আমার অত্যন্ত রক্ষনশীল বাবা যে আমাকে ভার্সিটির দরজায় পা রাখতে দেবেন তা আমার স্বপ্নেরও অতীত ছিল। বড় দু বোনের কলেজ না পেরুতেই বিয়ে এবং বাড়ির পরিবেশগত কারণে আমি জানতাম আমার বিয়েও হয়ে যাবে শিগগিরই। মনে মনে মানতে পারতামনা। আমার যে বড় পড়ার শখ। দেখতে শুনতে তত খারাপ না হলেও রোগা পটকা ছিলাম বলেই বুঝি তেমন কোন বিয়ের প্রস্তাব না আসাতে আমি বেঁচে যাই। তার ওপর ঢাকা ভার্সিটিতে কেমিস্ট্রিতে সুযোগ পেয়ে যাওয়াতে বাবা আর দ্বিমত করেননি। তবে আমার প্রতিদিনই আতংকে কাটতো এই বুঝি ধরে কারো সাথে বিয়ে দিয়ে দিল। আমার মনে হতো কোনরকমে অনার্স শেষ করে একটা চাকুরী নিতে পারলে আমি বাসা থেকে পালিয়ে যাব। আমার বড় শখ মাস্টার্স করে বিসিএস দিয়ে সরকারী কলেজের শিক্ষক হওয়ার। শুধু বাবাকে না মতান্তরে পুরো পরিবারকে দেখিয়ে দেয়া মেয়ে মানেই বিয়ে দিয়ে বোঝা পার করা না।
তবে বললেই তো আর সবার ভাগ্যের শিকে তার মনের মতে করে ছেঁড়েনা। আর তাই দ্বিতীয় বর্ষের ক্লাস শেষে একদিন বাড়ি ফিরতেই দেখি পুরো বাড়ি ভর্তি মেহমান। আমার আর বুঝতে বাকী থাকেনা ঘটনা কি? নিজের ঘরে ঢুকতে ঢুকতে জেনে গেলাম জনৈক অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী পাত্রের সাথে আমার বিবাহ। সত্যি বলতে কি আমি মন খারাপ করলেও খুশী হলাম এই ভেবে শ্বশুরবাড়ি চলে গেলে হয়তো পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়া সহজ হবে। আমার মতামতের বা পছন্দের কোন তোয়াক্কা না করেই তিন কবুলে সেই রাতেই বিয়ে হয়ে গেল নোমানের সাথে। আর আমাকে দেশে রেখে তিনদিনের মাথায় নোমান চলে গেল অস্ট্রেলিয়াতে।
আমার ছেলে একা একা থাকে, কি না কি খায়, কেমনে জানি দিন কাটে শাশুড়ি মায়ের ইত্যাকার কথার মায়ায় আমাকে শ্বশুরবাড়ি তুলে নেয়ার পরিবর্তে কয়েক মাসের মধ্যে অস্ট্রেলিয়ার প্লেনে তুলে দেয়া হয়। যেন ওনার ছেলে নাদান বাচ্চা, তার দেখভালের জন্য সুদূর বাংলাদেশ থেকে বৌ নামক কাউকে না পাঠালেই হচ্ছেনা। বাবার বাড়ির সবাই দারুন খুশী পরিবারের প্রথম কেউ বিদেশ যাচ্ছে। শ্বশুরবাড়ি খুশী ছেলের রান্না খাওয়ার লোক পাঠানো যাচ্ছে। শুধু আমার মনে নিজের স্বপ্নভঙ্গের নিদারুন জ্বালা। কেমন ছেলে নোমান? একবার ভাবলো পর্যন্ত না আমার পড়াটা শেষ হলে আমার একটা যোগ্যতা হতো। বিদেশের মাটিতে তার পাশাপাশি কাজ করার একটা সুযোগ থাকতো। নিশ্চিত আমার বাবার মতোই তারও মানসিকতা। আর তাই বিয়ের পরপর ও বিদেশ থেকে ফোন করলেও আমি কোন কথাই তেমন বলতাম না বা বলা চলে বলার কোন আগ্রহই হতোনা।
বিদেশে নিজের সংসারে এসে দেখলাম নোমান ঠিক আমার বাবার মানসিকতার না। ও চেয়েছিল আমি পড়া শেষ করে আস্তে ধীরে গুছিয়ে আসি। পুরোটাই ওর মা মানে আমার শাশুড়ীর কারসাজি। ওনার মনে কেন যেন ভয় ঢুকেছিল ছেলে না কোন সাদা চামড়ার মেয়েকে বিয়ে করে ফেলে? প্রথম প্রথম মন খারাপ থাকলেও আস্তে আস্তে নিজেকে গুছিয়ে নেই। মনকে প্রবোধ দেই ভাগ্যে থাকলে হয়তো এদেশেই কখনো পড়াশোনার সুযোগ মিলবে। প্রথম কয়েক সপ্তাহ কিছু না বললেও আস্তে আস্তে নোমান মুখ খোলে। একাউন্টিং বিষয়ে পড়াশোনা করে পার্মানেন্ট রেসিডেন্সির আবেদন করলেও এই বিষয়ক কোন চাকুরী সে পায়নি। অর্থাৎ কামলা দিয়ে তার জীবন চলে। এতোদিন একা ছিল বিধায় চালিয়ে নিতে সমস্যা হয়নি, কিন্তু দুজনের সংসার, ঘর ভাড়া চালিয়ে নিতে সে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে। আমি যদি কোন কাজে ঢুকি তবে তার উপকার হয়। আমার এই পড়াশোনার যোগ্যতায় কে আমাকে কি কাজ দেবে; কিচেন হ্যান্ড বা ওরকম কোন চাকুরী ছাড়া?
নোমানের উদ্যোগেই পেয়ে যাই একটা চেইন শপে নাইট ফিলারের কাজ। শুনতে বেশ বাহারী নাম হলেও এ কাজের মানে হচ্ছে রাতে যখন দোকান বন্ধ থাকে তখন শেলফে নতুন করে জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখার কাজ। রাতের দশটা থেকে ভোর চারটা পর্যন্ত কাজ। শুরু হয় আমার রাতের জীবন। কাজের বিনিময়ে পাওয়া অর্থ কাজে লাগে সংসারে স্বচ্ছলতা আনতে। স্বপ্ন দেখার সময়ে জেগে জেগে কাজ করতে করতে আমার পড়ালেখা করে বড় কিছু হওয়ার স্বপ্নরা দিনে দিনে তলিয়ে যায় জীবনের অতল গহীনে।
দুজনেই কাজ করাতে ঘরে এখন স্বাচ্ছন্দ্য আছে, সুখ আছে। সময়ের আর জীবনের প্রয়োজনে তার সাথে লোকের কথায় নতুন কেউ জীবনে আসা দরকার হয়ে পরে। সমস্যা হয়না কোন। বছর ঘুরে আমার কোলজুড়ে আসে আমার ছেলে। সরকার থেকে বাচ্চার জন্য পাওয়া ভাতা আর নিজেদের সঞ্চিত অর্থ দিয়ে নিজেরা সামলে নিলেও স্বচ্ছল ভাবটা দিন দিন কমে যাচ্ছিল। ফলাফল ঘরে নিত্য খিটিমিটি। নোমানই বললো তার মা কে কিছুদিন এনে রাখবে কি না নয়তো আমার মা কে? তাহলে একটু উপকার হয়তো হতেও পারে। আমাদের পড়ালেখা না করানোর ব্যাপারে বাবার সাথে মায়ের ও সায় ছিল দেখে মায়ের ওপর আমার একটা চাপা ক্ষোভ সবসময়ই আছে। তাই সিদ্ধান্ত হলো আমার শাশুড়ীই আসবেন আপাতভাবে সবকিছু সামাল দিতে।
আমি নিজে কখনো শ্বশুরবাড়িতে সেভাবে থাকিনি দেখে ভাবলাম শাশুড়ি মা এসে সব বুঝে নেয়া পর্যন্ত ওনার যতটা যত্ন সম্ভব করবো। উনি আসার সপ্তাহ দুয়েক পর থেকে আমি কাজে যাব আবার সেরকমই প্ল্যান। এই দুসপ্তাহ আমি যতোটা সম্ভব ওনার সেবা করলাম। তারপর আমার কাজ শুরু হওয়ার পর আর সেটা সেভাবে সম্ভব হচ্ছিলো না। সারারাত জেগে সকালে বাসায় ফিরে আবার ওনাকে আলাদা করে নাস্তা দিয়ে বসে থাকার মতো শক্তি আমার আর থাকতো না। ফলাফল দুদিনেই টের পেলাম ওনার মেজাজ খারাপ, ঠিকমত খান না। ওপরতলার ভাবী মাঝেসাঝে ওনার বাচ্চা নিয়ে আসেন আমার ছেলের সাথে খেলতে। এটা ওটা রান্না করেও নিয়ে আসেন। আমি ঘুমের ঘোরে শুনতে পাই উনি ভাবীকে বলছেন, আমি রাঁধতে পারিনা, ওনাকে ঠিকমত খেতে দেইনা, বাচ্চার যত্ন নেইনা ইত্যাদি ইত্যাদি। একদিন দুইদিন তিনদিন পর আমারো ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙে। নিজেদের একটু সুখের জন্য ওনার সাহায্য নিলাম কিন্তু সেটা যে বুমেরাং হয়ে বিপদের কারণ হবে তা কে জানতো? আবারো মনোমালিন্য শুরু হয়ে গেলো আমার আর নোমানের সাথে। আমার শুধু মনে হতো শাশুড়ি বৌ মানেই কি এসব দ্বন্দ্ব হতেই হবে? প্রতিদিন ভাবতাম থাক চুপ করে থাকবো, কয়দিন আর আছে? কিন্তু নিত্যদিন চোখে আঙ্গুল দিয়ে কেউ দোষ দিলে কাঁহাতক চুপ করে থাকা যায়?
অবশেষে একদিন ওনার মুখোমুখি হলাম। যা থাকে কপালে, আমি আজকে বলবোই আমার মনে যা আসে। আমার আর ওনার সাহায্যের দরকার নেই। উনি ফিরে যাক দেশে, আমি একটু স্বস্তিতে থাকি অন্তত।
– মা, আপনাকে একটা কথা বলি?
বলো, কি বলবা?
– আমার সবকিছু যদি আপনার এতো খারাপ লাগে তাহলে কি আমি সব ছেড়েছুড়ে চলে যাবো?
বাব্বাহ তুমি দেখি কথা ও বলতে পারো। আমিতো ভাবসিলাম, তোমার সেই ক্ষমতাও নাই।
– কি বলতে চাচ্ছেন?
শোন মেয়ে, তোমার বিয়ের সম্বন্ধ সরাসরি আনছে কে?
– আপনি।
শ্বশুরবাড়ি নিয়ে গিয়ে কথার হুল না ফুটায়ে তোমারে বিদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করসে কে?
– আপনি।
কেন করলাম?
– সেটাতো আপনি ভালো জানেন।
শোন তাইলে, আমার পোলাতো একটা ভ্যান্দা। অনার্স শেষ কইরা কইলো সে বিদেশ পড়তে যাইবো। পাস করলে অনেক টাকাটুকা কামাইবো। কিন্তু বাস্তবে কি হইলো? একটা পিআর জুটানো ছাড়া আর কিছুই সে করতে পারলো না। তোমার পড়াশোনার আগ্রহের কথা শুইনা আমার মনে হইলো তুমি অন্তত আইসা যদি তারে একটু লাইনে আনতে পারো সাথে নিজেও যদি লাইনে আসো। কিন্তু হইলো কি? আমার ভ্যান্দা পোলা তোমারেও ভ্যান্দা বানাইলো। এহন তুমি কামলা দেও রাইতে, আর সে দেয় দিনে। কি চমৎকার জীবন। দুইজনের কারো লগে কারো দেখা নাই। এরে কি সংসার করা কয়?
– বিদেশের মাটিতে ইন্টার পাস আমাকে এরচেয়ে ভালো চাকুরী কে দেবে? আর আপনার ছেলে চেষ্টা না করলে আমি কি করতে পারি?
তারে বুঝায়ে দেখবা। কাজ না হইলে তুমি চেষ্টা করবা। এইদেশের পড়াশোনাতো জানি আমাদের মতো না। চাইলেই ছোটখাট কোর্স কইরা আস্তেধীরে বড় পোস্টে যাওয়ার জন্য পড়বা। কিন্তু তোমারে দিনের কাজে আসতে হইবো। মেয়েমানুষের সবদিকেই জ্বালা। জামাই বেশী কামের হইলে ঘর থেকে বাইর হইতে দেয়না, আর আইলসা হইলে বৌ রে ঘরেই ঢুকতে দেয়না।
আমি যে কয়দিন আছি তোমাদের কাছে সংসার আমি দেখুম তুমি দিনের কাজ খুঁজবা। কয়দিন হয়তো কষ্ট হইবো, কিন্তু আমি দোয়া করমু। দেখবা কিছু একটা ঠিক পাইয়া যাইবা। শোনো, তুমি যখন ভালো কিছু নিজের যোগ্যতায় করবা তখন দেখবা আমার গাধা পোলা ও ওর লাইনে কাজ খুঁজতাসে।
– আপনি জেনেশুনে আপনার গাধা ছেলের সাথে বিয়ে দিয়ে আমার জীবনটা নষ্ট করলেন কেন?
এহ, তোমার বাপে তোমারে জানি আরো কত পড়াইতো? আমি বরং তোমারে উদ্ধার করসি। শুকরিয়া আদায় করো, বুঝছো?
– আর অন্যলোকের সামনে সারাক্ষণ আমার দোষ ধরাটা?
নয়তো কি আর তোমার মুখে কথা ফুটতো?
ভেবে দেখলাম আসলেতো ভুল বলেননি তিনি। বিদেশে চলে আসাতে তো অন্তত কিছু করে খেতে পারছি। নয়তো বাবার পছন্দে কার না কার বাড়ির হাড়ি ঠেলে জীবন যেতো কে জানে?
………………
পুরো একটা বছর উনি আমার কাছে ছিলেন। আমাকে ঘরের কুটোটিও নাড়তে দেননি। প্রথম দুমাস একটু কষ্ট হলেও আমি চাইল্ড কেয়ারে সার্টিফিকেট কোর্সে ভর্তি হই। অতঃপর চাকুরী পেয়ে যাই একটা চাইল্ড কেয়ার সেন্টারে। ছেলেটাকে সাথে নিয়ে কাজে যাই। রাতের জীবন ছেড়ে একটা স্বাভাবিক দিনের জীবনে ফিরে আসতে পারি শুধু ওনার কারণেই।
আজ আমার চাইল্ড এডুকেটরের ডিপ্লোমার রেজাল্ট হয়েছে। এখন থেকে আমি কিন্ডারের শিক্ষক হিসাবে কাজ করতে পারবো। কলেজের শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন পূরণ করতে না পারলেও বাচ্চাদের শিক্ষক তো অন্তত হতে পেরেছি। রেজাল্ট হাতে পেয়ে নোমানকে না দিয়ে প্রথম ফোনটা ওনাকেই দেই।
– মা, আমার স্বপ্নপূরণে সাহায্য করার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
পাগলী মেয়ে, এটা তোর নিজের যোগ্যতা। আমিতো ছিলাম সহায়ক মাত্র।
এতোদিনের কষ্টের ফল হাতে নিয়ে মনে হলো, জীবনে আসলে কখনো স্বপ্নহারা হতে নেই। মন থেকে চাইলে আর নিজের চেষ্টা থাকলে সৃষ্টিকর্তা ঠিকই কাউকে না কাউকে দিয়ে পথের শেষ প্রান্তে পৌঁছেই দেয়।
ডা. জান্নাতুল ফেরদৌস