Monday, October 6, 2025







বাড়ি"ধারাবাহিক গল্প"সৌরকলঙ্কসৌরকলঙ্ক পর্ব-১৭+১৮+১৯

সৌরকলঙ্ক পর্ব-১৭+১৮+১৯

#সৌরকলঙ্ক
#উম্মে_প্রভা
#পর্ব_১৭

– তৃপ্তি শিমুলকে আরেকবার ফোন করে দেখ তো ওরা কতদূর পৌঁছাল। আকাশে মেঘ করেছে, ঝড় বৃষ্টি শুরু হবে মনে হয়।

– ফোন করেছি, বলল **** বাজারে। আধা ঘণ্টা মতো লাগবে।

তানিয়ার কথার প্রেক্ষিতে বলল তৃপ্তি। তানিয়া রান্নাঘরের জানালা দিয়ে আরো একবার মেঘাচ্ছন্ন আকাশটা দেখলো। শামীমরা এখনো এসে পৌঁছায়নি। শিমুল তাদের নিয়ে আসতে গেছে। তানিয়া শামীমকে বলেছিল গতকালই তাদের বাড়ি চলে আসতে। কিন্তু শামীম রাজি হয়নি। প্রথমত ছেলের বাড়ি মেয়ে নিয়ে আসছে বিয়ে দিতে, যেটাই তথাগত নিয়মবিরোধী, আবার সেই বাড়ি এসে দুই দিন সপরিবারে থাকবে! এটা হয়? শামীম অবশ্য তানিয়াকে বলেছিল আকদটা তাদের ঢাকার বাড়িতে করার কথা, কিন্তু আশরাফ সেখানে যাবে না। তাছাড়া আশরাফের বোন-ভাই, বন্ধুবান্ধব সব এখানে। কাউকে সেভাবে না বললেও দুই-তিনজন কাছের লোককে তো বলতেই হবে। এখন সেটা ঢাকায় হলে তো আর সম্ভব না। তাই সব দিক বিবেচনা করে শামীম নিয়ম ভেঙে মেয়েকে নিয়ে খুলনায় আসতে রাজি হলো।

রান্নাঘর থেকে বের হতে হতে তানিয়া আরো একবার হাঁক ছেড়ে ডাকলো তৃপ্তিকে। দেখতে বলল আদিব তৈরি হয়েছে কি না। মায়ের কথা মতো আদিবের ঘরের দিকে হাঁটা দিল তৃপ্তি। আদিবের ঘরের দরজা খোলাই ছিল। তৃপ্তি তবুও দুইবার টোকা দিল। আদিব ভেতর থেকে গলা বাড়িয়ে বলল,

– দরজা খোলা আছে।

ভেতরে প্রবেশ করলো তৃপ্তি। ভেতরে ঢুকে দেখলো মায়ের কেনা সাদা পাঞ্জাবিটা এখনো পড়ে আছে আদিবের বিছানায়। আদিবের পরণে বাড়ির পুরনো কাপড়। সে গভীর মনোযোগে ল্যাপটপে কিছু দেখছে। তৃপ্তি তার এ অবস্থা দেখে বলল,

– এখনো তৈরি হও নি?

– হ্যাঁ, এই তো যাবো। মামারা চলে এসেছে?

– না, এখনো আসেনি।

– আর কে কে এসেছে?

– ফুফু আর মেজ চাচা। সেজ চাচা পরে আসবে।

– ছোট চাচা আসেনি?

ল্যাপটপ কিবোর্ডে হাত চালাতে চালাতে জানতে চাইলো আদিব। তৃপ্তি জানালার দিকে এগিয়ে গেল। বাইরে বাতাস শুরু হয়েছে। আদিবের ঘরের জানালা খোলা। খোলা জানালা দিয়ে ভেতরে ময়লা ঢুকতে পারে। তৃপ্তি হাত দিয়ে জানালার কপাট দিতে দিতে আদিবের প্রশ্নের জবাবে ছোট করে বলল,

– না।

আদিবের জানা ছিল ছোট চাচা আসবে না। তবুও জিজ্ঞেস করেছিল।

– নিশান ভাইও তো আসেনি?

– বড় আপার শরীর অসুস্থ, তাই সে আসতে পারেনি।

দীপ্তির অসুস্থতার কথা শুনে হাত থামলো আদিবের। সে এবার তৃপ্তির দিকে তাকালো জানতে চাইলো,

– কী হয়েছে আপার?

– তেমন কিছু না, ঐ সর্দি-কাশি।

তৃপ্তির কথা শুনে একটু স্বস্তি পেল আদিব। দীপ্তির প্রেগন্যান্সিতে বেশ কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছে, যেটা আদিবের অজানা নয়। সে নিজে দেখেছে দীপ্তির রিপোর্ট, যার কারণে একটু ভয়ে আছে সে। দীপ্তির বাচ্চাটা সুস্থভাবে ভূমিষ্ঠ না হওয়া পর্যন্ত সে নিশ্চিন্ত হতে পারছে না। সেই জন্য আপার শারীরিক অসুস্থতার কথা শুনে একটু চমকে উঠেছিল। তৃপ্তি আদিবের সাথে কথা বলতে বলতে জাহানারা বাড়িটার দিকে একবার তাকালো। সন্ধ্যা নামার সাথেই বাড়িটা উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত করা হয়েছে। এখন আরো সুন্দর লাগছে। তৃপ্তি সেদিকে তাকিয়ে আদিবের উদ্দেশ্যে বলল,

– জাহানারার ব্যাপারে আরেকবার ভাবতে পারতিস!

– না, পারতাম না। জাহানারার বরের অভিনয় করতে গিয়ে ওর একটু ক্লোজ হয়েছি মাত্র, তাই তোমার মা জ্ঞান হারিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। আর তার সত্যিকারের বর হওয়ার কথা মাথায় আনলে তোমার মাকে হয়ত আর বাঁচানোই যাবে না।

– তার মানে মা রাজি থাকলে তুই জাহানারাকে বিয়ে করতি?

জানালা ছেড়ে দ্রুত পায়ে আদিবের দিকে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো তৃপ্তি। আদিব ল্যাপটপ স্ক্রিনে চোখ রেখে নির্লিপ্তভাবে বলল,

– ভেবে দেখতাম।

ভাইয়ের কথা শুনে নিরাশ হলো তৃপ্তি। মা রাজি থাকলেও না কি জাহানারাকে বিয়ে করার বিষয়ে ছেলেটা “ভেবে দেখতো”। তার মানে জাহানারার প্রতি তার মনের অনুভূতি এখনো স্পষ্ট না। অথচ গতকাল তৃপ্তির মনে হয়েছিল ছেলেটা জাহানারাকে ভালোবাসতে শুরু করেছে। সে বলল,

– মা রাজি থাকলেও তুই ভেবে দেখতিস! তোর জাহানারাকে পছন্দ না?

– একটু পরে আমার বিয়ে আপা। এসব কথা বন্ধ করো।

– বিয়ে না, আকদ। না, বন্ধ করবো না। তুই বল, তুই জাহানারাকে পছন্দ করিস কি না?

– এতো এনয়িং কেন তুমি? একটু পরে অন্য একটা মেয়ে আমার জীবনে আসতে চলেছে আর তুমি আর একটা মেয়েকে আমি পছন্দ করি কি না সেটা নিয়ে প্রশ্ন তুলছো! সত্যি?

– হ্যাঁ, তুলছি। কারণ আমার মনে হচ্ছে তুই আবেগে পড়ে ভুল করছিস। পরে পস্তাবি। শোন, এখনো সময় আছে। তুই বললে আমি বড় মামার সাথে কথা বলবো। বড় মামা বিচক্ষণ মানুষ। উনি ঠিক বুঝবেন।

আদিবের মনের অবস্থা এমনিতেই ভালো ছিল না। তার উপর তৃপ্তির কথাগুলো যেন তাকে আরো উতক্ত করলো। সে ল্যাপটপ বন্ধ করে উঠে গেল। বিরক্তি প্রকাশ করে নিজের মনের ভাব লুকাতে চাইলো। তৃপ্তি তখন তার দিকেই তাকিয়ে। সত্যি যদি আদিব এখন তাকে বলে সে এই বিয়েটা করতে চাই না, তাহলে তৃপ্তি বড় মামার সাথে কথা বলে এই মুহূর্তে বিয়েটা ভেঙে দেবে। এতে মা যা বলে বলুক। কিন্তু তার ভাইকে সে কম্প্রোমাইজ করতে দেবে না।

– আমি রেডি হবো, তুমি নিচেও যাও।

তৃপ্তিকে হতাশ করে বলল আদিব। তৃপ্তি দুই দিকে মাথা নেড়ে শব্দ করে একটা শ্বাস ফেলল। বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। দরজার দিকে যেতে রাগান্বিত মুখে বলল,

– পস্তাবি তুই।

তৃপ্তি চলে যেতেই কোমরে দুই হাত রেখে বড় করে দম ফেলল আদিব। হঠাৎ অক্সিজেনের অভাব অনুভব করলো সে। তড়িঘড়ি এগিয়ে গিয়ে বন্ধ জানালাটা খুলে দিল। সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টির পানি বয়ে আনা বাতাসে ভিজিয়ে দিল তার বক্ষপট। শ্বাস টানলো সে বুক ভরে। প্রশান্তিতে চোখ বন্ধ করে নিল। সাথে সাথে বন্ধ চোখের পাতায় ভেসে উঠলো জাহানারার চন্দ্রাকৃতির নিখুঁত মুখটা। কানে বাজলো তিরতির করে কাঁপতে থাকা চিকন কণ্ঠে বলা, “আমি আপনাকে ভালোবাসি” কথাটা। তড়িৎ চোখ খুলল আদিব। জ্বলে উঠলো চোখ। ভেতরটা আবার অস্থির হলো। এ ঘটনা নতুন না। আদিবের অবচেতন মন প্রায় তার সামনে আনে সেই শেষ বিকেলের স্মৃতিটুকু। মনে করায় জাহানারার কথা। তবুও আদিব যেন এটাতে অভ্যস্ত হতে পারে না। স্মৃতিটুকু মানসপটে ভেসে ওঠার সাথে শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি এলোমেলো হয়। ভেতরে একটা সূক্ষ্ম অপরাধবোধ কাজ করে। মনে হয় একটা বোকা মেয়ের আকাশসম ভালোবাসার বিনিময়ে সে মেয়েটার প্রতি নিজের ভালোলাগাটুকুও জাহির করতে পারিনি। বারবার ফিরিয়ে দিয়েছে তাকে। কষ্ট দিয়েছে নিজের কথা দিয়ে। দাঁড় করিয়েছে মৃত্যুর মুখে। সেরাতে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে জাহানারার বলা কথাটা আবার মনে পড়লো আদিবের। “আপনি আমাকে একটুও কি ভালোবাসতে পারতেন না আদিব ভাই? একটুও?”

এই মুহূর্তে আবার কথাটা মনে হতেই আদিবের ভ্রূতে ভাঁজ পড়লো। গভীর ভাজ।থমকালো সে। মনে মনে মিলাতে লাগলো কিছু বিচ্ছিন্ন সমীকরণ। ব্যস্তপায়ে এগিয়ে এলো নিজের ল্যাপটপের কাছে। ল্যাপটপ চালু করে গুরুত্বপূর্ণ একটা ফাইল খুলল। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পড়তে লাগলো প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি অক্ষর। তবে নিজের জ্ঞানের সামান্য সীমাবদ্ধতার কারণে স্পষ্টভাবে বুঝতে পারলো না কিছু। অজ্ঞাত সঠিক তথ্যের জন্য কল লাগালো নিজের কলিগ কম বন্ধু রিচার্ডকে। দুই বার রিং হতেই অপরপাশ থেকে কল রিসিভ করলো রিচার্ড। আদিব কোনো ভণিতা ছাড়া নিজের প্রয়োজনের কথা বলল তাকে। রিচার্ড কিঞ্চিৎ অবাক হলো আদিবের কথায়। একমাস যাবৎ তাদের মধ্যে কোনো কথা-বার্তা নেই, আজ হঠাৎ আদিব ফোন করে তাকে এমন একটা কথা বলছে! অবাক হওয়াই তো স্বাভাবিক। তবে সে আদিবের কণ্ঠের গম্ভীরতা লক্ষ্য করে কিছু বলল না। আদিবের কথার প্রেক্ষিতে শুধু জানালো তার ঘণ্টা খানেক সময় লাগবে। আদিব সম্মতি জানিয়ে ফোন কাটলো। রিচার্ডের সাথে কথা বলার পর ফোন রেখে কী যেন ভাবছিল আদিব। তার সেই ভাবনায় ছেদ পড়লো গাড়ির তীব্র হর্নে। বুঝতে পারলো মামারা চলে এসেছে। নিজের ভাবনা এক পাশে রেখে শব্দ করে শ্বাস ফেলল সে। উঠে দাঁড়ালো বসা থেকে। বিছানার উপর থেকে কাপড় নিয়ে ঢুকলো বাথরুমে।

_____________
জিনিয়া সহ বাকি ভাই ও ভাইয়ের পরিবারের সকলকে তানিয়া আমন্ত্রণ জানালেও জিনিয়া ছাড়া কেউ আসেনি শামীমের সাথে। এতে শামীম তেমন একটা ভ্রূক্ষেপ না করলেও তানিয়া বেশ কষ্ট পেয়েছে। ভাই-ভাবির না আসার ব্যাপারে এক ফাঁকে জিনিয়াকে জিজ্ঞেস করলে, জিনিয়া তাকে জানালো মেজো ভাইয়ের ইচ্ছা ছিল রুবাইয়াকে নিজের শালকের ছেলের সাথে বিয়ে দেওয়ার। শামীমের কাছে প্রস্তাবও রেখেছিল, কিন্তু শামীম রাজি হয়নি। সেই রাগে আসেনি মেজো ভাই। আর ছোট ভাই কেন আসেনি সেটা জিনিয়া জানে না। ছোট ভাইয়ের না আসার কারণ জিনিয়া বলতে না পারলেও তানিয়া ঠিক বুঝলো। তার ছোট ভাই আশরাফকে পছন্দ করে না। আশরাফের সাথে তার সম্পর্ক তোফায়েল মেনে নিলেও সে হয়ত মেনে নেয়নি। সে জন্য তো এতগুলো বছরেও এদিক মুখো হয়নি। আজও হয়ত নিজের জেদ বজায় রেখে আসেনি।

– তোমার ননদ-দেবররা আসেনি?

– হ্যাঁ?

অন্যমনস্ক ছিল তানিয়া, যার দরুন জিনিয়ার কথা শুনতে পায়নি। জিনিয়া সেটা বুঝতে পেরে আবার বলল,

– তোমার ননদ, দেবররা আসেনি?

– সাজ্জাদ আর নাফিজা এসেছে। ভাইয়ের সাথে ভাইয়ের ঘরে। জায়েদ হয়ত একটু পরে আসবে। আর শাহেদ জরুরি কাজে আটকে পড়েছে।

– সোনিয়ার কাছে শুনেছিলাম তোমার ছোট দেবর নাকি নাসা থেকে ডাক পেয়েছে।

– হ্যাঁ। আমিও শুনেছি। তবে সত্যি কি না জানিনা। তোর দুলাভাই আমাকে তার ভাই-ভাগার সম্পর্কে তেমন কিছু বলে না।

তানিয়ার সাথে যে তার ননদ-দেবরদের সম্পর্ক তেমন একটা ভালো না, সেটা অজানা নয় জিনিয়ার। সে আর এ বিষয়ে কথা তুলল না। প্রসঙ্গ বদলালো।

এশার নামাজের পরেই ড্রইংরুমে জড়ো হলো সবাই। সন্ধ্যার সময় আকদের কাজ সম্পন্ন হওয়ার কথা থাকলেও শামীমদের আসতে দেরি হওয়ার কারণে এবং রুবাইয়া সঠিক একটু অসুস্থ হয়ে পড়ায়, আকদের সময় এশার নামাজের পর সময় ধার্য করা হলো। এশার পরেই কাজি সাহেব এলো। কাবিননামায় লেখালেখির কাজ শুরু করলো। বাইরে তখন ঝুপঝুপিয়ে বৃষ্টি পড়ছে। তীব্র গতিতে বাতাস বইছে। আদিব বসার ঘরের খোলা জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো। প্রকৃতির আলোড়নে নিজের ভেতরের আলোড়নকে দমাতে চাইলো। কতটা সক্ষম হলো বোঝা গেল না। তবে কাজি সাহেব যখন তার কাছে তার সম্মতি জানতে চাইলো, তখনো তাকে অন্যমনস্ক দেখালো। তার ধ্যান ভাঙলো কারো আর্তচিৎকারে। সাথে সাথে দৃষ্টি ঘোরালো সে, চোখ পড়লো মেঝেতে লুটিয়ে পড়া জাহানারার দিকে।

জাহানারার বিধ্বস্ত অবস্থা। গায়ে-পায়ে কাদায় মাখামাখি। লম্বা হাতার কাপড়টা ছেঁড়া প্রায়। গলায় কোনরকমে ঝুলছে ওড়না। বৃষ্টির পানিতে ভিজে জবুথবু সে। আদিব জাহানারার অমন অবস্থা দেখে এক মুহূর্ত দেরি না করে উঠে এলো। নাফিজাও এগিয়ে এলো সাথে সাথে। আদিব সামনে এসে দাঁড়াতেই উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলো জাহানারা, কিন্তু উঠতে পারলো না। আদিব লক্ষ্য করে দেখলো জাহানারার ডান পায়ের পাতায় কাদার সাথে রক্ত। সে তাড়াতাড়ি ঝুঁকে জাহানারার পায়ে হাত দিল। সাথে সাথে “আহ্” বলে ব্যথাতুর শব্দ ছিটকে এলো জাহানারার মুখ দিয়ে।

জাহানারার পায়ের গোড়ালির কাজটাই আড়াআড়ি করে খুব বিশ্রীভাবে কেটে গেছে। আদিব সেটা দেখে হতাশ শ্বাস ফেলল। জাহানারার মুখের দিকে তাকালো। অশ্রুশিক্ত লাল চোখ, বৃষ্টিতে ভেজা ফ্যাকাসে মুখ। কান্নার তোড়ে বেকে যাওয়া ঠোঁট, ফুলে ওঠা নাকের পাটা।আদিবের ভেতরটা ধ্বক করে উঠলো সাথে সাথে। উপস্থিত সকলে যে যার মতো বিভিন্ন কথা বললেও আদিব সেসব শুনলো বলে মনে হলো না। সে জাহানারার চোখে নিজের দৃষ্টি স্থির রেখে সেভাবেই তাকিয়ে রইল। এর মধ্যে তৃপ্তি তোয়ালে নিয়ে এসে জাহানারার গায়ে রাখল। নাফিজা সেটা জাহানারার গায়ে জড়িয়ে দিল। তৃপ্তি আর নাফিজা মিলে জাহানারাকে ধরে তুলল। তাকে সোফায় বসালো। কিন্তু এতকিছুর মধ্যেও আদিবের দৃষ্টি সরল না জাহানারার মুখ থেকে।

তাকে নিজের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে এতক্ষণে মুখ খুলল জাহানারা, কান্নাভেজা কণ্ঠে বলল,

-মিথ্যাবাদী, আমার কাছে যাওয়ার কথা বলে এখানে সেজেগুজে বিয়ে করছো তুমি! হ্যাঁ? লজ্জা করলো না আমাকে রেখে আবার বিয়ে করতে?

-বিয়ে হয়নি এখনো আমার।

আদিবের শীতল কণ্ঠ। কিছু সময়ের জন্য হয়তো জাহানারার মুখের অভিব্যক্তির পরিবর্তন হলো। যেটা কারো চোখে না পড়লেও আদিব ঠিক দেখল। ব্যাপারটা চোখে পড়তেই আদিবের ঠোঁটের কোণে সূক্ষ্ম হাসির রেখা উঁকি দিল। যেটা সে সকলের অগোচরে লুকিয়ে জাহানারার উদ্দেশ্যে আবার বলল,

-এখানে কী করে এলে? তুমি তো আমাদের বাড়ি চেনো না।

-সেলিনা দেখিয়ে দিয়েছে।

সেলিনা, জাহানারাদের বাড়ির গৃহকর্মী আমেনার মেয়ে। আদিব চেনে তাকে। আদিব এবার জাহানারাকে আপাদমস্তক চোখ বুলিয়ে বলল,

-আর এসব রক্তারক্তি হলো কী করে?

-বাড়ির পিছনের প্রাচীর টপকানোর সময়।

জাহানারার কথায় সবাই অবাক। এই মেয়ে কি না ঝড়বৃষ্টির মধ্যে বন-জঙ্গলে ঘেরা ঐ প্রাচীর টপকে এসেছে! জাহানারা কথা শেষ হতেই নাফিজা বলে উঠল,

-তুই পাগল জাহান! এই অন্ধকারে ঐ দিকে গেলি কেন? তুই জানিস ঐ বনের মধ্যে বেজি থাকে, সোড়েল থাকে। যদি তোকে কামড়ে দিত?

নাফিজা মাঝে মাঝেই ভুলে যায় যে তার ভাতিজির মানসিক ভারসাম্য আগের মতো নেই। এটা নতুন না। তার কথার উত্তরে আদিব বলল,

-জ্বি ফুপু, আপনার ভাতিজি পাগল। বলতে পারেন বদ্ধ উন্মাদ।

এরপর একটু থেমে জাহানারার উদ্দেশ্যে বলল,

-আর এতসব কেন করতে গেলে? রাস্তা দিয়েও তো আসতে পারতে?

-সন্ধ্যার সময় আসতে চেয়েছিলাম রাস্তা দিয়ে, কিন্তু ভাইয়া আসতে দিল না। জোর করে নিয়ে গেল বাড়ি। আটকে রাখল ঘরের ভেতর। বলল আমি নাকি পাগল হয়ে গেছি!

কথাটা বলতে বলতে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল জাহানারা। আদিব নির্লিপ্ত চোখে তার দিকে তাকাল। টি-টেবিলের উপর থেকে মিষ্টির প্লেটটা সরিয়ে জাহানারার মুখোমুখি বসলো। তৃপ্তিকে বলল একটা গামলায় গরম পানি আর ফার্স্ট এইড বাক্স নিয়ে আসতে। তারপর জাহানারার উদ্দেশ্যে বলল,

-তাহলে ভাইয়া আপনাকে ঘরে আটকে রেখেছিল, আপনি ঘর থেকে বের হলেন কীভাবে?

-নেহা দরজা খুলে দিয়েছে।

আবার নেহা? ফিচলে হাসল আদিব। সবাই দেখল সেটা। জাহানারা ঠোঁট উল্টে বলল,

-হাসছো কেন?

-এমনি।

জাহানারার দিকে গভীর চোখে তাকিয়ে শীতল কণ্ঠে বলল আদিব। জাহানারা তার দৃষ্টির সামনে একটু মিইয়ে গেল। আর কোনো কথা বলল না। তৃপ্তি রাবেয়াকে দিয়ে আদিবের বলা জিনিসগুলো নিয়ে এসে রাখল তার সামনে। আদিব উপস্থিত সবাইকে উপেক্ষা করে জাহানারার পা নিজের হাঁটুর উপর তুলল। সাথে সাথে সাদা পাঞ্জাবিতে রক্ত আর কাদা লেপ্টে গেল। আদিবের কাণ্ডে অবাক হলো সবাই।

তানিয়া এতক্ষণ মানুষজন আছে ভেবে চুপ করে থাকলেও এবার আর সহ্য করতে পারলো না। মুখ খুলল সে। শীতল কণ্ঠে ছেলের নাম ধরে ডাকল। ছেলেকে বোঝাতে চাইলো সে কোন পরিস্থিতিতে আছে। বোঝাতে চাইলো সবাই দেখছে তাকে, তার সংযত হওয়া উচিত। আদিব মায়ের শীতল কণ্ঠের পিছনে লুকিয়ে থাকা সাবধানী বাণীটা হয়তো বুঝলো, তাই তো বড় মামার উদ্দেশ্যে বলল,

-মামা, আমি যদি রুবাইয়াকে বিয়ে না করি, তাহলে কি আপনি খুব বেশি রাগ করবেন?

-বিয়ে না করার কারণ জানতে পারলে রাগের পরিমাণ কম বেশি হতে পারে।

-আদিব, তুমি কি বলছো? মাথা ঠিক আছে তোমার? ভাইয়া, তুমি ওর কথায় কান দিও না।

শামীমের কথা কেটে বলল তানিয়া। শামীম তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,

-তানি, চুপ কর। আদিবকে বলতে দে, ও কী বলতে চায় শুনি।

-থ্যাংক ইউ, মামা।

একটু সময় নিল আদিব, তারপর নিজের মনে কথাগুলো গুছিয়ে নিয়ে বলল,

-এই মেয়েটা না কি আমাকে ভীষণ ভালোবাসে। ভীষণ।যার কারণে আমি বারবার প্রত্যাখ্যান করার পরেও সে ফিরে আসে। আরো তীব্রভাবে আমাকে ভালোবাসে।এখন, এমন ভালোবাসাকে কত বার পায়ে ঠেলা যায়!তাই ভাবছি মেয়েটাকে একটা সুযোগ দিই।

-আর এই কথাটা তোমার এখন মনে হলো! যখন তোমার জন্য অন্য একটা মেয়ে প্রতীক্ষা করছে! লাইক সিরিয়াসলি?

– এতদিন তো তার ভালোবাসা বুঝিনি আমি। আজ হঠাৎ উপলব্ধি করলাম।তাই মনে হলো…!

আদিবের কথা শুনে ফিচলে হাসলো শামীম। তারপর কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই যাচ্ছিল, তখন জায়েদকে ভেতরে ঢুকতে দেখে থেমে গেল।

চোখ পড়ল জায়েদের ত্রুটিযুক্ত পায়ে। সাথে সাথে অপরাধবোধে ভেতরটা মিইয়ে গেল শামীমের।

আশরাফের সাথে বন্ধুত্বের কারণে তার ভাইদের সাথে বেশ ভালো সম্পর্ক ছিল শামীমের। তার মধ্যে জায়েদের সাথে সম্পর্কটা একটু বেশিই গাঢ় ছিল। ছেলেটাও শামীম ভাই বলতে পাগল ছিল। নিজের শখ-স্বপ্ন সব বলত শামীমের সাথে। শামীমও খুব মন দিয়ে শুনত। ভালো লাগত তার। নিজের ভাইরা সবসময় দূরে দূরে থাকত বলে বন্ধুর ভাইয়ের এমন আন্তরিক, হৃদ্যতাপূর্ণ ব্যবহার তাকে আপ্লুত করত।

শামীমের এখনো মনে আছে, জায়েদ পুলিশ সুপারের চাকরির জন্য দেওয়া সরকারি নিয়োগ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর শারীরিক পরীক্ষার জন্য গিয়েছিল ঢাকায়। তার সাথে ছিল শামীম আর আশরাফ। জায়েদ শারীরিক পরীক্ষা শেষে বাইরে বেরিয়ে উৎফুল্ল কণ্ঠে বলেছিল,

— শামীম ভাই, ধরে নেন চাকরি কনফার্ম।

জায়েদের আত্মবিশ্বাস দেখে শামীমেরও মনে হয়েছিল, জায়েদের চাকরিটা হয়ে যাবে। এবং তাই হয়েছিল।

কিন্তু তার সেই আত্মবিশ্বাস, তার স্বপ্ন— সব এক নিমেষে ধুলিসাৎ করে দিল শামীম। সেদিন আশরাফের উপর রাগে অন্ধ হয়ে সে শুধু জায়েদকে ধাক্কা দিয়ে রাস্তায় ফেলেনি, বরং জীবন থেকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়েছিল। তার স্বপ্ন থেকে বিচ্ছিন্ন করেছিল। কেড়ে নিয়েছিল জায়েদের সব আশা-আকাঙ্ক্ষা।

সেদিন আশরাফকে শামীমের বদ্ধ মুষ্টি থেকে ছাড়াতে জায়েদ এগিয়ে গেলে, শামীম রাগে ক্রুদ্ধ হয়ে ধাক্কা দেয় জায়েদকে। জায়েদ ছিটকে পড়ে মাঝরাস্তায়, সাথে সাথে এক দ্রুতগামী মোটরবাইক চলে যায় তার পায়ের উপর দিয়ে। থেঁতলে যায় জায়েদের পায়ের পপলিটিয়াল ধমনী। কেটে বাদ দিতে হয় সেটা। জায়েদের স্বাভাবিক হাঁটা-চলার ইতি ঘটে সেখানে। পুলিশ সুপার হিসেবে জয়েন করার অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার হাতে এসেও চাকরিতে যোগদান করা হয় না তার।

— আসসালামু আলাইকুম, শামীম ভাই। কেমন আছেন?

ঘরে ঢুকে সবার প্রথমে শামীমের দিকে চোখ পড়ল জায়েদের। সে প্রশস্ত হেসে সালাম দিয়ে জানতে চাইলো, শামীম কেমন আছে।

জায়েদের কথায় ভাবনা ছিন্ন হলো শামীমের। ম্লান হেসে বলল,

— ভালো। তুমি কেমন আছো?

— আলহামদুলিল্লাহ, আপন…

কথা শুরু করতে পারল না জায়েদ। তার আগেই তার চোখ গেল জাহানারার দিকে। মুখে অন্ধকার নেমে এল তার। জাহানারার দিকে তাকিয়ে বলল,

— তুমি এখানে কী করছো?

বাবাকে দেখে আদিবের কোলে থেকে নিজের পা টানতে লাগল জাহানারা। তবে আদিব তার পা ছাড়ল না। সে সেভাবে তুলো দিয়ে স্যাভলন লাগাতে লাগাতে বলল,

— তার বরের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে, তাই বিয়ে আটকাতে এসেছে, চাচা। রাগ করবেন না, প্লিজ।

আদিবের কথায় রসিকতার ছাপ। তানিয়ার যেন সহ্য হচ্ছে না এসব। সে জায়েদকে বলল,

— জায়েদ, তোমার পাগল মেয়েকে নিয়ে যাও তো এখান থেকে।

— চাচা, আপনি দেখছি ভিজে গেছেন। আসুন, বসুন।

মায়ের কথা উপেক্ষা করে বলল আদিব। তানিয়ার রাগ যেন আরও বেড়ে গেল। সে এবার গর্জে উঠল আদিবের উপর। তবে আদিব তার নির্লিপ্ততা বজায় রেখে শামীমের উদ্দেশ্যে বলল,

— মামা, আমার প্রশ্নের উত্তরটা এখনো বাকি।

— আমার কোনো সমস্যা নেই, আদিব।

ম্লান হেসে বলল শামীম।

তানিয়ার মাথায় যেন এবার বাজ পড়ল। সে তিলমিলিয়ে উঠে বলল,

— আদিব, তুমি কিন্তু বড্ড বাড়াবাড়ি করছো! আমার এসব ভালো লাগছে না। মাথা ঠিক আছে তোমার? ঐ পাগল মেয়ের সাথে থাকতে থাকতে তুমিও পাগল হয়ে গেছো?

— আমাকে বিয়ে করবে, জাহানারা?

তানিয়ার কথা শুনেও না শোনার ভান করে সবার সামনে জাহানারাকে বলল আদিব।

জাহানারা একটা শুকনো ঢোক গিলল। বলল,

— আমাদের তো বিয়ে হয়ে গেছে, আবার বিয়ে করবে?

— হুম। আবার বিয়ে করবো। করবে?

ছেলের কথা শুনে পাশে টি-টেবিলের উপর রাখা ফুলদানিটা এবার ফ্লোরে ছুঁড়ে মারল তানিয়া।

আশরাফ এতক্ষণ নীরব দর্শক হয়ে থাকলেও এবার শক্ত গলায় বলে উঠলো,

— তানিয়া, চুপচাপ নিজের ঘরে যাও।

রাগে-দুঃখে চোখে পানি এলো তানিয়ার। ছেলের উপেক্ষা আর বরের এমন চোখ রাঙানিতে সবার সামনে অপমানিত বোধ করল সে। আর একটাও কথা না বলে ধুপধাপ পা ফেলে নিজের ঘরে গিয়ে ঢুকল। সারা বাড়ি কাঁপিয়ে শব্দ তুলে দরজা দিল। জিনিয়া গেল তার পিছু।

আদিব সেদিকে তাকিয়ে একটা শ্বাস ফেলল। জাহানারার উদ্দেশ্যে আবার বলল,

— কী? করবে না বিয়ে?

তড়িৎ মাথা ঝাঁকাল জাহানারা। অর্থাৎ, সে আদিবকে বিয়ে করবে।

আদিব জাহানারার উত্তর পেয়ে তার চোখের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকাল। জাহানারা আদিবের প্রখর দৃষ্টির সামনে অপ্রস্তুত হয়ে দৃষ্টি ঝুকিয়ে নিল।

জাহানারার অপ্রস্তুত অভিব্যক্তি দেখে আদিবের ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠল এক রহস্যময় হাসি।

চলবে, ইনশাআল্লাহ।

#সৌরকলঙ্ক
#উম্মে_প্রভা
#পর্ব_১৮

-পুরোনো বন্ধুত্ব ঠিক করার জন্য মেয়ে বিয়ে দিতে নিয়ে এলে, তারপর পুরোনো ভুলের কথা মনে করে অনুতপ্ত হয়ে সেই বিয়ে ভেঙ্গে দিলে। তোমার ভাবনা চিন্তা দেখলে মাঝে মাঝে আমার শরীর জ্বলে ওঠে শামীম।সহ্য হয় না তোমার এসব খামখেয়ালি!

তিক্ত বিরক্ত হয়ে বলল রিনা।শামীম স্ত্রীর কথা শুনে তার দিকে গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকালো। স্ত্রী কে বোঝাতে চাইলো মেয়ে আছে তাদের সামনে কথা বার্তা যেন একটু হিসাব করে বলে।শামীমের সেই দৃষ্টির অর্থ রিনা বুঝলেও সেটা পাত্তা না দিয়ে ক্যাটকেটে গলায় বলল,

-ওভাবে তাকচ্ছো কেন?আমি কিছু ভুল বলেছি?তোমার জায়গায় আমি হলে তো আমার গুষ্টির তুষ্টি করে দিতে।অথচ নিজের বেলায় ষোল আনা!নিজের দোষ তো মানছ‌ই না আবার চোখ গরম করছো?

-চোখ গরম করলাম কখন?

– পঁয়ত্রিশ বছর সংসার করছি তোমার সাথে তোমার কোন দৃষ্টির কি মানে সেটা আমার মুখস্থ।আমাকে বোঝাতে এসো না।

-আম্মু প্লিজ স্টপ।কি শুরু করেছো বলতো? মানুষের বাসায় আছি আমরা। ফুপুর কথা একবার ভাবো সে শুনলে কি মনে করবে?

-যা মনে করার করুক।আমার তাতে কিছু যায় আসে না।তার জন্য তো আজ এমন পরিস্থিতি হ

-রিনা তুমি কিন্তু এবার বাড়াবাড়ি করছো!

রিনা কে তার কথা শেষ করতে না দিয়ে বলে উঠলো শামীম।শামীমের কাঠ কণ্ঠে রিনা যেন একটু চমকে উঠলো।তবে সে দমলো না । স্বামীর দিকে কঠোর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,

-আমার মেয়ের হওয়া বিয়ে ভেঙ্গে গেল।তাকে প্রত্যাখ্যান করে তার হবু বর অন্য একজনকে বিয়ে করলো, সেটা তোমার কাছে বাড়াবাড়ি হলো না। কিন্তু আমার দুই চারটে কথা তোমার কাছে বাড়াবাড়ি হয়ে গেল?বাহ!ভালো।

রাগে গজগজ করতে করতে বলল রিনা।শামীম একটা হতাশ শ্বাস ফেলল।সেও বুঝতে পারছে তার তড়িঘড়ি নেওয়া সিদ্ধান্তের ফলে, মেয়ের জীবনে বিয়ে ভাঙার যে অনাকাঙ্ক্ষিত দাগটা পড়লো সেটা একেবারে অদেখার নয়। কিন্তু সেই বা কি করতো।আদিব যখন সবার সামনে বলল সে বিয়েটা করতে চাইছে না তখন কি সে জোর করে তার ঘাড়ে মেয়েকে ঝোলাতো!আবার রাগ বাগ করেই বা কি করতো। একবার করেছিল তো রাগ যার‌ অনুতাপ এখনো নিয়ে বেড়াচ্ছে। তাছাড়া রুবাইয়া শিক্ষিত, সুন্দরী,আত্মনির্ভরশীল, সে ভবিষ্যতে আদিবের থেকে ভালো জীবন সঙ্গী পাবে এটা শামীম নিশ্চিত যার জন্য মেয়েকে নিয়ে সে খুব বেশি চিন্তিত না। কিন্তু রিনা,সে তো সেটা মানতে চাইছে না।তার এক কথা মেয়ের গায়ে বিয়ে ভাঙার যে দাগটা লাগলো এরপর ভালো জায়গায় মেয়ের বিয়ে হবে! ভদ্রমহিলা এতো দিন অস্ট্রেলিয়ার মতো উন্নত দেশে থেকেও চিন্তা ধারা উন্নত করতে পারে নি।সে এখনো সেই নব্বইয়ের দশকে আটকে আছে।যার কাছে লোকে কি বলবে সেটা মেয়ের স্বস্তি পূর্ণ জীবনের থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

বাবা মায়ের কথা চালা চালিতে রুবাইয়া এত সময় চুপ থাকলেও মা কে তার নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারাতে দেখে সে মুখ খুলল,

-আম্মু,তুমি একটু শান্ত হ‌ও প্লিজ।আমার দিকে তাকাও ,দেখ আমি ঠিক আছি।

-তা তো থাকবেই তুমি তো তোমার বাপের হুকুমের দাস,বাপ উঠতে বললে উঠবে,বসতে বললে বসবে।মায়ের কথা তো তোমার কানে ঢোকে না।

মেয়ের উপর চিড়বিড়িয়ে উঠলো রিনা। রুবাইয়া একটু চুপসে গেল।আর কিছু বলা সমীচীন মনে করলো না।পুরোনো অভিজ্ঞতা থেকে জানে এখন সে কিছু বললেই তার গুষ্টি, র’ক্ত,জাত সব টেনে এনে ঠেস দিয়ে বাবাকে কথা শোনাবে তার মা, যার ফলে পরিস্থিতি আরো বিগড়াবে সুতরাং এখন চুপ থাকাই ভালো।রিনা নিজের মনের রাগ উগ্রাতে যা মনে আসলো তাই বলে গেল। শামীম অসহায় চোখে মেয়ের দিকে তাকালো।দোষ যেহেতু তার সে তাই স্ত্রী কে কিছু বলতেও পারলো না। রুবাইয়া বাবার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে ইশারায় বলল একটু সহ্য করো!মায়ের বকবকানিতে অতিষ্ঠ হয়ে
রুবাইয়ার একসময় মনে হলো ঘর ছেড়ে বের হয়ে যেতে কিন্তু সে জানে এখন এখান থেকে বের হলে তার মা আরো ক্ষ্যেপপে। অজ্ঞাত সেও বাবার সাথে চুপচাপ বসে রইলো।

রিনা শান্ত হলো প্রায় তিরিশ মিনিট পর তাও আবার দরজায় টোকা পড়ার শব্দে। দরজায় দ্বিতীয় বার টোকা পড়তেই শামীমের দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকালো সে। অর্থাৎ এ সময় কে এলো। শামীম তার সেই দৃষ্টি উপেক্ষা করে ঠেস দিয়ে বলল,

-থামলে কেন? তোমার রেকর্ড চালাও মানুষ কে শোনাও।

কথাটা বলতে দরজা খুলতে বসা থেকে উঠে গেল শামীম।রিনা শামীমের কথা শুনে চোখ মুখ কুঁচকালো।শামীম দরজা খুলতেই দেখতে পেলো আশরাফ দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে।শামীমের চোখে চোখ পড়তেই দৃষ্টি সরিয়ে নিল সে।শামীম কে উপেক্ষা করে রিনার উদ্দেশ্যে বলল,

-ভাবি ভেতরে আসতে পারি?

-জি ভাইয়া।

জোরপূর্বক হেসে বলল রিনা।কণ্ঠে তার আন্তরিকতা। নিজের তিক্ত মনোভাব লুকিয়ে রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা। রুবাইয়া মায়ের এমন দ্রুত ভোল পরিবর্তন দেখে ঠোঁট টিপে হাসলো।রিনা অবশ্য মেয়ের সে হাঁসি লক্ষ্য করলো না।সে নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক করতে ব্যস্ত হলো।

আশরাফ ভেতরে প্রবেশ করে কোনো ভণিতা ছাড়া রিনার উদ্দেশ্যে বলল,

-ভাবি আমাদের জন্য রুবাইয়ার সাথে যেটা হলো তার জন্য আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত।আমার পরিবারের হয়ে আমি আপনাদের কাছে মাফ চাইছি।

আশরাফ হাত জোড় করে কথাটা বলতে নিতেই।সাথে ছি ছি করে উঠলো রিনা। বলল,

-ভাইয়া এভাবে কথা বলে লজ্জা দিবেন না ,প্লিজ।আমি বুঝছি আপনাদের দিকটা।আমার একটু রাগ হয়েছিল তখন কিন্তু ছেলে যখন সবার সামনে বলল‌ই সে এ বিয়ে করতে চায় না তখন আপনাদেরই বা কি করার ছিল।আমি অবশ্য আপনাদের ভাইকে বলেছিলাম এত তাড়াহুড়া না করতে।আজ কাল কার ছেলে মেয়েদের মন না মতি,একটু সময় নেওয়া ভালো। কিন্তু তিনি আমার কথা শুনলেন না। তিড়িং বিড়িং করে বিয়ের দিনক্ষণ ফেললেন।

কথা বলতে শামীমের দিকে তাকালো রিনা।শামীম তার কথা শুনে এক ভ্রূ উঁচিয়ে তার দিকে তাকালো।এই ভদ্র মহিলাকে গত এক ঘণ্টা যাবৎ তিনি আর তার মেয়ে দুইজন মিলে কত ভাবেই না আজকের ব্যাপরাটা বোঝাতে চেয়েছে কিন্তু সে কিছুতেই কিছু বুঝতে রাজি ছিল না।অথচ এখন কি সুন্দর আশরাফের সামনে দাবি করছে সে তাদের দিকটা বুঝছে! দারুণ!
গোপনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল শামীম।

আশরাফ রিনার কথায় আশ্বস্ত হলো।রিনার কথায় বুকের উপর থেকে যেন একটা ভারি পাথর সরে গেল। স্বস্তির শ্বাস ফেলল সে।রিনা কে তাদের এখানে আরো দুটো দিন থাকার অনুরোধ করে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে।আসার সময় শামীমের সাথে চোখাচোখি হলো কিন্তু কেউ কারো সাথে বাক্যবিনিময় করলো না।দুইজন সামনাসামনি হ‌ওয়ায় পুরোনো বন্ধুত্বের উষ্ণ আঁচ কিঞ্চিৎ তৈরি হলেও,ভেতরে জমে থাকা এত বছরের বরফ গলতে সময় তো লাগবে!

_______________

আজ বিকেলে জাহানারা কে বিধ্বস্ত অবস্থায় দেখে আসার পর থেকে আশরাফের ভেতরটা ছটফট করছিল। বারবার মনে পড়ছিল অনেক বছর আগে জায়েদ কে দেওয়া কথা,মায়ের ইচ্ছা।আদিবকে পাওয়ার জন্য জাহানারার করা পাগলামো।সব যেন একে একে চোখের সামনে ভেসে উঠছিল তার।ভেতরটা হাঁস ফাঁস করছিল অপরাধ বোধে।মনের সেই অস্থিরতার ক্ষণে আশরাফের হঠাৎ মনে হলো একটা শেষ চেষ্টা করে দেখলে কেমন হয়! কিন্তু পরক্ষণেই ভাবলো আদিব কি মানবে তার কথা।ছেলের কাছে অপমানিত হতে হবে না তো!
ভাবনা চিন্তার দোলা চলে সে গিয়ে পৌঁছাল ছেলের দরজায়।আদিব তখন তৈরি হচ্ছে, বাবা কে এসময় তার ঘরে দেখে একটু অবাক হলো। আশরাফ সচার আচার আদিবের ঘরে যায় না সুতরাং একটু অবাক হওয়া স্বাভাবিক। আশরাফ এগিয়ে গেল ছেলের কাছে।আদিব বাবাকে এই মুহূর্তে এখানে আসার কারণ জিজ্ঞেস করতেই। আশরাফ একটু ভাবনায় পড়লো।আদিব কে নিজের মনের কথাটা বলবে কি ,বলবে না এই দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগতে লাগলো।অনেকটা সময় নিয়ে নিজের মনের অস্থিরতা কোনোরকমে সামলে বলল,

-আদিব তুমি কি আমার একটা কথা রাখবে?

বাবার দ্বিধাদ্বন্দ্বিত চেহারা আর কণ্ঠের অসহায়ত্ব তার বাবার শক্ত সামর্থ্য ব্যক্তিত্বের সাথে সে মেলাতে পারলো না। খারাপ লাগলো তার। ভেতরটা কেমন যেন করে উঠলো।সে নরম গলায় বলল,

-বাবা তুমি কি বলতে চাও নির্দ্বিধায় বলতে পারো।আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো তোমার কথা রাখার।

নিজের অন্যায় আবদারের কথা মনে করে ছেলের কথায় আশ্বস্ত হতে পারলো না আশরাফ।সে তো জানে ছেলের জাহানারা প্রতি উদাসীনতা। সে একটা শ্বাস ফেলল তারপর পিতৃত্বের দাবি নিয়ে জানালো, “এই বিয়ে ভাঙতে,জায়েদ কে দেওয়া তার পুরোনো কথা রাখতে।”বাবার কথায় তার দিকে হতবাক চোখে তাকালো আদিব।আশরাফের কাছ থেকে এসময় এমন কথা আশা করিনি সে।বাবার কথার রেশ কাটিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করতে কিঞ্চিৎ সময় ব্যয় করলো আদিব।মনে করলো তার জীবনে বাবার গুরুত্ব।

তাদের ভাই বোনেদের জীবনে বাবার ভূমিকা অপরিসীম হলেও কখনো বাবা তাদের জীবনে হস্তক্ষেপ করেনি। সবসময় তাদের ইচ্ছা অনিচ্ছা কে প্রাধান্য দিয়েছে বলা ভালো তাদের চাওয়া পা‌ওয়াকে সব কিছুর ঊর্ধ্বে রেখেছে।আজ যখন সেই মানুষ টা এভাবে অসহায়ের মতো তার সামনে এসে দাঁড়ালো তখন তাকে ফেরাতে পারলো না আদিব।মেনে নিল বাবার অন্যায় আবদার।কথা দিল তার কথা রাখার।

শামীমের ঘর থেকে বের হতেই সন্ধ্যায় আদিবের সাথে হওয়া কথোপকথন মনে পড়তেই বুক চিরে আরো একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো আশরাফের। এগিয়ে গেল সে আদিবের ঘরের দিকে।

আদিবের ঘরের দরজা হ্যাঁ করে খোলা ছিল। আশরাফ ভেতরে ঢুকতেই দেখলো জাহানারা বেহুঁশ হয়ে বিছানায় শুয়ে আছে, তৃপ্তি তার মাথায় পানি দিচ্ছে।নাফিজা চিন্তিত মুখে তার শিয়োরে বসা।আদিব পড়ার টেবিলে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে। দৃষ্টি জাহানারার মুখে নিবদ্ধ। নির্লিপ্ত ভঙ্গি তার। আশরাফ ভেতরে ঢুকতেই তৃপ্তি বাবার উদ্দেশ্যে বলল,

-বাবা জ্বর তো কমছে না কি করবে?

-***** দিয়েছো আদিব।

-হুম।

-**** দেওয়ার পরেও কাজ হয় নি!

স্বোগতিক্ত করে বলল আশরাফ ।তাকে একটু চিন্তিত দেখালো।সে একটু ভেবে ফের বলল,

-আদিব একটা ******ইনজেকশন দাও, আশা করি কাজ হবে।না হলে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে।

-শরীর দুর্বল ******ইনজেকশন সহ্য করতে পারবে?মাথায় পানি দেওয়া হচ্ছে দেখা যাক কি হয়।

থামলো আদিব। আশরাফ‌ও তার কথাতে সম্মতি জানালো। এরপর নিরবতা। আশরাফ চেয়ার টেনে বসলো জাহানারা পাশে। মৃদু স্বরে ডাকলো তাকে। জাহানারা অবচেতন ভাবে সাঁড়া দিল।মেয়েটার জ্ঞান আছে দেখে কিঞ্চিৎ স্বস্তি পেল আশরাফ।

-মা কোথায়?রাগ কমেছে তার?

নিরবতা ভেঙ্গে প্রশ্ন করলো তৃপ্তি। আশরাফ শব্দ করে একটা শ্বাস ফেলল, বলল,

-নিজের ঘরে,রাগ এত তাড়াতাড়ি কমবে না।আদিব তোমার একবার মায়ের কাছে যাওয়া উচিত।

-এখন ইচ্ছা করছে না।

ভাবলেশহীন ভাবে বলল আদিব।আদিবের কথা শুনে উপস্থিত সবাই যেন একটু থমকালো।আদিবের কাছে তানিয়া ফাস্ট প্রায়োরিটি, এই কথাটা কম বেশি সবাই জানে সেই ছেলের মায়ের প্রতি এই অবহেলা ভাবালো সকলকে।তবে আদিব সেসব পাত্তা দিল না।সে তৃপ্তির উদ্দেশ্যে বলল,

-আপু এবার থামো। ঠান্ডা লেগে যাবে।

আদিবের কথায় তৃপ্তি জাহানারা মাথায় পানি ঢালা বন্ধ করলো।আদিব এগিয়ে এসে থ্যার্মোমিটার মুখে দিল জাহানারার।জ্বর মেপে দেখলো আগের থেকে কমেছে।থ্যার্মোমিটার ঝাড়া দিয়ে ফাস্ট‌এইড বাক্সে রেখে বলল,

-বাবা,ফুপু তোমরা যাও রেস্ট নাও।আপু তুমিও যাও। সারাদিন অনেক ধকল গিয়েছে এখন একটু আরাম করো।কোনো সমস্যা হলে আমি তোমাদের ডাকবো।

সত্যি সারাদিন অনেক ধকল গেছে সবার উপর। তৃপ্তি তো সেই ভোর থেকে মায়ের হাতে হাতে এটা ওটা করেছে। শরীর আর চলছে না তার।আদিবের কথা শুনে সে উঠে গেল।নাফিজাও আর বসলো না।আদিব যখন মেয়েটার সাথে আছে তখন চিন্তার কিছু নেই।নাফিজা আর তৃপ্তি চলে যেতেই আশরাফ উঠে দাঁড়ালো।আদিব কে জাহানারার খেয়াল রাখতে বলে ধীর পায়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

আশরাফ চলে যেতেই।ঘরের দরজা দিল আদিব।টেবিলের উপর রাখা খাবারগুলোর দিকে তাকিয়ে মরে যাওয়া ক্ষিদেটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো তার। কিন্তু খেতে ইচ্ছা করলো না। বিছানার দিকে এগিয়ে গেলো সে। জাহানারা গায়ে কম্বল টা ভালো করে টেনে দিয়ে তার পাশে হাঁটু গেঁড়ে বসলো।তারপর জাহানারার কানের কাছে মুখ নিয়ে দাঁতে দাঁত পিষে ফিসফিসিয়ে বলল,

-আই হেইট উই জাহানারা!আই হেইট ইউ।

চলবে, ইনশাআল্লাহ।

#সৌরকলঙ্ক
#উম্মে_প্রভা
#পর্ব_১৯

-“”নিজেকে চাঁদের মতো নিঃশব্দ ও শীতল করে তুলিস না, বরং সূর্যের মতো প্রজ্বলিত হ। যেন তোর কলঙ্ক কেউ সহজে দেখতে না পায়, উপভোগ তো দূরের কথা! তোর শক্তি ও দীপ্তি এত প্রবল হোক যে, তোর সামান্য দাগ খোঁজার জন্যও মানুষকে বিশেষ যন্ত্র আর গভীর জ্ঞানের আশ্রয় নিতে হয়। এমন অসাধারণ হ, যেন তোকে বুঝতে হলে আলোচনার নয়, গবেষণার প্রয়োজন হয়!”

অনেক বছর আগে ছোট চাচার বলা কথাগুলো আজ আবার স্মরণ করলো জাহানারা।সাথে সাথেই বন্ধ চোখের কোণ ঘেঁষে গড়িয়ে পড়লো নোনাজল।চোখ মেলে তাকালো সে।ঘুম অনেকক্ষণ ভেঙ্গেছে তার, অভ্যাসবশত চোখ বুজে শুয়ে ছিল।জীবনের চাওয়া পাওয়ার সমীকরণ মিলাচ্ছিল, ঠিক তখনই ছোট চাচার বলা কথাটা মনে পড়লো।

আদিব কে ভালোবেসে যখন সে পাগল প্রায়,মানুষের কথাও তখন তুঙ্গে।কথায় কথায় তার চরিত্র নিয়ে কথা বলে মানুষ।তাকে নির্লজ্জ বলে কথা শোনায়।ভয় ধরায় তাকে স্বাভাবিক ভাবে বাঁচতে।সে যত সবটা ভুলে আগাতে চায় মানুষ তাকে ততো ধাক্কা দিয়ে পিছনে সরিয়ে দেয়।একতরফা ভালোবাসার অপরাধে তাকে কলঙ্কিত করে। জাহানারার ছোট্ট মন সহ্য করতে পারে না সেসব। প্রতিদিন নিয়ম করে কাঁদে সে।দিন গুলো যেমন তেমন কাটলেও রাতগুলো কাটে দুর্বিষহ।প্রতি রাতে চোখের পানির সাথে নিজের কলুষিত অতীতের মুক্তি চায়। কিন্তু পারে না।ছোট চাচি তার সাধ্য মতে চেষ্টা করে তাকে আগলে রাখার। বাইরের মানুষ থেকে আগলে রাখলেও, কাছের মানুষ গুলো থেকে মেয়েটাকে রক্ষা করতে পারে না।তারা ঠিক বাড়ি বয়ে এসে মেয়েটার বোকামির প্রশংসা করে,ঠেস দিয়ে কথা বলে,সে আদিবের কতটা অযোগ্য সেটা দায়িত্ব নিয়ে মনে করায়।জাহানারা এসব চুপ চাপ শোনে।ভেতরে ভেতরে মুষড়ে পড়ে।পিছিয়ে নেই নিজেকে সবার থেকে।লুকিয়ে থাকার চেষ্টা করে সবার আড়ালে। যেখানে কেউ তাকে দেখবে না, কেউ তাকে চিনবে না।এভাবে দিন কাটে,সময় যায়।
একসময় অসুস্থ হয়ে পড়ে জাহানারা।।ভুগতে থাকে “সোশ্যাল ফোবিয়ায়”।বাধা গ্রস্থ হয় তার স্বাভাবিক জীবন যাপন।জায়েদ তখন মেয়ের থেকে মুখ ফিরিয়ে বসে আছে।সালেহা মেয়েকে নিয়ে চিন্তিত হলেও কিছুই করতে পারছে না।আকিব তখন মাত্র ভ্যার্সিটি থেকে বের হয়েছে। চাকরির পড়াশোনায় তার দম নেওয়ার ফুরসত নেই।তার‌উপর দীর্ঘ পথের দূরত্ব। মোবাইল ফোন‌ই তখন ভরসা।বোনের কাছে যেতে না পারলেও রোজ নিয়ম করে বোনকে ফোন করে,তার মন ভালো করার চেষ্টা করে, সাহস যোগায়। বোনের কাছে না থাকতে পারার জন্য গোপনে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। পরিবার থেকে দূরে থাকার কারণে জাহানারার জীবনে তখন ভরাডুবি।শাহেদ ভাতিজির অবস্থা দেখে সেজ ভাইকে নিজের সাধ্যমতো বোঝানোর চেষ্টা করে, কিন্তু শাহেদ মেয়ের মুখ দেখবে না।যে মেয়ের জন্য তার মা তাদের ছেড়ে চলে গেছে, তাকে নিজের চোখের সামনে রাখবে না।সেজ ভাইয়ের জেদের কাছে পরাস্ত হয়ে শাহেদ নিজেই এগিয়ে যায় ভাতিজির উদ্ধারে।
জাহানারার জীবনের ভরাডুবিতে হাল ধরে। জাহানারার ছোট বড় প্রতিটা পদক্ষেপে তার সাথে পা ফেলে।তাকে প্রতিদিন একটু একটু করে নিজকে চিন্তে শেখায়।তার দোষ ছাপিয়ে গুণ তুলে ধরে।তাকে আত্মবিশ্বাসী করে তোলে। স্বাবলম্বী হতে সাহায্য করে।নিজেকে ভালোবাসতে বাধ্য করে। পরিশেষে সফল হয় শাহেদ।উঠে দাঁড়ায় জাহানারা।নিজের ভয় ছাপিয়ে সাহসিকতার সাথে এগিয়ে যায় সামনে।লুফে নেয় একের পর এক সাফল্য।

ছোট চাচা না থাকলে হয়ত জাহানারা আহাসান সেই কবেই অন্ধকারে হারিয়ে যেত। এবং , এবং যার জন্য,যার কারণে সে নিশ্বেষ হয়ে যেত সে হয়ত তার সমাপ্তিতে “আহ্ ” টুকু করতো না!নিজের মনেই তাচ্ছিল্য হাসলো জাহানারা।চোখ মেলে তাকালো সিলিংয়ের দিকে।রাত এখনো খানিক বাকি।ঘাড় ঘুরিয়ে জানালার দিকে চোখ দিতেই শেষ প্রহরের নিঃশব্দ অন্ধকার দৃষ্টি ছুঁলো।একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করলো জাহানারা।জানালা থেকে চোখ ফিরিয়ে নিজের বা পাশে তাকালো ,দেখল বিছানার হেড বোর্ডে হেলান দিয়ে আদিব বসে আছে।চোখ বন্ধ তার।তবে পায়ের অনবরত নড়ন চড়ন বলছে সজাগ সে।ডিম লাইটের ঝাপসা আলোই অদ্ভুত দেখাচ্ছে তাকে।আলো আধারিতে আদিব কে নিজের পাশে দেখে প্রথমে একটু চমকে ছিল জাহানারা তবে সেটা ক্ষণিকের জন্য।নিজের অবস্থান বুঝতে পেরে নিজেকে সামলে নিয়েছিল সাথে সাথে।জাহানারার দৃষ্টি আদিবেই নিবদ্ধ ছিল ঠিক তখন আদিব তার থমথমে কণ্ঠে বলে উঠলো,

-কংগ্রাচুলেশনস, জাহানারা! ইউ হ্যাভ ডান ইট, ইয়োর উইশ হ্যাজ কাম ট্রু!”

কথা বলতে বলতে হাত বাড়িয়ে ঘরের বাতি জ্বালালো সে। দৃশ্যমান হলো তার চেহারা। জাহানারা দেখলো তার ঠোঁটের কোণের তাচ্ছিল্যের হাঁসি।আদিবের মুখের দিকে তাকিয়ে সেও মৃদু হাসলো, ঠোঁটের কোণে হাঁসি ধরে রেখে ছোট করে বলল,

-থ্যাংক ইউ।

নিজের কটাক্ষের বিনিময়ে জাহানারার এমন প্রতি উত্তর আশা করেনি আদিব।তার চোয়াল শক্ত হলো। জাহানারা যেটা স্পষ্ট দেখলো।তবে খুব একটা গুরুত্ব দিল না।মাথা ঝিমঝিম করছে তার।পেটে জ্বলছে।খিধে লেগেছে।এই মুহূর্তে কিছু না খেলে হচ্ছে না।এখন তার খাওয়া দরকার ।এই ছেলের রাগ বাগ পরে দেখা যাবে।শোয়া থেকে উঠে বসতে চেষ্টা করলো জাহানারা।সাথে সাথে সারা শরীর ব্যথায় ঝনঝনিয়ে উঠলো।সব থেকে বেশি পীড়া দিল পায়ের নিচের ক্ষতটা। দাঁতে দাঁত রাখল সে।চোখ মুখ নীল হলো ব্যথায়।
নেহার উপর ভীষণ রাগ হলো।মেয়েটাকে বলেছিল, তারিনের কাছ থেকে কোনোভাবে পিছনের পকেট গেটের চাবি আনতে, কিন্তু বোকা মেয়ে পারলো না, অজ্ঞাত প্রাচীর টপকাতে হলো তাঁকে।মনে মনে আহাম্মক বলে গালি দিল সে নেহা কে। তারপর ধীরে সুস্থ উঠে বসলো। আদিব ততক্ষণে তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।এক দৃষ্টিতে তাকে পর্যবেক্ষণ করছে।রাগ ক্ষোভ মিলে অদ্ভুত মুখো ভঙ্গি করে রেখেছে। জাহানারা তার দিকে এক পলক তাকিয়ে টেবিলের দিকে তাকালো চোখ পড়লো টেবিলের উপর রাখা ঢাকা পাত্র গুলোর দিকে।সেদিকে তাকিয়ে আদিব কে উদ্দেশ্য করে বলল,

-খাবার কিছু আছে, না আপনি সব খেয়ে ফেলেছেন?

আদিবের দৃষ্টি আরো একটু রুক্ষ হলো মনে হয়।তবে জাহানারা ভ্রূক্ষেপ করলো না।সে ফের বলল,

-কিছু জিজ্ঞেস করছি।উত্তর দিন প্লিজ। ভীষণ খিধে লেগেছে।

-কেন আমার পুরো ভবিষ্যৎ টা খেয়ে পেট ভরে নি?

-না,ওটাতে শুধু মন ভরেছে।

– তুমি কি জানো তুমি একটা অসহ্য রকমের মিথ্যাবাদী,অসভ্য,বেয়াদব মেয়ে!

জাহানারার দিকে আঙুল তাক করে দাঁতে দাঁত পিষে বলল আদিব।

-এতো দাঁত পিষবেন না। দাঁত ভেঙে যাবে। এমনিতেই চুলে পাক ধরেছে, দাঁত ভেঙ্গে গেল কিন্তু সার্টিফাইড বুড়ো হয়ে যাবেন।

-জাহানারা!

-আস্তে!বাড়ি মানুষজন আছে না।তারা কি ভাববে!

-তোমার নির্লজ্জতা দেখে অবাক হচ্ছি আমি।সামান্য পরিমাণ লজ্জা নেই তোমার, না? এতগুলো দিন ধরে মিথ্যা নাটক করলে,আশে পাশের মানুষ গুলোকে অতিষ্ঠ করলে।বাপ ভাই কে কাঁদালে…!
আমার সাথে এতদিন অভিনয় করলে।এত এত অন্যায় করেও তোমার চোখে মুখে অপরাধ বোধের ছায়া টুকু নেই! উলটো তুমি এই ভোর রাতে আমার সাথে ইয়ারকি করছো!

-ইয়ারকি করছি না।সত্যি বলছি।যাই হোক আমাকে কিছু খেতে দিন।

-আমাকে খাও!

রাগে তিলমিলিয়ে উঠে বলল আদিব। এগিয়ে গেল জানালার দিকে।খুলে দিল জানালা।ভোরের নরম ঠান্ডা বাতাসে দমাতো চাইলো ভেতরের তাপ।রাগে শরীর জ্বলছে তার।সে ভেবেছিল এই মেয়েটা এত দিন যা কাণ্ড কারখানা করেছে তার জন্য দুঃখিত হবে।নিজের কাজের জন্য ক্ষমা চাইবে, অনুতপ্ত হবে। কিন্তু তার মধ্যে যে অনুতাপের ছিটে ফোঁটাও থাকবে না সেটা ভাবেনি।খোলা জানালার সামনে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়ালো আদিব।নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণের জন্য জোরে জোরে দম ফেলতে লাগলো।

-আজ না, পরে একদিন সময় করে খাবো।

সবে মাত্র রাগটা নিয়ন্ত্রণে এসেছিল আদিবের, সে সময় জাহানারার লাগামহীন কথায় নিয়ন্ত্রণ হওয়া রাগটা আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো।অনেকটা তেড়ে এলো সে জাহানারার দিকে হাত উঁচিয়ে বলল,

-আর একটা ফালতু কথা বললে থাপ্পড়িয়ে তোমার দাঁত ফেলে দেবো বেয়াদব।

রাগে গনগনে আদিবের চোখ মুখ। জাহানারা বুঝলো একটু বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে।তবে সেটা প্রকাশ করলো না।মনের ভাব লুকিয়ে গলার শ্লেষ পরিষ্কার করে কথা ঘোরালো,

-খিধে লেগেছে।

ভ্রূতে ভাঁজ পড়লো আদিবের।জাহানারার রোগে ক্লিষ্ট দুর্বল মুখটা দেখে এতক্ষণে টনক নড়লো।মেয়েটা অসুস্থ এটা রাগের চোটে মাথা থেকে বের হয়ে গিয়েছিল তার। ফোঁস করে একটা শ্বাস ফেলল সে। জাহানারার দিকে একটা অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে এগিয়ে গেল টেবিলের দিকে।ঢাকনা উঠিয়ে দেখলো,তার সাথে জাহানারার জন্যও খাবার রেখে গেছে তৃপ্তি। কিন্তু এই গরমে খাবার ভালো আছে কি না সেটা নিয়ে সংশয় দেখা দিল।

ঢেকে রাখা পাত্রের ঢাকনা সরালো আদিব।ঢাকনা সরাতেই নাকে এসে ঠেকলো উৎকট গন্ধ।বুঝলো খাবার নষ্ট হয়ে গিয়েছে। স্বাভাবিক। সেই কোন সন্ধ্যায় রান্না বান্না হয়েছে এতক্ষণ সেসব ঠিক থাকে!প্লেটটা নিচে নামিয়ে তার পাশে রাখা কেকের প্লেটটা হাতে নিল আদিব।এটা দেখে মনে হলো ঠিক আছে, তবুও নিশ্চিত হ‌ওয়ার জন্য চামচ দিয়ে কেটে একটু মুখে নিল। কেক নষ্ট হয়নি বুঝতে পেরে জাহানারা কে বলল,

-পৌলাও মাংস সব নষ্ট হয়ে গিয়েছে।দুই টুকরো পেস্ট্রি আছে, খাবে?

-মিষ্টি নেই?

-কি?

-মিষ্টি-টিষ্টি নেই?

ঘাড় ফিরালো আদিব।টেবিলের দিকে তাকালো।একটা বড় প্লেট।প্লেটের ঢাকনা সরাতেই তিন চার রকমের মিষ্টি চোখে পড়লো।সে ওখান থেকে দুটো মিষ্টি ছোট্ট বাটিতে তুলতেই জাহানারা বলল,

-প্লেট ধরে নিয়ে আসেন।

আদিব জাহানারার কথা শুনে তার দিকে সরু চোখে তাকালো।চোখের ভাষায় বলতে চাইলো এতো খেতে পারবে? জাহানারা বুঝলো তার দৃষ্টির মানে।বলল,

-ওভাবে তাকিয়েন না। একবার নিয়ে আসেন, সব শেষ করে ফেলবো।

শব্দ করে একটা শ্বাস ফেলল আদিব প্লেট দুটো নিয়ে গিয়ে জাহানারার সামনে রাখলো।বসলো তার সামনে। জাহানারা বিনা বাক্য ব্যয়ে হাতে তুলে নিল প্লেট।মন দিলো খাওয়ায়। কি মনে করে একবার আদিবের দিকে তাকালো।জানতে চাইলো সে খেয়েছে কি না।আদিব তার কথার উত্তরে বিরক্ত হয়ে বলল,

-আমাকে নিয়ে তোমার ভাবতে হবে নিজে খাও।

-ফাইন।

নিজের খাওয়ায় আবার মনোযোগী হলো জাহানারা।‌একটা পেস্ট্রি সহ পুরো মিষ্টির প্লেট খালি করে থামলো সে।পানি খেয়ে মুখ মুছে তৃপ্তির ঢেকুর তুললো।আদিব তখন তার দিকে তাকিয়ে।তার গোগ্রাসে গেলা দেখছিল সে।আদিব কে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে জাহানারা দাঁত বের করে হাসলো,বলল,

-আপনার বিরহে দুই দিন প্রায় না খাওয়া। তাছাড়া জানেন তো মিষ্টি আমার কত পছন্দ।

-সব শেষ করলে যখন তখন ওটা বাকি রাখলে কেন?

প্লেটে বেঁচে যাওয়া কেকের টুকরো দেখে কটাক্ষ করে বলল আদিব।

-ওটা তো আপনি খেয়েছেন।আমি কারো এঁটো খাই না।

জাহানারার কথাটা শুনে এক ভ্রূ উঁচিয়ে চোখ সরু করলো আদিব।দুই সপ্তাহ আগেও নির্লজ্জের মত তার খাওয়া “এঁটো” জুস এক প্রকার কেড়ে খেয়ে স্বামী স্ত্রীর ভালোবাসা বৃদ্ধির জ্ঞান দিতো আর আজ তার খাওয়া জিনিস “এঁটো” বলে খেতে পারছে না!বাহ!

-কথায় কথায় ওভাবে ত্যাড়া বাঁকা করে তাকান কেন! অদ্ভুত!

চোখ সরালো আদিব।উঠে গেল তার সামনে থেকে।বিড়বিড়ালো বেয়াদব শব্দটা। জাহানারা যেটা স্পষ্ট শুনলো। আদিবের অলক্ষ্যে ঠোঁট টিপে হাসলো।আদিব গিয়ে বসলো সামনের সোফায়। জাহানারা আরাম বিছানার হেড বোর্ডে হেলান দিলো।আদিব নিজের জায়গায় বসে শীতল দৃষ্টিতে চাইলো তার পানে। জাহানারা ভ্রূ নাচালো কিন্তু আদিব কিছু বলল না।ওভাবে বেশ কিছু সময় অতিবাহিত হলো ।আদিব কোন কথা বলছে না বিধায় জাহানারা‌ও কিছু বলল না। কিছুক্ষণ এদিক ওদিক তাকাতাকি করে নিজের চঞ্চল দৃষ্টি স্থির করলো আদিবের ওপর।আদিবের চোখে চোখ রাখলো।এবার নীরবতা ভাঙলো আদিব।

-আমার কিছু মনে নেই,ষ!আমি কাউকে চিন্তে পারছি না!কান্না কাটি ইত্যাদি ইত্যাদি এত ,এত নাটক সব আমার সাথে বিয়ে করার জন্য?

-ইয়েস।

সময় অপচয় না করেই উত্তর দিল জাহানারা।আদিবের মুখ থমথমে হলো।

-এসব করতে তোমার লজ্জা করেনি একটুও?‌

-লজ্জা ,ঘৃণা,ভয় দিন থাকতে নয়! মোশাররফ স্যারের অমোঘ বাণী।আমার কিন্তু মনে আছে আপনার মনে নেই?

-‌এসব করার সময় একবারও আমার কথা মনে হলো না?আমার

আদিবের কথার মাঝে ফিক করে হেসে উঠলো জাহানারা।বলল,

-স্যরি,বাট আপনার কথা ভেবেই তো এত কিছু করালাম।আর আপনি জিজ্ঞেস করছেন আপনার কথা মনে হলো কি না!

-জাহানারা আমার সাথে একদম হেঁয়ালি করবে না।অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে রেখেছি, ধৈর্য চ্যুত হলে খবর আছে তোমার!

বরফ শীতল কণ্ঠে বলল আদিব। জাহানারা পূর্বের নেয় চোখে চোখ রাখলো তার। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেলল তার চোখে। সেভাবেই তাকিয়ে স্পষ্ট কণ্ঠে বলল,

-আপনার সুখ শান্তি আমার কেন জানি পছন্দ হয় না।গায়ে জালা ধরে, আপনি ভালো আছেন সুখে আছেন এ কথা শুনলে। আপনাকে আমার সাধ্য মত খারাপ রাখার জন্য এতো কিছু করতে হয়েছে আমাকে। ক্লিয়ার?

আদিব চমকালো।চোখে মুখে খেলে গেল তার বিস্ময়।তার ধারণা ছিল জাহানারা তাকে ভালোবাসে, তাই তাকে পাওয়ার জন্য এত কিছু করছে।মুখে যায় বলুক মেয়েটার তার জন্য করা এই পাগলামি অল্প স্বল্প নাড়া দিয়েছিল তার মনে। ক্ষণিকের জন্য মনে হয়েছিল মেয়েটা একতরফা ভালোবেসে তার জন্য এত কিছু করতে পারলে, ভালোবাসার বিনিময়ে ভালোবাসা পেলে কি করবে!এসব ভেবেই তো তার অবচেতন মন বারবার এগিয়ে যেত মেয়েটার দিকে, চেষ্টা করতো তাঁকে বোঝার ,তার কথিত ভালোবাসা বোঝার।অথচ তার সব ধারণা মিথ্যা ছিল!ঠুনকো ছিল! জাহানারার কথা শুনে নিজের ভাবনা চিন্তা আঁস্তাকুড়ে ফেলল আদিব। গম্ভীর স্বরে বলল,

-ভালোবাসো না! ঘৃণা করো?

-ইয়েস।

-তাহলে বিয়েতে সম্মতি দিলে কেন?

-বাইরে থেকে আপনার সুখ শান্তি কতটাই বা নষ্ট করতে পারতাম! তাই আপনার অন্দরে প্রবেশ করলাম। তাছাড়া কিছু না।

-আমাকে এতো ঘৃণা করার কারণ?

– বলতে চাইছি না। আমার মন।আমার অনুভূতি।আপনাকে জানাতে ইচ্ছুক ন‌ই।

দৃষ্টি সুচালো হলো আদিবের।তার পছন্দ হলো না জাহানারার এমন ঔদ্ধত্য আচরণ।সর্ব শরীর জ্বলে উঠলো। রক্ত মাথায় চড়লো।তড়াক করে উঠে দাঁড়ালো সে ক্ষিপ্র গতিতে জাহানারার দিকে এগিয়ে গেল।নিজের শক্ত হাতে চোয়াল চেপে ধরলো জাহানারার। নিজেদের মধ্যের দূরত্ব কম করে নিঃশ্বাসে নিশ্বাস মিশিয়ে ক্রুদ্ধ স্বরে বলল,

-বিয়ে করছো, সুস্থ ভাবে সংসার করবে ,বেশি বাড়াবাড়ি করলে বাপের নাম ভুলিয়ে দেব।আমার সুখ শান্তি নষ্ট করার চিন্তা বাদ দিয়ে নিজের চিন্তা করো।

নিজের কথা শেষ হতেই মৃদু বল প্রয়োগ করে ঝাঁকি দিয়ে জাহানারার চোয়াল ছাড়লো আদিব।জাহানারার ঘাড়ে সামান্য ব্যথা লাগলো তাতে। কিন্তু আদিবের সামনে সেটা প্রকাশ করলো না। নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে তাকালো আদিবের দিকে।শীতল দৃষ্টি রাখলো আদিবের চোখে।আদিব তার সেই দৃষ্টিতে দৃষ্টি গেঁথে ফের বলল,

-“এন্ড আই মীন ইট”।

ঘর থেকে বেরিয়ে গেল আদিব।তার গমনরত পথের দিকে তাকিয়ে জাহানারার সুন্দর মুখ অন্ধকার আচ্ছন্ন হলো।দৃষ্টিতে অস্বচ্ছতা নিয়ে সে বিড়বিড়ালো,

-আই হেইট ইউ টু আদিব আহাসান।

_____________
-মা কিছু খেয়ে না‌ও। ঔষধ খেতে হবে।

-কানের গোড়ায় ঘ্যান ঘ্যান করিস না তো।যা এখান থেকে।

তৃপ্তির উপর খেঁকিয়ে উঠলো তানিয়া। তৃপ্তি মায়ের ঝাড়ি খেয়ে চোখ মুখ গোটাল। খালার দিকে তাকালো।জিনিয়া চোখের ইশারায় তাকে কে আশ্বস্ত করলো যে, সে দেখছে। তৃপ্তি খালার কথায় আশ্বস্ত হলো।সরে গেল ঘর থেকে।জিনিয়া বোনের গায়ে হাত বুলিয়ে বোঝানোর সুরে বলল,

-আপা রাগ ফেলে এবার কিছু মুখে দাও।কাল রাতে কিছু মুখে তোলো নি ,সকালেও কিছু খেলে না,এখন বাজে দুপুর দুইটা, এতসময় না খেয়ে আছো, আবার বলছো খাবে না। এমন করলে হয়! শরীর খারাপ করবে তো!

-শরীর খারাপ হোক।মরে যায় আমি।এত অপমান সহ্য করে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়া ভাল। আল্লাহ আমার মরণ করুক।

-আপা!ওসব কথা কেন বলছো।জানো না এসব বলতে নেই। আল্লাহ নারাজ হয়।

জিনিয়ার কথা শেষ হতেই দরজা টোকা পড়লো।জিনিয়া পিছন ফিরে তাকালো।তানিয়ার মনে হয়েছিল ছেলে এসেছে হয়ত নিজের কাজের সাফাই দিতে। কিন্তু তাকে নিরাশ করে শামীম ঢুকলো ঘরে।তানিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলল,

-তুই কি ছোট্ট বাচ্চা!কি শুরু করেছিস!রাগ হয়েছে বুঝলাম কিন্তু এর সাথে খাওয়ার সম্পর্ক কি।আর তাছাড়া আমি তো তোর রাগ করার কোনো কারণ দেখছি না।তুই অনেক বছর আগে বাবা মা’র সাথে যা করেছিস তোর সাথে তাই হচ্ছে।একে বলে কর্মফল, এখানে তো তোর রাগ করার প্রশ্নই ওঠে না।

শামীমের ধা’রা’লো তীরের নেয় কথা।জিনিয়ার সামনে এভাবে বলায় লজ্জায় অপমানে কুঁকড়ে গেল তানিয়া। দিপ্তীর বিয়ের পর থেকে একাধিক বার আত্মীয় স্বজনের মুখ থেকে সে শুনেছে,”মা বাবা পালিয়ে বিয়ে করছে মেয়ে তো করবেই”।এসব কথা শুনে শুনেই তৃপ্তি আর আদিব কে সবসময় নিজের চোখে চোখে রেখেছে।নিয়ম শৃঙ্খলার বেড়া জালে আটকেছে। সবসময় চেষ্টা করেছে তারা যেন দিপ্তীর মতো কিছু না করে।অথচ তার ছেলে তার চেষ্টা প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে তাকে আবার দাড় করিয়েছে পুরোনো কাঠ গড়ায়!ছোট করেছে তাকে সবার সামনে।

-চুপ চাপ ওঠ।খেতে চল।ঐদিকে তোর বর, মেয়ে তোর জন্য না খেয়ে বসে আছে।আর তুই এখানে গুম হয়ে বসে আছিস!ওঠ।চল।

-তুমি যাও আমি যাবো না।

গো ধরে বলল তানিয়া।

-তানি!আমাকে রাগাস না কিন্তু। এখুনি ওঠ।ওঠ বলছি।কি হলো ওঠ…!

শামীমের ধমকা ধমকিতে এক প্রকার বাধ্য হয়ে উঠে দাঁড়ালো তানিয়া।পা বাড়ালো শামীমের পিছু।তার প্রতিটি পদক্ষেপের সাথে আদিবের প্রতি রাগ,অভিমান আরো গাঢ় হলো।মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো ছেলেকে তার কাজের জন্য সে কখনো মাফ করবে না।

চলবে, ইনশাআল্লাহ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ
পরবর্তী নিবন্ধ
গল্প পোকা
গল্প পোকাhttps://golpopoka.com
গল্পপোকা ডট কম -এ আপনাকে স্বাগতম......
RELATED ARTICLES

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments

Md masrur Hasan mahi على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
আমিনুল ইসলাম على প্রয়োজন পর্ব: ৩০ ( অন্তিম)
সাজিবুল ইসলাম على ধর্ষিতাবউ২ ৯ তথা শেষ পর্ব
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
Nita Sarkar على স্বপ্নীল ৬৮
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على রহস্য শেষ_পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على অলক্ষ্যে তুমি পর্ব-০৬ এবং শেষ পর্ব
Nazmun Nahar Akhi على Psycho_is_back? part_7
Nazmun Nahar Akhi على Dangerous_Villian_Lover part 2
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على জানালার ওপারে পর্ব-১৭ এবং শেষ পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على লীলা বোর্ডিং ১২১৫ পর্ব-১১ এবং শেষ পর্ব
মিজানুর রহমান রাহুল على সেই তুমি পর্ব-০১
@feelings على প্রহেলিকা
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Nusrat jahan على coffee & vanilla Part-10
Pallabi Roy على স্বপ্নীল ৬৮
M.D Mahabub على The_Villain_Lover Part_2
Labani sarkar على Dangerous_Villain_Lover part 23
MD Akas Apc على বিবেক
Tanisha Ahmed على Devil love part-18 
Aius Barmon shorob على নারীর দেহকে নয়
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Priya Banerjee على devil love married life last part
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Riya Biswas على তুমি রবে ৫২
Mohammad Adib على তুমি রবে ৬০
Avni Ayesha على তুমি রবে ২৮
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
সুমিত على তুমি রবে ২৮
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
Samiah Begum على তুমি রবে ৫১
biddut das rocky على নর নারী
গল্প পোকা على নষ্ট গলি শেষ পর্ব
Md Jobayer Hossain Shohag على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على দুই অলসের সংসার
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤৪২.
A.J.S Rakib على মন ফড়িং ❤৪২.
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
Samiya noor على গল্পঃ ভয়
Sadikul على গল্পঃ ভয়
Samia Islam على গল্পঃ ভয়
শূন্য মায়া على মন ফড়িং ❤ ৪০.
Sutapa biswas على মন ফড়িং ❤৩৯.
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৮.
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৭
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
Siyam على বিবেক
Sudipto Guchhait على My_Mafia_Boss পর্ব-৯
saptami karmakar على devil love married life last part
saptami karmakar على devil love married life last part
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ২৬.
Shreyashi Dutta على  বিয়ে part 1
Sandipan Biswas على  বিয়ে part 1
Paramita Bhattacharyya على অনুরাগ শেষ পর্ব
জামিয়া পারভীন তানি على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
মায়া على মন ফড়িং  ২২
সুরিয়া মিম على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على মন ফড়িং ২১
গল্প পোকা على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
Sahin ssb على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৮. 
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৭.
Jannatul Ferdous على খেলাঘর পর্ব-৩৫
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ফাল্গুনের_ফুল last_part_8
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ছাত্রী যখন বউ পাঠঃ ১
গল্প পোকা على বাজির প্রেম পাঠঃ ১
Foujia Khanom Parsha على মা… ?
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৮
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
Ibna Al Wadud Shovon على স্বার্থ