#স্পর্শতায় তুমি
#সূচনা_পর্ব
#অধির_রায়
‘আমি পারব না৷ এখনই দম বন্ধ হয়ে আসছে৷ আমি কিছুতেই অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারবো না৷ এই বিয়ে করলে আমি মা’রা যাবো৷ প্লিজ তুমি কিছু একটা করো। নয়ত আমাকে গলা টিপে মে’রে ফেলো৷ আমি তোমাকে ছাড়া অন্য কাউকে ভালো বাসতে পারবো না৷’
কান্না করতে বিয়ের সাজে বলে উঠে ছোঁয়া। ঋষির চোখ থেকেও অনবরত রক্তের নোনা জল কপোল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে৷ ঋষি বুকে পাথার চেপে রেখে ছোঁয়া কাঁধ শক্ত করে ধরে,
“তোমাকে পারতেই হবে ছোঁয়া৷ তোমার সাথে জড়িয়ে আছে তোমার বাবার সম্মান।”
ছোঁয়া অসহায় চোখ তুলে তাকায়। ভেজা গলায় বলল,
আমাকে পাশের রাস্তা থেকে বিষ এনে দিতে পারবে৷ আমার শেষ ইচ্ছাটা পূরণ করো৷ আমি তোমাকে ছাড়া অন্য কাউকে স্বামী হিসেবে মেনে নিতে পারব না৷ আমি সত্যি সত্যি ম’রে যাব। আমাকে দূরে ঠেলে দিও না৷
ঋষি এদিক ওদিক তাকিয়ে নিজেকে সংযত করল৷ ছোঁয়ার চোখের জল মুছে দিয়ে বলল,
“তুমি কি আমার সাথে যেতে চাও? তুমি চাইলে এখনই তোমাকে নিয়ে যাব৷ কোন বাঁধা মানবো না৷ আমরা পালিয়ে দূর দেশে চলে যাব৷”
ছোঁয়া কান্না চোখে ঋষির দিকে তাকায়৷ চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ছে অনবরত জল৷ কষ্টমাখা ভেজা গলায় বলল,
“আমি এমন কোন কাজ করব না৷ আমি তোমাকে আর কারো সামনে ছোট করতে পারব না৷ আমি এমনটা কিছুতেই চাইব না৷ আর তোমাকেও করতে দিব না৷”
“প্লিজ ছোঁয়া। একবার ভেবে দেখ। তোমাকে ছাড়া আমিও ভালো নেই৷ আমিও কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না৷
ছোঁয়া ভেজা গলায় বলল,
“আমাকে একটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরবে প্লিজ। এতোটাই শক্ত করে ধরবে যেন অন্য কারো আলিঙ্গনে তোমার ছোঁয়া হারিয়ে না যায়৷ আমি তোমার ছোঁয়া হয়ে থাকতে চাই৷”
ঋষি কোন জবাব না দিয়ে ছোঁয়াকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে৷ ছোঁয়া ঋষির স্পর্শ পেয়ে হাউমাউ করে কান্না শুরু করে৷ তাদের ভালোবাসার সাক্ষী দু’জনে চোখের জল৷ ছোঁয়া ঋষির বুকে মুখ লুকিয়ে কষ্টমাখা ভেজা গলায় বলল,
“আমাকে প্লিজ একটু বিষ এনে দাও৷ আমি তোমার স্পর্শ ভুলতে পারব না৷ তোমার ছোঁয়া তোমাকে ছাড়া কোথাও যেতে পারে না৷ তুমি তোমার ছোঁয়াকে আটকাও৷ আমি তোমায় খুব ভালোবাসি৷”
ঋষি কোন জবাব দিচ্ছে না৷ ছোঁয়াকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে চোখের জল ফেলে যাচ্ছে৷ ছোঁয়াকে এতোটাই শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে কেউ তাদের আলাদা করতে পারবে না৷ অতিরিক্ত কান্না করার জন্য কথাও বলতে পারছে না৷ ঋষি কথা বলার বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছে৷ ছোঁয়া আ’ষ্টে’পৃ’ষ্টে আরও শক্ত করে ঋষিকে জড়িয়ে ধরে৷ এটাই তার শেষ জড়িয়ে ধরা৷ আর কোনদিন ঋষি তার সামনে আসবে না৷ ঋষি অসহায় কষ্টমাখা ভেজা গলায় বলল,
“তুমি কেন নিজেকে দুর্বল ভাবছো? মা’রা যাওয়ার কথা বললে আমি নিজেই মা’রা যাব৷ তোমাকে ভুলা আমার পক্ষে অসম্ভব। তুমি যদি আর একবার মা’রা যাওয়ার কথা বলো তাহলে আমি এখনই নিজেকে শেষ করে দিব। তোমার একা কষ্ট হচ্ছে! আমার কোন কষ্টই হচ্ছে না? আমি এই বিচ্ছেদ মেনে নিতে পারছি না৷ আমাদের ভালোবাসা অসমাপ্তই থেকে যাবে৷”
ছোঁয়া ভেজা গলায় বলল,
“প্লিজ কিছু একটা করো৷ আমি তোমার প্রতি আমার আসক্ত কমবে না৷”
“সুখী হও।”
“আদৌও সুখী হওয়া সম্ভব৷ তোমাকে ছাড়া আমি কিভাবে সুখী হবো?”
“বিধাতার নামে আমার সুখ তোমায় দিলাম৷ আমার সবটুকু সুখ তোমায় লিখে দিলাম৷ স্বামী সোহাগী হও৷”
“আমি কিছুতেই সুখী হতো পারব না৷ তুমি….
চারদিকে উৎসবের আমেজ। রব এসে পড়েছে৷ ছোঁয়ার বান্ধবীরা ছোঁয়াকে টানছে৷ অন্যদিকে ঋষির বেস্ট ফ্রেন্ড অর্পণ ঋষিকে টানছে৷ কেউ কাউকে ছাড়ছে না৷ দু’জনই আ’ষ্টে’পৃ’ষ্টে জড়িয়ে ধরে আছে৷ অনেক কষ্টে দু’জনকে আলাদা করে৷ অর্পণ ঋষির হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে যান৷ ছোঁয়া এক দৃষ্টিতে ঋষির দিকে তাকিয়ে আছে৷ ভালোবাসার মানুষের দিকে তাকিয়ে চোখের জল ফেলে যাচ্ছে। এক সময় ভালোবাসার মানুষ চোখের আড়াল হয়ে যায়৷ ছোঁয়াকে টানতে টানতে বিয়ের পিরিতে নিয়ে আসে৷
ঋষি রাস্তায় এসে প্রাণপ্রিয় বন্ধু অর্পণকে ধাক্কা দিয়ে নিজের থেকে সরিয়ে দেয়৷ ঋষি অর্পনের দিকে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,
” আমার ধারেকাছেও আসার চেষ্টা করবি না৷ আমি কখন কি করে ফেলবো জানা নেই?”
ঋষি এক প্রকার হুমদি দিয়ে সেখান থেকে চলে যায়৷ অর্পন ঋষির কথা গায়ে লাগায় না৷ ঋষির যা বলেছে তা তার মন থেকে বলেনি৷ মনের ভিতর জমে থাকা ক্ষোভ আর ঘৃণা নিয়ে বলেছে৷ অর্পন ঋষির পিছন পিছন যেতে থাকে৷ মেইন রাস্তায় বাহারি রকমের গাড়ির চলাচল৷ ভুল বশত কিছু করতে পারে। সে ভয়ে অর্পন কিছুতেই ঋষিকে একা ছাড়বে না৷ ঋষি এক ধ্যানে হেঁটে যাচ্ছে৷ অর্পনের হাঁটার শব্দ ঋষির কানে আসছে৷ ঋষির মন বলছে এখন অর্পনকে ক’ষি’য়ে কয়েকটা থা’প্প’ড় বসাতে৷ প্রায় এক কিলো হেঁটে আসে ঋষি৷ হাঁটতে হাঁটতে পা চিনচিন ব্যথা করছে৷ তবুও হেঁটে যাচ্ছে৷ দূর পথে এসে একটা রিক্সা চোখে পড়ে৷ ঋষি রিক্সাই উঠে বসে৷ রিক্সা চলতে শুরু করলে মানা করে দেয়৷ অর্পন দূরে এসে রিক্সায় উঠার পর রিক্সা চলতে শুরু করে৷ ঋষি অর্পণের হাত চেপে ধরে ভেজা গলায় বলল,
“ছোঁয়া আজ থেকে অন্য কারোর হয়ে গেল৷ আমি তাকে দেওয়া কথা রাখতে পারলাম না৷ আমি একজন ব্যর্থ প্রেমিক। ছোঁয়ার চোখে অপরাধী হয়ে গেলাম। ছোঁয়া আমাকে কোনদিন ক্ষমা করবে না৷”
অর্পন কি বলে সান্ত্বনা দিবে কিছুই খুঁজে পাচ্ছে না? ঋষিকে না দেখলে অর্পণ জানতে পারতো না ছেলেরা এভাবে কাঁদে। কিছু সময় পর ঋষি চোখের জল মুছে কষ্টমাখা কন্ঠে বলল,
“ছেলেদের কাঁদতে নেই৷ আমি কেন কান্না করছি? আমার কোন কিছু ভালো লাগছে না৷ আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে৷ আ’ত্মহ”ত্যা পাপ জেনেও সুইসাইড করতাম৷ কিন্তু আমার মা বাবাকে দেখবে কে? আমি ছাড়া তাদের কেউ নেই৷ আমি ছাড়া আমার বোনের আবদার পূরণ করবে কে? আমার বোন জানতে পারলে খুব কষ্ট পাবে৷”
অর্পন ঋষিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,
“আমরা তোদের বাসায় এসে পড়েছি৷ আমি আজ তোর সাথে মতিঝিল যাব না৷ তোর সাথে থাকব।”
ঋষি হাসার চেষ্টা করে বলল,
“ভয় নেই৷ আমি কোন ভুল পদক্ষেপ নিব না৷ আমাকে একটু একা থাকতে দে। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে৷ একা থাকলে কিছু কষ্ট কমবে৷”
অর্পন জানে ঋষিকে একা ছাড়া যাবে না৷ তবুও ঋষির চোখ রাঙানো দেখে একা রেখে চলে আসে৷ রাতের আঁধারে ঋষি নিজের রুমে চোরের মতো প্রবেশ করে৷ রুমের লাইট অন করতে বিছানার উপর নিজের বোনকে দেখে ঘাবড়ে যায়৷ কিছু বলতে নিবে তার আগেই নিজের বোন এসে বলল,
“তুই এই কাজ কিভাবে করলি? তুই আমার ফ্রেন্ডের সাথে প্রেম করিস আমি জানি না৷”
ঋষি বোনের রাগ দেখে বুঝতে পারে তার বোন প্রতি খুব রেগে আছে৷ বুকে পাথর চেপে রেখে হাসার চেষ্টা করে বলল,
“এসব আবোল তাবোল কি বকছিস? তোর মাথা খারাপ হয়েছে৷ আর তুই আমার রুমে কেন? যা তোর রুমে যা৷”
“তুই কেন আমার কাছ থেকে সবকিছু লুকাতে চাইছিস? আমি সেখানে উপস্থিতি ছিলাম৷ তুই সেখান থেকে কই গেছিলি৷ তোর ফোন বন্ধ কেন? তোকে আমি কতো বার ফোন দিছি৷ ছোঁয়ার ভালোবাসা কিভাবে ছাড়তে পারলি?”
ঋষি বোনকে কাছে টেনে বলল,
“আমার বোন দেখি অনেক বড় হয়ে গেছে৷ ভালোবাসালেই পেতে হবে এমন কোন সংবিধান নেই৷”
“তুই ছোঁয়ার বাবাকে বুঝাতে পারতি৷ ছোঁয়ার বাবার কাছে এক বছর চেয়ে নিতি৷ তুই মাত্র মাস্টার্স দিয়েছিস৷ এক বছর ছোঁয়া তোর জন্য অপেক্ষা করতে পারল না৷”
ঋষি নিজের চোখের জল মুছে নেয়৷ কেন চোখে আজ এতো জল আসছে ঋষির জানা নেই? বুকে হাজারও কষ্ট চাপা দিয়ে মলিন কষ্টমাখা কন্ঠে বলল,
“ছোঁয়া বড় মেয়ে৷ তার ছোট আরও তিন বোন আছে৷ তার বিয়ের জন্য তার ছোট বোনের বিয়ে আটকে আছে৷ এমন অবস্থায় কি করা উচিত? আমার জন্য অপেক্ষা কিভাবে করবে?”
অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ক্ষোভ নিয়ে বলল,
“ছোঁয়ার ফ্যামিলির ব্রেক গ্রাউন্ড থেকে আমাদের ফ্যামিলির ব্রেক গ্রাউন্ড অনেক ভালো। আমরা ভালো ফ্যামিলি থেকে বিলংস করি৷ আমাদের এতো বড় বাড়িতে ছোঁয়ার জায়গা হতো না৷ না খেয়ে মা*রা যেত!”
“কোন বাবা মা চায়না তার মেয়েকে বেকার ছেলের হাতে তুলে দিতে৷ আমি তো বেকার৷ নাকি তোর ভাই বলে সেটা চোখে পড়ছে না৷ দেখ আমি হাসছি৷ আমার কোন কষ্ট হচ্ছে না৷ তুই কেন কান্না করছিস?”
ঋষি জানে তার বোন তাকে কতোটা ভালোবাসে৷ ছোটবেলা ঋষি অসুস্থ হলে কষ্ট সে পেতো। ঋষি কান্না করলে সেও কান্না করতো৷ মা ব*কা দিলে সে কান্না করতো৷ ঋষি নিজের কষ্ট আড়াল করতে চাইছে৷ কিন্তু বোনের ভালোবাসার কাছে হেরে যাচ্ছে৷ জড়িয়ে ধরে বলতে ইচ্ছা করছে, “তোর ভাই হেরে গেছে জীবন যুদ্ধে৷” ভেজা গলায় বলে উঠল,
“তোর চোখে জল কেন? তুই কেন ছোঁয়ার জন্য কষ্ট পাচ্ছিস? ছোঁয়া তার বাবাকে বলে সব ঠিক করতে পারতো৷”
ঋষি কষ্টমাখা ভারী গলায় ক্ষেভ নিয়ে বলে উঠল,
“রুম থেকে চলে যা৷ আমাকে কিছু সময় একা থাকতে দে৷ আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে৷ প্লিজ আমাকে একা থাকতে দেয়৷”
ঋষি সারারাত অতিবাহিত করে নির্ঘুমে৷ ঘুমের দুইটা মেডিসিন খাওয়ার পরেও চোখের পাতায় ঘুম নেই৷ ছোট চোখের মণি জোড়া শুধু ছোঁয়ার ভালোবাসা খুঁজে চলছে৷ সারারাত কেটে যায় নিকোটিনের ধোঁয়ায়৷ যে ছেলে নিকোটিনের ধোঁয়া সহ্য করতে পারত না৷ আজ তার হাতের মাধ্যমে নিকোটিনের ধোঁয়া বের হচ্ছে। এক রাতের ভাগ্য মানুষকে কোথা থেকে কোথায় নিয়ে যায়?
ভার্সিটির কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে নিরবে নিভৃতে বসে আছে তিন জোড়া চোখ৷ সকলের অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ছোঁয়ার দিকে৷ স্তব্ধতা বিরাজ করছে চার জনের মাঝে৷ ছোঁয়ার চোখ থেকে টুপ করে দুই ফোঁটা অশ্রু কপোল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল।
চলবে….