#সে_আমারই
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ৪৯
বেশ অনেক দিন পর ফারনাজ বাপের বাড়িতে এসে খুব খুশি। অবশেষে তুরাগ তাকে আসতে দিল। না আসতে দিয়েও উপায় ছিল না যদিও। তবে কড়াকড়ি ভাবে সাবধানে থাকতে বলেছে। ছোটাছুটিও করতে একদম বারণ করেছে। কারণ একবার পড়ে টড়ে গেলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। ফারনাজ বোঝে না, নাকি? সে কেন যেচে পড়ে নিজেদের অংশের ক্ষতি করতে যাবে? সে অবশ্যই সাবধানে থাকবে। তাছাড়া সবাই তো আছেই তাকে দেখে রাখার জন্য। সব থেকে বড় কথা, একটা ভবিষ্যৎ ডাক্তার আছে না? সে তো তাকে বড়দের মতো বকাঝকাও করে। শরীরের কোনো অবহেলা করার উপায় নেই।
রাত নটার দিকে তুরাগের কল এলো। ফারনাজ তখন দৃষ্টির পাশে শুয়ে হাজারটা গল্পে ব্যস্ত। রিসিভ করে কানে ধরতেই তুরাগ বলে,
“কি করছ?”
“শুয়ে আছি, দৃষ্টির পাশে। তুমি?”
বহু কষ্টে ফারনাজ কে আপনি থেকে তুমিতে এনেছে। এই ‘তুমি’ তার মুখে শুনলে তার হৃদয় জুড়িয়ে যায়।
“আমি অফিস থেকে মাত্র ফিরলাম। খেয়েছ? আর মেডিসিন নিয়েছ?”
“হ্যাঁ সব হয়েছে। তুমি একটু চিন্তা করা বন্ধ করো তো। সবাই তো আছে, নাকি? আমার খেয়াল রাখার মানুষের অভাব নেই।”
“তবুও আমার চিন্তা হয়। তুমি তো খুব শান্ত মানুষ! আমি চিন্তা না করে পারি না। বাড়িতে যাওয়ার কি দরকার ছিল? জেদ করে চলে গেলে আমাকেও বাধ্য করলে তোমাকে যেতে দিতে।”
“দুটো দিন কি তুমি থাকতে পারবে না? নিতে তো আসবেই দুদিন পর।”
“আমার জায়গায় তুমি থাকলে বুঝতে।”
“অতো বুঝতে চাইছি না। অফিস থেকে এসেছ খাও তারপর ঘুমাও। রাতে আর ফোন দিয়ে আমাকে ডিস্টার্ব করবে না। হুহ!”
খট করে কেটে দিল। তুরাগ হতাশ শ্বাস ফ্যালে। দুদিন পরই তাদের রিসিভশনের তারিখ ধার্য করা হয়েছে। আফরানের কারসাজি, দেরি তার সহ্য হবে না বলেই দুদিন পর ঠিক করা হয়েছে। ফাহাদ আবরার যদিও একটু অমত পোষণ করেছিলেন, তবে আফরানের অস্থিরতার সামনে হার মানলেন। তাদের তিন ভাইয়েরই একই দিনে ধুমধাম করে অনুষ্ঠান হবে। আফরান, তুরাগ আর ফারদিন। ফাঁকে আরো একবার কবুলও বলে নেবে।
হঠাৎ করে তুরাগকে চেপে ধরে আফরান ন্যাকা সুরে কাঁদার ভান করে। সে বিরক্ত হয়। বলে,
“এভাবে চেপে ধরেছিস কেন? আমি তোর বউ নই।”
“আমি বউকে ছেড়ে থাকতে পারছি না। আর তুই আমার বউ হতে যাবি কেন? আমার বউ একমন শক্ত নয় ও তুলোর মতো তুলতুলে।”
তুরাগ নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়,
“ঢং করিস না তো। একটা বছর ছেড়ে থাকতে পারলি আর এখন দুটো দিন পারছিস না।”
আফরান তার বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল। বলল,
“তখন পেরেছিলাম, কিন্তু এখন পারছি না। আমরাও চল যাই। কি হবে গেলে?”
“গেলে তুই যা। আমি তোর মতো নির্লজ্জ হতে পারছি না।”
কিছুক্ষণ চুপ থাকে আফরান। অতঃপর বলে,
“ঠিক আছে, যাব না। তবে আজ আমি তোর সাথে থাকব। একা থাকতে আমার ভয় করবে।”
তুরাগ বালিশ ছুড়ে মারল তার মুখে। বলল,
“আমার রুমে থাকা যাবে না। এক্ষুনি বের হ।”
“নিজের বড় ভাইকে বের করে দিবি! এটা কেমন বেয়াদবি!”
তুরাগ হাল ছেড়ে দিল। মুখ কুঁচকে যেতে যেতে বলল,
“থাক তবে। আমি খেয়ে আসি।”
আফরান বালিশ জড়িয়ে ধরে রাখে। আহারে! বউটা যদি কাছে থাকত, কি ভালো টাই না হতো। আগের রাতের মতো খুব আদর করত। যদিও বউ একটু ঘাড়ত্যাড়া। কিন্তু সে ঠিকই সামলে নিত। তুলতুলে শরীরটা বুকের সঙ্গে মিশিয়ে রাখত। যতোই ছাড়তে বলুক না কেন, সে ছাড়ত না। দুটো দিন কীভাবে পার করবে? আজ আবার চুরি করে গেলে হয় না? পর মুহূর্তে মনে পড়ল দৃষ্টি তাকে কড়া ভাবে মানা করেছে। দুদিন যেন তাকে ও বাড়ির আশে পাশেও দ্যাখা না যায়। যদি দ্যাখা যায়, তাহলে খুব খারাপ হয়ে যাবে। সে কবুল বলবে না, আর শশুর বাড়িতেও যাবে না। এবং আফরানকে বিবাহিত ব্যাচেলর হয়ে থাকতে হবে। আফরান মনে মনে হাহাকার করে, সে কিছুতেই বিবাহিত ব্যাচেলর হয়ে থাকতে চায় না। সে বউয়ের সাথে থাকতে চায়।
—
পায়েলের মনটা একটু খারাপ। বেশি নয় একটুখানি খারাপ। তার কারণটা অবশ্য গুরুত্বর। সে ভেবেছিল বান্ধবীর বিয়েতে নাচবে। কিন্তু এখন তো তারও বিয়ে। নিজের বিয়েতে কি কেউ নাচে? মন খারাপ করে সে বলল,
“আমি না আর বিয়ে করব না। বিয়ে তো একবার হয়েছেই।”
ফারদিন ভ্রু কুঁচকে নেয়। বলে,
“কেন? কি সমস্যা তোমার?”
“তেমন কিছু না। আমি দৃষের বিয়েতে একটু মজা করতে চাইছিলাম। কিন্তু এখন তো আমারও বিয়ে! নিজের বিয়েতে মজা করা যায় না।”
“অতো মজা করে কাজ নেই। যা হচ্ছে হবে। নাচতে ইচ্ছে হলে নাচবে। মোচড়া মুচড়ি করা বন্ধ করো।”
পায়েল কিঞ্চিত রেগে গেল। এই লোক কখনো শান্ত সুরে কথা বলতে পারে না। সব সময় গম্ভীর! বিয়ে বিয়ে করে লাফাচ্ছে কেন সে কি জানে না? খুব জানে। বদ লোকটাকে চেনা হয়ে গেছে তার। সেও মুখ গম্ভীর করে বলল,
“ঠিক আছে। আমি দু’দিন আপু আর দৃষের সঙ্গে থাকব। চলি।”
ফারদিন তৎক্ষণাৎ তাকে চেপে ধরে। বলে,
“আপুদের সাথে থাকব! এর মানে কি?”
“আপনি দেখলেন না? বিয়ে বলে নাজ আপু চলে এসেছে আর আফরান স্যারও চলে গিয়েছে। তাহলে আমি আপনার সাথে কেন থাকব? ছাড়ুন আমাকে, আমি যাব।”
“না, তুমি যেতে পারবে না।”
“আমি যাবই যাব। ছাড়ুন নাহলে কিন্তু চেঁচাব।”
“আমাকে রাগিয়ে দিও না, পায়েল। খুব খারাপ হবে কিন্তু।”
হঠাৎ পায়েল দরজার দিকে চেয়ে বলল,
“আরে নাজ আপু আপনি! কিছু বলবেন নাকি?”
ফারদিন তাকে ছেড়ে দিয়ে দূরে সরে গেল। সুযোগ বুঝে পায়েল দৌড়ে চলে গেল। যাবার সময় বলে গেল,
“বোকা বর।”
সে ভ্যাবাচ্যাকা খেল। দরজার কাছে কেউ নেই। দাঁত কিড়মিড় করে ভাবল এর শোধ সে খুব ভালো ভাবেই তুলবে।
দৃষ্টির ঘরে দৌড়ে ঢুকে দরজা মে’রে সে শ্বাস নিল ঘন ঘন। দৃষ্টি কপালে ভাঁজ ফেলে জিজ্ঞেস করে,
“কি হয়েছে? কীসে তাড়া করল তোকে?”
সে মুখ কালো করে বিছানার এক কোণে বসে পড়ল। বলল,
“তোর ভাই একটা গু’ন্ডা।”
“আমি জানি। আর তুই গু’ন্ডার বউ।”
পায়েল বিছানার উপর পা উঠিয়ে বাবু হয়ে বসে। বলে,
“বুঝলে, নাজ আপু? এই দুই ভাই বোন একই রকম ঘাড়ত্যাড়া, একজন নিজের বউকে আর অন্যজন নিজের বরকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাতে খুব ভালোবাসে। দ্যাখো না কীভাবে আমার উপর অত্যাচার করে? উঠতে বসতে ধমক দেয়। কড়া চোখে তাকায়। একটু এদিক ওদিক হলে আর রক্ষে নেই। গুন্ডাটাই তো আমাকে জোর করে বিয়ে করল। আমি কি বিয়ে করতে চেয়েছিলাম? এমন গুন্ডাকে আমি কখনোই বিয়ে করতাম না। সব তো আমার কপালে ছিল বলে হলো।”
ফারনাজ ভীষণ মনোযোগের সহিত শুনছে। সে ফের বলে,
“তোমরা দুজন তো জমজ, কিন্তু লোকটা তোমার মতো এমন মিষ্টি হলো না কেন বলো তো? আস্ত একটা তিতা করোলা।”
ফারনাজ ফিক করে হেসে ফেলল। হাসতে হাসতে চোখে জল চলে এলো। দৃষ্টি বলল,
“এতো হাসিস না, শ্বাস নিতে কষ্ট হবে।”
সে ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে গেল। পায়েলের দিকে চোখ পাকিয়ে চেয়ে দৃষ্টি বলে,
“এতো সব কথা যে বললি, তা যদি ভাইয়ার কানে যায়। তাহলে তোর কি হবে?”
পায়েল মোটেও ভয় পায়নি এমন ভাবে বলল,
“আমি তোর ভাইকে ভয় পাই নাকি? সে বাঘ না ভাল্লুক?”
“বাঘ ভাল্লুক তো নয় কিন্তু আস্ত একটা তিতা করোলা গু’ন্ডা।”
পায়েল একটু মিইয়ে গেল বোধহয়। ঝপাৎ করে দৃষ্টির গায়ের উপর পড়ে বলল,
“তোর মনে এখন কি চলছে আমি জানি। তুই তোর ভাইয়ের কাছে আমার নামে নালিশ করতে চায়ছিস। তাই না?”
“একদম ঠিক ধরেছিস।”
সে এবার রূপ বদলে ফেলল,
“এই না না, বলিস না প্লিজ। এসব জানতে পারলে আমাকে বস্তায় ভরে নদীতে ভাসিয়ে দেবে। আজ এমনিতেই বোকা বানিয়ে আমি তোদের রুমে চলে এসেছি। হাতের কাছে পেলে নিশ্চয়ই ছাড়বে না। আর এ কথা জানলে আমার শাস্তি ডাবল হবে। প্লিজ বলিস না।”
দৃষ্টি তাকে ঠেলে উঠিয়ে বলল,
“মুখ বন্ধ রাখ। লাইট অফ করে দিয়ে এক পাশে শুয়ে পড়। আর না থাকতে চায়লে বের হ।”
পায়েল দ্রুত আলো নিভিয়ে এক পাশে শুয়ে পড়ল। সে কিছুতেই যেতে চায় না। এক হাতে বান্ধবীকে জড়িয়ে ধরে শুরু করল তার সকল পরিকল্পনা। তাদের তিন জনের তিন বরকে ঘোর ফাঁদে ফ্যালার পরিকল্পনা।
চলবে,
#সে_আমারই
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ৫০
জীবনের একটা মুহূর্ত থাকে। যেই মুহূর্তটা আসার জন্য সকলে ছটফট করে। মনে হয় কখন আসবে সেই সুবর্ণ সময়? এমনই একটা মুহূর্ত আফরানের জন্য, যেদিন সে সবার সম্মুখে কবুল বলে পুনরায় দৃষ্টিকে নিজের জীবনের সাথে জুড়বে। আর এতে কোনো বাঁধা থাকবে না। কোনো চিন্তা থাকবে না। সারাজীবন সে তাকে মনের কুঠুরিতে আটকে রাখবে। সামান্য ফাঁকও রাখবে না।
কাঙ্ক্ষিত দিনটি এসেই গেল। আজ তাদের বিয়ের দিন এবং রিসিভশনও বটে। শেরোয়ানির দিকে তাকিয়ে তার ভীষণ আনন্দ লাগছে। আগের বিয়েতে তো কিছুই হয়নি। নিজে ফর্মাল গেটআপে ছিল আর দৃষ্টির জন্য একটা লাল ওড়না কিনেছিল। যা তার মাথায় দিয়ে বিয়ে সম্পন্ন হয়েছিল। আফরানের এও মনে আছে যে, জীবনে প্রথমবারের মতো সে তার গায়ে হাত তুলেছিল। এবং সেদিনই প্রতিজ্ঞা করেছিল, এই প্রথম এই শেষ। আর কখনো তার গায়ে ফুলের টোকাও দেবে না।
সে শেরোয়ানি গায়ে এঁটে আয়নার সামনে দাঁড়াল। বাহ্! ভীষণ হ্যান্ডসাম লাগছে তাকে। এবার বউয়ের নজরে পড়লেই হয়। বউটা তো তাকে দেখেও দ্যাখে না। মাথায় পাগড়ি দিয়ে ঘর ছেড়ে বের হলো। তার যে আর দেরি সহ্য হচ্ছে না। বউয়ের সাজে দৃষ্টিকে দ্যাখার জন্য কলিজাটা দপ দপ করছে। তুরাগের রুমের মধ্যে প্রবেশ করে বলল,
“রেডি হয়েছিস? চল যাই।”
তুরাগ তখন বিছানায় শুয়ে ফোনে কিছু করছিল। ভাইকে দেখে উঠে বসে হা করে তাকাল। আফরান একটু লজ্জা পাবার ভান করে বলল,
“এভাবে তাকাস কেন? ক্রাশ খেলি নাকি? আমাকে খুব হ্যান্ডসাম লাগছে, বল?”
তুরাগ বিরক্ত হয়ে বলে,
“তুই এখন সেজে গুজে বসে আছিস কেন! যাবার এখনো চার ঘণ্টা দেরি আছে।”
আফরান যেন আকাশ থেকে পড়ল,
“কি বলিস! এখনো চার ঘণ্টা?”
“হ্যাঁ।”
“না না আমি বিশ্বাস করি না। এখনই চল। একটু আগে গেলে কি হবে?”
তুরাগ ফের শুয়ে পড়ে বলল,
“এটাকে একটু আগে বলে না। নাটক না করে ঘরে গিয়ে ঘুম দে।”
একটু থেমে চোখ চিপে বলল,
“নাহলে কিন্তু রাত জাগতে পারবি না। যা, ঘরে যা।”
আফরান ভেবে দেখল তুরাগের কথাই ঠিক। উত্তেজনায় ঘুম হয়নি ঠিক মতো। একটা ঘুম না দিলে অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। সে কিছুতেই আজকের রাত ঘুমিয়ে কাটাতে চায় না। পুরো রাত জাগবে এবং সাথে বউকেও জাগিয়ে রাখবে। ভাবতে কি যে ভালো লাগল! সে সুরসুর করে রুমে গিয়ে শেরোয়ানি খুলে শুয়ে পড়ল। ভাবল কখন যে চারটা ঘন্টা পার হবে?
–
খুব শীঘ্রই যাওয়ার সময় ঘনিয়ে এলো। নিজে দায়িত্ব নিয়ে সিনথিয়া দুই ভাইকে সাজিয়ে দিল। অতঃপর বলল,
“বাহ্! খুব সুন্দর লাগছে আমার ভাইদের। নজর না লাগে।”
আফরান মুচড়িয়ে উঠে বলল,
“কখন যাব, আপু? চল না যাই।”
“শুরু হয়ে গেল! আপু তুই জানিস? চার ঘন্টা আগে থেকেই ও লাফাচ্ছে। বলে ‘চল এখন যাই, একটু আগে গেলে কিছু হবে না’। আমি বুঝিয়ে সুঝিয়ে রুমে পাঠালাম।”
সিনথিয়া হেসে ফেলল। ভাইয়ের মাথার পাগড়ি ঠিক করে দিয়ে বলল,
“আর একটু ধৈর্য ধরতে হবে, ভাই। জানিস তো? সবুরে মেওয়া ফলে।”
আফরান ভালো ছেলের মতো মেনে নিল। আর একটু অপেক্ষা তারপর! তারপর দৃষ্টি তার সামনে। আজ বউ সাজে তাকে খুব ভালো করে দেখবে। চোখ একটুও সরাবে না। ধৈর্যের ফল সে খুব ভালো ভাবেই বুঝে নেবে।
তাদের রিসিভসনের জন্য বিরাট একটা কমিউনিটি সেন্টার ঠিক করা হয়েছে। তাদের সবার পরিবারের ও নিজেদের আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধব সবাইকে জানানো হয়েছে। আর এতো লোকের জন্য একটা বড় জায়গা তো লাগবেই। দুই পরিবারের তিন ছেলের রিসিভসনের আয়োজন বড় ধুমধামের সাথে করা হচ্ছে। চোখে তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতো আয়োজন।
তিন ভাই একসাথে গেটের সামনে দাঁড়াল। গেট আগলে দাঁড়িয়ে আছে ফারনাজ, দৃষ্টি ও পায়েলের কিছু বন্ধু বান্ধবী। মিষ্টি মুখ করিয়ে তারা বড় আকারের অ্যামাউন্ট দাবি করেছে। সব থেকে বড় কথা সিনথিয়া এসেই রূপ বদলে ফেলেছে। সে বর পক্ষ থেকে ইউ টার্ন নিয়ে কনে পক্ষ হয়ে গেছে। আফরান আহত দৃষ্টিতে চেয়ে বলল,
“তুই এভাবে পল্টি খেলি, আপু? তুই তো বরপক্ষ।”
সিনথিয়া তার কথা হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে বলল,
“আমি তোদের চিনিই না। আমি জন্ম থেকে কনে পক্ষ। তাড়াতাড়ি টাকা বের কর আর ভেতরে আয়। নাহলে সারা রাত ধরে দাঁড়িয়ে থাক। আমাদের কোনো আপত্তি নেই।”
তিন ভাইয়ের কাছে দশ হাজার করে দাবি করা হয়েছে। মোট ত্রিশ হাজার। পাশ থেকে তাদের বন্ধুরা টাকা দিয়ে দিল। আফরান ফের বলল,
“তুই এমন চিটারি করবি আমি ভাবতেও পারিনি।”
সিনথিয়া তার মাথায় গাট্টা মেরে বলল,
“যা ভাগ।”
মাথায় হাত বুলিয়ে মুখ ছোট করে সে প্রবেশ করল। তিনজনকে পাশাপাশি বসানো হলো। বেশ খাতির করা হলো। মিষ্টি, শরবত এই ওই খাওয়ানো হলো। আফরানের মনের মধ্যে কু গায়ছে। শ্যালিকাদের মুখ দেখে সুবিধার মনে হচ্ছে না। নিশ্চয়ই কোনো গভীর ষড়যন্ত্র করছে। তুরাগের হাত চেপে ধরে বলল,
“আমার এসব ভালো লাগছে না। বউদের নিয়ে এলেই তো হয়। এদের মতলব ভালো লাগছে না।”
সেও তাল মিলিয়ে বলল,
“আমারও কেমন লাগছে। সবাই মিটিমিটি হাসছে। কারণ কি হতে পারে?”
কেউই বিশেষ কিছু বুঝতে পারল না। তবে জানা গেল একটু পরই যখন তাদের বউদের সামনে নিয়ে যাওয়া হলো। মাঝে বিরাট পর্দা। ওপাশে তাদের বউ। ছটা ডান হাত পর্দা এপাশে বের করা। সব গুলো হাতেই একই মেহেদীর ডিজাইন। তুরাগ বিরক্ত হয়ে বলল,
“এসব কি আপু? কষ্ট করে এলাম বিয়ে করে চলে যাব। এগুলো কেমন মজা?”
সিনথিয়া তাকে ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দিল,
“তুই চুপ কর। বউ পেতে গেলে এই ধাপ পার করতেই হবে। নিজেরা নিজেদের বউ চিনে নিতে পারলে নিবি। আর যদি চিনতে না পারিস তাহলে বউ তোদের ভাগ্যে নেই ধরে নে।”
সিনথিয়া তাদের বুঝিয়ে দিল। ছটা ডান হাতের মধ্যে তাদের তিনজনের বউয়ের হাত আছে। তাদের তিনজন কে তিনটা হাত বেছে নিতে হবে। যদি বউ চিনে নিতে পারে তো ভালো, নাহলে বাইরে যাবার রাস্তাটাও দেখিয়ে দিল খুব ভালো করে।
আফরান চোখ ছোট ছোট করে চেয়ে বলল,
“এসব ভালো হচ্ছে না কিন্তু, আপু। এর শোধ কিন্তু আমি তুলব।”
সিনথিয়া তার কথাকে পাত্তা দিল না। বরং বলল,
“তাড়াতাড়ি বউ চিনে নিয়ে চল। কাজি বসে আছে।”
তুরাগ শ্বাস ফেলে এগোলো। ফারনাজ কে চিনতে পারবে না সে? তা কীভাবে সম্ভব? ছোঁয়া ছুঁয়ি তো কম হয়নি। তার চুলের গোড়া থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত সবটা চেনা আছে। পর পর দুটো হাত পরখ করে তৃতীয় হাত সে ধরে ফেলল। এটাই তার সম্পদ। প্রেগন্যান্সির জন্য ফারনাজের স্বাস্থ্য ভালো হয়েছে, তাছাড়া সে সম্পূর্ণ নিশ্চিত। বলল,
“এটাই আমার বউ। দ্রুত আমার হাতে দিয়ে দে।”
সিনথিয়া চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে বলল,
“তুই শিয়র?”
“একশো ভাগ।”
হাত ধরে টানতেই সত্যি সত্যি ফারনাজ বেরিয়ে এলো। সকলে বাহবা দিল তাকে। তুরাগ কাউকে পরোয়া না করে টেনে তাকে নিয়ে গেল। ফারনাজ চোখ পাকিয়ে চেয়ে বলল,
“তুমি আমাকে চিনলে কীভাবে?”
সে তার হাতের উল্টো পিঠে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলল,
“কারণ আমি চিনি।”
ফারনাজ লজ্জা পেল। তুরাগ তাকে নিয়ে কাজীর কাছে গেল। বাবাকে বলল,
“বাবা তাড়াতাড়ি শেষ করো এটা। ওর শরীরের উপর অনেক ধকল গিয়েছে। অসুস্থ হয়ে পড়বে শেষে।”
তার কথা শতভাগ ঠিক। তাই সবাই তাদের বিয়েটা পড়িয়ে দিলেন। সবার সম্মুখে তুরাগ পুনরায় কবুল বলে ফারনাজকে নিজের জীবনের সাথে জুড়ে নিল।
চলবে,