#স্বর্ণকেশী_মায়াবিনী
#লেখনীতে-বর্ণ(Borno)
#পর্ব-১৯
ভোর বেলা,চারদিকে পাখিদের কিচিমিচির কলরবে মেহরাবের ঘুম ভেঙ্গে যায়।নতুন জায়গা তারমধ্যে সারারাত প্রিয়তমার যন্ত্রনায় ভালো ঘুম হয়নি।এখনও চোখে রাজ্যের ঘুম কিন্তু আর মন সায় দিচ্ছে না শুয়ে থাকতে।আবার সরতে ও পারছে না।প্রতিদিন কার মতো মেহরাবের উন্মুক্ত বুকে মাথা রেখে দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে আছে মায়া।মেহরাব গভীর দৃষ্টিতে চেয়ে আছে মায়ার পানে।কি সুন্দর ঘুমিয়ে আছে অথচ এই মেয়েটা রাতে ওর সাথে কতো কি করেছে।মুখে হাসির ঝলক বজায় রেখে ভাবতে থাকে”পা’গলী একটা,যতোই জ্বা’লাতন করুক না কেনো এসব ও হাসি মুখে সহ্য করে যাবে।
এসব ভেবে মায়ার মুখে মেহরাবের হাত দ্বারা স্পর্শ করছে।চোখ নাক গাল ঠোঁট ছুয়ে ছুয়ে দিচ্ছে।মায়া ঘুমের মধ্যে ওর স্পর্শ পেয়ে নড়াচড়া করছে।একটা সময় ওকে ছেরে দিয়ে পাশ ফিরে শোয়।মেহরাব আস্তে করে উঠে ফ্রেশ হতে ওয়াশ রুমে চলে যায়।ফ্রেশ হয়ে এসে দেখে মায়া ওর মাথা চেপে ধরে আছে।মেহরাব সে সব দেখেও না দেখার ভান করে নিজের কাজ করছে।তোয়ালে দিয়ে চুল মোছায় ব্যাস্ত সে।মাঝে মাঝে আর চোখে মায়ার দিকে তাকাচ্ছে।চুল মোছা শেষ করে ওর কাছে গিয়ে বসে।
-কি ব্যাপার ঘুম ভাঙ্গছে ?
মায়া কিছু বলে না,মাথাটা ভিষণ ভার ভার লাগছে কিন্তু কেনো?আর এটা কোন জায়গা?এখানে কখন আসলো কিছুই তো মনে পরেছে না।
-কি হলো কিছু বলছো না যে?
-এটা কোথায়?আর আমরা তো হোটেলে গিয়েছিলাম এখানে আসলাম কিভাবে?
মেহরাব একটু দম ছেরে বলতে লাগে
-কিছু মনে থাকবে কিভাবে থাকার কাজ করলে তো থাকবে।
-মানে কি বলছেন বুঝলাম না।
-আচ্ছা ওখানে বসে কি খেয়েছিলে বলোতো?
-কি আবার জুস আর কোক খেয়েছিলাম।
-জ্বী না ম্যাম আপনি যেটা খেয়েছেন সেটা অন্য কারোর অর্ডার করা ড্রিংকস আর সেটার মধ্যে নে’শা যাত দ্রব্য মিশানো ছিলো।
এ কথা শুনে মায়া খুবই শকড্ হয়।
-হায় আল্লার বলেন কি আমার তো অনেক বড়ো ভুল হয়ে গেছে পাপ হবে তো।
-হুম তা হবে এখন মন থেকে ক্ষমা চাও আল্লাহর কাছে আর ভবিষ্যতে না জেনে এ ভাবে খেতে যাবে না ওকে।
-হু বুঝতে পারছি।কিন্তু আমার এই অবস্থা কেনো?আমার জামা কাপড় কই?
-এখন মনে পরছে সে সব কোথায়? সব কিছু ধুয়ে শুকাতে দিয়েছি।
-ধুয়ে দিয়েছেন মানে?
-মায়া তুমি সজ্ঞানে ছিলে না।সারা রাস্তায় মা”তলামি করেছো শুধু তাই না এখানে আসার পর থেকে কি সব করেছো তা আর নাইবা শুনলে।
কিন্তু মায়া সবটা শুনতে চায়।মেহরাব আবার বলতে শুরু করে
-তোমার এমন অবস্থা দেখে প্রথমে লেবুর শরবত খাইয়ে দেই।কিন্তু তুমি কি করলে খেয়েই সবকিছু ব”মি করে দিলে।নিজের কাপড় নষ্ট করেছো সাথে আমারটাও।তোমাকে পরিষ্কার করে আমার টিশার্ট পরিয়ে দেই।সাথে নিজেও ফ্রেশ হয়ে আসি।তোমার জন্য ডিনার টা করতে পারিনি কিন্তু নিজে তো দিব্যি সারারাত ধরে আমাকে ডিনার বানিয়ে খেয়েছো।
এ সব শুনে মায়া ঢোক গিলে বলে
-মানে কি বলছেন আপনাকে ডিনার বানিয়ে..খেয়েছি?
মেহরাব ওর কাছে এসে ওর খোলা বুকের দিকে তাকাতে বলে।মায়া ওর দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে সত্যি অচেতন অবস্থায় কি সব করেছে ভাবতেই একরাশ লজ্জা ওকে গ্রাস করতে বসেছে।শুধু বুকে নয় কাঁধে গলায় পেটে এ সব জায়গায় লাল আঁচড় আর কা”মরের দাগ।অতিরিক্ত ফর্সা হওয়ায় এসব দাগ স্পষ্ট বিদ্যমান।ছিঃ কি করলো এসব ও।
-হয়েছে আর লজ্জা পাওয়ার দরকার নেই এখন উঠে ফ্রেশ হয়ে নেও।না হলে এবার আমার পালা,পেটের মধ্যে ক্ষুদায় ইঁদুর দৌড়াচ্ছে।দেখা যাবে এবার আমি ব্রেকফাস্ট হিসেবে তোমাকেই বেছে নিবো।কি দিবে তো ব্রেকফাস্ট করতে?
“বেশরম ব্যাডামানুষ কি সব বলছে।আমি না হয় অজান্তে করেছি তাই বলে সে সজ্ঞানে থেকে এসব বলে খালি লজ্জায় ফেলবে?ইচ্ছে করেই এ সব বলছে।
মায়া আর শুয়ে থাকতে পারছে না।গায়ে জড়ানো চাদরটি আরো শক্ত করে জড়িয়ে কোনো রকমে উঠে ওয়াশ রুমে ছুটে যায়।শাওয়ার নিয়ে বিপাকে পরে।ড্রেস তো নেই কি পরবে।দরজা খুলে একটু ফাঁক করে মেহরাব কে ডেকে পরিধানের জন্য কিছু চায়।মেহরাব ওর লং ফুল হাতার একটি শার্ট দেয়।মায়া এটা পেয়ে বোকা বনে যায়।ভাবে শুধু এটা পরবে কিভাবে?মেহরাব ওকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলে
-কি হলো পরে আসো নাকি আমি এসে পরিয়ে দিবো?
ওর কথা শুনে তারাতারি ভেতরে মুখ নিয়ে দরজা লক করে দেয়।অগত্যা শার্ট পরেই বেরিয়ে আসে।হাঁটুর নিচ অব্দি হওয়াতে ওর কাছে তেমন খারাপ লাগে না।আয়নার সামনে এসে চুল গুলো মুছতে থাকে।কিন্তু শুকাতে সময় লাগবে ভেবে খোলা বারান্দায় চলে যায়।সকালে ঝলমলে রোদ পুরোটাই বারান্দা জুড়ে তাই চুল গুলো শুকাতে কষ্ট হবে না ভেবে এখানে এসে দাড়িয়ে যায়।বাংলোর আশপাশ টা বেশ সুন্দর।চারপাশ টা অনেক জায়গা জুড়ে দেওয়াল দিয়ে ঘেরা আর ভিতরে চারপাশ টাতে গাছ লাগানো।হরেক রকমের গাছ আছে এখানে।মনে মনে ভেবে নেয় একটু পরে বের হয়ে সবটা ঘুরবে।
মেহরাব এক কাপ কফি সমেত রুমে আসে,মায়াকে দেখতে না পেয়ে টি টেবিলের ওপর কফির মগ দুটো রেখে বারান্দায় দিকে যায়।আস্তে আস্তে এগিয়ে পেছন থেকে মায়া কে কোমর জড়িয়ে ধরে।স্যাম্পু করা ঝলমলে চুলের মধ্যে নাক ডুবিয়ে নিশ্বাস নিতে থাকে।আর লেশালো স্বরে বলতে থাকে
-এই অবস্থায় তোমায় খুব হটি লাগছে সোনা।মাথা নষ্ট করে দিলে যে।নিজেকে ঠিক রাখি কেমনে বলো।
মায়া ওর কথা গুলো শুনে চুপ করে আছে।কি বা বলবে?প্রতিবারই প্রিয় মানুষটার পবিএ ছোয়া ওকে মুগ্ধ করে।মনে অন্যরকম শিহরন বয়ে যায়।চোখ বন্ধ করে ওর গভির ছোয়া গুলো অনুভব করে।এটাই যে ওর জীবনের আসল সুখ।একটা সময় জীবনে সুখ বলতে কিছু ছিলো না।কিন্তু এখন মেহরাব ওকে পরিমাপ ছাড়া সুখের রাজ্যে ভাসিয়ে দেয়।এই মানুষটাকে ও কখনও কষ্ট দিবে না।মেহরাবের হাতের বন্ধনির মধ্যে থেকেই ওর দিকে ঘুরে তাকায়।চোখে চোখ রাখে একটা সময় এই চোখের দিকে তাকাতে লজ্জা পেতো এখন আর সেটা লাগে না।মায়া ওর পায়ের ওপর পা রেখে একটু উঁচু হয়।মেহরাব ওর দিকে ঘোর লাগা দৃষ্টিতে তাকায়।স্নিগ্ধ সকালের মতো ওর মায়াবিনীকে স্নিগ্ধ লাগছে।আর পারছে না দৃষ্টি মেলাতে।কিছুক্ষনের জন্য অধরে অধর মিলিত করে একাকার হয়ে মিশে যায় দুজন দুজনায়।
মিনিট খানেক পর মেহরাব নিজ থেকে ওকে ছেরে দেয়।
-আপনার না ক্ষিদে পেয়েছে?আমি কিছু বানিয়ে আনছি।
-তোমার কষ্ট করার দরকার নেই তাছারা এখানে তো রান্না করার মতো তেমন কিছু নেই।খাবার অর্ডার করে দিয়েছি এক্ষুনি চলে আসবে।
মায়া ভেতরে এসে কফির মগ দেখে বুঝতে পারে মেহরাব নিজেই বানিয়ে এনেছিলো।কিন্তু এতোক্ষণে মনে হয় ঠান্ডা হয়ে গেছে।ধরে বুঝতে পারে আসলেই তাই।গরম করে নিয়ে আসবে ভেবেই মগটি নিয়ে রান্না ঘরের উদ্দেশ্য যেতে লাগলে মেহরাবের বাধা দেয়।
-দরকার নেই দাও খেয়ে নেই
-কিন্তু ঠান্ডা হয়ে গেছে তো?
-তুমি শিওর ?
-অবশ্যই
-আচ্ছা একটু খেয়ে দেখো তো
কি আর করার মায়া এক চুমুক খেয়ে দেখে হালকা গরম তবুও আরেকটু গরম করলে ভালো হতো।
-দাও এবার
-কিন্তু
-কোনো কিন্তু নয় আই হোপ এবার আগের থেকে দ্বিগুন গরম হয়েছে কফি।আমার হটি বউটার ঠোঁটের ছোঁয়া বলে কথা।গরম না হয়ে পারে?বলেই খেতে শুরু করে।
মায়া ভাবে এই মানুষটা এমন কেনো?কি সব লাগাম ছারা কথা বলে তারওপর এতো ভালোবাসা আসে কোথ থেকে?
এর মাঝেই খাবারের পার্সেল চলে আসে।দুজনে খেয়ে নেয়।মেহরাব পুরো বাড়ি আর বাড়ির চারপাশটা মায়া কে ঘুরে ঘুরে দেখায়।আসলেই বেশ মনোরম পরিবেশ।শহরের কোলাহল মুক্ত নির্জন এলাকা বলেই এতোটা সুন্দর।
-পছন্দ হয়েছে তোমার?
-হুম খুব খুব
-জানতাম পছন্দ হবে তাই তো তোমার জন্য এটা কেনা।আমি ভাবছি তুমি তোমার নিজের মতো করে সাজাবে।কিন্তু তার আগে কিছু কাজ করাতে হবে।তারপর মাঝে মধ্যেই এই নির্জন পরিবেশে হুট হাট করে হানিমুনে চলে আসবো।
-আবার শুরু করে দিলেন।
-কি করবো বলো?আমার জায়গায় তুমি হলে বুঝতে।
-বেশ বুঝেতে পারছি আর পা’গলামি একটু কম করে করবেন।
-উহুম এ বিষয়ে আমার মন যা চায় তাই করবো কোনো নিষেধ শুনবো না।
~~~~~
দুই দিন পরে
আজ ফিরোজের বাসায় ওদের ইনভাইট করা হয়েছে।মূলত ফিরোজের একমাএ বোনের বিয়ের জন্য ছেলে পক্ষ মেয়েকে দেখতে আসবে।মেহরাবের কথা মতো মায়া শাড়ি পরেছে।দুজন রেডি হয়ে ফিরোজের বাসায় যায়।
মা আর বোন কে নিয়ে ফিরোজের পরিবার।বোন অনার্সে পড়ে দেখতে শুনতে ভালো ।এখন ভালো ছেলের হাতে বোনকে তুলে দিকে পারলে ওর শান্তি মিলবে।তবে ছেলে ভালো পরিচিতো,ফিরোজ আগে থেকেই মেহরাব কে বলে রেখেছিলো।মেহরাব ছেলের বায়োডাটা নিয়ে সব খোঁজ খবর নিয়েছে।ছেলে ভালো আর্মির জব করে।পরিবারও ভালো এখন বাকি কাজটা ভালো ভালোই হলেই হয়।
ছেলে পক্ষ চলে আসে,ফিরোজের বোন ফারজানা কে মায়া সুন্দর করে শাড়ি পরিয়ে সাজিয়ে দেয়।তবে মেকাপের ভারি আস্তরন মুখে মাখাতে দেয়নি ফারজানা।ওর কথা হলো আমি যেমন তেমনই যেনো তারা দেখতে পায়।মায়া ওর কথা মতোই হালকা সাজে সাজিয়ে দেয়।মনে মনে ভাবে আসলেই মেয়েটা বুদ্ধিমান।ফারজানা দেখতে সবমিলিয়ে সুন্দর এক দেখায় যে কেউ পছন্দ করার মতো।তাই ছেলে পক্ষের ওকে দেখেই সবার পছন্দ হয়ে যায়।সবার মতামত নিয়ে বিয়ের দিন তারিখ ও ঠিক করা হয়।এক মাস পরেই বিয়ে করে ছেলের বাড়ি থেকে আনুষ্ঠানিক ভাবে ফারজানাকে নিয়ে যাবে।
ফিরোজের মা মায়াকে অনেক যত্ন করে।সত্যি উনি একজন ভালো মনের মানুষ।মায়ার ও ওনাকে খুব ভালো লাগে।অনেক বার ওদের থাকতে বলে কিন্তু তাকে বুঝিয়ে মেহরাব আর মায়া বাসায় চলে আসে।
দিনকাল দুজনের ভালো চলছিলো।হঠাৎ করে একদিন আফিয়া আনজুম এর স্বামী মেহরাব কে কল করেছে। আফিয়া হসপিটালে ভর্তি কথাটা শুনেই মেহরাবের বুকের মধ্যে চিক মে”রে ওঠে,হাত থেকে মোবাইলটা পরে যায়।মায়া ওর অবস্থা দেখে ছুটে আসে।মেহরাব ফ্লোরে বসে পরে চোখ দুটো লাল হয়ে দু ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পরে।কি হয়েছে মায়া জিজ্ঞেস করলে মেহরাব ওকে জড়িয়ে ধরে।মায়া ওর অবস্থা দেখে ভয় পেয়ে যায়।মেহরাব কান্না সংবরন করে বলতে থাকে
-আমার আম্মিজান অনেক অসুস্থ্য মায়া।আমার আম্মিজানের অবস্থা নাকি বেশি ভালো না।
চলবে……..
#স্বর্ণকেশী_মায়াবিনী
#লেখনীতে-বর্ণ(Borno)
#পর্ব-২০
অচেতন অবস্থায় হসপিটালের বেডে শুয়ে আছে আফিয়া।মেহরাব তার ডান হাতটি নিজের মুঠোর মধ্যে নিয়ে পাশে বসে আছে।মুখে কোনো কথা নেই শুধু শব্দহীন কান্না করে যাচ্ছে।অপেক্ষায় আছে কখন আম্মিজানের জ্ঞান ফিরবে।কেবিনে একজনের অধিক ডুকতে দেওয়া হচ্ছে না তাই বাকি সবাই বাইরে অপেক্ষা করছে।
তখন আফিয়ার কথা শুনে মেহরাব একটা সেকেন্ড ব্যায় না করে মায়াকে সঙ্গে নিয়ে বের হয়ে যায়।নিজে গাড়ি ড্রাইভ করে।যতোটুকু সময় লাগার কথা আজ যেনো তার দ্বিগুন সময় লাগছে পৌছাতে।বিপদের মুহূর্ত গুলো এমনই হয়।হসপিটাল পৌছে আফিয়ার স্বামীর থেকে যা শুনতে পায় তা শুনে মেহরাবের মাথা শূন্য হয়ে যায়।এতো দিন ধরে অসুস্থ্য থাকলেও খারাপ কিছু ধরা পরেনি।কিন্তু হঠাৎই ধরা পরে আফিয়ার ব্লাড ক্যান্সার হয়েছে।এখন লাস্ট স্টেজে আছে।আর আজকে বেশি অসুস্থ্য হয়েছে বলেই ইমারজেন্সি ভর্তি করা হয়।এ সব বলে ভদ্রলোক কান্না করতে থাকে।মায়া কাকে রেখে কাকে সান্তনা দিবে বুঝতে পারছে না।ওর ও ভিষণ খারাপ লাগে।আফিয়া ওকে স্বল্প সময়ে যে ভালোবাসা দিয়েছে সেটা ও কখন ও ভুলতে পারবে না।আফিয়ার ছেলে মেয়ে দূরে থাকে তারাও শুনে রওয়ানা হয়েছে।
অনেকটা সময় পরে আফিয়ার জ্ঞান ফিরলে চোখ মেলে মেহরাব কে দেখতে পায়।নিজের হাতটি ছেলের হাতের মুঠোয় দেখে মুচকি হাসেন।তিনি বেশ বুঝতে পারছেন অসুস্থ্য তার কথা শুনে মেহরাব এর মাথা মন কোনো টাই ঠিক নেই।আরেক হাতে স্যালাইন চলছে সে হাতটি এ পাশ ঘুরাতে চাইলে মেহরাব বাধা দেয়।উঠতে নিষেধ করে মেহরাব।আফিয়া আর নড়াচড়া করে না।শরিরটা খুবই দূর্বল লাগছে।ছেলের দিকে চেয়ে বুঝতে পারছে অনেকক্ষণ ধরেই কান্না করছে।চোখ দুটো লাল হয়ে আছে।নাক মুখে ফোলা ফোলা ভাব।ফর্সা চেহারা লাল বর্ণ ধারন করেছে।
আফিয়ার নিজের পেটের সন্তানদের যেমন ভালবাসতেন তেমনি মেহরাব কেও ভালোবাসতেন।এই ভালোবাসায় কোনো খুঁত ছিলো না।এমন কয়জন আছে যে কিনা প্রাক্তন স্বামীর দ্বিতীয় স্ত্রীর বাচ্চাকে নিজের বুকে টেনে নেয়?
আফিয়া নিয়েছিলো ঐ টুকু বাচ্চার অসহায় মুখ দেখে তার হৃদয় টা ক্ষতবিক্ষত হয়ে গিয়েছিলো।আপন ভেবে নিজের বুকে টেনে নিয়েছিলো।মেহরাব কে কখনও বুঝতে দেয়নি আফিয়া ওর নিজের মা নয় কিন্তু আফিয়া একটা সময় মেহরাবকে সবকিছু খুলে বলে।কেনোনা এ সব বলাই লাগতো।সত্য কখনও চেপে রাখতে নেই।মেহরাব সব জেনেও কখনও কোনো ধরনের রিয়েক্ট করেনি।ওর মা আফিয়া ব্যাস আর কিছু জানার নেই।
-আব্বু আর কান্না করে না দেখো আমি তো সুস্থ্য।
আফিয়ার কথা শুনে মেহরাব ওর আম্মিজানের হাতটি ওর দু চোখের পাতায় ছোয়ায়।হাতের পিঠে একটা চুমু খায়।ফুপিয়ে কান্না করতে থাকে ও পারছে না এ কান্না থামাতে।আফিয়া এ সব দেখে নিজেকে শান্ত রাখতে পারছে না মন চাচ্ছে স্যালাইনের সুচ বের করে সব ছেরে ছুরে মেহরাব কে জড়িয়ে ধরতে।কিন্তু পারছে না নিচের ঠোঁট কামরে কান্না সংবরন করে নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করছে।আফিয়া যদি এ সব করে তা হলে মেহরাব আরো ভেঙ্গে পরবে।এতো শক্ত সামর্থ ছেলেটা আজ বাচ্চা দের মতো কাঁদছে এ সব কোনো মা সহ্য করতে পারবে না।
-আব্বু এবার থামো না হলে আমি কিন্তু আর এখানে থাকবো না।বাসায় চলে যাবো।
এবার মেহরাব একটু নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে।মুখ দিয়ে কথা বলার চেষ্টা করছে পারছে না।তবুও বলছে
-একদমই ও সব করবেন না আপনি সুস্থ্য হয়ে যাবেন আম্মিজান।আপনার ছেলে আপনাকে আর কষ্ট পেতে দিবে না।
-হুম
-আম্মিজান আপনি বিশ্রাম নিন আমার একটু বাইরে কাজ আছে।বলেই মেহরাব বের হয়ে যায়।
আফিয়া বেশ বুঝতে পারছে মেহরাব এর মনে কি চলছে।
কেবিন থেকে বের হতেই মায়া আর আফিয়ার স্বামী ওকে দেখে উঠে দাড়ায়।জ্ঞান ফেরার কথা শুনে ভদ্রলোক কেবিনে যায়।মায়া দরজা থেকে উকি দিয়ে একনজর আফিয়া কে দেখে মেহরাবের সামনে আসে।মেহরাব মায়াকে সঙ্গে নিয়ে ডাক্তারের রুমে প্রবেশ করে।ডাক্তারের থেকে জানতে পারে আফিয়ার শরিরের কন্ডিশন ভালো না যে কোনো মুহূর্তে খারাপ কিছু হয়ে যেতে পারে।মেহরাব জানতে চায় উন্নত চিকিৎসার জন্য যদি বিদেশ নেওয়া হয় তা হলে?জাক্তার জানায় শেষ স্টেজে তাই এক উপরওয়ালাই ভরসা।তবে রক্ত দিয়ে যেতে হবে নিয়মিতো।আজকেও দেওয়া হয়েছে আবারও লাগবে।
মেহরাব আগে থেকেই জানে ওর আম্মিজানের রক্তের গ্রুপ আর ওরটা একই। তাই আফিয়ার স্বামী কে বলে রেখেছে আবার যখন রক্তের দরকার হবে তখন ও দিবে।ওর কথা শুনে সে সায় দেয়।
সেদিনের মতো মায়াকে নিয়ে বাসায় চলে আসে মেহরাব।যদিও মায়া থাকতে চেয়েছিলো কিন্তু ততোক্ষণে আফিয়ার ছেলেমেয়েরা চলে এসেছিলো তাই আর ওকে থাকতে হয়নি।
পরদিন অফিসে থাকা কালিন হসপিটাল থেকে মেহরাবের কাছে কল আসতেই দ্রুত ছুটে যায় ও।জরুরী রক্ত লাগবে তাই,মেহরাব রক্ত দেয়।আজ আর আফিয়ার সাথে কথা বলতে পারেনি শুধু অচেতন অবস্থায় দেখেছে।মনের মধ্যে এক অজানা ঝড় বয়ে যাচ্ছে।আর মনে মনে অনেক বার আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করে ফেলেছে
“হে আল্লাহ আমার আম্মিজান কে তুমি সুস্থ্য করে দাও”
ক্লান্ত শরির নিয়ে বাসায় ফিরে মেহরাব।মায়া ওর এই অবস্থা দেখে ভয় পেয়ে যায়।অস্থির মনে প্রশ্ন করে বসে।কিন্তু মেহরাব কোনো প্রশ্নের জবাব দেয় না।রুমে প্রবেশ করে কাঁধের ব্যাগটা রেখে ও ভাবে খাটে চিৎ হয়ে শুয়ে পরে।মায়া আর কিছু জিজ্ঞেস না করে একে একে জুতা মোজা টাই খুলে দেয়।কিছুক্ষণ পর মেহরাব মায়াকে ডাক দিলে মায়া কাছে আসে।
মেহরাব যে রক্ত দিয়েছে সেটা ওকে জানায়।মায়া এখন বুঝতে পারছে ওকে কেনো এতো ক্লান্ত লাগছিলো।এখন এই অবস্থায় রেস্ট দরকার ভালো ভালো খাবার খাওয়ানো দরকার।
ক্লান্ত শরির আর মন নিয়ে কোনো মতে ফ্রেশ হয়ে আসে।মায়া রুমেই খাবার নিয়ে আসে।মেহরাব খেতে বসলে মায়া নিজেই খাবার মেখে ওকে খাইয়ে দেয়।এতে মেহরাবের অশান্ত মনে একটু ভালো লাগার প্রশান্তি বয়ে যায়।মেহরাব বুঝতে পেরেছে এতোদিনে মায়া ওর মনটাকে খুব ভালো করেই চিনে নিয়েছে।কি করলে ওর মন ভালো হবে মায়ার অনেকটাই জানা হয়ে গেছে।
খাবার খেয়ে মেহরাব কে শুয়ে থাকতে বলে।কিন্তু মেহরাব মায়াকে পাশে চায়।ওর মনটা আম্মিজানের কাছে পরে আছে কিন্তু দেহের ও যে শান্তি দরকার।একটা ভালো ঘুমের দরকার যেটার দ্বারা ওর সব ক্লান্তি দূর হয়ে যাবে।মায়া ওর হাতের কাজ শেষ করে মেহরাবের কাছে আসে।খাটের সাথে হেলান দিয়ে ওর পাশে বসলে মেহরাব নিজ বালিশের থেকে মাথা তুলে মায়ার কোলে মাথা গুজে দু পাশ থেকে মায়াকে জড়িয়ে ধরে।
মায়া বুঝতে পারে এ অশান্ত মন সহজে শান্ত হবার নয়।পরম যত্নে মাথার চুল গুলোতে হাত বুলাতে থাকে।এখন মেহরাব অনেকটা আরাম পাচ্ছে,পরম সুখে চোখ বন্ধ করে আছে।ঘুম আসছিলো না কিন্তু এখন ঘুম ঘুম ভাব আসছে।
একটা সময় মেহরাব গভির ঘুমে আছন্ন হয়ে যায়।মায়া বুঝতে পেরে ওর মাথা কোল থেকে আলতো করে তুলে বালিশে শুইয়ে দেয়।কিন্তু ওর চোখে যে ঘুম ধরা দিচ্ছে না।অনেকক্ষণ শুয়ে থেকে এপাশ ওপাশ করে অবশেষে উঠে নিঃশব্দে বারান্দায় চলে যায়।
বারান্দায় থাকা বেলি ফুলের সুবাস ওর নাকে যায়।বাগানের বড়ো লাইটের আলোতে চারপাশ টা খুব সুন্দর দেখা যাচ্ছে।আফিয়ার কথা খুব মনে পরছে।অল্প দিনের যে ভালোবাসাটা ও পেয়েছে সেটা ভুলে যাবার মতো নয়।অত্যান্ত ভালো মনের মানুষ যেটা মুখে বললে কম হয়ে যাবে।এতো শক্ত সামর্থ কঠিন মনের মানুষ মেহরাব,অথচ আফিয়ার অসুস্থতার কথা শোনার পর থেকে কেমন জানি মনমরা হয়ে ভেঙ্গে পরেছে।যদি আফিয়ার কিছু হয়ে যায় তা হলে মেহরাব কে ও কি ভাবে সামলাবে?
বাবা মা ছারা এতিম হয়েও এতোবছর যার ছায়া তলে থেকে বড়ো হয়েছে আজ সেই মায়ের এমন অবস্থা দেখে কোনো সন্তানই শান্ত থাকতে পারবে না।এসব ভাবতেই ওর চোখ বেয়ে নোনা জল গড়িয়ে পরতে থাকে।একটা সময় ফুপিয়ে কান্না করতে থাকে।সেই কান্নার শব্দ মেহরাবের কান অব্দি পৌছে যায়।হঠাৎ মায়া ওর কাঁধে হাতের স্পর্শ পায়।তারা হুরা করে চোখ মুছে মেহরাবের দিকে ঘুরে দাড়ায়।মেহরাব ওর দু হাত মেলে ধরে মায়া এক সেকেন্ড থেমে থাকে না।ঝাপ দিয়ে ওর প্রশস্ত বুকের মাঝে মুখ লুকিয়ে নিজেও জড়িয়ে ধরে মেহরাবকে।ধীর কন্ঠে প্রিয়তমাকে বলে
“যতো পারো কান্না করো।তোমার চোখের নোনা জলে এই বুকটা ভিজিয়ে দাও।তা হলে আমার অশান্ত মনটাও কিছুটা হলেও শান্ত হবে প্রিয়”
মেহরাবের কথা শুনে মায়ার কান্নার রেশ টা বাড়তে থাকে।মানুষটাকে শক্ত করে ধরে শব্দ করেই কান্না করতে থাকে।
চলবে……..
#স্বর্ণকেশী_মায়াবিনী
#লেখনীতে-বর্ণ(Borno)
#পর্ব-২১
আফিয়া আনজুমের মৃত্যুর এক সপ্তাহ পার হয়ে গেছে।কবর জিয়ারত করে অনেকক্ষণ ধরে কবরের পাশে বসে থেকে বাসার উদ্দেশ্য রওয়ানা হয়েছে মেহরাব।একটা সপ্তাহ ধরে মেহরাব এই কাজটাই নিয়মিতো করে যাচ্ছে।
“অসুস্থ্য হওয়ার পর সর্বোচ্চ এক মাসের মতো আফিয়া বেঁচে ছিলো।পরিবারের সবাই আর মেহরাব নিজেও আফিয়ার চিকিৎসার কোনো ত্রুটি রাখেনি।ডাক্তার যেহেতু আগেই বলে দিয়েছিলো বিদেশে নিলেও তেমন ভালো কোনো ফল হবে না।রোগির কন্ডিশন এমনিতেই বেশ জটিল তাই দেশেই সব রকম চেষ্টা করা হয়।অবশেষে জীবনের ইতি টেনে আত্নীয় স্বজন ও পরিবারের মানুষজনদের ছেরে পরপারে চলে গেছেন।
এই কয়টা দিন যখন তখন মেহরাব ছুটে গেছে আম্মিজানের নিকট।প্রথম প্রথম অল্প কথা হতো কিন্তু শেষের দিনগুলোতে আর কথা বলতে পারেননি।মেহরাব কে দেখলে শুধু চোখের পানি ঝরাতো আফিয়া।মনে হতো অনেক কিছু বলতে চায়।ওকে কিন্তু কিছুই বলতে পারেনি।মেহরাব ও অধির আগ্রহ ভরা নয়নে আম্মিজানের পানে অপেক্ষায় থাকতো।শুধুমাত্র মুখ থেকে আব্বু ডাকটা শোনার জন্য।
নিজের জন্ম দাতা বাবা মা নেই সেটা নিয়ে কখন ও আফসোস করেনি মেহরাব।কিন্তু আজ বুকটা ফেটে যাচ্ছে আফিয়ার কথা ভেবে।বাবা মা দুজনের মায়া মমতা দিয়ে ওকে বড়ো করেছে।একটা বারের জন্য ওকে মৃত বাবা মার জন্য আফসোস করার মতো সুযোগ দেয় নি।আর সেই আম্মিজানও সারাজীবনের জন্য ওকে একা করে চলে গেছে।ভাবতেই বুকের মধ্যে হাহাকার করে ওঠে।”
নিথর দেহ আর ভারাক্রান্ত মন নিয়ে ঘরে প্রবেশ করে মেহরাব।মায়াকে পাশ কাটিয়ে ওর রুমের দিকে পা বাড়ায়।মনে হচ্ছে মায়া এক অদৃশ্য আত্না ওকে মেহরাব দেখেনি।মায়ার বুকটা কষ্টে ফেটে যায়।ওর এমন আচরন মায়াকে বেশ পো’ড়ায়।আফিয়ার মৃত্যুর পর থেকে এটাই করে আসছে মেহরাব।
চুল গুলো বাবরি টাইপ মুখ ভর্তি চাপ দাড়ি।নিজের কোনো যত্ন নেই।মায়া এসব করতে গেলে উল্টো ওকে নিজের কাছে ঘেষতে বারণ করে দিয়েছে।তাই মায়া আর ওর কাছে যায় না।কাছ থেকে এ সব দেখে মনে কষ্ট নিয়ে সয়ে আসছে সবটা।
যেদিন আফিয়ার মৃত্যু হয় সে দিন মেহরাব অফিসের গুরুত্বপূর্ণ মিটিং এ ছিলো।অনেক বার কল করার পর ফিরোজ রিসিভ করে সংবাদ টা পায়।কিন্তু সময় মতো দিতে যেয়েও পারে না।অবশেষে মিটিং শেষে মেহরাব কে বলা হয়।সবটা শুনে মেহরাব এর মাথা শূন্য হয়ে যায়।তখনই ছুটে যায় হাসপাতাল।আফিয়ার নিথর দেহ দেখে প্রথমে চুপ ছিলো।কিন্তু পর মুহূর্তে মেহরাব চিৎকার দিয়ে কান্না করতে থাকে।পুরো হাসপাতালের মানুষ জড়ো হয়ে যায়।
সময় মতো আসতে না পারায় নিজেকে দেওয়ালের সাথে বারং বার আঘাত করে।প্রথমে কপাল পরে হাত মুঠো করে।ফিরোজ সহ আরো কয়েক জন ওকে থামাতে বেশ বেগ পেতে হয়েছিলো।মায়া তো বেশ ভয় পেয়ে যায় ওর এমন পাগলের মতো আচরন দেখে।একটা ডাক্তার সেখানে এসে ওর অবস্থা দেখে সাথে সাথে ঘুমের ইনজেকশন পুশ করে দেয়।না হলে এ সময়ে হাইপার হয়ে খারাপ কিছু একটা হতে পারে এটা ডাক্তার সবাইকে বলে।
ইনজেকশনের মেয়াদ অল্প সময়ের ছিলো বিধায় আফিয়ার দাফনের আগেই ওর জ্ঞান ফিরে।এসময় সবাই আবার ওকে নিয়ে চিন্তা করতে থাকে।কিন্তু সবাই কে অবাক করে দিয়ে মেহরাব শান্ত থাকে।মাটি দেওয়ার আগ পর্যন্ত ও নিরব থাকে।দাফন কার্জ শেষ করে গোরস্থান থেকে বের হয় না।একে একে সবাই চলে যায় মেহরাব আর যায়না।বসে থাকে ওর আম্মিজানের কবরের পাশে।ফিরোজ ওর জন্য অপেক্ষা করতে থাকে।অনেক সময় পর মেহরাব বের হলে ফিরোজ ওকে বাসায় দিয়ে যায়।সেই দিনের পর থেকে মেহরাব কারো সাথে কথা বলে না।কেউ কথা বললেও কোনো উওর দেয় না।নিজের রুমে দিনের বেলা গেলেও রাতের বেলায় সারারাত আফিয়া এসে যে রুমে থাকতো সে রুমের ফ্লোরে শুয়ে রাত পার করে।
এ সব শুধু মায়া মেহরাবের আড়ালে দেখে যায়।আর নিরবে চোখের জল ফেলে।ভাবে অতিরিক্ত শোকে এমন করছে কিন্তু এক দিন না দু দিন না প্রতিদিনই এ সব করে যাচ্ছে।খাওয়া গদাওয়া ঠিক মতো করছে না।মাঝে মধ্যে মায়া জোড় করলে খেতো এখন তাও খায় না।মায়া এখন আর জোড় করে না।নিজেকে খুব তুচ্ছ মনে হয়।যে মেহরাব মায়া ছারা কিছু বোঝে না সে কিভাবে এমনটা করতে পারে?ওর মাথায় কিছু ডোকে না।তাই ইচ্ছে করেই আর মেহরাবের কাছে নিজেকে উপস্থাপন করে না।
সংসার আর স্বামীর চিন্তায় মায়ার দিনকাল ভালো যাচ্ছে না।আজকাল ভার্সিটিতেও যাচ্ছে না।মনে সুখ শান্তি না থাকলে লেখাপড়া মাথায় ডুকবে কেমনে।মন চাচ্ছে সব ছেরে ছুরে যে দিক মন চায় সেদিকে চলে যেতে।কিন্তু চাইলেও পারছে না।আফিয়া জীবিত থাকা কালিন তাকে মায়ার কথা দেওয়া লাগছে “মেহরাব কে একা রেখে কখনও যেনো কোথাও না যায়।এমনকি রাগ করে ও না”
এ সব ভেবেই মায়া দীর্ঘ শ্বাস ফেলে।
মেহরাবের এমন অবস্থার জন্য মায়া সুখে নেই এ সব শায়লা আর সিতারার চোখ এড়ায়নি।সারাদিন ওরা শ্বাশুড়ী বউ মিলে মায়াকে নানান কথা বলে মন ভালো করতে চায়।শান্তনা দিয়ে রাখে কিন্তু মায়া এ সব এক কান দিয়ে শুনে আরেক কান দিয়ে বের করে দেয়।দিনের দু বেলা জোড় করে ওরা দুজন ওকে খাইয়ে দেয়।কিন্তু রাত হলেই আর খাবার মুখ দিয়ে পেটে যায় না ওর।
একদিন শায়লা কাজ করছে আর কথা বলছে মায়া ড্রইংরুমের সোফায় বসে ওর কথা গুলো শুনছে।পরক্ষণে শরিরটা কেমন জানি খারাপ লাগছে।ভাবে রুমে গিয়ে বিশ্রাম নিবে।শায়লাকে বলে রুমের দিকে যেতে লাগলে উঠে দাড়ায়।কিন্তু সামনের দিকে আর কদম ফেলতে পারে না।মাথা ঘুরে ওখানেই পরে যায়।সিতারা শায়লার চিৎকার শুনে দৌড়ে আসে।সিতারা এসে এমন অবস্থা দেখে স্বামী আর ছেলেকে ডাক দেয়।ওর আসলে প্রথমে ওদের পরিচিতো ডাক্তার কে কল করে।ডাক্তার চেক আপ করে সে যেটা বুঝতে পারে তা হলে মায়া প্রেগনেট।খবরটা শুনেই উপস্থিত সবাই বেশ খুশি হয়।এখন ভয়ের কিছু নেই বলে ডাক্তার চলে যায়।কিন্তু মায়া যেনো প্রেগনেন্সি টেস্ট ল্যাব থেকে করায় এটার পরামর্শ ডাক্তার দিয়ে যায়।মায়ার জ্ঞান ফিরলে শায়লার আর তর সয় না।সাথে সাথে মায়াকে খুশির সংবাদ টা দিয়ে দেয়।মায়া তো শুনে খুশিতে কি করবে ভেবে পাচ্ছে না কিন্তু মেহরাবের কথা ভেবে মুখ কালো করে ফেলে।খবরটা শুধু শায়লা আর সিতারা জানে তাই মায়া ওদের বলে
-এই খবরটা যেনো মেহরাব এখনই না জানে।আমি পরে তাকে খবরটা দিয়ে চমকে দিতে চাই।
ওরা দুজন মায়ার কথায় রাজি হয়।মায়ার মনে চাচ্ছে এখনই ছুটে যেতে মেহরাবের কাছে।আর জড়িয়ে ধরে বলতে ইচ্ছে করছে
“জানেন আমাদের পরিবারে নতুন অতিথি আসছে।আমরা দু থেকে তিন জন হচ্ছি।”
কিন্তু ওর ইচ্ছা করলেই এখন বলা যাবে না।মনে মনে পরিকল্পনা করে সামনেই মেহরাবের একটা স্পেশাল দিন।আর ঐ দিনই ওদের জীবনের সবচাইতে বড়ো খুশির সংবাদ টা ও মেহরাব কে শুনিয়ে চমকে দিবে।এ সব কথা ভাবতেই আপন মনে পেটে হাত রাখে।এক অদ্ভুত অনুভূতি অনুভব হয়।ওর মাঝে বেড়ে উঠবে দুটি মানুষের ভালোবাসার ফসল।ও মা হবে ভাবতেই দু চোখ বেয়ে আনন্দ অশ্রু গড়িয়ে পরে।কিন্তু মানুষটার এই পরিবর্ত ?এটা ও কি ভাবে ঠিক করবে?উপর ওয়ালার কাছে সর্বোচ্চ দোয়া টুকু করে যেনো এর সমাধান দ্রুত হয়।আবার আগের মতো ওরা যেনো সুন্দর হাসি খুশি খুনশুটি ময় সংসার করতে পারে।
~~~~~~
ছুটির দিন মেহরাব নিস্তেজ হয়ে ঘুমাচ্ছে।মায়া ওর ঘুমন্ত মুখ খানি দেখছে।আজ কতো দিন হয় এই মুখে হাত দিয়ে ছুতে পারছে না।ঠোঁটের স্বাদ নিতে পারছে না।বাহু বন্ধনে নিজেকে আবদ্ধ করতে পারছে না।এতো কাছে হয়েও কতোটা দূরত্ব ভাবতেই হুকের মধ্যে মোচর দিয়ে ওঠে।কান্না সংবরন করে উঠে পরে।
“গতোকাল রাতে কি মনে করে মেহরাব অনেক রাতে নিজের রুমে এসে ঘুমায়।মায়া শোয়া অবস্থায় কিন্তু জেগে ছিলো।মনে মনে খুব খুশি হয় ওকে এখানে আসতে দেখে।মন চাচ্ছে জড়িয়ে ধরতে কিন্তু পারছে না।যাক এসেছে এটাই ওর জন্য অনেক।মনে একটু হলেও প্রশান্তির শীতল হাওয়া বয়ে যায়।কষ্ট কিছুটা লাগব করে ঘুমিয়ে যায় মায়া।”
আজ মায়া ক্লিনিকে যাবে।মেহরাব ঘুম তাই আর কিছু বলে না।থাক মানুষটা অনেকদিন শান্তিতে ঘুমায় না ছুটির দিন ঘুমাক ভেবে মায়া হাতে পার্স আর মোবাইল নিয়ে রুম থেকে বের হয়।শায়লা কে সঙ্গে নিয়ে সিতারাকে বলে বাড়ি থেকে বের হয়।আজ আর গাড়ি নেয় নি।রিক্সা করে দুজন বেরিয়ে পরে।ল্যাব টেস্ট করিয়ে সেখান থেকেও মায়া নিশ্চিত হয় ও সত্যিই মা হতে চলছে।শায়লা কে আনন্দে জড়িয়ে ধরে।শায়লা ওকে বলে
-ভাবি দেখবেন এই খবর শুইন্যা ভাইজান খুশিতে পাগ’ল হয়ে যাইবো।তখন এমন আর করবো না আপনেরে ও অনেক ভালোবাসবো।
-কি যে বলো না শায়লা
-হুম সত্যি কইছি আমার যহন বা’চ্চা হইবো হেইডা শুইন্যা উনি আমারে অনেক ভালো পাইতো।
বলেই লজ্জা পাওয়া ভাল করে।ওর কথা গুলো শুনে মায়া মুখ চেপে হাসে।
-এবার চলো শায়লা যেতে হবে।
ওরা আবার বাসায় চলে আসে।এসে দেখে মেহরাব এখনও ঘুম।মেহরাবের পাশে বসে ও।আনমনে ওকে দেখতে থাকে।আগের সেই চেহারা আর বর্তমানের চেহারার মধ্যে অনেক তফাৎ।নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে না।ওর মুখ ভর্তি দাড়ির ওপর হাত বুলাতে থাকে।মাথার বাবরি চুল গুলোতেও হাত বুলিয়ে দেয়।আরেকটু সাহোস করে কপালে অধর ছুইয়ে দেয়।দম ছেরে ভাবে নাহ আজ এ টুকুই থাক এতেই মনে হাজার গুন শান্তি মিলেছে।বসা থেকে উঠে প্রেগনেন্সি রিপোর্ট টা আলমারি ড্রয়ারে রাখতে যায়।
আলমারির ভিতরে একটা ড্রয়ার যেটা ব্যবহার করা হয় না।আর বাকি সব ব্যাবহার করা হয়।সেটা খুলে হঠাৎ ড্রয়ারে কিছু দেখতে পায়।এই ড্রয়ারটা ও কখন ও খুলে দেখেনি।আজ ভাবলো এখানে রাখি মেহরাবের চোখে পরবে না ভেবে।ড্রয়ারটা পুরো খুলে দেখে তার মধ্যে ওর ব্যাবহৃত চুলের খোপার কাঠি,একটা ওয়ান টাইম কফি কাপ,আরো দুটো কাটা ক্লিপ।এ সব দেখে হতভম্ব হয়ে যায় ও।কি রিয়েকশন দিবে ভুলে যায়।কিছু সময়ের জন্য স্থির হয়ে রয়।চুলের কাঠিটি হাতে নিয়ে ভাবতে থাকে এটাতো সেই কাঠি যেটা মেহরাবের সাথে প্রথম দেখা হয়েছিলো।ঐ দিন হারিয়ে ফেলেছিলো,তারমানে হারায় নি?খোপাটা তা হলে মেহরাব ই খুলেছিলো…?
চলবে…..
(লেখার ভুল ত্রুটি মার্জনীয়)