Monday, October 6, 2025







সৌরকলঙ্ক পর্ব-১৫+১৬

#সৌরকলঙ্ক
#উম্মে_প্রভা
#পর্ব_১৫

ঘড়ির কাঁটায় আবার চোখ ফেলল তানিয়া ।এই দিয়ে কতবার যে সে সময় দেখলো তার হিসাব নেই।রাত বাজে একটা অথচ আদিব এখনো বাড়ি ফেরেনি।তানিয়া বেশ কিছুদিন ধরে লক্ষ্য করছে আদিবের রাত করে বাড়ি ফেরার ব্যাপারটা।রোজ রোজ আদিবের এই রাত বিরাত বাড়ি ফেরা পছন্দ হচ্ছে না তানিয়ার।বেশ কয়েকবার এ নিয়ে আদিবের সাথে কথাও বলতে চেয়েছে সে।
কিন্তু আদিব কে বাগে পেলে তো!সে জায়েদের বাড়ি ঘাটি গেড়েছে, এখন তার খাওয়া-দাওয়া,উঠা-বসা সব সেখানেই।মায়ের জন্য তার সময় কোথায়! তার সব সময় তো জাহানারার। জাহানারা জাহানারা করে পাগল হয়েছে ছেলেটা।তানিয়া মানছে মেয়েটা অসুস্থ কিন্তু তাতে তার ছেলের কি? জাহানারার বাবা আছে ,ভাই ,ভাবি আছে,মামারা আছে,চাচা ,ফুপু সবাই আছে তার দেখুক না। কিন্তু না, এতো সব থাকতেও তার ছেলেকে লাগবে তার! আজকাল এসব কথা ভাবতেই রক্ত গরম হয়ে ওঠে তানিয়ার।রাগ হয় আদিবের উপর।একটা উচ্চ শিক্ষিত ছেলে এতোটা আহাম্মক কীভাবে হয় ভেবে পায় না সে।কি দরকার ছিল আদিবের যেচে পড়ে ঝামেলায় জড়ানোর। মানবিকতার চক্করে কাজ কাম ছেড়ে এখানে বসে তার ছেলে এসব করছে,সহ্য করা যায়?

রাগে গজগজ করতে করতে আরো একবার ঘড়ি দেখলো তানিয়া। ঘড়ির কাঁটা জানান দিল একটা তিরিশ বাজে।না আর এভাবে চুপ করে বসে থাকলে হবে না।আজ একটা হেস্তনেস্ত করতেই হবে।তানিয়ার ধৈর্য চ্যুত হলো।সে রাবেয়া কে ডেকে সদর দরজা দিতে বলে বাইরে বেরিয়ে গেল।

____________
জাহানারার শরীর ভালো না।জ্বর এসেছে।সকাল থেকে বেশ কয়েকবার বমি করে ফ্লোর ভাসিয়েছে।জায়েদ, আকিব বাড়ি নেই।সালেহার বাবার বাড়ি জমি জায়গা নিয়ে কি এক ঝামেলা বেঁধেছে যার জন্য তাদের সেখানে যেতে হয়েছে।নেহা ছিল কিন্তু সেও কোন এক কাজে আজ সকালে ঢাকার উদ্দেশ্যে র‌ওনা দিয়েছে।বাড়িতে জাহানারা আর তারিন একা। জাহানারার এমন অবস্থায় ভড়কে গিয়েছিল তারিন তাই কোন কিছু না ভেবে বাধ্য হয়ে আদিব কে ডেকে পাঠিয়েছিল।আদিব আসার পর জাহানারার অবস্থা আরো খারাপ হয়।জ্বরের তেজে জ্ঞান হারায় সে। জ্ঞান ফেরার পর আবার বমি করে।আদিব ******ইনজেকশন দেওয়ার পর কিছুটা উন্নতি হয় জাহানারার শরীরের কিন্তু আদিব কে পাশে পেয়ে ছাড়তে চায় না সে।আদিব‌ও ভেবে দেখে বাড়িতে তারিন ছাড়া এ সময় কেউ নেই, তারিনের একটা ছোট্ট মেয়ে আছে, এখন সে মেয়েকে সামলাবে না জাহানারা কে? তাছাড়া রাত বিরাত যদি জাহানারা কিছু হয় তখন সে একা কি করবে? এসব ভেবে আজ রাতটা এখানে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই আদিব। আজ বাড়ি ফিরবে না এ কথা মা কে ফোন করে বলতে চেয়েছিল সে, কিন্তু রাত দশটার পরে জাহানারার অবস্থা হঠাৎ করে আবার খারাপ হয়।ম্যাথা ব্যথা করে ছটফটিয়ে ওঠে সে।একসময় নাক দিয়ে বের হয় সরু র’ক্তের ধারা।ভয় পেয়ে যায় আদিব।আদিব সময় নষ্ট না করে কল করে রাকিব কে ।রাকিব তৎক্ষণাৎ একটা ***** ঔষধ দিতে বলে জাহানারা কে।আদিব সেই মুহূর্তে তারিন কে জাহানারা পাশে রেখে ছুটে যায় ডিসপেনসারিতে।****ঔষধ নিয়ে আসে। ইনজেকশনের মাধ্যমে জাহানারা অবচেতন শরীরের প্রয়োগ করে সেটা।******ঔষধ ইনজেক্ট করার পর জাহানারা স্টেবেল হয়।তারিন আর আদিবের জানে পানি আসে।এসব দৌড়াদৌড়ির মধ্যে সে যে আজ এ বাড়িতে থাকবে এ কথা মা কে জানাতে ভুলে যায়।

মাঝ রাতে কলিং বেলের শব্দে চমকে ওঠে তারিন।সবে মাত্র মেয়েকে ঘুম পাড়িয়েছে সে।তার মেয়েরে ঘুম ভীষণ পাতলা ।ঘরে একটু ঠুকঠাক হলেই উঠে যায়।মেয়ে কলিং বেলের শব্দে মেয়ের ঘুম না ভাঙে তাই তড়িঘড়ি বিছানা ছেড়ে উঠে গেল তারিন।এত রাতে কে এসেছে সেটা দেখার জন্য কি হল চোখ দিতেই তানিয়ার থমথমে মুখটা চোখে পড়লো তার।বুঝলো তার বড় চাচি শাশুড়ি ছেলের টানে এই মাঝ রাতে ছুটে এসেছে।তারিন সময় নষ্ট না করে দরজা খুলে দিল।সালাম দিয়ে তানিয়া কে ভেতরে আসতে বলল।তানিয়া চুপচাপ ভেতরে প্রবেশ করলো।তানিয়ার অন্ধকার আচ্ছন্ন মুখটা দেখে তারিন কোন রকমে জিজ্ঞেস করলো,

-ভালো আছেন বড় চাচি?

তানিয়া হয়ত এমন একটা প্রশ্নেরই অপেক্ষা করছিল।সে ঠেস দিয়ে বলে উঠলো,

-তোমরা ভালো আর থাকতে দিচ্ছো কোথায়!যাই হোক ,আদিব কোথায় ওকে ডাকো।

জাহানারা ঘর থেকে বের হ‌ওয়ার সময় আদিবকে তার শিয়োরে দেখেছিল তারিন।তানিয়ার কথা শেষ হতেই সে বলল,

-আমি ডেকে আনছি।

কথাটা বলেই জাহানারা ঘরের দিকে পা বাড়ালো তারিন।কি যেন মনে করে তানিয়াও পিছু নিল তারিনের। জাহানারার ঘরের দরজা খোলায় ছিল।তারিন ঘরের ভেতরে ঢুকতেই দেখতে পেল।আদিব জাহানারার শিয়োরে বসে বিছানার হেড বোর্ডে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে।আদিবের এক হাত জাহানারা মাথার উপর রাখা আরেক হাত জাহানারা দুই হাতে জাপটে ধরে রেখেছে নিজের বুকের মাঝে। রক্ষণশীল পরিবারের মানুষের জন্য এমন একটা দৃশ্য দৃষ্টি কটু।তারিন একটু অপ্রস্তুত হলো।সে ইতস্তত করে ডাকলো আদিব কে।ঘুম তখনো গাঢ় হয়নি আদিবের , মাত্রই চোখ লেগেছিল।তারিনের ডাকে চমকে উঠলো সে। উদ্ভ্রান্তের মতো তারিনের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলো ,

-কি হয়েছে ভাবি? জাহানারা?

কথাটা বলে উঠতে নিতেই হাতে টান পড়লো আদিবের নিজের গা ঘেঁষে জাহানারা কে নিশ্চিন্তে শুতে দেখে স্বস্তির শ্বাস ফেলল সে।তবে তার স্বস্তি টা দীর্ঘ স্থায়ী হলো না যখন তারিনের পিছনে থাকা মায়ের গনগনে চোখে চোখ পড়লো ।তানিয়া অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ছেলের দিকে। জাহানারা কে ছেলের এত কাছে দেখে ভেতরটা জ্বলছে তার।মা কে এই মুহূর্তে এখানে আশা করেনি আদিব। সে জাহানারার হাত থেকে নিজের হাতটা সাবধানে ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়ালো।এগিয়ে এসে মায়ের উদ্দেশ্যে কিছু বলতে চাইলো হয়ত। কিন্তু তার আগেই তানিয়া স্থান ত্যাগ করলো।

তানিয়ার রাগে উত্তপ্ত চোখ আর থমথমে মুখ দেখে আদিবের বুঝতে বাকি রইলো মায়ের রাগের তীব্রতা। সে তড়িঘড়ি ছুটলো মায়ের পিছু।তানিয়া তখন জাহানারাদের ড্র‌ইংরুম পর্যন্ত পৌঁছেছে আদিব অনেকটা দৌড়ে গিয়ে পথরোধ করলো মায়ের।নরম স্বরে নিজের স্বপক্ষে বলল,

-মা আই ক্যান এক্সপ্লেইন।শোনো

-তোমার এক্সপ্লেনেশনের কোন প্রয়োজন নেই আমার।আমি যা বোঝার বুঝে গেছি।তুমি আমাকে ঠকিয়েছ আদিব।

আদিবের কথা কেটে বলল তানিয়া।তার কণ্ঠে রাগ স্পষ্ট। এলোমেলো শ্বাস প্রশ্বাস।আদিব জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজালো।বোঝানোর সুরে বলল,

-মা তুমি ভুল বুঝছো।আসলে জাহানারা অসুস্থ ছিল।তারিন ভাবি ছাড়া বাড়ি কেউ নেই, তাই আমি থেকে গিয়েছিলাম। যদি রাত বিরাত কিছু হয়!তোমাকে ফোন করে বলতে চেয়েছিলাম কিন্তু জাহানারার শরীর হঠাৎ এতো অসুস্থ হয়ে পড়লো যে ওকে সামলাতে সামলাতে তোমাকে ইনফর্ম করার কথা মাথা থেকে বেরিয়ে গেল।আমি…

আদিবের কথা অসমাপ্ত রেখেই সদর দরজার দিকে হাঁটা দিল তানিয়া।তার ভেতরটা কেমন কেমন জানি করছে।তার ছেলেকে তার থেকে ভালো আর কেউ চেনে না।ছেলের চোখে মুখে জাহানারার জন্য আজ যে অভিব্যক্তি দেখেছে সেটা বারবার তাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে তার সব চেষ্টা প্রচেষ্টার ব্যর্থতার কথা।ভয় হচ্ছে তার, ভীষণ ভয়।কানে বাজছে জাহানারা বলা বর্ষ পুরোনো কিছু কথা।

ঘটনাটা আদিব লন্ডন যা‌ওয়ার দুই বছর পরের। সাজ্জাদের বড় মেয়ে মিতুর বিয়েতে পরিবারের সবাই এক জায়গায় হয়েছিল আবার।নতুন পুরোনো অনেক আত্মীয় স্বজন এক হয়েছিল সাজ্জাদের বাড়ির উঠানে।সে আত্মীয়-স্বজনের মাঝে জাহানারা বেগমের খালাতো বোন লতিফাও ছিল।লতিফা কে জাহানারা বেগমের বোন কম ঘনিষ্ঠ বান্ধবী বললেও ভুল হবে না। জাহানারা বেগম যতদিন বেঁচে ছিল তার সাথে নিজের মনের সকল কথা বলতো সে।স্থানের দূরত্ব থাকলেও টেলিফোন দুই মিনিটের কথা কোনোদিন বাদ যেত না তাদের। জাহানারা আর আদিব কে নিয়ে জায়েদ কে দেওয়া আশরাফের কথা সম্পর্কেও জানতো সে। জাহানারা বেগমের এ বিষয়ে তীব্র আগ্রহ‌ও অজানা ছিল না লতিফার ।তিনি সকলের উপস্থিতিতে সেই বার আবার পুরোনো কথা তুলেছিলেন।একটা চেষ্টা করেছিলেন তানিয়ার মন পরিবর্তনের কিন্তু তানিয়া তার কথা কানে তোলে নি।উলটো সবার সামনে জাহানারা কে তার ছেলের অযোগ্য বলে অপমান করেছিল। জাহানারা তার ছেলের নখের যোগ্য না এমন কথাও উচ্চরণ করেছিল।সেই সাথে সালেহার শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে খোটা তুলেছিল। অহংকারে বশবর্তী হয়ে সবার সামনে ছোট করেছিল জায়েদ আর সালেহাকে।নিজের কথার বাণে ক্ষ’তবি’ক্ষত করেছিল সালেহার অন্তর‌আত্মা।

জাহানারা সেদিন সেখানেই উপস্থিত ছিল। তখনো পুরোপুরি সুস্থ হয় নি জাহানারা।সাইক্যাট্রিস্টের কাছে তখনো আসা যাওয়া নিয়মিত তার।শাহেদ ডাক্তারের পরামর্শ মতোই সবার মাঝে নিয়ে এসেছিল তাকে।কিন্তু শাহেদ ভাবেনি মেয়েটার সুস্থতার আশায় তাকে আবার এমন একটা বাজে পরিস্থিতির স্বীকার করবে।

জাহানারা বড় চাচির প্রতিটা কথা ,শব্দ ,বাক্য সব শুনেছিল সেদিন।দেখেছিল বাবার লজ্জা আড়ষ্ট মুখ আর মায়ের চোখের পানি।নিজের বিষয়ে বলা কথা গুলো যদিও সে সহ্য করে নিয়েছিল কিন্তু মা কে বলা কথা সহ্য করতে পারেনি সে।কারো পরোয়া না করে সবার সামনে বড় চাচির মুখোমুখি মুখি দাঁড়িয়েছিল সে। ভেতরের জ্বলতে থাকা আগুনের উত্তাপ কণ্ঠে এনে বলেছিল,

-আপনার ঐ যোগ্য ছেলেকে যদি আমার পিছনে নাকে দড়ি দিয়ে না ঘুরিয়েছি তো আমার নাম জাহানারা না।খুব অহংকার না আপনার ছেলেকে নিয়ে! আপনার এই অহংকার মাটিতে মিশিয়ে দেব একদম।মা ছেলে কেঁদে কুল পাবেন না!

জাহানারা কথা শুনে রাগ চরমে উঠলো তানিয়ার। রাগে অন্ধ হয়ে হাত উঠল জাহানারার উপর। সজোরে চড় বসালো জাহানারার গালে। দাঁতে দাঁত পিষে বলল,

-বেয়াদব।

জাহানারা কথা আর তানিয়ার কাজে স্তব্ধ হলো সবাই।শাহেদ এসে ভাতিজিকে সামলালো।সবার সামনে তানিয়ার সম্মানের কথা ভেবে দাঁতে দাঁত চেপে বেরিয়ে গেল জাহানারা কে নিয়ে। পরেরদিন তানিয়া আশরাফ কে বাড়িয়ে চাড়িয়ে বলল জাহানারা বলা কথাগুলো। আশরাফ সেদিন সেখানে অন‌উপস্থিত থাকলেও সাজ্জাদের কাছ থেকে সবটা শুনেছিল।জায়েদ আর সালেহাকে করা তানিয়ার অপমান সম্পর্কে‌ও অবগত ছিল সে। সাজ্জাদের কাছ থেকে সব শুনে তৎক্ষণাৎ মেজাজ খারাপ হয়েছিল আশরাফের তবে জাহানারার বলা কথা শুনে কেন জানি একটু শান্তি পেয়েছিল।মনে হয়েছিল তার দামড়া দামড়া ভাই গুলো ভদ্রতার খ্যাতিরে যেটা করতে পারিনি তার কিছুটা তো ঐ ছোট্ট মেয়েটা করতে পেরেছে।তানিয়ার কাছ থেকে তার রং মাখানো কথা শোনার পর আশরাফ কণ্ঠে মাত্র অতিরিক্ত শীতলতা এনে বলেছিল,

-তানিয়া তোমাকে একটা স্পষ্ট কথা জানিয়ে দিচ্ছি, এরপর যদি তুমি সালেহা কিংবা জায়েদ কোন ধরনের বাজে কথা বলো বা অপমান করো তাহলে আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না।অ্যান্ড আই মিন ইট।

আশরাফের ঐ শীতল কণ্ঠে কি ছিল কে জানে! তানিয়া এরপর আর কখনো সালেহা কিংবা জায়েদ কে কোনো কটু কথা বলিনি।এমনকি তাদের কে এবং তাদের যে কোনো বিষয় সুক্ষ্মভাবে এড়িয়ে গেছে।

এতগুলো দিন, এতগুলো বছরের ব্যবধানে জাহানারার বলা সেদিনের কথাগুলো ভুলে বসেছিল তানিয়া। কিন্তু আজ ছেলেকে জাহানারা কে আগলে বসে থাকতে দেখে সেই কথাগুলো যেন কানে বাজতে লাগলো।আদিবের কথা গুলো শুনতে ইচ্ছা করলো না তার।তাই তো ছেলের কথা উপেক্ষা করে পা বাড়ালো সামনে।

তানিয়া চলে যেতেই ফোঁস করে একটা শ্বাস ফেলল আদিব। তারিন কে জাহানারার খেয়াল রাখতে বলে ছুটলো মায়ের পিছনে।

______________

বাড়ির দরজায় আসতেই “বড় ভাবি” বলে রাবেয়ার দেওয়া চিৎকার কানে এলো আদিবের।সে সাথে সাথে দৌড়ালো ভেতরে।ভেতরে ঢুকে মা-কে মাটিতে পড়ে থাকতে দেখেই গলা বুক শুকিয়ে এলো তার।ছুটে গেল মায়ের কাছে।মায়ের মাথাটা কোলে নিয়ে পাগলের মতো ডাকতে লাগলো তাকে।রাবেয়া পানি নিয়ে এলো তাড়াতাড়ি। রাবেয়ার হাত থেকে পানি নিয়ে বারকয়েক তানিয়ার চোখে মুখে পানি ছিটালো আদিব। কিন্তু তানিয়ার জ্ঞান ফিরলো না।আদিবের ভয় হতে লাগলো এবার।তার মায়ের হার্টের সমস্যা আছে।চার বছর আগে ধরা পড়েছে রোগটা।আদিবের হঠাৎ মনে হলো মায়ের আবার ক্যার্ডিয়াক অ্যাটাক আসেনি তো?মায়ের বিবর্ণ মুখ আর নিথর দেহ দেখে নিজের পেশাদারিত্ব ভুলে বসলো সে।কিছু না ভেবেই ফোন করলো নিকটস্থ হাসপাতালে।মিনিট পাঁচেক সময় লাগলো আ্যম্বুলেন্স আসতে।আদিব মা কে নিয়ে উঠে বসলো আ্যম্বুলেন্স।

হাসপাতালে ভর্তি করা হলো তানিয়াকে। আশরাফ হাসপাতালেই ছিল।আদিব তানিয়াকে নিয়ে ভেতরে ঢুকতেই তার সাথে দেখা হল।বাবাকে দেখে আদিব যেন কিঞ্চিৎ স্বস্তি পেল। হাসপাতালে নিয়ে আসার প্রায় ঘণ্টাখানেক পরে জ্ঞান ফিরলো তানিয়ার। আশরাফ আদিব কে জানালো এখন ঝুঁকি মুক্ত সে।পেশার ফল করে শারীরিক দুর্বলতায় জ্ঞান হারিয়েছিল।আদিব অবশ্য তানিয়ার অবস্থা দেখে এটাই আশঙ্কা করেছিল কিন্তু নড়বড়ে মনের জোর নিয়ে আগ বাড়িয়ে কিছু করার সাহস পায়নি। আশরাফের কথা শুনে আটকে থাকা শ্বাস ছাড়লো আদিব।তার মনে হচ্ছিল এতক্ষণ গলার গোড়ায় কি যেন আটকে ছিল।খুব কষ্ট হচ্ছিল।এক কাক ডাকা ভোরে দাদিকে যে অবস্থায় দেখেছিল সেই দৃশ্য বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল।নিজেকে ভীষণ অসহায় লাগছিল। বাবার কথায় বুকের ভেতর থেকে বড় একটা চাপ সরে গেল যেন।একটা লম্বা শ্বাস টেনে ওয়াশরুম থেকে চোখে মুখে পানি ছিটিয়ে এলো।তানিয়াকে ততক্ষণে কেবিনে দেওয়া হয়েছে।আদিব ধীর পায়ে প্রবেশ করলো মায়ের কক্ষে।

তানিয়া নিষ্প্রাণ চোখে তাকালো ছেলের দিকে।আদিব টুল টেনে মায়ের পাশে বসলো।মায়ের হাতটা মুঠোয় নিয়ে কাতর স্বরে বলল,

-আই এম স্যরি মা,আই এম স্য

-আমি রুবাইয়ার সাথে তোমার বিয়ে দিতে চাই আদিব।আমার খুশির জন্য তুমি এই বিয়েটা করতে পারবে না?

আদিবের কথা কেটে বলল তানিয়া।মায়ের কথা হতবাক হলো আদিব। তানিয়া ছেলের হতভম্ব মুখের দিকে তাকিয়ে আবার বলল,

-পারবে না আমার খুশির জন্য এই বিয়েটা করতে?

কথাটা বলতে বলতে চোখের কোণে পানি জমলো তার।আদিব মায়ের পূর্বের প্রশ্নের জবাব হাতড়াচ্ছিল নিজের মধ্যে ঠিক সেই সময় মায়ের অশ্রু শিক্ত চোখ দেখে ভেতরটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগলো।সে আর কিছু না ভেবেই বলল,

-পারবো।

-সত্যি!

-হুম।

আদিবের ইতিবাচক উত্তরে সাথে মুখে হাঁসি ফুটে উঠলো তানিয়ার।আদিব মায়ের মুখের হাঁসি দেখে জোর করে মুখে হাঁসি টানলো। আশরাফ দরজার মুখেই দাঁড়িয়ে ছিল।মা ছেলের কথোপকথন শুনেছ সে।তানিয়া যে ছেলেকে আবেগের চাপে ফেলে নিজের কার্য সিদ্ধি করেছে সেটাও বুঝেছে। তানিয়ার মুখের হাসি দেখে ঠোঁটের কোণে তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে উঠলো আশরাফের।সশব্দে বেরিয়ে এলো তপ্ত শ্বাস।

চলবে, ইনশাআল্লাহ।

#সৌরকলঙ্ক
#উম্মে_প্রভা
#পর্ব_১৬

ছেলের সম্মতি পাওয়ার পর তানিয়া যেন আর এক মুহূর্তও দেরি করতে চাইলো না আদিব আর রুবাইয়ার আগত সম্পর্কে।তাই তো পরেরদিন বাড়ি ফিরেই ভাইকে ফোন করে ছেলের মতামত জানালেন।শামীম খুশি হলো আদিবের ইতিবাচক সাড়া পেয়ে তবে কিছু একটা ভেবে তানিয়ার কাছে জানতে চাইলো আশরাফের কি মত?তানিয়া ছেলের উত্তর পাওয়ার পর আশরাফের সাথে আর এ বিষয়ে কোন কথা বলেনি।শামীমের সাথে সে যখন কথা বলছিল আশরাফ তখন তার সামনে বসা।ভাইয়ার কথা শুনে সে আশরাফের দিকে তাকালো। আশরাফের নজর খবরের কাগজে থাকলেও কান তানিয়া আর শামীমের কথোপকথনে ছিল। তানিয়া ফোনের স্পিকারে হাত চেপে আশরাফের উদ্দেশ্যে বলল,

-এই শুনছো,ভাইয়া তোমার মত জানতে চাইছে কি বলবো?

-বলো, ছেলের সম্মতিতেই ছেলের বাপের সম্মতি।

খবরের কাগজ চোখ রেখেই বলল আশরাফ। তানিয়া হাফ ছেড়ে বাঁচলো। ঠোঁটের কোণে দেখা দিল তার চ‌ওড়া হাঁসি। আশরাফ এই বিয়েতে আদৌও রাজি হবে কি না এই নিয়ে খুব চিন্তায় ছিল তানিয়া।সে আশরাফের বলা কথাটা আরো সাজিয়ে গুছিয়ে বলল শামীম কে।শামীম আশরাফের সম্মতি পেয়ে বলল,

-তাহলে তোরা আংটি বদলের দিন ঠিক করে আমাকে জানাস

-আংটি বদল না ভাইয়া, একেবারে আকদ করতে চাইছি আমি।এখন আকদটা হয়ে থাক আদিব ফেরার আগে না হয় ধুম ধাম করে অনুষ্ঠান করে রুবাইয়া কে নিয়ে আসবো।কি বলো?

শামীমের কথা কেটে বলল তানিয়া। আশরাফ স্ত্রী দিকে আড় চোখে তাকালো।বুঝলো এই বিয়ে নিয়ে শামীমের থেকে তানিয়ার তাড়া বেশি। তানিয়ার কথা শুনে শামীম একটু ভাবুক হলো বলল,

-আমরা তো সামনের সপ্তাহ ফেরত যাচ্ছি এর মাঝে আকদ !কীভাবে কি করবি? আয়োজনের একটা ব্যাপার আছে না।কাউকে না বললেও ভাই বোনেদের তো নিতেই হবে।না হলে কথা হবে না?

-আয়োজন নিয়ে তোমাকে চিন্তা করতে হবে না ও ঠিক আমি ম্যানেজ করে নিবো।আর র‌ইলো সবাইকে বলার ফোন করে বললেই হয়ে যাবে। তাছাড়া এখন তো আর সেইরকম কিছু করা হচ্ছে না। সবাই বুঝবে।তোমার আপত্তি না থাকলে তাহলে সামনের শুক্রবার ডেট ফেলা যায়।

-তোর কোন সমস্যা না থাকলে আমার কোন আপত্তি নেই।তবে একা একা সব মাতব্বরি করিস না। আশরাফের কাছে থেকেও কিছু পরামর্শ নিস।

বোনের স্বেচ্ছাচারী স্বভাব সম্পর্কে ভলি ভাতি অবগত শামীম ,যার কারণে কথাটি বলল।ভাইয়ের কথা শুনের কিঞ্চিৎ দমলো তানিয়া তবে সেটা শামীম কিংবা আশরাফ কাউকে বুঝতে না দিয়ে জোরপূর্বক হেসে বলল,

-ওর কাছ থেকে না শুনে আমি কিছু করি না কি?অত সাহস এখনো তোমার বোনের হয়নি।

কথাটা বলতে বলতে চোরা চোখে একবার আশরাফের মুখের দিকে তাকালো তানিয়া।সাথে সাথে তার চোখে পড়লো আশরাফের ঠোঁটের কোণে ফুটে ওঠা তাচ্ছিল্যের হাসিতে। তানিয়া বুঝলো তার কথা এই হাসির কারণ।সে অযথা গলা ঝাড়া দিয়ে কথা ঘুরিয়ে শামীমের উদ্দেশ্যে বলল,

-তাহলে ঐ কথাই র‌ইলো সামনের শুক্রবার তোমরা আসছো।

-হুম।কোনো অসুবিধা হলে আমাকে জানাস।

-ঠিক আছে।

ফোন রাখলো তানিয়া। আশরাফ তখনো তার সামনে বসা।তানিয়া শামীমের সাথে হওয়া কথোপকথন আবার উল্লেখ করলো আশরাফের সাথে। আশরাফ সব শুনে মাথা নাড়ালো,বলল,

-ভালো। তোমার যা ইচ্ছা করো ।কোন প্রয়োজন হলে বলো।

-প্রয়োজন হলে বলবো মানে! তোমার ছেলের বিয়ে, তুমি এমন গা ঝাড়া দিয়ে বসে থাকলে হবে?

-ছেলের মা যখন সব দায়িত্ব গায়ে মেখে বসে আছে তখন আর ছেলের বাপের দরকার হবে না!

থামলো আশরাফ তারপর তানিয়ার দিকে গাঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে গম্ভীর স্বরে বলল,

-তোমার মনে যা চলছে তাই করো।আমাকে এসবের মধ্যে জড়িও না। আমার হস্তক্ষেপ তোমার পছন্দ হবে না।

আশরাফ যেন নিজের কথার মাঝে তানিয়াকে জানান দিল এই সম্বন্ধে তার আপত্তির কথা।তানিয়া অবাক চোখে তাকালো তার দিকে।মনে হলো এতগুলো বছরেও এই মানুষটাকে সে চিন্তে পারেনি। হঠাৎ একটু খারাপ লাগা কাজ করলো মনের ভেতর।আশরাফের অমতে ছেলের বিয়ে দিয়ে ভুল করছে না তো, এ চিন্তা মাথায় এলো। কিন্তু পরক্ষণেই যেই মনে পড়লো আশরাফের মতামত দেখতে গেলে তো জায়েদের ঐ বেয়াদব মেয়েকে বাড়ির ব‌উ করতে হতো!এ কথা মনে হতেই মনের খারাপ লাগাটা মুহূর্তে মিইয়ে গেল তানিয়ার। আশরাফের কথা উপেক্ষা করে উঠে দাঁড়ালো। তৃপ্তি কে ফোন করলো।ডেকে পাঠালো শিমুল আর তৃপ্তি কে।সময় কম এর মধ্যে অনেক কিছু করতে হবে। এবং তাকেই সব করতে হবে!

___________

-আদিব তুমি একটু আমাদের বাড়ি আসতে পারবে?

-আদিব যেতে পারবে না আকিব।আমাকে বলো, কিছু প্রয়োজন?

ফোনের অপর পাশে বড় চাচির কণ্ঠ শুনে ফোন কান থেকে সরিয়ে সামনে এনে দেখলো আকিব।ফোন স্ক্রিনে আদিবের নাম্বার দেখে তার বুঝতে অসুবিধা হলো না কল চাচি রিসিভ করেছে।তবে সেটা আদিবের উপস্থিতিতে না অন‌উপস্থিতিতে সেটা বুঝতে একটু অসুবিধা হলো আকিবের।আকিব কে চুপ থাকতে দেখে অপর পাশ থেকে পরপর দুইবার হ্যালো ,হ্যালো বলে উঠলো তানিয়া।আকিবের ভাবনায় ছেদ পড়লো।সে নিজের ভাবনা এক পাশে রেখে বড় চাচিকে সালাম দিয়ে তার শারীরিক অবস্থা জানতে চাইলো। তানিয়া হঠাৎ অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল সেই কথা ইতিমধ্যে কম বেশি সবাই জানতে পেরেছে।আদিব যে সেই কারণে তাদের বাড়ি আসছে না এটাও অজানা নয় আকিবের।আকিবের কথার উত্তরে তানিয়া জানালো,

-আমি ভালো আছি ।তোমাদের কি অবস্থা।

-আমরাও ভালো আছি চাচি।

একটু থামলো আকিব তারপর ইতস্তত করে বলল,

-চাচি আদিব কে একটু দেওয়া যাবে আসলে জাহানারা শরীরটা খুব খারাপ।সকাল থেকে কিছু মুখে তোলেনি। বারবার আদিব কে ডাকতে বলছে।

আকিবের কণ্ঠে অসহায়ত্বের ছাপ।তানিয়া সেটা বুঝলো কি না কে জানে।সে বলল,

-আদিব তো বাড়ি নেই। শপিংয়ে গেছে।ফোন ফেলে গেছে।

নিরাশ হলো আকিব ছোট করে বলল,

-ও।

তারপর কিছু একটা ভেবে বলল,

-চাচি আদিব ফিরলে কি ওকে একটু আমাদের বাড়ি পাঠাতে পারবেন?

-আকিব জানোই তো কাল আদিবের আকদ।ছেলেটা শপিং করে ক্লান্ত হয়ে ফিরে তোমাদের বাড়ি আবার কীভাবে যাবে? তাছাড়া, আদিব অনেক তো সাহায্য করলো তোমাদের, এবার ওর বিকল্প কিছু ভাবো।কতদিন আর এভাবে চলবে, হুম?আমি কি বলছি আশা করি বুঝেছো?

যথেষ্ট নমনীয় কণ্ঠস্বর তানিয়ার। কিন্তু কথা গুলো বেশ ধারালো।আদিবকে তার বড় চাচি যে আর এ বাড়ি মুখো হতে দিবে না সেটা বুঝতে কষ্ট হলো না আকিবের।সে চাচির কথার প্রেক্ষিতে ছোট করে বলল,

-হুম।

আকিবের উত্তরে তানিয়ার ঠোঁটের কোণে দেখা দিল চ‌ওড়া হাঁসি।সে মুখে হাঁসি রেখেই বলল,

-কাল সন্ধ্যার সময় চলে এসো কিন্তু।তোমাকে দেখে তোমার চাচু আর আদিব ভীষণ খুশি হবে।

-জি।

ছোট করে বলল আকিব এরপর তানিয়ার সৌজন্যমূলক কিছু কথার প্রেক্ষিতে কথা বলে ফোন রাখলো আকিব।তারিন তার সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল।থমথমে মুখে আকিবকে ফোন রাখতে দেখে বলল,

-কি হলো ?

-কি আবার হবে,আদিব আসতে পারবে না।তোমার ননদকে কিছু একটা বুঝিয়ে সুঝিয়ে খাওয়াও।

-আদিব আসবে না, এই কথা আদিব বলেছে?

-না,বড় চাচি বলেছে।আদিব বাড়ি নেই।ফোন রেখে বিয়ের শপিংয়ে গিয়েছে।

আদিবের আকদের ব্যাপারে আশরাফ বোন ভাইদের ইতিমধ্যে অবগত করেছে।সেই সুবাদে পরিবারের লোকজন‌ও জানে সবটা।তারিন বলল,

-আদিব আসলে আরেক বার ফোন করো ও ঠিক আসবে।

-পারবো না‌।

-কেন ?কি হয়েছে ?চাচি কিছু বলেছে?

-হ্যাঁ বলেছে।তার ছেলের বিকল্প খুঁজতে বলেছে। অস্পষ্টভাবে বুঝিয়েছে তার ছেলে আমাদের আর কোনো সাহায্য করতে পারবে না।শোনো তারিন তুমি জাহান কে একটু সামলাও আমি রাকিবের সাথে কথা বলছি।সত্যি এভাবে আর চলতে পারে না। কতদিন কারো পা মলে এভাবে সাহায্য ভিক্ষা করা যায়!

কথাটা বলেই রাগে গজগজ করতে করতে স্থান ত্যাগ করলো আকিব।তারিন স্বামীর গমনরত পথের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ডাইনিং টেবিলে ঢেকে রাখা খাবার গুলোর দিকে তাকিয়ে এগিয়ে গেল সেদিকে।কাল রাতে আদিব ফোন করে বুঝিয়ে সুঝিয়ে জাহানারা কে কিছু খাওয়াতে পারলেও আজ সকাল থেকে মেয়েটা দাঁতে একটা কুটোও কাটেনি।দুপুরের পর থেকে না খেয়ে দিয়ে একবারে নেতিয়ে পড়েছে।এদিকে শরীরে জ্বর‌ও ব‌ইছে পাল্লা দিয়ে।তার এমন অবস্থা দেখেই আকিব কে তারিন জোর করেছিল আদিবকে ফোন করতে। ভেবেছিল আকিবের ফোন পেলে আদিব নিশ্চয়ই আসবে।

তারিন যেদিন প্রথম আদিবের জাহানারার স্বামী হিসাবে অভিনয়ের কথা জানতে পেরেছিল তার সেদিন‌ই মনে হয়েছিল এমনভাবে কতদিন চলবে।আকিব কে বলেও ছিল এভাবে বেশিদিন চলতে দেওয়া যাবে না যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জাহানারা কে সুস্থ করার অন্য পথ দেখো কিন্তু তখন আকিব তার কথায় কান দেয় নি।অবশ্য এতে আকিবের‌ও দোষ নেই রাকিবের সেই পরিচিত ডাক্তার আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে চাইছিল সে।এর মধ্যে যে আদিব কে আর পাওয়া যাবে না সেটা কে জানতো। তারিন মাঝে মাঝে ভেবে পায় না এদের‌ই বা কেমন আক্কেল মেয়ে অসুস্থ আর তারা কোন না কোন ডাক্তারের ভরসায় বসে আছে।রাকিব বলতে সব এতোটা অন্ধ হয়েছে যে সে যা বলবে তাই!কেন দুনিয়ায় কি আর কোনো ডাক্তার নেই। যত্তসব!

নিজের মনে কথাগুলো ভাবতে ভাবতে জাহানারার ঘরে উপস্থিত হলো তারিন। জাহানারা তখন জ্বরে উত্তপ্ত থমথমে মুখ নিয়ে বসে আছে বিছানায়।নেহা তার পাশে বসা।কি যেন বলছে তাকে।তারিন কে দেখেই থেমে গেল।উঠে দাঁড়ালো।তারিনের মাঝে মাঝে নেহা নামের এই মেয়েটার উপর কেমন সন্দেহ হয়।কেন সেটা তারিন‌ নিজেও জানে না। কিন্তু মেয়েটাকে দেখলেই সন্দেহর দানাটা মনে ঘুরপাক খায়।

-জাহান একটু কিছু খেয়ে নাও।আদিব শপিংয়ে গেছে।আসতে দেরি হবে।ফোনে চার্জ নেই, তাই ফোন দিতে পারছে না।

খাবার ট্রে বিছানার উপর রাখতে রাখতে বলল তারিন। জাহানারা অবাক চোখে তার দিকে তাকালো।জ্বরে কাতর দুর্বল স্বরে উৎফুল্ল হয়ে বলল,

-আমার জন্য শপিংয়ে গেছে?

-হুম।

কথাটা বলতে বলতে আলমারিতে থাকা নতুন শাড়ি দুটোর কথা একবার মনে করে নিল তারিন।সে এ কয়দিনে আদিব কে যতটুকু চিনেছে সেটা থেকে এটা বুঝেছে যে ছেলেটা তার দায়িত্ব পালনে অবহেলা করে না।তারিনের মন বলছে রাত যতোই হোক ছেলেটা একবার হলেও এ বাড়ি আসবে।কাল কথা দিয়েছিল তো সে জাহানারা কে সুতরাং আসবেই, তখন শাড়ি দুটো তাকে দিয়ে বলবে জাহানারা কে দিতে।তারিনের কথা শুনে জাহানারা আশ্বস্ত হলো।বিনা বাক্যব্যয়ে চুপচাপ নিজের হাতে তুলে নিল খাবার প্লেট। তাল বাহানা না করে খেয়ে নিল সবটা। খাওয়ার পর নিজে থেকে ঔষধ খেলো। তারিন হাফ ছাড়ালো।

রাত ঠিক দশটার দিকে তারিনের ভাবনা অনুযায়ী আদিব এসে দাঁড়ালো তাদের দরজায়।ঘামে জবজবে শরীর হাতে দুইটা শপিং ব্যাগ।তারিন তাকে দেখে বুঝলো বাড়ি না ফিরে ছেলেটা সোজা এখানে এসেছে।তারিন আদিবের হাতে ব্যাগ দুটো দেখেও কিছু জিজ্ঞেস করলো না।আদিব তারিনের সাথে সামান্য কটা কথা বলে সোজা জাহানারার ঘরে গেল। জাহানারা তখন গভীর ঘুমে। অসুস্থ ক্লান্ত শরীরে ঘুম জাঁকিয়ে বসেছে চোখে।আদিব চেয়ার টেনে তার পাশে গিয়ে বসলো। জ্বরে উত্তপ্ত লাল মুখটা দেখে বুকের ভেতর কেমন মোচড় দিয়ে উঠলো তার।মেয়েটার লালচে মুখটা জানান দিচ্ছে তার তীব্র জ্বরের কথা।আদিব হাত বাড়িয়েও আবার পিছিয়ে নিল হাতটা। পকেট থেকে স্যানিটাইজার বের করে দুই ফোটা হাতে ফেলে ভালোভাবে ঘষে হাত জীবাণু মুক্ত করলো। তারপর হাত ছোঁয়ালো জাহানারার কপালে।আদিবের হাতের শীতল স্পর্শ পেয়ে একটু কেঁপে উঠলো জাহানারা।ঘুমটাও ছুটে গেল তার।চোখ পিটপিট করে তাকালো।ঘাড় ফিরিয়ে আদিব কে দেখতেই মুখে ফুটে উঠলো হাঁসি ।গদগদ হয়ে বলল,

-তুমি এসেছো?

-হুম।তোমার শরীর কেমন এখন?

-ভালো।খুব ভালো।

চোখ লালা হয়ে আছে। কণ্ঠে শরীরের সকল দুর্বলতা তারপরেও মেয়েটা বলছে সে ভালো আছে।আদিব ম্লান হাসলো।বলল,

-আমাকে মিস করছিলে।

নিজের কথাটায় নিজের কানে ঝংকার তুললো আদিবের।সে বুঝে পেল না এমন একটা প্রশ্ন সে কেন করলো।তবে এটা বুঝলো তার অবচেতন মন জানতে চাইছে এটা। জাহানারা তার প্রশ্নের জবাবে বলল,

-অনেক।তুমি মিস করেছো আমায়?

-হুম।

এটা সত্যি। আদিব বিগত চারদিনে খুব বেশি মিস করেছে জাহানারা কে।প্রতি ক্ষণে মনে পড়েছে তার মেয়েটাকে।বুঝতে পেরেছে মানবিকতা দেখাতে গিয়ে এক অদৃশ্য মায়ায় জড়িয়ে পড়েছে সে।

-তাহলে আসো নি কেন?

-তোমাকে বলেছিলাম না,আমার মা অসুস্থ।সেই জন্য‌ও আসতে পারেনি।

-কি অসুখ হয়েছে তার?এখনো কি সুস্থ হয় নি?

-এখন সুস্থ তবে আমি তার পাশে থাকলে তার ভালো লাগে। তাই এই কয়দিন তার কাছে ছিলাম।বুঝেছো?

-হ্যাঁ, বুঝেছি।এই গুলো আমার জন্য?

আদিবের পাশে রাখা শপিং ব্যাগের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলো জাহানারা।আদিব ব্যাগ গুলোর দিকে তাকালো। শপিংয়ের সময় রুবাইয়ার জন্য কাপড় পছন্দ করতে করতে হঠাৎ কি মনে করে শাড়ি দুটো জাহানারার জন্য নিয়ে নিল সে।তৃপ্তি ভাইয়ের কান্ডে অবাক হয়ে কারণ জানতে চেয়েছিল কিন্তু আদিব কিছু বলতে পারেনি।আসলে তার কাছে কোন কারণ ছিলোই না বলার।তার শুধু মনে হয়েছে শাড়ি দুটোতে জাহানারা কে মানাবে, ব্যাস।

জাহানারা হাত বাড়িয়ে শাড়ির প্যাকেট দুটো নিতে যেতেই আদিব থামিয়ে দিল তাকে।চীনে নতুন ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে।যা দ্রুততার সাথে ছাড়াচ্ছে।এই সময় একটু সতর্ক না হলে সমস্যা আছে।সে নেহাকে ডেকে ওগুলো আলমারিতে রাখতে বলল জাহানারা কে বলল সে কাল দেখবে। জাহানারা জেদ করায় ভাইরাসের কথা তুলল আদিব। জাহানারা বুঝলো তার কথা।আদিব নেহাকে নির্দেশ দিল হাত ভালো করে সাবান দিয়ে পরিষ্কার করে তবেই অন্য কিছু স্পর্শ করতে।

আদিব ক্লান্ত ছিল যার কারণে আজ আর বেশিক্ষণ বসলো না। জাহানারার খাওয়া শেষ হতেই উঠে দাঁড়ালো।আদিব যখন দরজার সামনে তখন জাহানারা পিছু ডাকলো তাকে।বলল,

-কাল আসবে তো?

জাহানারার প্রশ্নে আদিবের মনে পড়লো কাল তার আকদ।সে থমকালো। হঠাৎ কেমন অস্বস্তি হলো। জাহানারার মুখটার দিকে তাকিয়ে অকারণে বুকের ভেতরটা জ্বলে উঠলো।তবে সেটা জাহানারা কে বুঝতে না দিয়ে ম্লান হেঁসে বলল

– আসবো।

এরপর আর এক মুহূর্ত অপচয় না করে বেরিয়ে গেল সেখান থেকে।

_________
পরেরদিন সকাল পার হলো, দুপুর পার হলো কিন্তু আদিবের দেখা পেল না জাহানারা।তবে আদিবের দেখা না পেলেও আদিবের বিয়ের সংবাদ ঠিক তার কানে এলো।কথাটা শোনা মাত্রই উতলা হয়ে উঠলো সে।ঘরের জিনিসপত্র এদিক ওদিক করে ছুঁড়তে লাগলো।তারিন বাঁধা দিতে যা‌ওয়ায় আঘাত লাগলো তার। রক্ত ঝরলো তারিনের শরীর বেয়ে। আকিব বোনের পাগলামো সহ্য করতে পারলো না।হাত উঠালো তার গায়ে। জাহানারা ছিটকে পড়লো মেঝেতে নেহা গিয়ে ধরলো তাকে।তারিন থামালো আকিব কে।জায়েদ বাড়ি নেই। শুক্রবার জুম্মার নামাজের পর সে সালেহার কবর জিয়ারত করতে যায়। সেখানে বসে থাকে একেবারে ইশার নামাজ পড়ে বাড়ি ফেরে।আজ‌ও ফেরেনি সে।
আকিব রাগে দুঃখে বোনকে ঘর বন্দি করলো। জাহানারা ভাইয়ের এ আচরণ মেনে নিতে পারলো না।সে আরো চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করলো । কিন্তু আকিব তার সেসব চিৎকার চেঁচামেচি কানে তুললো না। জাহানারা এক সময় ক্লান্ত হয়ে লুটিয়ে পড়লো মেঝেতে।জানালা দিয়ে তার এমন অবস্থা দেখে আহাজারি করে বাড়ির মানুষ জড়ো করলো নেহা।আকিব ছুটে এলো।বোনের অবস্থা দেখে বাধ্য হয়ে বড় চাচাকে ফোন করলো। আশরাফ বাড়িতেই ছিল।ছেলের বিয়ে উপলক্ষ্যে ছুটি তার।আকিবের ফোন পাওয়া মাত্র উপস্থিত হলো সেখানে। জাহানারা কে জরুরি ভিত্তিতে ****ইনজেকশন দিল। তৎক্ষণাৎ জাহানারার জ্ঞান না ফিরলেও কিছুটা উন্নতি হলো তার অবস্থার‌।

বোনের অবস্থা দেখে অনুশোচনায় চোখ ভিজে উঠলো আকিবের। আশরাফকে জাহানারা গায়ে হাত তোলার কথা বলতে বলতে অঝোরে অশ্রু গড়ালো চোখ দিয়ে। আশরাফ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

-ও নিজের মাঝে নেই আকিব। তোদের ওর দিকটাও তো বোঝা উচিত।

-রাগে মাথা ঠিক ছিল না চাচু।স্যরি।

-আচ্ছা যা হয়েছে হয়েছে।এখন জ্ঞান ফিরলে আর কিছু বলিস না।

আকিব মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। জাহানারার জ্ঞান ফিরলো ঘণ্টা খানেক পর । জ্ঞান ফিরতেই তার মনে পড়লো সন্ধ্যায় আদিবের বিয়ে।কথাটা মনে হতেই দিক বেদিক ভুলে ছুটলো সে। জাহানারা যখন নিচে নামলো আকিব তখন লনে।ফোনে কথা বলছিল কারো সাথে জাহানারা কে ছুটতে দেখে সে উচ্চস্বরে পিছু ডাকলো কিন্তু জাহানারা থামলো না।সে উদ্ভ্রান্তের নেয় ছুটে গেল বড় চাচার বাড়ির দিকে।

চলবে, ইনশাআল্লাহ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ
পরবর্তী নিবন্ধ
গল্প পোকা
গল্প পোকাhttps://golpopoka.com
গল্পপোকা ডট কম -এ আপনাকে স্বাগতম......
RELATED ARTICLES

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments

Md masrur Hasan mahi على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
আমিনুল ইসলাম على প্রয়োজন পর্ব: ৩০ ( অন্তিম)
সাজিবুল ইসলাম على ধর্ষিতাবউ২ ৯ তথা শেষ পর্ব
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
Nita Sarkar على স্বপ্নীল ৬৮
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على রহস্য শেষ_পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على অলক্ষ্যে তুমি পর্ব-০৬ এবং শেষ পর্ব
Nazmun Nahar Akhi على Psycho_is_back? part_7
Nazmun Nahar Akhi على Dangerous_Villian_Lover part 2
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على জানালার ওপারে পর্ব-১৭ এবং শেষ পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على লীলা বোর্ডিং ১২১৫ পর্ব-১১ এবং শেষ পর্ব
মিজানুর রহমান রাহুল على সেই তুমি পর্ব-০১
@feelings على প্রহেলিকা
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Nusrat jahan على coffee & vanilla Part-10
Pallabi Roy على স্বপ্নীল ৬৮
M.D Mahabub على The_Villain_Lover Part_2
Labani sarkar على Dangerous_Villain_Lover part 23
MD Akas Apc على বিবেক
Tanisha Ahmed على Devil love part-18 
Aius Barmon shorob على নারীর দেহকে নয়
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Priya Banerjee على devil love married life last part
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Riya Biswas على তুমি রবে ৫২
Mohammad Adib على তুমি রবে ৬০
Avni Ayesha على তুমি রবে ২৮
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
সুমিত على তুমি রবে ২৮
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
Samiah Begum على তুমি রবে ৫১
biddut das rocky على নর নারী
গল্প পোকা على নষ্ট গলি শেষ পর্ব
Md Jobayer Hossain Shohag على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على দুই অলসের সংসার
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤৪২.
A.J.S Rakib على মন ফড়িং ❤৪২.
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
Samiya noor على গল্পঃ ভয়
Sadikul على গল্পঃ ভয়
Samia Islam على গল্পঃ ভয়
শূন্য মায়া على মন ফড়িং ❤ ৪০.
Sutapa biswas على মন ফড়িং ❤৩৯.
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৮.
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৭
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
Siyam على বিবেক
Sudipto Guchhait على My_Mafia_Boss পর্ব-৯
saptami karmakar على devil love married life last part
saptami karmakar على devil love married life last part
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ২৬.
Shreyashi Dutta على  বিয়ে part 1
Sandipan Biswas على  বিয়ে part 1
Paramita Bhattacharyya على অনুরাগ শেষ পর্ব
জামিয়া পারভীন তানি على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
মায়া على মন ফড়িং  ২২
সুরিয়া মিম على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على মন ফড়িং ২১
গল্প পোকা على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
Sahin ssb على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৮. 
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৭.
Jannatul Ferdous على খেলাঘর পর্ব-৩৫
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ফাল্গুনের_ফুল last_part_8
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ছাত্রী যখন বউ পাঠঃ ১
গল্প পোকা على বাজির প্রেম পাঠঃ ১
Foujia Khanom Parsha على মা… ?
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৮
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
Ibna Al Wadud Shovon على স্বার্থ