স্বর্ণকেশী মায়াবিনী পর্ব-২২+২৩+২৪

0
21

#স্বর্ণকেশী_মায়াবিনী
#লেখনীতে-বর্ণ(Borno)
#পর্ব-২২

মোবাইলের তীব্র রিংটোনে আনমনে ভাবনা চিন্তার রেশ কাটে মায়ার।মেহরাব কল রিসিভ করছে না।অবশেষে মায়া কলটি রিসিভ করে।আননোন নাম্বার প্রথমে চিনতে না পারলেও পরক্ষণে বুঝতে পারে এটা টয়া।বিয়ের পর পরই ওরা স্বামী স্ত্রী আবার বিদেশে পাড়ি জমায়।প্রথমে টয়া মায়ার ওপর একটু অভিমান দেখায় বিয়েতে না থাকার জন্য।পরে মায়া ওকে বুঝালে শান্ত হয়। সেটা না হয় ঠিক আছে কিন্তু মেহরাবের কি হয়েছে ওটা জিজ্ঞেস করে।আজ অনেকদিন হলো ওকে কল দিলে ধরে না আবার ধরলেও একটু কথা বলে রেখে দেয়।এ সব মায়ার কাছে টয়া জানতে চায়।

মায়া ওর কথা শুনে আস্তে আস্তে সব কিছু বলতে শুরু করে।আফিয়ার মৃত্যুর সংবাদ ওর জানা নেই মায়ার মুখ থেকে এ কথা শুনে খুব দুঃখ প্রকাশ করেছে টয়া।আর মেহরাবের কথা শুনে প্রথমে খারাপ লাগলেও মায়ার সাথে মেহরাব যা করছে এ সব শুনে ওর ওপর রেগে যায়।কেনো এ সব করছে?শোক পালন করে তাই বলে এ ভাবে?
মায়া সব কিছু বলার পর চুপ করে থাকে।টয়া বুঝতে পারে মায়ার মনের অবস্থা।মেহরাব কে কাছে পেলে দু গালে দুটো ঠাস করে লাগিয়ে দিতো।মায়াকে শান্তনা দেয় টয়া।কিন্তু মায়া আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না।ফুপিয়ে কান্না করে দেয়।টয়া অনেক বলে কয়ে ওকে শান্ত করে আর বলে

“সব ঠিক হয়ে যাবে মায়া চিন্তা করো না।তুমি জানো না ও তোমাকে কতোটা ভালোবাসে”

মায়া ওর জীবনের বড়ো সুখবরটা ও দিয়ে দেয় টয়া কে।কিন্তু ও যে এখনই জানাতে চায় না মেহরাব সেটাও বলে।টয়া শুনে অনেক খুশি হয়।আর বলে ওর সাধ্যমতো চেষ্টা করবে মেহরাব কে বুঝানোর।মায়া যেনো একদমই মন খারাপ না করে।এ সময় হাসিখুশি থাকতে হবে।মায়া ওর কথায় একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।
আরো কিছুক্ষণ কথা বলে মায়া কল কেটে দেয়।মোবাইলটা আগের জায়গায় রেখে মায়া আলমারি লক করে রুম থেকে বের হয়ে যায়।

অনেকক্ষণ ধরে ফিরোজ ড্রইংরুমে অপেক্ষা করছে মেহরাবের জন্য।মায়া কিছুক্ষণ ওর সাথে কথা বলে রান্না ঘরের দিকে চলে যায়।ফিরোজ মায়াকে দেখে বুঝতে পারে ওর মন ভালো নেই।আর মেহরাবের বর্তমান মনের অবস্থার কথা ওর সবটাই জানা।তাই মায়ার মনের অবস্থাটা কেমন হতে পারে সেটা ওকে দেখলেই যে কেউ বুঝতে পারবে।
ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে মেহরাব ড্রইংরুমে আসে।ফিরোজ ওকে দেখে বড়ো করে একটা সালাম দেয়।মেহরাব আস্তে করে সালামের জবাব দেয়।হাতে করে আনা ল্যাপটপ টা অন করে বসে।ফিরোজ কিছু বলতে চায় মেহরাব বুঝতে পারে

-যা বলার বলে ফেলো

-বলছিলাম কি বড়ো ভাই রুমের আয়নাটা কি আছে নাকি ভেঙ্গে গেছে?

ওর এমন কথা শুনে মেহরাব ওর দিকে এক নজর চেয়ে আবার ল্যাপটপে মন দেয়।

-যা বলার সরাসরি বলো আর আয়না ঠিক আছে।

-তা হলে তো চেহারা দেখার কথা।বড়োভাই আগের সেই আপনি আর এখনকার আপনিতে অনেক তফাৎ

-এ সব বলার জন্য আসছো?

ফিরোজের এবার মনে মনে রাগ লাগে কিন্তু প্রকাশ করতে পারছে না।

-নাহ একদমই না আর আজকে তো আপনার সাথে নয় আপুর সাথে দেখা করতে এসেছি।

মেহরাব আর কিছু বলে না।মায়াকে প্রথম প্রথম ফিরোজ ভাবি ডাকলেও এখন আর ডাকে না।অনেকদিন আগ থেকেই আপু ডাকা শুরু করেছে।মায়া ও অমত করেনি বরং ওর ও ভালো লাগে এই আপু ডাকটি।একমাএ বোনের মুখ থেকে বুবু ডাকটা শুনতো।এখানে এসে শুধু ভাবি ডাকটাই শুনেছে।যবে থেকে ফিরোজ মায়াকে আপু ডেকেছিলো মায়া বেশ খুশি হয়।নিজের ভাই নেই তো কি হয়েছে আজ থেকে ফিরোজ ওর ভাইয়ের মতো।
অনেকদিন পর মেহরাবের পছন্দের খাবার গুলো রান্না করা হয়েছে।তাই মায়া ফিরেজকে দুপুরের খাবারের জন্য ডেকেছে। আফিয়ার মৃত্যুর পর থেকে মেহরাব বলতে গেলে ডিপলি ডিপ্রেশন এ চলে যায়।এ সময়ে অফিস বাসা সবটাই ফিরোজ সামলিয়েছে।মেহরাব ওকে একটু আধটু শাসনে রাখে আর ফিরোজ ও সেটা জানে আর এটাও জানে মেহরাব ওকে কতোটা ভালোবাসে।তাই তো মেহরাবের সবকিছু ওর সর্বোচ্চ টা দিয়ে আগলে রাখে।বড়োভাইর ক্ষতি ও ঘুনাক্ষরেও হতে দিবে না।

দুপুরের খাবার শেষ করে ফিরোজ চলে যায়।আর মেহরাব ওর রুমে যায়।এখন মেহরাব বেশিক্ষণ সময়ই ওর রুমেই কাটায়।এ সময়টা মায়া কাছে আসে না।কপালে হাত রেখে ডিভানে চুপচাপ শুয়ে আছে মেহরাব।তখনই মোবাইলে কল আসে।রিসিভ করলে ওপাশের কন্ঠ স্বর শুনে শোয়া থেকে ওঠে বসে।অনেকক্ষণ ধরে কথা হয় এর মধ্যে ও বেশির ভাগ সময় শুধু শুনেছে।আর ওপর প্রান্তের মানুষটি শুধু বলেছে।কথা গুলো শুনে একটা সময় দীর্ঘ শ্বাস ছেরে কল কেটে দেয়।ভালো লাগছে না কিছু,মনে হচ্ছে মাথাটা ভিষণ ধরেছে।ঔষধ খেতে পারলে ভালো হতো।উঠে মেডিসিনের বক্স ঘেটে পেইন কিলার না পেয়ে বসে।নিজে নিজে কপালের সাথে আঙ্গুল ঘসতে থাকে।একটা সময় চোখ বন্ধ করে আবার শুয়ে পরে।আজ আর বের হবে না।ভালো লাগছে না শরির টা।
অনেকক্ষণ বাদে কারোর হাতের স্পর্শ পায় বুঝতে পারে কে সে।তাই আর চোখ খোলে না ও।মাথার চুল গুলো আস্তে করে টেনে দিয়ে কপালে বাম লাগিয়ে ম্যাসাজ করে দেয় মায়া।তখন আড়াল থেকে ওর অবস্থা দেখে নিয়েছিলো।অস্থির লাগছিলো ওর কাছে মানুষটা কষ্ট পাচ্ছে বলে।মেডিসিন নিতে পারেনি তো কি হয়েছে একটু সেবা করতে তো দোষ নাই।এখন ও মেহরাব ট্রমার মধ্যে আছে একটা সময় ঠিক আগের মতো সব ঠিক হয়ে যাবে।এ সব ভাবতে থাকে মায়া টুপ করে এক ফোটা নোনা জল বাম চোখের কার্নিশ বেয়ে পরে।

~~~~~~

মায়া আজ অনেক খুশিতে আছে।টয়ার পক্ষ থেকে ওদের দুজনকে একটা ট্রিট দেওয়া হচ্ছে।ঢাকার বাইরে ঘুরতে যাওয়ার।যদিও টয়া চেয়েছিলে দেশের বাইরে কোথাও ঘুরতে যাবার জন্য কিন্তু মেহরাব না করে দেয়।তা ছারা এই মুহূর্তে দেশের বাইরে যাবার মতো মন মানসিকতা ওর নেই।বহু কষ্টে দেশের মধ্যেই কোথাও যাওয়ার জন্য রাজি করানো হয়।মায়া ওর লাগেজ গুছিয়ে নিয়েছে সাথে মেহরাবের টাও।অনেকদিন পর মেহরাব ওর সাথে একটু স্বাভাবিক আচরন করেছে।একটু হলেও ওর কাছে এটাই অনেক।

“গতোকাল রাতে মেহরাব শুয়ে ছিলো মায়া রুমে এসে নিজের কিছু দরকারী জিনিস নিয়ে চলে যেতে লাগলে হাতে টান লাগে।পেছন ফিরে দেখে মেহরাব ওর হাত ধরে আছে।এ অবস্থা দেখে হার্ট বিট বেড়ে যায় মায়ার।আজ পনেরো দিনের বেশি হবে,এতো দিনে একটা বার ওকে ভালো করে ছুয়ে দেখেনি মেহরাব।মায়া নিরব কিছু বলে না মেহরাব ওকে টেনে সামনে দাঁড় করায়।

-কোথায় যাচ্ছো?

মায়া একটু দম ছেরে বলে

-মায়ের রুমে যাচ্ছি

মেহরাব মায়ার গালে হাত ছুয়ে দেয় মায়া শিওরে ওঠে।স্থির হয়ে যায়।মেহরাব মৃদু স্বরে বলে

-এখানেই থাকো কোথাও যেও না।

মায়া মাথা নেড়ে সম্মতি দিলে মেহরাব ওকে ছেরে দেয়।মায়া বিছানা গুছিয়ে শুয়ে পরে।মেহরাব দরজা লক করে এসে মায়ার পাশে শুয়ে পরে।রুমের ড্রিম লাইট জ্বলছে।মায়া ওর ওপর পাশে কাত হয়ে আছে তাই ওর মুখ দেখা যাচ্ছে না।মেহরাব ওর একদম কাছে গিয়ে পেটের ওপর হাত রেখে পুরোপুরি দূরত্ব ঘুচে দেয়।মায়া সজাগ তবুও নড়াচড়া করে না।এবার মেহরাব ওর চুল গুলো সরিয়ে গলায় মুখ গুজে দেয়।মায়ার মনে আনন্দ সুখ জাগে আবার পরক্ষণে রাগ লাগে।খুব করে কিছু শুনিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে কিন্তু জোড় গলায় কিছুই বলতে পারছে না।মন চাচ্ছে বিগত দিনের কষ্টের কান্না গুলো চিৎকার দিয়ে করতে।এখন মেহরাব কে বলতে পারতো

“কেনো এতো গুলো দিন আমাকে কষ্ট দিয়েছেন?কি দোষ করেছি? আমি তো আপনারই ভালোবাসার কাঙ্গাল।আপনি জানেন না?আপনার অবহেলা আমাকে কতো টা পো”ড়ায়?

এ সব ভেবে মনে হচ্ছে গলা জড়িয়ে আসছে।বহু কষ্টে নিজেকে কান্না থেকে বিরত রেখেছে।কিন্তু চোখের অবাধ্য জল ঠিকই গরিয়ে পরতে থাকে।একটা সময় খেয়াল করে মেহরাব ওভাবেই ওকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে গেছে।“

“ওদের ট্যুর চট্টগ্রামের” মূলত মেহরাবের অফিসিয়াল কিছু কাজের ডিল ওখানে হওয়ার কথা।তাই এক কাজে দু কাজ করতে পারবে ভেবে এখানে যাওয়ার প্লান করে।পরদিন মেহরাব মায়াকে সবকিছু গুছিয়ে রাখতে বলে।চট্টগ্রাম যাওয়ার কথা শুনে মায়া তো মহা খুশি।মনে মনে ভেবে নেয় যাক সারপ্রাইজ টা ওখানেই দিয়ে দিবো।

বড়ো বড়ো চুল আর দাড়ি কিছুটা কেটে নিজেকে একটু ফিট করে নেয় মেহরাব।মায়া ওকে আড়চোখে দেখছে অনেকদিন পর এভাবে দেখে ওর মনে অন্যরকম ভালো লাগে।যদিও ভালোবাসার মানুষ গুলো যে ভাবে যে বেশেই থাকুক না কেনো সবসময় একই রকম ভালোলাগা কাজ করে।সব কিছু গুছিয়ে বাসা থেকে বের হয়।
মেহরাবের ইচ্ছে ছিলো বিমানে যাওয়ার কিন্তু মায়া সেটা শুনে সাহোস করে বলে ওর খুব ইচ্ছা ট্রেনে চড়ার।আগে এই ইচ্ছা পূর্ণ করেই বিমানে উঠবে।মেহরাব এর অনিচ্ছা সত্বেও ফিরোজ কে দিয়ে ট্রেনের টিকেট করায়।ফিরোজ টিকেট বুক করে দেয়।স্টেশন পর্যন্ত ফিরোজ ওদের এগিয়ে দিয়ে যায়।

মহানগর এক্সপ্রেসের দুপুরের ট্রেনে ওদের যাএা শুরু হয়। স্নিগ্ধা এসি চেয়ার কোচে ওদের সিট।পাশাপাশি দুটো সিটের জানালার পাশের সিটে মায়াকে বসিয়ে মেহরাব পাশে বসে।মায়া খুব এক্সাইটেড এই জার্নিটার জন্য।স্মরনীয় করে রাখতে চায় মনের ডায়েরির পাতায়।প্রিয়জনের সাথে এই প্রথম দূরের যাএা ওর।নিশ্চই এই জার্নিটা ভালো হবে।ট্রেন প্রথমে আস্তে চলতে লাগলেও ধীরে ধীরে এর গতি সীমা বেড়ে যায়।শহরের বুক চিরে একটা সময় গ্রাম নদী মাঠ পেরিয়ে আপন মনে নিজ গন্তব্যের দিকে ছুটে চলছে।ট্রেনের জানালা খোলা তাই পুরো বাতাস টা ওদের গায়ে লাগছে।ঘন্টা খানেক বাইরের দৃশ্য অবলোকন করে মায়া আর পারছে না তাকিয়ে থাকতে।এখন কিছুটা ঠান্ডা লাগছে তাই মেহরাব কে বলে জানালা লাগিয়ে দেয়।ধীরে ধীরে চোখে ঘুমের ভাব দেখা দেয়।মেহরাব সাথে করে কিছু বই এনেছিলো সে গুলোই বের করে পড়তেছিলো।মায়া ঘুমিয়ে গেছে মেহরাব ওর মাথাটা নিজ কাঁধে এনে রাখে।মাঝে মাঝে সামনের দিকে ঝুকে পরলে আরেক হাত দিয়ে ওকে আগলে রাখছে।নিজের গাড়ি হলে কোলে শুইয়ে দিতে পারতো কিন্তু এখন ইচ্ছে করলেও পারছে না।বাতাসে সামনের চুল গুলো একটু এলোমেলো হয়ে গিয়েছিলো।কাঁধে মাথা থাকা অবস্থাতেই অন্য হাতের সাহায্যে চুল গুলো ঠিক করে দেয়।
কিছুক্ষণ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রয়।অনেকদিন এই সুন্দর মায়া ময় স্নিগ্ধ মুখ খানা মন ভরে দর্শন করা হয় না।কষ্ট দিয়ে আসছে ওর মায়াবিনীকে।এ সব ভেবে ওর বুকের মধ্যে হা হা হা কার করে ওঠে।তখন নিজের আরেকটি সত্বা ওকে বলতে থাকে

“মেহরাব তুই অনেক বড়ো অন্যায় করেছিস ওর সাথে।এখনও সময় আছে নিজেকে শুধরে নে।না হলে হিতে বিপরীত হয়ে যেতে পারে”

চলবে……

#স্বর্ণকেশী_মায়াবিনী
#লেখনীতে-বর্ণ(Borno)
#পর্ব-২৩

চট্টগ্রামের বেস্ট ওয়েস্টার্ন এলাইন্স একটি বিলাস বহুল হোটেল যেটা আগ্রাবাদে অবস্থিত।মেহরাব এখানের একটি রুম বুক করে।স্টেশন থেকে হোটেলে পৌছাতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেছে।মেহরাব আর মায়া ওদের জিনিস পএ নিয়ে ছয় তলার একটি কক্ষে চলে যায়।রুমে ডুকেই মায়ার চোখ জুড়িয়ে যায়।কি সুন্দর সাজানো গোছানো এ সবই ভাবতে থাকে।
রিসিভশন থেকে শুনেছে এখান থেকে বিমান বন্দর আর সী বিচ একদম কাছেই।তাই মেহরাব এই হোটেল টাই পছন্দ করেছে।প্রায় ছয় থেকে সাত ঘন্টার জার্নি তার ওপর ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া করা হয়নি।তাই ক্লান্ত দুজনেই।মেহরাব কাপড় বের করে ওয়াশ রুমে ডুকে যায় ফ্রেশ হতে।

মায়া রুমটি দেখতে থাকে।রুমের সাথে ওয়াশ রুম আর বড়ো একটি বারান্দা।মায়া থাই গ্লাস সরিয়ে বারান্দায় প্রবেশ করে।অনেকটাই উপরে ওরা তারওপর রাতের এই শহরটা বেশ নজর কারা লাগছে।এখান থেকে সী বিচ কাছে থাকলেও এই সময়টা দেখা পাবে না।মায়া মনে মনে বেশ আনন্দ পাচ্ছে রাত পোহালেই সমুদ্রের দেখা পাবে বলে।
সেই ছোটো বেলা থেকে বই পুস্তকের পাতায় পাহাড় সমুদ্র এসবের ছবি দেখে আসছে।সব সময়ই ভাবতো ইশ যদি একবার দেখতে পেতাম।অবশেষে ওর আশা পূর্ণ হতে চলেছে।

পেছন থেকে ভারি কন্ঠের আওয়াজে ওর ভাবনা চিন্তার ছেদ ঘটে।ট্রাউজার আর টি শার্ট পরে তোয়ালেটা দু হাত দিয়ে চুল গুলো মুছে নিচ্ছে মেহরাব।ও ভাবেই মায়াকে বলতে থাকে

-অনেক ঘন্টা জার্নি করেছো আগে ফ্রেশ হও তারপরে বারান্দায় বসে যতো পারো রাতের অন্ধকার বিলাস করে নিও।

মায়ার মনে মনে রাগ লাগে।মেহরাবের কথার কোনো জবাব না দিয়ে রুমে এসে লাগেজ থেকে কাপড় নিয়ে ফ্রেশ হতে যায়।জার্নির জন্য খাওয়াটাই ঠিক মতো হয়নি তাই মেহরাব মায়াকে নিয়ে হোটেলে অবস্থিত রেস্টুরেন্ট এ যায়।খাবার অর্ডার দিলেই রুমে দিতো কিন্তু মেহরাবের ইচ্ছে হলো দেখে শুনে খাবার খাবে তাই এখানে আসা।
খাবারের মেনু গুলো দেখে মেহরাব খাবার অর্ডার করে।মায়া রে জিজ্ঞেস করলে বলে

-আপনি যা খাবেন আমিও তাই খাবো

মেহরাব আর কিছু বলে না।কিছুক্ষণ পর খাবার আসলে খাবারের আইটেম দেখে মায়ার চক্ষুচরক অবস্থা।এ সব কি খাবার?ও তো এ সব খেতে পারবে না।দেখেই গা ঘিন ঘিন করছে।আসলে মেহরাব সী ফুডের অর্ডার করছে।এসব ওর অনেক প্রিয় তবে অনেকদিন খাওয়া হয় না বলে আজ অর্ডার দিলো।আর বাকি রইলো মায়ার ব্যাপার।ও জানতো মায়া এ সব খেতে পারবে না।আর সবসময় মায়াকে জিজ্ঞেস করলে ও একটা কথাই বলবে “আপনি যা খাবেন আমিও তাই খাবো।”কথা টা যাতে আর না বলে সে জন্যই ও এই কাজটা করেছে।
মেহরাব আপন মনে খাচ্ছে আর মায়া সে গুলোর দিকে চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে আছে।চামচ দিয়ে খোচাচ্ছে কি খাবে ভাবছে।

-কি হলো খাও আমার তো শেষ প্রায়।

বোকা মার্কা একটা হাসি দিয়ে বললো

-এই তো খাচ্ছি।
বলেই মুখটি বাংলার পাঁচ এর মতো করে ফেলে।ভাগ্যিস অবশেষে এর মধ্যে থেকে চিংড়ি মাছটাই ওর খাবার যোগ্য ছিলো বাকি গুলোর নাম আর মুখে নিতে চায়না।এক ধরনের খাবার গিয়ে খেয়ে ওঠা মায়া।বাকিটা ও মেহরাব কে দিয়ে দেয়।মেহরাব আড়চোখে একবার তাকায় কিছু না হলে সে গুলো ও খেয়ে নেয়।
খাওয়া শেষ করে একদম নিচে চলে আসে।রিসেপশনে ওরা কারোর জন্য অপেক্ষা করে।আধা ঘন্টা পরে একটা লোক আসলে তার সাথে মেহরাব কথা বলতে থাকে।এই ফাকে মায়া নিচের আশপাশ টা ঘুরে ঘুরে দেখে।আগের বার এই রকম কোনো এক হোটেলে গিয়ে কি কান্ডটাই না করেছিলো সে সব কথা মনে করে মায়া আনমনে হাসে।আবার পরক্ষণে মুখটা চুপসে যায়।তখনকার মেহরাব আর এখনকার মেহরাবের মধ্যে অনেক তফাৎ তাই ভেবে।

মেহরাবের ডাকে ও পিছন ফেরে।মায়া মেহরাবের কাছে যায়

-কে ছিলো লোকটা?

-বিজনেস ক্লায়েন্ট

-এখানেও?

-হা তুমি তো জানো এখানে একটা মিটিং হওয়ার কথা আর সেটা কাল সকালেই ফিক্সড করা হয়েছে।

মায়া বুঝেছে মেহরাব এই জন্যই এসেছে আর টয়ার কথা রক্ষার জন্য শুধুমাত্র ওকে আনা।সে যদি কাজেই ব্যাস্ত থাকে তা হলে আমাকে কেনো এনেছে এ সব ভাবছে।
আবার ফিরে যায় রুমে।
মেহরাব ফোনে কথা বলছে অনেকক্ষণ ধরে।মায়ার ঘুম আসছে না।আবারও বারান্দায় যায়,গ্রীল ধরে দূর আকাশ পানে চেয়ে রয়।শুধু মাএ জ্ব’লতে থাকা তারা গুলোই দেখতে পারছে আর কিছু নয়।মন খারাপের ভিরে নিজের খুশির খবরটাই ভুলে গেছে ও।পেটে হাত দিয়ে অনুভব করে এখানে আরেকটি সত্বার বাস শুরু হয়েছে।মা হবে ও মনে চমৎকার অনুভূতি।আসলে এটার অনুভূতি প্রকাশ করা অসম্ভব।এখানে তিন দিন থাকা হবে।তিনদিনের দিনই ও মেহরাব কে এই খুশির সংবাদ টা দিবে।কারন আর দুদিন পরই মেহরাবের জন্মদিন।শুভ দিনে শুভ সংবাদ টা দিতে চায় ওকে।

মায়া আর বেশিক্ষণ থাকে না ভেতরে এসে শুয়ে পরে।শরির টা ব্যাথা করছে হয়ত লং জার্নির জন্য।
খুব সকালে মায়ার ঘুম ভাঙ্গলে চোখ খুলে দেখে মেহরাব ওকে আষ্টে পিষ্টে পেচিয়ে ধরে আছে।নিজেকে ছাড়াতে পারছে না।অবশ্য মনে আনন্দ ও লাগছে তাই ঠিক করেছে এভাবেই থাকুক ও ছাড় পেতে চায় না এই বন্ধনি থেকে।মেহরাব ঠিক সময়ে ওঠে যায়।মায়া এখনও ঘুম ভেবে আর ডাকে না।রেডি হতেই মায়া ও উঠে পরে।ফ্রেশ হয়ে দুজনে বেরিয়ে পরে।মিটিং শেষ করতেই অনেক সময় লেগে যায়।মায়াকে মেহরাব কিছু স্নাক্স জাতীয় খাবার কিনে দেয়।সে গুলোই মায়া খেয়ে নিয়েছে ।কিন্তু তাতে কি কাজ হয়? মন চাচ্ছে গরম গরম ভাত দিয়ে ভর্তা মাছ মাংস খেতে।
অবশেষে ওর মন মতোই মেহরাব ওকে খাওয়ায়।মায়া মেহরাবের কাছে বলে সী বিচ নেওয়ার জন্য।মেহরাবের যেহেতু কাজের চাপ নেই তাই ও আর না করে না।চলে যায় দুজন বিচ পাড়ে।সাগর পাড়ের একদম কাছে গিয়ে মায়া অবাক।সত্যি এই সমুদ্রের কোনো কুল কিনারা নেই।কিছুক্ষণ পর পর ডেউ তেরে আসছে।লবন পানির ফেনা ভাসছে,বহু লোকজন পানিতে নেমে আনন্দের সাথে গোসল করছে।মেহরাব ওকে নিষেধ করে দেয়

-একদমই পানিতে নামবে না কিন্তু।

মায়ার মুখটা চুপসে যায়।অনেক রিকুয়েস্ট এর পর পানিতে নেমে হাঁটুর নিচ অব্দি ভেজার অনুমতি পায়।ব্যাস এটুকুতেই মায়া খুশি।কামিজ আর সালোয়ার উঁচু করে ধরে পানিতে হাটতে থাকে।কিছুক্ষণ পর পর ডেউ এসে ওকে ছুয়ে দিচ্ছে।ওর তো ইচ্ছে ছিলো মেহরাব কে সঙ্গে নিয়ে পানিতে নেমে গোসল করার কিন্তু সেটা আর হলো না।
ওখান থেকে উঠে সামনে দিকে এগিয়ে দেখে অনেক ধরনের সামুক ঝিনুক ভেসে আছে।মনের আনন্দে সে গুলো কুড়োতে লাগলে মেহরাব নিষেধ করে কিন্তু ওর নিষেধ মায়া অমান্য করে অনেক গুলো ঝিনুক তুলে নেয়।এরপরে ওরা সী বিচের দোকান গুলোতে যায়।মায়ার পছন্দ মতো অনেক কিছু কিনে নেয়।কিছু কিছু জিনিস মেহরাব পছন্দ করে দেয়।
আশপাশ অনেক এলাকা ঘুরে অবশেষে সূর্যাস্তের সময়টা উপভোগ করেই ওরা দুজন হোটেলে ফিরে আসে।

পরের দিন মেহরাব ফ্রি তাই মায়ার ইচ্ছাতে পাহাড়ি এলাকায় ঘুরতে যাওয়ার জন্য বেরিয়ে পরে।আগ্রাবাদ শহর থেকে বেশ কাছেই পাহাড়ি বনভূমির দেখা মিলে।মেইন রাস্তার পাশ দিয়ে পাহাড়ি রাস্তা একে বেকে গেছে।
চট্টগ্রাম শহরের জিরো পয়েন্ট থেকে মাত্র এক কিলোমিটার দূরে টাইগারপাস এলাকায় বাটালি হিল অবস্থিত।এটা এখানের সর্বাধিক উঁচু পাহার।এই পাহাড়ের চূড়া থেকে নাকি বঙ্গোপসাগর আর শহরের অংশ দেখা যায়।তাই শুনে মায়া বেশ আগ্রহী হয়ে ওঠে।পাহাড়ের উপরে ওঠার জন্য কিন্তু মেহরাব কি উঠতে দিবে?ওদের সাথে আগে পিছনে অনেক পর্যটক রয়েছে যারা এই পাহারের চূড়ায় উঠবে বলে আসছে।তবে যাদের উচুতে হাইট ফোবিয়া আছে তারা এতো উচুতে উঠতে পারবে না।অবশ্যই প্রচুর সাহোস লাগবে এই কাজটা করতে গেলে।মেহরাব আর মায়া অনেকটা পথ হেটে একটু উচুতে ওঠে।মায়া অল্পতেই হাফসিয়ে যায়।সমান্তরাল জায়গায় বসে একটু বিশ্রাম নিয়ে নেয়।ওর এই সময়টা নিজের শরিরের কথা মনেই থাকে না।মেহরাব ওকে নিষেধ করে আর না জাওয়ার জন্য।কিন্তু মায়ার মন চায় আরো উঠতে।

আবারও উঠে হাঁটা শুরু করে এবার ঢালু থেকে একটু উচুতে উঠতে গেলে সামনে থাকা মেহরাবের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়।ঠিক ঐ সময়ে মেহরাবের ফোনে কল আসলে ও কল রিসিভ করে কথা বলতে থাকে।কিন্তু হাত সরিয়ে ফেলার কারনে মায়া পা পিছলে নিচের দিকে পরে যায়।ব্যাথা পেয়ে আহ করে চিৎকার দিলে মেহরাব মায়ার দিকে নজর দেয়।কল কেটে দৌড়ে ওকে গিয়ে ধরে।ততোক্ষণে যে জীবনে বড়ো ধরনের একটা ক্ষতির সম্মুখীন হতে চলেছে সেটা ওদের জানা ছিলো না।মায়া ব্যাথার যন্তনায় কাতরাচ্ছে।মেহরাব বুঝতে পারছে না কি করবে।বেশি দেরি না করে ওখানের কিছু লোকজনের সাহায্যে ওকে ওদের হোটেলের কাছাকাছি একটা হসপিটাল নেওয়া হয়।যাওয়ার পথেই ওর বিল্ডিং শুরু হয়েছিলো।মেহরাব একদমই বুঝতে পারেনি।

ডাক্তার মায়ারে চেকআপ করে ওর কন্ডিশন দেখে কিছু একটা আন্দাজ করে।আরো শিওর হওয়ার জন্য আল্ট্রাসনোগ্রাফি করে।ফাইনালি ডাক্তার যেটা মেহরাবকে বলে সেটা শুনে ওর মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পরার মতো অবস্থা হয়।গলা শুকিয়ে যাচ্ছে।কলিজার মোচর দিয়ে বুকের বা পাশে চিনচিন করে ব্যাথা করছে।কি শুনলো এটা ও?যেটা ওর ভাবনার বাইরে ছিলো।আর এ সবটাই ওর অসাবধানতার ফল।একটু সচেতন হলে এমন ভোগান্তি পোহাতে হতো না।নিজেকে আজ প্রথম বারের মতো পৃথিবীর সবচাইতে বড়ো হতোভাগা আর অপরাধী মনে হচ্ছে।

চলবে……

#স্বর্ণকেশী_মায়াবিনী
#লেখনীতে-বর্ণ(Borno)
#পর্ব-২৪

“মি.মেহরাব আপনার ওয়াইফ দু মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলো।দুঃখের সাথে জানাচ্ছি বেবিটা মিসক্যারেজ হয়ে গেছে।কিন্তু ভালো খবর এই যে আপনার ওয়াইফ এখন বিপদ মুক্ত।তবে তার পরিপূর্ণ বিশ্রামের দরকার।

এসব শোনার পর থেকেই দুঃখ কষ্ট যন্ত্রনা বুকে ধারন করে আহত হৃদয়ে নিষ্পলক দৃষ্টিতে বসে আছে মেহরাব।
কি থেকে কি হয়ে গেলো ভেবে পাচ্ছে না।একটা শোক কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই জীবনে আরেক টা শোক হাজির।নিজেকে খুব তুচ্ছ মনে হচ্ছে।না হলে এমন একটা খবর সুসংবাদ রূপে না শুনে বরং দুঃসংবাদ রূপেই শুনতে হলো ওকে।তাও নিজের স্ত্রীর মুখ থেকে নয় ডাক্তারের মুখ থেকেই।
আর ভাবতে পারছে না কিছু,রাগ উঠে যায় নিজের ওপর।চুল গুলো দু হাতের সাহায্যে বারং বার উল্টে পিছনের দিকে দিচ্ছে।অস্থির হয়ে যাচ্ছে ও।বাসায় ফোন করে সিতারা কে মায়ার অবস্থার কথা জানালে ওরাও মায়ার জন্য চিন্তা করতে থাকে।মেহরাব সিতারার সাথে কথা বলে মায়ার প্রেগনেন্সির বিষয়টা সিওর হয়।সবটা শুনে প্রথমে মেহরাব রাগ হয়।তবে মায়া নিজেই ওদের বলতে নিষেধ করেছিলো এটা শুনে মেজাজ গরম হলেও আপাততো নিজেকে কন্ট্রোল করে চুপচাপ বসে থাকে।

——

“বড়ো ভাই”ডাকটা শুনে মাথা উঁচু করে মেহরাব।সামনে ফিরোজ কে দেখে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না।বসা থেকে উঠে ফিরোজ কে জড়িয়ে ধরে ফুপিয়ে কান্না করে দেয়।

“মেহরাবের মুখ থেকে মায়ার অবস্থার কথা শুনে যখন তখনই ফিরোজ বাসা থেকে বেরিয়ে পরে।গাড়ি বা ট্রেন যাএা করে আসলে অনেক সময় লাগবে ভেবে বিমানে করে চট্টগ্রাম চলে আসে।ফিরোজ জানে মেহরাব সবটা একা সামল দিচ্ছে।এই মুহূর্তে ওর পাশে ফিরোজের থাকা টা জরুরী।”

-ফিরোজ এটা কি হয়ে গেলো আমার সাথে?কি দোষ করেছিলাম আমি?সুখের সংবাদটা আমি শুনতেই পারলাম না।কতোটা হতোভাগা আমি।

-বড়োভাই আপনি শান্ত হোন।প্লিজ এভাবে ভেঙ্গে পরবেন না।

-ফিরোজ আমি যে আর পারছি না।একটা পর একটা আঘাতে জর্জরিত হতে হচ্ছে আমাকে।আমি নিজেকে কি ভাবে শান্ত করবো বলো?

-সব ঠিক হয়ে যাবে বড়োভাই আর আপু যে সুস্থ্য আছে এটাই অনেক।এর চাইতে ও খারাপ কিছু হতে পারতো কিন্তু হয়নি তাই শুকরিয়া করতে হবে।

মেহরাব এবার একটু নিজেকে সামলে নেয়।এতোক্ষণ ধরে নানা চিন্তায় মায়ার কথা ভুলেই গিয়েছিলো।ওর কি অবস্থা এখন দেখতে হবে।মেহরাব মানসিক কষ্ট পেলেও মায়াতো তো শারিরিক মানিসিক দুটোর কষ্টই পেয়েছে।ফিরোজ কে সাথে করে মায়ার কেবিনের সামনে গিয়ে দাড়ায়।নার্স এর কাছ থেকে খোঁজ নিয়ে জানতে পারে।এখনও জ্ঞান ফেরেনি জ্ঞান ফিরলেই ওদের খবর দিবে।
এখনও মায়াদের বাড়ির কাউকে মেহরাব জানাতে পারেনি।একা মানুষ পরিচিতো জন কেউ নেই এখানে।যা কিছু করার ও একাই ছোটাছুটি করে করেছে।

ফিরোজ ওকে আর কি বলে শান্তনা দিবে ভেবে পাচ্ছে না।ওকে আবার বসিয়ে দিয়ে মায়াদের বাড়ি ফোন করে।পুষ্পের সাথে অনেকক্ষণ কথা বলে সবটা জানিয়ে কল কেটে দেয়।

“এদিকে পুষ্প সবটা শুনে কাশেম মিয়া আর আয়মন কে জানায়।মেয়ের এমন অবস্থার কথা শুনে কাশেম মিয়ার মন ছুটে যায়।পারলে এখনই ছুটে আসে মেয়ের কাছে।কিন্তু ওরা তো চট্টগ্রাম।এখান থেকে না যাওয়া পর্যন্ত মেয়ের কাছে আসাটা সম্ভব হবে না।আয়মন এই প্রথম মায়ার জন্য মন থেকে কষ্ট পাচ্ছে।আগে যাই করুক না কেনো ধীরে ধীরে তার সব ভুল গুলো বুঝে শুধরে নিচ্ছে।শতো হলেও সেও একজন মা।এমন একটা দূর্ঘটনার কথা শুনলেও পাথর মনও গলে যেতে বাধ্য।পুষ্প খুব কান্না করছে বোনের জন্য।আয়মন স্বামী আর মেয়েকে সান্তনা দেয় আর নিজের কান্না ও ধরে রাখতে পারছে না।সেও কান্না করছে খুব করে আর ভাবছে এই মুহূর্তে মেয়েটার পাশে থাকতে পারলে ভালো হতো।”

মেহরাবের নিকট একজন নার্স এসে খবর দেয় পেশেন্টের জ্ঞান ফিরছে।কথাটা শোনা মাএই মেহরাব এক সেকেন্ড ব্যায় না করে কেবিনে চলে যায়।ফিরোজ ওর পিছু যায় তবে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে রয়।মেহরাব মায়ার কাছে গিয়ে দেখে মায়া নির্বাক চোখে চেয়ে আছে।এক হাতে স্যালাইন লাগানো অন্য হাত পেটের ওপর রাখা।দু চোখ দিয়ে অনবরত পানি পরছে।খুশির মাঝেই আচমকা ঝড়ের প্রভাব বিস্তার করে মুহূর্তে সুখ টা কেড়ে নিবে কে জানতো এটা?সবটাই যে উপরওয়ালার ইচ্ছা।তবুও মনে মনে যেনো কষ্টের সাথে এক রাশ রাগ ভর করেছে।
মেহরাবের উপস্থিতি টের পেয়েও অনড় রইলো।মোটেও ফিরে তাকাচ্ছে না ওর দিকে।মেহরাব এসে ওর বেডের পাশে বসে।মায়ার পেটে থাকা হাতের ওপর ওর হাত রাখে।মায়ার হাতে ওর স্পর্শ অনুভব হতেই চোখ বন্ধ করে নেয়।ভিতর থেকে কান্না টা দমিয়ে নিজের হাতটি টান মে’রে নিয়ে নেয়।এমন টা হওয়াতে মেহরাব একটু অবাক দৃষ্টিকে তাকায়।এটা কি হলে?একটু দম ছেরে নেয়,এই মুহূর্তে কি বলবে ওকে আর কি বলার আছে ভেবে পাচ্ছে না।নিজেকে কেমন অনুভূতি শূন্য মনে হচ্ছে।মায়ার মানসিক অবস্থার কথা ভেবে কিছু বলার ইচ্ছা জাগে না।

বসা থেকে উঠে বাইরে গিয়ে ফিরোজ কে ভেতরে পাঠায় মায়ার সাথে কথা বলার জন্য।মেহরাব ডাক্তারের সাথে কথা বলার জন্য চেম্বারের দিকে পা বাড়ায়।
ফিরোজ কেবিনে ডুকে দেখে মায়া কান্না করছে।ফিরোজ কে দেখে মায়ার কান্নার শব্দটা বেড়ে যায়।ফিরোজ ওর মনের অবস্থা বুঝতে পারছে কিন্তু ভেতরের কষ্টটা বোঝার ক্ষমতা যে কারোর নেই।তবুও সান্তনা দেওয়া ছাড়া আর কি বা করার আছে।

-আপু এভাবে কান্না করবেন না শরির আরো খারাপ করবে।

-ভাই আমি বাসায় যেতে চাই আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে এখানে।

-বড়োভাই ডাক্তারের সাথে কথা বলতে গেছে।দেখা যাক ডাক্তার কি বলে।

মায়া আর কিছু বলতে পারছে না।কপালে হাত রেখে শুয়ে পরে।স্যালাইন শেষ হতে এখনও অনেকটা সময় বাকি।মায়া ভাবতে থাকে পেছনের কথা গুলো।মনে কতো আনন্দ নিয়ে একটা ভালো সময় পার করছিলো।কিন্তু একটা সামান্য ভুলের জন্য নিমিষেই আনন্দ টা মিলিয়ে মনটা নিরানন্দ দায়ক হয়ে গেছে।উদাসীন চিওে মন শুধু একজনকেই দায়ি করছে।হা আজ তার অবহেলা আর বেখেয়ালির জন্য আমার
জীবনের সবচাইতে বড়ো সুখ টা থেকে বঞ্চিত হলাম।আর এর জন্য তাকে আমি কখন ও ক্ষমা করতে পারবো না।
সে দিন পার করে পরের দিন ওরা মায়াকে হসপিটাল থেকে রিলিজ করে বিমানে চলে আসে।কেনোনা এই শরিরে ওকে নিয়ে লং জার্নি করাটা একদমই উচিত হবে না বলে ডাক্তার জানায়।
সে দিনের পর থেকে আজ তিনদিন মায়া মেহরাবের সাথে কোনো ধরনের কথা বলছে না।মেহরাব অনেক বার চেষ্টা করেছে কিন্তু ও নিরুওর।তবুও মেহরাব ঠান্ডা মাথায় সবটা মেনে নেয়।সময় মতো ওর সবকিছু করে যাচ্ছে।নিজে যা পারছে করছে কিন্তু কিছু কিছু সময় মায়া সে গুলো ইগনোর করাতে মেহরাব সিতারা আর শায়লাকে দিয়ে করায়।তবুও ওর যত্নের ত্রুটি রাখে না।

মেয়ের আসার খবর শুনেই গ্রাম থেকে কাশেম মিয়া আয়মন আর পুষ্প শহরে চলে আসে।মেয়ের এমন মলিন আর শুকনা মুখ দেখে কাশেম মিয়া আর আয়মন কান্না করে।যদিও মেয়ের সামনে হাউমাউ করে কান্না না করাই ভালো।তাই কান্না টা কোনো মতে আটকে রেখে মেয়ের পাশে বসে।মায়া আয়মন কে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে।পুষ্প এসে মা আর বাবা কে শাসাতে থাকে।

-বাজান কেমন বাবা মা তোমরা?মেয়েকে শান্তনা না দিয়ে নিজেরাই কানতেছো।দেখো বুবু তোমাগো কান্না দেখলে তার ভালো লাগবো।মোটেই না বরং এখন তারে আমাগো সবাইর উচিত বুঝানো যা গেছে তা আর ফিরে আসবো না।নিজেকে ঠিক রাখতে হইবো।এইটা বুঝাতে হইবো।

কাশেম মিয়া বুঝতে পারে ছোটো মেয়ের কথাই ঠিক।আসলেই পুষ্প একটা জ্ঞানি মেয়ে।ওর কথায় যুক্তি আছে।
এ দিকে মেহরাবের ভেতরটা দুমরে মুচরে যাচ্ছে।এক তো অনাগত সন্তান দুনিয়াতে আসার আগেই উপর ওয়ালা নিয়ে গেলো।তারওপর বউয়ের ইগনোর করাটা ভিষণ ভাবে মনের ভিতর ক্ষতের সৃষ্টি করছে।এ ভাবে আর কতো দিন।কিছু বলে ও মায়াকে স্বাভাবিক করা যাচ্ছে না।কি করবে ভেবে পাচ্ছে না।তা হলে কি আরো সময় লাগবে মায়ার স্বাভাবিক হতে?

শ্বশুর শ্বাশুড়ী দুদিন থেকে আর থাকতে পারছে না।ঘর দুয়ার খালি পরে আছে।আবার মেয়ের এমন অবস্থা মন সায় দিচ্ছে না একা রেখে দিতে।কাশেম মিয়া খুব সাহোস করে মেহরাব কে বলে ফেলে মায়া কে কয়েকদিনের জন্য গ্রামে নিতে চায়।মনের একটু স্বাভাবিক পরিবর্তন হলেই মায়াকে দিয়ে যাবে।কিন্তু এ কথা শুনে মেহরাব একদমই চুপসে যায়।মায়া এই মুহূর্তে দূরে যাক এটা তো ও চায়নি।বরং ও চলে গেলে মেহরাব একা একা আরো বিভিন্ন ধরনের চিন্তায় শেষ হয়ে যাবে।
মনে মনে এ সব কিছু ভাবলেও শ্বশুড় কে মুখের ওপর না করতে পারছে না।আয়মন ও স্বামীর কথায় তাল মিলায়।তাই এখানে মেহরাবের কিছুই বলার থাকে না।মনে মনে ভাবে মায়াকে বলতে হবে যেনো না যায়।
রাতের খাবার শেষ করে যে যার রুমে চলে যায়।মেহরাব ওর রুমে ডুকে মায়াকে কাপড় চোপর গোছাতে দেখে একটু অবাক হয়।

-এতো রাতে এ সব গুছাচ্ছো কেনো?দিনে ও তো করতে পারতে।

মেহরাবের কথার কোনো জবাব মায়া দেয় না।আপন মনে কাপড় গুছিয়ে ব্যাগে রাখছে।এবার মেহরাবের রাগ লাগে তবুও রাগ সংবরন করে বলে

-মায়া এ সব রাখো এখন,দিনের বেলা শায়লা এ সব করে দিবে শুধু শুধু কষ্ট করো না ঘুমিয়ে পরো।

তবুও মায়া এ সবের তোয়াক্কা না করে ওর কাজই করে যাচ্ছে।মেহরাবের রাগ বাড়তে থাকে।আজ কয়েকদিন মোটেও কথা বলছে না মায়া ওর সঙ্গে।তবুও নিজেকে অনেক কষ্টে সামলে রেখেছে কিন্তু এখন আর পারছে না।এর একটা বিহিত করাই লাগবে।হুট করেই মেহরাব মায়ার এক হাতের বাহু চেপে ধরে

-কি হলো কথা কানে যায় না তখন থেকে বলছি এ সব রাখো কথা মোটেও কানে যাচ্ছে না?

মায়া এবার রাগি দৃষ্টি নিয়ে ওর পানে চায়।আজ আর কথা না বলে থাকতে পারছে না।যতো রাগ ক্ষোভ সব প্রকাশ করবে

-নাহ কানে যাচ্ছে না কারন আমি আপনার সাথে কথা বলতে ইচ্ছুক নই।তাছাড়া আমি কাল গ্রামে চলে যেতে চাই।
দয়া করে আমাকে আটকাবেন না।

কথাটা শুনে মেহরাবের রাগটা বেড়ে আরো দ্বিগুন হলো।

-নাহ তুমি কোথাও যাবে না।তুমি এখনও পুরোপুরি সুস্থ্য নও।

ওর কথা শুনে মায়া তাচ্ছিল্যের হাসি দেয়

-আমার শরির নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না।এই কয়েক মাস তো আপনার আমার দিকে এক নজর তাকানোরই সময় হয়নি।আজ আসছেন এ সব বলতে?দিনের পর দিন শুধু মানসিক ভাবে কষ্ট দিয়েছেন।আর আমি আপনাকে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলেও আমার কষ্ট গুলো না বুঝে শুধু ইগনোর করেছেন।আরে একটা মানুষ ম’রে গেছে বলে কি দেবদাস হতে হবে?ঘরের বউকে কি পর করে দিতে হবে?

শেষের কথাটা শুনে মেহরাব রাগে হাতের আঙ্গুল গুলো মুঠ করে নেয়।

-হা সে সব ও মেনে নিয়েছি।ভেবেছিলাম আপনি মায়ের মৃত্যুতে একটু বেশি শকড্।কিন্তু শেষে কি করলেন?

এটা বলেই মায়া কান্না করে দেয়।চোখ মুছে আবার বলতে লাগে

-আমি যা হারিয়েছি সেটার জন্য একমাএ আপনি দায়ী।আমি আপনাকে কখনও ক্ষমা করবো না।

কথাটা শোনা মাএই মেহরাবের পা থেকে মাথা পর্যন্ত যেনো আ’গুন ধরে যায়।হাত উঁচু করে মায়াকে চড় দেওয়া জন্য।মায়া সেটা বুঝতে পেরে ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে।কিন্তু নাহ মেহরাবের হাত থেমে যায়।

“কোনো সুপুরুষ তার প্রিয় মানুষটির ওপর আঘাত করতে পারে না।আঘাত করা তো কাপুরুষের কাজ।নিজের রাগ টা দমন করে রুম থেকে প্রস্থান করে মেহরাব।ইচ্ছে করলে মেহরাব ও মায়াকে অনেক কথা শুনিয়ে দিতে পারতো,নিজের ও যে ভুল আছে সেটাও ধরিয়ে দিতে পারতো।কিন্তু সেটা ও করেনি।মায়া তখন বসে পরে।অঝোর ধারায় চোখ থেকে নোনা জল পরছে।আর ভাবছে “শেষ পর্যন্ত মেহরাব ওকে চড় দেওয়ার উদ্দেশ্যে হাত তুললো…?

চলবে….

(লেখার ভুল ত্রুটি মার্জনীয়)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে