সে পর্ব-১৪

0
1589

#সে
#পর্ব_১৪
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
___________________
বাবা একটা নতুন সীম কিনে দিয়েছে। নতুন আইডি খুলে পরিচিত সব ফ্রেন্ডসদের ফেসবুকে এড করেছি। এমনকি রোজকেও এড করেছি। আমাদের কথা হয় রেগুলার। কলেজে ভর্তি হওয়ার আগ পর্যন্ত হাতে অফুরন্ত সময় রয়েছে। কিন্তু সময় যে কাটাবো করার মতো কিছু নেই। নিজেকে পরিবর্তন করতে গেলেই বুঝা যায়,আপাত দৃষ্টিতে আমরা এটাকে যতটা সহজ মনে করি আসলে ততটা সহজ নয়। বড়ো বড়ো লেকচার অন্যকে দেওয়া যায়। যখন নিজে একই সিচুয়েশনে এসে উপস্থিত হয় তখন হারে হারে মানুষ বুঝতে পারে উপদেশ দেওয়া সহজ হলেও সেগুলো কাজে লাগানো অত সহজ নয়।

বাড়ির বাইরে এসে হাঁটাহাঁটি করছি। আমার সাথে ফিহা আর আদিবও রয়েছে। বাচ্চাদের সঙ্গে থাকলে, খেললে নাকি মন ভালো হয়। সতেজ থাকে। কথাটি কিন্তু মিথ্যা নয়। যখন ওদের সঙ্গে আমি থাকি তখন অনেকটাই ভালো থাকি। তবে পুরোপুরি নয়! এছাড়া যখন আপনি নিজেও ধরে ফেলবেন যে, আপনি আসলে ভালো থাকার জন্যই বাচ্চাদের সঙ্গ দিচ্ছেন এবং নিচ্ছেন তখনই মন ৩৬০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে বেঁকে বসবে। কারণ এর আগেও বহুবার বলেছি, মন বড্ড বেহায়া। যার ভেতর থাকে, তার ভালো সহ্য হয় না।

আমি এক জায়গায় বসে পড়লাম। ফিহা দৌঁড়াচ্ছে আর খিলখিল করে হাসছে। পেছন পেছন আদিব দৌঁড়াচ্ছে। অজান্তে আমি নিজেও হেসে ফেললাম। নিচ থেকে ঘাস তুলে অযথাই আঙুলে পেঁচাচ্ছি আর রুদ্রর কথা ভাবছি। তাকে না দেখে, কথা না বলে কত সময় পার হয়ে গেল! সে এখন কী করছে? আমি যেমন তার কথা ভাবছি,সেও কি ভাবছে? তারও কি আমার কথা মনে পড়ে? বোধ হয় না! সে তো ব্যস্ত মানুষ। অনেক মানুষের আনাগোনা রয়েছে তার চারপাশে। সেখানে আমার শূন্যতা পূরণ করার মানুষেরও অভাব নেই নিশ্চয়ই!

গেটের দিকে চোখ পড়তেই লক্ষ্য করলাম ফায়াজ আসছে। আমরা ঢাকায় এসেছি ছয় দিন হবে। এই ছয় দিনে তার সঙ্গে আমার বিশেষ দেখা বা কথা কোনোটাই হয়নি। বার দুয়েক ঘরের বারান্দা থেকে দেখেছিলাম। সেটাও সেরকম নয়। আজ তাকে বিশেষভাবে আমার নজরে পড়েছে। কারণটা যদিও আহামরি নয়। ফায়াজ একটা কালো রঙের শার্ট পরেছে। নীলের প্রতি বেশিরভাগ মানুষের ঝোঁক থাকলেও ছোটোবেলা থেকেই আমার পছন্দ কালো রং। কালো রং যে শুধু ছেলেরা পরলেই মুগ্ধ হই এমনটা নয়। কালো শাড়ি পরা কোনো মেয়ে দেখলেও আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকি।

ফায়াজ বাড়ির দিকে না গিয়ে আমার দিকেই এগিয়ে আসলো। তার হাতে একটা ফাইল। মিষ্টি করে হেসে বলল,’বসতে পারি?’
উত্তরে আমিও মৃদু হেসে বললাম,’শিওর।’
ফায়াজকে দেখেই ফিহা ‘মামা, মামা’ বলে দৌঁড়ে এসে তার গলা জড়িয়ে ধরে। ফায়াজও পরম আদরে ফিহাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খায়। পকেট থেকে চকোলেট বের করে আদিব আর ফিহাকে দিয়ে বলে,’যাও তোমরা খেলো।’

ওরা চকোলেট নিয়ে দূরে গিয়ে আগের মতোই খেলায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আমি ওদের ব্যস্ত হওয়া দেখছিলাম। পাশ থেকে সে খ্যাঁক করে গলা পরিষ্কার করে বলে,’ভালো আছেন ম্যাম?’
‘জি আলহামদুলিল্লাহ্‌। আপনি?’ উনার দিকে তাকিয়ে বললাম আমি।
‘আলহামদুলিল্লাহ্‌ আমিও ভালো আছি। বলতে পারেন অনেক ভালো আছি।’
‘তাই নাকি?’
‘জি। কারণটা শুনবেন না?’
‘বললে অবশ্যই শুনব।’
‘আমার চাকরী হয়েছে আজ।’
‘ওয়াও! সত্যিই? এটা তো খুশির খবর।’

ফায়াজের ঠোঁটের হাসি চওড়া হয়। সে আমার দিকে দুটো ডেইরি মিল্ক চকোলেট এগিয়ে দিয়ে বলে,’আপনার জন্য।’
‘মিষ্টির বদলে চকোলেট কেন?’
‘বেতন পেয়েই মিষ্টি খাওয়াব নিজের টাকায়।’
‘থ্যাঙ্কিউ। আমি কিন্তু মজা করে বলেছি। আর চকোলেট দুটো ফিহাকে দিয়েন। আমি ডেইরি মিল্ক খাই না।’
‘কেন?’
‘পুরোটাই চকোলেট। অতিরিক্ত মিষ্টি লাগে। আমার ক্যাটবেরী পছন্দ।’
‘ও।’
‘মন খারাপ করবেন না প্লিজ!’
‘না, মন খারাপ করিনি। তারপর আপনার দিনকাল কেমন যায়?’
‘যাচ্ছে একটু বোরিং ভাবেই। এখানকার জায়গা তেমন চিনি না। কোনো বন্ধু-বান্ধবীও নেই যে তাদের সাথে ঘুরব কিংবা সময় কাটাবো।’
‘স্বাভাবিক। কলেজে ভর্তি হওয়ার পর দেখবেন তখন ফ্রেন্ডের অভাব হবে না। তবে আপনি চাইলে, আমি আপনাকে ঢাকার কোথাও ঘোরাতে পারি।’
‘আপনি? চাকরী বাদ দিয়ে?’
‘না, তা কেন হবে? শুক্রবার তো অফ ডে। আজ বুধবার। কালকের পরেরদিনই যেতে পারি।’
‘আচ্ছা আমি আপনাকে পরে জানাবো।’
‘পরে কেন? বিশ্বাস করতে পারছেন না আমাকে?’
‘এমনটা নয়। মাকে আগে বলতে হবে।’
‘ও। আচ্ছা সমস্যা নেই।’

আসল বিষয়টা কিন্তু মা নয়। মাকে বললে অবশ্যই মা রাজি হবে। কারণ ইতিমধ্যে ফায়াজ মায়ের অনেক পছন্দের একটা ছেলে। তাকে বিশ্বাসও করা যায়। শুধু আমার মন-ই টানে না। টানবেই বা কী করে? মন যে রুদ্রর কাছে পড়ে রয়েছে। তাকে হাসিমুখে বললাম,’আমি উঠব এখন। আপনি কি এখন যাবেন নাকি আরও পরে?’
‘আপনি ছিলেন বলেই বসেছি। আপনি না থাকলে তো বসে লাভ নেই। চলুন।’

যাওয়ার সময় আদিব আর ফিহাকেও ডেকে নিলাম। প্রথম প্রথম যতটা মুডি এবং গম্ভীর ফায়াজকে ভেবেছিলাম ততটা কিন্তু সে নয়। একটু চঞ্চল আছে বটে। আমাদের ফ্ল্যাট আগে পড়ে। বিদায় নিয়ে ভেতরে যাওয়ার সময় সে পিছু ডেকে বলে,’ম্যাম অনুমতি দিলে একটা কথা বলতাম।’
আমি পেছনে তাকিয়ে বললাম,’অনুমতি চাওয়ার কী আছে? বলুন।’
‘আপনি আমার জন্য লাকি পার্সন। আমার মন কেন যেন বলে, আপনি জীবনে এসেছেন বলেই চাকরীটা পেয়েছি। মুখে হাসি ফুঁটেছে। জীবনটা এখন আর রঙহীন লাগে না; বরং রঙিন মনে হয়।’

সে ফিহাকে নিয়ে চলে যাচ্ছে। এদিকে আমি ‘থ’ মেরে দাঁড়িয়ে রয়েছি। আমি কী করে তার জীবনে আসলাম? তাও কীনা লাকি পার্সন! আদিব তাড়া দিয়ে বলল,’ও আপু চলো।’
চিন্তাভাবনা বাদ দিয়ে আমি ভেতরে চলে যাই।
________________

অনেকদিন বাদে আজ রুদ্রর আইডি সার্চ করেছি। বুকটা কেমন ধকধক করছে। পুরো টাইমলাইন চেক করলাম। সুন্দর সুন্দর কিছু কবিতা রয়েছে। বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে আড্ডা দেওয়া ছবি। নিজে গান গেয়ে আপলোড করেছে। সেখানে অসংখ্য মেয়েদের কমেন্টের সারি। মনে মনে হিংসা হচ্ছে খুব। আবার কষ্টও লাগে। কষ্টের চেয়ে অবাক বেশি লাগে এটা ভেবে, সে তো ভীষণ ভালো আছে। তার বিরহে আমি কেন এত পুড়ছি? তাকে দোষ দেওয়া যায় না। সেই অধিকার-ও আমার নেই। আর না কখনও ছিল! সে ভালো থাকুক, ভালো থাকবে এটাই আমি চাই। ডাটা অফ করে ফোনটা বিছানার ওপর ফেলে দিলাম। কী করব ভেবে না পেয়ে কিছুক্ষণ ঘরের মধ্যেই পায়চারি করি। তখন মনে পড়ে যায় ডায়েরীর কথা। গত পরশু বাড়ির সামনের দোকান থেকে একটা ডায়েরী করেছি। ডায়েরীর রং নীল। কেমন যেন চিকমিক করে। রোদের মধ্যে আরও বেশি সুন্দর লাগে। এতটাই পছন্দ হয়েছিল যে, কিনে ফেলি। এখনও অব্দি কিছুই লিখিনি। আজ মনে হচ্ছে,কিছু লিখি।

মন খারাপের অসংখ্য গল্প লেখার জন্য সঙ্গী হিসেবে বেছে নিলাম ডায়েরীকে। প্রথম পৃষ্ঠাতেই গোটা গোটা অক্ষরে লিখেছি, ‘ব্যক্তিগত সে’।
হ্যাঁ, এখানেই আজ থেকে তাকে নিয়ে লিখব আমার অব্যক্ত কথাগুলি। ঘড়ির কাঁটায় এখন রাত ২টা বাজে। প্রথম পৃষ্ঠা উল্টিয়ে দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় লিখলাম,

‘সে আমার না হওয়া আক্ষেপ,
আমার না হওয়া এক আফসোসের নাম।
সে আমার মাঝরাতে ঘুম ভাঙার কারণ,
সে আমার অপেক্ষার ডাকনাম।

অপেক্ষার প্রহর ফুরাবে একদিন
শুধু ফুরাবে না তাঁর ব্যস্ততা।
মানিয়ে হয়তো নেব একদিন
শুধু রয়ে যাবে শূন্যতা।

আমার জায়গা দখল করে নেবে অন্য কেউ,
শুধু আমার-ই কাটবে না তাঁর শূন্যতা।
আমার কি ভালো থাকা হবে না?
হয়তো হ্যাঁ,আবার হয়তো না!’

হাত কাঁপছে। আর লিখতে পারছি না। ডায়েরী বন্ধ করে ঘরের লাইট অফ করে শুয়ে পড়ি। সত্যিই কি আমার কখনও ভালো থাকা হবে না? অন্য কেউ যদি রুদ্রর শূন্যতা দূর করতে পারে তাহলে আমার শূন্যতাকে কেন কেউ পূর্ণতা দান করতে পারবে না?

একটা কথা বলা হয়নি আপনাদের। চাকরীতে জয়েন করার পর থেকে ফায়াজ যথেষ্ট পরিমাণ সময় দিচ্ছে আমাকে। প্রতিবেলায় ফেসবুকে ম্যাসেজ করে খবর নিচ্ছে আমি খেয়েছি কী-না। ফায়াজ করে পরের চাকরী আর রুদ্রর নিজের বিজনেস। ফায়াজ সময় পায় আর রুদ্র সময় পায় না? সবকিছুর জন্যই রুদ্রর সময় হয়। শুধু আমিই ছিলাম না তার প্রায়োরিটির লিস্টে কোথাও। হয়তো আমারই এক্সপেকটেশন বেশি ছিল।

সেই শুক্রবার ফায়াজের সঙ্গে ঘুরতে যাইনি। ইচ্ছে হয়নি বলতে পারেন। সে টেক্সট করলে রিপ্লাই করার চেষ্টা করি। ভদ্রতার খাতিরেই বলা চলে। একটা জিনিস আমায় খুব ভাবায়, আমার ক্ষেত্রে যেমনটা হচ্ছে মানে আমি তো রুদ্রকে ভালোবাসি তাই অন্য কাউকে আমার পছন্দ হয় না। অন্য কারো সঙ্গ খুব একটা ভালোও লাগে না। হতে পারে রুদ্রও কাউকে ভালোবাসে। এজন্যই হয়তো তার আমার সঙ্গ ভালো লাগে না। সেও ভদ্রতার খাতিরে কথা বলে। এমনটা কি হতে পারে না? এরকম কতশত যুক্তি যে সামনে দাঁড় করাই! কিন্তু কোনোটাই মনঃপুত হয় না। রুদ্রকে আমার বেশ রহস্যজনক বলে মনে হয়। অন্যদিকে মনে হচ্ছে ফায়াজ বেশ পজেসিভ আমার ওপর। এতবেশি টেক কেয়ার করে! শুধু তাই নয় তার পাগলামিগুলোও ইদানীং চোখে পড়ছে। অনলাইনে না পেলেই ফোন করবে। যতক্ষণ না রিসিভ করব ফোন দিতেই থাকবে। যেদিন অনেক বেশি অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকে সেদিন দিনে কথা হয় না। রাত ১১টা কি ১২টার দিকে কল দিয়ে অনুরোধ করে বলবে,’পাঁচ মিনিট কথা বলো প্লিজ!’ আমি ঘুমের অভিনয় করলেও সে হাতে-পায়ে ধরে অনুরোধ করে।

প্রথম মাসে বেতন পেয়ে কী করেছিল শুনুন। মিষ্টি তো এনেই ছিল কিন্তু আমার জন্য যেটা করেছিল তা ছিল ভাবনারও বাহিরে। সে’বার ফাতিমা আপু আবার এসেছিল। আমায় ফোন দিয়ে বলল,’একটু বাসায় আসো তো। খুব দরকার।’
সময়টা তখন বিকেল। আমি ঘরেই ছিলাম। এরকম জরুরী তলব আপু কখনও করেনি। দরকার হলে সে নিজেই বাড়িতে আসে। ভাবলাম কোনো সমস্যা হয়েছে কী-না আবার! একবার ভেবেছিলাম মাকেও নিয়ে যাই। ঘুমিয়েছিল বলে আর ডাকিনি। ভাগ্যিস মা ঘুমিয়ে ছিল! নয়তো কী যে ভাবতো! বাড়ি থেকে বের হয়ে মেইন দরজার সামনে একটা বেলীফুলের মালা, একটা কিটক্যাট আর একটা চিরকুট দেখতে পেলাম। চিরকুটে লেখা ছিল,’নবনী তোমার জন্য সব।’

চকোলেট আর ফুল নিয়ে আরেকটু এগোতেই দেখি আরেকটা কিটক্যাট। এভাবে একটার পর একটা পেতেই থাকি। কী একটা অবস্থা! কিটক্যাটের লাইন শেষ হয় ফায়াজের ঘরে গিয়ে। সেখানে দেখি খাটের ওপর অনেকগুলো কিটক্যাট আর একটা টেডিবিয়ার। আমি স্তব্ধ! পেছন থেকে তখন ফায়াজ বলে,’পছন্দ হয়েছে?’

আমি বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,’এসব কী? এত চকোলেট দিয়ে আমি কী করব?’
‘খাবে। তুমিই তো বলেছিলে তুমি কিটক্যাট পছন্দ করো।’
‘এজন্য এতগুলো?’
‘তোমার হাতে ১০টা। আর বিছানার ওপর ১০০টা। মাত্র ১১০টা কিটক্যাট। এত হলো কীভাবে?’
আমি তখন কিছুই বলতে পারিনি। তবে এটা বুঝে গিয়েছিলাম, তার মনে আমার জন্য অন্যরকম অনুভূতি রয়েছে। হয়তো সেই অনুভূতির নাম ভালোবাসা! যা হোক, রাত অনেক হয়েছে। এখন আমার ঘুমানো দরকার।
.
.
পরেরদিন সকালে রেডি হয়ে বের হয়েছি। উদ্দেশ্য নীলক্ষেত যাব। সময় কাটানোর জন্য বই পড়া উপকারী। এটা আমার কথা নয়। তিথির কথা। তিথিও নাকি ইদানীং অনেক উপন্যাসের বই পড়ে সময় কাটাচ্ছে। একাডেমিক বইয়ের প্রতি ইন্টারেস্ট না থাকলেও, গল্প-উপন্যাসের বই অনেক ইন্টারেস্টিং হয়। এখন মোটামুটি ঢাকার রাস্তাঘাট চিনি। বন্ধের দিন বাবার সাথে ঘুরে ঘুরে চিনেছি। আমি রিকশা নিয়ে নিলাম। ঢাকা শহরে আর কিছু থাকুক না থাকুক জ্যামের শেষ নেই। ভুল বললাম, ঢাকায় তো সবই আছে। তবে জ্যামের জন্যই বের হতে মন চায় না। যারা ঢাকা-শহরে চাকরী করে তাদেরকে যথেষ্ট সময় হাতে নিয়ে বের হতে হয়। যদিও আমার কোনো তাড়া নেই তবুও জ্যাম আমার একদম পছন্দ না। গা গুলায়।

এখন জ্যাম কিছুটা কম থাকায় দ্রুতই পৌঁছে গিয়েছি। শুক্রবার বোঝা যায় জ্যাম কাকে বলে! নীলক্ষেত গিয়ে বই ঘাটছি। রুদ্রর প্রিয় লেখক হুমায়ুন আহমেদ। ভাবলাম উনার বই-ই নিই। হুমায়ুন আহমেদের অসংখ্য বইয়ের মধ্যে বই সিলেক্ট করা কষ্টকর। তিথিকে কল করে ওর পড়া কিছু বইয়ের নাম জেনে নিলাম। খুঁজে খুঁজে বের করে ঐগুলাই কিনলাম। ফিরে আসার সময়ে একটা ফুটপাতে চোখ আটকে যায়। বেশ অনেকগুলো বই নিয়ে একজন বুড়ো দাদার বয়সী লোক বসে রয়েছে। আমার দৃষ্টি আটকিয়েছে হুমায়ুন আহমেদের লেখা ‘অপেক্ষা’ বইটির দিকে। বইটির বিষয়বস্তু কী আমি জানি না। তবে নামটা আমায় খুব টেনেছে। অপেক্ষা! এই বইটিও আমি নিয়ে নিলাম।

ফিরে আসার সময় রিকশা নিয়ে বিপত্তি বাঁধল। যেগুলো পাচ্ছিলাম ভাড়া বেশি চাচ্ছিল। এদিকে বই কিনে আমার হাতের অবস্থাও ফাঁকা। তাই বাধ্য হয়ে বাসেই উঠলাম। বই পড়তে পড়তে যাব, মন্দ হবে না। বাসে উঠে মাঝের সারিতে জানালার পাশের সিটটায় বসলাম। জানালার কাঁচ খুলে দেওয়ায় এখন কিছুটা বাতাস আসছে। অপেক্ষা বইটিই আগে পড়া শুরু করলাম। বাস চলছে বাসের মতো। আমার পাশে কে এসে বসেছে আমি দেখিনি। আমি ততক্ষণে পড়ায় ব্যস্ত। হেল্পার এসে যখন বলল,’আপা ভাড়া দ্যান।’

তখন বই পড়া থেকে আমার মনোযোগ নষ্ট হয়। ব্যাগ থেকে টাকা বের করে ভাড়া দিয়ে তৎক্ষণাৎ বই পড়ায় মনোযোগ বসাই। এদিকে যে বৃষ্টি পড়াও আরম্ভ হয়েছে সেই খেয়ালও আমার নেই। পাশের লোকটি যখন বলল,’জানালা লাগান। বৃষ্টি আসতেছে।’ তখন আবারও আমার মনোযোগ নষ্ট হয়। এবার আমি বেশ বিরক্তও হই। কিন্তু সেটা মুখে প্রকাশ করলাম না। জানালা বন্ধ করতে গিয়ে বাঁধল আরেক বিপত্তি! এত শক্ত যে হাত ব্যথা হয়ে যাচ্ছিল তবুও জানালার কাঁচ লাগাতে পারছিলাম না। তখন পাশের ব্যক্তিটি বলল,’দেখি আমি লাগাচ্ছি।’

জানালা থেকে হাত সরিয়ে নিলাম আমি। উনি উঠে দাঁড়িয়ে জানালা লাগিয়ে দিল। আমার মতো তার এত কসরত করতে হয়নি। সব ঝামেলা শেষ। এবার পড়া যাক। পড়ার মাঝে ডুবে যাচ্ছিলাম প্রায় তখন সে পিঞ্চ মেরে বলল,’এত মনোযোগ দিয়ে অপেক্ষা পড়ছেন। কারো জন্য অপেক্ষা করছেন নাকি? আমার জন্য নয় তো?’
বিরক্তিতে চোখমুখ কুঁচকে তার দিকে তাকানোর পর সে হেসে ফেলল। সে যে হেসেছে সেটা আমি তার চোখ দেখে বুঝেছি; কারণ তার মুখে মাস্ক। সে এবার মাস্কটি খুলে বলল,’এবারও কি আমায় চেনেনি? আমি শুভ্র।’

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে