#গল্পপোকা_ধারাবাহিক_গল্প_প্রতিযোগিতা_২০২০
স্বপ্ন সারথি পর্ব: ০৭
টি এ অনন্যা
রিয়ানা, তিয়াশা এবং পূর্ণতা একই ঘরে ঘুমানোর প্রস্তুতি নেয়। কিন্তু তিনজন শুয়ে গল্প আড্ডায় মেতে ওঠে। তিয়াশা এবং রিয়ানা এক বছরের ছোট বড়। তাই তাদের সম্পর্কটা সব সময় ভালো বন্ধুর মতো। তাছাড়া পূর্ণতাও তিয়াশার চেয়ে মাত্র দুই বছরের বড়। তিয়াশার সাথে পূর্ণতার এর আগেও যতবার দেখা হয়েছে তাতে তারা খুব ভালো বন্ধু বলাই চলে। তবে ততটা কথা হয়নি কখনও তাদের।
রিয়ানা এবং পূর্ণতা তিয়াশাকে চেপে ধরে তার প্রেমের গল্প বলার জন্য। যদিও রিয়ানা সেই প্রথম থেকেই সব জানে। তবুও আজ পূর্ণতার সাথে নিজেও নতুন করে শুনতে চাইছে। দুজনের কবলে পড়ে আর রক্ষা নেই বেচারি তিয়াশার। তাছাড়া আজ নিজে থেকে এমনিতেও সে খুব খুশি। পাঁচ বছরের ভালোবাসার সম্পর্কের পূর্ণতা পেল আজ। আর কিছুদিন পর চিরকালের মতো তার ভালোবাসার মানুষটা একান্তই নিজের হয়ে যাবে। তাই তিয়াশা খুশি মনে রিয়ানা এবং পূর্ণতাকে তার ভালোবাসার সফল গল্প শুনায়।
বহুদিন পর দু’বোন দেখা হলো তাই শাহানাজ ছেলে আর স্বামীকে ঘুমানোর ব্যবস্থা করে দিয়ে বোনের কাছে আসেন। আজ রাতটা বোনের সাথেই ঘুমাবেন তিনি।
“যাক আলহামদুলিল্লাহ আপা তোমার এক মেয়ের চিন্তা দূর হলো। এখন বিয়েটা ভালোয় ভালোয় হয়ে গেলেই শুকরিয়া।”
শাহানাজের কথার জবাবে তার বড় বোন শায়লা উত্তর দিলেন, “হুম আলহামদুলিল্লাহ । ওর বাবা মারা যাওয়ার পর মেয়ে দুটো নিয়ে কত চিন্তায় ছিলাম! আল্লাহ আমাকে দুটো সোনার টুকরো মেয়ে দিয়েছিল তাই রক্ষে। মানুষের মতো মানুষ করে বড় করতে পেরেছি। নাহয় তো সমাজের কত মানুষের কত কথা শুনতে হতো।”
“এবার রিয়ানাকে নিয়ে কিছু চিন্তা করো। ও তো চাকরি করে পড়াশোনা শেষ। এখনই উপযুক্ত সময় বিয়ে দেওয়ার জন্য।”
“দেখি আগে ওর সাথে কথা বলে ওর কোনো নিজের পছন্দ আছে কিনা? যদি না থাকে তবে ভালো একটা ছেলে পেলেই ওকেও বিয়ে দিয়ে আমার দায়িত্ব পালন করব।”
শাহানাজ নিজের ছেলের জন্য চাইছিলেন রিয়ানার মতো একজন প্রতিষ্ঠিত এবং সুশিক্ষিত মেয়ে। তাই নিজে থেকেই রিয়ানার বিয়ের কথা তুললেন। কিন্তু এখন দ্বিধা-দ্বন্দে ভুগছেন কী করবেন তিনি? ছেলের জন্য রিয়ানাকে চাইবেন নাকি কিছুদিন অপেক্ষা করবেন?
শাহানাজ এসব ভাবতে ভাবতে বলেই দিলেন কথাটা, “আপা তোমার রিয়ানাকে কিন্তু আমার বড্ড পছন্দ। তুমি চাইলে আমার ঘরের লক্ষী করে নিতে পারি। অনিকেরও বেশ পছন্দ রিয়ানাকে।”
শায়লা বেশ অবাক হয়েই জিজ্ঞাসা করলেন, “মানে কী? বুঝলাম না তোর কথা।”
“আপা তুমি কী ভুলে যাচ্ছ আমার প্রিয়ন আছে। ওকেও তো বিয়ে করাব ভাবছি আমরা। আর মেয়ে যদি নিজেদের মধ্যে হয় তাহলে তো বেশ ভালোই হয়। তোমাদেরও জানা শুনা আছে আমার প্রিয়নকে।”
“তা ঠিক আছে কিন্তু প্রিয়ন এবং রিয়ানা ওরা তো একে অপরকে ভাই-বোনের মতো দেখে। ওরা কী চায় তাও তো আমাদের জানা দরকার। তাছাড়া ওদের কোনো পছন্দ অপছন্দ থাকতেই পারে।”
“প্রিয়নের ব্যাপার ছেড়ে দাও আমার উপর। ওকে আমি বললে ও আমার কথা ফেলতে পারবে না।”
“আচ্ছা আমি দেখি আগে রিয়ানার সাথে কথা বলে। মেয়ে বড় হয়েছে। ওর মতামতের বাইরে আমি কিছু করর না।”
“আচ্ছা তুমি তাহলে কথা বলে দেখো আর আমিও প্রিয়নের সাথে কথা বলব।”
তিনজন পাশাপাশি শুয়ে গল্প করছিল। গল্পের প্রধান বক্তা ছিল তিয়াশা আর স্রোতা ছিল পূর্ণতা। মাঝেমধ্যে দুষ্টুমি করছিল তিনজনের মাঝে থাকা রিয়ানা। তিয়াশার ভালোবাসার পূর্ণতায় অনেক বেশি খুশি হয় পূর্ণতা। কিন্তু খুশিটা চোখের কোণে অশ্রু হয়ে জ্বলজ্বল করে। তিয়াশা গল্প করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়ে টের পায় না। রিয়ানা আগে থেকেই তিয়াশার এই অভ্যাসের সাথে পরিচিত। এমনকি প্রেম করা চলাকালীন সে তার বর জাহিদের সাথে কথা বলতে বলতে ঘুমিয়ে যেত।
কথা বলতে বলতে অনেক রিয়ানা অনেকক্ষণ তিয়াশার শব্দ না পেয়ে হাসতে হাসতে রিয়ানার বলল, “দেখেছ পূর্ণতা, আপুর কাণ্ডটা। কথা বলতে বলতে কেউ কি করে যে ঘুমাতে পারে আপুকে না দেখলে আমি কখনো বুঝতেই পারতাম না।”
রিয়ানার কথার কোনো সাড়াশব্দ দিচ্ছিল না তাই পূর্ণতার দিকে ফিরে দেখল পূর্ণতার চোখ ছলছল করছিল এবং অন্যমনস্ক ছিল।
রিয়ানা পূর্ণতাকে হালকা করে ধাক্কা দিয়ে জিজ্ঞাসা করল, “কী হয়েছে তোমার? এনি প্রোবলেম?
পূর্ণতা চোখ টিপে নিজেকে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক করে বলল, ” আরে না কী বলো? কী হবে আমার আবার? আপু কী ঘুমিয়ে গেছে?”
রিয়ানা উঠে বসে পূর্ণতার হাত ধরে বলল, “হুম ঘুমিয়েছে। ওঠো তো একটু ছাদে যাব।”
পূর্ণতা বিস্ময় ভরা দৃষ্টি নিয়ে বলল, “এই পাগল হয়ে গেলে নাকি? এত রাতে ছাদে কেন যাবে? আন্টি জানলে বকা দিবে। অনেক রাত হয়েছে। চুপ করে ঘুমাও। তিয়াশা ঘুমিয়েছে। আমাদের কথার আওয়াজে ও জেগে যাবে।”
রিয়ানা গলার স্বরে কাঠিন্যতা এনে বলল, “এজন্যই তোমাকে বলছি আসো আমার সাথে। তোমার সাথে আমার কথা আছে। এখানে বললে আপু জেগে যাবে।”
পূর্ণতা কিছু বলতে নিলে তার মুখ চেপে ধরে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে নিজে খাট থেকে চুপিচুপি নেমে ওকেও টেনে নামায়। এরপর আস্তে আস্তে ঘরের দরজা খুলে বিড়ালের ন্যায় পা টিপে টিপে বাইরে বেরিয়ে সোজা ছাদে চলে যায়। দো-তলা ভবনের উপর ছাদটা বেশ সুন্দর গাছপালায় ভরা। বিভিন্ন ফুলের গাছের সমারোহ। চাঁদনি রাত হওয়ায় সবকিছুই যেমন দিনের মতো স্বচ্ছ দেখা যাচ্ছিল।
রিয়ানা একহাতে পূর্ণতার কাঁধে ধরে এবং অন্যহাতে রিয়ানার ডান হাত চেপে ধরে হাটতে হাটতে ছাদের এক কোণায় নিয়ে যায়। রিয়ানা নিজে ছাদের রেলিঙ ধরে দাঁড়িয়ে পূর্ণতাকে সামনে দাঁড় করিয়ে তার দু’কাঁধে হাত রেখে আকুতি স্বরে বলল,
“পূর্ণতা তুমি আমার বড় বোনের মতো। যদিও আমি তোমায় সর্বদা নাম ধরেই ডাকি। কারণ তুমি আমায় সেই অধিকারটা দিয়েছ। কিন্তু তুমি কি জানো তুমি শুধু আমার বন্ধু নও তুমি আমার বড় বোন?
পূর্ণতা বলল, ” হুম জানি তো। কিন্তু কী হয়েছে তোমার। এভাবে কেন কথা বলছ?”
“কিছু হয়নি। আগে আমার কথা শেষ করতে দাও।”
পূর্ণতা ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি নিয়ে বলল, “আচ্ছা ঠিক আছে ম্যাডাম। আপনি বলুন আমি শুনছি।”
রিয়ানা পূর্ণতার দু’হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল, “আমি তিয়াশা আপুকে যতটুকু ভালোবাসি তোমাকে তার থেকে এক বিন্দুও কম নয়। আজ আমি তোমার ছোট বোন হয়ে তোমার কাছে একটা জিনিস জানতে চাইব। প্লিজ না করবে না। বলো আমায় সব বলবে?”
পূর্ণতা বুঝতে পারছে না রিয়ানা কী জানতে চাচ্ছে? তাই দ্বিধায় পড়ে যায় কী উত্তর দিবে সে এখন? তাকে কিছুক্ষণ নিরব থাকতে দেখে পূর্ণতা আবার বলল, “এই আপু বলো না আমার এই চাওয়াটা পূর্ণ করবে আজ।”
পূর্ণতা বলল, “আগে তো বলো কী জানতে চাও? সেটা যদি আমার জানা থাকে অবশ্যই বলব তোমায়।”
রিয়ানা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, “হ্যাঁ অবশ্যই তুমি তা জানো আমি যা জানতে চাই। তোমার অজানা কিছু জানতে চাইব না।”
পূর্ণতা উত্তরে বলল, “হুম বলো, তুমি কী জানতে চাও। আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করব তোমায় সব উত্তর দিতে।”
রিয়ানা দৃঢ়কণ্ঠে বলল, “আমি তোমার অতীত জানতে চাই। তোমার বমর্ষতার কারণ জানতে চাই। তোমার চোখের সুপ্ত ভাষাতেই কী নির্মমতা লুকায়িত তা জানতে চাই। এগুলো তো নিশ্চয় তোমার অজানা নয়।”
“আমার কণ্টকাকীর্ণ অতীত থাকুক না আমার কাছেই। প্লিজ বাদ দাও ওসব।”
“হুম তোমার কাছেই তো থাকবে। আমি তো নিয়ে যাব না তোমার অতীত । কিন্তু আমি জানতে চাচ্ছি কী ছিল তা যার কারণে তুমি আপসেট থাকো প্রায়শই ?”
পূর্ণতা কৃত্রিম হাসি নিয়ে বলল, “আরে কী বলছ! আমি তো ঠিকই থাকি সবসময় হাসি-খুশি।”
“হ্যাঁ, তুমি হাসি-খুশি থাকো। কিন্তু তা মন থেকে নয়। আমি এই দেড় বছরে তোমাকে খুব ভালো করেই চিনেছি। তোমার মুখে হাসি থাকে কিন্তু তাতে কোনো প্রাণ থাকে না। তুমি খুশি থাকো কিন্তু মন থেকে নয়। তোমার কষ্ট গুলো আমি উপলব্ধি করতে পারি অনুভব করতে পারি। প্লিজ আমায় সব শেয়ার করো। ছোট বোনের সাথে শেয়ার করলে তোমার হালকা লাগবে।”
পূর্ণতা নিজের হাত দুটো রিয়ানার হাত হতে ছাড়িয়ে নিয়ে ছাদের অন্য পাশের রেলিঙে দাঁড়িয়ে আকাশ পানে তাকিয়ে বলল, “কিছু কিছু কষ্ট স্মৃতি হয়ে থাকে জীবনের পটভূমিতে। আর স্মৃতি কিংবা অনুভূতিগুলো বুকের ভেতর জমা রেখেও শান্তি আছে। কারণ তা আমায় হারিয়ে যাওয়া মানুষটাকে কখনো ভুলতে দিবে না। কিন্তু যদি তা শেয়ার করা হয় তবে কষ্ট হালকা হয়ে স্মৃতিগুলো হারিয়ে যায়।”
পূর্ণতার মুখে হারিয়ে যাওয়া মানুষ কথাটি শুনে রিয়ানা অবাক হয়ে যায়। বিস্ময় নিয়ে পূর্ণতার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করল, “হারিয়ে যাওয়া মানুষ মানে! তুমি কী কাউকে ভালোবাসতে?”
পূর্ণতা হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়িয়ে বলল, “হুম”
রিয়ানা উৎসুক হয়ে আবার জিজ্ঞাসা করল, ” সত্যি! কে সে?”
চলবে………….