#সৌরকলঙ্ক
#উম্মে_প্রভা
#পর্ব_৩
সজীবকে দ্রুত পায়ে সামনে আগাতে দেখে পিছু ডাকলো আদিব।সজীব তার ডাকের উত্তরে সেভাবেই সামনে আগাতে আগাতে বলল,
-পরে কথা হবে আদি। আসছি।
সজীবের বিচলিত কণ্ঠ।আদিব বুঝলো সেজ চাচার বাড়ি কিছু হয়েছে। সজীবের পিছু নিতে পা বাড়ালো সামনে কিন্তু পরক্ষণে পুরোনো কিছু ঘটনা মনে পড়তেই বেড়িয়ে নেওয়া পা থেমে গেল শূন্যে।স্থির হলো পা জোড়া।চোখ বন্ধ করে একটা শ্বাস ফেলল।পিছিয়ে এলো।পকেট থেকে টাকা বের করে গাড়ি চালক কে তার পাওনা মিটিয়ে নিজের মালপত্র নামালো গাড়ি থেকে।গাড়ির ডিকিতে নিজের মালপত্রের সাথে সজীবের ল্যাগেজটা চোখে পড়লো তার। সজীবের ল্যাগেজটা ডিকি থেকে নামিয়ে সেটা আপাতত নিজের কাছে রাখলো।গাড়ি থেকে মালপত্র নামিয়ে গাড়ি চালককে বিদায় করে মাত্রই সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছিল আদিব ঠিক তখন চোখ গেল রাস্তার অপরপাশে। ল্যাম্পপোস্টের উজ্জ্বল আলোতে স্পষ্ট দেখতে পেল বাবার শুকনা শরীরটা।বাবাকে দেখে তার ঠোঁটের কোণে দেখা দিল মৃদু হাসির রেখা। আশরাফ অবশ্য তখনো ছেলেকে খেয়াল করেনি।সে আতিয়ার সাহেবের সাথে কথায় ব্যস্ত।আদিবদের প্রতিবেশী আতিয়ার সাহেব।আদিব চেনে তাকে।তার বাবার পুরোনো বন্ধু তিনি।আশরাফ কে ভালো করে পরখ করে আদিবের মনে হলো বাবাকে অন্যরকম দেখাচ্ছে।দূর থেকে বাবার মুখটা যতটুকু দেখা গেল তাতে বাবার মুখের বিষণ্ন ভাবটা তার চোখ এড়ালো না।আদিবের মন আবার বলে উঠলো কিছু একটা হয়েছে।বাবার বিষণ্ন মুখ আর বাইরের পরিবেশ দেখে মনের ভেতর খুঁতখুঁত করে উঠলো। একবার মনে হলো কারো কি কিছু হয়েছে! কিন্তু ফের মনে হলো কারো কিছু হলে তো সে জানতো।ছোট আপা কম বেশি সবার কথাই তো তাকে বলে। ফ্লাইটে ওঠার আগেও তো তার সাথে কথা হয়েছে কৈ তাকে তো তেমন কিছু বলল না।না কি কারো বাড়ি কোনো অনুষ্ঠান বাঁধলো।এটা হতে পারে।ছোট আপা তাকে বলেও ছিল নিতুর বিয়ের বিষয়ে কথা হচ্ছে।তাহলে কি নিতুর বিয়ে! কিন্তু সজীব ওভাবে ছুটলো কেন?আর বাবাকেই বা অমন মন মরা দেখাচ্ছে কেন? এতটুকু সময়ের মধ্যে অনেক কিছু ভেবে ফেলল আদিব।তার ভাবনা চিন্তার মাঝেই আশরাফ লক্ষ্য করলো তাকে।ছেলেকে দেখা মাত্র একপ্রকার ছুটে এলো আশরাফ।বাবাকে নিজের দিকে আসতে দেখে ভাবনায় ছেদ পড়লো আদিবের।বাবাকে সালাম জানালো সে। আশরাফ সালামের জবাব দিল।আদিবের আসতে কোনো অসুবিধা হয়েছে কি না সেটা জানতে চাইলো। তারপর আদিবের মুখে নির্নিমেষ দৃষ্টি রেখে বলল,
-অনেক বড় হয়ে গেছ আদিব!
বাবার কথায় মৃদু হাসলো আদিব।বলল,
-আর তুমি বুড়ো হয়ে গেছ।
কথাটা বলেই বাবাকে জড়িয়ে ধরলো আদিব। আশরাফও হাত বাড়ালো। ছেলেকে জড়িয়ে ধরে হাতের বাঁধন শক্ত করলো।এভাবে কতসময় অতিবাহিত হলো জানা নেই দুইজনের।জায়েদের বাড়ি চিৎকার চেঁচামেচির আওয়াজে ধ্যান ভাঙল তাদের।আদিব বাবাকে ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো।জায়েদের বাড়ির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-বাড়ির সামনে এত মানুষজন কিছু হয়েছে বাবা?সেজ চাচাদের বাড়ি
-আজ সন্ধ্যায় তোমার সেজ চাচি ইন্তেকাল করেছেন।
আদিবের কথা মাঝ পথে কেটে বলল আশরাফ।
বাবার কথায় হতবাক হলো আদিব।বিস্ফোরিত চোখে তাকালো বাবার দিকে।নিজের কানকে বিশ্বাস হলো না তার।সে আবার জিজ্ঞেস করলো,
-স্যরি !কি বললে?
-সালেহা মারা গেছে।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জায়েদের বাড়ির দিকে তাকিয়ে বলল আশরাফ।আদিবের মুখ দিয়ে যেন আর কোন কথা যোগাল না। হঠাৎ ভেতরটা কেমন জানি করে উঠলো তার।চোখের সামনে ভেসে উঠলো গোলগাল আকৃতির হাস্যোজ্জ্বল এক মুখ।যে মুখে সরলতা বই কিছুই নেই।নিজের অজান্তেই চোখের কোন ঘেঁষে গড়িয়ে পড়লো নোনাজল। অন্ধকার রাতে আলো আধারী তে যেটা সন্তর্পণে মুছে নিল সে।কিছুটা সময় নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে বলল,
-হঠাৎ কি হলো?মানে কীভাবে…?
নিজের কথা সম্পূর্ণ করতে পারলো না আদিব।গলার স্বর আটকে আসলো। আশরাফ বুঝলো ছেলের অসম্পূর্ণ প্রশ্নটা।বলল,
-বেশ কয়েকদিন ধরেই শরীর ভালো ছিল না সালেহার।গত কালকে একটু বেশি খারাপ হয়েছিল।জায়েদ আমাকে খবর দিলে আমি গিয়ে দেখলাম সালেহার অবস্থা তেমন ভালো না। তৎক্ষণাৎ ******* এর একটা ইনজেকশন পুশ করলাম।জায়েদ কে বললাম এতে কাজ না হলে হসপিটালে ভর্তি করতে হবে।কাল রাত এগারোটা পর্যন্ত ওদের ওখানেই ছিলাম আমি। সালেহার অবস্থার উন্নতি দেখে বাড়ি ফিরেছিলাম।আজকে বিকেল চেম্বারে যাওয়ার সময় জায়েদের সাথে দেখা হলো তখন সালেহার কথা জিজ্ঞেস করায় বলল,”সালেহা ভালো আছে।কোন সমস্যা নেই।নাতনির সাথে খেলছে।”এরপর মাগরিবের পরপর আকিব ফোন করে বলল,”বড় চাচা মা কেমন যেন করছে। নিশ্বাস নিতে পারছে না। হাঁস ফাঁস করছে।”আকিবের কথা শুনে আমি দ্রুত সালেহাকে নেবুলাইজার দিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমার ওখানে নিয়ে যেতে বললাম।
থামলো আশরাফ।একটু সময় নিল।একটা শ্বাস টেনে ফের বলল,
-আমার ওখানে যখন সালেহাকে নিয়ে পৌঁছাল ওরা তখন অলরেডি যা হওয়ার হয়ে গেছে………!দীর্ঘ সময় ধরে শ্বাসকষ্ট হওয়ার ফলে হৃদপিণ্ডে চাপ পড়ে কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়েছে।নেবুলাইজার ব্যবহারের আগেই হয়ত অ্যাটাক হয়েছে।সালেহা হয়ত শেষ পর্যন্ত সহ্য করার চেষ্টা করেছে যখন আর পারিনি তখন ছটফটিয়ে উঠেছে।আমি ওকে এতবার বলেছিলাম তোমার কিছু হলে জায়েদ কে বলবা। নিজের মধ্যে সব চেপে রাখবে না। কিন্তু ও আমার কথা কানে নেই নি।এর আগেও একবার শ্বাস নালীতে সর্দি এঁটে মরেই যাচ্ছিল।সেইবার আমি কাছে পিঠে ছিলাম তাই কিছু করতে পেরেছিলাম ।কিন্তু এই বার…!
আবারো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল আশরাফ। সালেহার মৃত্যু টা কেন জানি সে মেনে নিতে পারছে না ।মনে হচ্ছে একটুর জন্য মানুষটাকে বাঁচাতে পারলো না সে।তার হাটুর বয়েসি মেয়েটা চোখের সামনে দিয়ে চলে গেল।
এই তো সেদিন তার চোখের সামনে জন্মালো মেয়েটা ।তার মা জাহানারা গিয়েছিল দুই সেট কাপড় নিয়ে সালেহা কে দেখতে।আসতে দেরি হচ্ছিল বিধায় বাবা তাকে ফুপুর ওখানে পাঠালো মা কে আনতে।সে গিয়ে দেখে এইটুকু একটা কাপড়ের পুঁটলিতে একটা ছোট্ট বাচ্চা নিয়ে শীতের রোদে উঠানে বসে আছে মা আর ফুপু।তাকে দেখে ফুপু হই হই করে উঠলো।অনেকদিন পর ফুপু বাড়ি গিয়েছে সে,ফুপু তার খ্যাতির যত্নে কি করতে কি করে ভেবে পায় না। ছোট্ট দুধের সালেহাকে রেখে তাকে নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়লেন ফুপু। খাওয়া দাওয়া শেষ তারা সবাই বারান্দায় বসেছিল তখন
মা সালেহাকে জোর করে তার কোলে দিয়েছিল।আশরাফ মায়ের জোরাজুরিতে কোন রকমে সালেহাকে কোলে নিল।কোলের মধ্যে থাকা ছোট্ট শরীরটা আশরাফ অবাক চোখে দেখছিল। পুতুলের মতো মেয়েটাও বড় বড় চোখ মেলে তাকিয়ে ছিল তার দিকে এরপর কিছুক্ষণ যেতে না যেতেই গলা ফাটিয়ে কেঁদে উঠলো । আশরাফ তড়িঘড়ি মায়ের কোলে দিয়ে হাফ ছেঁড়ে বাঁচলো।তার সেই তড়িঘড়ি দেখে মা আর ফুপুর সে কি হাসি।
আজও চোখের সামনে সবটা ভাসে আশরাফের।মনে হয় এই তো সেদিনের কথা। সেদিনের সেই ছোট্ট সালেহা না কি মা’রা গেছে!তার চোখের সামনে বেড়ে ওঠা মেয়েটা না কি আজ তাদের সাথে নেই!এ কঠিন সত্যিটা ভাবতেও যে তার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। অন্যমনস্ক হয়ে কথা গুলো ভাবছিল আশরাফ।ছেলের ডাকে ভাবনায় ছেদ পড়লো।চোখের চশমাটা খুলে ফতুয়ার প্রান্ত ভাগের কাপড়ে মুছে আবার চোখে দিয়ে বলল,
-আমি জায়েদের ওখানে যাচ্ছি দেখি কি অবস্থা ওদিকের।তুমি যাবে?
-জ্বি।
তড়িৎ জবাব দিল আদিব। আশরাফ বাড়ির দারোয়ান কে ডেকে আদিবের জিনিসপত্রগুলো ভেতরে নিয়ে যেতে বলল। তারপর বাপ ছেলে এগিয়ে গেল জায়েদের বাড়ির দিকে। সালেহার মৃত্যুর সংবাদ শুনে এরমধ্যে অনেক আত্মীয় স্বজন পাড়া প্রতিবেশী জমা হয়েছে জায়েদের বাড়ির উঠানে।আকিবের কাজের সূত্রে পরিচিত,
তার সাথে কর্মরত সিনিয়র জুনিয়র অনেকেই ছুটে এসেছে। আশরাফের বাড়ি থেকে জায়েদের বাড়ি যাওয়ার এই স্বল্প দূরত্বের রাস্তায় অনেক পরিচিত মানুষের সাথে দেখা হলো আদিবের ।তবে কারো সাথে সেভাবে কথা হয়ে উঠলো না। চোখাচোখি আর সালাম বিনিময় পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকলো।
জায়েদের বাড়ির সামনে মাত্রই এসে দাঁড়িয়েছিল আদিব, ঠিক তখন পিছন থেকে ভেসে আসলো গাড়ির হর্নের শব্দ।পিছন ফিরে দেখলো পরপর তিনটা গাড়ি রাস্তার ধার ঘেঁষে সারিবদ্ধভাবে থামলো।ভ্রূ তে কিঞ্চিৎ ভাজ ফেলে গাড়ির বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়েই ছিল সে হঠাৎ গাড়ির দরজা খুলে গাড়ি থেকে নেমে আসা মানুষটাকে দেখে বুকের ভেতর ধক করে উঠলো।অবাক চোখে তাকালো সে অশ্রু শিক্ত গোলগাল সুন্দর মুখের মেয়েটার দিকে। পলকহীন দৃষ্টিতে চেয়ে দেখলো দুইজনের মধ্যকার দূরত্ব কমতে।
আদিবের নির্নিমেষ দৃষ্টি কিন্তু অপরপাশের ব্যক্তিটি তার দিকে তাকানোর প্রয়োজন বোধ করলো না।সে গাড়ি থেকে নেমেই উন্মাদিনীর নেয় ছুট তে লাগলো।কয়েক পা আসতেই রাস্তায় থাকা এবড়োখেবড়ো আদলা ইটে আঘাত লাগলো পায়ে। ভারসাম্য হারলো সে। আদিব সামনেই ছিল তার ।মুখ থুবড়ে পড়লো সে আদিবের বুকে।আদিব সযত্নে আগলে নিল সাথে সাথে।সাবধানি কণ্ঠে আওড়ালো,
-কেয়ারফুল!
আদিবের বলা সতর্ক বাণী টা মেয়েটার কানে গেল বলে মনে হলো না।সে পায়ের নিচে শক্ত মাটি ফিরে পেতেই আবার ছুটলো।শোকে তাপে বিভোর মেয়েটা এটাও লক্ষ্য করলো না যে আদিবের ঘড়িতে বেঁধে তার এক গাছি কাঁচা চুল পটপট শব্দ তুলে ছিঁড়ে গেল।যেভাবে ঝড়ের গতিতে এসেছিল ঠিক সেভাবেই প্রস্থান করলো।
আদিব তার প্রস্থানরত পথের দিকে তাকিয়েই ছিল তখন আশরাফের বলা কথা কানে গেল।
-আকিব তো কোন মতে নিজেকে সামলে নিয়েছে কিন্তু মেয়েটা যে কি করবে!
-আদিব !তুই এখানে! তোমার আক্কেল তো ভালো!ছেলেটা এতোটা পথ জার্নি করে বাড়ি ফিরল। তুমি তাকে রেস্ট করতে না দিয়ে এখানে নিয়ে এলে!
জায়েদের বাড়ির ভেতর থেকে ব্যস্ত পায়ে এগিয়ে এসে বলল তানিয়া।কণ্ঠে তার উদ্বিগ্নতা। সেটা ছেলে ক্লান্ত শরীরে এখানে আসার জন্য না অন্য কারণে সেটা বোঝা গেল না।তবে আশরাফ কিছু আন্দাজ করলো।সে গভীর চোখে তাকালো সহধর্মিণীর দিকে। আশরাফের তীক্ষ্ণ দৃষ্টির সামনে কিঞ্চিৎ অপ্রস্তুত হলো তানিয়া।বাবা মায়ের এই শীতল সমীকরণ চোখ এড়ালো না আদিবের।সে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে বলল,
-আমি ঠিক আছি মা।
-সত্যি তো?
-হুম।
-তাহলে চোখ মুখ অমন শুকনা শুকনা লাগছে কেন?খারাপ লাগলে না হয় বাড়ি যা ।রেস্ট নে।সালেহাকে নিয়ে যাওয়ার আগে না হয় দেখে যাস।
-আমি সত্যি ঠিক আছি মা।তুমি অযথা চিন্তা করো না।
ছেলের কথায় আশ্বস্ত হলো তানিয়া।ছেলের কোন অসুবিধা হলে যেন তাকে জানায় এ কথা কয়েকবার মনে করিয়ে দিয়ে ফিরে গেল ভেতরে।তানিয়া চলে যেতেই শাহেদ উপস্থিত হলো সেখানে।আদিব কে দেখে কিছুটা অবাক হলো সে।চোখ মুখ দেখেই বোঝা গেল এখানে এই মুহূর্তে আদিব কে আশা করেনি সে।আদিব ছোট চাচাকে সালাম দিল।শাহেদ তার সালামের উত্তর দিয়ে বলল,
-এমন এক পরিস্থিতিতে এলি যে ভালো-মন্দ টুকুও মন খুলে জিজ্ঞেস করতে পারছি না।তা কখন এলি?
-এই তো কিছুক্ষণ আগে।
-সেজ ভাইয়ের সাথে দেখা করেছিস?
-না। মাত্রই এলাম এখনো দেখা করিনি।
-ও।
আদিবের সাথে কথা শেষ করে শাহেদ আশরাফের উদ্দেশ্যে বলল,
-মিয়া ভাই ভাবিকে নিয়ে এখনই বের হবো?জাহানের জন্য এতক্ষণ অপেক্ষা করা হচ্ছিল।ও যখন চলে এসেছে তখন বের হওয়া যাক কি বলো?রাতও তো বাড়ছে আর দেরি করা কি ঠিক হবে!
-মেয়েটা মাত্রই এলো।একটু মা’র পাশে বসুক। অনন্ত কিছু সময় দাও তাকে।রাত এখনো অনেক বাকি।এত তাড়াহুড়োর কিছু নেই। মানুষটাকে সেই তো একবারে রেখে আসতে হবে, একটু দেরি করেই না হয় যাওয়া যাক।
আশরাফের কথায় সম্মতি জানিয়ে শব্দ করে একটা শ্বাস ফেলল শাহেদ। তারপর আদিবকে সাথে আসতে বলে সামনে পা বাড়ালো সে।ভেতরে যেতে যেতে আদিবের সাথে কিছু টুকটাক কথা হলো তার।বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই ডান পাশে কামিনী গাছ তলায় দেখা মিলল জায়েদের।আদিব এগিয়ে গেল সেজ চাচার দিকে।জায়েদ ক্লিষ্ট চোখে তার দিকে চেয়ে কোন রকমে জিজ্ঞেস করলো,
-কখন এলে?
– কিছুক্ষণ আগে।
এরপর আর কোন কথা যোগাল না কারো মুখে।আদিব সেজ চাচার পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। জায়েদের কাছে অনেকে আসলো,অনেকে বসলো।কেউ দ্বীর্ঘশ্বাস মিশ্রিত সান্ত্বনা দিল তো কেউ এতো তাড়াতাড়ি সালেহার মৃত্যুতে দুঃখ প্রকাশ করলো।কেউ বা আবার জাহানারার জন্য জায়েদ কে শক্ত হতে বলল।জায়েদ তাদের কথার উত্তরে, প্রতি উত্তরে শুধু হাঁ,হু করে গেল। কিছুক্ষণ পর শাহেদ এসে জানালো সালেহাকে নিয়ে বের হবে তারা।জানাজার নামাজ ইশার নামাজের পরেই সম্পন্ন হয়েছে সালেহার। এতক্ষণ শুধু জাহানারার জন্য অপেক্ষায় ছিল। জাহানারা যেন মাকে শেষ দেখাটা দেখতে পারে সেই জন্য এতো দেরি।এখন উঠতে হবে। শাহেদের কথা শুনে টালমাটাল পায়ে উঠে দাঁড়ালো জায়েদ।পা দুটো কেমন জানি ভারি ঠেকলো জায়েদের কাছে তবুও এগিয়ে গেল সামনে ।খাটিয়ার কাছাকাছি যেতেই দেখলো জাহানারা আকিব কে ধরে আকুলি বিকুলি করে কাঁদছে।বুকের ভেতরট হুঁ হুঁ করে উঠলো জায়েদের।সে আর আকিব তবুও নিজেকে সামলে নেবে কিন্তু মেয়েটা কীভাবে নিজেকে সামলাবে এটা ভেবেই দৃষ্টি ঝাপসা হলো তার। জাহানারার আর্তনাদে ভারি হলো পরিবেশ।আকিব অনেক কষ্টে সামলালো বোন কে। কাঁদতে কাঁদতে এক পর্যায়ে নিস্তেজ হলো জাহানারার শরীর। জ্ঞান হারালো সে।বাড়ির ভিতরে নিয়ে গিয়ে মাথায় পানি দেওয়া হলো তার। জাহানারা কে সে অবস্থায় রেখেই এগিয়ে গেল শবযাত্রা।
_____________
সালেহার শেষ কাজ সম্পন্ন করে বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত বারোটা বাজলো আদিবের।আদিব কবরস্থান থেকে সোজা বাড়ি ফিরলো।সেজ চাচার ওখানে আর গেল না।মা কে যতোই বলুক সে ঠিক আছে কিন্তু সত্যি কথা বলতে ভীষণ ক্লান্ত সে।শরীর আর কুলাচ্ছে না। বিশ্রাম চাইছে।বাড়ি ফিরে কলিং বেল চাপতেই তাদের বাড়ির পুরোনো গৃহকর্মী রাবেয়া দরজা খুলে দিল। আদিব কে দেখে একগাল হাসলো সে।আদিব ম্লান হেঁসে সালাম দিল।
-কেমন আছেন খালা?
-এই তো আলহামদুলিল্লাহ। তুমি ফ্রেশ হয়ে নেও আব্বা, আমি খাবর দিচ্ছি।
-এখন আর কিছু খেতে ইচ্ছা করছে না খালা।আমি একটু ঘুমাবো।ঘুম থেকে উঠে খাবো। আপনি টেবিলে খাবার রেখে দিয়েন আমি গরম করে খেয়ে নিবো।
-সে কি আব্বা!একেবারে খালি পেটে ঘুমাবা!শরীর খারাপ করবে তো।এক গ্লাস গরম দুধ দিই সেটা অনন্ত খেয়ে শুইও।
রাবেয়ার কথায় ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালো আদিব।তারপর ক্লান্ত শরীর টা নিয়ে এগিয়ে গেল নিজের ঘরের দিকে।ঘরে এসে দেখলো তার লাগেজগুলো আলমারির পাশে রাখা। সেখান থেকে একটা লাগেজ নিয়ে জামাকাপড় বের করে ওয়াশরুমে ঢুকলো সে।ফ্রেশ হয়ে এসে দেখলো রাবেয়া খালা বিছানার পাশের সাইড টেবিলে দুধের গ্লাস ঢেকে রেখে গেছেন।আদিব গ্লাসটা নিয়ে দুধটুকু খেয়ে বিছানায় পিঠ ঠেকালো। ক্লান্ত শরীরে চোখ বুজতেই ঘুম নেমে এলো চোখে।
আদিবের ঘুম ভাঙলো পরের দিন দুপুর বারোটায়।ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে নিচে নামতেই দেখলো তৃপ্তি আর তার মা বসে কথা বলছে।কথা শুনে বুঝলো সেজ চাচিকে নিয়ে কথা হচ্ছে।আদিব কে দেখেই তৃপ্তি বলে উঠলো,
-ঘুম ভেঙ্গেছে তাহলে।আমি তো ভেবেছিলাম তোর সাথে হয়ত দেখা না করেই চলে যেতে হবে।
-কখন এলে?
সোফায় বসতে বসতে জিজ্ঞেস করলো আদিব।তানিয়া ছেলের খাবার দাবারের ব্যবস্থা করতে উঠে গেল সেখান থেকে।
– কাল রাতেই এসেছি।
আদিবের প্রশ্নের উত্তরে বলল তৃপ্তি।
-কাল রাতে! কিন্তু আমি তো তোমাকে দেখালাম না।
-সেজ চাচার ওখানে ছিলাম।
-আমিও তো ছিলাম সেখানে কৈ তোমাকে তো চোখে পড়লো না।
-আমাকে সত্যি দেখিসনি?
চোখ সরু করলো তৃপ্তি। সন্দেহীন কণ্ঠ।আদিব একটু ভাবুক হলো।মনে করার চেষ্টা করলো কাল তৃপ্তি কে ও বাড়িতে দেখেছে কি না। কিন্তু তেমন কিছু মনে পড়লো না। তৃপ্তি আদিবের ভাবুক মুখের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট বেঁকিয়ে হাসলো।বলল,
-থাক কষ্ট করে মনে করতে হবে না।আমি হেল্প করছি। জাহানারার ঠিক পাশেই ছিলাম আমি।তুই খেয়াল করিস নি।অবশ্য আমাকে খেয়াল না করারই কথা!দৃষ্টি অন্য কাউতে আটকালে আর কাউকে কি চোখে পড়ে!
তৃপ্তির কথায় শব্দ করে একটা শ্বাস ফেলল আদিব।সোফায় হেলান দিয়ে ঘাড় এলিয়ে দিয়ে পায়ের উপর পা তুলে বলল,
– পিঞ্চ করার পদ্ধতিটা ঠিক ছিল কিন্তু বিষয়টা ভুল ছিল।
-বিষয়টা একদম সঠিক ছিল ।মা-ও খেয়াল করছে তোমার ঐ ড্যাবড্যাবে দৃষ্টি।আমাকে বলাও হয়ে গেছে তার।
-মোটেও আমি ড্যাবড্যাব করে তাকায় নি।
তড়াক করে সোজা হয়ে বসলো আদিব।তেতে উঠে বলল উক্ত কথাটা।ভাইয়ের কথা শুনে ফিচলে হাসলো তৃপ্তি।আয়েশ করে সোফায় পিঠ ঠেকিয়ে বলল,
-দেশ বিদেশ ঘুরে এলি কিন্তু পুরোনো অভ্যাস বদলাতে পারলি না!তোর এই গলার স্বর উঁচু করে মনের ভাব লুকানোর ট্রিক্স অন্য কাউকে দেখাস, আমাকে না।
তৃপ্তির কথায় বিরক্ত হলো আদিব।মুখ দিয়ে বিরক্ত সূচক শব্দ বের করে বলল,
-ফালতু কথা বলো না।শুনতে ভালো লাগছে না।তুমি যেটা বলতে চাইছো আমি বেশ বুঝছি।তোমার অবগতির জন্য জানিয়ে দিই তুমি ভুল ভাবছো।অনেকদিন পর দেখলাম মেয়েটাকে তাই একটু তাকিয়েছিলাম।ব্যাস, দ্যাট সিট।এটা নিয়ে এতো টন্ট মারার দরকার নেই!
-টন্ট মারছি না, সত্যি কথা বলছি।তুই হ্যাঁ করে তাকিয়ে ছিলি মেয়েটার দিকে।
-আহ…! আপা লুক আট ইয়োর ল্যাংগুয়েজে।কি বিশ্রী শোনাচ্ছে।ডোন্ট ফরগেট তুমি যার বিষয়ে কথা বলছো সে বোন হয় আমার।
-চাচাতো বোন।
আদিবের কথা শেষ না হতেই বলল তৃপ্তি।
-ইউ আর জাস্ট ইম্পসিবল।তোমার সাতে তর্ক করায় বৃথা!
-তোদের আবার কি নিয়ে তর্ক শুরু হলো?
তৃপ্তি আর আদিবের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে জানতে চাইলো তানিয়া। তৃপ্তি আদিব কে কিছু বলতেই যাচ্ছিল তানিয়াকে দেখে থেমে গেল।কথা ঘোরালো।তানিয়া স্পষ্ট বুঝতে পারলো মেয়ে কিছু লুকাচ্ছে তার কাছ থেকে কিন্তু কিছু বলল না।আদিব কে তাড়া দিল ডাইনিংয়ে যেতে।আদিব সোফা ছেড়ে উঠতে
উঠতে সাবধানি দৃষ্টিতে বোনের দিকে একবার তাকালো।যার অর্থ উলটো পালটা ভাবা বাদ দাও। তৃপ্তি বুঝতে পারলো ভাইয়ের দৃষ্টির অর্থ।সে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে হাসলো।
চলবে, ইনশাআল্লাহ।
#সৌরকলঙ্ক
#উম্মে_প্রভা
#পর্ব_৪
তৃপ্তির মুখের হাসিটা দীর্ঘ স্থায়ী হলো না যখন মনে পড়লো জাহানারার বর্তমান অবস্থান। তৃপ্তির সাথে সাথে মনে হলো তার মা হয়ত জীবনের সব থেকে বড় ভুল করেছিল জাহানারা কে ছেলের অযোগ্য ঘোষিত করে।কথাটা মনে হতেই আপনা আপনি একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো ভেতর থেকে। দূরে ডাইনিংয়ে দাঁড়ানো তানিয়ার দিকে তাকালো সে।তানিয়া সযত্নে ছেলের খাবার পরিবেশন করছে।চোখে মুখে তার উচ্ছ্বাস। অনেকদিন পর ছেলেকে নিজ হাতে খেতে দিতে পেরে সন্তুষ্ট সে। তৃপ্তি বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো।এগিয়ে গল ডাইনিংয়ের দিকে।তানিয়া তখন আদিবের শরীর স্বাস্থ্যের অবনতি নিয়ে আহাজারি করছে।আদিব মায়ের আহাজারি কান নিচ্ছে বলে মনে হলো না।তাকে নিজের খাবার প্লেটে মনোযোগী দেখালো। তৃপ্তি ডাইনিংয়ের চেয়ারে ঠেস দিয়ে দাঁড়ালো।মায়ের কথা শুনে টিপ্পনী কেটে বলল,
-মা তুমি তোমার ছেলের শরীর স্বাস্থ্য নিয়ে অযথা কান্না কাটি করছো!ছেলেকে একবার ভালো করে দেখো!লিকলিকে একটা বাছুর পাঠিয়েছিলে তুমি লন্ডনে যেটা মোটা তাজা ষাঁড় হয়ে ফিরে এসেছে! তারপরও তুমি যদি ছেলের স্বাস্থ্য শরীর কমে গেছে,শুকিয়ে গেছে এই ধরনের কথা বলো তাহলে মানায়!এমন কথা শুনলে লোকে হাসবে। বলবে তুমি ছেলে নিয়ে ন্যাকামি করছো!
তৃপ্তির কথা শুনে খাবার প্লেটে হাত থেমে গেল আদিবের। তানিয়া চোখ গরম করে মেয়ের দিকে তাকালো। আদিব ঘাড় উঁচিয়ে তৃপ্তির দিকে তাকালো ভ্রূ তে গিঁট দিয়ে বলল,
– আমাকে নিয়ে বডি শেমিং না করেও মাকে বোঝানো যেত কথাটা!
-বডি শেমিং করলাম কোথায়!আমি তো শুধু মা কে বোঝাতে চাইলাম তোর শরীর স্বাস্থ্য নিয়ে মায়ের অত আক্ষেপ করার দরকার নেই।তুই আগের থেকে এখন আরো বেশি হিষ্ট পুষ্ট হয়েছিস।
তড়িঘড়ি বলল তৃপ্তি।আদিব চোখ সরু করলো। তৃপ্তি দাঁত বের করে হেসে বলল,
-ওভাবে তাকাচ্ছিস কেন।আমার বলা কথায় গুরুত্ব না দিয়ে,তার পিছনের অর্থ কে গুরুত্ব দে।
থামলো তৃপ্তি।আদিব আর কিছু বলল না। খাবার প্লেটে মন দিল। তৃপ্তি তা দেখে হাফ ছেড়ে বাঁচলো।আদিবের যে হুট হাট রেগে যাওয়ার ধ্যাত! তার কথায় যে আদিব এতক্ষণে রেগে বো’মা হয়নি তার জন্য স্বস্তি পেল।আদিব খাবার প্লেটে হাত চালাতে চালাতে তানিয়ার উদ্দেশ্যে বলল,
-মা সেজ চাচাদের কি অবস্থা?জানো কিছু?
-আছে কোনোরকম। মৃত্যু শোক কাটিয়ে ওঠা কি অত সহজ।একটু সময় তো লাগবে স্বাভাবিক হতে।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের কথার দাড়ি টানলো তানিয়া। সালেহার প্রতি তার মনে একটা সূক্ষ্ম রাগ থাকলেও সালেহার এত তাড়াতাড়ি চলে যাওয়াটা সে মেনে নিতে পারছে না।মুখে প্রকাশ না করলেও খারাপ লাগছে তার।
-আকিব আর সেজ চাচা শক্ত মনের ওরা ঠিক নিজেদের সামলে নেবে। কিন্তু জাহান টা যে কি করবে!আজ সকালেও জ্ঞান ফেরার পর চিৎকার চেঁচামেচি করছিল।কোনোভাবে সামলানো যাচ্ছিল না।শেষ মেষ ভুলিয়ে ভালিয়ে সজীব ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়েছে।
-এখন এত দাপাদাপি করে কী লাভ !মা বেঁচে থাকতে তো মা’র খোঁজই নেয়নি।ধিঙ্গি পানা করে বেড়িয়েছে।এখন একেবারে কেঁদে কেটে পুকুর করছে!
তৃপ্তির কথা মুখ থেকে ফুরাতে না ফুরাতেই কটাক্ষের সুরে বলে উঠলো তানিয়া।মায়ের কথায় তাজ্জব বনে গেল তৃপ্তি।সে মানছে তার মা জাহানারা কে পছন্দ করে না কিন্তু তাই বলে এমন সময়ে মেয়েটার সম্পর্কে এমন কথা সে আশা করেনি মায়ের কাছ থেকে। তৃপ্তির সহ্য হলো না মায়ের কথাটা।সে তড়াক করে বলল,
-যা জানো না সে বিষয়ে কথা বলো না মা। জাহানারা যথেষ্ট করেছে চাচির জন্য।মানছি চাচির কাছে পিঠে থাকতে পারেনি, কিন্তু সেখানে তার কোন দোষ নেই।দোষ তোমাদের।তোমাদের জন্য এমন পরিস্থিতি তৈরি হলো যে……!
-তোমাদের বলতে কি বোঝাতে চাইছো আপু?
তৃপ্তির অসমাপ্ত কথার মাঝে শীতল কণ্ঠে প্রশ্ন ছুড়লো আদিব। তৃপ্তি কোন রাখ ঢাক না রেখেই তার প্রশ্নে জবাবে বলল,
-আদিব শোন যেচে পড়ে কথা গাঁয়ে মাখিস না।আমি মা আর সেজ চাচার কথা বলছি।তবে তুই যদি নিজের ঘাড়েও দোষ নিতে চাস নিতে পারিস।তুই মানিস আর না মানিস কিছু দোষ তোরও ছিল।
তৃপ্তির কথা শুনে চোয়াল শক্ত হলো আদিবের। খাওয়া এখনো শেষ হয়নি আদিবের।প্লেটে অবশিষ্ট কিছু খাবার তখনো বিদ্যমান যেটা রেখেই উঠে দাঁড়ালো সে।প্লেটে পানি ঢেলে হনহন করে বেরিয়ে গেল ডাইনিং ছেড়ে।তানিয়া বারবার পিছু ডাকলো কিন্তু আদিব থামলো না।আদিব চলে যেতেই তৃপ্তির উপর চটে উঠলো তানিয়া,
-ছেলেটার খাওয়ার সময় এসব কথা না তুললে হতো না!
-যা সত্যি তাই বলেছি এতে তোমার ছেলের রাগ হলে আমি কি করবো। কথায় আছে,” যার মনে দোষ ,তার কথায় রোষ!”তোমার ছেলের অবস্থা হয়েছে তেমন।মা শোনো তোমাকে আমি এর আগেও বলেছি আবারও বলছি কথা বলার আগে ভেবে চিন্তে বলবে।
রসকষহীন কথা তৃপ্তির।তানিয়া অগ্নি দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকিয়ে শীতল কণ্ঠে বলল,
-তোমার জ্ঞান দেওয়া হয়ে গেলে যাও এখান থেকে।
তানিয়ার কণ্ঠ শীতল হলেও তার চোখে মুখে রাগ স্পষ্ট। তৃপ্তি এই মুহূর্তে আর কথা বাড়াতে চাইলো না।নিঃশব্দে স্থান ত্যাগ করলো।
_______________
ঘরে এসে রাগে ফুঁসতে লাগলো আদিব।রাগে ভেতরটা গনগন করে উঠলো। তৃপ্তির বলা কথাগুলো তীক্ষ্ণ ফলার মতো খোঁচাতে লাগলো তাকে। হাঁস ফাঁস করে উঠলো ভেতরটা।
নিজের ভেতরকার অস্থিরতা কমাতে ঘরের জানালা গুলো খুলে দিল সে।দক্ষিণের জানালাটা খুলতেই চোখে পড়লো দুই তলা বিশিষ্ট বিশাল বাংলো বাড়ি।জানালা দিয়ে যার উঠানসহ বাগান টা স্পষ্ট দৃশ্য মান। দৃষ্টি স্থির হলো আদিবের।
তৃপ্তির কাছ থেকে শুনেছিল আদিব, জাহানারার নামে লিখে দেওয়া দাদির জমিতে বিরাট বাড়ি তুলেছে জাহানারা। তবে এতোটা বিরাট আশা করেনি।নিজের স্বল্প অভিজ্ঞতা থেকে বুঝলো জাহানারা বেশ মোটা অঙ্ক ঢেলেছে বাড়ির পিছনে।জানালা দিয়ে যতদূর চোখ যায় ততদূর আদিব নিজের দৃষ্টি ঘোরালে। মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগলো বাড়ির শৈল্পিক কারুকার্য।বাড়ি নিখুঁত প্রকৌশল দেখতে দেখতে আদিবের চোখ আটকালো বাড়ির উত্তর পাশে প্রাচীর ঘেঁষে বেড়ে ওঠা লিচু গাছটার দিকে।কিয়ৎক্ষণের জন্য থমকালো আদিব।এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো গাছটার দিকে। মৃদু বাতাসে গাছের ছোট ছোট পাতাগুলোর নড়ন চড়ন যেন আদিবের মানসপটে পুরোনো স্মৃতির আলোড়ন তুলল। স্মৃতির পাতা উল্টে হুড়মুড় করে চোখের সামনে লুটিয়ে পড়লো স্পষ্ট স্মৃতি গুলো।
তখন ক্লাস এইটে পড়ে আদিব।সেজ চাচার কাছে অঙ্ক আর বিজ্ঞানের প্রাইভেট টিউশনের জন্য চাচাদের বাড়ি রোজ আসা যাওয়া তার।
রোজকার নেয় সেদিনও সেজ চাচার কাছে পড়া শেষ করে বের হচ্ছিল আদিব ঠিক তখন সেজ চাচির টিনের রান্নাঘরের টিন ঘেঁষে ছোট্ট একটা লিচুর চারা চোখে পড়লো।যেটা ঝিল কাকরের মধ্যে অযত্নে বেড়ে উঠছে।চাচির কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে গাছটা সাবধানে সেখান থেকে তুলছিল আদিব সে সময় কোথা থেকে তীরের বেগে ছুটে এলো জাহানারা।কোমরে হাত দিয়ে চোখ মুখ গুটিয়ে বলল,
-আদিব ভাই ওটা আমার গাছ।আপনি কেন তুলছেন?
আদিব জাহানারা কথায় গুরুত্ব না দিয়ে সযত্নে গাছটা ঝিলকাকড়ওয়ালা মাটি থেকে আলাদা করতে করতে ভাবলেশহীনভাবে বলল,
-এটা তোমার গাছ! কিন্তু কোথাও তো তোমার নাম লেখা নেই!
-আমি লিচু খেয়ে লিচুর আঁটি ফেলেছিলাম ওখানে সেটা থেকেই গাছ হয়েছে। বুঝেছেন!
-না বুঝলাম না।এ বাড়িতে লিচু তুমি একা খাও! যে শুধু তোমার ফেলা লিচুর বীচে এই গাছ হয়েছে।হতেও তো পারে এটা অন্য কারো ফেলা বীচে জন্মেছে!
-না এটা আমার ফেলা লিচুর বীচে হয়েছে।আমি জানি।আমি এই এই খানে দাঁড়িয়ে মুখ দিয়ে ফুঁ করে ছুঁড়ে ফেলেছিলাম ওখানে।মনে আছে আমার। আপনি রাখেন ওটা।রাখেন বলছি।
চেঁচিয়ে উঠলো জাহানারা।সেজ চাচি তার আওয়াজ শুনে রান্নাঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে এলো।জানতে চাইলো কি হয়েছে।মা কে দেখে আহ্লাদে গদগদ হয়ে আদিবকে বলা কথাটা মা কে শোনাল জাহানারা। জাহানারার কথা শুনে সালেহা চোখ পাকিয়ে বলল,
-তোর গাছ হ্যাঁ!তা এতো দিন কোথায় ছিলি?এতো দিন তো ফিরেও তাকাস নি গাছটার দিকে ।এখন যেই আদিব নিতে গেল অমনি দরদ উতলে উঠলো!পাঁজি মেয়ে।এক চড়ে তোমার হিংসা ছুটিয়ে দেব আমি!
মায়ের শাসানির সামনে আর কিছু বলতে সাহস পেল না জাহানারা।তবে রাগে ক্ষোভে গজগজ করতে আদিবের দিকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো।আদিব তার দৃষ্টি উপেক্ষা করে গাছাটা হাতে নিয়ে বাড়ির পথে পা বাড়ালো।
সেদিন সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ায় গাছটা তাদের বাগানে এক পাশে রেখে পরের দিন কোথায় লাগাবে সেটা ঠিক করে ঘরে ঢুকলো আদিব। পরেরদিন সকালে যখন গাছটা লাগতে যাবে তখন দাদি এসে বলল,তাদের বাগানে পাশের বাড়ির আতিয়ার সাহেবের বাগানের মেহগনি গাছের ছায়া পড়ে সুতরাং সেখানে গাছটা ভালো ভাবে বেড়ে উঠতে পারবে না।আদিব ভেবে দেখলো দাদির কথায় যুক্তি আছে। কিন্তু গাছটা কোথায় লাগাবে সেটা ভেবে আদিব ভাবুক হলো। জাহানারা বেগম আদিব কে নিজ মনে কিছু ভাবতে দেখে জানতে চাইলো আদিব কি ভাবছে।দাদির কথায় ভাবনায় ছেদ পড়লো আদিবের।সে দাদিকে তার ভাবনার কথা বলতেই দাদি বলল আদিবদের বাড়ির পিছনে যে খালি জায়গা আছে সেখানে গাছটি লাগাতে।খোলা জায়গা, আলো বাতাসের কমতি নেই। গাছটির জন্য একদম উপযুক্ত স্থান।দাদির কথায় সম্মতি জানালো আদিব।দাদির সাথে সেখানে গিয়ে দাদির দেখানো জায়গায় মাটির নিচে আবদ্ধ করলো ছোট্ট চারা গাছটার নরম শেকড়।গাছ লাগিয়ে পানি দিয়ে উঠে দাঁড়াতেই জাহানারা কোথা থেকে উদয় হয়ে মুখ টিপে হাসতে লাগলো। বলল,
-আদিব ভাই গাছটা কিন্তু আমারও হলো না, আপনারও হলো না।
জাহানারার কথার তাৎপর্য বুঝতে কিছুটা সময় লাগলো আদিবের।ওর কথার অর্থ উদ্ধার করতে পের সদ্য লাগানো গাছটার দিকে তাকালো আদিব।গাছটা এখন আর এই জায়গা থেকে তোলা ঠিক হবে না এটা বুঝতে পেরে রাগে ফুঁসে উঠলো।দাদির উদ্দেশ্যে বলল,
-দাদি তুমি এই মেয়ের জন্য আমাকে মিথ্যা বললে!
– না দাদু।তুমি কি পাগল হলে?আমি তোমাকে মিথ্যা বলবো!তুমিই বলো তোমাদের বাগানে আতিয়ারের মেহগনি গাছের ছায়া পড়ে না? তুমিই বলো ওখানে গাছটা ভালোভাবে বেড়ে উঠতে পারতো?আমি গাছটা যেন ভালোভাবে বেড়ে ওঠে সেইজন্য এখানে লাগাতে বললাম।
আদিবকে রাগে ফুঁসতে দেখে তড়িঘড়ি বলল জাহানারা বেগম। তারপর একটু থেমে জাহানারার দিকে চোখ পাকিয়ে আদিব কে উদ্দেশ্য করে বলল,
-তুমি জানের কথায় কান দিচ্ছো দাদু!তুমি বুঝতে পারছো না ,ও তোমাকে রাগাতে চাচ্ছে।
দাদির কথায় দমলো আদিব। শক্ত চোখে তাকালো জাহানারার দিকে। জাহানারা তার সেই দৃষ্টি পাত্তা দিল না।যেভাবে নাচাতে নাচতে এসেছিল সেভাবেই নাচতে নাচতে চলে গেল। এরপর দাদি আদিব কে কত কিছু বোঝাল কিন্তু আদিবের মনের খচখচানি বন্ধ হলো না।কানে বাজতে থাকলো,”গাছটা কিন্তু আমারও হলো না,আপনারও হলো না।”এই কথাটা অনেকদিন পর্যন্ত ঘুরলো আদিবের মাথায়।রাগ হলো জাহানারার উপর। অভিমান জমলো দাদির দিকে।ভেতর থেকে কেউ যেন বলল,দাদি তার আদরের নাতনির আবদার রাখতে গাছটা ওখানে লাগানোর যুক্তি দিয়েছিল। তাছাড়া আর কিছুই না!এই কথাটা মনে হতেই আদিব খুব করে চাইলো ঐ হিংসুটে মেয়েটা যেন চাচির কাছে খুব শীঘ্রই চরম ঝাড় খায়।
এই কাজটা অবশ্য সে নিজেই করতে পারতো কিন্তু নালিশ ,কুটনামি এসব করা তার স্বভাব বিরোধী।তাই তো কিছু বলল না চাচিকে। চুপচাপ অপেক্ষা করতে লাগলো সেই দিনের। জাহানারার যে পূর্ব অতীত সেই অতীত অনুযায়ী সপ্তাহে দুই তিন বার সে মায়ের হাতে ঠেঙানি খায়।এটা নতুন না।তবে সেবার সময় একটু বেশি লাগলো কিন্তু অবশেষে আদিবের মনের ইচ্ছা পূরণ হলো।স্কুলে কোন এক ছেলের সাথে মারামারি করতে গিয়ে তার চোখে কলম দিয়ে খোঁচা মেরেছে জাহানারা।সেই নালিশ জানাতে সেজ চাচা কে ডেকে পাঠালো জাহানারার স্কুলের হেডস্যার।সেজ চাচা কোন রকমে মেয়েকে হেড স্যারের হাত থেকে বাঁচিয়ে ফেরালেও, সালেহার হাত থেকে বাঁচতে পারলো না। জাহানারা বাড়ির গেটের সামনে আসতে না আসতেই সালেহা রাস্তার মধ্যে তার কান ধরে পিঠে দুমদাম কিল বসিয়ে দিল।আদিব তখন স্কুল থেকে ফিরছিল রাস্তার মাঝে এই দৃশ্য দেখে সাইকেলের প্যাডেলে পায়ের গতি ধীর করলো।জাহানারার নাস্তানাবুদ অবস্থা দেখে ঠোঁট চেপে হাসলো।ঠিক তখনই লক্ষ্য করলো জাহানারা ঠোঁট উল্টে তার দিকে তাকিয়ে আছে। জাহানারার খাবো খাবো দৃষ্টি দেখে নিজেকে আর সামলাতে পারলো না আদিব ,ফিক করে হেসে ফেলল এবার।আদিবের সেই হাঁসি দেখে রাগে ক্ষোভে কেঁদে ফেলল জাহানারা।সালেহা মেয়ের চোখের পানি দেখে থামলো।বকতে বকতে মেয়েকে বাড়ির ভেতরে নিল।
আদিবের সেই হাসি টুকুই যেন আদিবের কাল হলো। শুধু মাত্র ঐ হাঁসির কারণে এরপর থেকে জাহানারা আদিব কে দেখলেই চোখ মুখ গুটিয়ে অদ্ভুত ভঙ্গিতে ভেংচি কাটত।প্রথম প্রথম আদিব ব্যাপার টা তেমন গুরুত্ব দিল না। এককথায় নির্লিপ্ত ভাব দেখালো।
তবে আদিবের এই নির্লিপ্ত ভাবটা জাহানারা কে সাহস যোগাল।সে যেন পেয়ে বসলো।যখন তখন যেখানে সেখানে শুরু করলো অমন বেয়াদবি।একটা সময় পর আদিবের মনে হলো এবার ব্যাপারটা থামানো উচিত।যেমন ভাবা তেমন কাজ একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে জাহানারা কে চোখে পড়লো তার।মেজ চাচাদের বাড়ির সামনে নিতুর সাথে গল্প করছে। কাঁধে স্কুল ব্যাগ।আদিব কে দেখেই মুখ বেকালো সে।সাথে সাইকেলর ব্রেক কষলো আদিব। সাইকেল স্ট্যান্ডে দাড় করিয়ে পিছন ফিরে সোজা এসে দাঁড়ালো জাহানারার সামনে।কোন ভণিতা না করে বাজখাঁই গলায় বলল,
-কিছু বলছি না বলে তোমার বেশি সাহস হয়ে গেছে না! বেয়াদব।আর একবার মুখ ভেংচিয়ে দেখো থাপড়ে দাঁত ফেলে দেবো তোমার।
আদিবের আকস্মিক আক্রমণে থতোমতো খেল জাহানারা।সে হয়ত আশা করেনি আদিব এভাবে তেড়ে আসবে। আদিবের ব্যবহার জাহানারা কিঞ্চিৎ অপ্রস্তুত হল তবে দমলো না।আদিবের কথার জবাবে পালটা বলে উঠলো,
-আমি আপনাকে ভেংচি দেইনি।আমি নিতুকে ভেংচি দিয়েছি।এই নিতু বল।
নিজের কথার সত্যতা প্রমাণে নিতুকে সাক্ষী হিসেবে দাড় করালো জাহানারা।জাহানারার এমন কাজে নিতু যেন আকাশ থেকে পড়লো।এমনিতে ভিতু স্বভাবের সে।তাছাড়া আদিবকে সে ভয় পায়।জাহানারার কথায় সে বুঝে পেল না কি করবে।নিতুর সম্মতি দিতে দেরি হতে দেখে তাড়া লাগালো জাহানারা।আদিব স্পষ্ট বুঝতে পারলো জাহানারা নিজেকে সঠিক প্রমাণিত করতে নিজে মিথ্যা কথা বলছে সেই সাথে নিতুকেও বাধ্য করছে।মেজাজ চড়া গেল আদিবের।
-চুপ বেয়াদব!আর একটাও কথা বলবে না।একত বেয়াদবি করেছ আবার এখন সেটা ঢাকতে মিথ্যা কথা বলছো! অসভ্য একটা!
আদিবের উচ্চ কণ্ঠ। জাহানারা কেঁপে উঠলো।আদিবের গলার আওয়াজ পেয়ে বাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো নিতুর মা ডালিয়া।এসেই আদিবের কাছে জানতে চাইলো কি হয়েছে।আদিব সবটা বলতেই ডালিয়া ছি : ছি : করে উঠলো।বলল,
-বড় ভাইয়ের সাথে কেও এমন করে জাহান!আদিব তোর বড় না!ওর সাথে এমন বেয়াদবি করলি কি করে তুই! ছি : ছি :!
মেজ চাচির কথা শুনে চোখ টলমলে হলো জাহানারার।আদিব আর দাঁড়ালো না সেখানে।রাগে গজ গজ করতে করতে স্থান ত্যাগ করলো।সেদিনে সেই ঘটনা সেখান থেমে থাকলো না। ডালিয়া বেশ রসিয়ে কষিয়ে সালেহা কে বললেন। সালেহা রাগে দুঃখে মেয়ে কে ইচ্ছা মতো মার লাগলো।সেই সাথে হুঁশিয়ারি দিল জাহানারা কে আর যদি কোনোদিন কারো সাথে বেয়াদবি করতে দেখে তাহলে জাহানারার একদিন কি তার একদিন।মায়ের সেই হুমকি মাথা পেতে নিলো জাহানারা।এরপর আদিবের থেকে একশ হাত দূরত্ব তৈরি করলো।
আদিবের সাথে বেয়াদবি করার জন্য জাহানারা কে সালেহা উত্তম মাধ্যম দিয়েছে এই কথা নিয়ে তিন বাড়িতেই কম বেশি আলোচনা হলো। আশরাফ কথাটা শুনে আফসোস করে বলল, “এটুকু বিষয়ে সালেহার মেয়ের গায়ে হাত তোলা উচিত হয়নি,ছোট মানুষ অত বোঝে না কি!আর আদিব তুমিও বা কি?ঐটুকু মানুষের কথায় কেউ রাগে!ওর কি অত ভালো মন্দ জ্ঞান হয়েছে !”বাবার কথায় আদিবের মনে হলো অন্যায় টা তার।তানিয়া আশরাফের কথায় সহমত হতে পারলো না সে বলল,”সালেহা যা করেছে ভালো করেছে। মেয়েটা একটু বেশিই অবাধ্য হচ্ছে ,এই সময় শাসন না করলে হিতে বিপরীত হবে।”আদিব বাবা মায়ের কথায় বুঝলো যা হয়েছে হয়েছে এতে তার কিছু করার নেই।সে নিজের খাবার চুপচাপ শেষ করে নিজের ঘরে গেল।
এরপর বেশ কিছুদিন জাহানারা কে আদিবের আশেপাশে লক্ষ্য করা গেল না।আদিবের মনে হলো সেজ চাচির মারে মেয়ের বুঝ এসেছে। কিন্তু আদিবের সেই ভাবনাকে ভুল প্রমাণিত করে মেয়েটা যেন আরো বাড়লো।এই ঘটনার আগে যদিও বা আদিবের সাথে তার তেমন কোন কথাবার্তা কিংবা তেমন কোন ঘনিষ্ঠতা ছিল না। জাহানারা যথা সম্ভব আদিবের থেকে দূরেই থাকতো কিন্তু এই ঘটনার পর মেয়েটা যেন আদিব কে নিজের শত্রু হিসেবে দেখতে লাগলো।আড়ালে আবডালে নানাভাবে বিরক্ত করতে লাগলো সে আদিব কে।এই যেমন:- সেজ চাচার কাছে পড়তে গেলে তার পায়ের একটা স্যান্ডেল পড়ে থাকলে আরেকটার হদিস থাকতো না,কখনো বা রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় কোথা থেকে গায়ে ছোট ইটের টুকরো উড়ে এসে লাগতো। আবার কখনো বা পাড়ার বাচ্চাদের দিয়ে তাকে কানা বক বলে ডাকাতো।এসব ঘটনায় অতিষ্ঠ হয়ে আদিব একদিন জাহানারা কে ডেকে গম্ভীর কণ্ঠে বলল সে যেন তার এসব কর্মকাণ্ড বন্ধ করে।আদিবের কথা শুনে জাহানারা আকাশ থেকে পড়ার ভ্যান করে বলল,সে এসব কিছু জানেই না।সে তো মায়ের কথা শুনে এখন আদিবের সামনেও যায় না , ইত্যাদি ইত্যাদি। জাহানারার কথা শুনে দাঁতে দাঁত চাপলো আদিব।এই নিয়ে আর জাহানারা কে কিছু বলল না।সবটা হজম করে তক্কে তক্কে থাকলো কবে মেয়েটাকে হাতে নাতে ধরবে।এভাবে সময় গড়াতে লাগলো। কিন্তু আদিব কোন ভাবেই মেয়েটার নাগাল পেল না। বৃত্তি পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য অন্যদিকে আর খেয়াল রইলো না। এরমধ্যে জাহানারা বার্ষিক পরীক্ষা শেষে নানা বাড়ি বেড়াতে গেল।আদিব যেন হাফ ছেড়ে বাঁচল।তবে সেটা ছিল সীমিত সময়ের জন্য।
পরের বছর ক্লাস ফাইভ পাস করে জাহানারা আদিবের স্কুলে ভর্তি হলো।সজীবও সে বছর সালেহার এখানে এসে উঠলো।আদিবের ক্লাসে ভর্তি হলো সজীব। পূর্ব পরিচিত হওয়ার দরুন দুইজনের বন্ধুত্ব হতে বেশি সময় লাগলো না।বেশ কয়েকদিন যেতে না যেতেই সজীব লক্ষ্য করলো জাহানারার আদিবের সাথে করা শয়তানি গুলো।একদিন আদিবের স্যান্ডেল বাড়ির পিছনের বাগানে ফেলতে নিতেই সজীব হাতে নাতেও ধরলো জাহানারা কে। সজীব জাহানারার এই শয়তানি সালেহাকে বলতে যাওয়ার জন্য উদ্যত হতেই জাহানারা হাতে পায়ে ধরলো তার।আদিবও ছিল সেখানে আদিবের থেকেও বারবার মাফ চাইলো জাহানারা বলল আর কখনো এমন কিছু করবে না। রীতিমতো কথা দিল সে।আদিব সজীব কে বলল এবারের মতো ছেড়ে দিতে এরপরে যদি আবার এমন কিছু করে তখন দেখা যাবে।সেদিনের পর সত্যি জাহানারা আর তেমন কিছু করলো না।এমনকি তাকে আদিবের ধারে কাছে দেখা গেল না।তবে আদিব উড়ো উড়ো শুনতে পেত আড়ালে তাকে জাহানারার কানা বক বলে ডাকা সম্বোধন টা।কিন্তু তেমন গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করতো না।তাছাড়া আদিবের তখন সময় কোথায়!স্কুল শেষ করে ক্লাস নাইনে বিভাগীয় বিষয়গুলোর জন্য আলাদা কোচিং করে বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যায় তার। যেখানে দুপের খাওয়া টাও ঠিক মতো হয় না সেখানে জাহানারা কি করলো না করলো তা দেখবে কখন!
ছেলের কথা চিন্তা করে আশরাফ জায়েদ কে বলে বাড়ি এসে পড়িয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করলো।যার দরুন সেজো চাচার বাড়ি যাওয়া বন্ধ হলো আদিবের।এরপর পড়াশোনার চাপে, স্কুল, কোচিংয়ের ব্যাস্ততায় কীভাবে কীভাবে যেন এসএসসি পরীক্ষা নাকের দোর গোড়ায় এসে পৌঁছাল।পরীক্ষার জন্য প্রয়োজন ছাড়া বাড়ির বাইরে যাওয়া বন্ধ হলো আদিবের। আশ্চর্য জনক হলেও সত্যি, এই সময়টুকুতে জাহানারার সাথে তার দেখা হলো না বললেই চলে।কোন এক অদৃশ্য কারণে হঠাৎ জাহানারার উড়ু উড়ু চলা ফেরায় সীমা টানলো সালেহা। জাহানারাও যেন বাধ্য মেয়ের মতো ঘর মুখো হলো।
এরপর অনেকদিন পর ফের জাহানারার সাথে দেখা হলো আদিবের।এসএসসি পরীক্ষা গোল্ডেন পাওয়ার খুশিতে মিষ্টি দিতে গিয়েছিল সে সেজ চাচার বাড়ি। জাহানারা উঠানে লাফদড়ি খেলছিল।আদিব কে দেখে খেলা থামিয়ে এগিয়ে এলো সে।জাহানারা কে অনেদিন পর দেখে আদিবের কাছে মনে হলো মেয়েটা হঠাৎ বড় হয়ে গেছে।আদিব কে দেখেই এক গাল হাসলো জাহানারা।হাতে থাকা লাফদড়ি একপাশে রেখে বলল,
-আপনি না কি গোল্ডেন প্লাস পেয়েছেন আদিব ভাই।তা আমাদের মিষ্টি কৈ?
আদিব হাতে থাকা মিষ্টির থালা জাহানারার হাতে দিয়ে বলল,
-এই যে মিষ্টি।চাচিকে দিও।আমি মেজ চাচিদের বাড়ি যাচ্ছি। সজীব আছে?
-ছোট মামা বাড়ি গেছে।
-ও ফিরলে আমার সাথে দেখা করতে বলবে।
ব্যস্ত পায়ে বেরিয়ে আসলো আদিব।সেদিন অনেকদিন পর সেই এক চিলতে কথা হয়েছিল জাহানারার সাথে তার। তারপর রাস্তা ঘাটে মাঝে সাঝে দেখা হলেও ভালো মন্দ ব্যতীত আর কোন বাক্য বিনিময় হয়নি দুজনের।
আদিব নিজের পড়াশোনা নিয়ে এতটাই ব্যস্ত থাকতো যে কোথায় কি হচ্ছে,কারকি খবর এসবের জন্য সময়ই ছিল না তার কাছে। তবে একদিন খাবার টেবিলে হঠাৎ জাহানারার কথা উঠলো।দাদি তুললেন কথাটা। জাহানারার জন্য না কি বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে ফুপুর বড় জা।কথাটা শুনতেই আশরাফ বলে উঠলো,
-মানুষের আক্কেলও বলিহারি! ঐ টুকু মেয়ের জন্য বিয়ের প্রস্তাব দেয় কীভাবে!তুমি নাফিজাকে কিছু বলো নি?
-নাফিজা বলেছিল জাহানারা এখন ছোট, জায়েদ এখন মেয়ে বিয়ে দেবে না। ওর জা শোনেনি।বাধ্য হয়ে নাফিজা জায়েদের সাথে কথা বলতে এনেছিল।
-জায়েদ কি বলল?
আদিব লক্ষ্য করলো বাবার গলাটা কেমন জানি শোনালো।দাদি বললেন,
-বোনের জা বলে কথা, মুখের উপর না করে কি করে।আমতা আমতা করছিল।বাধ্য হয়ে যা বলার আমি বলেছি।বলেছি আমাদের মেয়ে অন্য কোথাও পাঠাবো না, বাড়িতেই রাখবো।
দাদির কথার তাৎপর্য বুঝলো না আদিব তবে লক্ষ্য করলো খাওয়ার প্লেটে হাত থেমে গেল তার মায়ের।বাবা কিছু বলতে যাচ্ছিল তার কথা মাঝ পথে কেটে তার মা বলল,
-মা আপনি কি জাহানারার জন্য আদিবের কথা বলছেন?
মায়ের প্রশ্নে আকাশ থেকে পড়লো আদিব।তবে দাদির মুখে চওড়া হাসি দেখা দিল।সে সেভাবেই বলল,
-হ্যাঁ বউমা।কেন তোমার মনে নেই খোকা তো বলেছিল জাহানারা কে সে আদিবের জন্য নিবে।ভুলে গেলে না কি।
-আপনার ছেলে কি বলেছিল, না বলেছিল তার দায় আমার ছেলে নিতে যাবে না মা! আপনার খোকা যা বলেছিলো সব ভুলে যান মা।
-সে কি বউমা এসব কি বলছো তুমি!ভুলে যাবো মানে!খোকা কথা দিয়েছিল জায়েদ কে।তুমিও তো ছিল সেদিন, কৈ তখন তো আপত্তি করোনি তাহলে এখন কি হলো!
-এখন আপত্তি করছি।
কথাটা বলে খাওয়ার টেবিল ছেড়ে উঠে গেল তানিয়া।আদিব হতবাক হয়ে বসে রইলো কিছুক্ষণ। বোঝার চেষ্টা করলো এতক্ষণ ঠিক কি নিয়ে কথা হলো।
চলবে,ইনশাআল্লাহ