখ বুলিয়ে দেখলাম আমি পড়তে পারছি। বড় করে একটি খবর লেখা, “শাশুড়ী ও ননদের হাতে গৃহবধূ খুন।”
নিচে আরেকটু ছোট করে পুরো ঘটনাটি লিখা। ঘটনাটি কিশোরগঞ্জের। আমার বিড়বিড় করে পড়া দেখে মেয়েটি বললো, যাক অন্তত পড়ালেখা মনে আছে। আপনি অপেক্ষা করুন, আমি চা নিয়ে আসি। মা চা বানাচ্ছে। লেবু আর আদার চা। জানেন তো, লেবুর চা অনেক ভালো শরীরের জন্য।
মেয়েটি চা আনতে বেরিয়ে গেল। বাইরে সন্ধা। তারমানে আমি অনেক ঘুমিয়েছি। দরজা দিয়ে রান্না ঘরে চাচীকে দেখা যাচ্ছে। আমি বাইরে ঘুমিয়েছিলাম। ঘরে আসলাম কিভাবে বুঝতে পারছি না।
আমি পুরোপুরি সুস্থ হলেও অতীত কিছুই মনে পড়ছে না। বাহাদুর সরকার এর বাড়িতেই আমার ঠিকানা হলো। আমার নতুন নাম রাখা হলো ইমন। আগের কিছু মনে নেই তাই ইমন। আমি আড়ৎ এ হিসাব রক্ষকের কাজ করি। মাছের পাইকাররা দশটা এগারোটার ভিতর মাছ নিয়ে যায়। বাড়িতে আসতে আমার বারোটা বাজে। মস্ত বড় উঠানের চারিদিকে যে অনেকগুলো ঘর সবগুলো বাহাদুর সরকারের মেয়েদের জন্য। উনার ছয়টি মেয়ে, পাঁচটির বিয়ে হয়ে গেছে। তবুও তিনি ঘর করে রেখেছেন উনার মেয়েরা স্বামী সন্তান নিয়ে আসলে যার যার ঘরেই থাকবে। আমি যে ঘরে থাকি এমন তিনটি ঘর অতিথীদের জন্য। কলেজে যে মেয়েটা পড়ে তার নাম তৃষা। বাহাদুর সরকারের সবচেয়ে ছোট মেয়ে। যত দুষ্টুমি আছে সব এই মেয়েটির মধ্যে বিদ্যমান। প্রতিদিন বিকেলে আমার সাথে গল্প করতে আসে। দু’দিন প্রশ্ন করেছে কখনো প্রেম করেছিলাম কি না। নাকি প্রেম করে সবকিছু ভোলার মতো প্রেমিকাকেও ভুলে গেছি। মেয়েটির মুখে কোনো কিছু আটকায় না। ডাক্তার বলেছে আমি এমনিতে সম্পূর্ণ সুস্থ, শুধু স্মৃতিটুকু মনে নেই। আমার একটু সমস্যা অবশ্য হয়। তৃষার বড় বোনেরা স্বামী নিয়ে বেড়াতে আসলে যখন বোনের ছেলে মেয়েরা তাদের বাবাকে আব্বু বলে ডাকে তখন আমার মাথায় প্রচন্ড ব্যথা হয়। ভোতা এক ধরনের ব্যথা। মনে হয় কেউ যেন মাথার ভিতর হাতুরি পিটায়।
আমি কথা খুব কম বলি। তৃষার তুলনায় আমি কথাই বলি না। ইদানিং মেয়েটার চাল চলনে পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি। এই বয়সের মেয়েদের চোখে রঙ্গিন স্বপ্ন ঘুরে বেড়ায়। তারা অনেক নায়ক, শিল্পী, অভিনেতাকে নিয়েও স্বপ্ন সাজাতে পছন্দ করে। আবেগের বয়স বলা চলে। গতকাল এসে প্রশ্ন করলো, আমার সাথে কথা বলতে ভালো লাগে না আপনার? বাবা না আপনাকে ফোন কিনে দিয়েছে? আমি মায়ের মোবাইল রাতে নিয়ে রাখলে ফোনে কথা বলবেন? তাহলে হয়তো মনে পড়বে কখনো রাত জেগে কারো সাথে ফোনে কথা বলেছেন নাকি। প্রেমিকা থাকলেও আপনার মনে পড়বে। অতীত মনে পড়তে পারে আপনার।
তার কথাটি আমার ভালো লেগেছে। কিন্তু যে বাড়িতে আমি আশ্রয় পেয়েছি সে বাড়ির মেয়ের সাথে রাত জেগে কথা বলা ভালো দেখায় না। যদি সরকার সাহেব কখনো জানতে পারে খুব কষ্ট পাবেন।
গ্রামের মানুষ নয়টা দশটার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ে। আমারই কেবল দেরি হয়। তৃষা কয়েকটা বই দিয়েছিল অবসরে পড়ার জন্য। বই পড়তে পড়তে বিছানায় বই রেখেই ঘুমিয়ে পড়ি। মোবাইলটা বেজে উঠলো। বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করছে না। এত রাতে নিশ্চয় রং নাম্বার থেকে ফোন এসেছে। কিন্তু দ্বিতীয়বার ফোন আসায় না উঠে পারলাম না। এই নাম্বার আমার অপরিচিত। রিসিভ করতেই একটি মেয়ে কন্ঠ ফিসফিস করছে।
“তুমি কোথায় ছিলে এতদিন? জানো আমি তোমাকে কত খুঁজেছি। একটাদিনও ফোন দাওনি। নতুন কাউকে পেয়ে আমাকে ভুলে গেছো, তাইনা? আমাকে আর ভালোবাসো না তুমি।”
যা ভেবেছি ঠিক তাই। এত রাতে রং নাম্বার ছাড়া আর কে ফোন দিবে? আমি বললাম, আপনি ভুল করে রং নাম্বারে ফোন দিয়েছেন। রাখি, আল্লাহ হাফেজ।
লাইন কাটার সাথে সাথে আবারো ফোন দিলো। রিসিভ করতেই ফিসফিস করে বলছে, আমি তৃষা। ফোন কাটবেন না। আপনি আগে প্রেম করতেন কিনা যাচাই করছিলাম। আপনার কিছু মনে পড়ছে?
আমি জবাব দিলাম, না মনে পড়ছে না।
মধ্যরাতে ফোন দিয়ে যাচাই করে আমার প্রেমিকা ছিল কিনা। কি অদ্ভুত চিন্তাধারণা। মনে মনে হাসি পাচ্ছে খুব।
তৃষার নিঃশ্বাসের শব্দ পাচ্ছি। কেমন ঘোর লাগা। মনে হচ্ছে আমার পাশেই শোয়ে নিঃশ্বাস ফেলছে। তৃষা বললো, আজ শুরু করলাম। এখন থেকে প্রতিদিন রাতে কথা বলবেন। আপনার সামনে গেলে আমি কথা বলতে পারি না। যা গুছিয়ে রাখি, আপনার সামনে গেলে ভুলে যাই। তাই ফোনে বলবো কথা। এখন রাখি, আর শুনুন কাউকে বলবেন না কিন্তু। রাখি রাখি, ঘুমান আপনি।
ফোন রাখার পর ভাবছি তৃষা কি দুর্বলতা প্রকাশ করছে নাকি আমার স্মৃতির কোনো কিছু মনে করানোর চেষ্টা করছে। আমার প্রতি তার কোনো প্রেম আছে?
উফপ, কী সব ভাবছি। আমার এসব ভাবনা মোটেই উচিত নয়।
দেখতে দেখতে এই বাড়িতে আমার তিন বছর পেরিয়ে গেল।
যে ঘরটাতে আমি থাকি এই ঘরটার পেছনের দিকে অন্য বাড়ির ঘর। ঐ ঘরে চারদিন হলো একটি ফুটফুটে বাচ্চা জন্ম নিয়েছে। তার জগৎ শুরু হয়েছে জন্মলগ্ন থেকে। তাহলে আমার জগতও জন্মলগ্ন থেকেই শুরু হয়েছে। বাস থেকে শুরু হয়নি।
বাচ্চার কান্নার শব্দ আমাকে চারদিন ঘুমাতে দেয়নি। আড়ৎ এ গিয়ে ঝিমাতে হচ্ছে। বাচ্চার কান্নার কোনো নির্ধারিত সময় নেই। কিন্তু এই কান্নার শব্দ আমার মাথার ভিতরটা নাড়িয়ে দিচ্ছে। কিছু অস্পষ্ট ছবি চোখের সামনে এসেও চলে যায় বারবার। আমি এই কান্নার শব্দ আর নিতে পারছি না। মাঝরাতে কান্না বন্ধ হলে একটু ঘুমানোর চেষ্টা করি তার উপর তৃষা ফোন দেয়। জানতে চায় আমার প্রিয় ফুল কী, সিনেমার নায়ক নায়িকা কোনটা পছন্দ। ছবির মতো ভালোবাসতে ইচ্ছে করে নাকি কাউকে। যতসব আবেগী কথা বার্তা। তাকে না করতে পারছি না যেন আমাকে ফোন না দেয়। তৃষার এই দুর্বলতা তাকে কষ্ট দিবে। আমার মাথায় যে ভোতা যন্ত্রনা হয়ে কিছু ছবি ভাসে। আমার মন বলছে আমার অতীত খুব শীঘ্রই মনে পড়বে। আমি চাই না তৃষা কোনো মায়ায় জড়িয়ে পড়ুক।
সরকার সাহেব আর চাচির সামনে মাথা নিচু করে বসে আছি। বড্ড অপরাধী লাগছে নিজেকে। আমি একবার ধারণা করেছিলাম এমনটা হবে। তবুও তৃষার আবেগের মূল্য দিতে গিয়ে তার সাথে ফোনে কথা বলতাম। কিন্তু কখনো পশ্রয় দেইনি আমি। কিন্তু ফোনে কথা বলার বিষয়টি চাচি জেনে গেছে। চাচি সরকার সাহেবকে বলার পরই এখন আমাকে মাথা নিচু করে বসে থাকতে হচ্ছে। সরকার সাহেব একটু আগে বললেন, বাবা তিন বছর হয়ে গেছে তুমি আমাদের বাড়িতে আছো। আমরা তোমার বাবা মায়ের খোঁজ জানলে তাদের সাথে কথা বলতাম। এখন তুমি যদি চাও আমরা নিজেরাই একটা সিদ্ধান্তে আসতে পারি। এক বাড়ির মধ্যে দুই ঘর থেকে ফোনে কথা বলা ভালো দেখায় না।আমি প্রথমে কী বলব ভেবে পাচ্ছিলাম না। শেষে মাথা নিচু করে বললাম, আমি জানি না কথাগুলো কিভাবে নিবেন। আমার আর তৃষার মধ্যে কোনো সম্পর্ক গড়ে উঠেনি। তৃষা বলেছিল ফোনে কথা বললে আমার অতীত মনে পড়তে পারে। সেজন্যই কথা বলা, এর বেশি কিছু না। আমার মনে হচ্ছে খুব শীঘ্রই আমার অতীত মনে পড়বে। তৃষা খুব ভালো মেয়ে। আমি চাই না সে কষ্ট পায়। আর অপছন্দ করার মতো মেয়ে সে নয়। আমাকে আর কিছুদিন সময় দিন।
কিছুক্ষন চুপ থেকে সরকার সাহেব বললেন, আচ্ছা ঠিক আছে। তুমি গিয়ে বিশ্রাম করো।
টানা চারদিন আমি তৃষার ফোন রিসিভ করিনি। তৃষাও আমার সামনে আসে না। শুধু রাত হলেই ফোন দেয়। চাচী নিশ্চয় তৃষাকে কিছু বলেছে। আমি চাই না সে মায়ায় জড়িয়ে পড়ুক। দরকার হলে সবার কাছে ক্ষমা চেয়ে আমি অন্য কোথাও চলে যাব। তবুও আর ফোনে কথা বলা ঠিক হবে না।
বেলা তখন দশটার মতো বাজে। পত্রিকার চার নাম্বার পৃষ্ঠা উল্টাতেই চোখে পড়লো, “নরসিংদী সদরের শাপলা চত্ত্বর বাজারে আগুন”
একটি ছবি দেয়া আছে। ছবিতে কয়েকটা দোকানের উপরে ধোঁয়ার ছবি। আমার মাথা চক্কর দিয়ে উঠল। মাথার ভিতরের অনেক দূর থেকে কিছু স্মৃতি দৌড়ে মস্তৃষ্কে আসতে লাগলো। চোখ বুজে আসছিল। মনে হচ্ছে কোনো স্বপ্ন আমাকে তাড়া করছে। কত পরিচিত স্বপ্নগুলো আমার বারবার দেখা হবার পরও মনে হচ্ছে আরো দেখার বাকি। সরকার সাহেব চায়ে চুমুক দিয়ে দেখে আমি টেবিলে মাথা ফেলে দিয়েছি। আড়ৎ এর কর্মচারী সহ সরকার সাহেব আমাকে টেনে সোজা করে বসালেন। জানতে চাইলেন কী হয়েছে আমার? আমি বললাম, আমার খারাপ লাগছে। তিনি ভ্যান ডেকে নিজে আমাকে নিয়ে ভ্যানে উঠলেন। ভ্যানের দুইদিকে রিক্সার সিটের মতো বসার জায়গা। আমার চোখে ভাসছে একটা বাচ্চা মেয়ে আমার কোলে। আমি তাকে চুমো খাচ্ছি। আবার হঠাৎ চোখের পর্দা থেকে সে ছবি সরে যাচ্ছে। আমি কি অন্য জগতে চলে যাচ্ছি? নাকি আমার অতীত আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে?
বিছানায় গা এলিয়ে দেয়ার সাথে সাথে আমার প্রচন্ড শীত করছে। চাচী কাঁথা দিয়ে দিলেন আমার শরীরে। আমার চোখে ভাসছে আমার মা আমার কপালে জলপট্টি দিচ্ছেন। আমার ঘুম ঘুম চোখ। চোখ মেলে তাকাতে পারছি না। একটি মেয়ের কোলে বাচ্চা। যে বাচ্চাকে একটু আগে আমি চুমু খেয়েছি কোলে নিয়ে। কতসব চোখে ভাসছে।
একটি দোকানে আমি বসা। দোকানের সাইনবোর্ডের নিচে ঠিকানা লিখা, শাপলা চত্বর বাজার, নরসিংদী।
আমি ঘুম থেকে লাফিয়ে উঠলাম। কতক্ষন ঘুমে ছিলাম জানি না। তবে আমার সব মনে পড়ছে। চাচী পাশেই পাখা দিয়ে বাতাস করছে। আমার গায়ে এখন কাঁথা নেই। সারা শরীর ভিজে একাকার। সরকার সাহেবকে চাচী ডাকছেন। তিনি ঘরে এসে আমার পাশে চেয়ার টেনে বসলেন। আমি উঠে বসলাম। গায়ে একটুও জ্বর নেই। আমি সরকার সাহেবের হাত ধরলাম।
“চাচা আমি বাড়ি যাব। আমার সব মনে পড়েছে। আমার বাড়ি নরসিংদী সদরে। শাপলা চত্ত্বর বাজারে আমার একটি দোকান আছে। ঘটনার দিন আমি সিরাজগঞ্জে আসার জন্য বাসে উঠেছিলাম। সেখানে আমার এক বন্ধুর বাড়ি। অজ্ঞান হবার পর বাস শেষ সীমানায় এই দেবীগঞ্জে চলে এসেছে। চাচা আপনারা আমার জন্য অনেক করেছেন। আমাকে বাড়ি যেতে হবে চাচা। আমার স্ত্রী আছে, বাচ্চা আছে। আমার মা হয়তো পথ চেয়ে বসে আছে।”
তৃষা দরজা থেকে চলে গেল। চাচা আমার পিঠে হাত রেখে বললেন, “আল্লাহর কাছে লাখো কোটি শুকরিয়া, তুমি তোমার অতীত মনে করতে পেরেছো। তুমি অবশ্যই যাবে, কোনো চিন্তা করোনা আমি সব ব্যবস্থা করছি।
এই বাড়িতে আসার সময় আমার হাতে কোনো ব্যাগ ছিল না। আজ যাবার সময় একটি ব্যাগ যাচ্ছে আমার সাথে। কাপড়, গাছের ফল আরো কত কী। চাচা চাচীকে বললাম, অগ্রীম দাওয়াত। আমি গিয়েই ফোন করবো তারা যেন আমার বাড়ি আসে। নয়তো আমি নিজেই নেবার জন্য চলে আসবো। চাচা চাচীর অশ্রুসিক্ত চোখ আমাকেও কাঁদিয়েছে। তৃষার কাছ থেকে বিদায় নিতে ঘরে ঢুকে দেখি আমাকে দেখে মুখ ঘুরিয়ে ওড়নায় চোখের জল মুছে।
-তৃষা আমাকে ভুল বুঝো না। আমি তোমাদের সবার কাছে কৃতজ্ঞ। আমি তোমাদের কাউকে কখনো ভুলবো না। তুমি কিন্তু অবশ্যই যাবে আমাদের বাড়ি।
তৃষার গলার স্বর ভেজা। মোলায়েম কন্ঠে বললো, ভাবিকে নিয়ে আগে আসবেন তারপর যাবো। আমি দরজার চৌকাঠ পেরুতেই কারো ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ পেলাম। সবাইকে কাঁদিয়ে নিজের চোখের জল মুছতে মুছতে বেরিয়ে পড়লাম আপন ঠিকানায়।
আমাকে দেখে মায়ের কান্না কিছুতেই থামছে না। তিনটি বছর আমি কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলাম। এলাকার মানুষ আমাকে দেখতে জড়ো হলো। সবার কাছে সবকিছু খুলে বললাম। ফুটফুটে মেয়েটি আমার কোলে বসা। চার বছর বয়স হয়েছে। শিমুকে দেখছি না কোথাও। মনে হয় অভিমান করে পাশের রুমে লুকিয়ে কান্না করছে। মেয়েটিকে কোলে নিয়ে পাশের রুমে গিয়ে দেখি সেখানেও শিমু নেই। মেয়েটাকে আদর করে জানতে চাইলাম, মামনি তোমার আম্মু কোথায়?
পেছন থেকে আমার মা বললো, আগে কিছু খেয়ে নে তারপর সব বলছি।
আমার ভিতরটা মুচড়ে উঠল। জানকে চাইলাম, কী হয়েছে মা? বলো আমাকে।
মা বললো, “শিমু যেতে চায়নি। শিমু বলেছে তুই যতদিন না আসবি সে এখানেই থাকবে। কিন্তুর শিমুর বাবা মা মানতে রাজি না। তারা এভাবে মেয়েকে ফেলে রাখতে পারবে না। তোর বাবা কত করে বলেছে, আমরা তো আছি। শিমুকে নিজের মেয়ের মতোই দেখে রাখব। কিন্তু তোর শ্বশুর শাশুড়ী কিছুতেই রাখবেনা। মাস ছয়েক আগে শিমুকে নিয়ে গেছে অন্য জায়গায় বিয়ে দিবে বলে। শিমু এর মধ্যে দুই তিনবার চলে এসেছে। আমার কাছে কান্না করে বলেছে তার জীবন থাকতে সে অন্য কোথাও বিয়ে করবে না। তার স্বামী আছে, বাচ্চা আছে। সে কেন আবার বিয়ে করবে? তাকে দুয়েক জায়গা থেকে পাত্রপক্ষ দেখে গেলেও বিয়ে হয়নি। তুই চিন্তা করিস না। তুই ফিরে এসেছিস শুনলে দৌড়ে চলে আসবে।”
আমি দাঁড়ানো থেকে বসে পড়লাম। তিনটা বছর পেরিয়ে গেছে। শিমুকে ফোন দেব কিনা ভাবছি নাকি নিজেই গিয়ে নিয়ে আসব। শ্বশুর শাশুড়ির মন মানসিকতা তেমন ভালো মনে হচ্ছে না। ফোন দেয়াটাই ভালো হবে। আমার জন্য না হোক, আমাদের মেয়েটার জন্য শিমুকে ফিরে আসতেই হবে। আমি জানি শিমু না এসে পারবে না।
ফোনে ঐ প্রান্তে কত পরিচিত একটি কন্ঠ। কত যুগ যেন কথা হয় না।
-কী ব্যাপার? কে আপনি? কথা বলছেন না কেন?
-শিমু আমি ফিরে এসেছি।
কিছুক্ষন নীরবতা। তারপর ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ। আমি তাকে কাঁদাতে চাইনি।
-আমি জানতাম তুমি ফিরে আসবে। কত মানুষ কত অলক্ষনে কথা বলেছে। আমি বিশ্বাস করিনি। কোথায় ছিলে এতদিন তুমি? কেন করলে এমনটা?
-মোবাইলেই সব বলতে হবে? বাড়ি আসবে না?
-অবশ্যই আসবো। আমি একা চলে এলে খারাপ দেখায়। তুমি এক কাজ করো। বাবাকে আর দুইজন মুরব্বী নিয়ে আমাকে নিতে এসো। একটা পারিবারিক, সামাজিক ব্যাপার আছে। আমি বাবা মা’কে খুশির খবরটা দিয়ে আসি। কাল সকালেই চলে আসো, কেমন?
-আচ্ছা ঠিক আছে। আর তোমার মেয়ে অনেক অভিমান করেছে। বলছে, আব্বু তুমি কিন্তু আম্মুকে বাড়ি আসলে অনেক বকবে।
ঐ প্রান্তে আবারো কান্নার শব্দ। আমি ফোন রেখে দিলাম। শিমু কিছুক্ষন কাঁদবে। মেয়েরা অঝরে কান্না করার অদ্ভুত ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়। সেই হিসেবে ছেলেরা কাঁদেই না। তবে আমার চোখ দুটো অজানা কারণে ভিজে যাচ্ছে। আবেগে, নয়তো কোনো কিছুর শূণ্যতায়, নয়তো স্মৃতির টানে।
সমাপ্ত…
গল্পঃ স্মৃতির জগত