Sunday, October 5, 2025







বাড়ি"ধারাবাহিক গল্প"সৌরকলঙ্কসৌরকলঙ্ক পর্ব-২৬+২৭+২৮

সৌরকলঙ্ক পর্ব-২৬+২৭+২৮

#সৌরকলঙ্ক
#উম্মে_প্রভা
#পর্ব_২৬

পরের দিন, খুলনা মেডিকেল থেকে সজীবের পাঠানো স্বাস্থ্যকর্মী এসে করোনা টেস্টের জন্য প্রয়োজনীয় নমুনা সংগ্রহ করল আদিবের থেকে। সরকারি ল্যাবগুলোতে সাধারণত সময় বেশি লাগলেও সজীবের উপস্থিতিতে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই রিপোর্ট হাতে এলো। রিপোর্ট দেখে সজীব নিশ্চিত হলো আদিবের করোনা হয়নি। জাহানারাকে কথাটা বলতেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সে। এই অসময়ে সজীবের সাহায্যের জন্য তাকে ধন্যবাদ দিতেই যাচ্ছিল জাহানারা, তার আগেই থমথমে গলায় সজীব বলে উঠলো,

—পাপ তো কম করিসনি, এবার ছেলেটার সেবা করে একটু সওয়াব কামা।

—এননোনমঙনোও…!

সজীবের কথার উত্তরে ভেঁচি কাটলো জাহানারা। এটা তার পুরনো অভ্যাস, এবং সজীব তার ভুক্তভোগী। সজীব রেগে উঠল তার কাণ্ডে। রাগান্বিত স্বরে তেতে উঠে বলল,

—সামনে থাকলে চড়িয়ে তোর দাঁত ফেলে দিতাম, বেয়াদব কোথাকার!

—সাহস থাকলে আইসে চড়িয়ে যা।

—মানুষ হবি না তুই? ডাইনি! এই দুলাভাইকে কি বলেছিলি তুই? মানুষটা এমনি অসুস্থ! তোর কথা শুনে দুই দিন বিছানায় ছিল সে।

বাবার অসুস্থতার কথা শুনে বুকের ভেতর ধক করে উঠলো জাহানারার। চোখ জ্বলতে লাগলো। কান্না গলায় দলা পাকিয়ে এলো। কথা জোগালো না আর। সজীব তার কথার জন্য অপেক্ষাও করলো না। সে নিজের মতো বলতে লাগলো,

—যা হয়েছে, হয়ে গেছে জান। সেসব পুরনো অতীত। কেন শুধু শুধু সেসব টেনে আজ, আগামী নষ্ট করছিস? এত বছর তো অতৃপ্ত আত্মার মতো ঘুরে বেড়াতিস এই বলে যে আদিব তোর ভালোবাসার মূল্য দিলো না, ওর জন্য তোর সাথে এই হলো, ঐ হলো। এখন তো ছেলেটা তোকে সুযোগ দিচ্ছে, এখন তাহলে বাড়াবাড়ি করছিস কেন? এখনো সময় আছে, ভালো হয়ে যা।

—তোর বন্ধুর কাছে তোর সাথে কুটনামি করা হয়ে গেছে! শোন ছোট মামা, তোর জ্ঞান তোর কাছে রাখ। আমার যা মনে চাই, আমি তাই করব।

—কর! যা ইচ্ছা কর। মর! আমার কি?

খট করে কল কাটলো সজীব। জাহানারা আদিবের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকালো। গত দুই রাত মাথা যন্ত্রণায় ঘুম হয়নি ছেলেটার। সজীবের পাঠানো ওষুধ দিয়েছিল, তাতেও কাজ হয়নি। পরে আদিব নিজে ওষুধের নাম লিখে দিয়েছিল জাহানারাকে। জাহানারা দারোয়ানকে দিয়ে সেটা আনিয়ে খাওয়ানোর পর ঘুমাতে পেরেছে সে।

সজীবের কাছ থেকে তার ও আদিবের মধ্যকার কথোপকথনের আভাস পেয়ে রাগ হলো জাহানারার। তার ধারণা ছিল, আদিব আর যাই হোক, তাদের ভেতরের স্বামী-স্ত্রীর কথা কাউকে বলবে না। তার ধারণা ভুল প্রমাণিত হওয়ায় মনে মনে ভীষণ কষ্ট পেল সে। যদিও কষ্ট পাওয়াটা নিরর্থক ছিল, কারণ আপাতদৃষ্টিতে জাহানারা থেকে সজীবের সাথে সম্পর্ক ভালো আদিবের। দেখা-সাক্ষাৎ না হলেও ফোনে নিয়ম করে কথা হয় তাদের। সেখানে জাহানারার সাথে নেই-নেই, আছে-আছে সম্পর্ক। সুতরাং আদিব তার বিষয়ে সজীবের কাছে বলতেই পারে; তাছাড়া সজীব তার আপন মামা। জায়েদ কিংবা আকিবের থেকে জাহানারা তাকে মান্য করে, তার ভাগ্নির কীর্তি আদিব তাকে বলবে—এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু জাহানারা এসব যুক্তি-তর্ক দেখলো না, সে মুখ ফুলিয়ে রইলো।

আদিবের ঘুম ভাঙলো দুপুর গড়িয়ে। জাহানারা তখনো তার সামনে বসা। জাহানারাকে নিজের সামনে গুম হয়ে বসে থাকতে দেখে আদিবের ভ্রূতে সূক্ষ্ম ভাজ পড়লো। অলস শরীর টেনে বিছানার হেডবোর্ডে হেলান দিয়ে বসে বলল,

—কি হয়েছে?

—আপনি ছোট মামার সাথে আমার নামে কুটনামি করেছেন কেন? ছিঃ ছিঃ! আমি আপনাকে এরকম ভাবিনি!

জাহানারার কথা শুনে কিঞ্চিৎ অপ্রস্তুত হলো আদিব। সেদিন সন্ধ্যায় রাগের মাথায় সজীবকে ফোন করে কথাগুলো বলেছিল সে। সজীব যে তার ভাগ্নির কানে সেসব পৌঁছে দেবে, এটা ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি। সে নিজের স্বপক্ষে ইতস্তত করে বলল,

—মোটেও কুটনামি করিনি আমি। শুধু সত্যি বলেছি। এখন সজীব সে কথা যদি বাড়িয়ে-চাড়িয়ে বলে, সেখানে আমার কি?

—আমাদের স্বামী-স্ত্রীর ভেতরের কথা আপনি উগলাতে গেলেন কেন মামার কাছে?

স্বামী-স্ত্রীর ভেতরের কথা! আদিব ভ্রু উঁচিয়ে তাকালো জাহানারার দিকে। ফিক করে হাসলো। জাহানারা যেন বুঝতে পারল না আদিবের হাসির মানে, সে তড়াক করে বলল,

—অমন শয়তানি হাসি দিবেন না। আপনাকে আমি স্বামীও মানি, আবার আমরা স্বামী-স্ত্রী—সেটাও মানি।

—শুধু সংসার মানো না? তাই তো?

জাহানারা কথা কেটে বলল আদিব। জাহানারা ভ্রূতে ছোট্ট ভাজ ফেলে অবাক কণ্ঠে বলল,

—কখন বললাম সংসার মানি না? আজব! শোনেন, আমি আপনাকে বলেছিলাম, আপনাকে শান্তিতে থাকতে দিতে চাই না—এর মানে এই নয় যে ঘর-সংসার মানবো না। হ্যাঁ, সেটা আলাদা ব্যাপার যে আমি ঘর-সংসার কিভাবে করতে হয়, আপাতত জানি না। তবে শিখে নেব। এর মানে এই নয় যে আমি আপনাকে স্বামী মানি না, আমাদের বিয়ে মানি না। একটা কথা ভালো করে শুনে রাখুন—আমাদের ভিতরে মারামারি, কাটাকাটি যা হয় হোক, কাউকে বলবেন না। এমনকি আপনার মাকেও না।

জাহানারা একদম ঠোট সেঁটে কথাগুলো বলে থামলো। আদিব একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তার দিকে। এই মেয়ে কখন কি বলে, কখন কি করে, কিছু বোধগম্য হয় না তার। এই তো দুই দিন আগের কথা, কার সাথে ফোনে কথা বলছিল আদিব—তাদের কথোপকথন স্পষ্ট শুনেছে—সে চিৎকার করে বলছিল, এই বিয়ে সে মানে না, আদিবকে স্বামী মানে না, এই বিয়েটা শুধু একটা প্রাঙ্ক, আদিবের কোনো যোগ্যতা নেই তার পাশে দাঁড়ানোর, ইত্যাদি ইত্যাদি। কথাগুলো শুনে আদিবের খারাপ লেগেছিল খুব। অজানা এক বিশ্রী অনুভূতি বিষাক্ত সাপের মতো জড়িয়ে ধরেছিল ভেতরটা। সেই মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, জাহানারার সাথে আর না। তার জীবনে এখনো অনেক কিছু করার বাকি। এই সম্পর্ক নিয়ে পড়ে থাকার সময় নেই তার। জাহানারা থেকে মুক্তি নিয়ে দ্রুত চলে যাবে সে লন্ডন। মনোযোগী হবে নিজের কাজে, নিজের সাধ্য-সাধনায়। সংসার জীবন আর পা রাখবে না। এই ভাবনা অনুযায়ী দুজন উকিলের সাথে কথা বলেছিল সে। তাদের মধ্যে একজন জানালো, আইনি কাজের জন্য তারপর মাত্রই বিয়ে হয়েছে, অন্তত তিন-চার মাস সময় লাগবে। আদিব তাকে কার্যক্রম আগে বাড়াতে বলল। সিদ্ধান্ত নিল, এর মধ্যে সে লন্ডন ফিরে যাবে; ডিভোর্সের দিন-তারিখ পড়লে তখন না হয় আবার আসবে। কিন্তু এর মধ্যে করোনা যে তাণ্ডব শুরু করলো! আদিবের ভেবে-চিন্তা রাখা প্ল্যানের বারোটা বাজালো।

—ওভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?

আদিবকে নিজের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলল জাহানারা। জাহানারার কথায় ভাবনায় ছেদ পড়লো আদিবের। সে একটা শ্বাস টেনে বলল,

—দুই দিন আগেও আমি তোমার যোগ্য না এ কথা বলে আমাকে নিয়ে উপহাস করছিলে, বিয়েটাকে প্রাঙ্ক বলছিলে, আরো কত কথাই না বলছিলে। আর এখন আরেক কথা বলছো। তুমি আসলে চাও কি, জাহানারা?

আদিবের প্রশ্নে ভড়কে গেল জাহানারা। আদিবের দিনের পর দিন তাকে এড়িয়ে যাওয়ায় রাগে-ক্ষোভে আদিবকে শুনানোর জন্য ফোনে কথা বলার মিথ্যা অভিনয় করছিল সেদিন সে। কথাগুলো বলার উদ্দেশ্য ছিল, আদিব যেন নিজে থেকে এসে কথা বলে, প্রতিবাদ করে, ঝগড়া করে। কিন্তু আদিবের নির্লিপ্ত ভাব তাকে আশাহত করেছিল। সেদিন রাগের মাথায় কি কি বলেছিল, আপাতত কিছু মনে পড়ছে না জাহানারার। আজকাল অনেক জিনিস মনে থাকে না। মাথায় লাগা আঘাতটা ভালোই ক্ষতি করেছে তার। মাঝে মাঝে দিপ্তীর ঐ কাজের মেয়েটার উপর ভীষণ রাগ হয় তার। “তোরা চুরি করে পালাবি পাল, চুরি-লুকাতে মা’র্ডার আর হাঁপ মা’র্ডার করতে গেলি কেন? ভালো হয়েছে, দুটোর যাবজ্জীবন জেল হয়েছে!”

—আপনি আড়ি পেতে আমার কথা শুনছিলেন?

নিজের অহেতুক ভাবনা পাশে রেখে চোখ সরু করে বলল জাহানারা।আদিবের মেজাজ খারাপ হলো এবার। রাগান্বিত কণ্ঠে সে বলে উঠলো,

—এতো বিরক্তিকর কেন তুমি? একটা সোজা কথার সোজা জবাব দেওয়া যায় না?

—এতো হাইপার হচ্ছেন কেন? কবে কি বলেছি, মনে নেই তো।

—ও প্লিজ, নাটক বন্ধ করো জাহানারা।

—সত্যি বলছি তো।

অসহায় মুখে বলল জাহানারা। জাহানারার সরল মুখটা দেখে আদিবের মন বলল, মেয়েটা সত্যি বলছে; কিন্তু মস্তিষ্ক বলল, এর ফাঁদে পা দিও না আদিব আহাসান। মস্তিষ্কের সাবধান বাণীতে টনক নড়লো আদিবের। সে শব্দ করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল,

—ফরগেট ইট। সজীব ফোন করেছে? রিপোর্ট কি এসেছে আমার?

—নেগেটিভ।

স্বস্তির শ্বাস ফেলল আদিব। অবশ্য সে কিছুটা আন্দাজ করেছিল, কিন্তু করোনা ভাইরাস তার যে আলাদা আলাদা রূপ দেখাচ্ছে, সে ক্ষেত্রে নিশ্চিত হতে পারেনি। তবে তার নিজের থেকে বেশি জাহানারাকে নিয়ে চিন্তা হচ্ছিল। একগুঁয়ে মেয়েটাকে শত ভয় দেখালেও তার কাছ ছাড়া করতে পারিনি। আদিবের তো ভয় হচ্ছিল, তার সেবা-যত্ন করতে গিয়ে মেয়েটা না আক্রান্ত হয়!

—আপনি ফ্রেশ হয়ে নিন, আমি খাবার দিচ্ছি।

—রান্না করেছো তুমি?

অবাক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো আদিব। জাহানারা মুখ লটকানো অবস্থাতেই বলল,

—না। ভাবি মহুয়াকে পাঠিয়েছে।ও করেছে।

—মহুয়া কে?

—আমাদের বাড়ির কাজের মেয়ে।

—ও।

উঠে দাঁড়ালো আদিব। ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়িয়ে আবার পিছনে ফিরলো। জাহানারার লটকানো মুখটা দেখে বলল,

—মুখ লটকে আছে কেন? কি হয়েছে?

—আপনি আমার কথা বিশ্বাস করলেন না। কেন?

—তুমি এ যাবৎ এত মিথ্যা কথা বলেছো যে, তোমার কথা বিশ্বাস করা আমার জন্য কষ্টসাধ্য। তোমার অবস্থা এখন সেই রাখাল আর বাঘের গল্পের রাখালের মতো। কেউ তোমাকে বিশ্বাস করবে না।

—আমাকে বাঘে খেয়ে ফেললে তখন?

—তোমার দোষে তোমাকে খাবে। এখানে আমরা কি করতে পারি!

—আমি মরে গেলে আপনি কাঁদবেন?

হুট করে কি ভেবে প্রশ্নটা করলো জাহানারা। তার খুব জানতে ইচ্ছা করলো, তার কিছু হলে আদিব কষ্ট পাবে কি না।আদিব তার প্রশ্নের উত্তরটা সাথে সাথেই দিল,

—না। হাঁপ ছেড়ে বাঁচবো।

—জানি তো, আবার বিয়ে করবেন। মনে মনে তো লাড্ডু ফুটছে আমার মরার কথা শুনে। আমি অত সহজে মরছি না, সোনা। সারাজীবন ঘাড়ের উপর বসে থাকবো। আরেকটা বিয়ের চিন্তা মাথা থেকে বাদ দেন।

ছ্যাঁৎ করে উঠলো জাহানারা। তারপর চোখ-মুখ কুঁচকে অদ্ভুত ভঙ্গিতে আদিবের দিকে কটমটে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ধুপধাপ পা ফেলে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। জাহানারা চলে যেতেই আদিবের ঠোঁটের কোণে দেখা দিল মুচকি হাসি। কিছুক্ষণ পূর্বে জাহানারার মরার কথা শুনে হৃৎপিণ্ডের ক্রিয়ায় যে সামান্য বিঘ্ন ঘটেছিল, সেটা পুনর্বহল হলো।

_________

জাহানারা নিচে এসে দেখলো মহুয়ার রান্না-বান্না সব শেষ। সে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। জায়েদদের বাড়িতেই থাকে সে। সালেহা বাবার বাড়ি থেকে মেয়েটাকে নিয়ে এসেছিল। সালেহার কেমন দূরসম্পর্কের চাচার মেয়ে মহুয়া। মা-বাবা মারা গেছে বছর তিনেক। চাচার থেকে এক নে’শাখোরের সাথে বিয়ে দিয়েছিল মেয়েটার। সে নে’শা’র ঘোরে রাস্তায় গাড়ি চাপা পড়েছে। স্বামী মারা যাওয়ার পর তার আর জায়গা হয়নি শ্বশুরের ভিটায়। বাধ্য হয়ে বাপের বাড়ি ফিরে এসেছে, কিন্তু সেখানেও গতি হয়নি। বাবা-মা মারা যাওয়ার পর চাচারা বাবার সহায়-সম্পত্তি শরীয়তের নামে জোর-জবরদস্তি দখল করেছে।

জাহানারার বড় মামা রাজীব মেয়েটার তোর দুরবস্থা দেখে বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিল, কিন্তু জাহানারার বড় মামির পছন্দ হয়নি সেটা। স্বামীর মুখের উপর কিছু না বললেও আড়ালে-আবডালে কথা শুনাতো সে মহুয়াকে। সালেহা সেই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হয় একবার। তার ভালো লাগেনি বিষয়টা, তাই ভাইয়ের সাথে কথা বলে মহুয়াকে নিজের সাথে বাড়ি নিয়ে আসে। সেই থেকে এখানে থাকে মহুয়া। কাজে পারদর্শী, স্বল্পভাষী মেয়েটাকে সালেহা জাহানারার থেকে কম চোখে দেখতো না। কিন্তু সালেহা মরার পর তার অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। তারিন এমনিতে ভালো হলেও শ্বাশুড়ির মতো অত মানবদরদী নয়। সে আর পাঁচটা কাজের লোকের মতো মহুয়াকে ট্রিট না করলে, সে যে একজন বাইরের মানুষ—সেই সূক্ষ্ম রেখাটা মেনে চলে। মহুয়া অবশ্য এসব নিয়ে মাথা ঘামায় না। এক যুবতী মেয়ে সে, এই বাড়িতে খাওয়া-পরার সাথে সুরক্ষা পাচ্ছে—এই তার কাছে ঢের।

—রান্না হয়ে গেছে?

ঢেকে রাখা পাতিলের ঢাকনা সরিয়ে জিজ্ঞেস করলো জাহানারা। মহুয়া থালাবাসন পরিষ্কার করছিল। সে সেগুলো করতে করতে স্পষ্ট কণ্ঠে উত্তর দিল,

—জ্বি।

জাহানারা তাকে বাসন মাজতে দেখে বলে উঠলো,

—ওগুলো করা লাগবে না আপনার। আপনি শুধু রান্না করে দিলেই হবে। আসলে ঐ ছেলেটা অসুস্থ, আর আমি রাঁধতে পারি না!

লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল জাহানারা। মহুয়া তার কথায় মৃদু হাসলো। বলল,

—সমস্যা নেই। আমি এগুলোও করে দেব। আপনার কষ্ট কম হবে।

—আপনার অসুবিধা হবে না?

—না। আমার অভ্যাস আছে।

—গ্রেট! তাহলে আপনি যতদিন আমাদের কাজের লোকগুলো ফিরে না আসে, আমাদের কাজ করে দিয়েন। আমি মাসে দশ হাজার করে দেবো, কেমন?

মাথা নাড়ালো মহুয়া। বুঝলো, জাহানারা তাকে তারিন হয়তো বাড়ির কাজের লোক হিসাবে পরিচয় দিয়েছে। সে আর নিজের পরিচয় দিল না। অবশ্য দিয়েও বা কি!

আজ প্রায় দুই দিন পর নিচে নেমলো আদিব। এই দুই দিন নিজের ঘরেই ছিল সে। চাচির এই অন্ত কুঁড়ে ,অলস মেয়েটা তার জন্য খাবার-দাবার উপরে নিয়ে যেতো। শুধু তাই নয়, নিজে হাতে খাইয়ে দিতো। ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি। যে মেয়ে এক গ্লাস পানি ঢেলে খেতে গড়িমসি করে, সে না কি তার সেবা-যত্ন করেছে— যাকে না কি সে ঘৃণা করে! ইন্টারেস্টিং!

জাহানারা আদিবের পাশের চেয়ারে এসে বসলো। তারপর আদিব সেদিন যেভাবে খাইয়ে দেওয়ার কথা জিজ্ঞেস করেছিল, ঠিক সেভাবেই বলল,

—হাত দিয়ে খেতে পারবেন? না খাইয়ে দেবো?

—নো থ্যাংকস, আমি পারবো। এমনিতে অনেক করেছেন।

কথাটা বলেই পাশ ফিরে তাকালো আদিব। চোখ পড়লো মহুয়ার দিকে। সাথে সাথে থমকালো সে। চোখ-মুখে খেলে গেল বিস্ময়। উঠে দাঁড়ালো বসা থেকে।

—মাহিরা!

বহুদিন পর বাবার দেওয়া ভালো নামটা শুনে চমকে তাকালো মহুয়া। আদিবকে দেখে অবাক হলো কিঞ্চিৎ। প্রায় এগারো বছর পর ছেলেটাকে দেখছে সে। চেহারা-ছবি সব পাল্টে গেছে ছেলেটার, তবে কণ্ঠস্বরটা আগের মতোই আছে।

—আদিব? আদিব আহাসান?

—হ্যাঁ। তুমি এখানে…?

মহুয়ার হাতে খাবারের পাত্র আর তার মলিন কাপড়-চোপড় আদিবকে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ফেলল, তবে তার বুদ্ধিদীপ্ত মস্তিষ্ক খুব বেশি সময় নিলো না ব্যাপারটা বুঝতে। এর মধ্যে জাহানারা ফোড়ন কাটলো,

—আপনারা চেনেন একে অপরকে?

—হুম।

ছোট করে উত্তর দিল আদিব, তারপর মহুয়ার উদ্দেশ্যে বলল,

—তোমার এই অবস্থা কেন? কি হয়েছে? আঙ্কেল কোথায়?

*********কলেজে একসাথে ছিলো আদিব আর মহুয়া। খুলনায় বাসা ভাড়া করে থাকতো সে। ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট। বাবার টাকা-পয়সারও কমতি ছিল না। আদিবের সাথে খুব গলায় গলায় ভাব না থাকলেও ভালো একটা সম্পর্ক ছিল। আরো একটা কারণ আছে, যার কারণে মেয়েটাকে আজো মনে আছে তার। সজীব পছন্দ করতো মেয়েটাকে। আদিবকে প্রায় বলতো, “মামি হয় তোর রেসপেক্ট দিয়ে কথা বলবি।”

বাবার নাম উঠতেই চোখে পানি ছলকে উঠলো মহুয়ার। কোনরকমে বলল,

—বাবা মারা গেছে, তিন বছর হলো।

আদিবের মুখটা চুপসে গেল কথাটা শুনে। দুই-একবার দেখা হয়েছে তার মহুয়ার বাবার সাথে। ভদ্রলোক সরকারি কলেজের প্রফেসর ছিলেন, অমায়িক আচার-ব্যবহার তার। মেয়ের পড়াশোনার খোঁজ নিতে প্রায় আসতো কলেজে, কোচিংয়ে তখন সজীবের সাথে আদিব থাকার দরুন দেখা হতো তার। অমায়িক হেসে ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করতেন, মাঝে মাঝে তাদের দুইজনকে পাশের হোটেলে নিয়ে গরম গরম ছানা জিলাপি খাওয়াতো। আদিবের এখনো স্পষ্ট মনে আছে সেসব। সজীবের কাছে শুনেছে, টাকা-পয়সার কমতি ছিল না তাদের। তাহলে আজ তার একমাত্র মেয়ের এ দশা কেন—সেটা ভাবালো আদিবকে। তার ভাবনার মাঝেই কথা বলল মহুয়া,

—বাবা-মা সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ার পর বড় চাচা জোর করে এক নেশাখোরের সাথে বিয়ে দেয় আমার। এক মাসের সংসারের মাথায় আমার স্বামী মারা যায়। বাড়ি ফিরে দেখি, চাচারা বাবার রেখে যাওয়া সম্পত্তি শরীয়তের বিধান দেখিয়ে আত্মসাৎ করেছে। আমি সন্তান হিসাবে যেটুকু পাবো, সেটুকুও না কি আমার বিয়েতে খরচ করে শেষ হয়েছে। আমার আর কিছু নেই বলে দাবি করেছে। আমার আর কিছুই নেই। কিছু না।

কথাগুলো বলতে গিয়ে ডুকরে উঠলো মহুয়া। আদিব তার দিকে তাকিয়ে জাহানারার দিকে তাকালো, চোখের ইশারায় তাকে সামলাতে বলল। কিন্তু জাহানারা তো জাহানারাই, সে এসব পারে না। বড়জোর মুখ দিয়ে দুটো মিষ্টি কথা বের করতে পারবে সে, কিন্তু কাউকে সান্ত্বনা দেওয়া, তার দুঃখে তাকে আগলে নেওয়া—এটা তার জন্য কষ্টকর। সে আদিবের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো, ঠোঁট উল্টে মাথা নাড়ালো—যার অর্থ, “কি করবে?” আদিব হতাশ শ্বাস ফেলল একটা, তারপর নিজেই বোঝানোর সুরে বলল,

—মহুয়া, শান্ত হও। বসো। পানি খাও একটু।

গ্লাসে পানি ঢেলে এগিয়ে দিল আদিব। মহুয়া বসলো। একটু খানি চুমুক দিয়ে পানি খেল। কিছুটা সময় নিয়ে নিজেকে সামলালো। একটু সামলে উঠতেই আদিব জিজ্ঞেস করলো,

—পড়াশোনা শেষ করোনি? তুমি তো ভালো স্টুডেন্ট ছিলে।

—মেডিকেলে পরপর দুবার দিয়েও তো হলো না। এরপর পাবলিকে ভর্তি হলাম। তৃতীয় সেমিস্টারের মাঝামাঝি পর্যায় এসে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লাম। যক্ষ্মা ধরা পড়লো। যক্ষ্মা সারিয়ে পড়াশোনার জন্য প্রস্তুতি নিতে নিতে সেমিস্টার গ্যাপ হলো। এরপর মাথায় কি চাপলো, পড়াশোনা আর হলো না।

একটা ভারী দীর্ঘশ্বাসের সাথে নিজের কথা শেষ করলো মহুয়া। তার এই স্বল্প জীবনের করুণ গল্পে ভারী হলো পরিবেশ। আদিব কিছু সময় চুপ থেকে মনের এক অদম্য কৌতূহলে নিজের সীমা অতিক্রম করে একটা প্রশ্ন করে বসলো,

—ইমরান ভাই…

আদিবের অসামাপ্ত বাক্যে ক্লিষ্ট চোখে তার দিকে তাকালো মহুয়া। তার চোখের দৃষ্টি আদিবকে বলে দিল, ভুল হয়েছে তার। মহুয়ার পুরনো ক্ষতে কৌতূহলী হয়ে আঘাত হেনেছে সে!

চলবে, ইনশাআল্লাহ।

#সৌরকলঙ্ক
#উম্মে_প্রভা
#পর্ব_২৭

সাহসের অভাবে আদিবকে সাথে নিয়েই মহুয়ার কাছে নিজের মনের কথা জানাতে গিয়েছিল সজীব। কিন্তু সেখানে পৌঁছে মহুয়াকে এক ছেলের সাথে কিছুটা ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখে থমকে গেল সে। মুহূর্তেই মন পাল্টালো।
মহুয়া প্রথমে অপ্রস্তুত হলেও দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে জানালো—ছেলেটি তার বাগদত্তা, নাম ইমরান। বড় খালার ছেলে। ঘরোয়া পরিবেশে তাদের আংটি বদল হয়েছে, তাই এখনো সবার কাছে জানানো হয়নি।

মহুয়া আদিব আর সজীবকে ইমরানের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পর সেদিন অনেকটা সময় বসেছিল তারা। একে অপরের সামনে বেশ গল্প-আলাপ হয়েছিল তিনজনের ভেতরে। আদিব অবশ্য সজীবকে নিয়ে চিন্তিত ছিল। কিন্তু ছেলেটা তার চিন্তা হওয়া উড়িয়ে দিয়ে নিজেকে যথেষ্ট স্বাভাবিক রেখেছিল। যে কোনো পরিস্থিতিতে নিজেকে স্বাভাবিক রাখা—এটা অবশ্য সজীবের মহৎ গুণ। আদিব সেটা বুঝতে পেরেই কোচিংয়ের দোহাই দিয়ে সজীবকে নিয়ে উঠে এসেছিল। ওদের সামনে থেকে আসার পর আদিব দেখেছিল সজীবের সেই ভগ্ন রূপ। আভাস পেয়েছিল, প্রথম ভালোবাসার ব্যর্থতা মানুষকে কতোটা পীড়িত করে। সেদিন মনে মনে ভেবে নিয়েছিল, ভালোবাসা নামক এই জঞ্জালে সে কখনো জড়াবে না। কখনো না।

—আমার যক্ষ্মা ধরা পড়ার পর খালা সম্পর্ক ভেঙে দিল। ইমরানও চুপচাপ মেনে নিল।

নিরাসক্ত ভঙ্গিতে বলল মহুয়া। আদিবের ভাবনায় ছেদ পড়লো। মহুয়ার কথা কিঞ্চিৎ অবাক হলো সে। ইমরানের সাথে দুই-একবার যা দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছে, আদিবের কখনো মনে হয়নি ছেলেটা এমন মেরুদণ্ডহীন।

—ব্লাডি মামার বয়!

বিড়বিড় করে বলল জাহানারা। মহুয়া কথাটা না শুনলেও আদিবের কানে গেল সেটা। আড়চোখে তাকালো সে জাহানারার দিকে। মুখ থমথমে তার। মনে হচ্ছে, ইমরান মহুয়ার সাথে না, তার সাথেই প্রতারণা করেছে। আদিবের দৃষ্টি অনুভব করে তার দিকে তাকালো জাহানারা। সঙ্গে সঙ্গে নজর ঘুরালো আদিব। মহুয়ার দিকে দৃষ্টি ফেরালো। মহুয়া চোখের পানি মুছে বলল,

—আমার কথা বাদ দাও, তোমার কি খবর? শুনেছিলাম বিদেশে গিয়েছ? কবে ফিরলে?

—অনেক দিন হলো, প্রায় চার-পাঁচ মাস।

—দেশে থেকে যাবে না আবার ফিরবে?

মহুয়ার প্রশ্নে ম্লান হাসলো আদিব। চোখে ক্লান্তি ঝিলিক দিলো তার। চেয়ার টেনে বসলো সে। মহুয়াকেও বসতে বলল। মহুয়া বসলো। আদিব একটু সময় নিয়ে বলল,

—এতো দিনে ফিরে যেতাম, কিন্তু একটু ঝামেলায় পড়লাম। এরপর যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলামই, কি করোনা প্রকোপে আটকে গেলাম। দেখি সামনে পরিস্থিতি কী হয়। তবে ফিরতে হবে।

একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল আদিব। আদিবের ফিরে যাওয়ার কথা শুনে জাহানারা বুকের ভেতরটা কেমন হুহু করে উঠলো। কিন্তু পরক্ষণেই আদিবের বলা “ঝামেলা” শব্দটা মনে হতেই বিরহের সুর যেন অপমানের গান গাইলো। মুখ জুড়ে অন্ধকার নামলো তার। ঝামেলা বলতে আদিব যে জাহানারাকে বুঝিয়েছে—এটা যেন দৈববাণী হলো তার কানে। চোয়াল শক্ত হলো তার।

আদিবের অবশ্য সেদিকে খেয়াল নেই, সে মহুয়ার সাথে কথায় ব্যস্ত। মহুয়া কোথায়, কীভাবে আছে, সেটা আগ্রহভরে শুনছে। জাহানারা নামক মেয়েটা যে এখানে উপস্থিত, সেটা ভুলে বসেছ। একের পর এক প্রশ্ন করছে সে মহুয়াকে। মহুয়াও খুশি মনে তার উত্তর দিচ্ছে। জাহানারা যেন অদৃশ্য তাদের কাছে। নিজের এমন অবহেলা গায়ে লাগলো জাহানারার। রাগ হলো আদিবের ওপর।

মনে মনে প্রশ্ন জাগলো—মহুয়া অসহায়, কিন্তু তাই বলে তার বিষয়ে এতো আগ্রহ কেন দেখাতে হবে? দিন-দুনিয়া ভুলে এতো কথা বলতে হবে কেন? কৈ, সে তো এতদিন ধরে ছেলেটার সাথে আছে, কখনো তো তার বিষয়ে এতো কৌতূহল দেখায় না! অথচ কারো কোনো সহপাঠীকে নিয়ে কৌতূহলের অন্ত নেই! এই ছেলে না কি কারো সাথে কথা বলে না, কারো বিষয়ে কৌতূহল দেখায় না—তাহলে মহুয়ার ব্যাপারে এতো মনোযোগী হচ্ছে কেন?

সন্দেহের ছায়ায় প্রশ্নগুলো মনের গভীরে উঁকি দিতেই মহুয়ার ওপর থেকে নিচে পর্যন্ত ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলো জাহানারা। মলিন কাপড়েও মেয়েটার সৌন্দর্য ভাটা পড়েনি। চোখ-মুখে এক আলাদা মায়া, আর সবচেয়ে আকর্ষণীয়—কোমর ছাড়ানো লম্বা বেণী, যা তার সৌন্দর্য আরো দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।

মহুয়ার লম্বা বেণী দেখে বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো জাহানারার। জ্বলে উঠলো ভেতরটা। ঈর্ষান্বিত হলো মন। হাত চলে গেল ঘাড়ে। অপারেশনের পর চার মাস অতিক্রম হয়েছে, কিন্তু তার চুল মাত্র মাথার ত্বক ঢেকে ঘাড় ছুঁয়েছে। এই চুল লম্বা হয়ে আগের মতো হাঁটু ছাড়াতে কত সময় লাগবে, আল্লাহই জানেন। মনে মনে দিপ্তীর কাজের মেয়ে রেণু আর তার প্রমিকের উদ্দেশ্যে মোটা মোটা দুটো গালি দিল জাহানারা। তবু যেন ভেতরের আগুন নিভলো না।

এটা অবশ্য নতুন নয়। আদিবের আশেপাশে কাউকে দেখলেই অকারণে এমন ঈর্ষান্বিত হয় জাহানারা। চুলের শোক, আদিবের মহুয়ার প্রতি মনোযোগ—ঠিক কী কারণে জাহানারার মেজাজ টঙে উঠলো, কে জানে! সে তাদের কথার ছন্দে বাধা দিতে কাঠখোট্টা গলায় আদিবের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,

—খাবেন না, না কি কথা বলেই পেট ভরবেন?

কথাটা বলেই ঠপ করে চেয়ারে বসলো জাহানারা। আদিব তার বাজখাই গলায় চমকে উঠলো। মহুয়াও কিছুটা অপ্রস্তুত হলো। জাহানারা তাদের সেই পরিবর্তিত অভিব্যক্তি দেখার প্রয়োজন বোধ করলো না। সে নিজের প্লেট টেনে খাবার নিতে লাগলো। খাবারের বাটিতে চামচের আঘাতের অস্বাভাবিক শব্দ যেন তার রুষ্টতা প্রকাশ করলো।

জাহানারা হঠাৎ এমন আচরণে আদিব অবাক হলো। এই তো ঠিক ছিল, মেয়েটা হঠাৎ আবার কী হলো? ভ্রূতে গাঢ় ভাঁজ পড়লো। তবে মহুয়ার কাচুমাচু মুখ দেখে তার সামনে পরিস্থিতি সামলাতে জোরপূর্বক হেসে বলল,

—হ্যাঁ, খেতে হবে। ভীষণ ক্ষিদে পেয়েছে। মহুয়া, বসো আমাদের সাথে। একসাথে লাঞ্চ করি।

—আমি খেয়েছি, তোমরা খাও।

মিথ্যা বলল মহুয়া। জাহানারার ঠেস দেওয়া কথা আর থমথমে মুখ তাকে চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে, তার সাথে আদিবের সহজ আলাপ পছন্দ হয়নি তার। এবং জাহানারার চোখে-মুখে স্পষ্ট—সে তাদের দুইজনের মধ্যে তৃতীয় জনের উপস্থিতি মানতে নারাজ। সুতরাং তার প্রস্থান করা উচিত। সে ঠোঁটের কোণে হাসি টেনে ইতস্তত করে বলল,

—তুলি আমাকে ছাড়া কিছু বোঝে না। আমার দেরি হলে তারিন মামিকে বিরক্ত করবে। আমি আসি। তোমরা খাও।

কথাটা বলে অনেকটা তড়িঘড়ি করে সদর দরজার দিকে পা বাড়ালো মহুয়া। আদিব পিছু ডাকতে গিয়েও জাহানারার অন্ধকার মুখ দেখে থেমে গেল। মহুয়া চলে যেতেই মুখ খুললো আদিব।

—থেকে থেকে মাথায় কী ভূত চাপে তোমার? এতো উইয়ার্ড কেন তুমি?

—আপনি না কি অপরিচিত মানুষের সাথে কথা বলেন না?

কটাক্ষপূর্ণ সুর জাহানারার।

—আশ্চর্য! এখানে আমি কথা বলি না বলি, সে প্রসঙ্গ আসছে কোথা থেকে?

কণ্ঠে বিরক্তি আদিবের। জাহানারার এই ক্ষণে রূপ বদলানো বিষয়টা অসহ্য লাগছে তার। আদিবের বিরক্তির আঁচ পেয়ে জাহানারা দাঁতে দাঁত পিষলো। স্থির চোখে তাকিয়ে আদিবের অভিব্যক্তি পর্যবেক্ষণ করলো, তারপর হুট করে বলল,

—আপনি এই মেয়েকে পছন্দ করতেন?

চোখ লাল হয়ে উঠেছে জাহানারার। খুব খারাপ লাগছে তার। এতো বছর পর আজ প্রথম কেন জানি মনে হচ্ছে, আদিবের জীবনে হয়তো কেউ ছিল, যার কারণে তাকে বারবার প্রত্যাখ্যান করেছে ছেলেটা। সেই সাথে এটাও মনে হচ্ছে—সেই মেয়েটা মহুয়া নয় তো?

আদিবের এতো দিনের প্রত্যাখ্যানও তাকে এতো পীড়া দেয়নি, যেটা এটা ভেবে পাচ্ছে যে আদিবের জীবনে অন্য কেউ ছিল, যার জন্য সে তার দিকে ফিরে তাকায়নি। চোখ ভিজে উঠলো জাহানারার। জাহানারার অশ্রুসজল জ্বলজ্বলে চোখ দেখে ভড়কে গেল আদিব। উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

—কী হয়েছে তোমার? এমন করছো কেন?

—আপনি এই মেয়েকে ভালোবাসতেন?

—তুমি কি পাগল হয়েছো? কীসব বলছো? কীসের মধ্যে কী ঢুকাচ্ছো? ও জাস্ট পরিচিত আমার।

রাগান্বিত কণ্ঠ আদিবের। জাহানারার এমন উদ্ভট কথা শুনে মেজাজ খারাপ হচ্ছে তার। জাহানারার যেন হুঁশ ফিরলো আদিবের গর্জনে। সঙ্গে সাথে নিজেকে সামলালো সে। একটা ঢোক গিলে, “সরি” বলে উঠে গেল খাওয়া ছেড়ে। আদিব তার গমনরত পথের দিকে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো। “এই গরম, তো এই নরম! মেয়েটা আসলে চায় কী?” ফোঁস করে একটা তপ্ত শ্বাস ফেলল।

জাহানারার পিছু নিতে গিয়েও থামলো। নিজেকে কড়া গলায় বোঝালো, *”এই মেয়ের প্রতি অত আহ্লাদ দেখানোর দরকার নেই।”*
অবশেষে নিজের খাবারে মন দিল। পেটে ক্ষিদে তার। দুই দিন ঠিকভাবে খেতে পারিনি। ঐ তার ছেঁড়া মেয়েটা ট্রে ভর্তি খাবার নিয়ে তার ঘরে হাজির হলেও মুখে কিছু তুলতে পারিনি সে। মুখের সামনে ভাতের লোকমা তুলেও হাত থেমে গেল আদিবের। সামনে আধখাওয়া প্লেটটার দিকে তাকালো। খাবারের প্লেটে খাবার সব ঠিকই আছে, শুধু খাবার মাখিয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গেছে মেয়েটা। দুই দিকে মাথা নাড়লো, হতাশ শ্বাস ফেলল। ভাতের প্লেট হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো, পা বাড়ালো নিজের ঘরের দিকে।

ঘরের দরজায় এসে দাঁড়াতেই থমকালো আদিব। জাহানারা হাপুস নয়নে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। তাকে লক্ষ্য করে তড়িঘড়ি চোখ মুছলো সে। কান্না লুকাতে রাগ দেখিয়ে বলল,

—ঘরে ঢোকার সময় নক করতে পারেন না? বেয়াদব!

—ঘরের দরজা খোলা ছিল।

ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে স্বাভাবিক স্বরে বলল আদিব। জাহানারা তার কথার জবাবে কী বলবে ভেবে পেল না। সে আমতা-আমতা করে কিছু বলতে যাচ্ছিল, তার আগে আদিব কথা কেটে বলল,

—খুব ক্ষিদে পেয়েছে আমার। ঢং বাদ দিয়ে চুপচাপ এসে খেয়ে নাও।

গত দুই দিন আদিব ঠিকঠাকভাবে কিছু মুখে তোলেনি—এটা অজানা নয় জাহানারার। আদিবের কথা শুনে সে আর টু শব্দ করলো না। এসে বসলো তার সামনে। আদিবও আর কথা বাড়ালো না, খাবারের প্লেটে মন দিল।

খাওয়া শেষে প্লেট রেখে হাত ধুয়ে এসে জাহানারা সামনে বসলো আদিবের। এরপর কোনো ভণিতা ছাড়াই জিজ্ঞেস করলো,

—সমস্যা কী তোমার?

—আমার কোনো সমস্যা নেই।

ঘাড় গুঁজে মিনমিনিয়ে বলল জাহানারা।

—তাহলে তখন ওভাবে কাঁদছিলে কেন?

—ইচ্ছা হয়েছিল, তাই কাঁদছিলাম।

—আর ওসব প্রশ্নের মানে?

—মনে হলো, তাই।

—কী মনে হলো?

—এতো প্রশ্ন করছেন কেন?

অধৈর্য হয়ে উঠলো জাহানারা। তার ভালো লাগছে না এসব। বুকের ভেতর জ্বলছে। পুরোনো কোনো ব্যথা আয়োজন করে মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে।

আদিব তার কথার গুরুত্ব দিল না। সে আগের থেকে আরো গম্ভীর হলো। শীতল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

—কী মনে হলো, জাহানারা?

—মনে হলো, আপনি ঐ মেয়েটাকে পছন্দ করতেন, হয়তো ভালোবাসতেনও। সেই জন্য আমাকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।

মনের কথা মুখ পর্যন্ত এসেই থামলো জাহানারার। নিজের ওপর এই মুহূর্তে রাগ হলো তার। কেন যে মনের ভাব বেশিক্ষণ মনে চেপে রাখতে পারে না, এটা ভেবে আক্ষেপ হলো খুব।

—আর এটা মনে হলো কেন? আমি মহুয়ার সাথে দুটো কথা বলেছি, তাই?

—দুটো কথা না, একটু বেশিই কথা বলছিলেন। শুধু তাই নয়, কথা বলার সময় মুখ দিয়ে মধু ঝরছিল আপনার।

ছ্যাঁৎ করে উঠলো জাহানারা। আদিব তার দিকে নিঃশব্দে তাকালো, সেভাবেই বলল,

—আমি সবার সাথেই এভাবেই কথা বলি। বলতে পারো, এর থেকে বেশি মধু ঝরিয়ে কথা বলি।

—কৈ, আমার সাথে তো বলেন না?

—তুমি আর বাকি সবাই তো এক না।

—কেন? আমি কি ক্ষতি করেছি আপ—

গলা কেঁপে উঠলো জাহানারার। নিজের কথা থামাতে হলো। চোখের পানি নিয়ন্ত্রণ করার যথাসাধ্য চেষ্টা করলো সে। কিন্তু অবাধ্য অশ্রুরা তার শাসন অমান্য করে মসৃণ গাল বেয়ে গড়িয়েই পড়লো। ভেতরটা রাগ, ক্ষোভ, হিংসা, বিরক্তি মিলিয়ে এক অদ্ভুত অনুভূতির জানান দিল। বুঝলো, সে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে। ঠোঁটে ঠোঁট চাপলো সে।

জাহানারা জোর করে নিজেকে আটকে রাখার ব্যর্থ চেষ্টা দেখে শব্দ করে ঠোঁটের কোণে ফিসফিসিয়ে হাসি দেখা দিল আদিবের। বলল,

—তুমি আমার সাথে কথা বলতে আসলে বি’ষ উগলাও, আমি তোমার বি’ষের বদলে মধু ঝরাই কী করে?

—সরেন তো যান এখান থেকে!

আদিবের কথায় তেতে উঠে বলল জাহানারা। আদিবকে এই মুহূর্তে নিজের সামনে থেকে সরাতে চাইলো। কিন্তু আদিব নড়লো না। সে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলো জাহানারার দিকে। আদিবের দৃষ্টির সামনে আড়ষ্ট হলো জাহানারা। ভয় হতে লাগলো। মনের অনুভূতির আলোড়ন টের পেয়ে নিজের অনুভূতি আড়ালে রাখতে রাগ দেখিয়ে বলল,

—কী হলো? যান এখান থেকে। বের হন।

গলার জোরের সাথে চোখের পানির জোরও বাড়লো। জাহানারার নিয়ন্ত্রিত সত্তা অনিয়ন্ত্রিত হলো।

—তুমি কি জেলাস, জাহানারা?

নিজের কাছে নিজের জয়-পরাজয়ের এই দুর্বল মুহূর্তে আদিবের কথাটা যেন কানে ঝংকার তুললো তার। তড়াক করে মেজাজ চড়লো। গনগনে আগুন চোখে তাকালো সে আদিবের দিকে।

সে জ্বলছে—তাও আবার ঐ মেয়ের জন্য! এই ছেলে কি ভুলে গেছে, সে নায়িকা জাহানারা আহসান, লাখো ভক্ত তার, হাজার ছেলের স্বপ্ন সে। কতো মেয়ের আকাঙ্ক্ষা তার মতো জীবনের। আত্মঅহংকারী মন ফেটে পড়লো আত্মগরিমায়। কিন্তু পরক্ষণেই মহুয়ার মৃত সাপের মতো পড়ে থাকা বেণীটা চোখের সামনে ভেসে উঠতেই মনে পড়লো—সৌন্দর্যে খুত পড়েছে তার। কথাটা ভাবতেই মিইয়ে গেল সে। কাঁচের মতো নয় ভেঙে গেল দম্ভ। আগুন চোখে দেখা দিল স্বচ্ছ পানি। কান্না এসে দলা পাকালো গলায়। হীনমন্যতার মতো বাজে অনুভূতি ঘিরে ধরলো তাকে। কিছু না ভেবেই একরাশ সংশয় নিয়ে সে আদিবকে জিজ্ঞেস করলো,

—আমাকে কি এখন খুব বাজে দেখা যায়, আদিব ভাই?

কথাটা বলতে বলতে ঘাড়ে হাত দিল জাহানারা। জাহানারার কথায় তার দিকে ভালোভাবে তাকালো আদিব। জাহানারা সুন্দর। তাকে আহামরি সুন্দরী বললে ভুল হবে না। একদৃষ্টিতে চোখ আটকে যাওয়ার মতো রূপ তার। সামান্য চুলের জন্য সেই শ্রীতে ব্যাঘাত ঘটেনি। অন্তত আদিবের কাছে তেমনটাই মনে হলো। কিন্তু জাহানারার সংশয়ী গলা আর ভীতু চোখদুটো দেখে সত্যিটা বলতে ইচ্ছে করলো না তার। তাছাড়া মেয়েটা অনেক জ্বালিয়েছে তাকে—সে তো একটু মজা নিতেই পারে। এমন মনোভাব নিয়ে মনের কথা মনে রেখেই বলল,

—সে তো তুমি বরাবরই বাজে দেখতে, এ আর নতুন কী!

এমনিতে ছেলেদের মতো এই ছোট ছোট চুল নিয়ে দুঃখের শেষ ছিল না জাহানারার। তার ওপর আদিবের মহুয়ার প্রতি কৌতূহল একযোগে মনে হাজার সুইয়ের খোঁচা দিচ্ছিল। সবকিছু মিলিয়ে কোনো রকমে সামলে রেখেছিল সে নিজেকে। বহু কষ্টে এক মুঠো আত্মবিশ্বাস জিইয়ে রেখেছিল সে। আদিবের রসিকতায় তার সেই জিইয়ে রাখা আত্মবিশ্বাসটুকুও তাসের ঘরের মতো হুড়মুড়িয়ে পড়লো। চোখের পানি বাঁধ ভেঙে ফেললো। ফুঁপিয়ে উঠলো সে।

জাহানারার কান্ডে ভড়কালো আদিব। সে ভাবেনি, তার ঠাট্টার ছলে বলা কথা জাহানারা সিরিয়াসলি নেবে। সে তড়িঘড়ি করে বলল,

—আরে, আমি ইয়ার্কি করছিলাম, জাহানারা। ইয়ার্কি করছিলাম। তুমি অনেক সুন্দর। অনেক সুন্দর। প্লিজ থামো…

আদিব জাহানারাকে চুপ করাতে তাকে বোঝাতে যা মুখে আসলো বলে গেল। কিন্তু কে শোনে কার কথা? তার কষ্টরা বাঁধ ভেঙেছে আজ। সারা জীবন এই একটা জিনিসের ভরসায় তো টিকে ছিল সে। যেই রূপের ভরসায় এতো হম্বিতম্বি, সেটাই না কি কোনো কালে ছিল না? এটা মেনে নেওয়া যায়!

এই জন্য হয়তো বলে, কাছের মানুষের একটা কথা দূরের মানুষের হাজারটা কথার সমান। না হলে, যার সৌন্দর্যে হাজার মানুষ প্রতিনিয়ত মুগ্ধ হয়, সে সামান্য রসিকতায় কাতর হয়! নিজস্ব চিন্তাভাবনা সব বাদ দিয়ে আদিবের বলা ঐ এক কথার জেরে প্রায় আধাঘণ্টা ধরে কাঁদলো জাহানারা। আদিব যখন কোনো কথাতেই তাকে থামাতে পারলো না, তখন বাধ্য হয়ে হাল ছাড়লো।

সময় অতিবাহিত হলো। জাহানারা কান্নার বেগ ধীর হলো। থামলো সে।কিছু একটা ভাবলো তারপর কান্না ভেজা কণ্ঠে সরল মনে প্রশ্ন করলো,

—আপনি তখন আমাকে সুন্দর বললেন—এটা মন থেকে বলেছেন, না আমাকে চুপ করাতে মিথ্যা মিথ্যা বলেছেন?

জাহানারার কথার ধরন শুনে হেসে ফেলল আদিব। দাঁত বের হলো তার সেই হাসিতে। আদিবের সেই হাসিতে মুগ্ধ হলো জাহানারা।অনেক দিন পর বিনা ভয়-ডরে মন বলল,”এই হাসির জন্য হলেও এই ছেলেকে তোমার আবার ভালোবাসা উচিত, জাহানারা।” নিজের মনের চাটুকারিতায় নিজেই হতবাক হলো জাহানারা। বুঝলো, এই ছেলেকে ভালোবাসার জন্য র’ক্তপিণ্ডের দলাটা আবার অযুহাত খুঁজছে। সঙ্গে সঙ্গে শাসালো নিজেকে। জোরপূর্বক কঠোরতা এনে বলল, “একদম না!”

তার কড়া গলায় মনের গদগদ ভাব মিইয়ে গেলেও দমলো না।ঠিক তখন জাহানারার মন-মস্তিষ্কের সংঘর্ষের মধ্যেই আদিব টোকা দিল তার নাকে। মুখভরা হাসি নিয়ে বলল,

—পাগল একটা! আজ পর্যন্ত আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দর মেয়ে তুমি।

ব্যাস! জাহানারার মন-মস্তিষ্কের টানাপোড়েনে এগিয়ে গেল তার মন।আদিবের আদুরে ছোঁয়া আর সহজ স্বীকারোক্তি তাকে মুড়িয়ে রাখা শক্ত খোলসটা ভেঙে ফেলল নিমিষে। মাথা চাড়া দিলো পুরোদমে। এতদিন ছলে-বলে আদিবের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশের যে সুযোগ খুঁজছিল, সেটা পেয়ে ডগমগিয়ে উঠলো।

চলবে, ইনশাআল্লাহ।

#সৌরকলঙ্ক
#উম্মে_প্রভা
#পর্ব_২৮

জাহানারার পরিবর্তিত মুখভঙ্গি দেখে হুশ ফিরলো আদিবের।বুঝলো,মুখ ফসকে মনের কথা বলে ফেলেছে। এই মুহূর্তে পরিস্থিতি সামাল দিতে অযথা গলা ঝাড়া দিল সে। কোনোমতে বলল,

– মা ফোন দিয়েছিল। বলছিল, জরুরি কথা আছে।

ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল আদিব। আদিব চলে যেতেই একটা শুকনো ঢোক গিলল জাহানারা। গলা-বুক অকারণে শুকিয়ে আসছে তার। একগুঁয়ে মন জেদ ধরে বসে আছে তার কথা না শোনার। তবে জাহানারাও বদ্ধপরিকর—সে এত সহজে হাল ছাড়বে না। এই ছেলেটাকে বারবার ভালোবেসে সে নিঃস্ব হতে পারবে না। কিছুতেই না।

সেদিন রাতে কোনোরকমে দুই মুঠো খেয়ে গেস্টরুমে ঢুকলো জাহানারা। আদিব পিছু ডেকে ও ঘরে কেন যাচ্ছে সে কথা জিজ্ঞেস করায় থমথমে গলায় জানাল, “সে একটু একা থাকতে চাই।”তার কথায় আদিবের কপালে গাঢ় ভাঁজ পড়লো। বুঝতে পারলো না, হঠাৎ কি হলো জাহানারার। তার এই আকস্মিক পরিবর্তন ভাবালো আদিবকে।তবে কিছু বললো না সে।

জাহানারার ঘুম হলো না সে রাতে। অনেক যুক্তি-তর্ক, অনেক বোঝাপড়া হলো তার নিজের সাথে।কিন্তু পরিশেষে “আদিব তার স্বামী” এই এক বাক্যে ব্যর্থ হলো তার সকল চেষ্টা-প্রচেষ্টা— ভেতরর স্বত্বা স্পষ্ট কণ্ঠে ঘোষণা দিল, “তাকে ভালোবাসায় কোনো অন্যায় নেই। ভালোবাসতেই পারে সে তাকে, এত এত ভাবা-ভাবির কি আছে!”

মনের উপর কোনো কালেই জোর খাটেনি জাহানারার। এবারো খাটলো না। হার মানলো। কাকডাকা ভোরে খুব গোপনে স্বীকার করলো, আদিবকে ভালোবাসে সে। নিজের মনে ছেলেটাকে ভালোবাসার স্বীকারোক্তি দিলেও তার মনের ভাব চেপে গেল আদিবের থেকে। এতদিন অভিনয় জগতে যতটা অভিনয় শিল্প রপ্ত করেছিল, তার সবটুকু ঢেলে দিল তার ভালোবাসা লুকাতে। আদিব যেন তার মনের কথা জানতে না পারে, তার জন্য নিজেদের মাঝে টানলো দূরত্ব।

অন্যদিকে, জাহানারার হঠাৎ এমন পরিবর্তনে চিন্তিত হলো আদিব। মনে মনে খুঁজতে লাগলো জাহানারার এমন আচরণের কারণ। মনে হলো, মহুয়ার আসা-যাওয়া, তার সাথে আদিবের কথাবার্তা হয়তো পছন্দ হচ্ছে না জাহানারর , তাই এমন করছে মেয়েটা। অজ্ঞাত তারিনকে ফোন করলো সে। করোনা ভাইরাসের তীব্র প্রকোপের কথা বলে মহুয়ার এ বাড়ি আসা বন্ধ করলো। কিন্তু তাতেও ভাবান্তর হলো না জাহানারার। দিন যেতে লাগলো, সময় অতিবাহিত হলো। আদিবের ভাবনা আস্তে আস্তে রাগে পরিণত হলো।নিজের প্রতি জাহানারার এমন অবহেলা সহ্য হলো না তার। সিদ্ধান্ত নিল জাহানারা যতদিন নিজে থেকে এগিয়ে না আসছে ততদিন সেও তার কাছে পিঠে ঘেঁষবে না।নিজের নিজের অনুভূতি বজায় রেখে একে অন্যের থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলতে লাগলো দুইজন।

এরপর একদিন রাতের কথা। ডাক্তার স্টিফেনের সাথে একটা জরুরি কেস নিয়ে আলোচনা করতে করতে রাত গড়িয়ে বারোটা বাজলো।কথা শেষ করে ফোন রেখে নিচে নামলো আদিব। ফ্রিজ খুলে খাবার বের করতেই দেখলো, দুপুরে খাওয়ার পর খাবার যেমন রেখেছিল, তেমনি আছে।অর্থাৎ, জাহানারা রাতে খায়নি। আজকাল তার সাথে খায় না জাহানারা, নিজের মতো আগে ভাগে খেয়ে নেয়।প্রথম প্রথম আদিবের ব্যাপরটা একটু খারাপ লাগলেও জাহানারার দিকটা ভেবে তেমন মাথা ঘামায় নি।ভেবেছে মেয়েটা হয়তো ক্ষিদে সহ্য করতে পারে না তাই তার জন্য অপেক্ষা করে না। কিন্তু আজ রাতে না খেয়ে ঘুমিয়েছে এটা ভেবে মেজাজ খারাপ হলো আদিবের।এতোদিনের গিলে নেওয়া রাগ ঠেলে বাইরে আসতে লাগলো।
খাবারদাবার সব আবার ফ্রিজে রেখে পা বাড়ালো সে জাহানারার ঘরের দিকে,“অনেক হয়েছে। আর না। মেয়েটার সমস্যা কি? এমন অদ্ভুত আচরণ করছে কেন? আজ তাকে জানতেই হবে।”
কথাগুলো ভাবতে ভাবতে জাহানারার ঘরের দরজায় থামলো আদিব।দরজার কপাট খোলা ছিল। আদিব হাত দিতেই পুরনো কব্জায় অদ্ভুত শব্দ তুলে খুলে গেল সেটা। দরজা খুলতেই আদিবের চোখে পড়লো অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘরে জড়োসড়ো হয়ে বিছানায় পড়ে থাকা জাহানারার দিকে। সাথে সাথে বুকের ভেতরটা ধড়ফড় করে উঠলো। যে রাগ-ক্ষোভ নিয়ে কৈফিয়ত জারি করতে এসেছিল, সেগুলো ভুলে গেলো নিমিষে। ব্যস্ত পায়ে এগিয়ে গেল ভেতরে।

জাহানারার পাশে ঝুঁকে হাত রাখলো কপালে। যেটা ভেবেছিল, তাই। জ্বর এসেছে মেয়েটার। জ্বরের তাপে গায়ে হাত রাখা যাচ্ছে না। ঘরের লাইট জ্বালালো আদিব। জাহানারা তখনো বেহুঁশের মতো পড়ে। আদিব পানি নিয়ে আসলো বালতি ভরে। পানি দিলো জাহানারার মাথায়। হাত-পা মুছিয়ে দিলো ভিজে গামছা দিয়ে। কাজটা করতে গিয়ে একটা অস্বস্তি বোধ তার আপদমস্তক ঘিরে ধরলেও জাহানারার অসুস্থতার কথা ভেবে গলধঃকরণ করলো সেটা।

এক ফাকে জাহানারা নিভু চোখে তাকালো তার দিকে। মনে হলো, তাকে দেখে মৃদু হাসলো। আদিব অবশ্য সেদিকে খেয়াল করলো না। সে মেয়েটাকে বিছানায় শুইয়ে চটপট স্যুপ বানিয়ে নিয়ে আসলো। জাহানারাকে ধৈর্য্য নিয়ে সেটা খাওয়ালো, তারপর ওষুধ খাইয়ে বিছানায় শুইয়ে কাঁথা টেনে দিল তার গায়ে। জাহানারার ফ্যাকাশে মুখটা দেখে চোখে মুখে চিন্তার ছাপ পড়লো আদিবের।আদিব লক্ষ্য করে দেখেছে প্রায় প্রতিমাসে দুই-তিনবার করে জ্বর আসছে মেয়েটার—ব্যাপারটা স্বাভাবিক লাগছে না তার কাছে।ভেতরে কোন বড় অসুখ বাসা বাধলে এমনটা হয়।সে মনে মনে ঠিক করলো, মেয়েটা এবার সুস্থ হলে নিজ দায়িত্বে তাকে নিয়ে গিয়ে একটা সিটি স্ক্যান করাবে।আদিবের কেন জানি মনে হচ্ছে, মেয়েটার এমন হুটহাট শরীর খারাপের পিছনে মাথায় পাওয়া আঘাতটা দায়ী।

নিজ মনে কথাগুলো ভাবতে ভাবতে খাবার টেবিলে বসলো আদিব।পেটে ক্ষিদে থাকা সত্ত্বেও জাহানারার চিন্তায় গলা দিয়ে খাবার নামলো না তার কোনরকমে আধপেটা খেয়ে উঠে দাড়ালো। খাবারগুলো ফ্রিজে রেখে সবকিছু জাহানারার ঘরে গেল।ঠিক করলো, আজ রাতটা সেখানেই থাকবে। রাতবিরাতে মেয়েটার যদি কিছু হয়। নিজের ঘর থেকে ফোন নিয়ে এসে ঘরের দরজা দিল।দরজা দিয়ে চেয়ার টেনে বসলো তার মাথার পাশে। জাহানারার রক্তশূন্য মুখটার দিকে তাকালো নরম চোখে। সাথে সাথে বুকের ভেতর হুঁহুঁ করে উঠলো তার। বুঝলো, এই জেদি মেয়েটার প্রতি একটু না, অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়েছে সে। মেয়েটার কিছু হলে খারাপ লাগে তার, অন্তর পোড়ে। মেয়েটার অনুপস্থিতিতে খালি খালি লাগে ভেতরটা। মাঝে মাঝে মনে হয়, চার মাস আগে স্বার্থপরতা দেখিয়ে চলে গেলেই পারতো সে। কেন যে শুধু শুধু মায়া দেখাতে গেল। অসুস্থ মেয়েটার অসুখ সারাতে গিয়ে নিজেই যেন নাম না-জানা অসুখ বাধিয়ে বসলো।বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।

ঠিক সেই সময় জানালার কপাট বাড়ি খেল গ্রিলে। চমকে উঠলো সে। জাহানারাও যেন কেঁপে কেঁপে উঠলো একটু। জানালার দিকে তাকাতেই লক্ষ্য করলো, বাইরে বাতাস বইছে, ঝড় উঠেছে। বসা থেকে উঠে জানালার দিকে এগিয়ে গেল আদিব।খোলা জানালা দিয়ে বাইরে চোখ ফেলতেই নুইয়ে পড়া সুপারি গাছটা চোখে বাধলো।বাইরে ইতিমধ্যে তান্ডব শুরু করেছে। গাছগাছালি বাতাসের দাপটে মুষড়ে পড়ছে। জানালার কপাট টেনে জানালা লাগিয়ে দিল আদিব। আলমারির ওপর থেকে চার্জার লাইটটা বের করে হাতের কাছে রাখলো। “ঝড় উঠেছে মানে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হবে—সুতরাং প্রস্তুতি নিয়ে রাখা ভালো।” কিন্তু চার্জার লাইট অন করতেই খেয়াল করলো, আলো নিভুনিভু। তার মানে, চার্জ নেই। তাড়াতাড়ি সেটা চার্জে বসালো সে। চার্জার লাইট চার্জে দিতে না দিতেই বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হলো।আদিব বিরক্তিসূচক শব্দ বের করলো মুখ দিয়ে। চার্জার লাইট টেবিলের উপর রেখে ফোনের ফ্ল্যাশ জালিয়ে মোমবাতি খুঁজতে লাগলো। বাবাকে বলেছিল আইপিএস লাগাতে, কিন্তু তার বাবা “করছি, করবো” করে আজো লাগায়নি।

মোমবাতি জ্বালিয়ে বিছানার পাশে সাইড টেবিলে রাখার সময় পিটপিট করে চোখ মেলল জাহানারা। আদিবকে দেখে মৃদু হাসলো সে। আদিব মোমবাতি টেবিলের উপর রেখে জাহানারার দিকে ঝুঁকলো। কপালে হাত দিয়ে বলল,
– এখন কেমন লাগছে?

জাহানারা ঘোর লাগা চোখে তাকালো তার দিকে। হাত বাড়িয়ে তার হাতটা দুই হাতের মুঠোয় নিয়ে মুখের একপাশে রেখে চোখ বুজে অন্যরকম স্বরে বলল,
– এবার ভালো লাগছে।

কেমন যেন শোনালো জাহানারার গলাটা। আদিবের শরীরে কাঁটা দিল। সে আরো খানিকটা ঝুঁকলো। জাহানারার বাঁধন থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
– তাহলে ঘুমাও।

কথাটা বলতে বলতে উত্তরের জানালার দিকে চোখ গেল আদিবের। জানালাটা খোলা থেকে গেছে। জানালা দিয়ে বৃষ্টির পানি এসে ফ্লোর ভেজাচ্ছে। জানালা বন্ধ করার উদ্দেশ্যে সেদিকে পা বাড়াতেই জাহানারা পিছন থেকে হাত টেনে ধরলো আদিবের। আদিব অবাক হয়ে পিছন ফিরে তাকালো। জিজ্ঞেস করলো,
– কি হয়েছে?

দুই দিকে মাথা নাড়লো জাহানারা। যার অর্থ, *“কিছু না।”* হাত ছেড়ে দিল তার। হাত ছাড়া পেতেই জানালার দিকে গেল আদিব। জানালা বন্ধ করে ফিরে এলো বিছানার কাছে। জাহানারার পাশে থাকা খালি জায়গায় উঠে বসলো। বিছানায় শরীর এলিয়ে জাহানারার দিকে তাকালো। জাহানারা তখন জেগেই। আদিব তার পাশে শুতেই পাশ ফিরে তাকালো সে। আদিব তাকে নিজের দিকে তাকাতে দেখেই মৃদু হাসলো। তাকে আশ্বস্ত করে বলল,
– পাশেই আছি। কিছু লাগলে বলবে। ঠিক আছে?

– হুঁ।

মৃদু হেসে সায় দিল জাহানারা। আদিব নিশ্চিন্তে চোখ বুজলো। ঠান্ডা আবহাওয়ায় খুব বেশি সময় লাগলো না তার চোখে ঘুম নামতে। মাত্র তন্দ্রা আচ্ছন্ন হয়েছিল আদিব, ঠিক তখন বুকের উপর ভারি কিছু অনুভব হতেই ঘুম ছুটে গেল তার। চোখ মেলে দেখলো, জাহানারা তার বুকের উপর মাথা দিয়ে রেখেছে। মেয়েটা থেকে থেকে কেঁপে উঠছে।বুকের কাছে ভেজা ভেজা ঠেকলো। আদিবের বুঝতে অসুবিধা হলো না—কাঁদছে মেয়েটা। সে কিছু বলল না। আলতো হাতে জড়িয়ে নিল মেয়েটাকে। আদিবের আলতো হাতের নরম স্পর্শ জাহানারা যেন বেসামল হলো। আদিবকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। কান্নাভেজা কণ্ঠে বলে উঠলো,

– আমার আপনাকে লাগবে। আপনাকে লাগবে আমার। দিবেন আপনাকে।

চোখ বন্ধ করে একটা দম খিচলো আদিব। জাহানারার কথাটায় কি ছিল কে জানে, ভেতরটা কেমন যেন শিউরে উঠলো তার। একটা ঢোক গিলে জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজালো সে। নিজেকে ধাতস্থ করলো সময় নিয়ে। তারপর জাহানারা কে সামলাতে কিছু বলতেই যাচ্ছিল, তার আগে নিজের পুরু ঠোঁটে জাহানারার ঠোঁটের স্পর্শ পেলো।থমকালো সে। জাহানারার কোমল ঠোটের ছোঁয়ায় শিহরিত হলো সারা শরীর। জাহানারার আদুরে স্পর্শে ব্যাকুল হলো মন। সাথে সাথে নিজের মাঝে জড়িয়ে নিলো জাহানারাকে। সাড়া দিল তার স্পর্শে। গ্রহণ করলো তার নীরব আত্মসমর্পণ। মিশে গেল জাহানারার নরম শরীরে।

__________

শেষ রাতে ঘুমাতে যাওয়ায় ঘুম ভাঙতে দেরি হলো আদিবের। ঘুম ভেঙে সবার প্রথম বিছানা হাতড়ালো সে। খালি বিছানা হাত পড়তেই আস্তে ধীরে চোখ খুললো। আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসলো। ঘরের চারিদিকে চোখ বুলালো। প্রত্যাশিত মানুষটাকে সামনে না পেয়ে কিঞ্চিৎ হতাশ হলো। তবে সেটা নিয়ে খুব বেশি মাথা ঘামালো না। হাই তুলতে তুলতে অলস শরীরটা টেনে পা বাড়ালো নিজের ঘরের। ফ্রেশ হতে হবে তাকে। এ ঘরে জামাকাপড় নেই তার, সুতরাং নিজের ঘরে যেতে হবে।

অনেকটা সময় নিয়ে ফ্রেশ হলো আদিব। ফ্রেশ হয়ে ঘর থেকে বের হওয়ার সময় জাহানারার ঘরে একবার উকি দিতে ভুলল না। তবে জাহানারাকে এবারও ঘরে দেখতে পেল না। জাহানারা নিচে আছে ভেবে সিঁড়ির দিকে পা বাড়ালো সে। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে নামতে জাহানারার কলকলিয়ে হাসির শব্দ কানে এসে বাড়ি খেলো তার। অন্যসময় হলে জাহানারার এমন হা-হা-হি-হি টাইপের হাসি শুনে বিরক্তিতে নাক-মুখ কুঁচকে ফেলতো আদিব। মনে মনে শব্দদূষণের আরোপ লাগাতো জাহানারার উপর। কিন্তু আজ তেমন কিছুই মনে হলো না তার। বরং জাহানারার উচ্ছ্বাসিত হাসি শুনে তার ঠোঁট প্রশস্ত হলো। মনে মনে একটা প্রশান্তি অনুভব করলো। উৎফুল্ল চিত্তে এগিয়ে গেল সামনে।

কিন্তু যতটা উৎফুল্লতা নিয়ে সামনে এগিয়েছিল, তার সবটা এক নিমিষেই উধাও হলো, যখন জাহানারার পাশে রাকিব সারোয়ারকে দেখলো। মুখ জুড়ে অন্ধকার নামলো আদিবের। ভেতরটা অজানা কারণে কুঁকড়ে গেল।

জাহানারা তখনো খেয়াল করেনি আদিবকে। সে রাকিবের সাথে কথায় ব্যস্ত। অনেকদিন পর বন্ধুকে পেয়ে আবেগে আপ্লুত। আদিব এসে দাঁড়ানোর কিছুক্ষণ পর তাকে খেয়াল করলো তারা। আদিবের দিকে জাহানারা তাকাতেই চোখ পড়লো।সাথে দৃষ্টি নত করলো জাহানারা।আদিব এগিয়ে গেল সামনে।রাকিব কে দেখে মনে সদ্য তৈরি হ‌ওয়া তিক্ত অনুভূতিটা এক পাশে রেখে হাত মিলালো রাকিবের সাথে। কুশলাদি বিনিময় করলো। তারপর একটু সময় নিয়ে এদিক-সেদিকের কথা বলে রাকিবের এ বাড়িতে আসার কথা জানতে চাইলো। রাকিবের হয়ে উত্তরটা জাহানারাই দিল। জানালো আজ জন্মদিন তার। প্রতিবারের মতো তাকে শুভেচ্ছা জানাতে রাকিব হাজির হয়েছে এ বাড়ি।

– আমি অবশ্য কাল রাতেই আসতাম। কিন্তু এখন তো জাহানারা বিবাহিত। রাতবিরাতে আসলে যদি তুমি কিংবা তোমার বাড়ির লোক মাইন্ড করো, সেটা ভেবেই আসিনি।

জাহানারার কথা টেনে বলল রাকিব। অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাসলো সে। আদিবের গায়ে জ্বালা ধরালো সেই হাসি।মনে মনে আওড়ালো, “এতই যখন ভাবলেন, তাহলে সাতসকালে আসলেন কেন? রাত-দিনের ব্যবধানে শ্বশুরবাড়ি, বরের মাইন্ড বদলে যাবে না কি? যতসব!”

– আরে, কেউ কিছু মনে করতো না। তুমি বেশি ভেবে ফেলেছো।

রাকিবের কথার প্রেক্ষিতে বলল জাহানারা। তার বর, তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন উন্মুক্ত খেয়ালের—এটা বোঝাতে চাইলো রাকিবকে। রাকিব ব্যাপারটা বুঝলো কি বুঝলো না সেটা রাকিবই জানে। কিন্তু জাহানারার এমন আগবাড়িয়ে কথা বলায় চোয়াল শক্ত হলো আদিবের। জাহানারার রাকিবকে *“তুমি”* সম্বোধনটা ‌আদিবের মনে তীরের নেয় বিধলো। থমথমে হলো তার মুখভঙ্গি।

রাকিব খেয়াল করলো আদিবের বদলে যাওয়া অভিব্যক্তি। সাথে সাথে তার ঠোঁটের কোণে দেখা দিল বাঁকা হাসি। সে আরেকটু সরে বসলো জাহানারার দিকে। কথা শুরু করলো জাহানারার আসন্ন প্রজেক্ট নিয়ে। কাজের কথা উঠলে জাহানারা হুঁশজ্ঞান থাকে না।আজও তার ব্যতিক্রম হলো না। সে আদিবকে উপেক্ষা করে রাকিবের কথায় মগ্ন হলো।

জাহানারা আর রাকিবের কথার মাঝে নিজেকে অযথা মনে হলো আদিবের। বুঝলো, তাদের মধ্যে তার কোনো কাজ নেই। উঠে দাঁড়ালো সে। জরুরি ফোনকলের দোহাই দিয়ে সরে আসলো সেখান থেকে।এসে দাঁড়ালো বাগানে।

কাল রাতের ঝড়ে বাগানের গাছপালা সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।সেগুলো ঠিক করছে তাদের হাসেম।হাসেম এই বাড়িতেই থাকে, দাররক্ষার পাশাপাশি মালির কাজটাও সেই করে। বাগানের এমন এলোমেলো অবস্থা দেখে গত রাতের একখণ্ড এলোমেলো স্মৃতি চোখে ভেসে উঠলো আদিবের। সাথে সাথে চোখ বন্ধ করে নিল সে। বুকের ভেতর তৈরি হওয়া ধড়ফড়ানিটা শান্ত করতে শ্বাস নিলো বুক ভরে।

– স্যার, আপনার কফি।

নেহার আচমকা ডাকে চমকে উঠলো আদিব। ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো। ট্রে হাতে দাঁড়িয়ে আছে নেহা। মুখে অমায়িক হাসি। আদিব নিজেকে ধাতস্থ করে কফির মগটা হাতে নিল। আদিব কফির মগ হাতে নিতেই চলে আসছিল নেহা, কিন্তু আদিব পিছু ডাকলো।আটকালো তাকে। নিজের মনে উদয় হওয়া প্রশ্নের উত্তর জানা দরকার আদিবের—তার জন্য এই মেয়েটাই এখন তার একমাত্র ভরসা।

– তুমি কখন এলে?

– সকালে রাকিব স্যারের সাথে।

– ছোট চাচুরা সব কেমন আছে?

– আলহামদুলিল্লাহ, ভালো।

নেহার সাথে ঠিক তেমন সখ্যতা নেই আদিবের। তার সাথে সেভাবে আগবাড়িয়ে কথাও বলে না আদিব। আজ নিজে থেকে কথা বলায় একটু অবাক হলো নেহা। যেটা তার চোখে-মুখে স্পষ্ট ফুটে উঠলো। আদিব বুঝলো সেটা, কিন্তু গুরুত্ব দিল না। সে নিজের কথা চালিয়ে গেল। এদিক-সেদিকের কথা বলে নেহার সাথে সহজ হলো। তারপর আসলো মূল কথায়। জানতে চাইলো,

– রাকিব সারোয়ার কি তোমার ম্যামের জন্মদিনে প্রতিবছর এমন ফুলের তোড়া নিয়ে হাজির হয়? না কি এবার স্পেশাল কিছু?

নেহা সহজ-সরল মানুষ। কেউ একটু ভালোভাবে কথা বললে গলে যায়। আর যদি মানুষটা তার ম্যামের সবচেয়ে কাছের মানুষ হয়, তাহলে তো কথাই নেই। আদিবের প্রশ্নের উত্তরে সে গড়গড় করে বলল,

– প্রতিবছরই আসে। সবার প্রথমে সেই উইশ করে ম্যামকে। একবার তো ধুমধাম করে সারপ্রাইজ পার্টিও রেখেছিল। কিন্তু ম্যাম যায়নি। খুব কষ্ট পেয়েছিল স্যার।অনেক মানুষ ছিল, ভালোই অপদস্ত হয়েছিল উনি।

সহানুভূতির সুর নেহার। তার সত্যিই খারাপ লেগেছিল সেবার রাকিব স্যারের জন্য। কিন্তু তার ম্যামের বা কি দোষ? সে বারবার রাকিব স্যারকে বলেছিল, সে যেতে পারবে না। কিন্তু রাকিব স্যার অযথা জেদ ধরলো। ফলস্বরূপ, ঘরভরা লোকের মধ্যে অপমানিত হতে হলো।এখানে অবশ্যই তার ম্যামের দোষ নেই!

– তোমার ম্যামের সাথে উনার কেমন সম্পর্ক?

নেহার ভাবনার মাঝে বলল আদিব। সন্দেহহীন কণ্ঠ আদিবের। তবে নেহা অত সব খেয়াল করলো না। জাহানারার প্রতি রাকিবের মনের দুর্বলতা সম্পর্কে জানা থাকলেও জাহানারা মনের ভাব জানে না আদিব। সেটা জানার ক্ষুদ্র চেষ্টা করলো সে। নেহা সময় অপচয় না করে আদিবের প্রশ্নের জবাবে বলল,

– রাকিব স্যার তো ইন্ডাস্ট্রিতে আছে। *“আরএস মাল্টিমিডিয়া”* সেটা তো তার প্রোডাকশন হাউজ। ম্যাম বেশ কয়েকটা কাজ করেছে আরএস থেকে। সেখান থেকেই একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয়েছে তাদের। তবে ম্যামের দিক থেকে কিছু না থাকলেও রাকিব স্যার ম্যামের উপর লাট্টু—

জিভ কাটলো নেহা। কার সামনে কি বলছে সেটা ভেবে ঢোক গিলল। বুঝলো, আদিবের সহজ আচরণে খুব বেশিই সহজ হয়ে গেছে সে। নিজের নিয়ন্ত্রণহীন কথা বলার স্বভাবের জন্য নিজের উপর রাগ হলো তার। মনে মনে নিজেকে কড়া করে দুটো গালি দিলো সে। তারপর নিজের কথা ঢাকতে আমতা আমতা করে বলল,

– রাকিব স্যার আর ম্যাম তো পূর্বপরিচিত। সেই সুবাদে স্যার ম্যামকে স্নেহ করে, আর কি।

– *স্নেহ* করে!

তাচ্ছিল্যে হাসল আদিব। নেহার কাছে যেটা মোটেও সুবিধার লাগলো না। এমনিতেই আদিব আর তার ম্যামের সম্পর্ক যে সমীকরণ! তার কথায় তাদের মধ্যে আবার কোনো সমস্যা হয় কি না—সেটা ভেবে মনের মধ্যে খুঁতখুঁত করতে লাগলো। তার মনের ভাবনা-চিন্তার মাঝেই ডাক পড়লো ভেতর থেকে। জাহানারা ডাকছে তাকে। মনে একরাশ দুশ্চিন্তা নিয়ে ছুটলো সে ভেতরে।

নেহা চলে যেতেই রাকিব এসে দাঁড়ালো আদিবের পাশে। আদিব তখন সামনে তাকিয়ে একমনে কিছু ভাবছে। রাকিবের উপস্থিতি টের পায়নি সে। রাকিব আদিবের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে গলা ঝাড়া দিল। আদিবের ধ্যান ভাঙলো। পাশ ফিরে তাকালো। ঠোঁট চ‌ওড়া করে জোরপূর্বক হাসলো। রাকিবও প্রতিউত্তরে হাসলো। তারপর সামনে তাকিয়ে নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল,

– ডিভোর্স ফাইল করে, বউর কাছে যাওয়ার যুক্তিটা ঠিক বুঝলাম না, আদিব।

রাকিবের কথা যেন গরম সীসার মতো গিয়ে ঠেকলো আদিবের কানে।সাথে সাথে মুখভঙ্গি কঠোর হলো তার।রক্তিম বর্ণ ধারণ করলো চোখ। মুষ্টি বদ্ধ হলো হাত।

চলবে, ইনশাআল্লাহ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ
পরবর্তী নিবন্ধ
গল্প পোকা
গল্প পোকাhttps://golpopoka.com
গল্পপোকা ডট কম -এ আপনাকে স্বাগতম......
RELATED ARTICLES

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments

Md masrur Hasan mahi على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
আমিনুল ইসলাম على প্রয়োজন পর্ব: ৩০ ( অন্তিম)
সাজিবুল ইসলাম على ধর্ষিতাবউ২ ৯ তথা শেষ পর্ব
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
Nita Sarkar على স্বপ্নীল ৬৮
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على রহস্য শেষ_পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على অলক্ষ্যে তুমি পর্ব-০৬ এবং শেষ পর্ব
Nazmun Nahar Akhi على Psycho_is_back? part_7
Nazmun Nahar Akhi على Dangerous_Villian_Lover part 2
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على জানালার ওপারে পর্ব-১৭ এবং শেষ পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على লীলা বোর্ডিং ১২১৫ পর্ব-১১ এবং শেষ পর্ব
মিজানুর রহমান রাহুল على সেই তুমি পর্ব-০১
@feelings على প্রহেলিকা
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Nusrat jahan على coffee & vanilla Part-10
Pallabi Roy على স্বপ্নীল ৬৮
M.D Mahabub على The_Villain_Lover Part_2
Labani sarkar على Dangerous_Villain_Lover part 23
MD Akas Apc على বিবেক
Tanisha Ahmed على Devil love part-18 
Aius Barmon shorob على নারীর দেহকে নয়
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Priya Banerjee على devil love married life last part
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Riya Biswas على তুমি রবে ৫২
Mohammad Adib على তুমি রবে ৬০
Avni Ayesha على তুমি রবে ২৮
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
সুমিত على তুমি রবে ২৮
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
Samiah Begum على তুমি রবে ৫১
biddut das rocky على নর নারী
গল্প পোকা على নষ্ট গলি শেষ পর্ব
Md Jobayer Hossain Shohag على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على দুই অলসের সংসার
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤৪২.
A.J.S Rakib على মন ফড়িং ❤৪২.
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
Samiya noor على গল্পঃ ভয়
Sadikul على গল্পঃ ভয়
Samia Islam على গল্পঃ ভয়
শূন্য মায়া على মন ফড়িং ❤ ৪০.
Sutapa biswas على মন ফড়িং ❤৩৯.
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৮.
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৭
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
Siyam على বিবেক
Sudipto Guchhait على My_Mafia_Boss পর্ব-৯
saptami karmakar على devil love married life last part
saptami karmakar على devil love married life last part
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ২৬.
Shreyashi Dutta على  বিয়ে part 1
Sandipan Biswas على  বিয়ে part 1
Paramita Bhattacharyya على অনুরাগ শেষ পর্ব
জামিয়া পারভীন তানি على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
মায়া على মন ফড়িং  ২২
সুরিয়া মিম على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على মন ফড়িং ২১
গল্প পোকা على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
Sahin ssb على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৮. 
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৭.
Jannatul Ferdous على খেলাঘর পর্ব-৩৫
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ফাল্গুনের_ফুল last_part_8
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ছাত্রী যখন বউ পাঠঃ ১
গল্প পোকা على বাজির প্রেম পাঠঃ ১
Foujia Khanom Parsha على মা… ?
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৮
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
Ibna Al Wadud Shovon على স্বার্থ