#স্বচ্ছ_প্রণয়াসক্ত
#পর্ব_১৩
#মুসফিরাত_জান্নাত
নীলাভ অম্বরের বুকে আঁধারের ঘনঘটা।ঝিমিয়ে রয়েছে নিস্তব্ধ শহর।সুবহে সাদেকের সমাপ্তি হতেই উঠে পড়ে মুয়াজ্জিন।অযু করে পবিত্র হয়ে নিয়ে আল্লাহর মহিমা ঘোষণা করে আযান দেয় সে।ঘুম জড়ানো কণ্ঠস্বর।তবুও কতো সুমধুর ধ্বনি হয়ে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে।গত দিনের ধকলের দরুন ক্লান্ত শরীরে ঘুমটা বেশ গভীরে গিয়ে ঠেকেছিলো।হটাৎ আযানের ধ্বনি কর্ণগোচর হতেই ঘুম ছুটে যায় দুজনের।অলস্যতার দরুন আরও একটু ঘুমিয়ে নেওয়ার ইচ্ছে পোষণ করতেই নড়ে ওঠে ঐশীর স্মৃতি কোষ।বাবার অবস্থা মাথা চারা দিতেই তড়িৎ চোখ খোলে সে।নামাযে দাড়িয়ে আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করা দরকার।ড্রিম লাইটের স্পষ্ট আলোয় সে দেখতে পায় তার দিকে পূর্ণ দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে সাদাত।অপরিদৃষ্ট সাদাতের এমন চাহনির মানে বুঝলো না ঐশী।ভ্রু কুটি করে তাকালো।অতঃপর সাদাতের দৃষ্টি অনুসরণ করে নিজের দিকে তাকাতেই লজ্জায় কুঁকড়ে উঠলো।শরীরের পোশাক এলোমেলো।উদরের খানিক অংশ দৃশ্যমান হয়ে আছে।পায়জামা হাটু অবধি উঠে গিয়েছে।গায়ের ওড়নার হদিস নেই।দ্রুত উঠে বসলো ঐশী।গায়ের জামা ঠিকঠাক করে হাটু মুড়ে বসলো সে।এক পলক তাকালো সাদাতের পানে।সাদাত ততক্ষণে নিজের দৃষ্টি সড়িয়ে নিয়েছে।বিছানার উপর ওড়নার সন্ধান চালিয়ে আবছা আলোয় হাতড়ে চলেছে সে।তাকে খানিকটা স্বস্তি দিতে বড় লাইটের সুইচ না জ্বালিয়েই ওয়াশরুমে চলে গেলো সাদাত।হাঁফ ছাড়লো ঐশী।লাইট অন করতেই চোখের পর্দায় ভেসে উঠলো বেবি পিংক কালারের ওড়নাটি।দ্রুত নিজের গায়ে জড়িয়ে নিলো সে।এটাচড ওয়াশরুমে সাদাতের অবস্থান হওয়ায় ড্রয়িংরুমের লাগোয়া ওয়াশরুমে চলে গেলো ফ্রেশ হতে।আজকের দিনে কোনো বিলম্ব করা চলবে না।সৃষ্টিকর্তার দরবারে যে তার অনেক কিছু চাওয়ার আছে আজ।বাবার দ্রুত সুস্থতা চেয়ে কান্নাকাটি করতে ভুললে তো চলবে না।
_______
সকালে সবার জন্য খাবার রান্না করে হসপিটালের উদ্দেশ্যে রওনা হলো তারা।তাবাসসুমের মন মানেনি।দূর থেকেও বাবাকে এক পলক দেখার নেশায় পিছু নিলো ওদের।কলেজ থেকে ছুটি নেয় সাদাত।শশুর হলেও ওনার প্রতি দেখভাল করার দ্বায়িত্ব বোধটা যে কাধে চেপেছে।
সকালে কার্ডিওলজিস্ট এসে আনোয়ার খাঁনকে পর্যবেক্ষন করেন।এমজিওগ্রাম সহ সব রিপোর্ট দেখে সাদাতের সাথে কথা বলেন তিনি।গম্ভীর গলায় বলেন,
“রুগীর অবস্থা খুব সিরিয়াস।দীর্ঘদিন হলো হার্টের সমস্যা পুষে রেখেছেন তিনি।হার্টে দুইটা ব্লক আছে।আজকেই এনজিওপ্লাস্টি করতে হবে।তাও ঝুঁকিমুক্ত থাকবে কিনা বলতে পারছি না আমরা।”
ছ্যাৎ করে উঠলো সকলের মন।নিমিষেই যেন চুরমার হয়ে গেলো ওদের পুরো পৃথিবী।দুমড়ে মুষড়ে গেলো ঐশী।ঘটনাস্থলেই সঙ্গা হারালেন সালেহা খাঁনম।শোকের মাঝে আরেক শোক। মা’কে নিয়ে ব্যস্ত হতে হলো ওদের।তাবাসসুম খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে।তুষার কাছে ভিরতে দিচ্ছে না ওকে।সব দোষ যেনো ওর উপরেই বর্তেছে।তাই সম্পূর্ণ বিষয় সম্পর্কে অবগত হতে পারলো না সে।তবে বুঝে গেলো কপাল খুব একটা সুবিধার নয়।নিভৃতেই চোখের জল ফেললো সে।সাদাত ভারাক্রান্ত গলায় বললো,
“যত দ্রুত সম্ভব অপারেশনের ব্যবস্থা করুন।টাকা যা লাগে পুরোটার ব্যবস্থা হবে।শুধু ওনার যেনো কোনো ক্ষতি না হয়।”
বোর্ন পেপারে তড়িঘড়ি করে সই করে দিলো ওরা।আনোয়ার খাঁনকে নিয়ে যাওয়া হলো ওটিতে।সাধারনত হার্ট অ্যাটাকের ২৪ ঘণ্টার ভিতরে স্টেন্টিং করলে অ্যাটাকের ফলে বিভিন্ন অর্গানের ক্ষতি থেকে রেহাই পাওয়া যায়।সেখানে কাল রাত থেকে সকালের এ সময় পর্যন্ত প্রায় ১২ ঘন্টার উপরে সময় অতিবাহিত হয়েছে।বিভিন্ন ঝুঁকি থেকে বাঁচাতে তাই দ্রুত অপারেশনের ব্যবস্থা করা হয়।বিদেশ থেকে কার্ডিওলজির উপর সদ্য উচ্চ ডিগ্রি নিয়ে আসা সার্জনের কাছে রেফার করা হলো ওনাকে।সেই ডাক্তার আর কেও নয়।তাবাসসুমের প্রেমিক ডা.ফাহিম আঞ্জুম রাসেল।যাত্রাপথে একলা এক কোণে তার প্রেমিকাকে কাঁদতে দেখেও থমকে দাঁড়ায় না রাসেল।পেশাগত দ্বায়িত্ব বোধের খাতিরে জীবনের অনেক ইচ্ছাই দমন করতে হয় তাদের।পেশেন্ট যে তাবাসসুমের বাবা তা অজানা নয় তার।এ কারণেই তো অপারেশনের ব্যবস্থাটা দ্রুত করেছে সে।টাকাও যথাসম্ভব লেস করে দিয়েছে।যাত্রাপথে প্রেয়সীকে ভরসা দেয়ার অবকাশও নেয় না সে।দ্রুত পা ফেলে চলে যায় ওটিতে।একটু বিলম্বও যে অনেক বড় বিপদের কারণ হতে পারে।সেদিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে তাবাসসুম।
__________
হসপিটালের করিডরে এক কোনে ঘাপটি মে’রে বসে দুই হাতে মুখ আড়াল করে কেঁদে চলেছে তাবাসসুম।বাবার অবস্থা দেখে ভীষণ ভয় পেয়েছিলো সে।ভেবেছিলো বাবাকে হয়তো হারিয়েই বসেছে ।বাবার এই অবস্থার জন্য বার বার নিজেকেই দোষ দিয়ে যাচ্ছে তাবাসসুম।নিজেকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলতে ইচ্ছে করছে এই মুহুর্তে।সে কারো সাথে প্রেমে আবদ্ধ না হলেই বাবা এতোটা উত্তেজিত হতো না।তাহলে কারোরই কোনো সমস্যায় পড়তে হতো না।বার বার অতীতে ফিরে গিয়ে স্মৃতি থেকে রাসেলকে মুছে দেয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে।কেঁদে কেঁদে চোখের পানিও শুকিয়ে ফেলেছে এখন।নিথর হয়ে অযত্নে ওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
এমন অবস্থায় সেখানে আসে ঐশী।তার মুখটা চিন্তায় অস্থির।নিজেরই বুক কাঁপছে।কিন্তু বোনের বিধ্বস্ত চেহারা দেখে সামলে নিলো নিজেকে।নিজের অস্থিরতাকে প্রাধান্য না দিয়ে তাবাসসুমের পাশে দাঁড়ালো সে।সবাই কেমন অবজ্ঞা করে চলেছে মেয়েটিকে।বোনের কাছে গিয়ে ঘেষতেই আবারও হাউ মাউ করে কেঁদে ওঠে দুজনে।তাবাসসুম বিপর্যস্ত কণ্ঠে বলে,
“সব কিছুর জন্য আমিই দ্বায়ী।আব্বুর মেয়ে হিসেবে কলঙ্ক আমি।আব্বুকে এতো অপদস্ত করেও জ্ঞান ফেরেনি আমার।শেষ মেশ ওনার জানেও হাত দিয়ে ফেলেছি।আমি এই পৃথিবীতে বেঁচে কেনো আছি রে ঐশী?ম’রে যাওয়া উচিৎ তো আমার।”
হু হু করে ওঠে তাবাসসুম।সাথে তাল মেলায় ঐশী।বুকটা ধক করে ওঠে তার।কন্ঠ নালী রোধ হয়ে আসে।হাজার চেষ্টা করেও নিজেকে সামাল দিতে পারে না।কান্না মিশ্রিত কণ্ঠে বোনকে স্বান্তনা দেয় সে,
“আব্বুর কিচ্ছু হবে না আপু।তুই শুধু শুধু নিজেকে দোষ দিচ্ছিস।এখানে কারোরই হাত নেই।আব্বু তো আগে থেকেই অসুস্থ ছিলো।আল্লাহ চাইলে আব্বু সুস্থ হয়ে উঠবে।একটু তো শান্ত হ।”
ঐশীর কথা তাবাসসুমের কর্ণ স্পর্শ করলো কিনা অস্পষ্টই রয়ে গেলো।তখনও কেঁদে চলেছে সে।বোনকে শান্ত হতে বললেও নিজে শান্ত হতে পারছে না ঐশী।চিন্তারা শান্ত হতে দিচ্ছে না তাকে।একদিকে বাবার চিন্তা ও অন্য দিকে বোনের পা’গলামো অস্থির করে তুলেছে তাকে।তাবাসসুমের দিকে চেয়ে মায়ের নিকটেও যেতে পারছে না ঐশী।রাহেলা খাঁনমের কাছে অবশ্য মাসুদা শেখ ও সাদাতের বাড়ির লোকজন সঙ্গ দিচ্ছেন।অপারেশন শুরু হওয়ার বেশ খানিকটা আগেই তারা পরিবার সমেত দেখা করতে এসেছেন এখানে।
বয়সে ছোট হয়েও ঐশীর কাধে দ্বায়িত্বের চাপটা যেনো একটু বেশিই।তাবাসসুম খামখেয়ালি পনা স্বভাবের আবেগি মেয়ে।সকাল থেকে উল্টা পাল্টা বিলাপ করে চলেছে সে।তাই আবেগের বসে উল্টা পাল্টা কিছু যেনো করে না বসে সেদিকেও খেয়াল রাখতে হচ্ছে তার।তাবাসসুম ও ঐশী পিঠাপিঠি হওয়ায় তাদের সম্পর্কটা প্রায় ঝগড়ার সেতুতে সীমাবদ্ধ থাকে।যদিও একে অপরের প্রতি ভালোবাসার কোনো কমতি নেই।তা প্রকাশ পায় একে অপরের দুঃসময়ে।এই এখন যেমন বোনের জন্য চিন্তিত হয়ে আছে সে।কি করলে তার বোন একটু শান্ত হয় তার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।বোনকে নিজের কাধে ঠাই দিয়ে নানান কথা বলে বুঝ দিয়ে যাচ্ছে।
কিঞ্চিৎ দুরত্বে দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য দেখে বিমোহিত হলো সাদাত।তার অর্ধাঙ্গিনী যে বেশ দ্বায়িত্বশীলা রমনী তা বুঝতে বাকি রইলো না তার।
ধীরে ধীরে ক্লান্ত হয়ে এলো তাবাসসুমের দেহ।কান্নার বেগ কমে এলো।প্রায় অচেতন হয়ে নেতিয়ে পড়লো ঐশীর দেহে।কোনো একটি ফাঁকা কেবিনের সন্ধান করে তার একটি বেডে শুইয়ে দেয়া হলো তাবাসসুমকে।হসপিটালের একটা নার্স দেখে বললেন,
“অতিরিক্ত চিন্তায় জ্ঞান হারিয়েছে।একটু বিশ্রাম নিলেই ঠিক হয়ে যাবে।”
চলে গেলো নার্সটি।মাথা চেপে ধরে জানালার সাদা পর্দা ভেদ করে দাঁড়িয়ে রইলো ঐশী।রাজ্যের দ্বায়িত্ব ও চিন্তা তার কাধে।বাবা অপারেশন থিয়েটারে মৃ’ত্যুশয্যায় পড়ে আছে।মায়ের বিধ্বস্ত অবস্থা।কষ্টে নেতিয়ে যাওয়া রাগী ভাই ও পাশের বেডে পড়ে থাকা জ্ঞান শূন্য আবেগী বোন।কোন দিকে যাবে সে বুঝে আসে না তার।মুহুর্তেই নিজেকে ছায়া শূন্য অনুভুত হয়।ছাদের নিচে দাঁড়িয়েও খা খা রোদ্দুরের উত্তপ্ততা যেনো গা ভষ্ম করে দেয়।পূর্ণ গতিতে ঘূর্ণায়মান ফ্যানের নিচে থেকেও ঘামতে থাকে সে।দূর থেকে ডাকে দাঁড় কাকের দল।বুক কাঁপে দূরু দূরু।মনে মনে প্রার্থনা করে, আল্লাহ সব আগের ন্যায় স্বাভাবিক করে দাও।
কিছু সময় পর ঐশীর পাশে এসে দাঁড়ায় সাদাত।ঐশীর চেহারা বিপর্যস্ত।চিন্তায় দিকশূন্য হয়ে আছে।কুল হারা এক সাগরে ভেসে চলেছে সে।চারিদিকে অথৈ পানি।মৃ’ত্যুর দল যেনো হাত ছানি দিয়ে ডাকছে।নিজের বুকে বিষাক্ত অনুভুতির শিহরণ বয়ে যাচ্ছে।এই মুহুর্তে এই বিষকে প্রশমন করার জন্য একজনের ভীষণ প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে সে।সাদাত হয়তো কিছু বুঝলো।ঐশীর মাথায় হাত দিয়ে ভারাক্রান্ত কণ্ঠে বললো,
“চিন্তা সব সমস্যার সমাধান হয় না ঐশী।মাঝে মাঝে চিন্তা নতুন সমস্যার সৃষ্টি করে।মা,আপুর এই অবস্থা।এর মাঝে তুমিও অতিরিক্ত চিন্তায় সঙ্গা হারালে ওদের দেখবে কে?তাই একদম চিন্তা করো না।আল্লাহকে তো সবাই ডাকছি।তিনি নিরাশ করবেন না আমাদের।বাবার কিচ্ছু হবে না দেখো।”
ভরসার একটা হাত মাথায় পড়তেই ডুকরে কেঁদে ওঠে ঐশী।নিজেকে শক্ত রাখার খোলসটা মুহুর্তেই খুলে যায়।ভেঙে পড়ে সে।আচমকা তার সাদাতকে আপন মনে হয়।এই মুহুর্তে ভরসা পাওয়ার জন্য একটা খুটি যে বড্ড প্রয়োজন।সাদাতের বুকে মুখ গুজে কেঁদে চলে সে।পরম যত্নে প্রয়সীকে আগলে নেয় সাদাত।বিয়ের পর প্রেয়সীকে ভরসা যোগাতে এটা তার প্রথম আলিঙ্গন।প্রেয়সীর ব্যাথায় ব্যাথিত হয়ে চুরমার হয়ে যায় সাদাত।ঐশী যদি একটি বারের জন্যও বুঝতো তার এই বিধ্বস্ত অবস্থা দেখে পুরুষটির অন্তরে প্রলয়ঙ্কারী ঝড় উথলে উঠেছে,তবে সে এই মুহুর্তে কান্না করার স্পর্ধা অবধি করতো না।
প্রায় ঘন্টা দুয়েকের চেষ্টায় অপারেশন সাকসেসফুল হলো।এতো গুলো মানুষের চোখের পানি ও দোয়াকে উপেক্ষা করলেন না সৃষ্টিকর্তা।তাই হয়তো এ যাত্রায় মৃ’ত্যুর মুখ থেকে বেঁচে ফিরলেন আনোয়ার খাঁন।এতে যে ডাক্তারের জুরিও মেলা ভার তা অস্বীকার করার সাধ্য নেই তাদের।আল্লাহর কাছে শোকরানা নামায আদায় করলেন সালেহা খাঁনম।কিছু দান সদকা করার নিয়তও করে বসলেন।তুষারও থমকালো ডাক্তার হিসেবে তার বোনের প্রেমিককে দেখে।এরপর আর তার উপর রাগ পুষে রাখলো না কেও।বরং সঠিক একটা মানুষ নিজের জীবনের জন্য বেছে নেওয়ায় সন্তুষ্ট হলো।
________
প্রশান্তিমাখা ক্লান্ত বদনে দরজার দিকে তাকিয়ে আছেন আনোয়ার খাঁন।সবাই ঘরে এসে ওনার কাছে সঙ্গ দিলেও দরজার আড়ালে লুকিয়ে বাবাকে দেখে চলেছে তাবাসসুম।বাবার কাছে আসার অগাধ ইচ্ছে বুকে চেপেও ভয়ের দরুন দমিয়ে রাখতে হচ্ছে।শুরুতে তাবাসসুমের উপর রাগ জমলেও জীবন মরণ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার এই মুহুর্তে এসে তা বিলীন হয়ে গেলো।অসুস্থ গলায় ক্ষীণ স্বরে মেয়েকে কাছে ডাকলেন তিনি।ভীত ঢোক গিলে এক পা দু পা করে এগিয়ে গেলো সে।মেয়ের হাত ধরে ছোট করে বললেন,
“বাবাকে এই অবস্থায় রেখেও কেও দূরে থাকে?ভয় লাগে না তোর?”
ফুপিয়ে কেঁদে ওঠে তাবাসসুম।বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
“তোমাকে হারানোর ভয়েই তো দূরে থাকি আব্বু।যদি তুমি আবারও অসুস্থ হয়ে যাও এই ভয় যে আমাকে তোমার কাছে আসতে দেয় না।”
“দূর বোকা!মেয়েদের দেখলে কেও অসুস্থ হয় নাকি?নিজের সন্তানের মুখ তো মানুষের মানসিক সুস্থতার ঔষধ।”
বাবার কথায় বুক কাঁপে তাবাসসুমের।পিতার মনে এখনো কতো ভালাবাসা তার জন্য।অথচ সে কিনা অবাধ্যতা করে চললো।ঠিক এই মুহুর্তে এসে বাবার পা ছুঁয়ে দিলো সে।হাউমাউ করে কেঁদে ক্ষমা চাইলো।
“আমাকে ক্ষমা করো আব্বু।আমি আর এমন কোনো কাজ করবো না যাতে তোমরা কষ্ট পাও।”
এক হাতে ধরে মেয়েকে কাছে টেনে নিলেন তিনি।চোখে তার নোনা জল।মুখে স্মিত হাসি।এ যে আনন্দের আরেক মুহুর্ত।নরম গলায় বললেন,
“সন্তানের কোনো ভুলই পিতা মাতার কাছে ক্ষমা চাওয়ার মতো বড় হয় না পা’গলি।সন্তানের স্থান পায়ে নয় বাবাদের বুকে রাখতে হয়।”
এটুকু বলে থামলেন তিনি।উপরে যতো রাগী ও কঠোরই হন না কেনো ভেতরে তিনি সন্তানদের জন্য প্রচুর দূর্বল।সেখানে তাবাসসুম তো তার প্রথম সন্তান।ওনার জীবনের প্রথম বাবা ডাক শোনার কারণ।তার উপর কি তিনি রেগে থাকতে পারেন?একটু পরে হালকা হাসলেন তিনি।অসুস্থ অবস্থায়ও রগড় করে বললেন,
“কিন্তু এখন হয়তো তোকে বুকে রাখতে পারবো না।সে অবস্থাও তো আমার নেই।”
হাতের উল্টো পিঠে চোখের জল মোছে তাবাসসুম।হালকা হেসে বলে,
“তোমাকে বুকে রাখতে হবে না আব্বু।আগে সুস্থ হও তুমি।”
হেসে ওঠেন আনোয়ার খাঁন।বাবা মেয়ের ভুল ভাঙার এই মুহুর্তে এসে হাসি ফুটে ওঠে অন্য সকলের মুখে।
সবকিছু মিটমাট হওয়ায় প্রশান্তি পায় সবাই।বাবাকে বিশ্রাম নিতে দিয়ে একে একে বেরিয়ে যায় সবাই।বিদায় নেয় সাদাতের পরিবার।যাওয়ার আগে ঐশীকে একবুক সান্ত্বনা ও সমবেদনার ঝুড়ি উপহার দিয়ে যায় সিন্থিয়া।ঐশীর এই দুঃসময়ে বান্ধবীর প্রকৃত কর্তব্য যথা নিয়মেই পালন করে সে।এই অবেলার ওই করিডোরে শুধুমাত্র অবস্থান থাকে ঐশী ও সাদাতের।গলা ঝেড়ে সাদাত শুধায়,
“তুমি ঠিক আছো?”
হুট করে সাদাতের এমন প্রশ্নটার মানে ঠাহর করতে পারে না ঐশী।ভ্রু কুটি করে বলে,
“হুম।হটাৎ এটা জানতে চাইলেন কেনো?”
সাদাত লম্বা একটা শ্বাস টেনে নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলে,
“একটু বের হওয়ার দরকার ছিলো।তুমি একা থাকতে পারবে কিনা এজন্য জানতে চাইলাম।”
“হুম পারব।”
বুকটা জুড়িয়ে যায় ঐশীর।মনের ভেতরে স্বচ্ছ আকাশ উঁকি দেয়।লোকটা তাকে নিয়ে এতো ভাবে?সব ক্ষেত্রেই তার সুবিধা অসুবিধাগুলো নিভৃতেই কি নিখুঁত ভাবে দেখে চলে।মুগ্ধ হয় মেয়েটি।এক চিলতে হাসে সে।ঐশীর মুখে হাসি দেখে নিশ্চিন্ত হয় সাদাত।নিজের প্রয়োজন পূর্ন করতে প্রস্থান করতে উদ্যত হয় সে।ঐশীর এবার মনে হয় তারও উচিৎ সাদাতের খেয়াল রাখার।না হলে সমানে সমান হবে কি করে।সে জানতে চায়,
“কোথায় যাচ্ছেন?”
থমকে দাঁড়ায় সাদাত।নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলে,
“ভয় নেই।যেখানেই যাই না কেনো আমার শেষ গন্তব্য তোমার মাঝেই নিবদ্ধ।”
শব্দগুলোর মাঝে হয়তো কোনো অদৈব শক্তি লুকায়িত ছিলো।যা নিমিষেই মুগ্ধ করে দিলো ঐশীকে।তোলপাড় উঠলো হৃদয়ে।সে ক্ষনকালের জন্য থমকে না গিয়ে পারলো না।এক পলকে চেয়ে রইলো নিজস্ব পুরুষটির যাত্রাপথে।বিষয়টা হয়তো খেয়ালও হলো না অপর পুরুষটির।নিজের লম্বা পা ফেলে চলে যায় সে।
চলবে