Sunday, October 5, 2025







বাড়ি"ধারাবাহিক গল্প"সৌরকলঙ্কসৌরকলঙ্ক পর্ব-২০+২১+২২

সৌরকলঙ্ক পর্ব-২০+২১+২২

#সৌরকলঙ্ক
#উম্মে_প্রভা
#পর্ব_২০

– তোমার কোথাও ভুল হচ্ছে, আদিব। আমি দেখেছি জাহানারার রিপোর্ট।

– রিপোর্টটা তোমার ভাতিজি হয়তো কড়া মূল্যে তৈরি করেছিল। বানোয়াট ওটা।

– কী বলছো!

আশরাফের কণ্ঠে বিস্ময়। আদিব মাথা নাড়ালো, যার অর্থ সে সত্যি বলছে। বিয়ের দিন সন্ধ্যাবেলা যখন মনে মনে খুব গোপনে জাহানারার স্মৃতিচারণ করছিল সে, তখন জাহানারাকে মুমূর্ষু অবস্থায় পাওয়ার পর জাহানারা তাকে ভালোবাসার যে অভিযোগ করেছিল, সেটা মনে হতেই আদিব যেন একটু থমকালো। তার হঠাৎ মনে হলো, কোথাও কি কিছু ভুল হচ্ছে! জাহানারা যেখানে অবচেতন অবস্থাতেও তার কথা ভোলেনি, সেখানে জ্ঞান ফেরার পর সমস্ত কিছু কিভাবে ভুলে গেল! তারপর মনে হলো, তখনো হয়তো সেভাবে ক্ষতি হয়নি। কিন্তু আবার মনে হলো, কিন্তু সে যেটা ভাবছে, সেটা যদি সত্যি হয়!

নিজের ভাবনার দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মধ্যে তার মনে পড়লো, ছোট চাচা তাকে জাহানারার রিপোর্ট পাঠিয়েছিল, যেটা সময়ের অভাবে দেখা হয়নি। আদিব সেই রিপোর্ট ফাইল খুলল। খুব সময় নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো। কিন্তু ডাক্তার রাকিবের সারোয়ারের দেওয়া স্টেটমেন্ট তাকে আরো দিশেহারা করলো। মন বলল, সে অহেতুক সন্দেহ করছে। হতে পারে, অবচেতন মনে ভুলভাল বকছিল জাহানারা। ফাইল ক্লোজ করে বের হতেই মনে পড়লো, ছোট চাচা যখন জাহানারার MRI ও CT স্ক্যানের রিপোর্ট কালেক্ট করে, তখন রাকিবকে দেখানোর আগে তাকে ছবি তুলে পাঠিয়েছিল। ল্যাপটপ গ্যালারিতে প্রবেশ করলো সে। দুই মাস পুরনো ছবিটা নতুন ছবির ভিড়ে হারিয়ে ছিল, সেটা খুঁজতে একটু সময় লাগলো। তবে ছবি পেলেও নিজের জ্ঞানের স্বল্পতার কারণে বুঝতে একটু অসুবিধা হলো।

MRI-এর নির্দিষ্ট টেকনিক্যাল টার্ম ও নিউরোলজিক্যাল ডিটেইল, যেমন হিপোক্যাম্পাস, টেম্পোরাল লোবের ক্ষতি বা নিউরোপ্লাস্টিসিটি সম্পর্কিত বিশ্লেষণ, কনকাশন বা ক্ষুদ্র রক্তক্ষরণের সূক্ষ্ম লক্ষণ (Microbleeds, Diffuse Axonal Injury) এগুলো ভালোভাবে বুঝতে পারলো না সে। একজন কার্ডিয়াক সার্জন হিসেবে সাধারণত মস্তিষ্কের MRI রিপোর্ট সরাসরি বিশ্লেষণ করতে অভ্যস্ত না সে, এটি তার বিশেষায়িত ক্ষেত্রের বাইরে। তবে MRI রিপোর্ট অনুযায়ী জাহানারার মস্তিষ্কে ক্ষতির পরিমাণ দেখে ভ্রূতে গাঢ় ভাঁজ পড়লো তার।মনকে বোঝাতে চাইলো হয়তো ভুল হয়েছে কোথাও।মন বুঝলেও মস্তিষ্ক মানতে চাইলো না। মাথায় হাত উঠলো তার। ভাবনায় পড়লো সে। অজ্ঞাত নিজের সন্দেহে পোক্ত মোহর লাগাতে ফোন করলো রিচার্ডকে। কোনো ভণিতা ছাড়া খুলে বলল তার সংশয়। রিচার্ড ব্যস্ত ছিল হয়তো, সে রিপোর্ট পাঠাতে বলে কিছু সময় নিল। ঠিক এক ঘন্টা পর রিচার্ড আবার ফোন করলো আদিবকে। আদিব তখন এশার নামাজ শেষ করে মাত্রই উঠেছে। রিচার্ডের কল রিসিভ করতেই রিচার্ড সম্পূর্ণ তথ্য রাখলো তার সামনে। জানালো, যার রিপোর্ট পাঠিয়েছে, তার মস্তিষ্কের সকল অংশ স্বাভাবিক রয়েছে, কোনো আঘাতজনিত পরিবর্তন বা ক্ষত দেখা যায়নি।

গ্রে ম্যাটার (Gray Matter) ও হোয়াইট ম্যাটার (White Matter) স্বাভাবিক।

হিপোক্যাম্পাস ও টেম্পোরাল লোব (Hippocampus & Temporal Lobes):
কোনো অস্বাভাবিক সংকোচন (Atrophy) বা আঘাতজনিত পরিবর্তন নেই।
কোনো সিগন্যাল ইন্টেনসিটির পরিবর্তন নেই, যা স্মৃতিভ্রংশ বা নিউরোডিজেনারেটিভ রোগের ইঙ্গিত দেয়।

একে একে প্রতিটি পয়েন্ট উপস্থাপন করলো রিচার্ড। আদিব চুপচাপ সবটা শুনলো। রিচার্ডের কথার তাৎপর্য অনুযায়ী আদিব বুঝে নিল। তাকে বিশ্রীভাবে প্রতারিত করা হয়েছে। খুব বিশ্রীভাবে। সাথে সাথে রাগে সারা শরীর জ্বলে উঠলো তার। মাথার শিরা দপদপ করতে লাগলো। রিচার্ডের সাথে কথা শেষ করে বাবার ঘরের দিকে গেল সে। তাকে জানাতে চাইলো, যার জন্য সে নিজের আত্মসম্মান জলাঞ্জলি দিয়ে তার কাছে দয়া ভিক্ষা চেয়েছে, সেই মেয়ে তার সে দয়ার যোগ্য নয়। কিন্তু বাবার ঘরের সামনে এসে সে আরো একবার হতাশ হলো।

– আমি জানতাম ঐ মেয়ের কিছু হয়নি। তোমাকে কি আমি এমনি এমনি ঐ মেয়ে থেকে দূরে থাকতে বলতাম! তখন মায়ের কথা শুনলে না। চলে গেলে সেবা-যত্ন করতে। এখন নাও ভোগো।

আদিবের ভাবনা ছিন্ন হলো মায়ের কথায়। তানিয়া রাগে গজগজ করতে করতে বসলো সোফায়। আশরাফ তখনো আদিবের কথা বিশ্বাস করে উঠতে পারেনি। এর মধ্যে তানিয়ার কথায় সে বিরক্ত হলো। আদিব মায়ের কথা শুনে মায়ের মুখের দিকে নির্নিমেষ দৃষ্টিতে তাকালো। তানিয়া তখনো নিজের মত বকবক করেছে।

– ওদের আমি চিনি না। হাড়ে হাড়ে চিনি ওদের। আমার ছেলে-মেয়ের সর্বনাশ করার জন্য সবসময় মুখিয়ে থাকে ওরা। কিন্তু তোমার বাপ, তোমরা, আমার কোনো কথা তো শুনবে না। তোমরা তো…

– তোমার একটা কথায় তিনটে মিথ্যা থাকে, মা। তোমাকে কিভাবে বিশ্বাস করবো?

ছেলের কথায় হতবাক হলো তানিয়া। অবাক চোখে তার দিকে তাকালো। আদিব তাচ্ছিল্যে হাসলো। বলল,

– তোমার সব কথায় তো শুনি আমি, তাহলে হঠাৎ জ্ঞান হারানোর নাটক করতে গেলে কেন? আমি তোমাকে বলেছিলাম, আমার একটু সময় চাই। তুমি ঐ সময়টুকু দিতে পারলে না? এত অবিশ্বাস তোমার ছেলের প্রতি!

থামলো আদিব। ফোঁস করে একটা শ্বাস ফেলল।

– তোমার আর জাহানারার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই, মা। তোমরা দুজনেই সমান। নিজের জেদ পূরণ করার জন্য যে কোনো সীমা অতিক্রম করতে পারো তোমরা। তাতে সামনের জনের মনের উপর কি প্রভাব পড়লো, তা দেখার প্রয়োজন বোধ করো না। অবশ্য দোষ তোমার না, দোষ আমার। নিজের দুর্বলতা যে তোমাকে বুঝতে দিয়েছি!তোমার সামনে বারবার জাহির করেছি, “আমার মা আমার সব”। ব্যাস! তুমি সুযোগ নিয়েছো!

ছেলের কথা শুনে উত্তপ্ত চোখে আশরাফের দিকে তাকালো তানিয়া। সেদিন রাতে যে তার কিছু হয়নি, এ কথা সে আর আশরাফ ছাড়া কেউ জানতো না। BP একটু লো ছিল তার। মাথাও ঘুরছিল, কিন্তু শরীর তখনো ভেঙে পড়েনি। আদিবকে জাহানারার সাথে এক বিছানায় এত কাছে দেখে তার মাথা কাজ করছিল না। মন শুধু বলছিল, ছেলেকে ঐ মেয়ের থেকে যেকোনো উপায়ে দূরে রাখতে হবে। তার জন্য যা করার লাগে, সে করবে। এসব ভেবেই জ্ঞান হারানোর ভান করে মাটিতে শুয়ে পড়েছিল। পরিকল্পনা অনুযায়ী, আদিব আসার কিছুক্ষণ পরে উঠেও যেত, কিন্তু মায়ের অবস্থা দেখে ছেলে এত উদ্বিগ্ন হয়ে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবে, এটা ভাবেনি তানিয়া। তবে সে তার সাধ্য মতো নিখুঁত অভিনয় চালিয়ে গেছে। আদিব তার অভিনয় দেখে বুঝতেই পারেনি তার মায়ের কিছু হয়নি। তবে তানিয়া ছেলের চোখেকে ধোঁকা দিতে পারলেও আশরাফকে ধোঁকা দিতে পারেনি। তানিয়ার হৃদস্পন্দনের স্বাভাবিকতা তাকে বুঝিয়ে দিয়েছে সত্যিটা। কিন্তু স্ত্রীকে ছেলের সামনে ছোট করতে চায়নি, তাই কিছু বলে নি আশরাফ। গতকাল শামীমরা চলে যাওয়ার পরে জাহানারার সাথে আদিবের বিয়ে নিয়ে বাকবিতণ্ডাতার দরুণ আশরাফ তাকে কথাটা মনে করিয়ে দিয়েছে, ছেলেকে বোকা বানাতে পারলেও তাকে বোকা বানাতে পারেনি তানিয়া। আদিবের কথা শুনে তানিয়া বুঝলো, আশরাফ ছেলেকে সে কথা জানিয়ে দিয়েছে। আদিব বাবার দিকে মায়ের চোখা দৃষ্টি দেখে বলল,

– বাবা কিছু বলে নি আমাকে। তুমি নিজে মুখে যখন মেজ খালাকে তোমার মাস্টার প্ল্যান শোনাচ্ছিলে, দুর্ভাগ্যক্রমে আমি তখন শুনেছি। এনিওয়ে, সামনের মাসে আমি লন্ডন ফিরে যাচ্ছি। জাহানারা হয়তো এখানেই থাকবে। তোমরা দুইজন যত খুশি নাটক নাটক খেলো। কেমন?

– নিজের সহবত ভুলো না, আদিব। মায়ের সাথে কথা বলছো তুমি। আমি যা করেছি, তোমার ভালোর জন্য। আজ তুমি আমাকে না বুঝলেও একদিন ঠিক বুঝবে। ঐ মেয়ে কখনো তোমার জন্য সঠিক ছিল না, এবং আমার ধারণা মতে ভবিষ্যতেও হবে না। মনে রেখো।

উঠে গেল তানিয়া। আশরাফ একটা হতাশ শ্বাস ফেলল। আদিবের কাছ থেকে জাহানারার সত্যি জানতে পেরে কেন জানি তারও আজ মনে হচ্ছে, জাহানারা আদিবের জন্য সত্যিই সঠিক জীবনসঙ্গী নয়। তার হয়তো ভুল হলো কোথাও!

– আদিব, আমি দুঃখিত। আমার জন্য হয়তো তোমার জীবনটা এলোমেলো হয়ে গেল। জাহানারা যে অভিনয় করছে, সেটা আমি বুঝতে পারিনি। আই এম সরি।

– ডোন্ট বি সরি, বাবা। তোমার কোনো দোষ নেই এখানে। তুমি তো জানতে না তোমার ভাতিজির কাণ্ডকারখানা। তাছাড়া, বিয়ের আগে আমি সব জানতে পেরেছিলাম। আমি এই বিয়েটা করেছি শুধুমাত্র মাকে আর ঐ মেয়েটাকে শিক্ষা দিতে। দুইজন দুইজনের সামনে থাকবে, জ্বলবে-পুড়বে, বেশ হবে!

আদিবের ছেলেমানুষি কথা। আশরাফ হাসলো। বলল,

– চোরের উপর রাগ করে মাটিতে ভাত ঢেলে খাওয়ার মত অবস্থা হলো না আদিব?

– মানে?

– মানে, মায়ের উপর রাগ করে বিয়েটা করা মনে হয় তোমার ঠিক হয়নি। আমি যদি জানতাম জাহানারা সুস্থ-স্বাভাবিক, সে অভিনয় করছে, তাহলে কখনো তোমাকে এই বিয়ে করতে দিতাম না। ছোট্ট সেই জাহানারা আর এই জাহানারার মধ্যে বিস্তর ফারাক, আদিব। এই জাহানারা বাংলাদেশের অন্যতম সফল অভিনেত্রী। লাখ লাখ ভক্ত তার। তার জীবনের ছোট থেকে ছোট বিষয় নিউজ চ্যানেলগুলোতে ফলাও করে প্রচার করে। তোমার অতি সাধারণ জীবন, তার জীবনের সাথে খাপ খায় না।

বাবার কথা শুনে মৃদু হাসলো আদিব। ঠোঁটের কোণে হাসি রেখেই বলল,

– আমি আর জাহানারা কোন কালে একরকম ছিলাম, বাবা? আমরা তো সবসময় দুই মেরুর দুই প্রান্তের ছিলাম। একদিন এসব ভেবেই তোমাকে বলেছিলাম, আমি চাই না জাহানারার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক হোক।

শব্দ করে একটা শ্বাস ফেলল আদিব। তারপর একটু সময় নিয়ে আবার বলল,

– যাই হোক, আমাকে পাওয়ার জন্য জাহানারা ম্যাডাম এত কিছু করার বদলে তাকে একটা সুযোগ দেওয়া দরকার ছিল। তাই তাকে সুযোগটা দিয়েছি। যেন কখনো কেউ আমার দিকে আঙুল তাক করে বলতে না পারে, “একটা মেয়ে তোমাকে দুনিয়া সমান ভালোবেসে শেষ হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু তুমি সামান্য ভ্রুক্ষেপও করোনি।” বিয়েটা করে নিজের ইমেজ ক্লিন করলাম, আর কি!

এবার একটু শব্দ করে হাসলো আদিব। আশরাফ ছেলের হাসির আড়ালে কিছু অব্যক্ত কথা পড়ে নিল হয়তো, সেজন্য তার হাসিতে তাল মিলাতে পারলো না। আদিব বাবার গাঢ় দৃষ্টির সামনে কিঞ্চিৎ অপ্রস্তুত হলো। তার বাবা যদি জানতে পারে, জাহানারা তাকে ভালোবেসে নয়, শুধুমাত্র প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য এতকিছু করেছে, তাহলে হয়তো সহ্য করতে পারবে না। তার জন্য ছেলের জীবনে ভুল মানুষ এসেছে, সেটা ভেবে আত্মগ্লানিতে হয়তো কুঁকড়ে যাবে। এসব ভেবেই অতি সাবধানে জাহানারার তাকে বিয়ে করার আসল উদ্দেশ্য গোপন করলো সে। ভেতরে ভেতরে একটা দীর্ঘশ্বাস লুকালো। কথা ঘোরালো।

__________
– এই মেয়ে, তুমি কে?

সবে মাত্র চৌকাঠের ভেতরে পা রেখেছিল নেহা, ঠিক তখন কর্কশ গলায় তাকে উদ্দেশ্য করে বলল তানিয়া। নেহাকে তানিয়া না চিনলেও নেহা তাকে চেনে। জাহানারার কাছে এই ভদ্র মহিলার অনেক কিসসা-কাহিনী শুনেছে সে। সালেহার মৃত্যুর সময় একবার দেখেছেও। জাহানারার একজন অনুগত ভৃত্য হিসেবে নেহার একদম পছন্দ নয় তানিয়াকে। সে তানিয়ার কথার উত্তরে নিজের পেশাদারিত্ব বজায় রেখে স্পষ্ট কণ্ঠে বলল,

– আমি ইরিন নেহা। জাহানারা ম্যামের ব্যক্তিগত সহকারী।

জাহানারার কথা শুনতেই তানিয়ার নিভে যাওয়া রাগটা আবার দপ করে জ্বলে উঠলো। সে কাঠকাঠ গলায় বলল,

– তোমার এখানে কি কাজ?

– আমি যেখানে সেখানেই ওর কাজ, চাচিমা…।

নেহার হয়ে উত্তর দিল জাহানারা। তার আকস্মিক আগমনে একটু চমকালো তানিয়া। পিছন ফিরে তাকালো। সিঁড়ির শেষ ধাপে সিঁড়ির রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে জাহানারা। পায়ের ক্ষত এখনো তাজা তার। কিন্তু তবুও নিজে থেকে হাঁটা-চলা করতে হচ্ছে। এছাড়া তো উপায়ও নেই। বাড়ির কাজের লোকগুলো তার ঘরে ঘেঁষে না। তিন বেলা নিয়ম করে খাবার দিয়েই তাদের কাজ শেষ। আর ঐ আদিব, সে তো এই দুই দিনে তার দিকে ফিরেও তাকায়নি। আজ সকালেও এক পায়ের ভরে বাথরুমে গোসল করতে গিয়ে চিৎ হয়ে পড়েছে সে। ঐ অহংকারী ছেলেটা তখন ঘরেই ছিল, কিন্তু একটু এগিয়েও যায়নি।বিগত দুই দিনে এ বাড়িতে এত অসুবিধার সম্মুখীন হয়েছে যে, আজ বাধ্য হয়ে নেহাকে ডেকেছে। অবশ্য এ জন্য ঐ ছেলের অনুমতি নিতে হয়েছে। ভাগ্য ভালো, আপত্তি করেনি। তবে জাহানারা জানতো, মায়ের ছেলে আপত্তি না করলেও তার মা ঠিক আপত্তি করবে, তাই তো নিজের ঘরের জানালা দিয়ে নেহাকে এ বাড়িতে আসতে দেখে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে সিঁড়ি বেয়ে এসেছে।

জাহানারার কথার প্রেক্ষিতে তানিয়া ভ্রু কুঁচকালো। কটাক্ষপূর্ণ গলায় বলল,

– জীবনে তো কোনদিন ভালো করে চাচি বলেও ডাকোনি, আজ আবার চাচিমা বলছো কোন দুঃখে?

চলবে, ইনশাআল্লাহ।

#সৌরকলঙ্ক
#উম্মে_প্রভা
#পর্ব_২১

– “জীবনে তো কোন দিন ভালো করে চাচি বলেও ডাকো নি, আজ আবার চাচিমা বলছো কোন দুঃখে!”

তানিয়ার কথা পুরোপুরি মিথ্যা নয়, তবে নির্ভেজাল সত্যও নয়। ছোটবেলা থেকেই জাহানারা তাকে বড় চাচি বলে সম্মান করে এসেছে। কিন্তু সেই লিচুতলার ঘটনা—যেদিন আদিবকে জড়িয়ে ধরেছিল—তার রেশ ধরেই সেদিন বিকেলে তানিয়া বাড়িতে গিয়ে সালেহা ও জাহানারাকে কঠোর ভাষায় অপমান করে, জাহানারাকে রাস্তার মেয়েছেলে বলে তিরস্কার করে। সেই মুহূর্তের অপমান জাহানারার মনে গভীর দাগ কাটে। যে শ্রদ্ধা ও সম্মান তানিয়ার জন্য তার মনে ছিল, তা যেন ধূলিসাৎ হয় সেদিন। এরপর থেকে আর কখনো বড় চাচি বলে সম্বোধন করা হয়নি জাহানারাকে। তাছাড়া তাদের খুব বেশি দেখা-সাক্ষাৎও হতো না, যার কারণে প্রয়োজনও পড়েনি কোনো সম্বোধনের। তানিয়ার কটাক্ষপূর্ণ কথা শুনে ফিচলে হাসি দেখা দিল জাহানারার ঠোঁটের কোণে। সে তানিয়ার কথার প্রেক্ষিতে বলল,

– “আপনার হয়তো মনে নেই চাচিমা। কিন্তু ছোটবেলায় কিন্তু চাচি বলেই ডাকতাম। এরপর তো আপনার ছেলের প্রেমে উল্টে পাল্টে পড়লাম, যার ফলস্বরূপ আপনি আমাকে যা তা শোনালেন। আমার আপনার কথা পছন্দ হলো না। ব্যাস, সে কারণে ক্ষণিকের জন্য ঐ ডাক স্থগিত রাখলাম। যাকগে, ওসব পুরোনো কথা। নেহা, একটু এদিকে এসে তো।”

জাহানারা আদেশ পাওয়া মাত্রই ব্যাগপত্র ফেলে অনেকটা দৌড়ে এগিয়ে গেল নেহা। জাহানারা তার হাতে ভর দিয়ে সামনে এগিয়ে এলো, সোফায় আরাম করে বসলো। তারপর বলল,

– “তো যা বলছিলাম। সম্পর্কে আপনি আমার চাচি, এখন আবার আমার বরের মা হন। একটা না, দুই দুটো সম্পর্ক! মান তো রাখতেই হবে। সেই জন্য দুই সম্পর্ক মিলিয়ে একটা সম্বোধন। আপনি আবার আমার ডাক শুনে আবেগে আপ্লুত হবেন না, প্লিজ। আমি জাস্ট ফর্ম্যালিটি পালন করছি। নাথিং এলস, চাচিমা…!”

জাহানারার স্পষ্ট কণ্ঠ, স্বাভাবিক বচনভঙ্গি। সে যে এত বড় একটা কাণ্ড ঘটিয়ে আদিবের জীবনে প্রবেশ করছে, তার জন্য বিন্দুমাত্র অনুতাপ নেই তার চোখে-মুখে। তানিয়া এমন কিছু আশা করেনি তার থেকে। সে ভেবেছিল জাহানারা হয়তো তার কাজের জন্য লজ্জায়-ভয়ে ঘরে সিটিয়ে থাকবে, নিজের জন্য সাফাই গাইবে, চোখের পানি-নাকের পানি ফেলে আকুলি-বিকুলি করে কান্নাকাটি করবে। জাহানারার এমন নির্লিপ্ত স্বাভাবিক ভঙ্গি দেখে চোয়াল শক্ত হলো তানিয়ার। ইচ্ছা করলো মেয়েটাকে কষে দুটো চড় বসাতে, কিন্তু পরিস্থিতি বিবেচনা করে নিজেকে সামলালো। নিঃশব্দে একটা শ্বাস টেনে ভেতরের রাগটা দমন করলো। তারপর জাহানারার দিকে শীতল চোখে চেয়ে বলল,

– “বেহায়া তো ছিলেই, অভদ্রতাও দেখছি ভালো করেই রপ্ত করেছ। খুব ভালো! তো তোমার বাপ জানে তোমার এসব কীর্তিকলাপ সম্পর্কে?”

– “না, জানে না। তবে আশা করছি আপনি নিজ দায়িত্বে খুব শীঘ্রই তাকে জানাবেন।”

– “তা তো জানাবোই। মেয়ে কী গুনের কাজ করে বেড়াচ্ছে, বাপ হিসাবে তারও তো জানা দরকার! তাই না?”

কথাটা বলতে বলতেই নিজের ফোনটা সোফার উপর থেকে নিজের হাতে নিল তানিয়া। কল লাগালো জায়েদের নাম্বারে। দুই বার রিং হতেই কল ধরলো জায়েদ। তানিয়া কোনো ভণিতা ছাড়া বলল,

– “জায়েদ, এক্ষুনি আমার বাড়ি এসো।”

কথাটা বলেই ফোন কাটলো তানিয়া। এরপর সাজ্জাদ আর নাফিজাকে কল করলো। তাদেরকেও এই মুহূর্তে এ বাড়ি আসতে বলে ফোন রাখলো। তাদের আদরের ভাতিজি কী করেছে, সেটা তাদেরও জানা দরকার! ফোন সোফার সাইড টেবিলে রেখে জাহানারার মুখোমুখি সোফায় বসল তানিয়া। জাহানারা তার ভঙ্গি দেখে ঠোঁট টিপে হাসলো। ছোটবেলায় অনেকটা সময় এই মানুষটার সাথে কাটানো হয়েছে তার। আদরে-আহ্লাদে সবসময় তাকে ভরিয়ে রাখতো মানুষটা। কোথাও সাথে করে নিয়ে গেলে কেউ তার পরিচয় জানতে চাইলে উৎফুল্ল কণ্ঠে বলত, “আমাদের মেয়ে”। কখনো দিপ্তী-তৃপ্তি থেকে আলাদা করে দেখতো না তাকে। জাহানারাও লেপ্টে থাকতো সবসময় তার সাথে। এরপর দিপ্তী আপুর বিয়ের ঘটনা ঘটলো। জাহানারার এখনো মনে আছে সেই রাতটা। বাবা পহেলা বৈশাখের মেলা থেকে তার জন্য মাটির পুতুল কিনে এনেছিল এক ঝুড়ি। সে বাবার ডাকে ঘুম থেকে উঠে সেগুলোই দেখছিল। বাবা তাকে কাঁচা ঘুম থেকে ডেকে তুলেছিল বলে মা চোখ-মুখ গুটিয়ে বাবার দিকে বিরক্ত চোখে তাকিয়ে ছিল। জাহানারার অবশ্য মায়ের দিকে অত খেয়াল ছিল না। সে তার পুতুল দেখতে ব্যস্ত ছিল। আকিব তার পাশেই বসা, দুই ভাইবোন একে একে ঝুড়ি থেকে পুতুল বের করছিল। তখন হঠাৎ বাইরে থেকে বড় চাচির গলার আওয়াজ পাওয়া গেল। রাত তখন বেশ হয়েছে। এত রাতে চাচির গলা শুনে বিপদ-আপদের আশঙ্কায় মা-বাবা অনেকটা দৌড়ে গেল বাইরে। আকিবও তার পিছু নিল। সবাইকে বাইরে ছুটতে দেখে জাহানারাও কৌতূহলী হলো। বিছানা থেকে নেমে সেও এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালো দরজার মুখে। সেখানে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকতেই চোখ পড়লো বড় চাচির রাগে গনগনে লাল মুখটায়। চাচির চোখে পানি, সবসময় মাথায় থাকা ঘোমটাটা অনাদরে পড়ে আছে ঘাড়ের উপর। চুল উশখুশ। বিধ্বস্ত অবস্থা তার। বড় চাচিকে ওভাবে দেখে একটু ভালো লাগলো না জাহানারার। ইচ্ছা করলো দৌড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করতে তার কী হয়েছে। কিন্তু কেন জানি সাহস হলো না। এরমধ্যে জাহানারার কানে বাজলো চাচির বলা কথাগুলো। দিপ্তী আপু তার নানু বাড়ি থেকে বের হয়ে নিশান ভাইয়ের সাথে কোথায় যেন চলে গেছে। চাচি আম্মুর কাছে জানতে চাইছে তারা কোথায়। আম্মু এত বলছে সে জানে না, কিন্তু চাচি শুনছে না। তার এক কথা, দিপ্তী তার সাথে সব কিছু বলে, সে সব জানে। বাবাও চাচির কথা শুনে গমগমে গলায় দুই বার বলল,

– “সালেহা, তুমি কিছু জানলে লুকিও না।”

বাবার কথা শুনে আম্মুকে আরো অসহায় দেখালো। সে অসহায় ভাবে বলল,

– “বিশ্বাস করো, আমি কিছু জানি না।”

– “তোমার নাকের নিচে সব কিছু হয়েছে, আর তুমি বলছো তুমি কিছু জানো না! এই কথা কিভাবে বিশ্বাস করবো আমি, সালেহা? যাই হোক, সেসব আমি কিছু জানতে চাইছি না। আমি শুধু জানতে চাই আমার মেয়ে কোথায়! আমি তাকে দেখতে চাই।”

বড় চাচির উচ্চ গলার শব্দ মেজ চাচাদের বাড়ি পর্যন্ত গিয়েছিল হয়তো, তাই তো মেজ চাচা, মেজ চাচি সেই রাতে উপস্থিত হলো তাদের বসার ঘরে। তাদের আগমনে বড় চাচির মুখে আরো অন্ধকার নামলো। জাহানারা ড্যাবড্যাব চোখে দেখলো সেটা। ছয় বছর বয়সে পরিস্থিতির গম্ভীরতা বুঝতে সে না পারলেও এটা বুঝতে পারলো, খুব খারাপ কিছু হয়েছে। মেজ চাচা, মেজ চাচি আসার ঠিক সঙ্গে সঙ্গে বড় চাচা আর দাদি এলো সেখানে। বড় চাচা গম্ভীর কণ্ঠে বড় চাচির উদ্দেশ্যে বলল,

– “তানিয়া, বাড়ি চলো। দিপ্তী ঢাকায় আছে। বিয়ে করছে সে নিশানকে। টেলিফোন করেছিল।”

বড় চাচার কথা শোনা মাত্রই মেঝেতে থপ করে বসে পড়লো বড় চাচি। রক্তলাল চোখের কর্ণিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো পানি। দিপ্তী আপু আর নিশান ভাইয়ের বিয়ের কথা শুনে জাহানারার আনন্দ লাগলেও চাচির অবস্থা দেখে সে চমকে উঠলো। চাচির চোখে পানি দেখে তার কেমন কেমন যেন লাগলো। এর মধ্যে ঘরের নিরবতা ভেদ করে মেজ চাচি টিপনি কাটলো,

– “এ তো হবারই ছিল। দুইজন রাস্তাঘাটে যে পরিমাণ হাসাহাসি-কেলাকেলি করতো, আমি তো আগেই বুঝেছিলাম কিছু চলছে ওদের মাঝে। সালেহাকে তো বলেও ছিলাম, কিন্তু ঐ তো বলল, তেমন কিছু না। ওরা ভাইবোনের মতো!”

– “আহ! ডালিয়া!”

মেজ চাচির কথার মাঝে ধমক দিয়ে তাকে চুপ করালো মেজ চাচা। তবে খুব একটা লাভ হলো না তাতে। বড় চাচি তার কথা শুনে চোখের পানি মুছে উঠে দাঁড়ালো। আম্মুর দিকে আঙুল উঁচিয়ে বলল,

– “তুমি আমার যে সর্বনাশ করলে, সেটা আমি কোনদিন ভুলবো না, সালেহা।”

আর দাঁড়ালো না চাচি, বৃষ্টি মাথায় বেরিয়ে গেল তাদের বাড়ি থেকে। সেদিনের পর তিন বাড়ির যাতায়াতের জন্য যে ছোট্ট একটা দরজা ছিল, সেটাতে তালা পড়লো। তৃপ্তি আপুর আনা-গোনা বন্ধ হলো দুই বাড়ি। আদিব ভাইকেও কিছুদিন সেভাবে দেখা গেল না আর। জাহানারা বড় চাচার বাড়ি যেতে চাইলে আম্মু বকে-ধমকে তাকে ঘরে আটকালো। তারপরও একদিন অনেক জেদ করে দাদির সাথে গিয়েছিল সে বড় চাচার বাড়ি। চাচিকে দেখে দৌড়ে গিয়েছিল তার কাছে। কিন্তু চাচি কথা বলেনি তার সাথে, মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল অবহেলায়। দিন প্রতিদিন বড় চাচির বদলে যাওয়া আচরণ জাহানারাকে উপলব্ধি করিয়েছিল, সে আর চাচির কাছে ঘেঁষতে পারবে না, তার থেকে আদর-আহ্লাদ পাবে না। তার সেই উপলব্ধি আস্তে দূরে সরিয়ে এনেছিল তাকে চাচির থেকে, তৈরি করেছিল সম্পর্কে ব্যবধান।

কোন একসময় যেই মানুষটার প্রতিচ্ছবি হতে চেয়েছিল, সেই মানুষটার প্রতিদ্বন্দ্বী হবে, সেটা কখনো ভাবেনি জাহানারা। অথচ আজ দেখ! সময়! সত্যি বড় নিষ্ঠুর!একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করলো জাহানারা।

কিছু সময় পর জায়েদের আগমন হলো। সে একা আসেনি, আকিবকে সাথে নিয়ে এসেছে। স্ত্রীর মৃত্যুর পর মানসিকভাবে অনেকটা ভেঙে পড়েছে জায়েদ। এখন খারাপ কিছুর আশঙ্কা দেখলেই কেন জানি ছেলেকে ছাড়া বের হতে চায় না বাড়ি থেকে। তানিয়া ভেবেছিল বাবাকে দেখে জাহানারার অভিব্যক্তি পরিবর্তিত হবে, তবে তাকে অবাক করে দিয়ে সে ভাবলেশহীন ভাবে বসে রইলো। ভদ্রতার খাতিরে বসা থেকে উঠলো পর্যন্ত না। তানিয়া তার ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ দেখে মনে মনে একটু অবাক হলো। সে যে জাহানারাকে চিনতো, সে একটু বোকা-বোকা ফটফটে হলেও এত বেয়াদব তো ছিল না। তার চেনা-জানা জাহানারার সাথে এই জাহানারাকে সে মিলাতে পারলো না।

জায়েদ ব্যস্ত পায়ে এগিয়ে এলো বড় ভাবির কাছে। জানতে চাইলো হঠাৎ কী কারণে এত জরুরি তলব। তানিয়া তার কথার উত্তরে বলল, সাজ্জাদ আর নাফিজা আসুক, তারপর সে কথা বলবে। জায়েদ আর এরপর কিছু বলার সাহস পেল না। আকিব অবশ্য নেহার কাছে বার দুয়েক জানতে চাইলো ঘটনা কী, কিন্তু নেহা কিছু বলল না। জাহানারাকে ওভাবে বসে থাকতে দেখে আকিব একবার চাচির কাছে জিজ্ঞেস করলো, তার বোন কিছু করেছে কিনা? প্রতি উত্তরে তানিয়া তাচ্ছিল্য হাসলো। আকিব অজ্ঞাত জাহানারাকে প্রশ্ন করলো, কিন্তু সেও উত্তর দিল না। এর মধ্যে সাজ্জাদ আর নাফিজা এসে উপস্থিত হলো। তানিয়া আর সময় অপচয় করলো না। জাহানারার বিষয়ে সবটা পাই টু পাই খুলে বলল সকলকে। সব শুনে কিছু সময়ের জন্য স্তম্ভিত হলো জায়েদ। আকিব অবিশ্বাস্য কণ্ঠে বলে উঠলো,

– “আমি আপনার কথা বিশ্বাস করছি না, চাচি।”

– “আমার কথা বিশ্বাস না হলে বোনের কাছে শোনো। ঐ তো বসেই আছে।”

আকিব জাহানারার বাহু ধরে তার দিকে ফেরালো। জেরা করলো,

– “চাচি যা বলছে, সব সত্যি?”

– “হ্যাঁ।”

আকিব ভাষা হারালো নিজের। অপরাধী যেখানে নিজে অপরাধ স্বীকার করছে, সেখানে আর কী বলবে! হতভম্ব চোখে সে তাকিয়ে রইলো বোনের দিকে। নাফিজা আহাজারি করে উঠলো,

– “ও মা, এরকম করলি কেন? জীবনটা কি নাটক-সিনেমা! ও আল্লাহ!”

– “জাহান, এমন করলে কেন?”

সাজ্জাদের দারাজ কণ্ঠ। জাহানারা একটু যেন ঘাবড়ালো। তবে সেটা প্রকাশ করলো না। কোনোমতে বলল,

– “আমি আমার কাজের এক্সপ্লিনেশন দিতে চাইছি না কারো কাছে।”

জাহানারার রূঢ় গলায় কথাটা বলতেই মেজাজ চড়লো আকিবের। চাচার সাথে এমন বেয়াদবি পছন্দ হলো না তার। রাগে ফুঁসে উঠলো সে। হাত উঠাতে গেল বোনের গায়ে, কিন্তু মাঝপথেই হাত আটকে দিল কেউ। নিজের কাজে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে রাগান্বিত চোখে পাশ ফিরে তাকালো সে। আদিবের মুখটা দেখে জ্বলে ওঠা রাগ যেন দুপ করে নিভে গেল তার। আদিব তার হাত ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। বুকে হাত বেঁধে বলল,

-কথায় কথায় গায়ে হাত তোলা খুব খারাপ অভ্যাস, আকিব ভাই। সে আপনার বোন, থানার অপরাধী নয়।

ঠোঁটে একটুকরো ছোট্ট হাসি টেনে কথা শেষ করল আদিব। এরপর মায়ের দিকে একবার তাকিয়ে, তারপর দৃষ্টি ফেরাল জাহানারার দিকে। জাহানারা তখনো একই জায়গায় গ্যাঁট হয়ে বসে আছে। এই কারণেই সে জাহানারা কে কখনো পছন্দ করতে পারেনি-এত ত্যাড়া মেয়েটা!

ঘরের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে আদিব বুঝতে পারল, তার মা ইতিমধ্যেই যা বলার সব বলে ফেলেছেন। দুই দিকে মাথা নাড়লো সে, এই দুই ভদ্রমহিলার মাঝে তার আগত জীবন কেমন হতে চলেছে সেই ভবিষ্যৎ চিন্তায় হতাশ শ্বাস ফেলল।

– জাহানারা, বাড়ি চলো।

জায়েদের থমথমে কণ্ঠে চমকে তাকাল জাহানারা। চোখ মুহূর্তেই অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠল। প্রায় এগারো বছর পর সরাসরি তাকে কিছু বলল জায়েদ! জাহানারা বাবার দিকে তাকাতেই তিনি দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলেন অন্যদিকে। সেই মুহূর্তে জাহানারার ভেতরটা ক্ষোভে জ্বলে উঠল। অশ্রুসিক্ত চোখ রক্তিম হয়ে উঠল। জেদ ধরে বলল,

-যাব না! আর আপনি কোন অধিকারে আমাকে আদেশ করছেন?

জাহানারার রোষপূর্ণ কণ্ঠ। উপস্থিত সবাই হতবাক হয়ে তার দিকে তাকাল। জায়েদও বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ বাকরুদ্ধ হয়ে মেয়ের দিকে চেয়ে থাকার পরও কিছু বলতে পারলেন না। জাহানারা বাবার দৃষ্টি লক্ষ্য করে বলল,

-ওভাবে তাকিয়ে আছেন কেন! আমি কি ভুল কিছু বলেছি? বরং আপনিই হয়তো কিছু ভুলে গেছেন! সমস্যা নেই, আমি মনে করিয়ে দিচ্ছি। এগারো বছর, তিন মাস, নয় দিন আগে, আপনি সর্বসমক্ষে আমাকে ত্যাজ্য করেছিলেন। আমার প্রতি আপনার থাকা সব দায়-দায়িত্ব থেকে নিজেকে মুক্ত ঘোষণা করেছিলেন। বলেছিলেন, আমার ওপর আপনার আর কোনো অধিকার নেই, আমারও আপনার কাছে চাওয়া পাওয়া নেই। তাহলে আজ আপনি কোন ভিত্তিতে আমাকে আদেশ দিচ্ছেন?

– জাহান!

– চেঁচাবেন না, ভাই! যা সত্যি, সেটাই বলছি আমি। এত বছর ধরে যা মেনে এসেছি, সেটাই উচ্চারণ করেছি মাত্র। তোমার বাবা আমার কেউ নন, সুতরাং তার আমাকে কিছু বলার অধিকার নেই! নেই!

শেষ কথাগুলো উচ্চস্বরে বলে উঠে দাঁড়াল জাহানারা। সঙ্গে সঙ্গে পায়ের ব্যথায় পুরো শরীর কেঁপে উঠল, কিন্তু সেই ব্যথাকে উপেক্ষা করেই সে সামনে এগিয়ে গেল। রাগে, জেদে, আহত পায়ে আরো যন্ত্রণা দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেল। পেছনে ফেলে গেল হতভম্ব কিছু মুখ।

– কি সাংঘাতিক! আদিব, তুই এই মেয়ে নিয়ে সংসার কিভাবে করবি?

তানিয়ার কথায় ঘরের নীরবতা ভাঙ্গল।আদিব মায়ের কথা উপেক্ষা করে সেজ চাচার দিকে তাকালো ।বুঝতে চেষ্টা করল তার মনের অবস্থা।সেজ চাচার মুখ দেখে খুব একটা অসুবিধা হলো এটা বুঝতে যে, জাহানারার বলা কথাগুলো মানুষটাকে মা’রা’ত্মক ভাবে আহত করেছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে গলা ঝাড়া দিল আদিব। বলল,

– সেজ চাচা, জাহানারা এখন আমার স্ত্রী। আমি সব জেনে-শুনেই তাকে বিয়ে করেছি, পুরোপুরি সজ্ঞানে। আমাদের বিয়েটা সত্যি হয়েছে, এখন চাইলেও অস্বীকার করা যাবে না। আর আমি তা চাইও না। আমি জাহানারার সঙ্গে একটা সুস্থ, স্বাভাবিক সম্পর্ক চাই। যা হয়েছে, তা অতীত, আপনারা দয়া করে সব ভুলে যান।

আদিবের এই কথার পর আর কেউ কিছু বলার সাহস পেল না। যখন সে-ই ভুক্তভোগী হয়ে সবকিছু সহজে মেনে নিচ্ছে, তখন অন্য কারও কিছু বলার থাকতে পারে না!

বাকি সবাই স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেও তানিয়া পারল না। ছেলের এই অতিরিক্ত ভালোমানুষী দেখে রাগ হলো তার ছেলের উপর। ঠিক আছে, বিয়েটা হয়ে গেছে, মেয়েটাকে নিয়েই তাকে বাকি জীবন কাটাতে হবে, তা সে মানছে। তাছাড়া আর কিছু করারও নেই।তানিয়া নিজেও চায়না ছেলের বিয়েটা ভাঙুক। ডিভোর্স টিভোর্স তাদের চৌদ্দ গুষ্টিতে নেই,ছেলেকে দিয়ে সেটা শুরুও হতে দেবে না সে। মেয়েটা যেমন‌ই হোক ,এখন তার সাথেই সংসার করতে হবে ছেলেকে।
তাই বলে মেয়েটাকে এতো সহজে মেনে নিবে!যা ইচ্ছা তাই করতে দেবে!একটু শাসন বারণ না করলে হবে!এমনিতে বেয়াদব মেয়ে এরপর তো তার ছেলের এমন মহনাতা দেখে তার মাথায় চড়ে বসবে!

– বাড়ি চলো, আকিব। আমাদের আর এখানে থাকার প্রয়োজন নেই।

আর দাঁড়ালেন না জায়েদ। ভারী পা দুটো টেনে নিয়ে ধীর পায়ে বেরিয়ে গেল বাইরে।

চলবে, ইনশাআল্লাহ।

# সৌরকলঙ্ক
# উম্মে প্রভা
# পর্ব ২২

– চাচার সাথে এভাবে কথা বলা উচিত হয়নি তোর!

– আমাকে উচিত-অনুচিত শিখাতে হবে না তোকে। যা করেছি, বেশ করেছি। তোর চাচা আমার সাথে যা করেছে, তার তুলনায় আমি কিছুই বলেনি। শুধু তার বলা কথাগুলোই তাকে শুনিয়েছি। আর কেউ না জানুক, তুই তো জানিস—আমার আজকের এই অবস্থার জন্য পরোক্ষভাবে তোর চাচা দায়ী। আমি কখনো ঐ আদিবের দিকে তাকাতাম? কখনো না। তোর চাচার জন্য তাকিয়েছি। তার জন্য নিজের মনকে কনভিন্স করেছি যে ঐ আদিব আমার ভবিষ্যৎ। নিজের চাওয়ার আগে তোর চাচার ইচ্ছা প্রাধান্য দিয়েছি। একটা অপছন্দনীয় মানুষকে পছন্দ করেছি। আমার জন্য এটা কত কষ্টের ছিল, জানিস? কিন্তু যার জন্য এসব কিছু করলাম, সে কি করলো? আমাকে দোষী করে বনবাসে দিলো। শুধুমাত্র ঐ মানুষটার জন্য আমি আমার মায়ের থেকে দূরে থেকেছি। শেষ সময়টাতে পর্যন্ত…

গলা ধরে এলো জাহানারার। টলমল করলো চোখ, কেঁপে উঠলো গলা। নিতুর খুব খারাপ লাগলো। মুঠোফোন টা হাত বদল করে অন্য কানে ধরলো। বুক চিরে বেরিয়ে এলো এক লম্বা দীর্ঘশ্বাস।

নাফিজার বড় জা যেদিন জাহানারার জন্য সম্বন্ধ নিয়ে জায়েদের বসার ঘরে হাজির হয়েছিল, সেদিন কাকতালীয়ভাবে নিতু আর জাহানারা ঘরের দরজার পিছনেই দাঁড়িয়ে ছিল। তখন অপ্রত্যাশিতভাবে কানে আসে তাদের ভেতরের সব কথোপকথন। নিতু আদিব ভাইয়ের সাথে জাহানারার ভবিষ্যৎ সম্পর্কের কথা শুনে খুশিতে নেচে উঠলেও জাহানারার ওপর যেন বজ্রপাত হলো। আদিবকে তার কোনো কালেই পছন্দ ছিল না। ঠিকঠাক চেহারার গোমড়া মুখো একটা ছেলে। কথা বলে দাঁড়ি-পাল্লায় ওজন করে। ভালো রেজাল্টের ভারে মাটিতে পা পড়ে না তার। এমন একটা মানুষকে জাহানারার জন্য নিজের জীবনসাথী হিসেবে ভাবাও কষ্টকর ছিল। সে তো দাদির মুখে কথাটা শোনামাত্র ভেতরে যেতে উদ্বত হচ্ছিল, ঠিক তখন বাধা দিল নিতু। ফুপুর বড় জা এমনি মিষ্টি মিষ্টি কথা বললেও মানুষ সুবিধার না, জাহানারা তার সামনে উল্টোপাল্টা কিছু বললে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। এসব ভেবে জাহানারাকে কোনো রকমে সামলে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে নিজের সাথে বাড়ি নিয়ে গেল নিতু।

জাহানারা সেদিন তার সাথেই ছিল। নিতু বাড়িতে একা। বাবা-মা বড় আপুকে নিয়ে রাজশাহী গেছে। ভর্তি পরীক্ষা বড় আপুর। যাওয়ার সময় তার মা সেজ চাচিকে বলে গেছে, জাহানারা যেন আজ রাতটা নিতুর সাথে থাকে। সালেহা সচরাচর মেয়েকে কারো বাড়ি রাত থাকতে দেয় না, কিন্তু নিতু একা থাকবে—চিন্তা করে আপত্তি করেনি। তাছাড়া সাজ্জাদের বাড়ি গোছানো, সদর দরজায় একটা তালা মারলেই সব সুরক্ষিত। দুই বোনের কোনো সমস্যা হবে না। সালেহার চিন্তার কারণ নেই।

সেই রাতে জাহানারা কাঁদতে কাঁদতে বন্যা বইয়ে দিল। সে কিছুতেই আদিবকে বিয়ে করবে না। দরকার পড়লে বাড়ি থেকে পালিয়ে যাবে, এই করবে, ঐ করবে—ইত্যাদি ইত্যাদি। জাহানারার কথাবার্তা শুনে নিতুর মনে হলো, সে বেশি বাড়িয়ে বলছে। আদিব ভাইয়ের মতো ভদ্র-সভ্য ছেলে আর একটা নেই এই তল্লাটে। দেখতে একেবারে বিশ্রী নয়। জাহানারার প্যানপ্যানানিতে সে বিরক্ত হলো, কিন্তু সেই মুহূর্তে কিছু বলা সমীচিন মনে করলো না। সে তো চেনে জাহানারাকে কিছু বললেই তেতে উঠবে। চুপচাপ জাহানারার সব কথা শুনলো নিতু। একসময় জাহানারা শান্ত হলো। ঠিক তখন নিতু বলল,”আদিব ভাই কথা কম বলে, কিন্তু খারাপ না। তাছাড়া সেজ চাচা আদিব ভাইকে খুব পছন্দ করে।”অনেকটা ভয়ে ভয়ে কথাটা বলল নিতু।

নিতুর কথায় থমকালো জাহানারা। গভীর ভাবনায় মগ্ন হলো। এরপর আর একটা ‘টু’ শব্দ করলো না সে। নিজের বালিশ টেনে ঘুমিয়ে পড়লো। নিতুও আর তাকে খোঁচালো না। সকালে ঘুম থেকে উঠতেই মা-বাবাকে বাড়ি দেখে জাহানারার সাথে আর এ বিষয়ে কথা বলতে পারল না।

এরপর কোচিংয়ে মডেল টেস্টের চাপে জাহানারার সাথে বেশ কয়েকদিন দেখা সাক্ষাৎ হলো না। এক বিকেলে সেজ চাচি এসেছিল বাড়ি। তার থেকে জানতে পারলো, জাহানারার না কি ভীষণ জ্বর। জ্বরের তোড়ে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না সে।নিতু কথাটা শুনে তখনই ছুটে গেল জাহানারার কাছে। গিয়ে দেখলো, বেহুঁশের মতো বিছানায় পড়ে আছে জাহানারা। তার উপস্থিতি টের পেয়ে চোখ মেলে তাকালো। ম্লান হেসে বলল, “আমি মনে হয় মরে যাবো। ভালোই হবে, পড়াশোনার ঝামেলা চুকে যাবে।”

ওর কথা শুনে বিরক্ত হয়ে নিতু বলল, “ফালতু কথা বলবি না।”

নিতুর কথা শুনে দাঁত বের করে হাসলো জাহানারা। নিতু ঘণ্টাখানেক বসলো তার পাশে। তারপর জাহানারা ঘুমিয়ে পড়তেই বাড়ি ফিরে এলো।

এর দুই দিন পর নিতু যখন আবার জাহানারা কে দেখতে গেল, তখন জাহানারা অনেকটা সুস্থ। নিতুকে দেখেই সে বলে উঠলো,

– নিতু, আমি ঠিক করেছি—আব্বু যা বলবে, তাই হবে। আব্বু যদি চায় আমি আদিব ভাইকে বিয়ে করি, তাহলে সেটাই হবে।

– তুই কি আদিব ভাইয়ের সাথে বিয়ের কথা শুনে শোকে শোকে জ্বর বাধিয়েছিলি?**

চোখ সরু করলো নিতু। সে জানে, জাহানারা কোনো জিনিস মেনে নিতে না পারলে মনের শোকে শরীর তাতায়। এটা নতুন না।তাই তো জাহানারা কথা উপেক্ষা করেই প্রশ্ন করলো নিতু। জাহানারা নিতুর কথা শোনেইনি, এমন ভাব করে ফের বলল,

– আমি আব্বুর জন্য জীবনে কিছুই তো করতে পারলাম না। অন্তত তার মনমতো জামাই পাওয়াতে বাধা না দিই। কি বলিস?

একটা সূক্ষ্ম ম্লান হাসিতে নিজের কথা শেষ করলো জাহানারা। কথা যখন সেজ চাচার বিষয়ে হয়, ব্যাপার তখন ভিন্ন। সেই সময় কোনো কথা বলা চলে না। কিন্তু তবুও নিতু কথা বলল,

– মনের ওপর জোর দিয়ে কিছু করিস না। হ্যাপি থাকতে পারবি না। তোর খুশি চাচার কাছে তার খুশির থেকে বড়!

– জানি তো। জেনে-বুঝেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। চিন্তা করিস না, আমি হ্যাপি থাকবো।

জাহানারার আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠ। নিতু আশ্বস্ত হলো। এরপর কী দিয়ে কী হলো, কে জানে—জাহানারা নিজমনে একটু একটু করে ঝুঁকতে লাগলো আদিব ভাইয়ের দিকে। নিতু সেটা দেখলো, বুঝলো, কিন্তু কিছু বলতে পারলো না।

দিনগুলো এভাবেই গড়াতে থাকলো। জাহানারা নিজের মনে জোর করে করা আপসের সিদ্ধান্তকে ধীরে ধীরে ভালোলাগার যুক্তিতে রূপান্তরিত করলো। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই ভালোলাগা একসময় গভীর ভালোবাসায় পরিণত হলো। কিশোরী হৃদয়ে জন্ম নিলো এক অকৃত্রিম ভালোবাসা, যা সব বাধা অতিক্রম করার সাহস রাখে।নিতু জাহানারার সেই ভালোবাসার সাক্ষী হলো।

ঠিক তারপর আসলো সেই টালমাটাল দিন গুলো।একদিন নিতুর কানে এলো বড় চাচির সুপ্ত মনোকামনা। বড় চাচি তার বোনের মেয়ের সাথে বিয়ে দিতে চায় ছেলের। কথাটা শোনামাত্রই নিতুর গলা-বুক শুকিয়ে এলো। ইতিমধ্যে জাহানারা আদিব ভাইকে যে ভাবে ভালোবেসে ফেলেছে, চাচির ইচ্ছা শুনলে জাহানারা কি করবে—সেটা ভেবে ভেতরে ভেতরে ভয় দানা বাঁধলো নিতুর। সময় অপচয় না করে জাহানারাকে সে কথাটা জানালো। যদিও জানতো, তখন আর কিছু করার নেই। জাহানারা ততদিনে আদিব ভাইয়ের প্রেমে গলা পানিতে ডুবুডুবু।

– দোষ আমার ছিল, না? আমিও মানছি, দোষ আমার ছিল। কিন্তু তোর চাচা আমার মায়ের গায়ে হাত তুলল কেন? আমার মা তো কিছু করেনি, তাকে দোষ দিল কেন? আমি তোর চাচার ভরসায় ঐ ছেলের দিকে পা বাড়িয়েছিলাম। আমার বিশ্বাস ছিল, আমার জীবনে ভালো-খারাপ সব পরিস্থিতিতে সে আমার পাশে থাকবে। কিন্তু সে পাশে থাকা তো দূর, আমাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিল। ছোট চাচু না থাকলে তো আমি মরেই যেতাম। যখন আমার তার প্রয়োজন ছিল, তখন যেহেতু সে আমার পাশে থাকেনি—তাহলে এখন তার মাতব্বরি আমার দরকার নেই।

রাগে গজগজ করতে করতে বলল জাহানারা। পানি ভর্তি চোখে আগুনের আঁচ তার। চোখের পানি সামলানোর চেষ্টা করলো সে, কিন্তু তার চোখের পানি তার মতোই অবাধ্য। তার সকল চেষ্টাকে ব্যর্থ করে গড়িয়ে পড়লো চোখের কর্ণিশ বেয়ে। নিজেকে সামলানোর চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে রাগ হলো খুব। সঙ্গে সঙ্গে হাতের ফোনটা সজোরে ছুঁড়ে মারলো সামনে। ভারি ফোনটা আছড়ে পড়লো টাইলসের ফ্লোরে। নেহা আৎকে উঠলো দৃশ্যটা দেখে। তার অতি সাধের আইফোনটা মাটিতে গড়াগড়ি খেতে দেখে বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো। জাহানারার দিকে অসহায় চোখে তাকালো সে।

রাগের মাথায় তার ম্যাডামের জিনিসপত্র ছুঁড়ে ফেলার অভ্যাস পুরোনো, কিন্তু আজ পর্যন্ত ফোন ভাঙার রেকর্ড নেই। আজ তার ফোনটা ভেঙে সেই রেকর্ড তৈরি করলো ম্যাডাম। নিজের ওপর রাগ হলো তার। মনে হলো, কেন শুধু শুধু নিতু আপুকে ওসব বলতে গেল? তাকে কিছু না বললে সে ম্যাডামের সাথে কথাও বলতে চাইতো না, ম্যাডাম এমন তেতেও উঠতো না, তার ফোনটাও ভাঙতো না। কিন্তু তারই বা কি দোষ? ম্যাডামের হুকুম—নিতু আপু ফোন করলে যে পরিস্থিতিতেই থাকুক না কেন, কল রিসিভ করতে হবে। সে তো সেই আদেশই পালন করছিল। তাছাড়া কিছু না।

– নেহা, তোমাকে লাস্ট বার বলছি—আমার বিষয়ে কাকে কি বলতে হবে, সেটা আমাকে জিজ্ঞেস না করে আগ বাড়িয়ে কিছু বলবে না।

নেহাকে শাসিয়ে বলল জাহানারা। নেহা একটা শুকনো ঢোক গিলল। জাহানারার উত্তপ্ত দৃষ্টির সামনে নিজের নজর ঝুঁকালো। কোনো রকমে স্বপক্ষে সাফাই দিল,

– স্যরি ম্যাম, আসলে তখন নিতু আপু ফোন করেছিল। উনি আপনার গলা শুনে জিজ্ঞেস করলো, কি হয়েছে?তাই …

-তাই তুমি গড়গড় করে সব বলে দিলে। তোমার কোনো সেন্স নেই। বুঝতে পারো না—সব কথা সবাইকে বলতে হয় না? এই বুদ্ধি নিয়ে তুমি আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট হয়েছ?

– সবাই আর নিতু আপু তো এক না, ম্যাম!

– মুখে মুখে তর্ক করবে না, নেহা!

নিতু আর বাকি সবাই এক না—জাহানারার কাছে। এই জরুরি পার্থক্যটা জাহানারা খুব স্পষ্টভাবে বুঝিয়েছিল নেহাকে। নেহা তার কথা মতোই সেটা অক্ষরে অক্ষরে মেনেছে। এখানে নেহার কোনো দোষ নেই, সেটা জাহানারাও ভালো জানে। কিন্তু তার রাগ তো আর সেটা জানে না। রাগ তো তার জায়গা খুঁজছে কারো উপর আঁছড়ে পড়ার। নেহা হয়তো বুঝলো জাহানারা মনের অবস্থা,সে আর প্রতিউত্তর না করে বিনা অপরাধে ক্ষমা চাইলো।

**- স্যরি ম্যাম।**

নেহার আত্মসমর্পনে জাহানারার রাগের পারদ নামলো কি না—বোঝা গেল না। নেহা আড়চোখে একবার তাকালো জাহানারার দিকে। ঠোঁট কামড়ে বসে আছে সে, নজর মেঝেতে পড়ে থাকা ফোনের দিকে। শীতল দৃষ্টি তার। জাহানারার দৃষ্টি অনুসরণ করে চোখ সরাতেই নেহার চোখ গেল জাহানারার পায়ের দিকে। জাহানারার পায়ের দিকে লক্ষ্য করতেই দেখতে পেল, সাদা ব্যান্ডেজ রক্তে ভিজে উঠছে।এই মুহূর্তে নেহার ভীষণ মায়া হলো জাহানারার জন্য। একবার ভাবলো,এগিয়ে গিয়ে ব্যান্ডেজটা বদলে দিবে, কিন্তু পরক্ষণেই জাহানারার অগ্নিমূর্তি স্মরণ করে সাহস হলো না আগাতে। অজ্ঞাত নিরুপায় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো নিজের জায়গায়।

– নেহা, বাইরে যাও। তোমার ম্যাডামের সাথে কথা আছে আমার।

ঘরে ঢুকেই গম্ভীর কণ্ঠে নেহাকে উদ্দেশ্য করে কথাটা বলল আদিব। আদিবের হঠাৎ আগমনে, অন্যমনস্কতার দরুন চমকে উঠলো নেহা। জাহানারা অবশ্য স্থির র‌ইলো।আদিবের আকস্মিক আগমনে তার মধ্যে কোন ভাবান্তর হলো না। আদিবের কথাটা বোধগম্য হতেই তড়িঘড়ি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল নেহা।

নেহা চলে যেতেই আদিব গিয়ে দাঁড়ালো জাহানারার সামনে। শীতল কণ্ঠে বলল,

– সবসময় এত বি’ষ উগলাও কেন?

– মুখ সংযত করে কথা বলুন।

– আমাকে বলার আগে নিজের মুখ সংযত করো। কোন সাহসে সেজ চাচুর সাথে ওভাবে কথা বললে তুমি? একবারো বুক কাঁপলো না তোমার?

বাবাকে কথাগুলো বলার সময় শুধু বুক না ,পুরো ভেতরটা কাঁপছিল জাহানারার। কথাগুলো জোর করে গলা চিরে বের করেছিল সে। বাবাকে যতটা কষ্ট দিতে কথাগুলো বলেছিল, তার থেকে দশগুণ কষ্ট সে নিজে পেয়েছে। ভেতরটা ছারখার হয়ে গেছে তার। আদিবের কথাটা তাকে যেন আবার তখনকার সেই অনুভূতিটা ফেরত দিল।সাথে সাথে নিভে যাওয়া রাগটা দাউদাউ করে জ্বলে উঠলো। মনে পড়লো—সব কিছুর জন্য এই ছেলেটা দায়ী। শুধুমাত্র এই ছেলেটা। নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারালো সে। তীব্র আক্রোশের সহিত বলে উঠলো,

– আই হেইট ইউ, আদিব আহাসান।

জাহানারা এভাবে ফুঁসে ওঠায় হতবুদ্ধ হলো আদিব। এমন প্রতিক্রিয়া একেবারেই অপ্রত্যাশিত ছিল তার।ভ্রূতে ভাঁজ পড়লো আদিবের।

চলবে, ইনশাআল্লাহ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ
পরবর্তী নিবন্ধ
গল্প পোকা
গল্প পোকাhttps://golpopoka.com
গল্পপোকা ডট কম -এ আপনাকে স্বাগতম......
RELATED ARTICLES

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments

Md masrur Hasan mahi على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
আমিনুল ইসলাম على প্রয়োজন পর্ব: ৩০ ( অন্তিম)
সাজিবুল ইসলাম على ধর্ষিতাবউ২ ৯ তথা শেষ পর্ব
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
Nita Sarkar على স্বপ্নীল ৬৮
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على রহস্য শেষ_পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على অলক্ষ্যে তুমি পর্ব-০৬ এবং শেষ পর্ব
Nazmun Nahar Akhi على Psycho_is_back? part_7
Nazmun Nahar Akhi على Dangerous_Villian_Lover part 2
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على জানালার ওপারে পর্ব-১৭ এবং শেষ পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على লীলা বোর্ডিং ১২১৫ পর্ব-১১ এবং শেষ পর্ব
মিজানুর রহমান রাহুল على সেই তুমি পর্ব-০১
@feelings على প্রহেলিকা
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Nusrat jahan على coffee & vanilla Part-10
Pallabi Roy على স্বপ্নীল ৬৮
M.D Mahabub على The_Villain_Lover Part_2
Labani sarkar على Dangerous_Villain_Lover part 23
MD Akas Apc على বিবেক
Tanisha Ahmed على Devil love part-18 
Aius Barmon shorob على নারীর দেহকে নয়
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Priya Banerjee على devil love married life last part
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Riya Biswas على তুমি রবে ৫২
Mohammad Adib على তুমি রবে ৬০
Avni Ayesha على তুমি রবে ২৮
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
সুমিত على তুমি রবে ২৮
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
Samiah Begum على তুমি রবে ৫১
biddut das rocky على নর নারী
গল্প পোকা على নষ্ট গলি শেষ পর্ব
Md Jobayer Hossain Shohag على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على দুই অলসের সংসার
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤৪২.
A.J.S Rakib على মন ফড়িং ❤৪২.
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
Samiya noor على গল্পঃ ভয়
Sadikul على গল্পঃ ভয়
Samia Islam على গল্পঃ ভয়
শূন্য মায়া على মন ফড়িং ❤ ৪০.
Sutapa biswas على মন ফড়িং ❤৩৯.
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৮.
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৭
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
Siyam على বিবেক
Sudipto Guchhait على My_Mafia_Boss পর্ব-৯
saptami karmakar على devil love married life last part
saptami karmakar على devil love married life last part
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ২৬.
Shreyashi Dutta على  বিয়ে part 1
Sandipan Biswas على  বিয়ে part 1
Paramita Bhattacharyya على অনুরাগ শেষ পর্ব
জামিয়া পারভীন তানি على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
মায়া على মন ফড়িং  ২২
সুরিয়া মিম على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على মন ফড়িং ২১
গল্প পোকা على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
Sahin ssb على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৮. 
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৭.
Jannatul Ferdous على খেলাঘর পর্ব-৩৫
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ফাল্গুনের_ফুল last_part_8
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ছাত্রী যখন বউ পাঠঃ ১
গল্প পোকা على বাজির প্রেম পাঠঃ ১
Foujia Khanom Parsha على মা… ?
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৮
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
Ibna Al Wadud Shovon على স্বার্থ