#স্তব্ধের_স্নিগ্ধতা
#মাশফিয়াত_সুইটি(ছদ্মনাম)
পর্ব:০৯
সূর্যের রশ্মি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে বাড়িতে মানুষজন গিজগিজ করছে নাস্তা করেই দুপুরের খাবারের তোড়জোড় চলছে রান্নাঘরে।স্নিগ্ধতার ভোর বেলায় ঘুম থেকে উঠার অভ্যাস,স্নিগ্ধতার সঙ্গে থাকতে থাকতে স্তব্ধেরও এমন একটা অভ্যাস হয়ে গেছে তাই ফজরের সময় উঠে নামাজ পড়ে আবারও ঘুম দিয়েছে।
স্নিগ্ধতা রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালো রান্নাঘরে স্তব্ধের মামী সঙ্গে আরও কিছু মাঝ বয়সী মহিলারা রান্নার আয়োজন করছেন।স্নিগ্ধতা ভেতরে প্রবেশ করতেই মামী স্নিগ্ধতার দিকে একবার তাকিয়ে মৃদু হেসে,
– ঘুম ভেঙ্গে গেছে? কিছু লাগবে?
– না।
– তাহলে এখানে এলে যে?
– একা ভালো লাগছিল না তাই এসেছি আমি কাজ করে দেই?
– তোমাকে কিছু করতে হবে না।
– দিন না মামী আমার রান্না করতে ভালো লাগে কোন কাজটা করবো বলুন।
– তোমার যেটা ইচ্ছে করো।
স্নিগ্ধতা সবার সঙ্গে কাজ করতে লাগলো।অরিত্রি শিকদারকে দেখতে অনেক খুশি খুশি লাগছে রাতুল শিকদার কপাল কুঁচকে তাকিয়ে বললেন,
– কি ব্যাপার আজ এতো খুশি কেন?
– রুশি আসছে।
– কোথায়!
– মিলির বিয়ে উপলক্ষে এখানে আসছে।
– ওহ কবে আসবে?
– এইতো এলো বলে তুমি বরং তোমার ছেলের বউয়ের দিকে খেয়াল রেখো বাচ্চা মেয়ে কখন কি হয়ে যায়।
বলেই অরিত্রি শিকদার বাঁকা হাসলেন রাতুল শিকদার চিন্তিত হয়ে গেলেন ঘর থেকে বেরিয়ে হাঁটা ধরলেন।স্তব্ধ বিছানায় হেলান দিয়ে গেইম খেলছে রাতুল শিকদার ছেলের কাছে এসে বললেন,
– বসে বসে বাচ্চাদের মতো গেইম খেলা ছাড়া কোনো কাজ নেই? স্নিগ্ধতা কোথায়?
– জানি না।
– জানি না বললে হবে না নিজের বউয়ের খবর জানতে হবে, নতুন এক জায়গা নতুন মানুষ ওর কাছে সবকিছু অচেনা তাই ওকে দেখে রাখার দায়িত্ব তোর।
– পারবো না তুমি গিয়ে তোমার পুত্রবধূর খেয়াল রাখো।
– ভেবেছিলাম এবার হয়তো ভালো হয়ে গেছো কিন্তু না আমার ভাবনা সম্পূর্ণ ভুল মা যেমন ছেলে তো তেমনই হবে।
স্তব্ধ নিজের মতো করে গেইম খেলছে, ছেলের কাছে পাত্তা না পেয়ে রাতুল শিকদার রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে চলে গেলেন।
স্নিগ্ধতা রান্না করে মিলির ঘরের দিকে যাচ্ছিল এখন গোসল করা খুব জরুরী ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে গেছে শাড়ির কিছু কিছু জায়গা ঘামে ভিজে গেছে। আচমকা কেউ স্নিগ্ধতার হাত টেনে ধরল স্তব্ধকে দেখে স্নিগ্ধতার ঠোঁটের কোণে হাসি প্রশস্ত হয়েছে স্তব্ধ স্নিগ্ধতাকে টানতে টানতে ধমক দিয়ে বলল,
– এতক্ষণ কোথায় ছিলে? তোমার জন্য ড্যড এর কাছে বকা খেতে হয়েছে।
– রান্নাঘরে ছিলাম।
– রান্নাঘরে যেতে হবে কেন সবসময় পাকামো।
– এখানে এসে আপনি তো আমায় ভুলেই গেছেন গতকাল রাত থেকে আপনার খবরই নেই, একা একা ভালো লাগছিল না তাই তো রান্নাঘরে গিয়েছিলাম।
স্তব্ধ স্নিগ্ধতার হাত ছেড়ে ব্রু নাচিয়ে বলল,
– মিস করছিলে আমায়?
স্নিগ্ধতা থতমত খেয়ে গেল কিছুটা তুতলিয়ে বলল,
– মি..মিস করেছি কখন বললাম!
– তার মানে মিস করোনি?
স্নিগ্ধতা চুপ করে রইল মুখ খুললেই বিপদ লজ্জায় পড়তে হবে। স্তব্ধ আবারো ধমক দিয়ে বলল,
– ছিহ তোমার শরীরে জীবাণু আছে তাড়াতাড়ি গোসল করতে যাও।
স্নিগ্ধতা মুখ বাঁকিয়ে,
– এ্যহ আসছে আমার জীবাণুমুক্ত জামাই।
স্নিগ্ধতা ওয়াশরুমে ঢুকে গেল স্তব্ধ মুচকি হেসে বিছানায় বসে পড়লো।
_____________
নিচে অনেক হৈচৈ হচ্ছে মিলি স্তব্ধ আর স্নিগ্ধতাকে নিচে যাওয়ার জন্য ডেকে গেছে। স্তব্ধ সামনে স্নিগ্ধতা তার পিছু পিছু সামনে এগোচ্ছে, হল ঘরে অনেক লোকজন হেসে হেসে কথা বলছে মোটামুটি সবার মুখ খানিকটা পরিচিত হলেও তিনজন নারীকে পুরোপুরি অপরিচিত লাগছে স্নিগ্ধতার কাছে। স্তব্ধকে দেখতেই একজন মাঝ বয়সী মহিলা এগিয়ে এসে,
– স্তব্ধ বাবা কেমন আছিস?
স্তব্ধ হেসে জবাব দিল,
– ভালো আন্টি, তুমি কেমন আছো?
– আমিও ভালো।
স্নিগ্ধতা একপাশে দাড়িয়ে তাদের দেখছে।অরিত্রি শিকদার মহিলার কাঁধে হাত রেখে,
– রুশি আমার সঙ্গে চল তোর সাথে অনেক কথা আছে।
– আপা একটু সবুর কর আমারও তোর সঙ্গে অনেক কথা আছে।
স্নিগ্ধতার চিনতে এবার অসুবিধা হয়নি এর আগেও অনেকবার এই নামটা শুনেছে এবার শুধু চোখের দেখাটা হয়ে গেছে। রুশি স্নিগ্ধতার দিকে এগিয়ে গেল স্নিগ্ধতার গালটা টেনে মৃদু হেসে বললেন,
– তুমিই তাহলে স্তব্ধের বউ যাকে দুলাভাই জোর করে স্তব্ধের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছে।
স্নিগ্ধতা মাথা নিচু করে দাড়িয়ে রইল রুশি নামক মহিলাটি যে সুবিধার না এটা তার বোধগম্য হয়ে গেছে।রুশি মেয়ে দু’টোর উদ্দেশ্যে বললেন,
– নাতাশা, নেহা যাও গিয়ে চেঞ্জ করে নাও আমি তোমার আন্টির ঘরে যাচ্ছি।
অরিত্রি শিকদার এবং রুশি উপরে চলে গেলেন, মেয়ে দুটিও পেছনে পেছনে চলে গেল।
‘তোর আসাতে আমি যে কি খুশি হয়েছিরে রুশি।’
– তুই খুশি হলেও আমি খুশি হতে পারিনি সবাই জানে স্তব্ধের সঙ্গে নাতাশার বিয়ে হবে যেই আমি মেয়েদের নিয়ে ট্যুরে গেলাম অন্য একটা মেয়ের সঙ্গে স্তব্ধের বিয়ে হয়ে গেল।
– সবকিছু রাতুলের প্লান ও ইচ্ছে করে আমার ছেলেটাকে ব্ল্যাকমেইল করে বিয়ে করিয়েছে।
– নাতাশাকে কিভাবে বুঝাবো? স্তব্ধের বিয়ের কথা শুনেই মেয়েটা আমার কষ্ট পেয়েছে।
– নাতাশাকে আমি বুঝিয়ে বলবো আর হ্যা উকিলের সঙ্গে কথা হয়ে গেছে মিলির বিয়েটা শেষ হলেই বাড়িতে গিয়ে ডিভোর্স করিয়ে মেয়েটাকে বিদায় করে দিব।
– এখনও অনেকগুলো দিন বাকি এ ক’দিনে লোকজন জানাজানি হলে মান সম্মান থাকবে না।
– আমাদের বাড়ির লোক ছাড়া কেউ জানেনা।
স্নিগ্ধতার হাতের রান্না খেয়ে সবাই অনেক প্রশংসা করেছে অরিত্রি শিকদারের অনেক রাগ হচ্ছিল। সন্ধ্যায় মিলির গায়ে হলুদ তাই বিকেলে পার্লার থেকে সাজানোর জন্য কিছু মেয়ে এসেছে, মিলির সঙ্গে স্নিগ্ধতার ভালোই ভাব জমে গেছে, মিলির জোরাজুরিতে স্নিগ্ধতাকেও সাজতে হলো।
ছেলেপক্ষ থেকে অনেক লোকজন এসেছে হলুদ লাগানোর জন্য। একটা ছেলে বারবার স্নিগ্ধতার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে প্রথমে খেয়াল না করলেও এখন স্নিগ্ধতা ঠিক বুঝতে পারছে ছেলেটা তাকে দেখছে।স্নিগ্ধতার বেশ অস্বস্তি লাগছে এখান থেকে সরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই ছেলেটা তার সামনে এসে দাড়ালো লাজুক হেসে বলল,
– আপনি দেখতে অনেক সুন্দর।
স্তব্ধ এসে স্নিগ্ধতার ঘাড়ে হাত রাখলো, এতে দু’জনেই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে।স্তব্ধ নিজের চুলগুলো স্লাইড করতে করতে বলল,
– সুন্দর তো লাগবেই দেখতে হবে না বউটা কার।
ছেলেটা বিষ্মিত দৃষ্টিতে প্রশ্ন করলো,
– বউ! কে বউ? কার বউ?
– যাকে তুমি এতক্ষণ ধরে চোখে হারাচ্ছিলে যাকে তোমার কাছে সুন্দর লাগছে সেই আমার বউ।
– ও আপনার!
– ও আমার একমাত্র বউ।
– দেখে বুঝাই যায় না উনি যে বিবাহিত।
বলেই ছেলেটি দ্রুত জায়গা ত্যাগ করলো।স্নিগ্ধতা স্তব্ধের হাত নিজের কাঁধ থেকে সরিয়ে দিয়ে চলে যাচ্ছিল স্তব্ধ সঙ্গে সঙ্গে তার হাত ধরে,
– কি বলে গেল শুনলে তোমাকে দেখে নাকি বিবাহিত বুঝা যায় না, তাহলে এখন আমার কি করা উচিত বলো তো যাতে সবাই তোমায় দেখলেই তুমি যে বিবাহিত বুঝে যায়।
– জানি না।
– জানি না বললে তো হবে না নিজের বউয়ের সেফ্টির জন্য আমাকে জানতেই হবে।
– ছাড়ুন আমায় মানুষজন দেখলে কি ভাববে।
– আমার বউকে আমি ধরেছি দরকার হলে কোলে নিয়ে বসে থাকব কার কি?
– দিনে দিনে আপনি অসভ্য হয়ে যাচ্ছেন।
– কি অসভ্যতামি করলাম?
স্নিগ্ধতা নিজের হাত ছাড়িয়ে চলে গেল স্তব্ধও পিছু পিছু যাওয়া ধরল। দূর থেকে পুরো দৃশ্যটা একজন মনোযোগ সহকারে দেখল তার চোখ ভিজে গেছে অরিত্রি শিকদার কাঁধে হাত রাখতেই মেয়েটা চোখের পানি আড়ালে মুছে নিলো। অরিত্রি শিকদার বললেন,
– নাতাশা এসব দেখে একদম কষ্ট পাবি না।
– ছোট থেকে জেনে এসেছি স্তব্ধ শুধু আমার ওর সঙ্গে আমার বিয়ে হবে আজ কিনা অন্য একটা মেয়ে আমার কাছ থেকে ওকে কেড়ে নিলো আন্টি।
– কেউ কেড়ে নেয়নি সবকিছু পরিস্থিতির কারণে হয়েছে চিন্তা করিস না স্তব্ধ এখনও তোর।
– ওই মেয়েটা?
– ওর ব্যবস্থা আমি আর তোর মা করবো।
নাতাশার চোখে খুশি চকচক করছে। গায়ে হলুদ শেষ মানুষজন যেতে যেতে অনেক রাত হয়ে গেছে আজকেও স্নিগ্ধতা মিলির সঙ্গে থেকেছে মিলির অনুরোধে।
____________
দুপুরে বরযাত্রী এলো খাওয়া দাওয়া শেষ করে বিয়ে পড়ানো শেষ হলো। যাওয়ার সময় মিলি অনেক কান্নাকাটি করেছে, মিলি যেতেই বাড়ির সবাই যেন মনমরা হয়ে গেল হওয়ারই কথা এত যত্নে বড় করা মেয়ে আজ অন্য এক বাড়িতে চলে গেল।
স্নিগ্ধতারও খারাপ লাগছে এই দু’দিনে মিলির সঙ্গে সখ্যতা গড়ে উঠেছিল।আরও একদিন থেকে সবাই বাড়িতে ফিরে এলো। রাহেলা বেগম বাড়িতেই ছিলেন অনেকবার অরিত্রি শিকদার যেতে বলেছিলেন কিন্তু তিনি যাননি।
স্নিগ্ধতা বাড়ি ফিরে ফ্রেশ হয়েই রাহেলা বেগমের ঘরে গেল। রাহেলা বেগমের মাথায় তেল মালিশ করতে করতে বলল,
– কেমন আছো দিদান?
– এখন ভালো আছি।
– আগে কি ভালো ছিলে না?
– না তুই ছিলি না কেউ এত যত্ন করে তেল মালিশ করে দেয়নি।
– এখন আমি এসে গেছি রোজ তেল লাগিয়ে দিব।
– আমার দাদুভাইয়ের মাথায়ও লাগিয়ে দিস এর বদৌলতে যদি মাথা থেকে ভূত নামে।
– উনার মাথায় ভূত আছে!
– হুম।
স্তব্ধ বাড়িতে নেই এসেই চেঞ্জ করে বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে বের হয়েছে। স্নিগ্ধতা রাহেলা বেগমের ঘর থেকে নিজের ঘরে চলে এলো, আরিয়া শশুর বাড়িতে চলে গেছে অরিত্রি শিকদার আরো কিছুদিন থেকে যেতে বলেছিলেন কিন্তু কয়েকদিন পর আবার আসবে বলে মা’কে বুঝিয়ে চলে গেছে।
স্নিগ্ধতার সেদিনকার রাতের কথা মনে পড়তেই ভেতরে একটা ভয় ঢুকে গেল দ্রুত মোবাইলটা নিয়ে স্তব্ধের নাম্বারে কল দিল। রাতুল শিকদার স্নিগ্ধতাকে নতুন মোবাইল কিনে দিয়েছে যাতে যখন ইচ্ছে পরিচিত মানুষদের সঙ্গে কথা বলতে পারে। কয়েকবার রিং হওয়ার পর স্তব্ধ ফোন ধরে বলল,
– কি হয়েছে ইদানিং আমায় মিস করছো মনে হচ্ছে?
– একটা দরকারি কথা ছিল।
– বলো।
– যেখানেই যান যার সঙ্গেই মিশুন না কেন উল্টো পাল্টা কিছু ভুলেও খেয়ে আসবেন না সেদিন রাতে কিছু বলিনি বলে আজও যে বলবো না এসব ভাববেন না।
– এটা বলার জন্য আমার সময় নষ্ট করলে? আমি তো ভাবলাম আমাকে হয়তো মিস করছিলে যাই হোক ভয় পেও না বউ ফলের জুস ছাড়া আর কিছুই খাব না।
– না খেলে ভালো।
বলেই স্নিগ্ধতা কল কেটে দিল।স্তব্ধ ফোনের দিকে তাকিয়ে,’যাহ কেটে দিল! কি আনরোমান্টিক বউ।’
অরিত্রি শিকদার রাতুল শিকদারের পাশে বসে বললেন,
– রুশি নাতাশা এবং নিতুকে নিয়ে আমাদের বাড়িতে কিছুদিন থাকবে আমিই বলেছি আসতে একা একা ভালো লাগে না।
– এক কোথায় ছেলের বউ আছে মা আছে।
– মা তো এখন তার নাত বউয়ের ভক্ত হয়ে গেছে রুশি এসে থেকে যাক ক’দিন।
– নিজের বাড়ি ছেড়ে আমাদের বাড়িতে?
– আমি বলেছি তাই আসবে এ নিয়ে কোনো কথা শুনতে চাই না আগেই জানিয়ে দিলাম।
অরিত্রি শিকদার গুনগুন করতে করতে চলে গেলেন। রাতুল শিকদার কপালে হাত দিয়ে,’কে জানে এদের মনে কি চলছে?
চলবে……