#সে_আমারই
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ৪৭
আজ সকালটা রোজকার সকালের মতন নয়। একটু নয়, পুরোটাই অন্যরকম। দৃষ্টি বিছানার সঙ্গে লেপ্টে আছে। পাশেই তাকে আগলে নিয়ে ঘুমিয়ে আছে আফরান। সে হাত বাড়িয়ে তার চুলে আঙুল চালায়। অনুভব করে নড়ার শক্তি খুব কমই আছে। সর্বাঙ্গে চিনচিনে অসহ্য ব্যথা। সকাল তো বেশ হয়েছে। এখনো তাকে কেউ ডাকতে আসেনি। হয়তো ঘুমানোর সুযোগ দিয়েছে। তারা তো আর জানে না রাতভর চোখের পাতা এক করতে দেওয়া হয়নি তাকে। রাত্রির শেষ প্রহর এতো দিনের জমিয়ে রাখা কথা বলতে বলতেই কেটে গেল। তারপর ঘুমিয়েছে লোকটা, কিন্তু সে আর ঘুমাতে পারেনি।
দৃষ্টির মনে হলো তার কাছে কোনো রকম পেইন কিলার নেই। ওটার এই মুহূর্তে বড্ড প্রয়োজন। নাহলে আজ সারাদিন এই বিছানাতেই পড়ে থাকতে হবে। কিছু একটা ভেবে সে পায়েলের নম্বরে ফোন দিল। রিসিভ হতে বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগল।
“কি রে! তুই ওই রুম থেকে আমাকে ফোন করছিস কেন? ডাকলেই তো হতো।”
“নিজের কথা বন্ধ করে আমার কথাটা আগে শোন।”
দুর্বলতা তার কণ্ঠে। সে বলল,
“আচ্ছা বল।”
ভীষণ ইতস্তত করে দৃষ্টি বলল,
“তোর কাছে ব্যথার ওষুধ আছে?”
“হ্যাঁ, আছে তো। কেন?”
“সব কথায় তোর পাল্টা প্রশ্ন না করলে হয় না, না? রাতে কীভাবে শুয়ে ছিলাম জানিনা। এখন আমার ঘাড় ব্যথা করছে। তাই দরকার। এবার খুশি? দিয়ে যা আমার রুমে।”
পায়েল মিনমিন করে বলল,
“আচ্ছা বাবা, আসছি। এতো রেগে যাচ্ছিস কেন?”
সে ফোন রাখার পূর্ব মুহূর্তে মনে পড়ল। লোকটার কোনো জামা কাপড় এখানে নেই। শার্টটা রাতেই ছিঁড়ে এসেছে আর প্যান্ট ভেজা। সে শাওয়ার নিয়ে তোয়ালে জড়িয়েই ঘুমাচ্ছে। কি একটা সমস্যা! তড়িঘড়ি করে বলল,
“ফোন রাখবি না। শোন আমার কথা।”
“বল।”
“ভাইয়ার একটা টিশার্ট আর ট্রাউজার দিয়ে যাস।”
পায়েল ভ্রু কুঁচকে বলল,
“তোর ভাইয়ের জামা কাপড় দিয়ে তুই আবার কি করবি?”
দাঁতে দাঁত চেপে সে বলে,
“আবার প্রশ্ন! তুই কি স্কুলের ম্যাডাম সেজেছিস? শুধু প্রশ্ন আর প্রশ্ন! এতো না বলে নিয়ে আয়। আমি পরব, হয়েছে শান্তি?”
সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। একে তো শরীর খারাপ লাগছে তার উপর পায়েলে এ কেন? তা কেন? হাজারটা প্রশ্ন!
কিছুক্ষণ পর পায়েল দরজায় টোকা দিয়ে ডাকল। দৃষ্টি গায়ে ওড়না জড়িয়ে ধীরে ধীরে বিছানা থেকে নেমে এগিয়ে গেল। দরজা অল্প খুলে হাত বাড়িয়ে দিল। পায়েল তার হাতে জিনিস গুলো দিয়ে বলল,
“ঘাড় খুব ব্যথা করছে? আমি তাহলে তেল মালিশ করে দেই?”
“না, লাগবে না। ওষুধ খেলে ঠিক হয়ে যাবে।”
“খালি পেটে খাবি? ব্রেকফাস্ট করে খাস বরং।”
“রুমে বিস্কিট আছে। তাতেই হয়ে যাবে।”
একটু থেমে তাকে দেখে নিয়ে পায়েল আবার বলে,
“এমন দ্যাখাচ্ছে কেন? ঘুম হয়নি নাকি? কিন্তু তুই তো কাল তাড়াতাড়িই ঘুমিয়ে পড়লি। অন্যরকম লাগছে। আর এতো সকালে শাওয়ারও নিয়ে ফেলেছিস!”
দৃষ্টি অতিষ্ট হয়ে গেল তার জেরায়। রেগে গিয়ে বলল,
“ঘাড় ব্যথা করছে বলে দ্রুত শাওয়ার নিয়েছি। আর এমন দ্যাখাচ্ছে কেন তা তুই বুঝিস না! বিয়ে হয়েছে না তোর? আর ভাইয়ার জামাও তো আমি পরে নাচার জন্য নিয়েছি! গ”র্দভ! পুলিশের মতো জেরা শুধু।”
দরজা ঠাস করে বন্ধ করে দিল। পায়েল কিছুক্ষণ বোকার মত দাঁড়িয়ে রইল। দৃষ্টির কথাগুলো ব্যাখ্যা করতেই সবটা বুঝে ফেলল। নিজেই লজ্জায় পড়ে গেল। আফরান স্যার নিশ্চয়ই আছেন। ফারদিন তো তাকে ঠিকই বলে, সে একটা গ’র্দভ।
রুমে যেতেই ফারদিন তাকে দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেলল। বলল,
“এতো লজ্জা পাচ্ছ কেন? দিনের বেলা তো আমি ভদ্র হয়ে থাকি।”
এই আরেক নির্লজ্জ লোক! কপট রাগ দেখিয়ে বলল,
“আপনি একটা যা তা।”
একটু এগিয়ে গিয়ে বলল,
“দৃষ্টি আমার কাছে আপনার জামা কাপড় চেয়েছিল। স্যার আছেন মনে হয়।”
“হ্যাঁ আছে। তো?”
তার নির্লিপ্ততা দেখে সে হা করে চেয়ে বলল,
“আপনি জানেন!”
উদাম গায়ে শার্ট জড়াতে জড়াতে বলল,
“আমার বোনের সব খবর আমি রাখি।”
সে নিজেই বোনের বরকে ঘরে ঢোকার সুযোগ করে দিয়েছে। আর সে জানবে না?
—
বেশ কিছুক্ষণ ধাক্কা ধাক্কি করে আফরান কে তোলা গেল। ঘুম ঘুম চোখে তাকিয়েছে সে। বিরক্ত হয়ে বলল,
“এতো সকালে ডাকছিস কেন? এখনো সূর্যও ওঠেনি। ঘুমাতে দে।”
“হ্যাঁ, সূর্য তো আপনার জন্য বসে আছে। সকাল আটটা বাজে।”
“এ্যা!”
তড়িৎ গতিতে লাফিয়ে উঠে বসল সে। মাথায় হাত দিয়ে বলল,
“সর্বনাশ! আমার ডিউটির কি হবে? এখন তো রুম ছেড়েও বের হতো পারব না। তোর দ’জ্জাল বাপ দেখলে নিশ্চয়ই গু’লি করে আমার মাথার খুলি উড়িয়ে দেবে। এই দৃষ! তোদের বাড়িতে ব’ন্দুক নেই তো আবার?”
দৃষ্টি অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে কাত হয়ে শুয়ে পড়ল। বলল,
“ফাজলামো সাইডে রেখে চেঞ্জ করে নিন। ভাইয়ার জামা কাপড় আছে দেখুন। তোয়ালে পরে আর কতক্ষন থাকবেন? নাকি এটা পরেই বাইরে বের হবেন?”
আফরানের টনক নড়ল। তবে টি শার্ট গায়ে দেওয়ার আগে দৃষ্টির হাত টেনে ধরল। নিজের দিকে তাকে ফিরিয়ে বলল,
“টিশার্ট পরার আগে দেখে নে আমার কোথায় কি কি করেছিস।”
সে মুখ কুঁচকে ফেলল। শুরু হয়ে গেছে লজ্জাহীন কথা বার্তা। আফরান তাকে বুকের কাছে দাঁতের ছাপ, পিঠে নখের আঁচড় সহ কিছু দাগ দ্যাখাল। ব্যথাতুর মুখ বানিয়ে বলল,
“কত ব্যথা পেয়েছি জানিস? এখনো ব্যথা করছে, জ্বলছে। একটু আদর করে দে তো।”
আসল ব্যাপারটা মুহূর্তেই দৃষ্টি ধরে ফেলল। চোখ রাঙিয়ে বলল,
“আমাকে রাগালে কিন্তু মোটেও ভালো হবে না। ইচ্ছে করেই আমাকে লজ্জায় ফ্যালার ধান্দা, না? বেশি কথা বললে আপনি একদম রুমের বাইরে। বুঝেছেন?”
মুখ ছোট করে সে বলে,
“এমন করিস কেন? আচ্ছা ঠিক আছে। লাগবে না আদর। তুই কিপ্টে হতে পারিস কিন্তু আমি না।”
চোখের পলকে ঝুঁকে দৃষ্টির গলা সহ কাঁধের আশে পাশের মৃদু দাগে ঠোঁট ছুঁইয়ে ফেলল। দৃষ্টি তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বলল,
“ধুর! সরুন তো।”
আফরান মৃদু হেসে গায়ে টিশার্ট জড়িয়ে নিল। ফারদিনের টিশার্ট একটু ছোটই হলো। শরীরে লেপ্টে গেল একেবারে। ট্রাউজার একটু খাটো হয়ে গেল। কি আর করার? ফোন বের করে কল লাগাল কোথাও। রিসিভ হতেই বলল,
“হ্যালো ডক্টর আহমেদ?”
“হ্যাঁ, বলুন।”
“আমি ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজে আটকে পড়েছি। আপনি কি আমার ডিউটির দিকটা হ্যান্ডেল করতে পারবেন? আমার দুটো ক্লাসও ছিল আজ।”
“নো প্রবলেম, ডক্টর ইততেয়াজ। আমি সামলে নেব।”
“থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ। বড় থ্যাঙ্ক ইউ হিসেবে আপনাকে গুড নিউজ খুব শিঘ্রই দেব। রাখছি।”
তার শেষের কথায় মৃন্ময় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। ডক্টর ইততেয়াজও না! মাঝে মধ্যে অদ্ভুত ব্যবহার করেন।
কথা শেষে আফরান আবারও শুয়ে পড়ল। দৃষ্টির গায়ে হাত রাখতেই ঝটকা মেরে সরিয়ে দিল সে। কড়া কণ্ঠে বলল,
“আমার গায়ে হাত দিলে খবর আছে বলে দিলাম।”
কি ব্যাপার বউয়ের গায়ে এমন বিদ্যুৎ কেন? হাত দিতে না দিতেই ঝটকা খেতে হলো। শান্ত সুরে বলল,
“পেইন কিলার নিয়েছিস? নাকি আমি গিয়ে নিয়ে আসব?”
“নিয়েছি। আপনাকে অত ভাবতে হবে না। মুখটা বন্ধ রাখলে খুশি হব।”
“তোর কি ভীষণ ঘুম পাচ্ছে? ঘুমের জন্য মনে হয় তোর মেজাজ ভালো নেই। তার চেয়ে বরং তুই ঘুমিয়ে নে। আমি আর বিরক্ত করব না।”
আফরান বুঝে ফ্যালায় তার ভালো লাগল। তবে অর্ধেক বুঝেছে, পুরোটা নয়। ঘুমের পাশাপাশি শরীর খারাপ তার মেজাজ খারাপ করে দিচ্ছে। পাশ ফিরে তার বুকের মধ্যে ঢুকে গিয়ে বলল,
“সত্যি ঘুমের জন্য আমার মাথা ব্যথা করছে। আমাকে ঘুমাতে না দিলে আমি আপনার নাক ফাটিয়ে ফেলব।”
সে হেসে তার মাথায় অধর ছুঁইয়ে বলল,
“ঘুমিয়ে পড়। একদমই বিরক্ত করব না। নাক ফাটানোর ইচ্ছে নেই। আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। ঘুমালে সব ঠিক হয়ে যাবে।”
চলবে,
#সে_আমারই
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ৪৮
সকাল সকাল ছেলের শশুর বাড়িতে হানা দিলেন আমিনুল ইততেয়াজ। তিনি সকালের নাস্তা করে এসেছেন কিনা সেটা এখনো রহস্য। বাড়ির প্রত্যেকে হতভম্ব, বিস্মিত। বহু বছর পর আজ হঠাৎ আগমনের কারণ কি? মিসেস সীমা তড়িঘড়ি করে চা পরিবেশন করলেন। আমিনুল ইততেয়াজ চুমুক দিয়ে তৃপ্তির হাসি সহিত বললেন,
“চা টা দারুন হয়েছে, সীমা। কত দিন পর তোমার হাতের চা খাচ্ছি, বলো তো!”
মিসেস সীমা একটু হাসেন। ফাহাদ আবরার মুখ গম্ভীর করে বসে আসেন। আমিনুল ইততেয়াজের এমন ব্যবহার তিনি মানতে পারছেন না। বেয়াই মশাই ফের বললেন,
“কিছু মনে কোরো না, সীমা। ফাহাদ কখন বাড়িতে থাকে কি না থাকে, তাই ভেবে আমি সকাল সকাল চলে এলাম।”
“আপনি নাস্তা করে আসেননি, দুলাভাই?”
“না, তা আর সময় পেলাম কই। তুমি বরং নাস্তার ব্যবস্থা করো। আমি ফাহাদের সাথে কথা শেষ করি। তারপর নাস্তা করেই বের হব।”
মিসেস সীমা স্বামীর মুখের দিকে এক পলক চেয়ে চলে গেলেন। ফাহাদ আবরার একটু নড়েচড়ে বসে গলা খাঁকারি দিলেন। বললেন,
“কি এমন জরুরী কথা, যেটা বলতে সকালের নাস্তা না করেই চলে এলেন!”
তিনি হাসেন। রহস্য করে বললেন,
“আমি কেমন শুকিয়ে গিয়েছি, দেখেছ? দশ দিন আগে কেমন দেখেছিলে আর আজ কেমন দেখছ?”
ফাহাদ আবরার পরখ করে দেখলেন, সত্যিই তাকে একটু শুকনো লাগছে। মুখ আগের থেকে শুকিয়ে গেছে।
“খাওয়া দাওয়া করতে পারি না, বুঝলে? মনে হয় যে খাবারে কি যেন নেই। গলা দিয়ে নামেই না। আমি আমার মুখের রুচি তোমার থেকে ফেরত চাইছি।”
তারা বুঝলেন না কিছুই। রামিজ আবরার বললেন,
“সকাল সকাল মশকরা করতে এসেছেন? আপনার মুখের রুচি আমরা ফিরিয়ে দেব মানে কি? মুখের রুচি কি ছিনিয়ে নেওয়ার মতো জিনিস?”
আমিনুল ইততেয়াজ চায়ের শেষ চুমুকটা দিয়ে কাপ রেখে দিলেন। বিষণ্ণ মাখা সুরে বললেন,
“তোমার মেয়ে যখন প্রথম আমাদের বাড়িতে গেল, আমার তখন খুব রাগ হলো। আমি চেয়েছিলাম বিজনেস পার্টনারের মেয়ের সাথে ছেলের বিয়ে দিতে। ভীষণ রেগে ছিলাম মেয়েটার উপর। তবে একদিন কি হলো জানো? অফিসে সেদিন প্রচুর কাজ ছিল। আমরা দুই ভাই সমান ব্যস্ত। দুপুরে খাওয়া হয় কি না হয় ঠিক নেই। এদিকে ক্ষুধার জ্বালায় পেট ডাকে। তিয়াস বলল লোক পাঠিয়ে বাইরে থেকে খাবার কিনে নিয়ে আসতে। আমিও ভাবলাম তাই হোক, এভাবে থাকা সম্ভব না। আর বাইরে গিয়ে খাওয়ার সময়ও নেই। লোক ডাকার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে বাড়ি থেকে একজন গার্ড এলো। সাথে নিয়ে এলো দু দুটো টিফিন বক্স। আমরা তো চমকে গেলাম। বাড়ি থেকে খাবার আসার তো কথা ছিল না। সেসব চিন্তা বাদ দিয়ে খাওয়া শুরু করলাম। খেতে গিয়ে আরো চমকে উঠলাম। অপূর্ব স্বাদ! এমন খাবার শেষ খেয়েছিলাম আমার মায়ের হাতে। এতো ভালো লাগল আমার! আমি তিয়াসের থেকেও একটু নিলাম। তিয়াস তো দিতেই চায়ছিল না। বাড়ি এসে রাতেও সেই ভারী খাবার খেলাম। শেষে কি জানতে পারলাম জানো? তোমার মেয়ে রেঁধেছিল সেগুলো। আমি প্রচন্ড অবাক হলাম। মনে মনে খুশি হলেও বাইরে তা প্রকাশ করলাম না। খুশি হয়ে আমি নিজেই ওকে দোলনা কিনে দিলাম। মেয়েটা এতো খুশি হলো! ছোট ছোট জিনিসে কেউ এতো খুশি হতে পারে তা আমি দেখলাম। প্রায়ই পরোক্ষভাবে ওর হাতের রান্না খেতে চাইতাম। ও বুঝত কিনা জানিনা, তবে যত্ন করে আমার জন্য রান্না করত।”
ফোঁস করে শ্বাস ফ্যালেন তিনি। হাঁপিয়ে উঠেছেন এক নাগাড়ে বলতে গিয়ে। শ্বাস নিয়ে পুনরায় বললেন,
“তোমার মেয়েই আমার রুচির পরিবর্তন করেছে। তাতে আমার কোনো হাত নেই। রূপসী আমার বিজনেস পার্টনারের মেয়ে। তাকে আমি বহু আগে বলেছিলাম আফরানের কথা। হঠাৎ যখন দুজনের দ্যাখা হয়ে গেল রূপসী আফরানের সাথে চলে এলো। আমি ও’কে আসতে বলিনি। এসেই শুরু করে দিল আফরানকে পাবার কীর্তন। আমি কিছু বলতে পারিনি, শুধু তার হ্যাঁ তে হ্যাঁ মিলিয়েছি। এতেও আমার ভুল ছিল। দৃষ্টি সেটা জানতে পেরেই তোমার সাথে চলে এলো। সেদিন যখন আমার সামনেই কাঁদল? বিশ্বাস করো আমার বুকটা ফেটে যাচ্ছিল। বাবা বলে যখন ডাকল তখন মনে হলো খুব আপন কেউ আমাকে ডাকছে। তাও আমি পারিনি ও’কে বাঁধা দিতে। মুখ লুকিয়ে বসে ছিলাম। মানতে পারছিলাম না, অল্প দিনেই একটা মেয়ে আমার অনেক আপন হয়ে গিয়েছে। আমি তাকে মেয়ের চোখেই দেখতে শুরু করেছি। আমার মনে আমার মেয়ের মতোই স্থান তৈরি করেছে ও।”
ফাহাদ আবরার, রামিজ আবরার চুপ করে বসে রইলেন। এখন তারা সবটা বুঝতে পারছেন। সবটাই এখন স্বচ্ছ জলের মতো পরিষ্কার। আমিনুল ইততেয়াজ হঠাৎ ফাহাদ আবরারের দুহাত মুঠোয় ধরে বসলেন। বললেন,
“তোমার মেয়েকে আমি ফেরত চাইছি। আমার ঘরের বউ নয়, মেয়ে করে রাখতে চাই তাকে। আমার পূর্বের সকল ভুল ও অন্যায়ের জন্য আমি লজ্জিত এবং তোমাদের কাছে মাফ চাইছি।”
ফাহাদ আবরার নিজেই লজ্জা পেলেন। বয়সে বড় একটা মানুষ! তার এভাবে মাফ চাওয়া শোভা পায় না। তিনি হাতের উপর হাত রেখে বললেন,
“এভাবে বলবেন না। আপনি আমার বড়।”
“সেসব পরে হবে। তার আগে বলো মেয়েকে ফিরিয়ে দেবে কিনা? আমি কিন্তু আমার মেয়েকে ধুমধাম করে উঠিয়ে নিয়ে যাব।”
ফাহাদ আবরার একটু মোচড়া মুচড়ি করলেন। বুঝতে পেরে আমিনুল ইততেয়াজ বললেন,
“তোমার আফরানের উপর রাগ তো? ঠিক আছে আফরানও মাফ চায়বে। আমি এক্ষুনি ওকে আসতে বলছি।”
তিনি সাথে সাথে ফোন করলেন ছেলেকে। বললেন যেখানেই থাকুক যেন এখনই চলে আসে। আফরান পড়লো বিপাকে, এখন তো রুম থেকেই বের হতে হবে। যাগগে, যা হবার হবে। এখন শশুর কে মানাতে হবে। সে হাত দিয়ে চুলটা একটু ঠিক করে। চশমাটা চোখে দিল। দৃষ্টির গায়ের চাদরটা একটু টেনে দিয়ে বের হলো। সকলের যখন দরজার দিকে নজর তখন আফরান নেমে এলো সিঁড়ি বেয়ে। আমিনুল ইততেয়াজ অবাক না হলেও দুই ভাই চমকালেন। ফাহাদ আবরার উঠে দাঁড়িয়ে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে বললেন,
“তুমি আমার বাড়িতে! কখন এলে?”
আফরান মাথা চুলকে বলল,
“ইয়ে মানে, সেটা বলা কি খুব দরকার? না বললে হয় না শশুর বাবা?”
তিনি দাঁত কটমট করে বললেন,
“দেখেছেন আপনার ছেলের কাণ্ড? চুরি করে আমার বাড়িতে এসে আমারই মেয়ের ঘরে ঘাপটি মে’রে বসে ছিল। আমার কি উচিত আপনার ছেলের কাছে মেয়েকে দেওয়া?”
সে হঠাৎ শশুর কে জাপটে ধরে। হাহাকার করে বলে,
“এমন কথা বলবেন না, শশুর বাবা। আপনার মেয়েকে এভাবে আটকে রাখবেন না। দিয়ে দিন আমাকে। আমি তাকে রানী করে রাখব। কোনো কষ্ট তার পর্যন্ত যেতে দেব না। আমি ও’কে ছাড়া থাকতে পারব না, বিশ্বাস করুন। আর আজ পর্যন্ত সকল বিষয় যেগুলো আপনার খারাপ লেগেছে, সব কিছু জন্য আমি স্যরি। একদম মন থেকে স্যরি।”
ফাহাদ আবরার একেবারে শান্ত হয়ে গেলেন। পিঠ চাপড়ে বললেন,
“ছাড়ো আমাকে। শশুর কে মে’রে ফেলে তার মেয়েকে নিয়ে যেতে চায়ছ নাকি!”
সে দ্রুত তাকে ছেড়ে দেয়। মুখ গোমড়া করে বলে,
“না, আমি চাই শশুর আমার বিয়েতে নাচবে।”
তিনি ধাক্কা খেলেন। চোখ পাকিয়ে বললেন,
“মশকরা করো আমার সাথে?”
তিনি গলা উঁচিয়ে মিসেস সীমাকে ডাকেন। রান্না ঘর থেকে ছুটে আসেন তিনি। বলেন,
“কি হলো?”
আফরানকে দেখে চমকে উঠে বললেন,
“তুই কখন এলি! আর এগুলো তো ফারদিনের জামা কাপড় মনে হচ্ছে। এগুলোই বা কখন পরলি?”
“আহা সীমা! বাদ দাও এসব। তার আগে বেয়াই আর জামাইকে খেতে দাও। সকাল কটা বাজে খেয়াল আছে?”
তিনি ফের রান্না ঘরের দিকে ছুটতে ছুটতে বললেন,
“সব শেষ। এখনই টেবিলে দিয়ে দিচ্ছি। আপনারা আসুন। পায়েল যাও তো ফারদিন আর দৃষ্টিকে ডেকে দাও। বর্ষন আর বন্যাকে এখন ডাকার দরকার নেই। ইচ্ছে মতো আজ ঘুমাক।”
পায়েল তো খুশিতে আটখানা। ছুটে গেল তাদের ডাকতে। শশুরের শান্ত কণ্ঠ শুনে মনে হলো তিনি গলে গিয়েছেন। এবার সে বান্ধবীর দ্বিতীয়বার বিয়েতে খুব নাচবে। আগেরবার তো ভয়ের জন্য হলোই না কিছু। সাজবেও অনেক। হলুদে এক রকম, মেহেদীতে এক রকম আবার বিয়েতে এক রকম। তিন রকম সাজবে। বিশেষ করে তার বরটাকে তাক লাগিয়ে দেবে একদম। সেজেগুজে বশ করে ফেলবে যাতে বকাঝকা একটু কম করে।
চলবে,