#সে
#পর্ব_১৫
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
___________________
শুভ্রর চোখে-মুখে হাসির বিস্তৃতি পরিলক্ষিত হচ্ছে স্পষ্টভাবে। ভাবটা এমন যেন, আমাদের দেখা যে হতোই সেই ব্যাপারে একদম শিওর সে। তবে আমার জন্য এতটাও স্বাভাবিক নয়। আমার ভ্রু কুঁচকানো দেখে সেও এবার ভ্রু কুঁচকে ফেলল। চিন্তিতভাবে বলল,’আপনি কি আমায় চিনতে পারেননি?’
আমি বললাম,’ট্রেনে আপনায় প্রথম দেখেছিলাম সেই হিসেবে চিনতে পেরেছি। কিন্তু স্টেশনে যে বলে গেলেন, আগেও আমাদের দেখা হয়েছিল সেটা আমি জানি না। আদৌ দেখা হয়েছিল কীনা সেটা যখন জানিনা তখন আপনাকে চেনার প্রশ্নই আসে না।’
সে মুচকি হাসলো। মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে হেসে সীটের সাথে হেলান দিয়ে বসে বলে,’এটাও অবশ্য অস্বাভাবিক না। তো এখন কি আপনার জানতে ইচ্ছে করছে না কীভাবে চেনার কথা?’
‘আপনার বলার ইচ্ছে থাকলে শুনতে পারি।’
‘নিজ থেকে ইন্টারেস্ট নেই?’ শুভ্রর চোখেমুখে বিস্মিত ভাব। আমি শান্ত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বললাম,’অতিরিক্ত আগ্রহ মানুষকে নিরাশ করে। জেনেশুনে বারবার একই পরিস্থিতিতে পড়তে চাচ্ছি না।’
এ কথা শুনে তার হাসিমুখে ব্যাঘাত ঘটল। কপালে পড়ল তিন, চারটে ভাঁজ। কিছু্ক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,’বাচ্চা হলেও বেশ কঠিন কঠিন কথা বলতে শিখে গেছেন। আপনার খুব একটা আগ্রহ নেই সেটা অবশ্য বুঝতে পারছি।’
‘একেবারে যে নেই তাও নয়। বিষয়টা এমন যে, আপনি বললে আমিও শুনতে চাই। কিন্তু না বললেও আমার কোনো সমস্যা নেই।’
‘বুঝতে পেরেছি। আমি বলতে চাই। না জানলে আপনার কীরকম লাগবে জানিনা। তবে আমার মনটা সারাক্ষণই খুতখুত করবে।’
আমি হেসে ফেললাম। সে বলল,’সিলেটে সেই বিয়ের ঘটনা মনে আছে? আমি বরের বন্ধু ছিলাম।’
আমি চুপ করে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। সে বলল,’আপনার সেই দুর্ঘটনার কথা অবশ্যই মনে থাকার কথা। আপনি যখন অস্থির হয়ে বলছিলেন আপনি বিপদে পড়েছেন তখন আমি ও আমার একটা বন্ধু ঐ ছেলের পেছনে দৌঁড়ে যাই। সবাই মিলে মারার পর ফিরে এসে আপনাকে অজ্ঞান অবস্থায় দেখতে পাই।ভয়ে আপনার আতঙ্কিত মুখটাও দেখতে মায়াবী লাগছিল। সেই যে চোখে আপনার মুখটা গেঁথে রয়েছে আর ভুলিনি। তাই তো ট্রেনে দেখেই আপনাকে চিনে ফেলেছিলাম।’
‘আই সী! এই তাহলে কাহিনী। আচ্ছা মা-ও কেন আপনাকে চিনল না?’
‘কী করে চিনবে? তার একমাত্র মেয়ের এমন অবস্থায় আশেপাশের কারো দিকে নজর দেওয়ার সময় আছে? কোনো বাবা-মা’ই পারবে না।’
‘হুম। সেদিনের জন্য ধন্যবাদ।’
‘তার কোনো প্রয়োজন নেই। শুধু একটু সাবধানে থাকবেন।’
‘থাকব।’
আমি আর কিছুই বললাম না। সেও আর কোনো কথা বাড়াল না। বাস থেকে নামার পূর্বে অনুনয়েরস্বরে বলল,’আপনার ফেসবুক আইডিটা পেতে পারি? প্লিজ!’
এমনভাবে বলল যে, মুখের ওপর না বলার উপায় নেই। আইডির নাম বলে আমি বাস থেকে নেমে যাই। সে জানালা দিয়ে মাথা বের করে বলে,’রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছি। এক্সেপ্ট করে নিবেন। আর হ্যাঁ, সাবধানে যাবেন।’
উত্তরে আমি শুধু মাথা নাড়ালাম।
বাসায় গিয়ে ফ্রেশ হয়ে খেয়ে-দেয়ে আবারও বই নিয়ে বসেছি। সত্যি বলতে আমি বইটির মাঝে পুরো ডুবে গিয়েছি। সময় কাটানোর জন্য বইয়ের নেশার চেয়ে ভালো কিছু হয় না। হতেই পারে না। আমি অন্তত এটাই মনে করি। কিন্তু সমস্যা বাঁধল ঘুম নিয়ে। কেমন যেন ঘুম ঘুম পাচ্ছে খুব। পাঠ্যবই পড়তে গেলে ঘুম পেতো। কিন্তু এখন দেখছি গল্পের বই পড়লেও ঘুম পায়। বই বন্ধ করে কিছু্ক্ষণ ঘুমিয়ে নিলাম।
সময়গুলো কাটছিল আমার এভাবেই। এলোমেলো হয়ে রুটিনমাফিক বলা চলে। এরমাঝে একদিন দেখি রুদ্র একটা পোষ্ট করেছে। ছবি আপলোড করেছে আরকি। রোজও আছে সেখানে। ওকে ট্যাগ করেছিল বলে আমার নিউজফিডে এসেছে। অবাধ্য মন বারবার করে বলছে, ‘কমেন্ট কর। একটা কমেন্ট কর।’
আমিও বাধ্য মেয়ের মতো কমেন্ট করলাম,’ভালোই সময় কাটছে দেখি রোজ।’
প্রায় সাথে সাথে রুদ্র রিপ্লাই করে,’আরে! কে এটা? পিচ্চি ম্যাম?’
আমাকে সে কীভাবে চিনল আমি জানিনা। রিয়েল নামে আইডি তো খুলিনি। তবে প্রোফাইলে আমার নিজের একটা ছবি আছে। যদিও মুখ দেখা যায় না। তার কমেন্ট দেখে আমি আর কিছুই বললাম না। আমার মনে হচ্ছে, সে আগে থেকেই জানে এটা আমার আইডি। অথচ একবারও চেষ্টাও করেনি যোগাযোগ করার। বারবার তার ব্যবহার দেখে আমায় অবাক হতে হচ্ছে। অনলাইন থেকে বেরিয়ে ছাদে যাই আমি।
বাদলা দিন। তাই আকাশ মেঘলা করে বৃষ্টি নামতেও সময় লাগল না। আমি ছাদ থেকে না নেমে বৃষ্টিতে বেশ কিছু্ক্ষণ ভিজেছি। কখনও জ্বর আসেনি এর আগে। এবার এসেছে। রাতে শরীর কাঁপিয়ে জ্বর আসে আমার। ফায়াজ আমার প্রচণ্ড কেয়ার করে। কিন্তু এবার যেন তা আরও বেশি বেড়েছে। তিনবেলা খাবার আর ওষুধ নিয়ে ঘ্যানঘ্যান করতে করতে আমার মাথা খেয়ে ফেলছিল। একেবারে খারাপও লাগতো না। কেউ কেয়ার করলে ভালোই লাগে। তবে সেটা ভালো লাগা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ।
এরপর আসে শুভ্রর কথা। তার কথা তো আর বলাই হয়নি। রিকোয়েস্ট এক্সেপ্ট করার পর সবসময় ম্যাসেজ করতো। খোঁজ-খবর নিতো। আমার ফ্রেন্ডসদের সঙ্গেও এড হয়েছে দেখলাম। আমি কথা না বললে ওদের থেকে আমার খবর নেয়। ওরা এটা নিয়ে অনেক হাসি-ঠাট্টাও করে। শুভ্রর কথাবার্তাতেও মনে হয় সে আমায় পছন্দ করে। হতে পারে ভালোওবাসে। আমি বুঝেও না বোঝার ভান করে থাকি। বান্ধবীদের সাথে যখন কথা হয় তখন ওরা ফায়াজ আর শুভ্রর টপিক তুলবেই। মাঝখানে আমি বলির পাঠা হয়ে ওদের হাস্যকর কথাবার্তা শুনি। ওরা এটাও বলে, কারো একজনের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে যেন আমিও ভালো থাকি। আমার উত্তর বরাবরই এমন থাকে,’আমি এমনিতেও ভালো আছি।’
মানুষ দুটো ভীষণ ভালো। কিন্তু ভালোবাসতে পারব এমন কখনই মনে হয়নি আমার। সেদিনের কথা। রেজাল্ট দিয়েছে আমাদের। এরপর কলেজে ভর্তির ব্যাপারে কথা বলার জন্যই তিথি আমায় কল করেছিল। এই টপিকে কথা বলার পর কোত্থেকে থেকে তখন রুদ্রর কথাও চলে আসে মাঝে। তিথি বলে,’দোস্ত রুদ্র ভাইয়ার সাথে আর কথা হয়নি?’
‘না। কথা আর হবে বলে মনেও হয় না। সে তার জীবন নিয়ে দিব্যি ভালো আছে। ঐ জীবনে আমার কোনো ঠাই নেই।’
‘তার সমস্যাটা কী আমি আজও বুঝলাম না। মোট কথা আমি তো তারেই বুঝি না। পুরা রহস্যজনক একটা মানুষ। বারবার কনফিউশনে ফেলে দেয়।’
‘কনফিউশনের কী আছে? আমার কাছে তো সবটাই পরিষ্কার।’
‘মানে? কী পরিষ্কার? তুইও কি সব জানিস?’
‘আমিও সব জানি বলতে? বুঝলাম না।’
‘ভাইয়ার সঙ্গে একদিন কথা হয়েছিল আমার। তোর ব্যাপারে কথা বলার জন্যই নক করেছিলাম। আগেই সরি বলি, তোকে না জানিয়ে কাজটা করেছি বলে। আমি আসলে তার মনোভাব জানতে চেয়েছিলাম। সে কী চায় সেটা জানতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তার তো ব্যস্ততাই শেষ হয় না। শুধু একটা কথাই বলেছিল তোদের রিলেশন কখনও সম্ভব নয়। জিজ্ঞেস করলাম কারণ কী? ম্যাসেজ সীন করেই রেখে দিয়েছে।আর রিপ্লাই করেনি।’
আমি চুপ থেকে ওর কথাগুলো শুনলাম। রাগ হচ্ছে খুব। আসলে রাগটা ঠিক কার ওপর হচ্ছে সেটাই আমি বুঝতে পারছি না। দাঁতে দাঁত চেপে বললাম,’কাজটা তোর একদম উচিত হয়নি তিথি। এতে আমি কতটা ছোটো হয়ে গেলাম তুই জানিস? সঙ্গে তোকেও ছোটো করেছে। মানুষ এতটা ব্যস্ত থাকে না যে একটা রিপ্লাই সে করতে পারবে না। যার ম্যাসেজ সীন করার সময় হয়, সে কয়েক সেকেন্ড সময় ব্যয় করে ম্যাসেজের রিপ্লাইও দিতে পারে। তুই আর কখনও তাকে ম্যাসেজ করবি না। আমি বুঝে গেছি এবং জানিও সে কেমন এবং কী চায়!’
তিথি চুপ করে থাকে। আমি নিজেই বললাম,’সম্পর্কে জড়ালে সে অনেকটা আটকে থাকার মতো থাকবে। তখন তার আলাদা দায়িত্ব থাকবে। মেয়েদের সাথে যখন-তখন ঘুরতে যেতে পারবে না। রিপ্লাই করতে পারবে না। বিভিন্ন ধরণের রসিকতা মন্তব্যে করতে পারবে না। তার চারদিকে এখন অসংখ্য মেয়ের ছড়াছড়ি। অনেক মেয়ে তার ওপর ক্রাশিত। সে দেখতে সুন্দর, ভয়েস সুন্দর, ভালো গান করতে পারে। সুন্দর করে কথা বলতে পারে, মানুষ ইম্প্রেস করতে পারে। আর এই ধরণের মানুষেরা শুধু বাইরের চাকচিক্য দেখে। সত্যিকারের মানুষটিকে তাদের চোখে পড়ে না। মোহ অনেক খারাপ জিনিস। সে এখন মোহের ঘোরেই আছে। আমি জানিনা তার এই মোহ কখনও কাটবে নাকি, সে কখনও বুঝতে পারবে নাকি সে আসলে কী হারিয়েছে। তবে এতটুকু জানি, আমি তাকে চাই না। যেই মানুষটা এক আকাশ ভালোবাসা পেয়েও সমুদ্র সমান ভালোবাসা আর রূপকথার চাকচিক্যের মোহে মোহিত হয়, যার জন্য অনেক মেয়ে অপেক্ষারত, যার আমার জন্য এতটুকু সময় নেই সেই মানুষটা আর যাই হোক; আমার যোগ্য নয়। আমি তাকে চাই না।’
তিথি কেমন ভয়ে ভয়ে ম্রিয়মাণ কণ্ঠে বলল,’দোস্ত তুইও কিন্তু জীবনটাকে সুন্দর করে সাজিয়ে-গুছিয়ে নিতে পারিস। শুভ্র ভাইয়া, ফায়াজ ভাইয়া দু’জনই বেশ ভালো মানুষ। এর মধ্যে কাউকে না কাউকে তো সুযোগ দিতেই পারিস। বিশ্বাস করতে পারিস।’
‘এরকম কোনো ফিলিংস আর কারো প্রতি আমার আসে না। আমি তাদের পছন্দ করি। সম্মান করি। ব্যস এতটুকুই। বিশ্বাস শব্দটিতে যখন ঘুনে ধরে তখন আর কোনোভাবেই অখণ্ড জায়গাগুলো জোড়া লাগে না।’
‘কোনো মানুষ ব্যস্ততার মাঝে নিশ্চয়ই তোর এত কেয়ার করবে না। অবশ্যই তার অনুভূতি সত্যি।’
‘এখন কেউ ভালোবাসা দেখালে, কেয়ার করলেও আমার সন্দেহ লাগে। অবিশ্বাস হয়। নিশ্চয়ই পেছনে কোনো স্বার্থ লুকিয়ে আছে অথবা মাইন্ড গেইম খেলতে চাচ্ছে। এরকম ধারণাই রুদ্র আমার মাঝে ঢুকিয়ে দিয়েছে।’
‘আমি বুঝতে পারছি তোর দিকটা। তোর বলা সব কথাই সঠিক। কিন্তু তাই বলে তো সবাই এক নয়। কিছু তো ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে।’
‘নিশ্চয়ই। আমিও এটা বিশ্বাস করি। তবে এই ব্যতিক্রমী মানুষগুলোকে পেতে ভাগ্য লাগে। কেউ কেউ আবার পেয়েও হারায়। অনেক তো উদাহরণ স্বচক্ষে দেখলাম। শেষে গিয়ে দেখা যায় সবাই এক।’
তিথি আর কিছু বলল না। ওপাশ থেকে ওর দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শুনতে পেলাম। আমিও আর বেশি কিছু না বলে, ‘রাখছি রে।’ বলে ফোন রেখে দিলাম। মনের ভেতর চাপা উত্তেজনা কাজ করছে। যত নিজেকে শক্ত করতে যাচ্ছি ততই কোনো না কোনোভাবে অতীতের ছায়া আমায় আঁকড়ে ধরতে চাচ্ছে। অথচ আমার চাই সুখ। একটু শান্তি।
.
.
আমি নিজেকে পুরোপুরিভাবে গুটিয়ে নিচ্ছিলাম সবার থেকে। কারও সাথে কথা বলতে ভালো লাগে না। বাইরে যেতে ভালো লাগে না। সারাদিন রুমের ভেতরই থাকছি। বই পড়াতেও এখন মনোযোগ আসছে না। ফেসবুকে গেলে আরও বেশি খারাপ লাগে। রুদ্র কত ভালো আছে! অথচ আমি ভালো থাকতে পারছি না। নিজেকে ভীতু মনে হয়। অপারগ মনে হয়। আমি অতিষ্ঠ নিজের প্রতি।
ভেতরে ভেতরে গুমড়ে গুমড়ে মরছিলাম আমি। শুভ্র কিংবা ফায়াজ কারও সাথেই কথা হচ্ছিল না। ফায়াজ কয়েকবার বাসায় এসেছিল অবশ্য। আমি ঘর থেকে ওর গলার আওয়াজ শুনতে পেয়েছিলাম। কিন্তু বের হইনি। দেখা হয়নি আর কথাও নয়। যেখানে আমি নিজেই ভালো নেই সেখানে অন্যকে ভালো রাখা আমার পক্ষে অসম্ভব প্রায়। উল্টে এখন কথা হলে রাগারাগি হবে। যা নয় তা বলে ফেলব। এজন্যই নিজেকে সময় দিচ্ছিলাম আমি।
একদিন শুক্রবারের কথা।আদিব জেদ ধরেছে ঘুরতে যাবে। বাবার শরীর ভালো নেই। তাই বিশ্রাম দরকার তার। এদিকে বাড়ির কাজ ফেলে মায়েরও সম্ভব নয় ওকে নিয়ে ঘুরে আসা।শুধু বাকি রইলাম আমি-ই। আদিবের সঙ্গে মা-ও জেদ ধরে বলল,’সারাদিন তো ঘরের মধ্যেই থাকিস। আদিবকে নিয়ে একটু ঘুরে আয়।’
আমি বারণ করা সত্ত্বেও মা শুনল না। আমায় বলল,’তুই রেডি হয়ে নে। আমি ফায়াজকেও বলে দিচ্ছি তোদের সাথে যেতে।’
মা চলে যাওয়ার পর আমিও বাধ্য হয়ে রেডি হতে চলে যাই। রেডি হয়ে ড্রয়িংরুমে আসার পর জানতে পারি ফায়াজ বাড়িতে নেই। একা ছাড়তেও মা সাহস পাচ্ছে না। আমি মাকে অভয় দিয়ে বললাম,’সমস্যা নেই মা। আমি যেই জায়গাগুলি চিনি ওখান থেকেই ঘুরে আসব। তুমি এতবেশি চিন্তা কোরো না।’
এরপর আদিব আর আমিই বেরিয়ে পড়ি ঢাকা-শহর ঘোরার জন্য।
ঢাকার রবীন্দ্র সরোবর জায়গাটা আমার বেশ লাগে। হাঁটাহাঁটি করার জন্য ভালো একটা জায়গা। আদিবকে নিয়ে আমি সেখানে যাব বলেই মনস্থির করলাম। মাঝরাস্তায় ওভারব্রিজ থেকে নামার সময় হঠাৎ-ই আদিব চিৎকার করে বলল,’আপু ঐ দেখো ফায়াজ ভাইয়া।’
আদিবের আঙুলি দ্বারা ইশারাকৃত স্থানটিতে আমিও তাকালাম। দেখতে পেলাম একটা ফুচকার স্টলে ফায়াজ বসে আছে। সঙ্গে একটি মেয়েও আছে। দুজনে বেশ হাসি-খুশিভাবে কথা বলছে। কখনও কখনও মেয়েটি উচ্চশব্দে হেসে ফায়াজের হাতে চাপড়ও দিচ্ছে।আমি সেখানেই দাঁড়িয়ে রয়েছি। বুঝতে পারছি না আমার ঠিক কী করা উচিত। আমি ওদের কয়েকটা ছবি তুলে নিলাম। তারপর ফায়াজকে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,’আপনি এখন কোথায় আছেন?’
‘বন্ধুর বাসায় আছি। কেন?’ ফায়াজের কণ্ঠস্বর গম্ভীর শোনালো। আমি হাসলাম। হেসেই বললাম,’হোয়াটসঅ্যাপ চেক করেন একটু।’
এই বলে আমি কল কেটে দিয়ে ফোনের ডাটা অন করি। এই মাত্র তোলা ছবিগুলো পাঠিয়ে দিয়ে আদিবকে নিয়ে আমি আড়াল হয়ে যাই। সীন করেছে ফায়াজ। ছবিগুলো দেখেই আশেপাশে তাকিয়ে হন্যে হয়ে খুঁজছে আমাকে। এর মাঝে আদিব আরেক কাণ্ড বাঁধিয়ে বসে। দৌঁড়ে চলে যায় ফায়াজের কাছে। এবার বাধ্য হয়ে আমায়ও সেখানে যেতে হলো। প্রথমে একটু অপ্রস্তুতবোধ করলেও এরপর ঈর্ষান্বিত পরিলক্ষিত হয় তার মুখমণ্ডলে। ঈর্ষার সহিত সে আমায় বলে,’আরে নবনী যে! বসুন।’
তুমি থেকে আপনি করে বলছে। স্ট্রেঞ্জ! কিন্তু আমি অবাক হইনি একটুও। তবে সে আমায় অবাক করতে চেয়েছে বলেই আমার মনে হচ্ছে। অন্তত তার চোখের ভাষা এমনটাই বলছে। সে আমার সঙ্গে পাশে বসে থাকা মেয়েটির পরিচয় করিয়ে দিল। মেয়েটির নাম তিয়াশা। আমি কিছুই বললাম না। ওরা আমাদের ওদের সাথে খাওয়ার জন্য অফার করল। কিন্তু আমি রাজি হইনি। বেঁকে বসে আদিব। ও ফায়াজের সঙ্গে থাকবে। প্রথম থেকেই আদিব ফায়াজের ভক্ত। অগত্যা না খেলেও আমায় বসতে হলো। ফায়াজ বলল,’জিজ্ঞেস করলেন না সে আমার কী হয়?’
আমি কিছু না বলে সপ্রশ্নদৃষ্টিতে তাকালাম। সে হেসে বলল,’স্পেশাল একজন মানুষ। যে ভালো রাখতে জানে।’
আমি একটু উচ্চশব্দেই হাসলাম। আমার কিন্তু একটুও খারাপ লাগছে না। লাগার কথাও নয়। কারণ তার প্রতি আমার তেমন ফিলিংস কখনই তৈরি হয়নি। বরং যখন সে আমায় ডিরেক্ট প্রপোজ করেছিল তখনও তাকে আমি সরাসরি বারণ করে দিয়েছিলাম। আমি তাকে ঝু্লিয়েও রাখিনি। থেকে যেতেও বলিনি। সেখানে সে যদি নতুন কোনো সম্পর্কে জড়ায় সেখানে আমার তো খারাপ লাগার কথা নয়। বরং আমি খুশি। হাসি পাচ্ছে ফায়াজের বাচ্চামো দেখে। সে আসলে চাচ্ছে আমি জেলাস ফিল করি। কষ্ট পাই। যেখানে তার প্রতি আমার কোনো ভালোবাসাই ছিল না সেখানে কষ্ট পাব ভাবনাটা আকাশ-কুসুম।
তবে একটা কথা কিন্তু মানতেই হয়, ঘুরেফিরে প্রায় সবাই একদিকেই মোড় নেয়। শুধুমাত্র কোনো একজনকে নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে পারে না। হয়তো এটা সম্ভবও নয়।
চলবে….