Monday, October 6, 2025







সৌরকলঙ্ক পর্ব-০৯+১০

#সৌরকলঙ্ক
#উম্মে_প্রভা
#পর্ব_৯

জাহানারাকে এমতো অবস্থায় দেখে সময় অপচয় করলো না আদিব। ঝুঁকে তাকে কোলে তুলে নিল। দরজার দিকে পা বাড়াতে গিয়ে আবার পিছিয়ে আসলো।নিজে চোখে দেখে এসেছে বাইরেটা কতটা জনমানব শূন্য এখন কোনো যানবাহন তো দূরের কথা একটা মানুষ পাওয়াও দায়। জাহানারা কে সোফায় শুইয়ে দিয়ে তড়িঘড়ি পকেট থেকে ফোন বের করলো।ব্যস্ত হাতে ৯৯৯ কল করে জরুরি ভিত্তিতে অ্যাম্বুলেন্স পাঠাতে বলল।ফোনটা পকেটে রেখে হাঁটু গেড়ে জাহানারা পাশে বসলো আদিব। জাহানারার প্রাথমিক চিকিৎসার প্রয়োজন।সে জাহানারা কে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো। জাহানারাকে পর্যবেক্ষণ করে তার ডান পায়ে ধারালো অস্ত্রের আঘাত আর মাথার পিছনে বা পাশে গ্যাদগ্যাদে ক্ষত লক্ষ করলো। জাহানারার মাথার পিছনের ক্ষতটা দেখে আদিবের গলা শুকিয়ে এলো।একজন ডাক্তার হিসাবে এটা বুঝলো ক্ষতটা বেশ ভোগাবে মেয়েটাকে।একটা শুকনো ঢোক গিলল আদিব।টি টেবিলের উপর থাকা সুতি কাপড়ের টেবিল ক্লথটা উঠিয়ে জাহানারার মাথায় শক্ত করে বেঁধে দিল।কাপড় বাধার সময় অসাবধানতা বশত জাহানারার ক্ষততে চাপ পড়লো।সাথে সাথে ব্যথায় কেকিয়ে উঠলো সে।নিজের ভুলে অনুতপ্ত হলো আদিব সে বার কয়েক স্যরি শব্দটা আওড়ালো। অল্প একটু জ্ঞান তখনো অবশিষ্ট ছিল জাহানারার সে বন্ধ প্রায় চোখটা মেলার চেষ্টা করলো দেখার চেষ্টা করলো তার পাশে থাকা মানুষ টা কে।আদিব তখন জাহানারার পায়ের ক্ষততে নিজের সাদা রঙের রুমালটা বাঁধতে ব্যস্ত। জাহানারা আদিব কে দেখার চেষ্টা করলেও ভারি চোখের পাতা টেনে খুলতে সক্ষম হলো না।সে কোনোরকমে বিড়বিড় করে সামনের মানুষটার কাছে বাঁচার আকুতি জানালো। জাহানারার ব্যাথতুর কণ্ঠে বলা,”আমাকে প্লিজ বাঁচান।আমি বাঁচতে চাই।”এই সাহায্য প্রার্থনা আদিবের ভেতরটা নাড়িয়ে দিল।সে জাহানারা মুখের উপর ঝুঁকে এলো। বলল,

-জাহানারা আমি আদিব।আমি তোমার আদিব ভাই,শুনতে পাচ্ছ আমাকে।শোনো চোখ খোলো ।আমার দিকে তাকাও। জাহানারা।শুনছো!

-হুম!

-গুড। গুড।কথা বলো আমার সাথে।

-কি কথা বলবো?

জাহানারার নিভু নিভু গলা।আদিব কান বাড়িয়ে রাখলো তার ঠোঁটের কাছে।বুঝতে পারলো মেয়েটার শরীরের সাথে সাথে মস্তিষ্ক‌ও নিথর হচ্ছে। কিন্তু এটা হতে দিলে তো চলবে না।মেয়েটা একবার জ্ঞান হারালে জ্ঞান ফেরা হয়ত মুশকিল হয়ে যাবে তার জন্য। আদিব জিভে দিয়ে ঠোঁট ভেজালো।এটা তার বহু পুরোনো অভ্যাস যখন সে নার্ভাস থাকে তখন এমনটা করে থাকে। জাহানারার কথার প্রতি উত্তরে বলল,

-যা মনে আসছে তাই বলো।

-কিন্তু কিছু তো মনে আসছে না। শুধু ঘুম আসছে।

কথাটা বলতে বলতে আবার শরীরে প্রাপ্ত আ’ঘা’তের য’ন্ত্রণা’য় কেকিয়ে উঠলো জাহানারা। বিড়বিড় করে বলতে লাগলো,

-আমার খুব কষ্ট হচ্ছে আদিব ভাই।খুব কষ্ট হচ্ছে।আমি মনে হয় বাঁচবো না।আমাকে প্লিজ বাঁচান।আমি বাঁচতে চাই।প্লিজ আমাকে বাঁচান।

-কিচ্ছু হবে না তোমার।আমরা এখুনি হাসপাতালে পৌঁছে যাবো।তুমি সুস্থ হয়ে যাবে।আমার কথা শুনতে থাকো, প্লিজ।তুমি একদম ঠিক হয়ে যাবে।দেখি চোখ খোলো তো আমার দিকে তাকাও।আমার দিকে তাকাও।

আদিবের উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বর। জাহানারা কে এখন কোনোভাবেই অচেতন হতে দিলে চলবে না।ও’টিতে ঢোকানোর আগ পর্যন্ত যতোটা সময় পারা যায় মেয়েটাকে সজাগ রাখতে হবে। জাহানারা আদিবের কথা শুনলো কিনা বোঝা গেল না তবে আদিব নিজের মতো সবটুকু চেষ্টা করলো জাহানারা কে জাগিয়ে রাখার। জাহানারার সাথে কথার মাঝে আরো একবার ফোন চেক করলো আদিব , অ্যাম্বুলেন্স কতদূর পৌঁছাল তার খোঁজ করলো।মিনিট পনেরো লাগলো অ্যাম্বুলেন্স আসতে। অ্যাম্বুলেন্সের সাথে পুলিশের গাড়িও এসে দাঁড়ালো দরজায়।আদিব অ্যাম্বুলেন্স কল করার পর জাহানারার সাথে কথা বলার ফাঁকে পুলিশ কেও ইনফর্ম করেছিল। পুলিশ ইন্সপেক্টর কে বাড়ির দায়িত্ব দিয়ে জাহানারার সাথে অ্যাম্বুলেন্স উঠে বসলো আদিব। ইন্সপেক্টর মাহফুজুর আদিবের সাথে একজন কনস্টেবল পাঠালো।আদিব তাদের ফোন করে খবর দিলেও আসল অপরাধী না ধরা পর্যন্ত কাউকে বিশ্বাস করা যাবে না ,হতেও তো পারে আদিব মেইন কালপ্রিট। মাহফুজুরের সন্দেহের কড়া দৃষ্টি টা আদিব লক্ষ্য করলো না। জাহানারা কে নিয়ে ব্যস্ত হলো।অ্যাম্বুলেন্স ডাক্তার তো দূরের কথা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ একজন প্যারামেডিক কেও পাঠায় নি অ্যাম্বুলেন্সে।অথচ এই মুহূর্তে একজন দক্ষ ডাক্তারের ভীষণ প্রয়োজন ছিল।আদিব মনে হলো এখানে সে না থাকলে মেয়েটা কে হাসপাতালে নিয়ে যেতে যেতে যে পরিমাণে ক্ষতি হতো সেটা হয়ত কখনোই পূরণ করা যেত না।এই মুহূর্তে এসে এদেশের চিকিৎসাব্যবস্থার উপর ভীষণ রাগ হলো আদিবের। অ্যাম্বুলেন্স থাকা চিকিৎসা সরঞ্জাম দিয়ে সে নিজেই জাহানারার প্রাথমিক চিকিৎসা শেষ করলো।

রাতের ফাঁকা রাস্তায় সর্বোচ্চ গতিতে অ্যাম্বুলেন্স টান দিল ড্রাইভার যার জন্য নির্ধারিত সময়ের আগেই হাসপাতালে এসে পৌঁছালো তারা। কপাল ভালো ছিল অভিজ্ঞ ডাক্তার ডিউটিতে ছিল। জাহানারাকে দেখা মাত্রই তিনি তাকে ও’টিতে ঢোকাতে বললেন।আদিবকে বলল সকল ফর্মালিটি পূরণ করতে।রিসিপশন থেকে কনসেন্ট ফর্ম হাতে নিয়ে অটির সামনে বসলো আদিব। জাহানারার নাম আর বয়স ব্যতীত তার সম্পর্কে আর কিছুই জানে না আদিব এমনকি জাহানারার বর্তমান ঠিকানাও না। এমতাবস্থায় তার মাথায় সবার প্রথম এলো ছোট চাচার কথা।সাথে সাথে ছোট চাচাকে কল করলো সে।শাহেদ হয়ত জেগেই ছিল।আদিবের কল পাওয়া মাত্রই রিসিভ করলো।আদিব তাকে জাহানারার অবস্থা সংক্ষেপে বলল।শাহেদ তাকে জানালো সে এখুনি আসছে। জাহানারার ব্যাপারটা পুলিশ কেস বিধায় কনসেন্ট ফর্মে রোগী কিংবা তার অভিভাবকের স্বাক্ষরের বিষয়টা বেশি গুরুত্ব দিয়ে দেখলো না ডাক্তার। জাহানারার চিকিৎসা শুরু করলো। ঘণ্টা খানেকের মধ্যে হাসপাতালে এসে পৌঁছালো শাহেদ তার সাথে সজীব‌ও ছিল।তাদের দেখে স্বস্তির শ্বাস ফেলল আদিব।শাহেদ আর সজীব কে এ যাবৎ ঘটে যাওয়া ঘটনা সবিস্তারে শোনালো।আদিবের থেকে সমস্তটা শুনে হতবাক হলো তারা।শাহেদ কিংবা সজীব কেউ ভেবে পেল না অত রাতে জাহানারা নিশানের বাড়ি কি করছিল।সজীব শাহেদের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,

-আজ সকালেও জানের সাথে দেখা হয়েছে আমার।কৈ ও তো আমাকে নিশান আঙ্কেলের ওখানে যাওয়ার কথা বলল না।

নিশান সজীবের ভাতিজা হলেও বয়সে তার থেকে গুনে গুনে বারো বছরের বড়।যার কারণে সজীব তাকে আঙ্কেল সম্বোধন করে থাকে। সজীবের কথা শুনে শাহেদের ভ্রূ তে গাড়ো ভাঁজ পড়লো। সে অনেকটা স্বগোতক্তি করে বলল,

-জাহান তো মাঝে মাঝেই যায় দিপ্তীর ওখানে কিন্তু আমি এটা ভেবে পাচ্ছি না সোহেল কোথায় ছিল?আর গার্ড ছাড়া মেয়েটা একা বাড়ি থেকে বের হলো কীভাবে!

চিন্তিত কণ্ঠ শাহেদের।সে ফোন বের করলো পকেট থেকে, কল লাগালো জাহানারার দেহরক্ষী সোহেল কে।দুইবার রিং হতেই কল ধরলো সোহেল ঘুম ঘুম কণ্ঠে সালাম দিয়ে বলল,

-জি স্যার বলেন।

-তুমি কোথায়? যেখানেই থাকো না কেন এই মুহূর্তে ****** হাসপাতালে আসো।

-কি হয়েছে স্যার?এনি প্রবলেম?

সোহেলের উদ্বিগ্ন কণ্ঠ।শাহেদ তার কথা উপেক্ষা করে ফোন রাখলো। সোহেলের সাথে কথা শেষ করে আকিব কে ফোন করলো শাহেদ। সংক্ষেপে জাহানারা কথা বলে ফোন রাখলো।ফোন রাখার আগে অবশ্য জায়েদ কে যেন জাহানারার কথা আপাতত না জানায় সে বিষয়ে সতর্ক করতে ভুলল না।জায়েদ হাই ব্লাড প্রেশারের রোগী।
তাকে এই মুহূর্তে এসব জানানো নতুন দু’র্ঘটনা’র জন্য নিজেদের প্রস্তুত রাখা। তাছাড়া সালেহার মৃত্যুর পর থেকে সে অনেকটা ভেঙ্গে পড়েছে। যতই মুখে বলুক মেয়েকে সে ত্যাগ করেছে, মেয়ের সাথে তার কোনো সম্পর্ক নেই কিন্তু সেসব যে তার লোক-দেখানো মুখের কথা সেটা শাহেদের থেকে ভালো আর কে জানে!

-সজীব নিশান কে ফোন কর তো, দেখ কোথায় ওরা।

বলল শাহেদ। সজীব শাহেদের কথা মতো ফোন করতেই যাচ্ছিল কিন্তু আদিবের কথায় থেমে গেল,

-লাভ নেই।আমি অনেকবার ট্রাই করেছি ফোন ধরছে না কেউ।

– আশ্চর্য! রাতারাতি কোথায় গেল ছেলে মেয়ে দুটো?

শাহেদের উত্তেজিত কণ্ঠ।আদিব আর সজীব একে অপরের মুখের দিকে তাকালো।কেউ বুঝে উঠতে পারছে না কি হচ্ছে। হঠাৎ সজীবের কিছু মনে পড়েছে এমনভাবে বলল,

-ছোট ভাইয়া! নিশান আংকেলরা মনে হয় তাপসী আপার বাড়ি আছে।

-তাপসী?

নামটা শোনা শোনা হলে ঠিক চিন্তে পারলো না শাহেদ।সজীব ফের বলল,

-বড় ভাবির বোন। বসুন্ধরায় থাকে।

-ওনার নাম্বার আছে তোর কাছে।

-ছিল তো অনেক দিন কথা হয় নি।দেখতে হবে।

কথা বলতে বলতে ফোনের কন্টাক্ট লিস্ট বার করলো সজীব খুঁজতে লাগলো তাপসীর নাম্বার।আদিব সজীবের পাশ থেকে সরে গিয়ে বসলো সামনে রাখা চেয়ারে।তার মাথাটা হঠাৎ কেমন ভারভার লাগছে।চোখ জ্বলছে। চেয়ারে হেলান দিয়ে বসতেই মাথা ঠেকলো পিছনের দেওয়ালে।স্বস্তিতে আপনা আপনি চোখ বুজে এলো তার। তন্দ্রা ভাব আচ্ছন্ন হলো চোখে।বন্ধ চোখে সাথে সাথে ভেসে উঠলো রক্তে মাখামাখি ব্যথা তুর মুখ ,কানে ভাসল জাহানারার ধীমি কণ্ঠে বিড়বিড়িয়ে বলা কথাটা,”আপনি আমাকে একটুও কি ভালোবাসতে পারতেন না আদিব ভাই? একটুও?”নিদ্রা ভাব ছুটে গেল আদিবের তড়াক চোখ খুলে সোজা হয়ে বসলো।শুকনো ঢোক গিলে একটা শ্বাস নিল ভেতরে।আরো একবার মনে করলো জাহানারার বলা কথাটা। অ্যাম্বুলেন্সে তোলার আগে স্ট্রেচারে শোয়ানোর সময় জাহানারা কে নিজ বাহুতে নিয়েছিল আদিব তখন খুব কাছ থেকে জাহানারার মুখ নিঃসৃত কথাগুলো কানে গিয়েছিল তার।থমকেছিল আদিব মুহূর্তের জন্য, তবে গুরুত্ব দেয় নি, ভেবেছিল যন্ত্রণা কাতর শরীর মস্তিষ্ক বিকল করেছে যার জন্য মেয়েটা ভুলভাল বকছে। কিন্তু এই মুহূর্তে এসে সে উপলব্ধি করলো জাহানারার বলা কথার প্রতিটি শব্দ,প্রতিটি অক্ষর তার প্রতি জাহানারার গভীর ভালোবাসার জানান দিচ্ছিল।বুকের ভেতর কেমন একটু ধুকপুক করে উঠলো আদিবের।অযথা ঘাম ছুটতে লাগলো।সে উঠে দাঁড়ালো বসা থেকে।শাহেদ কে ওয়াশরুমে যাচ্ছি বলে বেরিয়ে আসলো খোলা হা‌ওয়ায়।বাইরে এসে বুক ফুলিয়ে শ্বাস নিল কতটা। নিঃশ্বাসের সাথে বের করে দিতে চাইলো ভেতরের ছটফটানি। কতটুকু সক্ষম হলো সেটা আদিব নিজেও বুঝতে পারলো না।তবে ইন্সপেক্টর মাহফুজুর রহমান কে হাসপাতালের সামনে নিজের জিপ থেকে নামতে দেখে মনের আড়াল হলো মনের সমস্যা।আদিবের দিকেই এগিয়ে এলো মাহফুজুর।এসে বলল,

-কি ব্যাপার পালাচ্ছিলেন না কি?

মাহফুজুর এর অবান্তর প্রশ্ন।ভ্রূতে ভাজ পড়লো আদিবের।অবাক হয়ে বলল,

-পালাবো কেন?

-অপরাধী কেন পালায়?

নিজের ভেতরের উথালপাতাল নিয়ে এমনিতেই অতিষ্ঠ ছিল আদিব এখন আবার মাহফুজুরের এমন হেঁয়ালি কথা তাকে আরো উত্ত্যক্ত করে তুলল।সে নিজের ভেতরে অস্থিরতা কোনোরকমে লুকিয়ে বলল,

– ইন্সপেক্টর আপনি কী বলতে চাইছেন সেটা স্পষ্ট করে বললে ভালো হতো।

-আচ্ছা স্পষ্ট করেই বলছি,আপনাকে আমার সাথে থানায় যেতে হবে।

-কারণ?

-প্রাথমিকভাবে কিছু জিজ্ঞাসাবাদের জন্য।

– ইন্সপেক্টর আপনি কি আমাকে সন্দেহ করছেন?

সরু দৃষ্টি আদিবের। কণ্ঠে শীতলতা। মাহফুজুর একটা শ্বাস ফেলল।বলল,

-ইয়েস।

-কোন ভিত্তিতে?

আদিবের প্রশ্নটা বোকা বোকা ঠেকলো মাহফুজুরের কাছে সে ফিচলে হেঁসে বলল,

-মাঝ রাতে একটা অন্ধকার প্রায় ফাঁকা বাড়িতে , আ’ঘাত প্রাপ্ত র’ক্তাক্ত মেয়ের পাশে আপনাকে দেখা গেছে।এখন এই অবস্থায় আপনাকে সন্দেহ করা কি স্বাভাবিক নয় মিস্টার!

মাহফুজুরের কথা যুক্তিযুক্ত।আদিব জিভে দিয়ে ঠোঁট ভেজালো। মনে হলো পুলিশ কে ইনফর্ম করা ভুল হয়েছে তার।সেই সাথে এটাও মনে হলো নিজের অজান্তেই বিশ্রী কোনো ঝামেলায় জড়িয়ে পড়লো সে।

-ইন্সপেক্টর আপনি দেখছি বাংলা সিনেমার মতো ভিলেন কে রেখে নায়ককে ধরছেন।

আদিবের ভাবনায় ছেদ পড়ল শাহেদের কণ্ঠে।শাহেদ বাড়ি থেকে বের হ‌ওয়ার সময় তাড়াহুড়ায় নিজের ম্যানি ব্যাগ নিয়ে আসতে ভুলে গেছে। হাসপাতালে কখন কি প্রয়োজন হয় তার ঠিক নেই, সেই জন্য বিকাশ থেকে ক্যাশ‌আউট করতে বাইরে এসেছিল কিন্তু মাঝপথে ইন্সপেক্টর মাহফুজুর আর আদিবের কথা শুনে তাকে থামতে হলো। মাহফুজুর ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকালো।শাহেদ এগিয়ে এলো তাদের দিকে। ইন্সপেক্টর মাহফুজুর ভ্রূ তে মোটা একটা ভাঁজ ফেলে শাহেদের পরিচয় জানতে চাইলো।শাহেদ নিজের পরিচয় দিয়ে বলল,

-আপনি অযথা আমার ভাতিজার উপর সন্দেহ করছেন অফিসার। একটু ভালো করে বাড়িটার তদন্ত করুন।ঐ বাড়িতে একজন দারোয়ান ও গৃহকর্মী ছিল তারা কোথায় গেল সেটা খোঁজ করুন।আর র‌ইলো প্রাথমিকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করার ব্যাপার সেটা বরং কাল সকালে করবেন।কাল আমি নিজে না হয় আমার ভাতিজাকে নিয়ে থানায় আসবো।

-বাড়িতে আরো দুইজন ছিল?
ভাবুক কণ্ঠে বলে উঠলো মাহফুজুর।শাহেদ ফের বলল,
-জি।আমার ভাতিজি জামাই, মানে বাড়ির মালিক নিজে কনফার্ম করছে এ বিষয়ে।

-বাড়ির মালিক কোথায়?

-তারা এক আত্মীয়ের বাড়ি পারিবারিক অনুষ্ঠানে গিয়েছিল। রাত বেশি হ‌ওয়ায় সেখান থাকতে হয়েছে তাদের।আমার মতে বাড়িটা আপনাদের আরো একটু ভালো করে খোঁজা খুঁজি করা উচিত।আমার মনে হচ্ছে এটা মে বি চুরির কেস।

-কেস কীসের সেটা তো সময় হলেই বোঝা যাবে! আমার টিম তদন্ত করছে,সত্য দ্রুতই বেরিয়ে আসবে।

আদিবের দিকে আড় চোখে তাকিয়ে কথাটা বলল মাহফুজুর তারপর কি যেন মনে পড়ছে এমন ভাবে বলল,

-ভিকটিম, নায়িকা জাহানারা আহাসান না?

-জি।

শাহেদ উত্তর দিল। জাহানারাকে নিয়ে আসার সময় মাহফুজুর এক ঝলক দেখেছিল জাহানারার চেহারাটা,তবে নিশ্চিত ছিল না। কিন্তু শাহেদের উত্তরে সে নিশ্চিত হলো সেই সাথে কিঞ্চিৎ চিন্তিতও।নায়িকা জাহানারা আহাসান ভিকটিম মানে, কেসটা এখন যেমন তেমন ভাবে ফেলে রাখলে হবে না। জুনিয়রের উপরে ফেলে রেখে নিশ্চিন্তেও থাকা যাবে না। খাটাখাটুনি বাড়লো ভেবে কিঞ্চিৎ বিরক্ত হলো মাহফুজুর।আদিব কে কাল সকাল দশটার মধ্যে থানয় যেতে বলে শাহেদের কাছ থেকে নিশানের নাম্বার নিয়ে বেরিয়ে গেল হাসপাতালের গেট দিয়ে। মাহফুজুর চলে যেতেই।শাহেদ কিঞ্চিৎ বিরক্ত কণ্ঠে বলল,

-পুলিশ কে ফোন করতে গিয়েছিলি কি ভেবে।পুলিশ কে ফোন করার আগে অন্তত নিজের অবস্থান তো মাথায় রাখতি? তুই আর জাহান ছাড়া বাড়িতে কেউ নেই সুতরাং পুলিশ আসলে সবার প্রথমে ওর অবস্থার জন্য তোকেই দায়ী করবে এই সিম্পল বিষয়টা কি তোর মাথায় আসে নি?

-জাহানারা অবস্থা দেখে ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। তাছাড়া জাহানারা কে নির্মম ভাবে আঘাত করা হয়েছে,অপরাধী কে সেটাও তো খুঁজতে হবে!এসব ভেবেই ফোন করেছিলাম।তখন নিজের কথা মাথায় আসেনি।

শাহেদ এক দৃষ্টিতে তাকালো আদিবের দিকে। ছেলেটার চোখ মুখ,গায়ের রং সব কিছু তার বড় ভাবির মতো।মায়ের ছেলে হিসাবে আদিবকে কখনো নিজের পরিচয় দেওয়ার কষ্ট করতে হয় না। মানুষ দেখলেই বুঝে যায় এ তানিয়ার ছেলে।তার মিয়া ভাই প্রায়শ বলে “মা যেমন ছা তেমন” আদিব তার মায়ের মতো হয়েছে।এক গুয়ে,এক রোখা, অহংকারী।নিজের কথা আগে ভাবে।অথচ সেই ছেলে না কি আজ নিশ্চিত বিপদেও নিজের কথা ভাবার সময় পাইনি!আদিবের এই মনোভাব দেখে শাহেদের হঠাৎ একটা হিন্দি প্রাবাদ মনে পড়লো।

“বাপ কা বেটা, সিপাই কা ঘোড়া, কুচ নেহি তো থোড়া থোড়া।”

তার ভাবির শত চেষ্টাকে বিফল করে বাবার ভালো গুণ ঠিকই নিজের মাঝে যত্ন করে গুছিয়ে নিয়েছে আদিব।এ কথাটা মনে হতেই এ বিপদের মুহূর্তেও শাহেদের ঠোঁটে খেলে গেল প্রশস্ত হাঁসি।

চলবে, ইনশাআল্লাহ।

#সৌরকলঙ্ক
#উম্মে_প্রভা
#পর্ব_১০

ইন্সপেক্টর মাহফুজুর রহমান এবং তার টিম নিশানের বাড়ি ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে চুরির আলামত পেল পরের দিন, সেই সাথে একটা ঘরে নেশালো ঔষধ মিশোনো অর্ধেক কাপ চা।যে ঘর থেকে চায়ের কাপ টা পেয়েছিল সে ঘরে জাহানারার ক্ষণিকের উপস্থিতির ছোঁয়া পাওয়া গেল।যা থেকে স্পষ্ট হলো নেশালো দ্রব্য যুক্ত চা টা জাহানারার জন্য ছিল।সে যেটা থেকে হয়ত কয়েক চুমুক খেয়েছিল‌ও।পুরো বাড়ি খুঁজে অপরাধ সংলগ্ন আরো অনেক কিছু পেলেও নিশানের বক্তব্য মতো বাড়ির দারোয়ান মনসুর আর কাজের মেয়ে রেণুকে কোথাও পা‌ওয়া গেল না।তাদের অন‌উপস্থিতিতে সন্দেহের তীর তাদের দিকেই ঘুরলো। দিপ্তীর প্রেগন্যান্সির পরে রেণু কে কাজে রাখা হয়েছিল যার কারণে তার প্রতি বিশ্বাস টা একটু নড়বড় হলেও ,মনসুর কে কেন যেন অবিশ্বাস করতে পারলো না দীপ্তি আর নিশান।লোকটা নিশানের নানা বাড়ি এলাকার মানুষ। খুব ভদ্র আর অমায়িক। প্রায় সাত বছর ধরে তাদের সাথে আছে মনসুর।কতবার তার ভরসায় ফাঁকা বাড়ি রেখে দিনের পর দিন নিশ্চিন্তে ঘুরেছে তারা স্বামী-স্ত্রী ,কখনো কোনো ক্ষয় ক্ষতি হয় নি। সুতরাং আজ তাকে অবিশ্বাস করার প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু মনসুর এর বাড়ি খোঁজ নিয়ে যখন তাকে পাওয়া গেল না তখন নিশান আর দিপ্তীর বিশ্বাস কিঞ্চিৎ টালমাটাল হলো। মাহফুজুর রেণু আর মনসুর কে অপরাধী মেনে তার খোঁজ শুরু করলো।

নায়িকা জাহানারা আহাসান কেসের সাথে জড়িত থাকার কারণে উপর থেকে বেশ পেশার এলো মাহফুজুরের উপর।বাধ্য হয়ে নিজের তথাকথিত কচ্ছপ গতি থেকে বেরিয়ে আসতে হলো মাহফুজুর কে।দ্রুততার সহিত তদন্তে মনোযোগী হলো সে।দুই দিনের মাথায় খোঁজ পাওয়া গেল রেণুর। বেনাপোল স্থলবন্দর থেকে তাকে এবং তার প্রেমিকে আটক করা হলো।তাদের সাথে পাওয়া গেল বিপুল অর্থ। গ্রেফতার করে তাদের ঢাকা নিয়ে আসা হলো। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের সময়‌ই তারা তাদের অপরাধ স্বীকার করলো। ফাঁকা বাড়ি পেয়ে চুরির উদ্দেশ্যে নিজের প্রেমিককে ডেকে এনেছিল রেণু।ইচ্ছা ছিল প্রেমিকের হাতে চুরির মাল গুছিয়ে দিয়ে কিছু দিন চুপচাপ এখানে থাকবে সে, তারপর একটা সময় কোনো একটা অজুহাত দেখিয়ে কেটে পড়বে।সব কিছু প্ল্যান ম্যাফিক আগাচ্ছিল কিন্তু রাত দশটার পরপর অপ্রত্যাশিত ভাবে জাহানারা এসে দাঁড়ালো দিপ্তীর চৌকাঠে।রেণু দিপ্তীরা বাড়িতে নেই এই কথা বলে জাহানারা কে কাটাতে চাইলেও জাহানারা রেণুর কথা কানে তুললো না। সে সোজা নিজের জন্য বরাদ্দকৃত ঘরে গিয়ে ঢুকলো।যা‌ওয়ার আগে রেণুকে চায়ের কথা বলে যেতে ভুলল না। জাহানারা যখন বাড়ি প্রবেশ করেছে রেণুর প্রেমিক রুবেল তখন রান্না ঘরেই উপস্থিত ছিল। জাহানারা আসার মিনিট পাঁচেক আগে রেণুর সাহায্যে সে পিছনের দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করেছিল। জাহানারা আর রেণুর সমস্ত কথোপকথন রুবেল স্পষ্ট শুনেছে।বাড়িতে জাহানারার উপস্থিতিতে রেণু বিচলিত হলেও রুবেল থির থাকলো। ঠান্ডা মাথায় নিজের পকেট থেকে *****বের করে রেণুর হাতে দিল। বলল জাহানারার চায়ে মিশিয়ে দিতে। রেণুর ভরসায় হাত সাফ করতে আসলেও নিজের মতো সব ব্যবস্থা করে এসেছিল রুবেল।
জাহানারা কে চা দিয়ে আসার পর তারা অপেক্ষা করতে লাগলো তার অচেতন হ‌ওয়ার।এর পর রেণু জাহানারার ঘরে উঁকি দিয়ে তাকে ঘুমাতে দেখে স্বস্তির শ্বাস ফেলল।আর সময় নষ্ট না করে রুবেল কে সাথে নিয়ে নিশানের ঘরের দিকে পা বাড়ালো। দীপ্তি আলমারির অতিরিক্ত চাবি কোথায় রাখে সেটা অজানা নয় রেণুর।এর আগে লুকিয়ে চুরিয়ে বেশ কয়েকবার জায়গাটা দেখেছে সে। সেদিন‌ও নির্ধারিত জায়গায় চাবি পেল।
আলমারি থেকে টাকা,গহনা,আর যে-সব দামি জিনিস পেল সব গুছিয়ে তুলে নিল তারা।সব কিছু গোছ গাছ করে সিঁড়ি বেয়ে সাবধানে নেমেই আসছিল কিন্তু সেই সাবধানতায় কিঞ্চিৎ ফাঁক থেকে গেল, যার কারণে রুবেলের হাত লেগে সিঁড়ির পাশে দেওয়ালে লাগানো নিশান আর দিপ্তির কাচের ফোটোফ্রেমটা পড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে কাচ ভাঙার বিকট শব্দে নীরব বাড়ি সরব হলো।বাড়ির দারোয়ান মনসুর ভেতরে কোনো অঘটন ঘটেছে কিনা সেটা দেখতেই রেণুর নাম ধরে হাঁক ছেড়ে ভেতরে ছুটে আসলো।দরজা খোলাই ছিল। জাহানারা বাড়িতে ঢোকার পর তার থেকে কীভাবে বাঁচা যায় এই তড়িঘড়িতে রেণু ভুলে বসেছিল দরজা বন্ধ করার কথা। মনসুর দরজায় হাত দিতেই দরজা খুলে গেল।সে ভেতরে এসে কালো রঙের বড় ব্যাগ সহ রেণুর পাশে অপরিচিত ছেলে আর রেণুর অপ্রস্তুত মুখ দেখে যা বোঝার বুঝে নিল।ছুটে গিয়ে রুবেলের কলার চেপে ধরলো মনসুর।ফোন বের করে পুলিশ কে ফোন করতে লাগলো তখন শুরু হলো রুবেল আর তার মধ্যে ধস্তাধস্তি। মনসুর নিজের সাধ্য মতো চেষ্টা করলেও, তার বয়স্ক শরীরে পেরে উঠলো না রুবেল আর রেণুর সাথে।পরাস্ত হলো সে। মনসুর এর হাত পা বেঁধে ***** দিয়ে তাকে অচেতন করে সিঁড়ির ঘরের ভাঙা ফার্নিচার আড়ালে প্লাস্টিকের বস্তায় ভরে রেখে আসলো রেণু আর রুবেল।এই সময় হয়ত জাহানারার ঘুম ভেঙ্গে ছিল সে ছাদের সিঁড়ি দিয়ে রেণু আর রুবেল কে নামতে দেখে বিপদের আশঙ্কায় দ্রুত পায়ে ছুটে যাচ্ছিল সিঁড়ির দিকে, হয়ত উদ্দেশ্যে ছিল বাড়ি থেকে বের হওয়া। জাহানারা কে সিঁড়ির দিকে যেতে দেখে নিজেদের নিশ্চিত বিপদের আঁচ পায় রুবেল। তাই কোনো কিছু না ভেবেই জাহানারার পিছনে ছুটে যায়। সিঁড়ির ঘর থেকে পা‌ওয়া মোটা লোহার টুকরোটা দিয়ে আঘাত করে জাহানারা কে।মাথায় আঘাত পাওয়ার সাথে সাথে মুখ থুবড়ে পড়ে জাহানারা। সিঁড়ির প্রত্যেক টা ধাপ তার শরীর ছুঁয়ে লুটিয়ে পড়ে মেঝেতে। জাহানারার ঐ রক্তাক্ত অবস্থা দেখে ভড়কে যায় রুবেল আর রেণু।পরিকল্পনা পরিবর্তন করে রুবেলের সাথে রেণুও পালানোর প্রস্তুতি নেয়।তবে যাওয়ার আগে জাহানারার শরীরটা লুকাতে চেয়েছিল তারা, কিন্তু আদিবের আগমনে সেটা হয়ে ওঠেনি।তড়িঘড়ি স্থান ত্যাগ করেছে।

রেণু আর রুবেলে জবানবন্দি অনুযায়ী সিঁড়ি ঘরে পুরোনো জিনিস পত্রের পিছনে বস্তায় মোড়া মৃত মনসুরে এর শরীরটা পেল পুলিশ। প্লাস্টিকের বস্তায় পর্যাপ্ত অক্সিজেনের অভাবে তিন আগেই মারা গেছে মনসুর।তার শরীর হাসপাতালে পাঠানো হলো।গ্রামের বাড়ি ফোন করে খবর পাঠালো নিশান। মনসুরের বড় ছেলে এলো ছোট ভাইকে নিয়ে বাবার লাশ নিয়ে যেতে। বাবার লাশ দেখে কান্নায় ভেঙে পড়লো তারা।তাদের আহাজারি তে মুখর হলো হাসপাতাল প্রাঙ্গণ।নিশান তাদের সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা‌ও খুঁজে পেল না।মনে হলো রেণু কে কাজে রাখার আগে যদি তার বিষয়ে আরেকটু খোঁজ খবর নিতো তাহলে হয়ত আজ মনসুর তাদের মাঝে থাকতো, জাহানারার এমন দশা হতো না।নিজের অসতর্কতার জন্য ভীষণভাবে অনুতপ্ত হলো নিশান।মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো এরপর আর কখনো এমন বোকামি করবে না।

_____________
জাহানারার অপারেশন সফল হলেও ডাক্তারের দেওয়া নির্ধারিত সময়ে জ্ঞান ফিরলো না তার। ডাক্তার জানালো মাথায় আঘাত লাগার কারণে মস্তিষ্কের স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা রোধ পেয়েছে জাহানারার ,যার কারণে কোমায় চলে গেছে সে।লাইফ সাপোর্টের জন্য ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট রাখা হলো জাহানারা কে।আকিব বোনের অবস্থা দেখে ভেঙ্গে পড়লো।আকিব ভেঙ্গে পড়লেও জায়েদ নিজের কঠিন ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ন রাখলো। আকিব কে নির্দেশ দিল যদি দেশে ভালো চিকিৎসা না হয় তাহলে বোন কে নিয়ে সে যেন বিদেশ যায়। আকিব বাবার কথা মতো ডাক্তারের সাথে কথা বলল। কিন্তু ডাক্তার জানালো জাহানারা এখন যে দুর্বল মুহূর্তে আছে এই সময় তাকে স্থানান্তর করা ঝুঁকি পূর্ণ হতে পারে। ডাক্তার তাদের কয়েকটা দিন অপেক্ষা করতে বলল।সেই সাথে এটাও জানালো এরমধ্যে জাহানারার জ্ঞান ফিরতেও পারে। জাহানারার চিকিৎসাধীন ডাক্তারের সাথে কথা বলার পর এ বিষয়ে আশরাফের সাথে কথা বলল আকিব।আশরাফ সব শুনে, বুঝে আকিব কে বলল দেরি করার দরকার নেই।যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সব ব্যবস্থা করে জাহানারা কে নিয়ে আমেরিকায় পাড়ি দিতে। আশরাফের কথা শুনে আকিব আর দেরি করলো না জাহানারা কে আমেরিকা নিয়ে যা‌ওয়ার প্রস্তুতিতে লেগে পড়লো।

_____________

আদিব গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াতেই গাড়ি চালক আন্তরিক হেঁসে বলল,

-স্যার আপনার কাজ শেষ হলে আমাকে ফোন দিয়েন আমি আশেপাশেই থাকবো।

-তার দরকার নেই আপনি বাড়ি চলে যান।আমি কাজ শেষ হলে নিজেই ফিরে যাবো।

-না,না, স্যার একথা বলবেন না,বড় স্যার রাগ করবে।বড় স্যার শক্ত গলায় বলেছে আপনাকে না নিয়ে যেন না ফিরি। আপনি ঢাকা শহরের কিছু চিনেন না। আপনার যাতায়াতে কষ্ট হয়।

ড্রাইভার হানিফের কথা শুনে ফোঁস করে একটা শ্বাস ফেলল আদিব।দায় সারা ভাবে বলল,

-আচ্ছা ঠিক আছে, আমি বাড়ি যা‌ওয়ার আগে আপনাকে ফোন করে জানাবো।

আদিবের ইতিবাচক সম্মতি পেয়ে গাড়ি পিছিয়ে নিল হানিফ।পিছিয়ে যা‌ওয়া গাড়িটার চলমান চাকার দিকে নির্নিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো আদিব।

সপ্তাহ খানেক আগে জাহানারা কে নিয়ে দিপ্তীর বাড়িতে যে ঘটনাটা ঘটেছে সেটা কম বেশি সবাই জানতে পেরেছে।তানিয়া এই ঘটনা জানার পর থেকে ছেলেকে এক প্রকার চোখে চোখে রেখেছে।আদিবের বাইরে ঘোরা ফেরার জন্য তোফায়েল কে বলে গাড়ি বরাদ্দ করেছে।আদিব মায়ের এসব কাজ কর্ম ভালো লাগছে না কিন্তু নানা বাড়ি সকলের মধ্যে একটা সিনক্রিয়েট হবে বলে মা কে কিছু বলতেও পারছে না। খুলনা ফিরে যাবে তার‌ও উপায় নেই।সামনে নানির মৃত্যু বার্ষিকী। যার জন্য দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে।নানা চায় আদিব যেন এই দোয়া মাহফিলে উপস্থিত থাকে ,এই কারণে ইচ্ছা থাকা স্বত্বেও বাড়ি ফিরতে পারছে না আদিব।অথচ তার ছুটির আর মাত্র তিন সপ্তাহ বাকি তাকে ফিরতে হবে লন্ডন।এই শেষ সময়টা সে বাবার সাথে কাটাতে চায়।নিজের শহরে থাকতে চায়,আবার কবে ফিরবে তার কি ঠিক আছে।বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো আদিবের। একটা শ্বাস ফেলে হাসপাতালের ভেতরে পা বাড়ালো। জাহানারার অপারেশন সফল হয়েছে সেটা জানার পর সেই যে হাসপাতাল থেকে গিয়েছিল তারপর আর এ মুখো হওয়া হয়নি।এমন নয় যে তার ইচ্ছা হয় নি,আসলে মায়ের তীক্ষ্ণ নজরের ধার মনে করে আসতে চায়নি।

আদিব দুই তলায় উঠতেই করিডোরে দেখা হলো আকিবের সাথে। সালাম দিল আদিব। সালেহার মিলাদের পর আবার এই দেখা হয়েছে আদিব আর আকিবের।আকিব আদিবের সালামের উত্তর দিয়ে ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করলো।আকিব কে দেখা মনে হচ্ছিল সে কোথাও যাচ্ছে।আদিব সেটা জিজ্ঞেস করতেই জানালো নামাজ পড়তে যাচ্ছে।আদিব ঘড়িতে সময় দেখলো আসরের ওয়াক্ত পেরিয়ে যাচ্ছে।সে আকিব কে আর আটকালো না।এমনিতে জাহানারার জ্ঞান ফেরার আগ পর্যন্ত এখানে থাকা না থাকা সমান।তবুও আকিব কাজ কাম ফেলে বোনের জন্য ওয়েটিংরুমে সকাল থেকে রাত অবধি বসে থাকে।আকিব চলে যেতেই আদিব পা বাড়ালো আইসিউর দিকে। উদ্দেশ্য জাহানারা কে এক পলক দেখে চলে যাবে সে। কিন্তু আইসিইউ এর সামনে এসে দাঁড়ানোর পর থমকে গেল আদিব।চেয়েও নিস্তেজ সুন্দর মুখটা থেকে চোখ সরাতে পারলো না সে। স্মৃতির পাতায় হুড়মুড় করে ভিড় জমালো কিছু প্রিয় অপ্রিয় স্মৃতি।আইসিইউর দরজার লাগানো ছোট্ট গোলাকার কাচ ভেদ করে নির্নিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো অক্সিজেন মাস্ক লাগানো জাহানারার মুখটায়।সেভাবে কত সময় অতিবাহিত হলো জানা নেই আদিবের। হঠাৎ ভারি কণ্ঠের নারী স্বরে ধ্যান ভাঙলো তার।

-ওয়াইফ?

-হু!

অন্যমনস্ক ভাবে চমকে উঠলো আদিব।পাশ ফিরে তাকাতেই দেখলো এই হাসপাতালের সেবিকাদের জন্য বরাদ্দকৃত ইউনিফর্ম পরা মধ্যবয়স্ক এক ভদ্র মহিলা।আদিবের তার পোশাক দেখে বুঝতে অসুবিধা হলো না সে এই হাসপাতালের নার্স।আদিব কে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভদ্র মহিলা নিজে থেকে নিজের পরিচয় দিলেন।তার নাম নাহিদা, সে জাহানারার দায়িত্বে আছেন।তিনি একজন ক্রিটিক্যাল কেয়ার নার্স।আদিব তার কাছে জানতে চাইলো জাহানারা বর্তমান অবস্থা। নাহিদা জানালেন আগের থেকে কিছুটা উন্নতি হয়েছে জাহানারার। ডাক্তার আশা করছে দুই এক দিনের মধ্যে জ্ঞান ফিরতে পারার।আদিব ভদ্র মহিলার থেকে জাহানারার রিকভারি কথা শুনে মনে মনে স্বস্তি পেল।এই স্বস্তিটা মানবিকতার জন্য ছিল ,কি চাচাতো ভাই হিসাবে চাচাতো বোনের জন্য ছিল সেটা জানা নেই আদিবের তবে স্বস্তি টা তার মনের বিগত দিনের অস্থিরতা অনেকটা কম করলো। নাহিদার সাথে জাহানারার শারীরিক বিষয়ে আরো টুকটাক কথা বলে চলে আসার জন্য সামনে পা বাড়ালো আদিব।এত সব কথার মাঝে নাহিদার তাকে জাহানারার স্বামী মনে করা ভুলটা কথায়-কথায় হারিয়ে গেল।আদিব স্পষ্টভাবে কথাটা না শোনায় তাকে নিজের পরিচয় পরিষ্কার করলো না,নাহিদাও দ্বিতীয় বার কথাটা তুলল না। অজ্ঞাত একটা ছোট্ট ভুল বোঝাবুঝি থেকেই গেল।

আদিব জাহানারা কে দেখে যাওয়ার তিন দিন পরের কথা। নানির মৃত্যু বার্ষিকী উপলক্ষ্যে করা দোয়া মাহফিলের কাজে ব্যস্ত ছিল আদিব ঠিক সেই সময় দিপ্তীর ফোন এলো তার কাছে।ফোনটা দীপ্তি রোজকার নিয়মে ভালো-মন্দ জিজ্ঞেস করতে করলেও ,কথার মাঝে দীপ্তি বলল জাহানারার জ্ঞান ফিরেছে।তাকে আইসিইউ থেকে কেবিনে দেওয়া হয়েছে। নিশান দেখতে যাচ্ছে তাকে। দিপ্তীর কাছ থেকে জাহানারার জ্ঞান ফেরার খবরটা শুনে আদিবের মনে হলো তার‌ও একবার জাহানারা কে দেখে আসা উচিত। আগামীকাল সে খুলনা ফিরে যাচ্ছে। জাহানারা ঢাকতেই থাকবে। এরপর আর দেখা হয় কি না হয়!

বিকেলের পরে সব কাজ শেষ হতেই মা কে না বলেই হাসপাতালের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো আদিব। হাসপাতালে গিয়ে দেখলো জাহানারা কেবিনের সামনে শাহেদ, সজীব ,সজীবের স্ত্রী শিপ্রা সহ আরো কিছু অপরিচিত মুখ তবে এসব অপরিচিত মুখের মাঝে একটা স্বল্প পরিচিত মুখ আদিবের দৃষ্টি আকর্ষণ করলো।রাকিব সরোয়ার।ভ্রূ তে ভাঁজ পড়লো আদিবের। শাহেদের কাছ থেকে জানতে পারলো এই হাসপাতালের সিনিয়র নিউরোসার্জন রাকিব সরোয়ার। ব্যক্তিগত প্রয়োজনে কিছুদিনের জন্য আমেরিকা গিয়েছিল সে। গত কাল ফিরছে।এখন থেকে জাহানারার কেস সেই হ্যান্ডেল করবে।শাহেদ আর আদিবের কথার মাঝে ফোড়ন কেটে শাহেদের উদ্দেশ্যে শিপ্রা বলল,

-ছোট ভাইয়া এবার আপনাদের উচিত রাকিবের প্রস্তাবটা ভেবে দেখার। জাহানারার বয়স হচ্ছে,এমন ছেলে হাতছাড়া করলে পরে পস্তাতে হবে।

-কীসের মধ্যে কি বলিস! জায়গা দেখে কথা বল।বুড়ি হতে গেলি তবুও কোথায় কি বলতে হয় শিখলি না! অদ্ভুত!

শিপ্রা কথা সবার মাঝে পড়তে না পড়তেই তীব্র বিরক্তি নিয়ে বলে উঠলো সজীব।শিপ্রা যেন একটু চুপসালো।অন্য সময় হলে সজীবের এমন কথার প্রতিবাদে শিপ্রা এক ঘর ঝগড়া করতো কিন্তু এখন পরিস্থিতি ভিন্ন ।জাহানারার কে নিয়ে চিন্তিত সজীব। শিপ্রা জানে সেটা,বোঝে আদরের ভাগ্নির জন্য মামার উদ্বিগ্নতা।সে আর কথা বাড়ালো না। চুপসানো মুখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো।সজীব একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ালো।রাগ হচ্ছে তার শিপ্রা প্রতি। জাহানারা এখনো পুরোপুরি সুস্থ হতে পারলো না আর সে আছে তার বিয়ে নিয়ে। আহাম্মক একটা!

শিপ্রার কথার তাৎপর্য বুঝতে অসুবিধা হলো না আদিবের।রাকিব সরোয়ার এখনো জাহানারা ম্যাডামের জন্য অপেক্ষা করছে সেটা পরিষ্কার বুঝতে পারলো সে। মনে মনে খুশি হলো সে।রাকিব নিঃসন্দেহে একজন ভালো ছেলে, তার থেকে বড় কথা জাহানারা এখন যে স্ট্যাটাসে আছে তার জন্য উপযুক্ত রাকিব সরোয়ার। দুইজন দুইজনের জন্য একদম প্যার্ফেক্ট।আদিবের ভাবনা চিন্তার মাঝে রাকিব তার দিকে তাকালো।আদিবের ভাবনায় ছেদ পড়লো। সরাসরি চোখে চোখ পড়ায় কিঞ্চিৎ অপ্রস্তুত হলো আদিব।তবে নিজেকে দ্রুত‌ই সামলে নিল।আদিব কে দেখে তার দিকে এগিয়ে এলো রাকিব।
আদিব ভেবেছিল রাকিব হয়ত তাকে চিনবে না।সেই কবে দুই দিন কথা হয়েছিল ,এর মধ্যে কত সময় অতিবাহিত হয়েছে; তাকে না চেনায় স্বাভাবিক। কিন্তু তার ভাবনা কে ভুল প্রমাণিত করে রাকিব এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে দিল তার দিকে।খুব স্বাভাবিক ভাবে কুশলাদি বিনিময় করলো।রাকিবের এমন সহজ ব্যবহারে একটু অবাক হলো আদিব।সে আশা করেনি এতোটা।আদিবের সাথে কথা শেষে হতেই শাহেদ রাকিব কে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করলো,

-জাহানের অবস্থা কেমন দেখলে রাকিব?

-এখনো কিছু বোঝা যাচ্ছে না চাচু। তবে আন্দাজ করতে পারছি ডেমেজ বেশ ভালোই হয়েছে। তারপরও দেখি কি হয়।জয়েদ আঙ্কেল কোথায়?ওনাকে ভেতরে যেতে হবে।

-ভাই!ছিল তো এখানে, কোথায় গেল!সজীব দেখ তো কোথায় গেল ভাই।

শাহেদের কথায় জায়েদ কে খুঁজতে ছুটলো সজীব।রাকিব আদিব কে “আবার দেখা হবে ,সময় পেল এসো আমাদের বাড়ি” এ জাতীয় কথা বলে স্থান ত্যাগ করলো।রাকিবের সাথে শাহেদের কথোপকথন আদিবের কাছে স্পষ্ট করলো রাকিব সরোয়ারের সাথে তার চাচাদের ঘনিষ্ঠতা।তার হঠাৎ জানতে ইচ্ছা করলো রাকিবের সাথে জাহানারার সম্পর্ক টা কতটা ঘনিষ্ঠ?মনে প্রশ্ন জাগলো তাদের মধ্যে কি কোন গভীর সম্পর্ক আছে? পরক্ষণেই মনে হলো কোনো গভীর সম্পর্ক থাকলে হয়ত খবরের কাগজে বা এন্টারটেইনমেন্ট চ্যানেল গুলোতে বেশ ফলাও করে সে খবর ছাড়াতো। জাহানারা ম্যাডাম তো এখন বেশ চর্চায় আছে। যেখানে তিনি নতুন গাড়ি কিনলেও নিউজ হয়, সেখানে তার প্রণয়ের খবর চাপা থাকবে! কিন্তু আবার মনে হলো থাকতেও পারে, এই দুর্ঘটনার ব্যাপারটাও তো গোপন রাখা হয়েছে। জাহানারা ম্যাডামের পিআর টিম যে দক্ষতার সাথে এতবড় দুর্ঘটনা লুকিয়েছে, তাদের কাছে ম্যাডামের প্রেমের সম্পর্ক লুকানোটা খুব বেশি কষ্টকর নয়।নিজের মনের এমন অহেতুক ভাবনার উদয়ে বিব্রত হলো আদিব। জাহানারা জীবন নিয়ে মনের এত কৌতূহল পছন্দ হলো না তার জোর করে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলল সবটা। কতখানি সফল হলো কে জানে!তবে সিদ্ধান্ত নিল এখান থেকে চলে যাওয়ার। তাছাড়া এত মানুষজনের মধ্যে জাহানারার সাথে তার আজ দেখা করাটা হয়ত হবে না। সুতরাং খামাখা দাঁড়িয়ে থেকে লাভ নেই।মনে মনে ঠিক করলো লন্ডন ফেরত যাওয়ার আগে একবার দেখা করে যাবে মেয়েটার সাথে।

এসব ভেবেই হাসপাতাল থেকে বাইরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো সে কিন্তু যাওয়ার আগে সেজ চাচার সাথে দেখা করে যা‌ওয়া সমীচীন মনে করে আবার পিছিয়ে এলো।সেজ চাচার খোঁজ করতেই জানতে পরলো জায়েদ জাহানারা কেবিনে।আদিব বুঝলো চাচার বের হতে দেরি হবে।হাত ঘড়িতে সময় দেখলো , একটা কাজ আছে তার যেতে হবে তাকে। অজ্ঞাত সে আকিব কে বলে প্রস্থান করবে ভাবলো। আকিব জাহানারার কেবিনের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল আদিব এগিয়ে গেল সেদিকে।আকিব কে বলল সে চলে যাচ্ছে, পরে সময় করে একবার আসবে। আকিব মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। কিছু এদিক ওদিকের কথা বলে আদিব চলেই আসছিল তখন জায়েদ কেবিনের দরজা খুলে উদাস মুখে বেরিয়ে এলো কেবিন থেকে ।আদিব চাচাকে দেখে সামনে এগিয়ে গেল।দুই পা আগাতেই কেবিনের ভেতরটা দৃশ্যমান হলো আদিবের।চোখ পড়লো জাহানারার ফ্যাকাশে মুখে।বেড একটু উঁচু করে রাখায় জাহানারার মুখটা দৃশ্যমান।আদিব কে দেখেই চোখ স্থির হলো জাহানারার হাত উঁচিয়ে মৃদু স্বরে কি যেন বলল সে।সাথে সাথে নাহিদা নামের নার্সটি উচ্চ স্বরে বলে উঠলো,

-ওনাকে চিন্তে পারছেন?

জাহানারা আলতো করে মাথা নাড়ালো। ক্ষীণ স্বরে বলল,

-উনি?

-উনি আপনার হাজবেন্ড।

নাহিদা কথাটা বলা মাত্রই তাকে ধমকে উঠলো রাকিব। রাগান্বিত কণ্ঠে বলল,

-আপনি কি পাগল?দেখতে পারছেন না রোগীর কি অবস্থা।এমন সময় আমাদের একটা স্টেটমেন্ট রোগীর উপর কি ভয়ানক প্রভাব ফেলবে আপনার ধারণা আছে!

-স্যার কিন্তু আমি তো ভুল বলেনি, উনি তো পেশেন্টের স্বামী।

নিজের সপক্ষে আমতা আমতা করে বলল নাহিদা।রাকিবের মেজাজ এবার চড়লো।সে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

-আর এই কথা আপনাকে কে বলেছেন?

-উনি বলেছেন।

আদিবের দিকে ইশারা করে বলল নাহিদা। আদিব যেন আকাশ থেকে পড়লো।সে এমন কথা কখন বলছে সেটা মনে করার চেষ্টা করলো। ভ্রূ তে ভাঁজ ফেলে জানতে চাইলো কখন সে নাহিদা কে এমন কিছু বলেছে।উত্তরে নাহিদা তার আর আদিবের গত দিনের কথোপকথন সবিস্তারে উল্লেখ করলো।তার কথা শুনে আদিব স্পষ্ট কণ্ঠে বলল,

-আপনি ভুল বুঝেছেন।আমি ওনার হাজবেন্ড না,আমি ওনার ক্যাজিন।

আদিবের কথায় চুপসে গেল নাহিদা বুঝলো তার ভুল হয়েছে।সে আমতা আমতা করে বারবার স্যরি বলতে লাগলো।রাকিব তার স্যরি শুনলো কি না বোঝা গেল না।সে তখন জাহানারা কে পর্যবেক্ষণে ব্যস্ত।কড়া এন্টিবায়োটিকের প্রভাবে জাহানারা আবার ঘুমিয়ে পড়েছে।রাকিব জাহানারার অবস্থা দেখে স্বস্তি পেল।নাহিদা কে ইমিডিয়েটলি রুম থেকে বেরিয়ে যেতে বলল।তার রাগ হচ্ছে ভদ্র মহিলার উপর।তার উপস্থিতিতে ভদ্রমহিলা কেন আগ বাড়িয়ে কথা বলতে গেল সেটা ভেবে পাচ্ছে না সে!ভদ্রমহিলার অবান্তর ভাবনার জন্য আজ বড় সড় একটা সমস্যা হতে পারতো সেটা ভেবেই মেজাজ গরম হচ্ছে তার। ভাগ্য ভালো ছিল যে জাহানারা ঔষুধের প্রভাবে ঘুমিয়ে পড়েছিল।না হলে তাকে সামলাতে বেগ পেতে হতো।

রাকিব জাহানারা কে ভালো ভাবে পর্যবেক্ষণ করে জানালো সে আশঙ্কা করছে জাহানারা রেট্রোগ্রেড আ্যমনেশিয়া আক্রান্ত হয়েছে।তবে সে নিশ্চিত না। কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষার পর নিশ্চিত হবে।রেট্রোগ্রেড আ্যমনেশিয়ার কথা শুনে আদিবের চোখে মুখে চিন্তার গাঢ় ছাপ পড়লো।রেট্রোগ্রেড আ্যমনেশিয়ার ব্যাপারে খুব ভালোভাবে জানা না থাকলেও সে যেটুকু জানে তা হলো,

রেট্রোগ্রেড অ্যামনেশিয়া হলো এমন একটি স্মৃতিভ্রংশ অবস্থা, যেখানে ব্যক্তি তার অতীতের স্মৃতি হারিয়ে ফেলেন, কিন্তু নতুন তথ্য গ্রহণ ও মনে রাখতে পারেন। এটি সাধারণত মস্তিষ্কের আঘাত বা রোগের কারণে ঘটে। এক্ষেত্রে ব্যক্তি তার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো ভুলে যেতে পারেন।

এটি সাধারণত মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট অংশ, বিশেষ করে হিপোক্যাম্পাস, থ্যালামাস বা টেম্পোরাল লোবের ক্ষতির কারণে হয়।আদিব ধারণা করলো জাহানারার মাথায় আঘাত লাগার কারণে হয়ত এই সমস্যা দেখা দিয়েছে।কথাটা ভেবেই চিন্তা বাড়লো আদিবের।রেট্রোগ্রেড অ্যামনেশিয়ার যে ধরণগুলো আছে তার মধ্যে জাহানারা ঠিক কোনধরণে আক্রান্ত হয়েছে সেটাই আদিবের চিন্তার কারণ হলো।

রেট্রোগ্রেড আ্যমনেশিয়ার সাধারণ তিনটা ধরণ আছে, সীমিত, সম্পূর্ণ, প্রগতিশীল।এখন সীমিত পর্যায়ে হলে জাহানারা দুর্ঘটনার আগের কিছু অতীতের অংশ ভুলে যাবে।যেটা হয়ত তার জীবনে খুব বেশি প্রভাব ফেলবে না কিন্তু যদি সম্পূর্ণ হয়…… তাহলে?তাহলে তো সে নিজের অতীত জীবন ,এমনকি নিজের পরিচয়‌ও ভুলে যাবে।আবার যদি প্রগতিশীল হয় তাহলে ধীরে ধীরে মেয়েটা আলঝেইমার রোগে আক্রান্ত হবে যেটাও খুব একটা সুবিধার না!এই রোগের ভয়াবহতার কথা চিন্তা করে জাহানারার জন্য মায়া হলো আদিবের।মনে মনে দোয়া করলো রাকিবের ধারণা যেন ভুল হয়।

চলবে, ইনশাআল্লাহ

পূর্ববর্তী নিবন্ধ
পরবর্তী নিবন্ধ
গল্প পোকা
গল্প পোকাhttps://golpopoka.com
গল্পপোকা ডট কম -এ আপনাকে স্বাগতম......
RELATED ARTICLES

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments

Md masrur Hasan mahi على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
আমিনুল ইসলাম على প্রয়োজন পর্ব: ৩০ ( অন্তিম)
সাজিবুল ইসলাম على ধর্ষিতাবউ২ ৯ তথা শেষ পর্ব
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
Nita Sarkar على স্বপ্নীল ৬৮
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على রহস্য শেষ_পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على অলক্ষ্যে তুমি পর্ব-০৬ এবং শেষ পর্ব
Nazmun Nahar Akhi على Psycho_is_back? part_7
Nazmun Nahar Akhi على Dangerous_Villian_Lover part 2
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على জানালার ওপারে পর্ব-১৭ এবং শেষ পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على লীলা বোর্ডিং ১২১৫ পর্ব-১১ এবং শেষ পর্ব
মিজানুর রহমান রাহুল على সেই তুমি পর্ব-০১
@feelings على প্রহেলিকা
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Nusrat jahan على coffee & vanilla Part-10
Pallabi Roy على স্বপ্নীল ৬৮
M.D Mahabub على The_Villain_Lover Part_2
Labani sarkar على Dangerous_Villain_Lover part 23
MD Akas Apc على বিবেক
Tanisha Ahmed على Devil love part-18 
Aius Barmon shorob على নারীর দেহকে নয়
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Priya Banerjee على devil love married life last part
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Riya Biswas على তুমি রবে ৫২
Mohammad Adib على তুমি রবে ৬০
Avni Ayesha على তুমি রবে ২৮
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
সুমিত على তুমি রবে ২৮
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
Samiah Begum على তুমি রবে ৫১
biddut das rocky على নর নারী
গল্প পোকা على নষ্ট গলি শেষ পর্ব
Md Jobayer Hossain Shohag على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على দুই অলসের সংসার
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤৪২.
A.J.S Rakib على মন ফড়িং ❤৪২.
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
Samiya noor على গল্পঃ ভয়
Sadikul على গল্পঃ ভয়
Samia Islam على গল্পঃ ভয়
শূন্য মায়া على মন ফড়িং ❤ ৪০.
Sutapa biswas على মন ফড়িং ❤৩৯.
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৮.
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৭
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
Siyam على বিবেক
Sudipto Guchhait على My_Mafia_Boss পর্ব-৯
saptami karmakar على devil love married life last part
saptami karmakar على devil love married life last part
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ২৬.
Shreyashi Dutta على  বিয়ে part 1
Sandipan Biswas على  বিয়ে part 1
Paramita Bhattacharyya على অনুরাগ শেষ পর্ব
জামিয়া পারভীন তানি على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
মায়া على মন ফড়িং  ২২
সুরিয়া মিম على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على মন ফড়িং ২১
গল্প পোকা على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
Sahin ssb على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৮. 
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৭.
Jannatul Ferdous على খেলাঘর পর্ব-৩৫
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ফাল্গুনের_ফুল last_part_8
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ছাত্রী যখন বউ পাঠঃ ১
গল্প পোকা على বাজির প্রেম পাঠঃ ১
Foujia Khanom Parsha على মা… ?
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৮
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
Ibna Al Wadud Shovon على স্বার্থ