#স্বর্ণকেশী_মায়াবিনী
#লেখনিতে-বর্ণ(Borno)
#সূচনা_পর্ব
অপয়া হতোভাগী এইটা কি করলি?চোক্ষে দেহোস না দিলি তো আমার স্বর্বনাশ করে।এহোন শান্তি পাইছোস তো মনে?
কথা গুলো বলেই অগ্নি চোখে মায়ার দিকে তেরে আসছে ওর সৎমা আয়মন।ভয়ে চোখ বন্ধ করে ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছে মায়া।না জানি এখন কতো কি শুনতে হবে।তবে এ আর নতুন কি পান থেকে চুন খসতে দেরি হলেও আয়মন ওকে কথা শুনাতে দেরি করে না।
কিছুক্ষণ আগে,মায়া ফুরফুরে মনে ঘর থেকে বাইরে বের হতে গিয়ে খোলা বারান্দার এক পাশ থেকে কিছু একটা আনতে গিয়েছিলো।কিন্তু অসাবধানতা বশত উঁচু স্থানে রাখা পানি ভর্তি মাটির কলসিটাতে মায়ার ধাক্কা লাগে।তখনই কলসিটা বারান্দা থেকে নিচে পরে ভেঙ্গে যায়।আর আয়মন সেটা দেখেই রাগে মায়ার নিকট তেরে আসে।
সব সময়ের মতো একগাদা কথা শুনিয়ে দম নেয় আয়মন।মায়া কথা গুলো হজম করে বড়ো একটা দম ফেলে বলে “আর এমনটা হইবো না মা এবারের মতো মাফ করে দেও”আয়মন মেয়ের এমন কথা শুনে মুখ বাকিয়ে পিছন ফিরে বাইরের রান্না ঘরে ডোকে।মায়া ভাঙ্গা কলসির টুকরো গুলো গুছিয়ে বাড়ির পাশে ময়লা আবর্জনা ফেলার জায়গাতে ফেলে দিয়ে আসে।এ আর নতুন কি এসব কথা ও সবসময়ই শুনে থাকে আজও তার বযাতিক্রম হলো না।কিছু একটা হাতে নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয় মায়া।
মায়ার ছোটো বোন পুষ্প অনেকটা তারাহুরো করে বাপের কাছে ছুটে এসে বললো “বাজান তারাতারি আসো বুবু পুকুর পাড়ের বড়ো আম গাছের ডালে দড়ি দিয়া কিছু একটা করতাছে।ছোটো মেয়ের এমন কথা শুনে আবুল কাশেমের কিছুই বুঝে আসে না।কি হইছে জানতে চাইলে ছোটো মেয়ে তাকে জানায় “বাজান আইজ ও মায় বুবুরে অনেক বকছে আমার তো মনে হয় বুবু গাছের ডালের লগে দড়ি দিয়া গলায়..এই পর্যন্ত বলতেই কাশেম মিয়া মেয়েকে থামিয়ে দেয়।জমির কাজ বাদ দিয়ে তখনই উঠে পরে।এক মিনিট সময় নষ্ট না করে মেয়েকে সাথে নিয়ে রওয়ানা হয় বাড়ির পাশে পুকুর পাড়ের দিকে।মনে মনে আল্লাহর নাম জপতে থাকে।আর বলতে লাগে আল্লাহ খারাপ কিছু যেনো না ঘটে এ যাএায় মেয়েকে বাচিয়ে দাও।দোয়া দূরুত যা পারে পড়ছে।মা মরা মেয়েটা আর কতো দুঃখ কষ্ট ভোগ করবে।এই টুকু সময়ের মধ্যে মেয়েকে নিয়ে কাশেম মিয়া অনেক কিছু ভেবে ফেলেছে।
আম গাছের কাছে এসে কাশেম মিয়া দেখতে পায় গাছের যে ডালটা নিচের দিকে ঝুলে আছে সেটাতে একটা মোটা দড়ি এপাশ থেকে ওপাশে ফেলে দড়ির দুই মাথা হাতে ধরে গিঁট দিচ্ছে মায়া।কাশেম মিয়া দেরি না করে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে বলতে থাকে “মা’রে এমন কাম ভুলেও করিস না।তোরে আর কষ্ট পাইতে দিমু না।এই তোরে ছুইয়া কথা দিলাম।এতো দিন ধরে তোর মুখের দিক চাইয়া কিছু কইতে পারি নাই ।কিন্তু এহোন বুঝবার পারছি আমি ভুল করছি।এতোদিন ধইরা আমি আমার মা মরা মাইয়াডার প্রতি অনেক অন্যায় কইরা ফালাইছি।মারে তাই বইলা তুই মই’রা যাবি?এই অধম অক্ষম বাপটারে ক্ষমা কইরা দে মা।
এতোক্ষণ ধরে বাবার এ সব কথা বার্তা আর চোখের পানি ফেলার কারন বুঝে উঠতে পারছে না মায়া।আচমকা বাবার কি হলো সেটাই ভাবছে।মায়া ওর ছোটো বোন পুষ্প কে কি হইছে সেটা ইশারা করে জিজ্ঞেস করলে ও কিছু বলে না।কাশেম মিয়া এবার বলে ওঠে”চল মা বাড়িতে চল এইহানে আর থাকোন লাগবো না।পুষ্প ও বোন কে বললো”বুবু চলো এই জায়গাটা ভালা না বাড়িতে চলো।
বাবা আর বোনের কথার আগা মাথা কিছুই বুঝে আসে না ওর।ও তো এখানে দড়ি নিয়ে এসেছিলো একটা দোলনা বানাবে বলে।যদিও বোন কে কিছু বলেনি ভেবেছিলো দোলনা বানিয়ে পুষ্পকে দেখাবে আর ও খুব খুশি হবে তাই।
কাশেম মিয়া মেয়েকে সরিয়ে গাছে ঝুলানো দড়িটি খুলে নিজের হাতে নিয়ে দুই মেয়েকে নিয়ে বাড়ির দিকে রওয়ানা হয়।ছোটো মেয়ে সময় মতো আজ তারে খবর না দিলে হয়তো বড়ো কোনো অঘটন ঘটে যেতো।
মনে মনে কয়েক শত বার আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করে নেয়।আর বউয়ের প্রতি এতো দিনের পুষে রাখা চাপা রাগটা বাড়তে থাকে।মা মরা মেয়েটাকে সেই ছোটো থেকে এই পর্যন্ত তার দ্বিতীয় স্ত্রী দিনের পর দিন নি’র্যাতন করেই যাচ্ছে।আর না এর একটা ফয়সালা করেই ছাড়বে কাশেম মিয়া।
“আবুল কাশেম একজন কৃষক,এলাকার মানুষ তাকে কাশেম মিয়া বলেই জানে।হতোদরিদ্র কাশেম মিয়া বিয়ে করলে সেই ঘরে কন্যা সন্তান হওয়ার এক বছর যেতেই বউয়ের ডায়েরিয়া জনিত রোগে মৃ’ত্যু হয়।বলতে গেলে টাকা পয়সার অভাবে বিনা চিকিৎসায় বউ কে হারায়।মা ম’রা মেয়েকে নিয়ে কাশেম মিয়ার দিন কষ্টে কাটতে থাকে।মেয়ে সামলাবে নাকি জমিতে কাজ করবে?কাজ না করলেও মেয়েকে নিয়ে না খেয়ে দিনযাপন করতে হবে।তাই গ্রামের আশেপাশের মানুষ জনের কথায় আবার নতুন করে বিয়ে করেন কাশেম মিয়া।কিন্তু প্রথম প্রথম মেয়েকে ভালোবাসলেও আস্তে আস্তে সেটা কমে যায়।একটা সময় কাশেম মিয়ার দ্বিতীয় স্ত্রী দুই সন্তানের জননী হয়।কিন্তু প্রথম সন্তানটি বেচে নেই দ্বিতীয় সন্তানটিই পুষ্প।তবে প্রথম সন্তানটি ছেলে সন্তান ছিলো আর তার মৃত্যুর জন্য মায়াকেই দোষী মনে করে তার সৎ মা।আর তখন থেকেই মায়াকে একদমই সহ্য করতে পারেনা।
মায়া দেখতে যেমন সুন্দর তেমনি তার ব্যাবহার ও।শুধু তাই না লোকমুখে শুনেছে মায়া দেখতে ঠিক ওর মায়ের মতোই হয়েছে।কিন্তু মায়াকে দেখলে সবার মায়া হলেও সৎ মা আয়মনের মনে মায়ার জন্য কোনো মায়া নেই।সব সময় আয়মন মায়াকে অত্যা’চার করে থাকে আর দিনের পর দিন যেনো ওর ওপর অত্যা’চারের মাএা বাড়তেই থাকে।মায়া সব কিছু মুখ বুজে সহ্য করে নেয়।কখনও কিছু বলে না।এমনকি তিনবেলা খাবারও ঠিক মতো পায়নি কখনও।
কাশেম মিয়া মেয়ের পক্ষ নিয়ে কখনও প্রতিবাদ করতে গিয়েও করতে পারেনি কারন ,তার স্ত্রী আয়মন অভাবের সংসারে বাপের বাড়ির থেকে অনেক সাহায্য সহযোগিতা এনেছে।আর কাশেম মিয়ার ও কখনও এ বিষয়ে নিষেধ করেনি।তাই নিজের দূর্বলতা ভেবে বউয়ের ওপর কখনও কথা বলে সুবিধা করতে পারেনি বিধায় হাল ছেরে দিয়েছে।চোখের সামনে বড়ো মেয়ের সাথে এমন নির্দয় আচরন করাতেও মুখ ফুটে কিছু বলতে পারেনি।
তবে পুষ্প হয়েছে মায়ের আচরনের সম্পূর্ণ বিপরীত ধর্মী।ছোটো থেকেই পুষ্পের রয়েছে বোনের প্রতি অন্য রকম একটা মায়া।মায়াও পুষ্পকে অনেক ভালোবাসে।সৎ মায়ের এতো অত্যাচার সহ্য করেও সব ভুলে যায় পুষ্পের জন্য।পুষ্পের ভালোবাসার জন্য।মনে যতোই কষ্ট থাকুক শুধু বুবু বলে ডাক দিলেই মায়ার কষ্টে ভরা মনটা আনন্দে ভরে ওঠে।
আজ যখন মায়া পুকুর পাড়ে গাছের সাথে দড়ি নিয়ে কিছু একটা করছে সেটা দেখে পুষ্প বুঝতে পেরেছে আগের দিন ও মায়াকে বলেছিলো একটা দোলনা বানিয়ে দিতে।কিন্তু পুষ্প কাছে না গিয়ে মনে মনে একটা ফন্দি আটে।এই সুযোগ বাবাকে এমন কিছু বলবে যেটা শুনে কাশেম মিয়া বড়ো মেয়েকে নিয়ে যেনো একটু ভাবে।সব সময় বোনের ওপর অমানবিক অত্যাচার দেখে ও অভ্যস্ত ।আজ পর্যন্ত বাবাকে কখনও দেখেনি মায়ের ওপর কথা বলতে,তাই সেই সময় পুষ্পর মনে হয়েছিলো এটা করাই ওর উচিত।মায়া বড়ো হলেও জ্ঞান বুদ্ধির দিক দিয়ে পুষ্প এগিয়ে।মায়াও বুদ্ধিমতী তবে সেটা ওর মাঝে প্রকাশ পায় না বরং সব সময় চুপ থাকাটাই ওর অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে।
মায়া কলেজে পড়ে প্রথম বর্ষের ছাএী আর পুষ্প দশম শ্রেণিতে পড়ে।কাশেম মিয়ার সংসারে অভাব অনটন থাকলেও দুই মেয়েকে লেখা পড়া থেকে দূরে রাখেনি।তার ইচ্ছা ছেলে নেই তো কি হয়েছে মেয়েদের শিক্ষিত বানাবে।তার মতো কষ্ট যেনো মেয়েরা না করে।বাবার ইচ্ছা পূরনে দুই মেয়েই যথেষ্ট সচেতন।মায়ার থেকে পুষ্প লেখাপড়ায় মনোযোগী বেশি।
বাড়িতে এসে কাশেম মিয়া তার বউ আয়মন কে চিৎকার করে ডাকতে থাকে।অসময়ে স্বামীর ডাক শুনে বাইরের রান্না ঘর থেকে আয়মন শাড়ির আচলে হাত মুছতে মুছতে বের হয়।স্বামী চিৎকার করে কেনো ডাকছে জানতে চাইলে কাশেম মিয়া বউয়ের সামনে এসে বলে”আইজকার পর থেইক্যা যদি শুনি আমার বড়ো মাইয়্যার গায়ে হাত দিছোস আর বেশি কথা শুনাইছোস তাইলে তোরে আমি ভিটা ছাড়া করুম কইয়্যা দিলাম।”
হঠাৎ স্বামীর এমন রূপ দেখে আয়মন একটু ভরকে গেলো।সব সময় আয়মন স্বামীকে উঁচু গলায় কথা শোনাতো কিন্তু কাশেম মিয়া কখনও বউয়ের মুখের ওপর কিছু বলতে পারেনি ।আর আজ স্বামীর উঁচু গলার আওয়াজ আয়মনের মনে এক রাশ ভয় হানা দিয়েছে।কাছে এসে ঢোক গিলে নরম স্বরে বলতে লাগলো”কি হইছে আপনের ?আমি তো কিছুই বুঝবার পারছি না।”
বউয়ের কথা শুনে কাশেম মিয়া জবাব দেয়”তোর কিছু বুঝা লাগতো না আইজ আমার মাইয়্যা মই’রা গেলে তোরে বুঝাইতাম।
স্বামীর এমন কথায় যেনো আরো ভয় পেলো আয়মন।সকালেও অহেতুক কথা শুনিয়েছে সে মায়াকে।প্রতিদিনকার রুটিন হিসেবে মায়া সে সব শুধু শুনেছে কোনো প্রকার কথার প্রেক্ষিতে টু শব্দটিও করেনি।মায়ের সব কথা হজম করে না খেয়েই বাড়ি থেকে বের হয়েছিলো।হয়তো আয়মন এমনটাই চেয়েছিলো ।কিন্তু স্বামীর কথা শুনে আয়মন ভয় পাচ্ছে আবার মনে মনে ভাবছে ম’রে গেলে মানে কি ? তবে সরাসরি জিজ্ঞেস করার সাহোস হয়ে ওঠে নি আয়মনের।আজ আর স্বামীর কথার ওপর জবাব দেয়নি ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলো আর ভয়ের পাশাপাশি মনে মনে মায়ার প্রতি রাগ/জিদ টা বেড়ে চলছিলো।হয়তো আজকের কথা গুলো মায়া তার বাবাকে বলে সৎ মায়ের নামে নালিশ করেছে তাই স্বামী তার ওপর বেজায় চটেছে।
বাবা আর মায়ের এমন কথার মাঝে মায়া ওর বাবাকে টেনে দূরে সরিয়ে আনে।আর অন্যদিকে পুষ্প ওর মাকে যেতে বলে।আয়মন রান্না ঘরের দিকে যেতে লাগে আর কাশেম মিয়া পুষ্প কে বলতে থাকে “তোর মায় রে কইয়া দে ভালো হইয়্যা যাইতে না হইলে আমার চাইতে খারাপটা কেউ হইবো না কইলাম।
“বাজান মাথা ঠান্ডা করো মায়ের লগে এমন কথা কইয়ো না।কষ্ট পাবে।এ কথা বলে মায়া বাপের পাশে মাথা নিচু করে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।কাশেম মিয়া মেয়ের গালে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।”মারে অয় তোরে অনেক অত্যা’চার করে কিন্তু আমি কিছুই করবার পারিনি তোর লাইগ্যা।বাপের মতো বাপ হইতে পারিনাই আমারে মাফ কইরা দিস।বাবার এমন কথায় মায়ার বেশ খারাপ লাগে।”কি কও বাজান এ সব?আর কোনোদিন এমন কথা কইবা না।তুমি আমার একটা ভালো বাজান।বলে মায়া তার ওড়নার আচল দিয়ে বাবার চোখ মুছে দেয়।মা যতোই নির্যা’তন করুক না কেনো বোন আর বাবার এমন নিঃস্বার্থ ভালোবাসা আছে বলেই ও সব শারিরিক ও মানসিক দুঃখ কষ্ট ভুলে থাকে।মায়া সব সময় একটা কথা মনে প্রাণে বিশ্বাস করে ওর এই সৎ মা একদিন ওকে আদর করে ঠিক বুকে টেনে নিবে।নিজের মেয়ের মতোই ওকেও ভালোবাসবে।এ সব ভেবে মায়ার চোখ থেকে অজান্তেই জল গড়িয়ে পরে।
বুবু ঘরে চলো বোনের ডাকে চোখ মুছে নিজেকে ঠিক করে জবাব দেয় “তুই যা আমি একটু হাত মুখ ধুইয়া আইতাছি।
বারান্দার মেঝেতে খেজুর পাতার পাটি বিছিয়ে দুপুরের খাবার বেড়ে আয়মন স্বামী আর মেয়েকে ডাকতে লাগলো।কাশেম মিয়া এসে পাটিতে বসে পরে মেয়েদের জোড়ে ডাকতে লাগলেন।স্বামীর এমন কাজে আয়মন মোটেও খুশি হয় না।তখন পুষ্প মায়াকে ডাকতে ওর কাছে চলে যায়।
আয়মনের চাওয়া না চাওয়া আর অখুশিতে পুষ্প কখনও ভ্রুক্ষেপ করে না বরং ও সবসময় বোনকে সাথে নিয়েই খেয়ে থাকে।আয়মনের রাগ তখন পুষ্পের ওপর দ্বিগুন হতে থাকে।কাশেম মিয়া বউয়ের জন্য মেয়েকে সবসময় ডাকতে না পারলেও মনে মনে পণ করে রেখেছে আজকের পর থেকে সবসময় মায়াকে সাথে নিয়েই খাবে তাই আজ কয়েক বার মেয়েকে ডাক দিয়েছে ।পুষ্প আর মায়া এক সাথে এসে খেতে বসেছে।
আজ দেশি মোরগ রান্না হয়েছে তাই মায়া বেশ খুশি কিন্তু ওকে ওর পছন্দ মতো ভাত তরকারী দেয়নি ।আয়মন নিজ মেয়ে আর স্বামীকে বেশি করে খাবার তুলে দিচ্ছে।সেটা দেখে কাশেম মিয়া নিজ প্লেট থেকে মাংশ তুলে মায়ার প্লেটে দেয়।এতে আয়মন মনে মনে আরো ক্ষেপে যায়।মায়া খুশি মনে খেতে গিয়ে মায়ের দিকে নজর দিয়ে বুজতে পারে আয়মন বেশ রেগে আছে তাই ওর প্লেট থেকে মাংশ তুলতে গেলে কাশেম মিয়া ওর হাত ধরে থামিয়ে দেয়।শুধু তাই না পুষ্প নিজের হাতে আরো দু টুকরো মাংশ মায়ার পাতে তুলে দেয়।এতে যেনো আয়মনের নিজের কাছে মনে হলো কাটা ঘা’এ নুনের ছিটা দেওয়া হলো তাকে।
আয়মন ভেবে পায় না তার মেয়ে তার মতো না হয়ে বিপরীত স্বভাবের কেনো হলো?তার তো মায়ার ভালো কোনো কিছুই সহ্য হয় না।সে চায় মায়াকে সবাই তার মতোই ঘৃণা করুক।ওর যেনো কোনো কিছুতেই ভালো না হয়।নিজ মেয়ের জন্যই সব সময় চিন্তা করে।আর এই মেয়ে কিনা মায়ের ওপরই খবরদারি করে?ঠিক আছে এর একটা বিহিত করেই ছারবে ।মনে মনে বড়ো একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে আয়মন।মায়াকে খুব শিগ্রই বাড়ি থেকে বিদায় করতে হবে তা হলেই আয়মনের মনে শান্তি মিলবে তার আগে নয়।
বাড়ির সামনে দিয়ে একটা ছোটো খাল বয়ে গেছে।খালে উঠা নামার জন্য একটা অংশে কাঁঠ দিয়ে ঘাট বাঁধানো।যেমনটি পাকা করে সিঁড়ি বাঁধানো থাকে তবে এটা কাঠের হওয়াতে বেশ চওড়া করে বানানো।এখানে ধোয়া মোছা সহ অনেকেই তাদের প্রতিদিনের গোসল সেরে নেয়।
ঘাটের সর্বনিম্ন কাঠের সিড়িতে বসে আছে মায়া।কোমর এর নিচ অব্দি চুলের দৈর্ঘ্য।চুল গুলো ছেড়ে দিয়ে দু পায়ের টাকনু পর্যন্ত পানিতে চুবিয়ে রেখে এক মনে আকাশ দেখায় ব্যাস্ত রমনী।
পরন্ত বিকেলের গোধূলীর রাঙ্গা আলোয় আসমান ছেয়ে আছে।মুহূর্তটা সত্যিই মনোমুগ্ধকর ,তবে এ সময়টা দেখে কেউ অনেক আনন্দ পায় আবার কেউ একজন মনের দুঃখ কষ্ট গুলো মুছে দেবার জন্য মন খারাপের দিন গুলোতে এখানেই বসে বসে আসমান দেখে।আর সেটা মায়া নিজেই।আজ ও বসে আসমানের পানে চেয়ে মায়ের কথা ভাবছে।এই নিষ্ঠুর দুনিয়াতে ওকে একা রেখে না গেলে এতো কষ্ট পেতে হতো না।বিরবির করে বলছে “মা আমারে সাথে নিয়া যাইতা তা হলে আমিও তোমার মতো আকাশের তারা হয়ে থাকতে পারতাম।”এ সব ভাবতেই মনের অজান্তে টুপ করে চোখের কার্নিশ বেয়ে নোনা জল গড়িয়ে পরতে লাগলো।মন চাচ্ছে চিৎকার করে কান্না করতে কিন্তু পারছে না।তাই নিরবে কান্না করে যাচ্ছে।
কারোর হাতের স্পর্শে বাম হাতের পিঠ দিয়ে চোখের জল মুছে নেয়।ও জানে কে এসেছে।এখন ওর খুঁজে একমাএ পুষ্পই আসতে পারে আর সত্যিই পুষ্প এসেছে।
“বুবু তুমি এইহানে?আর আমি খুজতাছি যে।
“কিছু বলবি ?
“হুম তুমি জানো না এহোন সন্ধ্যা হওয়ার পালা এই সময় ভূত পেত্নী চলাফেরা করে আর তুমি চুল খুলেই বসে আছো?
“তো কি হয়েছে?
“কি হয়েছে মানে ধরে নিয়ে যাবে যে।আমার বুবুর যেই সুন্দর চুল এইডা দেখলেই তো কোনো ছেলে ভূত আমার বুবুর প্রেমে পইরা যাইবো।
মায়া মুচকি হেসে বোনকে বলতে লাগলো”তাও তো ভূতে ধরবে কোনো মানুষে তো না।
“বুবু শোনো এমন কথা কইয়ো না তুমি যেই সুন্দর আর তোমার চুল গুলোর কি সুন্দর রং একেবারে বিদেশীদের মতো লাগে তোমারে দেখতে ।যে কেউ তোমারে দেখলে এক দেহোনে পাগল হইয়া যাইবো।কথাটা শুনে মায়া বোনকে বলে
“অনেক দুষ্টু হয়ে গেছোস।
“সত্যি কইছি বুবু কিন্তু দেখো আমারে দেখলে মনে হয়না তোমার বোন আমি।তুমি কতো ফর্সা আর আমি শ্যাম বর্ণের কথাটা বলেই পুষ্পর মন খারাপ করে।
বোনের থুতনি ধরে সামনে ফিরায় মায়া।”এমন কথা আর কইবি না।আমার বোন আমার কাছে সবচাইতে সুন্দর আর আমি তোকে অনেক ভালোবাসি।কথাটা মনে থাকবে?
“হুম থাকবে বুবু।বলে বোনকে পাশ থেকে জড়িয়ে ধরে।
“জানো বুবু আমি না সবসময় একটা দুয়া করি
“কি দুয়া?
“কোনো এক রাজপুএ তোমার জীবনে আসবে আর তোমারে এক দেখায় পছন্দ করবে শুধু তাই না একে বারে বিয়া কইরা সাথে করে তার রাজ্যে নিয়া যাইবো।
“ধূর পাগলী আমাগো মতো গরীবের জীবনে এমন টা হয় নাকি?আর না আইবো কোনো রাজপুএ।এ সব স্বপ্নেই মানায় বুঝলি।
“কিন্তু বুবু তুমি দেইখো এমনটিই হইবো সেদিন মিলিয়ে নিও।
“হইছে অনেক স্বপ্ন দেখা এহোন চল বাড়ি যাই।
“চলো বুবু।
——
মিষ্টি সকালের ঝলমলে রোদের ঝলকানিতে মুখরিত চারদিক। রুমের জানালা গুলো বন্ধ তাই মিষ্টি রোদ তার আগমনের বার্তা শুধু বাহিরেই দিচ্ছে রুমের ভেতর আর ডুকতে পারছে না।মোটামুটি অন্ধকার রুমটিতে কেউ একজন গভির ঘুমে মগ্ন।তার ফোনে ভাইব্রেশন হয়েই যাচ্ছে ।কিন্তু ফোনের মালিক মোটেও টের পাচ্ছে না,অনেক রাত করে ঘুমাবার দরুন ঘুম ভাঙ্গছে না।দু থেকে তিন বার রিং হয়ে বন্ধ হবার ঠিক চারবারের সময় কল আসতেই ফোনের মালিক এবার কলটি রিসিভ করে।অপর প্রান্ত থেকে বড়ো গলায় সালামের শব্দ ভেসে আসলে ঘুম জড়ানো কন্ঠে খুব সুন্দর করে সালামের জবাব দেয় কল রিসিভকারী।
ওপর প্রান্ত থেকে বলতে লাগলো”স্যার এখানের সব কিছুর বন্দোব্যাস্ত করে রেখেছি আপনি কি কাল আসবেন?
কথাটা শুনে সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলো হা কাল আসছি আর ওখানের সবাইকে বলে রাখবেন মীর মেহরাব হুসাইন কালই ঢাকা থেকে ফুলপুরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে যাবে” কথাটা বলেই কল কেটে দিয়ে আবারো বালিশে মাথা রেখে গভির ঘুমে তলিয়ে যায়।হয়তো আরো কয়েক ঘন্টা তার ঘুমের প্রয়োজন।”
চলবে……
(ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন)