স্বার্থপর মা

0
880

তিন তিনবার মিসক্যারেজ হওয়ার পর থেকে আমি কেমন যেন মানসিক ভাবে পুরোপুরি ভেঙে পরলাম। নিজেদের প্রত্যাশা, পরিবারের চাপ, সমাজের চাপ সব মিলিয়ে আমি রীতিমত দিশেহারা। একটা মা ডাক শোনার জন্য আমি যেন তখন আমার পুরো পৃথিবী দিয়ে দিতে পারি। দেশের বাইরে থাকাতে পৃথিবী সেরা গাইনিকোলজিস্টের সেবা পাচ্ছিলাম। কিন্তু পেটে বাচ্চাগুলোকে ধরে না রাখতে পারার কোন সুস্পষ্ট কারণ ও খুঁজে না পাওয়াতে আমি তখন আরো বেশী পাগলপ্রায়। সব বন্ধুরা তাদের বাচ্চাদের সাথে ছবি দেয় ফেসবুকে, শুধু আমার দেয়ার মতো কোন ছবি নেই। খবরের কাগজ, টিভিতে দেখা দেশের রাস্তার ধারের ভিখারী মাকে ও আমার মনে হয় পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ। দিনে দিনে নিজেকে গুটিয়ে নিলাম সবার কাছ থেকে। দেশে সহসা ফোন করিনা। কাঁহাতক হায় আফসোস আর কেন হয়না, কি সমস্যা এসব কথা শুনতে ভালো লাগে?

তারপর আমারো দিন এলো। সৃষ্টিকর্তা আরো একবার মুখ তুলে চাইলেন। এ বেলা গাইনি বিশেষজ্ঞ আমাকে খুব ক্লোজ মনিটরিংয়ে রাখলো। প্রায় প্রতি দু সপ্তাহ পরপর আলট্রাসাউন্ড করে বাচ্চার ওজন, পেটের পানি, অন্য কোন অস্বাভাবিকতা ঘটে কি না সব নজর রাখা হচ্ছিলো। বারো সপ্তাহে করা রিপোর্ট দেখে গাইনি ডাক্তারের কপাল কুঁচকে যায়। বাচ্চার কিছু অস্বাভাবিকতা নজরে পরে তাদের। তবু সে অপেক্ষা করে আরো একটি আলট্রাসাউন্ডের। রিপোর্ট নিয়ে কথা বলার সময় রীতিমত বোর্ড মিটিং বসে গেল নানা বিভাগের ডাক্তার, কাউন্সেলর, মিডওয়াইফদের। আমার বাচ্চার মাথায় নাকি দুটো অস্বাভাবিক টিউমারের মতো কিছু দেখা যাচ্ছে। এই বাচ্চা কোনভাবেই স্বাভাবিক জীবন পাবেনা বলে শিশু নিউরোলজিস্ট, নিউরোসার্জনরা জানিয়ে দেন।

শুরু হলো আমাকে কাউন্সেলিং যেন বাচ্চাটাকে নষ্ট করে ফেলি। পৃথিবীর বুকে বাচ্চার কি ধরনের সমস্যা হতে পারে, আমি কিভাবে সেসব সমস্যা মোকাবিলা করবো, আমার কি কি ধরনের মানসিক অসুবিধা হতে পারে সব বুঝিয়ে আমাকে কাগজে কলমে দেখিয়ে দেয়া হলো এই বাচ্চা আমাদের পরিবার তথা সমাজের জন্য একটা বোঝা ছাড়া আর কিছুই হবেনা। আমার স্বামী টুটুলকে ও তারা বুঝিয়ে রাজী করে ফেলে। কিন্তু দিনদিন করে সময় গোনা আমি একটা বাচ্চার জন্য কতোটা মরিয়া হয়ে আছি তা যেন তারা সবাই ভুলে বসে আছে। আমি জোর গলায় বললাম, ‘আমার বাচ্চা কিভাবে পালবো সেটা আমি বুঝবো। আমি প্রেগন্যান্সী চালিয়ে নিতে চাই।’

প্রতিবার হাসপাতালের ডাক্তার দেখাতে যাওয়ার সময় আমাকে দুইভাবে কাউন্সেলিং করা হতো। আত্মীয় স্বজন, বন্ধুবান্ধব সবাই দুইভাগে ভাগ হয়ে যায়। আসলে সবাই একটা দোটানায় পরে গেছে কোন পক্ষ নিলে যে ভালো হয় এই ভাবনায়। কিন্তু আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল থাকি। আমার দৃঢ়তা দেখে টুটুলও মত পাল্টায়। আমরা সিদ্ধান্ত নেই প্রথম বছরটা আমি কাজ থেকে ছুটি নেব। যেন যে কোন সমস্যায় বাচ্চাকে সময় দেয়া যায়। বাকীটা সময় আর সৃষ্টিকর্তার হাতে ছেড়ে দিয়ে আমরা দিন গুনতে লাগলাম। অদ্ভুত হলেও সত্য আমার পেটের বাবুটার এতো সমস্যা থাকলেও আমার প্রেগন্যান্সীতে আর কোন সমস্যা ছিলনা। যেন সৃষ্টিকর্তা একসাথে এতোগুলো পরীক্ষায় আমাদের ফেলতে চাননি।

শিশুবিভাগ, প্রসূতি বিভাগের ডাক্তারদের সমন্বয়ে গড়া মেডিকেল বোর্ডের সিদ্ধান্ত মোতাবেক সময়ের দুসপ্তাহ আগে আমার সিজারিয়ান করা হয়। আমার ফুটফুটে বাচ্চাকে আমার গালে একবার ছুঁইয়ে নিয়ে যাওয়া হয় অপারেশন থিয়েটারে। তারপর শুধুই অপেক্ষা। ব্রেনের টিউমার সরানো শেষে এতো এতোগুলো নল লাগিয়ে মেয়েটাকে দেয়া হয় আইসিইউ তে। প্রায় দুমাস পর বাচ্চার সব যত্ন নেয়ার পদ্ধতি শিখিয়ে দিয়ে তাকে বাসায় ছাড়া হয়। খুব আশা ছিল সৃষ্টিকর্তাতো চাইলেই কত কি পরিবর্তন করে দিতে পারেন। আমার বাচ্চা আমায় মা বলে ডাকবে, পৃথিবীতে আমার পরবর্তী প্রজন্মের একটা অস্তিত্ব থাকবে এই আশাতেই তো এতোদূর আসা। কিন্তু সেই প্রজন্মের ভার বয়ে নিয়ে যাওয়া যে কতটা কষ্টের হবে এটা ডাক্তাররা বারবার বোঝালেও তখন বুঝতে চাইনি যা বুঝতে পেরেছি গত চার বছরে আমার শারিরীক মানসিক সর্বতোভাবে প্রতিবন্ধী মেয়েকে পালতে গিয়ে।

মা ডাক শোনার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। বড় মেয়ে হওয়ার বছর তিনেক পরে আমি আবার গর্ভধারণ করি। এবেলা একজন সুস্থ শিশু আমার কোল জুড়ে আসে। টুটুলই মূলত ছোট বাচ্চাটার দেখাশোনা করে। আমার সময়ের একটা সিংহভাগই যে চলে যায় আমার বড়মেয়ে তিতলীর পেছনে।
লোকে যখন হায় আফসোস করে তিতলীকে নিয়ে আমি তখন আমার ছেলে তাতানের দিকে তাকিয়ে খানিক সান্ত্বনা খুঁজে নিই।

পেটে লাগানো নল দিয়ে খাওয়ানো, নিয়মিত ন্যাপী পরিস্কার করা, বারবার পজিশন পাল্টে দেয়া যেন পিঠে ঘা না হয়ে যায় করতে করতে আজকাল যখন হাঁপিয়ে উঠি তখন মনে হয় আমার নেয়া তিতলীর পৃথিবীতে আসার সিদ্ধান্তটুকু কি আসলে ভুল ছিল? আমি কি বড় বেশী স্বার্থপর হয়ে গেছিলাম বলেই সৃষ্টিকর্তা আমার মেয়েটার জীবনটা এতো অভিশপ্ত করে দিলেন। তাতান যখন সারা ঘরময় দৌড়ে বেড়ায় তখন তিতলীর ও কি ইচ্ছে করেনা হেঁটে বেড়াতে? নাকি ওর মনের সেই ইচ্ছেটুকু চিন্তা করার শক্তি ও নেই, তা আমি জানিনা। শুধু প্রাণ নিয়ে বেঁচে থাকাটাই যে পৃথিবীতে সব কিছু নয়, তা আমার মতো ভুক্তভোগী মা ছাড়া আর কে জানে? মেয়েটার অসার শরীরের দিকে তাকিয়ে নিজেকে বড় স্বার্থপর মনে হয় আজকাল।

ডা. জান্নাতুল ফেরদৌস

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে