#স্নিগ্ধ পরশ
#পর্ব_১
#তানজিম_তানাজ
“একটা বিধবা মেয়ের সাথে আমার একমাত্র ভাতিজার বিয়ে দিলে তুমি!তোমার কী বুদ্ধিভ্রষ্ট হয়েছে!এই মেয়ের স্বামী বিয়ের একদিনের মাথায় মারা গিয়েছে এমন একটা অপয়া মেয়ের সাথে আমার ভাতিজার বিয়ে দিলে কোন সাহসে?গিয়েছিলে তো এই মেয়ের বিয়ে খেতে আর নিজের পুত্রবধূ করে নিয়ে আসলে!”
ক্ষোভে কথাগুলো বললেন মিসেস রোকেয়া বেগম। নাদিয়া বেগম ইতস্তত করে বললেন,
“উফফ!আস্তে কথা বলো রোকেয়া। সিরাত শুনে ফেলবে।মেয়েটা অনেক কষ্ট পাবে কথাগুলো শুনলে।”
রোকেয়া বেগম বিরক্তকর মুখমণ্ডল নিয়ে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালো। প্রচন্ড বিরক্ত নিয়ে বললো,
“শুনলে শুনবে। ভুল কিছুতো বলিনি।তোমাকে বোকা বানিয়ে ঘাড়ে চেপে বসেছে একেবারে বউ হয়ে আসলো এই বাড়িতে।”
রোকেয়া বেগমের কথা শুনে খুবই বিরক্ত হলেন নাদিয়া বেগম।গম্ভীর কন্ঠে বললেন,
“এসব আবোলতাবোল কথা কেনো বলছো! আর সিরাতের মত ছিলানা এই বিয়েতে। ও তো আহনাফকে বিয়ে করতে রাজিই হতে চাইছিলোনা পরে ওর বাবার কথা রাখতে এই বিয়েতে রাজি হয়।”
“তোমাকে আমার কিছু বুঝাতে হবেনা।সবই এই মেয়ের বুদ্ধি।ইচ্ছে করে প্রথমে রাজি হয়নি।জানি কেউ একে দোষারোপ করতেনা পারে। আমি কী বুঝিনা চালাকি।”
নাদিয়া বেগম পুনরায় গম্ভীর কন্ঠে বললেন,
“সবাইকে নিজের মতো মনে করোনা।তুমি এখন যেতে পারো।তোমার এখানে আর কোনো কাজ নেই।”
রোকেয়া বেগম রেগে গেলো নাদিয়া বেগমের কথায়।ভালো করে নিজের অপমানটা বুঝতে পারলো।কিন্তুু কিছু বললোনা আর।হাত থেকে ফুলের ডালাটা বিছানার উপর রেখে রুম থেকে চলে আসলো।রোকেয়ার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে এক দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করলো নাদিয়া বেগম।
নাদিয়া আর রোকেয়া বেগম মিলে রুম ফুল দিয়ে সাজাতে ছিলো।নাদিয়া বেগম ফুলের ডালাটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। ডালাটা বারান্দায় রেখে ভিতরে আসলো।রুমে আসতেই দেখলো অন্যমনষ্ক হয়ে সিরাত দাঁড়িয়ে রয়েছে।নাদিয়া বেগম সিরাতের কাছে এগিয়ে গেলো।সিরাত এতো সময় ওয়াশরুমে ছিলো কিন্তুু রোকেয়া বেগমের সব কথাই তার কর্ণকুহর হয়েছে।হঠাৎ মাথা কারো স্পর্শ সিরাত চমকে উঠলো।নাদিয়া বেগম পরম স্নেহে সিরাতের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে হেসে বললেন,
“ভয় কেনো পাচ্ছো মা!ভয়ের কিছু নেই আমি আছি তো।”
মূর্হতেই চোখ ছলছল করে উঠলো সিরাতের।আজ পর্যন্ত এখনো কেউ তাকে বলেনি ভয়ের কিছু নেই আমি আছি তো।শুধুমাত্র আমি আছি তো পাশে এই কথাটাই অনেক যথেষ্ট মনের সাহস জোগাতে, মনে ভরসা সঞ্চয় করতে।কিন্তুু এই কথাটা অনেক দূর্লব লাইন।সহজে শুনতে পাওয়া যায়না।যদি যেতো তাহলে হয়তো জীবনের কঠিন সময় অনেক সহজে পারি দেওয়া যেত।সিরাতের ভাবনায় ছেদ ঘটিয়ে নাদিয়া বেগম বললেন,
“চলো বিছানায় বসবে।”
নাদিয়া বেগম সিরাতকে বিছানায় বসিয়ে বললো,
“তুমি বসো মা। আমি এক্ষুণি আসছি।”
সিরাতকে বসিয়ে রেখে নাদিয়া বেগম নিচে চলে গেলেন।সিরাত চুপচাপ বসে ভাবতে লাগলো।নাদিয়া বেগম কত সহজে তাকে আপন করে নিয়েছে।শুধুমাত্র দুইদিনের আলাপে নিজের ছেলের বউ করে নিয়ে আসলেন!কিন্তুু বিয়ের মধ্যে যে করুণাও রয়েছে।সে তো কখন চাইনি করুণার পাত্রী হতে।তাহলে ভাগ্য কেনো তাকে বাধ্য করলো করুণার পাত্রী হতে!হয়তো ভাগ্য নিষ্ঠুর।সবসময় নিষ্ঠুরতার পরিচয় দেওয়া তার কাজ।মানুষ যা করতে চায়না ভাগ্যের পরিহাস তাকে বাধ্য করে তা করতে।আজকে সিরাতের বিয়ে ছিলো আদনানের সাথে।আদনান নিজ থেকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়।সিরাতে আগে একটা বিয়ে হয়েছিলো।বিয়েটা হয়েছিলো পারিবারিক ভাবে।কিন্তুু বিয়ের পর দিনই এক্সিডেন্টে মারা যায় তার স্বামী।সাথে সাথে নতুন বউয়ের তকমা থেকে বিধবার তকমা লাগে তার গায়ে।সব জেনেই আদনান তাকে বিয়ে করতে রাজি হয়।কিন্তুু বিয়ের আসরে এই কথা তার মা জেনে বিয়েতে অস্বীকার করেন তিনি আর আদনানও কোনো কথা না বাড়িয়ে বিয়ের আসর থেকে চলে যায়।ভরা বিয়ের আসরে কটু কথার পাত্রী হয় সিরাত।সবার অপমানের হাত থেকে বাঁচাতে তখনই নাদিয়া বেগম এসে নিজের ছেলের জন্য বিয়ের প্রস্তাব দেয়।সিরাত প্রথমে রাজি হয়নি।কিন্তুু পরে চাচার কথা রাখতে বিয়েতে রাজি হয়।
হঠাৎ রুমে প্রবেশের আভাস বুঝতে পেরে সিরাত দরজার পানে তাকায়।নাদিয়া বেগম হাতে খাবারের প্লেট নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করছে।সিরাতের পাশে বসে ভাত মেখে তার সামনে ধরলো।সিরাত শুধু থমকে সেদিকে তাকিয়ে রয়েছে।নাদিয়া বেগমের ব্যবহারে সিরাত ক্ষণে ক্ষণে অবাক হচ্ছে।অল্প সময়ে অনেকটা আপন করে নিয়েছেন তিনি সিরাতকে।নাদিয়া বেগম চোখে ইশারায় সিরাতকে খেতে বললেন।সিরাত খাবার মুখে নিয়ে খেতে লাগলো।এক অদ্ভুত ভালো লাগা কাজ করছে তার মনে।খাবারে এক অদ্ভুত তৃপ্তি পাচ্ছে আজ সে।এই খাবারের ভিতর লুকায়িত রয়েছে মাতৃস্নেহ।যে স্নেহ পাওয়ার জন্য এতোদিন তার মন আফসোস করতো।ইস যদি তারও মা বেচে থাকতে তাহলে তাকেও হয়তো তার মা মুখে তুলে খাইয়ে দিতো।আজ অনেক বছর পর মাতৃস্নেহের ছোঁয়া পেল।সিরাত ছোট থাকতে তার বাবা মা রোড এক্সিডেন্টে মারা যায়।তারপর থেকে চাচার বাসায় বড় হয়েছে সে।চাচার ভালোবাসা আর চাচির অবহেলার পাত্রী হয়ে তার বড় হওয়া।এই রোড এক্সিডেন্ট তার জীবন থেকে অনেক কিছু কেড়ে নিলো।
………..
সবে ওটি থেকে বের হলো আহনাফ।নিজের কেবিনে এসে গায়ের এপ্রোন খুলে চেয়ারের উপরে রাখলো। চেয়ারে বসে টেবিলে হাত রেখে তার উপর মাথা নুয়িয়ে রাখলো।মাথা ভার হয়ে রয়েছে তার।ফোনের আওয়াজে মাথা তুলে ফোনের দিকে তাকালো।সে জানে এখন তার মা ফোন দিয়েছে।আহনাফ ফোন কেটে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। হাতে এপ্রোনটা নিয়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলো।
…………
সিরাত পরনের ভারী বেনারসি পাল্টে নরমাল সুতির শাড়ী পরেছে।গরমে অস্বস্তি হচ্ছিলো তার অনেক।মাথা যন্ত্রণায় মরে যাওয়ার উপক্রম তার।শরীর যেন ছেড়ে দিচ্ছে তার। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো বারোটা বাজে পনেরো মিনিট।তার যার সাথে বিয়ে হয়েছে সেই ব্যাক্তির নাম আহনাফ। শুধু এইটুকু জানে সিরাত।তাকে এখনো দেখেনি সিরাত। বিয়ের সময় তার পাশে বসেছিলো অনেক সময় কিন্তুু তার দিকে তাকানো হয়নি সিরাতের।এই বাসায় আসার সাথে সাথে বেরিয়ে গিয়েছে আহনাফ।নাদিয়া বেগম বললেন তার জরুরি কাজ আছে তাই গিয়েছে।সিরাত বিছানায় গা হেলিয়ে দিলো।আর বসে থাকা সম্ভব হচ্ছেনা তার পক্ষে।বিছানায় শুতেই নিজের অজান্তে ঘুমিয়ে পড়লো সিরাত।
কিছুক্ষণ পর আহনাফ দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করলো। রুমে আসতেই চোখ গিয়ে পরলো সিরাতের দিকে। বাহিরে ঠান্ডা হওয়া বইছে।হয়তো ঝড় উঠবে।রুমের জনালা খোলা। বাহিরের বাতাস রুমে ঠান্ডা আবহাওয়া তৈরী করছে।স্নিগ্ধ এক ঘুমন্ত রমনীর দিকে তাকিয়ে রয়েছে আহনাফ।সেই তাকানো বেশি সময় স্থায়ী হলোনা।আহনাফ সিরাতের থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে নিজের দিকে তাকালো।আধ ভেজা হয়ে রয়েছে সে।দ্রুত কাবার্ডের কাছে গিয়ে নিজের জামাকাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো।
টাওয়াল দিয়ে চুল মুছতে মুছতে বের হলো আহনাফ।পরনে সাদা টি শার্ট আর কালো ট্রাউজার। টাওয়াল চেয়ারে মেলে দিয়ে রুমের জানালা বন্ধ করলো।মনস্থির করলো সোফায় ঘুমাবে সে।বিছানার কাছে এগিয়ে গেলো বালিশ নিতে।সিরাতের অপরপাশে বালিশ রাখা। আহনাফ একটু ঝুঁকে বালিশ নিতে গেলো।সঙ্গে সঙ্গে সিরাতের ঘুম ভেঙ্গে গেলো।চোখ খুলতেই আহনাফকে দেখে চিৎকার করলো।আহনাফ চমকে সোজা হয়ে দাঁড়ালো।সে পুরো থমকে গেলো।সিরাত উঠে বসে যা বললো তা শুনে আহনাফ পুরো অবাক।
চলবে!