স্নিগ্ধ পরশ পর্ব-০৬+০৭

0
1244

#স্নিগ্ধ পরশ
#পর্ব_৬ ও ৭
#তানজিম_তানাজ

“এভাবে তাকিয়ে আছো কেনো!”

ভ্রুকুচকে আহনাফ বললো।সিরাত এখনো বিষ্ময় নিয়ে আহনাফের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।আহনাফ বিরক্তভাব মুখে ফুটিয়ে সিরাতের হাত থেকে বক্সটা নিলো।বক্সের ভিতর থেকে ফোন বের করে চালু করে সিরাতের দিকে এগিয়ে দিলো।সিরাত বিষ্ময় নয়নে হাত বাড়িয়ে ফোনটা হাতে নিলো।আহনাফ নির্বিকার কন্ঠে বললো,

“ফোনের ভিতর সিম আছে।আর আমি সবার নাম্বার এতে সেইভ করে দিয়েছি।আর আমার নাম্বারও রয়েছে আমার নামে খোজ করো পেয়ে যাবে।”

সিরাত আহনাফের দিকে তাকিয়ে মাথা দুলালো।আহনাফ আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। গলায় টাই বাঁধছে সে।সিরাত গম্ভীর কন্ঠে বললো,
“কোনো প্রয়োজন ছিলোনা ফোন দেওয়ার। এমনিতেও আমাকে বিয়ে করে আমাকে করুণা করেছেন এটাই অনেক।আমার জন্য আপনাকে আর কিছু করতে হবেনা।”

আহনাফ আয়না দিয়েই সিরাতের প্রতিবিম্বের দিকে সরল চোখে চেয়ে রইলো।হয়তো সিরাতের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বোঝার চেষ্টা করছে।সিরাত ফোনটা সোফার উপর রেখে ফ্রেস হতে চলে গেলো।আহনাফ কিছুসময় একভাবে দাঁড়িয়ে রইলো।

———–

সিরাত ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়ে দেখলো আহনাফ রুমে নেই। সিরাত একপলক ঘড়ির দিকে তাকালো। ঘড়িতে ৭ টা বেজে ৫ মিনিট।এত সকালে উনি কোথায় গেলেন!সিরাত গিয়ে সোফায় বসলো।আহনাফ সব গুছিয়ে রেখে গেছে।বিছানা পরিপাটি করে গোছানো সোফায় থাকা বালিশ আর কাঁথা গুছিয়ে রেখে গেছো।এই দিনে সিরাত এইটুকু বুঝে গিয়েছে আহনাফ অনেক পরিপাটি। সিরাত হাতে ফোনটা নিয়ে কিছু সময় নেড়েচেড়ে দেখলো।দেখে মনে হচ্ছে অনেক দামী।আমাকে এতো দামী ফোন কিনে দেওয়ার কোনো মানেই হয়না।করুণা করে একটা নরমাল কম দামী কিনে দিলেও হতো।তাতেই আমি অনেক খুশি। কথা গুলো মনে মনে বলে সিরাত নিচে চলে গেলো।

সিরাত নিচে নেমে রান্না ঘরে চলে আসলো।নাদিয়া বেগম রুটি বেলতে ছিলেন।সিরাতকে দেখে বললেন,

“আহনাফ চলে গেলো আর তুমি এতো পরে নিচে নামলে যে!ছেলেটা যাওয়ার সময় একবার নিচে আসতে।ছেলেটা সাতদিনের জন্য মেডিকেল থেকে ক্যাম্পিংয়ে গেলো।”

সিরাত অবাক হলো কিছুটা।সে তো কিছুই জানেনা অবশ্য জানার কথাও না।সেই অধিকার তার নেই।নাদিয়া বেগম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,

“অবশ্য আহনাফ যেরকম ব্যবহার করে তোমার সাথে তাতে তোমার দূরে থাকারই কথা।কিন্তুু আহনাফ তোমাকে মন থেকে না মানলেও তুমিই আহনাফের স্ত্রী।নিজের অধিকার ছেড়ে দিওনা।নিজের অধিকার বানিয়ে নিতে শিখো।”

সিরাত কী বলবে কিছু বুঝতে পারছেনা চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো।

—————–
সিরাত তার চাচার বাসায় এসেছে কিছুসময় হলো।নাদিয়া বেগমের পারমিশন নিয়ে চলে এসেছে সকাল সকালই।কিছুতেই তার মন টিকতে ছিলোনা ওই বাসায়। সিরাত এককাপ চা বানিয়ে এনে তার চাচার সামনে রাখলো।আজমল সাহেবকে আজকে সকাল সকালই রিলিজ করা হয়েছে। তিনি বিছানায় গা হেলিয়ে বসে ছিলেন।সিরাতের হাত থেকে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে ইশারায় সিরাতকে বসতে বললেন।সিরাত তার পায়ের কাছে বিছানায় অপরপ্রান্তে বসলো।আজমল সাহেব কাপে এক চুমুক দিয়ে বললেন,

“তুই ও বাড়িতে ভালো আচ্ছিস মা!”

সিরাত হাসিমুখে মাথা দুলিয়ে বললো, “হ্যাঁ চাচা।আলহামদুলিল্লাহ আমি অনেক ভালো আছি।”

আজমল সাহেব সিরাতের কথায় স্বস্থি পেলেন।বুক থেকে যেন পাথরের ভার নেমে গেলো।শান্তি লাগছে এখন। সিরাতের জন্য তিনি অনেক চিন্তিত ছিলেন।স্বস্থির কন্ঠে বললেন,
“তোর শাশুড়ী মা অনেক ভালো।আর আহনাফ বাবাও অনেক ভালো।কত ভালো ব্যবহার তার।তুই অনেক ভালো থাকবি মা। ”

সিরাতের কাছে তাচ্ছিল্য লাগলো কথাগুলো।তবুও মুখে হাসি ফুটিয়ে মাথা দুলালো।আজমল সাহেব পুনরায় চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন,

“তবুও যদি কখনো কোনো সমস্যা হয় আমাকে সাথে সাথে জানাবি মা।তোকে আমার নিজের মেয়ের মতো ভালোবাসি।তুই আমার আরেক মেয়ে।তোর বাবা বেঁচে না থাকলে কী হয়েছে যতোদিন আমি বেঁচে আছি ততোদিন তোর বাবার ছায়া হয়েই বেঁচে থাকবো।”

সিরাতের চোখ ছলছল করে উঠলো। এই একটা মানুষ যে সিরাতের আপন অনেক কাছের মানুষ।সিরাতও তার চাচাকে বাবার চোখে দেখে।এই মানুষটাই বাবা মা হারানোর পর নিজের মেয়ে করে তাকে কাছে টেনে নিয়েছে।ভাগ্য সবসময় খারাপ করেনা আমাদের সাথে ভালো কিছুও করে।যেমন বাবার মতো এক নতুন বাবা পেয়েছে সে।সিরাত আরো কিছু সময় তার চাচার সাথে কথা বলে খালি চায়ের কাপ নিয়ে রান্না ঘরের দিকে এলো।রান্না ঘরের আসতেই সিরাতের চাচি ক্ষিপ্ত কন্ঠে বললেন,”এই যে নবাবজাদি!বড় ঘরে আপনার বিয়ে হয়েছে দেখে পা বুঝি মাটিতে পরছেনা!ঘরের বাকি কাজগুলো কে করবে শুনি। এতো সময় বসে যে আপনি গল্প করলেন!”

সিরাত দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,”এখুনি করছি চাঁচি। ”
বলেই সিরাত পানির ট্যাপ ছেড়ে চায়ের কাপ ধুতে লাগলো।তার চাঁচির এমন ব্যবহারে এখন সে অবস্ত।আগে খারাপ লাগলেও এখন আর লাগেনা।সিরাত কাপের সাথে সাথে রান্না ঘরে রাখা বাকি আধোয়া জিনিস ধুয়ে রাখলো।তারপর সবরুম গুছিয়ে বালতিতে পানি নিয়ে ঘর মোছা শুরু করলো।

————

তিন দিন হয়ে গেছে সিরাত তার চাচার বাসায় রয়েছে। দিনরাত খেটে মরছে তবুও চাচার বাসায় রয়েছে।চাচাকে স্বস্তি লাগে তার। ওই বাসায় থাকলে চাচার জন্য চিন্তিত থাকতো।সিরাতের চাচা এখন পুরোপুরি সুস্থ।বিকেলে সিরাতের বান্ধবী মিতু এসে সিরাতকে তাদের বাসায় নিয়ে যায়।মিতু সিরাতের অনেক কাছের বান্ধবী। সিরাতের সুখ দুঃখের সাথী।সিরাত ছোটবেলা থেকেই শুধু মিতুর সাথেই মিশে আসছে।মিতু সিরাতকে নিজের রুমে নিয়ে গিয়ে বিছানায় ধপ করে বসে পরলো।মিতু যখনই জানতে পরেছে তখনি সাথে সাথে গিয়ে সিরাতকে নিজের বাসায় নিয়ে এসেছে।সিরাতও বিছানায় বসলো। সঙ্গে সঙ্গে মিতু রাগান্বিত কন্ঠে বললো,
“এখন তো আমাকে ভুলই গেচ্ছিস দেখছি।তুই যে এসেচ্ছিস একবারও আমাকে জানানোর প্রয়োজন বোধ করলিনা!

সিরাত মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো,” আরে আরে এতো রেগে যাচ্ছিস কেনো!আমিই তো তোকে ফোন দিয়ে জানালাম দেরীতে হলেও।”

মিতু ভেংচি কেটে বললো,”প্রথম দিন বলচ্ছিস!তিনদিন পর জানিয়ে এখন বলছো তুমিই জানিয়েছো আমাকে!”

সিরাত এগিয়ে গিয়ে মিতুর কাছে বসে বললো,”এখন বল তুই কেমন আচ্ছিস!আর তোর শাশুড়ী কই!”

মিতুু হাসিমুখে বললো,”আমি ভালো আছি। আর আমার শাশুড়ী আমার ননদের বাসায় বেড়াতে গিয়েছে।আমার কথা বাদ দে।তুই কেমন আচ্ছিস তোর শশুর বাড়ীর সবাই কেমন!দুলাভাইকে বিয়ের দিন দেখেতো অনেক ভালোই মনে হয়েছে।”

সিরাত মুখে জোরপূর্বক হাসির রেখা ফুটিয়ে বললো,”হুম সবাই অনেক ভালো।”

মিতু ভ্রুকুচকে সিরাতকে বোঝার চেষ্টা করছে। মিতুর থেকে কথা লুকানো সিরাতের জন্য অনেকটা অসম্ভব ব্যাপার। তাই সিরাত দ্রুত কথা এড়াতে বললো,

“তা এখন কী করবি!ভর্তি হয়েচ্ছিস কোথাও!”

মিতু দীর্ঘশ্বাস ফেলে কিছুটা অাক্ষেপের কন্ঠে বললো,”না রে।শাশুড়ী মা বলে দিয়েছেন আর পড়াশোনা করতে দিবেননা তিনি।সংসার আর পড়াশোনা নাকি একসাথে ঠিকমতো করা যায়না।

কথাটা শুনে সিরাতের অনেক খারাপ লাগলো।এটা কেমন কথা!আগে তিনি বলে দিলেন সংসার আর পড়াশোনা একসাথে ঠিকমতো দুটো করা যায়না!আগে দেখতো।সবাই যে পারেনা এমন তো নয়।সবাই তো সংসার আর পড়াশুনা দুটোই সুন্দর ভাবে করছে।তবুও অনেকে এমন মনমানসিকতা নিয়ে থাকে যে সংসার আর পড়াশোনা দুটো একসাথে ঠিকমতো করা যায়না।এদের জন্যই অনেক বিয়ের পর ইচ্ছা থাকা শর্তেও পড়াশোনা করতে পারেনা।হঠাৎ কলিংবেল বাজতেই মিতু দরজা খুলতে চলে গেলো।সিরাতও মিতুর পিছু পিছু আসলো।মিতু দরজা খুলতেই মিতুর ছোট ননদ ভিতরে আসলো।বয়সে মিতুর বড়ই তিনি।সিরাতকে দেখে তিনি বিরক্তি নিয়ে বললেন,

“সিরাত তুমি এখানে!”

সিরাত কিছু বলার আগেই মিতু বলে উঠলো,

“আমি নিয়ে এসেছি।সিরাত ওর চাচার বাসায় এসেছে।সেখান থেকে আমার এখানে নিয়ে আসলাম।”

তিনি সিরাতের পা থেকে মাথা পর্যন্ত চোখ বুলিয়ে বললেন,
“তা শশুড়বাড়ি থেকে বের করে দিছে! নাকি এবারের স্বামীও মারা গিয়েছে!”

মিতুর ননদের কথা শুনে সিরাতের চোখ ছলছল করে উঠলো।মিতু তার ননদের কথা শুনে আশ্চর্য হয়ে বললো,

“এসব কী বলছেন আপনি আপু!সিরাতের চাচা অসুস্থ তাই সিরাত ওর চাচার বাসায় এসেছে।”

তিনি পুনরায় বিরক্তি নিয়ে বললেন,”তাহলে ভালো।প্রথম স্বামীটা তো বিয়ের পরদিনে মারা গিয়েছে তাই ভাবলাম…..”

কথাটা শেষ করতে না দিয়ে মিতু রাগান্বিত কন্ঠে বললো,

“এতে সিরাতের কোনো দোষছিলোনা।মৃত্যু কারো হাতের উপর নির্ভর করেনা।আপনি শুধু কেনো সিরাতকে দোষারোপ করছেন!”

সিরাত আর একমূর্হত দাঁড়ালো না দৌড়ে চলে আসলো।মিতু অনেকবার পিছন থেকে ডেকেছে কিন্তুু সিরাত দাঁড়ায়নি।অনেক কষ্টে কান্না আটকে রেখেছে সিরাত।বাসায় এসে কলিংবেল বাজাতেই সিরাতের চাচাতো বোন এসে দরজা খুললো।আজকে সকালে এসেছে সে। ঢাকার ভিতরেই এক কলেজে পড়ে সে। কিন্তুু বাসা থেকে অনেক দূর হওয়ায় হোস্টেল থেকে পড়াশোনা করে সে।দরজা খুলতেই সিরাত দৌড়ে নিজের রুমে চলে গেলো।রুমের দরজা আটকিয়ে বিছানায় শুয়ে মুখ লুকিয়ে কান্না করতে লাগলো।সবাই সিরাতকেই দোষারোপ করে তার প্রথম স্বামীর মৃত্যুর জন্য। কিন্তুু এতে তার কী দোষ!

দুইমিনিট পর কন্ঠ শুনে চমকে উঠলো সিরাত।ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলো সে। সামনের ব্যাক্তিকে দেখে থমকে গেলো সে।অবাক হয়ে বললো,
“আপনি!”

চলবে!

#স্নিগ্ধ পরশ
#পর্ব_৭
#তানজিম_তানাজ

সামনে থাকা ব্যাক্তি পুনরায় বললো,”আপনি ঠিক আছেন!”

সিরাত চোখমুছে মাথা দুলালো।বিষ্মিত হয়ে বললো,”কিন্তুু আপনি এখানে!”

সিরাত দরজা শুধু ভিরিয়ে রেখেছিল। দ্রুত দরজা খুলে ভিতরে আসলো নিশি।হতদন্ড হয়ে বললো,”আমি তোকে বলতে ভুলে গেছিলাম ভিতরে সাদাদ আছে!”

পাশে চোখ বুলাতেই দেখলো সাদাদ দাড়িয়ে রয়েছে।সাদাদের থেকে চোখ ফিরিয়ে সিরাতের দিকে তাকাতেই চমকে উঠে নিশি।সিরাতের কাছে এগিয়ে বললো,”একি তোর চোখমুখের এমন অবস্থা কেনো!”

সাদাদ বলে উঠলো,”উনি কান্না করছিলেন।আমি কিছু বলতেই কান্না থামিয়েছেন।”

নিশি সিরাতের দিকে চেয়ে ইশারায় বললো “কী হয়েছে!”

সিরাত কিছু বললোনা।সে কিছু তেই বুঝতে পারছেনা সাদাদ এখানে কী করছে!দেখেতো মনে হচ্ছে নিশি আর সাদাদ পরিচিত।সিরাত ভ্রুকুচকে সাদাদের দিকে তাকিয়ে আছে।সাদাদ বুঝতে পরে স্লানহাসি দিয়ে বললো,

“আসলে আমি আর নিশি ফ্রেন্ড। বলতে গেলে বেষ্ট ফ্রেন্ড।আসলে তোমার রুমে কেউ ছিলোনা বলে এই রুমে ফ্রেস হতে বলেছিলো নিশি।”

সিরাত আস্তে করে বললো, “ওহ”

তখনই ডাক পরলো সিরাতের চাচির।তিনি বসার ঘরে যেতে বলচ্ছেন সাদাদকে নিয়ে।নিশি সাদাদকে বসার ঘরে আসতে বলে চলে গেলো।সাদাদ একপলক সিরাতের দিকে তাকিয়ে চলে আসলো।সিরাত উঠে ওয়াশরুমে গেলো।চোখমুখে পানি ছিটিয়ে বেড়িয়ে আসলো।আজমল সাহেব এক আত্মীয়ের বাসায় গিয়েছেন।কিছুসময় পর নিশি আর তার মাও যাবে।সিরাত যাবেনা বলেদিয়েছে।সাদাদ আর নিশি সোফা বসে গল্প করছে। আর সিরাতের চাচি রুমে বসে রেস্ট নিচ্ছেন।সিরাত দুইকাপ চা এনে সাদাদ আর নিশিকে দিলো।সাদাদ সিরাতকে প্রশ্ন করলো,”আপনার জন্য আনেনি!আপনি খাবেননা!”
সিরাত কিছু বলার আগেই নিশি হেসে বললো,”সিরাত খুব একটা চা খায় না। তুমি খাও।”

সিরাত ট্রে রান্না ঘরে রেখে এসে সোফায় বসলো।সাদাদ চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললো,”বাহ্। আপনি তো দেখছি বেশ ভালো চা বানান।”

সিরাত সৌজন্যমূলক হাসলো কিছু বললোনা।বসার ঘরে টুকটাক কথা হচ্ছে। নিশি আর সাদাদই বেশি কথা বলছে আর সিরাত মাঝে মাঝে সায় মিলাচ্ছে।সাদাদ মাঝে মাঝেই সিরাতকে দুইএকটা প্রশ্ন করছে।এতেক্ষণে সিরাত এইটুকু বুঝতে পারলো সাদাদ অনেক মিশুক প্রকৃতির।তার ব্যবহারও অনেকভালো।নিশি আর সাদাদ স্কুল থেকে একসাথে।নিশি জেনারেল লাইনে মাস্টার্স করছে আর সাদাদ ইন্টার্নি করছে।সাদাদ একজন ডাক্তার।

কিছুক্ষণ হয়েছে সাদাদ চলে গিয়েছে।সিরাতের চাচিও এইমাত্র আত্মীয়ের বাসায় যাওয়ার জন্য বেরিয়েছে। সিরাত দরজা বন্ধ করে ভিতরে আসলো।মূলত সিরাতের চাঁচির বোনের বাসায় দাওয়াত ছিল।নিশির ভালো লাগচ্ছিলোনা তাই যায়নি।নিশি সাদাদকে অনেকবার বলেছিলো রাতে এখানে খেয়ে যেতে।কিন্তুু সাদাদ জরুরি কাজ আছে বলে চলে গিয়েছে।

রাতের খাওয়া দাওয়া শেষে নিশি আর সিরাত এক বিছানায় শুয়ে আছে।দুইবোন শুয়ে শুয়ে গল্প করছে। গল্পের মধ্যেই নিশি জিজ্ঞেস করলো,”আচ্ছা সারাদিনে দুলাভাই তোকে একবারও ফোন দিলোনা!”
সিরাত থমকে গেলো।আহনাফ গত তিনদিনে এখন পর্যন্ত একবারও ফোন দেয়নি তাকে।সিরাত আমতা আমতা করে বললো,”হয়তো ব্যাস্ত আছে অনেক।”
নিশি ধমকিয়ে বললো,”তুই চুপ থাক ব্যাস্ত আছে!এতো ব্যাস্ত যে বউয়ের খোঁজ নিবেনা।”

সিরাত চুপ করে রইলো।কী বলবে তার মাথায় আসচ্ছেনা।তখনই ফোন বেজে উঠলো।সিরাত উঠে বসে ফোনের স্কিন দেখলো অপরিচিত নাম্বার।নিশি উৎসাহ নিয়ে বললো,

“কীরে দুলাভাই ফোন দিছে!”

সিরাত দুইপাশে মাথা নাড়ালো।নিশির উৎসাহ মিলিয়ে গেলো।বিষন্নতা নিয়ে নিশি আধশোয়া হয়ে উঠে বসলো।নিশি চোখের ইশারা দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“তাহলে!”

“জানিনা।”

এর মধ্যেই কল কেটে গিয়েছে।সাথে সাথে পুনরায় কল আসলো।নিশি চোখের ইশারায় আসস্ত করে কল রিসিভ করতে বললো।সিরাত কল রিসিভ করে সালাম দিলো কিন্তুু কোনো উত্তর আসলোনা।সিরাত এখন রীতিমতো বিরক্ত। এতো রাতে কল দিয়ে চুপ করে রয়েছে দেখে।তারপরও সিরাত শান্ত কন্ঠে বললো,
“কে বলছেন!”
সাথে সাথে পাশ থেকে নিশি বললো,”কে কল করেছে!”

সিরাত পুনরায় বললো,”কে বলছেন!”

সাথে সাথে অপর পাশের ব্যাক্তি কল কেটে দিলো।সিরাতের খুব বিরক্ত লাগলো।নিশি জিজ্ঞেস করলো,

“কে কল দিয়েছে!”

সিরাত বিরক্তির ছাপ মুখে স্পষ্ট রেখে শুয়ে নির্বিকার কন্ঠে বললো,”জানিনা।কিছুতো বললোনা।”

সিরাতকে বিরক্ত দেখে নিশি আর কিছু বললোনা।শুয়ে পড়লো।সিরাতের মনে একবার জন্য মনে হয়েছিলো হয়তো আহনাফ ফোন দিয়েছে। কিন্তুু আহনাফ দেয়নি।ভাবতেই ক্ষাণিকটা খারাপ লাগলো।পরমূর্হতেই নিজকে সামলিয়ে ভাবলো আমার কেনো খারাপ লাগচ্ছে!আমার এমন ভাবনা হওয়াটাই ভুল ছিল।উনি কেনো আমাকে ফোন দিবেন!
তারপরও কোথাও যেনে খারাপ লাগা করছে।আর কিছু ভাবলোনা সিরাত।নিজের অজান্তেই মনের কোণ থেকে এক চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো।

——————-
সকাল দশটার দিকে সিরাতের চাচার বাসায় হাজির হন নাদিয়া বেগম।ততক্ষণে সিরাতের চাচা চাচি বাসায় চলে এসেছিলো।নাদিয়া বেগম কিছু সময় বসে সিরাতকে নিয়ে চলে আসেন।সিরাত নিজের রুমে এসে ল্যাগেজ থেকে একটা সুতির থ্রিপিস নিয়ে পিছনে ঘুরতেই দেখলো আহনাফ দাঁড়িয়ে রয়েছে।সিরাত থতমতে খেয়ে গেলো।উনি এখানে! কিন্তুু ওনার তো আরো তিনদিন পর বাসায় আসার কথা ছিলো।আহনাফ অদ্ভুতভাবে সিরাতের দিকে তাকিয়ে আছে তা দেখে সিরাত ইতস্ত করে বললো,

“কিছু বলবেন!”

আহনাফ কিছু বললোনা।রুম থেকে বেরিয়ে আসলো।সিরাত আহনাফের যাওয়ার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওয়াশরুমে চলে গেলো।বাহিরে প্রচুর গরম।ঘেমে একাকার হয়ে গেছিলো সিরাত যার জন্য টানা এক ঘন্টা গোসল করে বের হলো।সিরাত বের হয়েই দেখলো আহনাফ সোফায় বসে কোলের উপর বালিশ রেখে তারপর ল্যাপটপ রেখে কিছু একটা করছে।তখনিই আহনাফ সিরাতের দিকে তাকালো।সিরাত চমকে উঠলো।আহনাফ বিরক্তমাখা কন্ঠে বললো,

“গোসল করতে এতোসময় লাগে বুঝি!মা তোমার জন্য অনেক সময় অপেক্ষা করেছে।”

সিরাত হতদন্ড হয়ে বললো,”আমি এক্ষুণি যাচ্ছি।”

কথাটা বলেই সিরাত যেতে নিলে আহনাফ বলে উঠলো,”দাঁড়াও।কোথায় যাচ্ছো!মা নিচে নেই। তারা বেরিয়ে পরেছে। তোমার মতো কাণ্ডজ্ঞানহীনের জন্য আর কতো সময় অপেক্ষা করবে!আমি চলে যেতে বলেছি।”

সিরাত হতাশ হয়ে আহনাফের দিকে তাকালো।মনে মনে নিজের উপর রাগ লাগচ্ছে।সে তো জানতো তারা এখন বের হবে গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্যে তাও কেনো সিরাত এতো সময় নিয়ে গোসল করলো!তার আরো আগে বের হওয়া উচিত ছিল।নিজের উপর রাগ লাগচ্ছে অনেক।
আহনাফ পুনরায় নিজের কাজে ব্যাস্থ হয়ে গেলো।সিরাতে মাথায় প্যাচানো তোয়ালে খুলে বারান্দায় মেলে দিয়ে আসলো।তারপর ধোঁয়া ভিজা কাপড়চোপড়ের বালতি নিয়ে ছাঁদে চলে আসলো।ছাদে কাপড়চোপড় মেলে দিয়ে একপাশে এসে দাঁড়ালো। আকাশে কালো মেঘ তবুও রোদ আছে৷ তার মধ্যে রয়েছে নির্রমল বাতাস। যা সিরাতের চুলকে বারবার স্পর্শ করে এলোমেলো করে দিচ্ছে।সিরাত ক্ষাণিকক্ষন ছাঁদে দাঁড়িয়ে রইলো।পরিবেশটা তার অনেক ভালো লাগচ্ছে।এর আগে দুইবার ছাঁদে এসেছিলো তখন প্রচন্ড রোদ ছিল।আজকে রোদের তাপ কম।কিছুসময়ের মধ্যে চোখের পলকে ঝুম করে বৃষ্টি নামলো।সিরাত দ্রুত মেলে দেওয়া কাপড়চোপড় নামিয়ে পুনুরায় বালতিতে রাখলো তারপর সিড়ীর কাছে রেখে দিয়ে আসলো। আজকে সিরাতের বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছে করছে অনেক।সাতপাঁচ আর না ভেবে ছাঁদের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়ালো। মিনিট দশেক পর নেমে আসলো। তার অনেক ঠান্ডা লাগচ্ছে নাহলে আরো অনেক সময় ভিজবার ইচ্ছা ছিলো।

সিরাত রুমে ধীর পায়ে ঢুকে চারপাশে চোখ বুলালো।আহনাফ রুমের কোথাও নেই।সিরাত স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো। হাতের বালতি বারান্দায় রেখে দ্রুত লাগেজের ভিতর থেকে কামিজ বের করলো।তখনি আহনাফের কন্ঠ শুনে থমকে গেলো সিরাত।চুপ করে রইলো।আহনাফ পুনরায় বললো,

“এই অবেলায় বৃষ্টিতে কেনো ভিজেছো?”

সিরাত উঠে দাঁড়িয়ে বললো, “এমনি।”

আর এক মিনিটও দাঁড়ালোনা। দ্রুত ওয়াশরুমে চলে গেলো।
আহনাফের এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে অনেকটা লজ্জা লাগচ্ছিলো সিরাতে। পুরো ভিজে রয়েছে সে।ক্ষানিক সময় পুনরায় গোসল করে বের হলো সিরাত।সিরাত বের হতেই আহনাফ রাগান্বিত কন্ঠে বললো,

“গাধা নাকি তুমি!বৃষ্টিতে ভিজে এখন আবার এতোসময় নিয়ে গোসল করলে কেনো।একঘন্টা গোসল করেই তো বৃষ্টিতে ভিজেছো। তাহলে এখন আবার এতোসময় কেনো গোসল করলে!ঠান্ডা লাগে যদি!”

আহনাফের শেষ কথাটা শুনে থমকে গেলো সিরাত। সিরাতকে চুপ থাকতে দেখে আহনাফ দ্বিগুণ রাগ দেখিয়ে বললো,”কথা বলচ্ছো না কেনো!”

কথাটা ক্ষানিকটা জোরে বলছে আহনাফ।যার কারণে কেঁপে উঠলো সিরাত।পরমূর্হতেই সেদিন রাতের কথা মনে পড়তেই সিরাত রাগ দেখিয়ে বললো,
“আমার ঠান্ডা লাগলে তাতে আপনার কী!আপনার আমাকে নিয়ে ভাবতে হবেনা।”

আহনাফ অবাক হয়ে গেলো সিরাতের কথায়।রাগের আভা তার মুখ থেকে বিলিন হয়ে গেলো।কিছু বলতে নিয়েও আর কিছু বললোনা।সিরাত বারান্দায় চলে আসলো। তার অনেক রাগ লাগচ্ছে সেদিন আহনাফ যেভাবে বিবেকহীনের মতো রাতে রাস্তায় রেখে এসেছিলো এখন তার বিবেকবোধ কোথা থেকে আসছে!এখনও বিবেকবোধ থাকার দরকার নেই।সিরাত বারান্দায় ভিজা কাপড়চোপড় মেলে দিয়ে রুমে আসলো। রুমে আসতেই চমকে উঠলো সে।

চলবে!

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে