তারিন, কি হয়েছে তোমার? এমন মন খারাপ করে বসে আছো? আমার অফিসের সময় চলে যাচ্ছে, নাস্তা দেবেনা? তোমার স্কুল কি আজ ছুটি নাকি?
– রোজদিন আমাকেই কেন উঠে নাস্তা দিতে হবে? তুমি নিজে একটু করে নিলেও তো পার।
সেটা না হয় করে নিলাম। কিন্তু তোমাকে না দেখে অফিসের জন্য বের হতে ভালো লাগেনা।
– হয়েছে হয়েছে এতো আদিখ্যেতা দেখাতে হবেনা।
আচ্ছা কি হয়েছে বলোতো?
– রাহাত, আমি কি দেখতে খুব খারাপ?
হঠাৎ এ কথা বলছো কেন? পৃথিবীতে কোন মানুষই দেখতে খারাপ না। হুম এটা সত্যি যে তোমাকে হয়তো সবার ভালো লাগবেনা। আর এটা তেমন কোন বড় ব্যাপারও না। তোমার কাছের মানুষরা যদি তোমায় পছন্দ করে তবে অন্য সব মানুষদের প্রিয়ভাজন হতেই হবে বলে আমি মনে করিনা। কিন্তু হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন?
– আমাদের মেয়েদের একটা গ্রুপ আছে। ওখানে একটা কম্পিটিশন হয়েছিল। মেকাপ ছাড়া কে দেখতে কেমন? আমি লাড্ডুগুড্ডু হয়েছি।
ওহ এটাই বুঝি মন খারাপের কারণ?
– ঠিক মন খারাপ না। তবে ভাবছি। নিজের বোধহয় আরেকটু যত্ন নেয়া দরকার।
কি জানি বাবা, অত বুঝিনা। আমার কাছে এলোমেলো তোমাকেই তো ভালো লাগে। চল চা খাই এখন।
– হুম চলো।
চা খেয়ে রাহাত অফিসে চলে গেলেও তারিনের মন পরে থাকে ফেসবুকের সেই গ্রুপে। কেন এতো কম মানুষ তাকে লাইক দিল? ও তো সবার ছবিতেই লাইক কমেন্ট করেছে নিজের সাধ্যমত। রাহাতের তারিনের মন খারাপ নিয়ে মাথাব্যথা থাকবেনা সেটা তারিন খুব ভালোই জানে। রাহাতের কাছে ওর সংসার ভালোভাবে চললেই হলো। মাঝে মাঝে তারিনের মনে হয় ও একটা রোবটের সাথে সংসার করছে যার কোন হেলদোল নেই শুধু দিন কাটিয়ে যেতে পারলেই হলো।
আয়নায় নিজেকে অনেকটা সময় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে আজ তারিন। চুলে পাক ধরেছে, কপালে পরেছে বয়সের ভাঁজ। সংসার, চাকুরী, নিজেদের ভার্সিটির বন্ধুদের একটা চ্যারিটি স্কুল সামলে আসলেই নিজের জন্য সময় বের করা কঠিন হয়ে যায়। আর হিসেবের টাকাপয়সাও একটা ব্যাপার। তাও ভাগ্যিস ছেলেমেয়ে দুটো নিজে নিজে পড়ালেখা করে দেখে রক্ষা। এই মধ্যবয়সে গ্রুপের সবার সাথে ঝোঁকের মাথায় ছবিটা না দিলেও বোধহয় হতো। তাহলে শুধু শুধু মন খারাপ করে আজকের দিনটা কাটতোনা।
আয়নায় লম্বা সময় নিজেকে দেখতে দেখতে সময় যে কিভাবে চলে যায় টেরই পায়না তারিন। দৌড়ে দৌড়ে বাসা থেকে বের হতে যেয়ে আবারও সেই আটপৌড়ে রূপেই কাজে যাওয়া। সবাই কি সুন্দর ফিটফাট হয়ে থাকে দেখতে দারুন লাগলেও সময়ের সাথে দৌড়ে তারিন আর নিজেকে বদলানোর যেন সুযোগই করতে পারেনা। মনে মনে ভাবে শনিবারে চ্যারিটি স্কুলের যে ক্লাসটা নেয় সেটা শেষ করে একটু ঢুঁ মারবে পার্লারে। টিভিতে দেখা সিনিয়র অভিনেত্রীগুলোতো তারই বয়সী। অথচ ঘষামাজা করে কি সুন্দরীই না রয়েছে এখনো।
রাতে সব গুছিয়ে শুতে এসে দেখে এখনো রাহাত ঘুমোয়নি। অন্যদিন এর মধ্যে এক ঘুম হয়ে যায় তার বলেই তারিনের ধারনা।
– ঘুমোওনি যে এখনো?
ওপরের ড্রয়ারে তোমার জন্য একটা খাম রাখা আছে। পার্লারে যেয়ে একটু কি যেন করে ফেসিয়াল টেসিয়াল করে এসে ছবি তুলে না হয় তোমার ঐ গ্রুপে দিও। তোমার মন খারাপ দেখতে ভালো লাগেনা।
এটুকু বলে রাহাত অন্যদিকে ফিরে ঘুমিয়ে গেলেও তারিনের মনটা ভালো লাগায় ভরে যায়, যাক রাহাত তাহলে তাকে কেয়ার করে।
নিজের জন্য সময় বের করাও যে একটা কৌশলের ব্যাপার সেটা তারিন টের পায় পরের কয়েকদিনে। হাতে টাকা থাকা সত্ত্বেও নিজের যত্ন নিতে যাওয়ার সময়টুকু করে উঠতে পারেনা। শনিবারে বস্তির সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য নেয়া নির্ধারিত ক্লাস শেষে বের হওয়ার মুখে দেখে ক্লাসের সবচেয়ে ভালো ছাত্র আক্তার সময় পেরিয়ে গেলেও পড়তে আসেনি। একে তাকে বলে আক্তারের বাড়িতে যেয়ে তারিন দেখে আক্তারের ভীষণ জ্বর। জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকছে। অন্যের বাড়িতে কাজ করা আক্তারের মাকে ডাকিয়ে এনে ওকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে বাসায় আসতে আসতে পার্লারে যাওয়ার কথা বেমালুম ভুলে যায় তারিন। তার পরের সপ্তাহ পার হতে সেই মন খারাপের কথাও আর মনে থাকেনা তার। বরং মন ভীষণ রকম ভালো হয়ে যায় যখন আক্তারের মা আক্তারকে স্কুলে দিতে এসে হাত ধরে বলে যায়, ‘আপনের দিলটা বড় পরিস্কারগো আফা। আল্লাহ আপনের ভালো করুক।’
………….
রোজদিনকার মতো মুখ ধুয়ে একটু মুখে হাল্কা করে ময়েশ্চারাইজার লাগিয়ে বিছানায় শুতে আসতেই তারিন দেখে রাহাত জেগে আছে।
– কি ব্যাপার, তুমি আজকাল প্রায়শই দেরীতে ঘুমাচ্ছো?
তোমাকে খুব খুশী খুশী দেখাচ্ছে। পার্লারে গিয়ে কি কি করলে কিছুই তো বুঝতে পারছিনা।
– পার্লারে যাইনি। তোমার দেয়া টাকাটা খরচ হয়ে গেছে স্কুলের অসুস্থ একটা বাচ্চার পেছনে।
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে রাহাত তারিনের কথা শুনে।
মাঝে মাঝে এ ধরনের প্রতিযোগিতায় হেরে যাওয়া বোধহয় খারাপ কিছুনা, কি বলো তারিন?
– এ কথা বলছো কেন?
নিজের বাহ্যিক সৌন্দর্যের বাইরেও অন্তরের সৌন্দর্য বলেও যে একটা ব্যাপার আছে তা নতুন করে বোঝা যায়।
#ডা_জান্নাতুল_ফেরদৌস