সৌরকলঙ্ক পর্ব-৩০ এবং শেষ পর্ব

0
3

#সৌরকলঙ্ক
#উম্মে_প্রভা
#শেষ_পর্ব

গাঢ় লাল রঙের ছোট্ট রত্নখণ্ডে চোখ পড়তেই ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসির রেখা ফুটে উঠল আদিবের। প্রায় দুই বছর আগে, এক সহকর্মীর অনুরোধে তার ভাইয়ের বিয়ে উপলক্ষে লন্ডনের ****** শহরে গিয়েছিল সে। ফিরতি পথে এক ভিনটেজ জুয়েলারি শপে ঢুকে মায়ের জন্য কিছু কিনতে গিয়েই নজর কেড়েছিল চিকন সোনালি চেইনে বাঁধা রুবির লকেটটা। মূলত মায়ের জন্য কানের দুল কিনতে গিয়েছিল, কিন্তু এই লকেটটা দেখে অদ্ভুত এক টানে কিনে ফেলে। কাউকে দেওয়ার উদ্দেশ্য ছিল না, নিছক ভালো লাগা থেকে সংগ্রহে রাখা।

জাহানারার জন্মদিন উপলক্ষে তাকে কী উপহার দেবে সেটা ভাবতে গিয়ে দুই বছর ধরে অবহেলায় পড়ে থাকা লকেটটির কথা মনে পড়লো আজ। বাক্সবন্দি গয়নাটা হাতে তুলে নিয়ে আবার ব্রিফকেস যথাস্থানে রেখে দিল আদিব। আলমারি বন্ধ করে জাহানারার ঘরের দিকে রওনা হলো মন ভালো করা এক অনুভূতি নিয়ে।

জাহানারা জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে ছিল। দিন গড়ানোর সাথে সাথে মন খারাপ বাড়ছে তার। মাকে মনে পড়ছে খুব। গত বছর জন্মদিনেও মানুষটা তার সাথে ছিল। তার জন্য রান্নাঘর তোলপাড় করে রান্না করছিল, আর আজ সময়ের ব্যবধানে সেই মানুষটা তার সাথে নেই, কাছে নেই, কোথাও নেই। চোখ জলে উঠলো জাহানারার। ফুঁপিয়ে উঠলো সে। আদিব সেই সময় এসে দাঁড়িয়েছিল তার ঘরের দরজায়। জাহানারার শরীরের কম্পন দেখে আদিবের বুঝতে অসুবিধা হলো না—জাহানারা কাঁদছে। সে ব্যস্ত পায়ে এগিয়ে গেল সামনে। হাতের ছোট বাক্সটা লুকিয়ে ফেলল ট্রাউজারের পকেটে। জাহানারার ঘাড়ে হাত দিয়ে উদ্বেগজড়িত কণ্ঠে জানতে চাইলো,

-কী হয়েছে?

আদিবকে দেখে নিজের চোখের পানি লুকানোর চেষ্টা করলো জাহানারা। স্বাভাবিক করতে চাইলো নিজেকে, কিন্তু ব্যর্থ হলো সে। ফুঁপিয়ে উঠলো ঠোঁট চেপে। আদিব তাকে নিজের দিকে ফেরালো। অশ্রুসিক্ত মুখটা হাতের আঁজলায় নিয়ে ফের জিজ্ঞেস করলো,

-কী হয়েছে, বলো আমাকে? কেউ কিছু বলেছে?

দুই দিকে মাথা নাড়লো জাহানারা।মানে কিছু হয় নি ,কেউ কিছু বলে নি।

-তাহলে?

ফের প্রশ্ন আদিবের। জাহানারা মুখ খুলল,

-আম্মুর কথা মনে পড়ছে। কষ্ট হচ্ছে। খুব কষ্ট হচ্ছে।

কান্নায় ভেঙে পড়লো জাহানারা। আদিব আগলে নিল তাকে। জাহানারার মুখে সেজ চাচির কথা শুনে ভেতরটা ধক করে উঠলো তার। মানুষটা চলে গেছে, তাও প্রায় ছয় মাস হবে, অথচ মনে হয় না মানুষটা তাদের মাঝে নেই। আদিবের তো প্রায় এটা ভাবে, ঐ বাড়িতেই আছে মানুষটা। সে গেলেই বেরিয়ে আসবে রান্নাঘর থেকে, একগাল হেসে শাড়ির আঁচলে হাত মুছতে মুছতে বলবে, “এতোদিনে চাচির কথা মনে পড়লো বুঝি, আদিব?” কিন্তু আদিব জানে, সেটা সম্ভব না। মানুষটা শুধু তার স্মৃতিতেই আছে, এই দুনিয়ায় নয়। কথাটা ভাবতেই আদিবের বুক চিরে বেরিয়ে এলো একটা দীর্ঘশ্বাস। জাহানারাকে আরো একটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো নিজের সাথে। তাকে সময় দিল শান্ত হওয়ার। অনেকটা সময় নিয়ে শান্ত হলো জাহানারা। চোখ মুছলো। আদিব তার মুখের দিকে তাকিয়ে নরম গলায় জিজ্ঞেস করলো

-ফিল বেটার?

-কিছুটা।

নাক টেনে বলল জাহানারা। তারপর আদিবের উদ্দেশ্যে বলল,

-আপনি এই ঘরে কিছু বলবেন?

-হ্যাঁ, আসলে——

আদিবের কথার মাঝপথে দরজায় কড়া নাড়লো নেহা। জাহানারা তাকালো সেদিকে।আদিবও ঘাড় ফিরালো।

-ম্যাম, আপনার ভাই এসেছে।

নেহার কথা শেষ হতেই ব্যস্ত পায়ে এগিয়ে গেল জাহানারা। ভাই যে তার জন্মদিন উপলক্ষে এসেছে, এটা বুঝতে ভুল হলো না তার। জাহানারা চলে যেতেই ট্রাউজারের পকেট থেকে ছোট বাক্সটা বের করে দেখলো আদিব। সেটা আবার পকেটে রাখলো। মনে মনে ঠিক করলো,এখন যেহেতু দেওয়া হলো না জিনিস টা ,তখন একেবারে রাতেই দেবে।

____

নিচে নেমে ভাইয়ের পাশে বাবাকে দেখে চমকালো জাহানারা। চলার গতি ধীর হলো তার। গাঢ় অভিমানে দৃষ্টি হলো ঘোলাটে। চোখের পানি লুকাতে মুখ গুঁজে সামনে গিয়ে দাঁড়ালো সে। দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো মেঝেতে। সেভাবেই বলল,

-তোমরা এখানে…

গলার স্বর কেঁপে উঠলো জাহানারর। অজ্ঞাত থামতে হলো। ঠোঁটে ঠোঁট চাপলো। চেষ্টা করলো নিজেকে সামলানোর। জায়েদ বুঝলো মেয়ের অভিমান। পুরোনো কথা ভুলে এগিয়ে গেল সামনে। হাত রাখলো মেয়ের মাথায়। বাবার উষ্ণ স্পর্শে এতদিনে মনে জমা বরফ গললো জাহানারার। বাবাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে উঠলো সে। কান্নারত গলায় অনবরত বলতে লাগলো,

-আই অ্যাম স্যরি, আব্বু। আই অ্যাম স্যরি। আই অ্যাম স্যরি।

জায়েদ আলতো হাতে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,

-আই অ্যাম অলসো স্যরি, মা। আব্বুরও ভুল হয়েছে।তোমাকে বোঝা উচিত ছিল তার।তোমার বয়সের দোষ ছিল কিন্তু আমি তো বুঝাদার ছিলাম—।আমাকে মাফ করে দিও, প্লিজ।

জায়েদের গলায় অনুতাপের ছাপ।সে নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে এতো দিনে।বুঝতে পেরেছে সন্তান পথ হারালে তাকে পথ দেখাতে হয়। শক্ত করে হাত ধরে সঠিক পথে আনতে হয়।সমাজ কিংবা সম্মানের ভয়ে তার থেকে মুখ ফিরাতে হয় না।

বাবার কথায় জাহানারার কান্নার বেগ আরো বাড়লো। জায়েদের বুকের শার্ট ভিজলো মেয়ের চোখের পানিতে। এই মুহূর্তে এসে সে উপলব্ধি করলো, মা মারা যাওয়ার পর এত বছর বুকের ভেতর যে খাঁ খাঁ ভাবটা ছিল, যার জন্য কত নির্ঘুম রাত কাটিয়েছে, কোনো ঔষধে যার উপশম হয়নি—সেটা মেয়েকে বুকে নিতেই এক নিমিষে উধাও হয়ে গেল। অন্তঃকরণ জুড়ে ছেয়ে গেল শীতলতা। প্রশান্তির শ্বাস ফেলল সে।

-না, তোমার কোনো দোষ নেই। সব দোষ আমার। আমি বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেলেছি। তোমাদের ছোট করেছি, কষ্ট দিয়েছি। আই অ্যাম স্যরি, আব্বু।

ফের বলতে লাগলো জাহানারা।

-আচ্ছা হয়েছে।আর কত কাঁদবি ।এখন পুরোনো কথা বাদ দে। এদিকে আই, কেক কাট। দেখ, তোর জন্য পুতুলওয়ালা কেক এনেছি।

জাহানারার কথার মাঝে ফোড়ন কেটে বলল আকিব। জাহানারা নাক টেনে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। জায়েদ চোখের পানি মুছিয়ে দিল মেয়ের। বলল,

-সব ভুলে যাও, মা। যা হয়েছে, সেগুলো তো আর আমরা ঠিক করতে পারবো না, কিন্তু সামনের দিনগুলো তো ভালোভাবে কাটাতে পারবো। তাই না?

বাবার কথায় উপর-নিচে মাথা নাড়লো জাহানারা। আকিব অধৈর্য কণ্ঠে বলল,

-তোমাদের মিলনপর্ব শেষ হলে কেকটা কা’টো খাই।

আকিবের কথা শুনে চোখ-মুখ গুটালো জাহানারা বিরক্ত চোখে তাকালো তার দিকে।।

-ওভাবে তাকাচ্ছিস কেন?

-তোমার সেন্স দেখছি আমি। দেখছো, এতদিন পর আব্বুর সাথে কথা বলছি। কোথায় শান্তিতে কথা বলতে দেবে, তা না—ফোড়ন কাটছো!

-সারাদিন পড়ে আছে আব্বুর সাথে কথা বলার জন্য। আগে এটা কেটে উদ্ধার কর। ডিউটিতে যেতে হবে আমাকে। তাড়াতাড়ি আই।

জাহানারা কথা উপেক্ষা করে তাড়া দিল আকিব। জাহানারা আকিবের চলে যাওয়ার কথা শুনে বলল,

-আজকে ডিউটিতে না গেলে কী হয়? আমার জন্মদিন না। আজ ছুটি নাও।

-হবে না।এই পরিস্থিতিতে ছুটি পাবো না।তুই আই।তাড়াতাড়ি গেলে তাড়াতাড়ি ফিরতে পারবো।

এগিয়ে গেল জাহানারা। আকিব বাক্স থেকে কেক বের করলো। গোলাপি রঙের কাস্টমাইজড পুতুল বসানো কেকটা দেখে চোখ ছলছল করে উঠলো জাহানারার। মিতু আপুর জন্মদিনে এমন কেক এনেছিল মেজ চাচা। জাহানারার খুব শখ হয়েছিল, তার জন্মদিনে অমন একটা কেক আনতে। পুরো দুই মাস এই নিয়ে মায়ের পিছু পিছু ঘুরেছিল সে। সালেহা তেমন পাত্তা দেয়নি। তাছাড়া, সেইবার আকিবের ক্যাডেটে ভর্তির জন্য কোচিং-টিউশন ফি বাবদ অনেক টাকা খরচ হয়েছিল, যার দরুন জায়েদের হাতটান ছিল। কিন্তু জাহানারা ওসব শুনতে নারাজ। মেয়ের খুঁতখুঁতানিতে অতিষ্ঠ হয়ে সালেহা তার গায়ে হাত তুললো। জায়েদ বাড়ি ফিরে দেখে মেয়ে তার দরজায় বসে কাঁদছে, চোখ-মুখ লাল হয়ে গেছে। জায়েদ তড়িঘড়ি মেয়েকে কোলে নিল। সালেহাকে কেন মেয়েকে মেরেছে, তার জন্য তাকে ডেকে ধমকাধমকি দিল। মেয়ের চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে তাকে বলল, সে যেমন কেক চায়, তেমন নিয়ে আসবে। জাহানারা তো সেই খুশি। দাদিকে নেচে নেচে বলল সে কথা। দীপ্তি আপু, তৃপ্তি আপুকে বলল। নিতুকে বলল। সবাইকে দাওয়াত দিলো তাদের বাড়ি। সালেহা মেয়ের খুশিতে বাধা সাধলো না। বাড়ির পোষা বড় মোরগটা জবাই করে মেয়ের জন্মদিন উপলক্ষে অল্প-স্বল্প আয়োজন করলো। জাহানারা সেজেগুজে বসে ছিল সেদিন—আব্বু কেক নিয়ে আসলে সে কেক কাটবে, অবশ্য তার আগে বড় চাচার ক্যামেরায় কেক সামনে নিয়ে ছবি তুলবে। কিন্তু আব্বু এলো না সঠিক সময়ে। তার খবর এলো, এক্সিডেন্ট হয়েছে তার, হাসপাতালে আছে। বড় চাচা, মেজ চাচা ছুটলো সেখানে। আম্মুর মাথায় পানি দিল চাচিরা। জাহানারা পড়লো চিন্তায়—তার আব্বুকে নিয়ে না, তার জন্মদিনের কেক নিয়ে। আব্বু হাসপাতালে থাকলে তার কেক কী করে আসবে, এটা ভেবেই দৌড়ে গেল মায়ের কাছে। সরল মনে জিজ্ঞেস করলো,

-আম্মু, আমার কেক নিয়ে আসবে না আব্বু?

কথা বলা মাত্রই মেয়ের মুখে চড় বসালো সালেহা। খেকিয়ে উঠলো তার উপর। জাহানারা বেগম এসে ধরলো জাহানারাকে।সালেহা কে ধমকে বলল,

-ব‌উমা !ও অতো বোঝে না কী? ওর গায়ে হাত তুলছো কেন?

-ওর জন্য তো আপনার ছেলের এমন অবস্থা মা। অসভ্য মেয়ে—বাপ হাসপাতালে, তার খেয়াল নেই। ওনার কেক লাগবে!দূর হ এখান থেকে!

মায়ের বিকট ধমকে জাহানারা দাদির পিছনে লুকালো। ঠোঁট বেঁকিয়ে এলো তার। ছোট্ট জাহানারা সেদিন মনে মনে ঠিক করলো, আর কখনো সে জন্মদিন-জন্মদিন করবে না। সত্যি, তারপর জাহানারা আর কখনো মায়ের পিছু ঘোরেনি পুতুলওয়ালা কেকের জন্য, কখনো মাতামাতি করে নি নিজের জন্মদিন নিয়ে। আব্বু কখনো চাইলেও এড়িয়ে গেছে সে। জন্মদিনের আগে আগে কখনো গিয়ে নানা বাড়ি বসে থেকেছে, তো কখনো ছোট খালার বাড়ি। সবার সামনে মায়ের বলা কথাগুলো তার ছোট্ট মেয়ে মনে জিইয়ে রেখে এমন করেছে—সেটা সালেহা বুঝলেও মেয়ের মান ভাঙাতে পারেনি।প্রতিবছর এই দিনটাতে সূক্ষ্ম এক অপরাধবোধে কুঁকড়ে থেকেছে সে। চেষ্টা করেছে নিজের সাধ্য মতো মেয়ের জন্মদিন টা বিশেষ বানানোর কিন্তু জাহানারা মাঝে কখনো সেই উচ্ছাস দেখেনি যেটা সেই ছোট্ট বেলায় শেষ বার দেখেছিল।সালেহা নিজের বলা কথায় অনুতপ্ত হয়ে কতবার ছেলের সামনে চোখ ভিজিয়েছে ছেলের সামনে।মেয়ের মান ভাঙাতে না পারার আফসোসে কত না দীর্ঘশ্বাস ফেলেছে।

আকিব মায়ের সেই আফসোস মিটাতে নিজের সাধ্য মতো চেষ্টা করেছে বোনের মান ভাঙানোর, কিন্তু জাহানারা এত ব্যস্ত, তাকে বাগে পাওয়ায় দায়। তবে এবার বোন কে কাছে পিঠে পেয়ে এই সুযোগ হাতছাড়া করতে চায়নি, তাই তো সেই একই রকম কেক অর্ডার দিয়ে বানিয়ে এনেছে। এতে যদি তার বোনের মান ভাঙে, এতো দিন পরে এসে যদি তার মায়ের সুপ্ত ইচ্ছাটা পূর্ণ হয়। একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করলো আকিব। সকলের অগোচরে মুছে নিলো চোখের পানি। মুখে হাসি টেনে বলল,

-ঐ দেখ, আবার কাঁদতে বসেছে। কাল-নাগিনী থেকে ছিচকাঁদুনি হলি কবে!

অন্য সময় আকিবের মুখে কথাটা শুনলে ছ্যাঁৎ করে উঠতো জাহানারা। তবে আজ কিছু বলল না। চুপচাপ কেকে ছুরি বসালো। আব্বুকে কেক খাইয়ে আকিবের মুখের সামনে কেকের টুকরো ধরে কান্না ভেজা গলায় বলল,

-মা থাকলে ভালো হতো না, ভাই?

জাহানারার কথায় চোখর পানি ছলকে উঠলো আকিবের। কেকের টুকরো মুখে নিয়ে মাথা নাড়ালো সে। বোনের মাথায় হাত দিয়ে বলল,

-তুই সুখে থাক। তুই সুখে থাকলে মা যেখানেই থাকুক, ভালো থাকবে।

তারপর কথা ঘোরাতে আদিব কে ডাকলো,

-আদিব, ওখানে দাঁড়িয়ে কেন? এদিকে আই।

অনেকক্ষণ এসেছে আদিব। দূরে দাঁড়িয়ে ছিল সে। আকিবের ডাকে সামনে গেল।

এরপরের সময়টা বেশ আনন্দঘন কাটলো জাহানারার। আম্মুর শূন্যতা পোড়ালেও আব্বুর উপস্থিতি কিছুটা স্বস্তি দিলো। কিছু সময় বসে আকিব চলে গেল নিজের কাজে। জাহানারাকে জায়েদ বাড়ি নিয়ে যেতে চাইলো, কিন্তু আদিব বাধা দিল। জানালো, সে জাহানারার জন্মদিন উপলক্ষে রান্না বান্না করবে। কথাটা বলতে বলতে রান্নাঘরে ছুটলো আদিব। নেহা রান্নার যোগাড় করেই রেখেছিল। আদিবের খুব একটা অসুবিধা হলো না। রান্নাবান্না শেষ করতে করতে আকিব ফিরে এলো আবার। একসাথে খেতে বসলো সবাই। তারিনকে ডাকতে চেয়েছিল তারা, কিন্তু ওর বাচ্চা নিয়ে এখন এই পরিস্থিতিতে বাইরে বের হওয়া ঠিক হবে না বলে ওকে ডাকতে দিল না আকিব।

খাওয়াদাওয়া, গল্পগুজব শেষ করে উঠতে উঠতে রাত গড়ালো। অনেকদিন পর আব্বুর সান্নিধ্য পেয়ে কথা যেন ফুরাতেই চাইছিল না জাহানারার। জায়েদের রাতের ওষুধ আছে, দেরি হয়ে যাচ্ছে—এসব বলে আসর ভাঙলো আকিব। তবে জাহানারা জানালো, সে কালও বাড়ি যাবে। জাহানারার ওই বাড়ি যাওয়ার কথা শুনে একটা অদ্ভুত খারাপ লাগা কাজ করলো আদিবের মনে। তবে সে সেটা প্রকাশ করলো না।

সারাদিনের হৈচৈয়ের পর ফ্রেশ হয়ে বিছানায় শুতেই ঘুম জড়িয়ে আসলো আদিবের চোখ। কিন্তু ঘুম গাঢ় হওয়ার আগে বিছানায় ধপ করে কিছু পড়তেই ঘুম ছুটে গেল তার। ধুচমুচ করে উঠে বসলো সে। পাশ ফিরে দেখলো জাহানারা। তাকে দেখে ফোঁস করে একটা শ্বাস ফেললো আদিব। বুঝলো শব্দের উৎপত্তি। জাহানারা তাকে হুড়মুড়িয়ে উঠতে দেখে দাঁত বের করে হাসলো। বলল,

-ভয় পেয়েছেন?

আদিব নিজের জায়গায় আবার পিঠ ঠেকালো। ভাবলেশহীনভাবে বলল,

-না।

তারপর চোখ বন্ধ করে সেভাবেই বলল,

-এতদিন তো এমন ভাব করছিল, যেন আমার মুখ দেখলেও পাপ হবে। আজ একদম গায়ে হুমড়ি দিয়ে পড়ছো—ঘটনা কী?

এতদিন জাহানারা অনুভূতি লুকাতে আদিবের থেকে দূরে ছিল। যেটা গতকাল রাতে তাদের কাছাকাছি আসার পর আর প্রয়োজন নেই। তাছাড়া, কাল এতবার ছেলেটাকে “ভালোবাসি” বলেছে…!সব তো ফাঁস হয়েই গেছে এখন আর কি লুকাতে দূরে থাকবে।

-ঘটনা যা ঘটার, তা তো ঘটেই গেছে। আর রাখঢাক রেখে লাভ কী?

তড়িৎ চোখ খুলে তার দিকে তাকালো আদিব। চোখ-মুখ গুটিয়ে বলল,

-লজ্জা-শরমের বালাই নেই না তোমার?

-ওমা, আপনার সামনেও কিসের লজ্জা? তাছাড়া, আমি আপনার মতো অমন না।

-আমার মতো অমন না মানে? কী বলতে চাইছো?

চোখ সরু করলো আদিব। জাহানারা তার দিকে ফিরলো মুখের পাশে দুই হাত দিয়ে আরাম করে শুয়ে বলল

-মানে–মনে সাজ, মুখে লাজ—এমন টাইপ আর কী? ঠিকই তো, কাল রাতে জ——

-চুপ! একদম চুপ! আর একটা কথা বললে জালনা দিয়ে তোমাকে ফেলে দেব, বেয়াদব!

কপট ধমক দিল আদিব।মেয়েটার লাগামহীন কথার আচ পেয়ে কান লাল হয়ে উঠলো তার।জাহানারা ঠোঁট টিপে হাসলো। ছেলেটাকে এতদিনে শায়েস্তা করতে পেরে ভীষণ আনন্দ হলো।আদিব কে লজ্জায় ফেলতে এমন সব কথা শুরু করলো যে আদিবের মনে হলো মাটিতে মিশে যেতে পারলে ভালো হতো। বাধ্য হয়ে সে মুখ চেপে ধরলো জাহানারার। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো, আর কখনো এই মেয়ের ধারে-কাছে ঘেঁষবে না। কোনোদিন না। আদিবের চোখ-মুখ লজ্জায় লাল হলো, না রাগে লাল হলো, সেটা বোঝা গেল না। তবে জাহানারা মনে হলো, এবার তার থামা উচিত। সে থামলো। আদিবের হাতের নিচ থেকে ঠোঁট নেড়ে অস্পষ্ট স্বরে বলল,

-আর কিছু বলছি না, ছাড়েন। দম বন্ধ হয়ে আসছে।

আদিব ছেড়ে দিল তাকে। চোখ রাঙিয়ে হাতের আঙুল তুলে শাসালো—যার অর্থ এবার কিছু উল্টোপাল্টা বললে খবর আছে।জাহানারা মাথা নাড়লো। হাতের আঙুল ঠোঁট চেপে বোঝালো, সে আর কিছু বলবে না। আদিব আশ্বস্ত হয়ে পাশ ফিরলো। হাত বাড়িয়ে ঘরের আলো বন্ধ করলো। জাহানারা আর সত্যি ‘টু’ শব্দ করলো না। আদিবও কিছু বলল না। সাইড টেবিলে রাখা ছোট বাক্সটার দিকে তাকালো—যেটা বাইরে থেকে আসা ল্যাম্পপোস্টের আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। হাতে নিল সেটা। খুলে দেখলো। নানা ব্যস্ততায় জাহানারাকে দেওয়া হয়নি এটা।মনে মনে ঠিক করলো,মেয়েটা ঘুমিয়ে গেলে সাবধানে পরিয়ে দেবে।সকালে উঠে চমকাবে যাবে। ভাবনা অনুযায়ী জাহানারার গভীর ঘুমের অপেক্ষা করতে লাগলো আদিব। একসময় জাহানারার শ্বাসপ্রশ্বাস ভারী হলো। আদিব আন্দাজ করলো, জাহানারা ঘুমিয়ে পড়েছে। পাশ ফিরলো সে। জাহানারার মুখের উপর হাওয়ায় হাত নাড়ালো—জাহানারা আদো ঘুমিয়েছে কিনা সেটা পরীক্ষা করলো। যখন আশ্বস্ত হলো মেয়েটা সত্যি ঘুমিয়েছে, তখন বাক্স থেকে চেইনটা বের করে খুব সাবধানে পরিয়ে দিল তাকে। সাদা মসৃণ ত্বকে র’ক্তরঙা পাথরটা জ্বলজ্বল করে উঠলো। আদিবের ঠোঁটের কোণেও দেখা দিল মৃদু হাসি। মোহগ্রস্তের মতো এক ভাবেই তাকিয়ে রইলো সে পাথরটায়। তারপর হুট করে ঠোঁট ছোঁয়ালো সেখানে। নিজের কাণ্ডে নিজেই হকচকিয়ে গেল সে। ঠোঁট সরিয়ে উঠে আসতে চাইলো তড়িঘড়ি, কিন্তু তা আর হলো না—জাহানারা তার গলা নিজের হাতের বন্ধনীতে নিয়ে তার কানে ফিসফিস করে বলল,

-একেই বলে মনে সাজ, মুখে লাজ। বুঝেছেন?

-বুঝেছি।

নিজের সাথে জাহানারাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিয়ে জাহানারার ভঙ্গিতে বলল আদিব।পরপর দুই বার ঠোঁট ছোঁয়ালো পূর্বের জায়গায়। ধরা যখন পড়েই গেছে, তখন আর লুকিয়ে লাভ কী? জাহানারার ঠোঁট চওড়া হলো। ফিসফিস করে বলল,

-“ভালোবাসেন আমাকে?

-না।

আদিবের সোজা জবাব। যত আশা নিয়ে কথাটা জিজ্ঞেস করছিল জাহানারা, ততোটা নিরাশ হলো। তেতে উঠে বলল,

-ভালোবাসেন না তো জড়িয়ে ধরেছেন কেন?

-বেশ করেছি। আমার বউ, আমি ধরেছি। এখন পকপক না করে ঘুমাও।

-না, ঘুমাবো না। ছাড়েন।

রাগান্বিত স্বর জাহানারার।আদিব নাছোড়বান্দা।

-ছাড়বো না।

ছটফটিয়ে উঠলো জাহানারা। আদিবের গায়ের জোরের সাথে পারলো না। একসময় হার মানলো। ক্লান্ত কণ্ঠে বলল,

-আমাকে একটু ভালোবাসলে কী ক্ষতি হবে আপনার?

কথাটা যেন বুকে গিয়ে বিধলো আদিবের। সে জাহানারাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। জাহানারার মাথার তালুতে সময় নিয়ে চুমু খেল। নিজের স্পর্শে যেন বোঝাতে চাইলো নিজের অব্যক্ত অনুভূতি। জাহানারা বুঝলো তার কথা। ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠলো প্রাপ্তির হাসি। আদিবের বুকের মাঝে গুটিশুটি হয়ে চোখ বুজলো প্রশান্তিতে।

____

হাতের কব্জিতে তীব্র ব্যথা নিয়ে চোখ খুলল রাকিব। চোখ মেলতেই মাকে পেল সামনে। সময় অপচয় না করে অধৈর্য কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

-জাহান এসেছে?

-না।

-আসেনি? আমার এমন অবস্থা শুনেও আসেনি?

স্বগোতক্তি করলো রাকিব।আশাহত হলো সে।তার এমন অবস্থা শুনেও জাহানারা আসে নি এটা ভেবে কষ্ট পেল।তার ভাবনার মাঝেই কথা বলল মিসেস সারোয়ার,

-আমি ডাকিনি তাকে।

থমথমে গলা মিসেস সারোয়ার।মুখো ভঙ্গি কঠোর।ছেলের সামনে চেয়ার টেনে বসলো সে। গম্ভীর অথচ শীতল কণ্ঠে ফের বলল,

-একতরফা ভালোবাসা ততদিন সম্মানিত থাকে, যতদিন সেটা ভালোবাসার মানুষের স্বাভাবিক জীবনে বাধা না সাধে। জাহানারাকে তুমি ভালোবাসো—ইটস টোটালি অলরাইট, তাতে আমার কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু তুমি জোর করে তোমার অনুভূতি মেয়েটার উপর চাপিয়ে দেবে, ওর স্বাভাবিক জীবনে অস্থির করে তুলবে—সেটা হতে পারে না। আমার ছেলেকে জেনে বুঝে আমি এমন অন্যায় করতে দিতে পারি না। এর জন্য যদি তুমি আত্ম’ঘাতী হও, তাহলে হও। আমি সন্তান ছাড়া থাকতে পারবো, কিন্তু সন্তানের অপকর্মের কলঙ্ক নিয়ে নয়।”**

উঠে দাঁড়ালো মিসেস সারোয়ার। রাকিব এলোমেলো দৃষ্টি ফেলল। তার মা কখনো অন্যায়ের সাথে আপোস করে না, এটা অজানা নয় তার। তাকেও এমনটাই শিক্ষা দিয়েছে সে।মায়ের সেই শিক্ষাকে জেদের বশে ছোট করেছে—এটা ভাবতেই ভেতরটা কুঁকড়ে গেল অপরাধ বোধে।

-জাহানারা এতদিন একা ছিল, তুমি কোনো প্রতিশ্রুতি ছাড়া তার পাশে থেকেছো—এই পর্যন্ত ঠিক আছে। কিন্তু এখন সে বিবাহিত, অন্য একজনের স্ত্রী। এখান থেকে তোমাদের যাত্রাপথ আলাদা হওয়া উচিত। বুদ্ধি মানের জন্য ইশরায় যথেষ্ট।আই হোপ, তুমি আমার কথার মানে বুঝেছ রাকিব?

-ইয়েস, মা।

মিনমিনিয়ে বলল রাকিব।

-শুনতে পাইনি আমি।

-বুঝেছি মা।

গলার স্বর উঁচু করল রাকিব।ছেলে তার কথা বুঝেছে সেটা নিশ্চিত হতেই স্বস্তি পেল সে। ছেলের মাথায় হাত বুলালো। মুখের কঠোর ভাব সরিয়ে বলল,

-গেট ওয়েল সুন, আব্বা। আমি তোমার বাবাকে ফোন করে আসছি।

রাকিব ঘাড় নাড়লো। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল মিসেস সারোয়ার। রাকিব তার গমনরত পথের দিকে তাকিয়ে তপ্ত শ্বাস ফেলল। মেনে নিল নিজের ভবিতব্য।

______

প্রায় দুই বছর পরের কথা। জাহানারা তখন অন্তঃসত্ত্বা, পাঁচ মাস চলছে তার। আদিব ছুটি নিয়ে দেশে এসেছে জাহানারার ডেলিভারির জন্য। তার বাড়ি ফেরার উপলক্ষে তানিয়া মেয়ে-জামাইসহ জায়েদ আর সাজ্জাদের পরিবারকে দাওয়াত করেছে। বাড়িতে বেশ রমরমা পরিবেশ। খাওয়াদাওয়া, গল্পগুজবে মুখর চারিদিক। তানিয়া জাহানারাকে এখনো আড়চোখে দেখলেও ছেলের খুশির ভেতর নাক গলায় না। তাছাড়া, নিশানকেই যখন মেনে নিয়েছে, সেখানে সালেহার উপর রাগ করে জাহানারাকে কেন বঞ্চিত করবে—এমন ভাবনা থেকে ছেলের বউ নিয়ে খুশি সে। কিন্তু জাহানারার ঠোঁটকাটা স্বভাব আর ঐ সিনেমায় কাজ করার ব্যাপারটা ঠিক মানতে পারে না সে। এই সিনেমায় কাজ করার জন্য মেয়েটা তার ছেলের সাথে লন্ডন যায়নি,ঐ মেয়ের জন্য আবার আশরাফ যায়নি—এই দুই চাচা-ভাতিজির কারণে তার লন্ডন যাওয়া হয়নি।যাওয়া না যাওয়ার এই ঘূর্ণিপাকে অতিষ্ঠ হয়েছে সে।তার এতদিনের আশা ভণ্ডুল হ‌ওয়ায় তিক্ত-বিরক্ত সে জাহানারার উপর। কিন্তু জাহানারা অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার পর থেকে হৃদয় পরিবর্তন হয়েছে তার। সবসময় চেষ্টা করেছে তার সুবিধা-অসুবিধা দেখার, তাকে খুশি রাকার। জাহানারা কে নিয়ে এতোটা ভাবছে তানিয়া যে তার ইচ্ছা পূরণেই নিজের মনের বিপক্ষে গিয়ে এই দাওয়াতের ব্যবস্থা করেছে । না হলে এই ছাইগুষ্টির পিছনে খেটে মরতে বয়েই গেছে তার!

এই গরমে একরাশ বিরক্তি নিয়ে টেবিল থেকে খাবার বাটিগুলো সরিয়ে রান্নাঘরে রাখছিল তানিয়া। সেই সময় আদিবের চিৎকার কানে এলো তার। জাহানারার শরীর ভালো লাগছিল না, তাই তাকে নিয়ে নিজের ঘরে গিয়েছিল আদিব।তার চিৎকার শুনে ছুটলো সবাই।

আদিবের ঘরে যেতেই সবাই দেখলো, জাহানারা পেটে হাত দিয়ে ছটফট করছে আর আদিব উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বার বার জানতে চাইছে কি হচ্ছে তার।

মাকে দেখেই উঠে এলো আদিব।কাদো কাদো অসহায় গলায় বলল,

-মা, সব তো ঠিক ছিল, হঠাৎ কি হলো।ও এমন করেছে কেন?তুমি একটু দেখো প্লিজ ।

কথাটা বলতে বলতে চোখে পানি জমলো আদিবের। তানিয়ার বুকের ভেতরটা ছলাৎ করে উঠলো। ছেলের দেখা-দেখি তার চোখ‌ও ভিজলো। তৃপ্তিকে জাহানারার চিকিৎসারত ডাক্তার কে তৎক্ষণাৎ ডাকতে বলল। তারপর জাহানারার মাথায়-গোড়ায় বসে হাত বুলাতে বুলাতে আহাজারি করে বলতে লাগলো,

-ও মা, খুব বেশি কষ্ট হচ্ছে তোমার? খুব কষ্ট হচ্ছে। এই জন্য বলেছিলাম, এই গরমে এত ছোটাছুটি না করতে। কিন্তু আমার কথা কানে তোলে কেও!

আশরাফের দিকে রুক্ষ চোখে তাকালো তানিয়া। আশরাফ হতবুদ্ধি হলো। বুঝে পেল না, তার কী দোষ এখানে। সে তো শুধু বলেছিল, আদিব এসেছে, এই সুযোগে সবাইকে ডেকে খাওয়াদাওয়া করলে কেমন হয়। দিনক্ষণ তো আর সে ফেলেনি। আশ্চর্য! স্ত্রীর দৃষ্টি সহ্য করতে না পেরে আড়ালে গেল সে। দীপ্তিকে ডেকে বলল,

-তোর মা কে দেখ, কেমন খাবো-খাবো করছে। আমি বলেছিলাম, শুধু আয়োজন করতে দিনক্ষণ কিন্তু সেই ফেলল। এখন আমার উপর গরম দেখাচ্ছে।

-আচ্ছা, তুমি এখন কিছু বলো না। কিছু বললেই কিন্তু ফেঁসে যাবে ।দেখছো না, তার ছেলে কাঁদছে—মাথা ঠিক আছে না কি তার!

দিপ্তীর সাবাধানী বাণীতে এক পাশে সরে এলো আশরাফ ভুলেও আর স্ত্রী সামনে গেল না।
ডাক্তার শারমিন এলো প্রায় ফোন করার সাথেসাথে। এসে জানালো, ভয়ের কিছু নেই। লিগামেন্ট পেইন এটা। গর্ভাশয় প্রসারিত হচ্ছে, যার থেকে ব্যথার সৃষ্টি। জাহানারার প্রথম প্রেগন্যান্সি, তাই হয়তো ব্যথা সহ্য করতে না পেরে ছটফটিয়ে উঠেছে। ডাক্তার শারমিনের কথা শুনে উপস্থিত সকলে স্বস্তির শ্বাস ফেলল। তিনি অল্প পাওয়ারের *****ঔষুধ লিখে আরো কিছু দিকনির্দেশনা দিয়ে বিদায় নিলেন।

জাহানারা তখন স্থির হয়েছে। ব্যথা পুরোপুরি যায়নি, তবে তীব্রতা কম। সে সেভাবেই তানিয়ার উদ্দেশ্যে বলল,

-চাচিমা, আপনার ছেলে তো শেষমেষ আমার জন্য কেঁদেই ফেলল। তাহলে নাম আর বদলাতে হচ্ছে না আমার, কী বলেন?

স্তম্ভিত হলো তানিয়া।কত বড় সাহস মেয়েটা সেই পুরনো কথা তুলে তাকে খোঁটা দিচ্ছে।কথাটা মনে হতেই রাগে শরীর রিরি করতে লাগলো তানিয়ার।তার রাগ বাড়াতে আগুনে ঘি ঢাললো ডালিয়া।

– শুধু আদিব কেন? ভাবিও তো কাঁদছিল!

ফোড়ন কাটলো ডালিয়া।সাজ্জাদ স্ত্রীকে চোখের ইশারায় চুপ করতে বলল। কিন্তু তাতে লাভ কি? যা বলার তো বলা হয়ে গেছে। জাহানারা মেজো চাচির কথা টেনে অবাক হ‌ওয়ার ভ্যান করে বলল—

-তাই না কি?

ঠোঁট টিপে হাসল উপস্থিত সবাই। তানিয়া অগ্নিচোখে তাকাল ছেলের দিকে। মনে মনে বলল,‘কাঁদতে গেলি কোন দুঃখে? এতো পড়াশোনা করে ডাক্তার হয়েছিস, আর এতটুকু বুঝতে পারিস না কোনটা স্বাভাবিক ব্যথা আর কোনটা গুরুতর? ঘোড়ার ডাক্তার হয়েছে। যত সব!’*

ভিড় ঠেলে গজগজ করতে করতে বেরিয়ে এল তানিয়া। মেয়েটা নিজের কথা সত্যি করেই দেখালো— এটা মেনে নিতে পারল না সে। ছেলের উপর রাগ হলো খুব, তবে তার থেকে বেশি রাগ হলো ছেলের বাপের উপর।‘না সে এই গরমে দাওয়াত রাখতো, না ঐ মেয়ের শরীর দুর্বল হতো, না সে নেতিয়ে পড়তো, না আর তার ছেলে কেঁদে বুক ভাসাতো।এখানে দোষ যদি কারোর থাকে তাহলে সে টা এ লোকের’!

সবাই জাহানারা ঘর থেকে বের হতেই আদিব ক্ষিপ্ত গলায় বলল—

-তুমি আস্ত একটা বেয়াদব! সবার সামনে মাকে অমন খোঁচা দেওয়ার দরকার ছিল?

-উনি কম খোঁচা দেননি আমাকে। আর শুনুন, এসব আমাদের শ্বাশুড়ি-বউমার ব্যাপার, আপনি নাক গলাবেন না। আমার লড়ব-মরব, আবার এক হব। আপনি থার্ড পার্টি হয়ে ভেতরে ঢুকলে ব্যাপার সেনসেটিভ হবে। সুতরাং দূরে থাকুন। বেশি দরদ দেখাতে গিয়ে আমাদের সম্পর্কের সমীকরণ নষ্ট করেন না।

-তোমার এসব কথা-বার্তা আমার একটুও পছন্দ হয় না! কোথায় মিলেমিশে থাকবা, তা না— মেন্টাল একটা!

ফোঁস করে একটা শ্বাস ফেলল আদিব।ঘর জুড়ে পায়চারি করে নিজের রাগদমালো তারপর বলল,

-পেটের ব্যথা কমেছে?

-হ্যাঁ।শোনেন…

-বলো, শুনছি।

-আমাকে ভালোবাসেন না, তো ভ্যা ভ্যা করে কাঁদছিলেন কেন?

জাহানারার গা জ্বালানো ভঙ্গিতে পুরোনো প্রশ্ন। আদিব তার দিকে হতাশ চোখে তাকাল। দুই বছর হয়ে গেল বিয়ের, বাচ্চা হতে চলেছে তাদের। দুইজন একে অপরের সাথে থাকার কত শত শপথ করেছে,আদিব কতবার তাকে বুঝিয়েছে তার জীবনে কতোটা গুরুত্বপূর্ণ জাহানারা— তারপরেও মেয়েটা এখনো ঐ এক শব্দে আটকে আছে!মেয়েটা কি বোঝে না, সব কিছু মুখে বলতে হয় না, কিছু জিনিস বুঝে নিতে হয়?দুই দিকে মাথা নাড়ল সে। শব্দ করে শ্বাস ফেলল।
ঠিক তখনই কানে এল মায়ের গলা— বাবার উপর চটেছে মা।বুঝলো তার রাগ বাবার উপর ঝাড়ছে। জাহানারার প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই পড়ি মরি ছুটল সে।

জাহানারা মুচকি হাসল। তার গমনরত পথের দিকে চেয়ে হাত রাখল উঁচু পেটে। স্নেহভরে হাত বুলাল সেখানে। ধিমে স্বরে আওড়ালো,

“আমার আদিব…”

**সমাপ্ত।**

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে