সে আমারই পর্ব-১৮+১৯

0
533

#সে_আমারই
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ১৮

সকলের মিষ্টি রোদ। মিষ্টি পাখির কিচিরমিচির শব্দ। মিষ্টি হাওয়া। সব কিছুই মিষ্টি। তবে এই মিষ্টির মধ্যেও ভয়ে জমে আছে পায়েল। ফারদিন কাল তাদের বাড়িতে যেয়ে যে অনর্থ ঘটিয়ে এসেছে এতেই আরও একবার প্রমাণিত হয় যে সে গু’ন্ডা। গু’ন্ডার উপরের গু’ন্ডা। এখন তার বাড়িতে কি আর জায়গা হবে? বড় চাচী তো মে’রেই ফেলবেন। কি দরকার ছিল সবাইকে এমন হুমকি ধামকি দিয়ে তাকে নিয়ে আসা? শুধু শুধু ঝামেলা হলো না?
দৃষ্টি পাশে বসেই তার ওষুধ গুলো দেখে নিচ্ছে। আজ তাকে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। এবং ফারদিন ঘোষণা দিয়েছে তাকে তাদের বাড়িতেই যেতে হবে। যতদিন না সে পুরোপুরি সুস্থ হচ্ছে। এতে দুনিয়া উল্টে গেলে যাক। সব চুলোয় যাক। তবুও তাকে যেতেই হবে। সে অসহায় চোখে দৃষ্টির দিকে তাকাল। মিনমিন করে বলল,

“না গেলে হয় না? আমি নাহয় বাড়িতে চলে যাই? আমি তো এখন সুস্থ।”

দৃষ্টির ভাবলেশহীন কন্ঠস্বর,

“ঠিক আছে। ভাইয়াকে বলে যাস।”

পায়েল চুপসে গেল। এই ভাইয়াটার জন্যই তো যত সমস্যা। কিছু বলতে পারছে না সে চোখ রাঙানি আর গম্ভীরতার ঠ্যালায়। একটু পর ফারদিন কেবিনে প্রবেশ করল,

“বের হতে হবে, দৃষ। সব কাজ শেষ। চল। আর তোর বান্ধবী কি হেঁটে যেতে পারবে? জিজ্ঞেস কর তো।”

ফারদিন তাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করলেই পারত। এভাবে বলার কি আছে? সে মুখ গোমড়া করে জবাব দিল,

“আমি হেঁটে কেন দৌড়ে যেতে পারব, দৃষ। তোর ভাইকে বলে দে।”

“শুনে নিয়েছে।”

পায়েল মুখে বললেও ফারদিন জানে যে সে এখনও যথেষ্ট দুর্বল। হেঁটে যেতে পারবে না। সুতরাং যে দুই মিনিটের মধ্যে হুইলচেয়ার জোগাড় করে নিয়ে ফিরে এলো। পায়েল কিছুতেই বসতে চায়ল না,

“আমার পা খোঁড়া হয়ে যায় নি, দৃষ। হুইলচেয়ারের দরকার নেই।”

কেউ তার কথায় কান দিল না। ফারদিন তার দুই বাহু চেপে ধরে খপ করে উঠিয়ে খপ করে চোখের পলকে বসিয়ে দিল। পায়েলের গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে হলো। এভাবে কেউ ধরে? হাত কি দিয়ে তৈরি? লোহা? ব্যথা লেগেছে তো তার। ছলছল চোখে সে দৃষ্টির দিকে তাকাল। দৃষ্টি তার দিকে না তাকিয়েই হুইলচেয়ার ঠেলে চলল। ফারদিন তাদের পিছে। পায়েল ব্যথাতুর কন্ঠে বলল,

“তোর ভাইয়ের হাত না অন্যকিছু? এভাবে কেউ ধরে? মনে হচ্ছে আমার হাত দুটোই খুলে চলে আসবে।”

দৃষ্টি ব্যতীত ফারদিন তা শুনতে পেল না। হাঁটতে হাঁটতে দৃষ্টি আস্তে করে বলে,

“তুই’ই বলিস আমার ভাই গু’ন্ডা। এখন দ্যাখ গু’ন্ডাদের হাতের শক্তি কেমন? কথা না শুনলে দেবে এক ঘা। তারপর?”

পায়েল শুকনো ঢোক গিলে বলে,

“তারপর?”

“তারপর তুই আবার হাসপাতালের বেডে।”

পায়েল মাথা ঘুরিয়ে পেছন ফারদিন কে একবার দেখে নেয়। যে এক হাতে তার ওষুধপত্র ধরে এক হাত পকেটে পুরে হাঁটছে। মুখে কি দারুণ গম্ভীর্যতা! ফারনাজ কেমন হাসি খুশি সহজ সরল আর তার সম্পূর্ণ বিপরীত ফারদিন। পায়েল কখনও তাকে হাসতে দেখেছে বলে মনে পড়ে না। পায়েল ভেবে পায় না, এই দুটি জমজ কীভাবে হলো? লোকে বিশ্বাস করবে? সে আর কোনো কথা বলল না। চুপচাপ হুইলচেয়ারে বসে রইল।

বাড়ি পৌঁছাতেই মিসেস সীমা এবং মিসেস বিউটি ব্যস্ত হয়ে পড়লেন তাকে নিয়ে। ‘এখন কেমন আছ?’ ‘এসব কীভাবে হলো?’ ‘এখন ভালো লাগছে?’ ‘রেস্ট নেবে একটু?’ ‘কিছু খাও?’ ‘একটু স্যুপ বানিয়ে নিয়ে আসি?’ ইত্যাদি প্রশ্ন করতেই থাকলেন। পায়েল অভিভূত হয়ে দ্যাখে। তার এতো আপনজন থাকতেও কেউ তার খোঁজ খবর কখনও নেয়নি। আর দৃষ্টির পরিবার! এ যেন তারই পরিবার। চোখের কোণে অশ্রু জমে তার, তবে সকলের অলক্ষ্যে না মুছেও নেয়।
রাতে বাড়িতে ফিরে ফাহাদ আবরার এবং রামিজ আবরার ও তার খোঁজ নিলেন। পায়েল বুঝতেই পারল না যে এটা তার পরিবার নয়। সবাই এমন কেন? কই তার বাড়িতে তো এমন ভালো মানুষ নেই। একমাত্র ছোট চাচা ছাড়া। কিন্তু তিনিও তো ছোট চাচীর দাস!

পায়েল চুপচাপ বসে ভাবে। তখনই বিভিন্ন ফলমূল সহ ফলের রস নিয়ে প্রবেশ করেন দুই জা। সেগুলো সব নিয়ে তার সামনে রাখেন। পায়েল চমকে উঠে বলে,

“এসবের কি দরকার ছিল আন্টি? শুধু শুধু আপনারা কষ্ট করে এসব..”

মিসেস সীমা তার পাশে বসেন। মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,

“আমার কোনো এক সন্তান অসুস্থ হলে আমি এমনই করতাম। তুমিও তো আমার আরেকটা সন্তান তাই না? নাজ, দৃষ্টি, বন্যা এরা আমার কাছে যেমন, তুমিও তেমন। এখন খেয়ে নাও তো লক্ষ্মী মেয়ের মতো।”

কথা গুলো পায়েলের হৃদয়ে গভীর ভাবে দাগ কাটে। বাবা মা নেই আজ দশটা বছর। কেউ তাকে এভাবে আদর করে বলে নি ‘খেয়ে নে’। কেউ তাকে বলেনি ‘তুই তো আমার মেয়ের মতোই’। হুট করেই সে তাকে জড়িয়ে ধরে। বুকে মাথা ঠেকিয়ে শব্দ করে কাঁদে। মিসেস সীমা চমকে উঠে পরপরই তাকে আগলে নেন। মিসেস বিউটি দ্রুত এগিয়ে এসে তার মাথায় হাত রাখেন। মিসেস সীমা চিন্তিত কন্ঠে বলেন,

“কি হলো? কষ্ট হচ্ছে কোথাও? বলো? ছোট যা তো ফারদিন কে ডেকে নিয়ে আয়।”

মিসেস বিউটি লম্বা পা ফেলে চলে গেলেন। পায়েল এখনও তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কাঁদে। মিসেস সীমা কি করবেন খুঁজে পান না। মেয়েটা কাঁদছে কেন হঠাৎ?
ফারদিন এসে বাইরে দাঁড়িয়ে দ্যাখে। শান্ত দৃষ্টিতে চেয়ে রয়। মস্তিষ্ক বুঝে নেয় সব। সূক্ষ্ম শ্বাস ফেলে বলে,

“কিচ্ছু হয়নি, ছোট মা। থেমে যাবে নিজেই একটু পর। আর তোমরা দু’জন আজ ও’র সাথে থেকো বরং।”

সে প্রস্থান করে। তার কথা অনুযায়ী পায়েল একটু পরই শান্ত হয়ে এলো। শুকিয়ে এলো চোখের জল। তবে এখনও মিসেস সীমার বক্ষে লেপ্টে রইল। কেমন মা মা গন্ধ আসছে তার শরীর থেকে।
সেদিন ফারদিনের কথানুযায়ী তারা পায়েলের কাছে থেকে গেল। পায়েল কে মাঝে দিয়ে দুজন দুপাশে শুয়ে পড়ল। দৃষ্টি চলে গেল ফারনাজের ঘরে। পায়েলের ঘুমটা খুব ভালো হলো। শরীর মন উভয়ই চাঙ্গা হয়ে উঠল এক রাতেই।

সকালে ডাইনিং টেবিলে বসে আছেন সকলে। বড় চাচী আর ছোট চাচী মুখ গোমড়া করে সব কাজ করছে। পায়েল থাকলে তাকে দিয়েই সব করাত তারা। কিন্তু এখন তাদেরই সব কাজ করতে হচ্ছে। পায়েল কে না দেখেও বড় চাচা কোনো প্রশ্ন করলেন না। তবে ছোট চাচা চুপ থাকতে পারলেন না,

“পায়েল কোথায়? কাল থেকে দেখছি না।”

বড় চাচী মুখ ঝামটা মে’রে বললেন,

“চুপ করো তো ছোট ভাই। নবাবের বেটি, জমিদারের বাচ্চার কোনো খবর আমরা জানি না। আছে কোথাও রঙঢঙ করে বেড়াচ্ছে।”

ছোট চাচা মুখ কালো করলেন। পায়েল খুব প্রিয় ভাতিজি তার। বাপ মা ম’রা অসহায় একটা মেয়ে। তারা ছাড়া তার আর কে আছে? মামা বাড়ির লোকজনও খোঁজ নিল না কোনো দিন। বোন নেই মানে তাদের সব সম্পর্ক শেষ। বড় চাচা বিরক্ত হয়ে বললেন,

“খাবার সময় এসব কথা বাদ দাও তোমরা। ভালো লাগে না।”

দুই ভাই খেয়ে উঠে চলে গেল। ছোট চাচী মুখ বাঁকিয়ে বললেন,

“দরদ দেখলে আর বাঁচি না! এতো দরদ কীসের ওই মেয়ের উপর? দেখলে গা জ্বলে যায়।”

বড় চাচীও তেজ ঝাড়লেন,

“না’গর জুটিয়ে আমাদের সবাইকে হুমকি দ্যাখায়! সাহস কত! ও’কে একবার হাতের মুঠোয় পেয়ে নিই! না’গর জোটানোর সাধ মেটাব।”

সোহেল চুপচাপ বসে গলাধঃকরণ করে যাচ্ছিল। কিছু মনে পড়তেই বড় চাচী জিজ্ঞেস করলেন,

“ওই ছেলেটার ব্যাপারে খোঁজ নিয়েছিস, বাবা? কে ওই ছেলে?”

সোহেল পানি গিলল। মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,

“***ভার্সিটির ছাত্র লীগের নেতা ফারদিন আবরার। মা’র পিটের জন্য জনপ্রিয় বেশ। ভার্সিটির আশে পাশে শুনলাম ফারদিনের নাম শুনলেই ঠক ঠক করে কাঁপে সব। যাদের সে একবার ধরে, আধম’রা না করে ছাড়ে না। ভীষণ নামকরা গু’ন্ডা, সবাই বলে। ‌”

বলতে বলতে সোহেলের কপাল বেয়ে ঘামের রেখা নামে। বড় চাচী এবং ছোট চাচী ঢোক গিললেন। যা দ্যাখার তো দেখেই নিয়েছেন। ফারদিনের হাতে থাকা ভাঙা কাঁচের বোতলের কথা ভাবলেই এখনও তাদের বুক কাঁপে। ওটা যদি পেটে ঢুকিয়ে দিত? গু’ন্ডাদের একদমই বিশ্বাস নেই।

চলবে,

#সে_আমারই
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ১৯

টিফিন ব্রেকে ক্যান্টিনে বসে ছিল দৃষ্টি ও পায়েল। এখানে অনেকেই আছে। আছে কিছু ডাক্তারও। ফ্রি টাইমে এসে বসেছে একটু রেস্ট নেওয়ার এবং চা কফি খাওয়ার উদ্দেশ্যে। দৃষ্টি কফিতে চুমুক দিয়ে বলল,

“তোর বাড়ির কি অবস্থা এখন?”

সেদিনের পর একমাস কে’টে গিয়েছে। পায়েল দৃষ্টির থেকে কিছুই লুকায় না এখন আর। সে ভাবলেশহীন কন্ঠে বলে,

“এখন আমি তাদের কাছে অদৃশ্য। আমাকে কোনো কাজেও ডাকে না। গায়ে হাত তোলা তো একেবারে বন্ধ করে দিয়েছে। সোহেল ভাইও এড়িয়ে চলেন। সামনে পড়লে কোণা চোখে একটু তাকিয়ে চলে যান। আমি আছি নিজের মতো। কথা বলার মানুষ বলতে এক ছোট চাচা আর ছোট চাচার ছোট ছেলেটা।”

দৃষ্টি মৃদু হাসে। পরক্ষণেই পায়েল চোখ কপালে তুলে বলে,

“তোর ভাই এ কি জাদু করল বলতো? আমাকে বাড়িতে রেখে আসার পর থেকেই তারা চুপচাপ আছে। আমি তো ভেবেছিলাম হাতের কাছে পেলে আমাকে মে’রেই ফেলবে।”

দৃষ্টি ভ্রু নাচিয়ে বলে,

“দেখতে হবে না কার ভাই? দৃষ্টির গু’ন্ডা ভাই ফারদিন।”

“সত্যি বলছিস দৃষ? ওরা ভাইয়াকে ভয় পেয়েছে?”

“সত্যি বলছি পায়েল। ভাইয়া যেভাবে তোর ভাইয়ের নাকে ঘু’ষি মে’রেছিল! আর কাঁচের ভাঙা বোতল তোর বড় চাচীর মুখের সামনে ধরেছিল! আমি তো ভেবেছিলাম রেগে সত্যি সত্যিই না পেটে ঢুকিয়ে দেয়! তবে বড় চাচী তোর খোঁজ না দিলে নিশ্চয় ভাইয়া হাত সাফ করে নিত।”

পায়েল ঢোক গেলে এবং ভেবে নেয় তাকে বাড়িতে দিয়ে আসার কথা,

দৃষ্টি দের বাড়িতে গুনে গুনে তিন দিন থাকার পর ফারদিন তাকে বাড়িতে দিয়ে এসেছিল। তাকে দেখে কোনো প্রতিক্রিয়া দ্যাখায়নি তার চাচীরা। উল্টে ফারদিনের থেকে ভালো মন্দ শুনে , চা পানির কথা জিজ্ঞেস করেছিল। পায়েল কেবল হা করে চেয়ে ছিল। ফারদিন সব কিছু মানা করে তাকে গম্ভীর স্বরে “ভালো থেকো। নিজের খেয়াল রেখো” বলেই চলে গিয়েছিল।

“কি রে! ওমন হা করে কি ভাবছিস?”

পায়েল ভাবনার জগৎ থেকে বের হয়। মাথা নাড়িয়ে বলে,

“না, কিছু না।”

হঠাৎ আফরান কে হম্বিতম্বি করে আসতে দ্যাখা যায়। সে তাদের টেবিলের সামনে এসে জোরে শ্বাস নেয়। পায়েল উঠে দাঁড়িয়ে বলে,

“আরে স্যার! বসুন না? আপনাকে চিন্তিত দ্যাখাচ্ছে। কিছু কি হয়েছে?”

“বসা টসা ওসব পরে হবে। দৃষ, চল আমার সাথে। আপনিও চলুন, মিস পায়েল।”

সে দৃষ্টির হাত চেপে ধরে। আফরানের কন্ঠের জোর এতোটাই ছিল যে আশে পাশে সকলের দৃষ্টি তাদের উপর পড়েছে। দৃষ্টি উঠে দাঁড়ায়। ভ্রু কুঁচকে বলে,

“কি হয়েছে আপনার? কোথায় যাব আমরা?”

আফরান ভীষণ উত্তেজিত। ধৈর্যহীন কন্ঠে বলে,

“গেলেই দেখতে পাবি। তাড়াতাড়ি চল।”

সে দৃষ্টির হাত টেনেই এগোলো। পায়েল ছুটল পিছু। দৃষ্টি হতবাক, কলেজের মধ্যে আফরান কখনও তাকে তুই বা দৃষ বলে কথা বলে না। তাহলে কি হয়েছে? গুরুতর কিছু? পথিমধ্যে দ্যাখা হয় মৃন্ময়ের সাথে। সে হা করে কিছু বলতে পারে না। তার আগেই আফরান হাওয়া। মৃন্ময় অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে। দৃষ্টিকে টানতে টানতে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে আফরান?
আফরান আজ বাড়ির গাড়ি এনেছে। দৃষ্টিকে ঠেলে ঢুকিয়ে সে ড্রাইভিং সিটে বসে পড়ল। পায়েল পেছনে বসল। গাড়ি স্টার্ট হতেই সে জিজ্ঞেস করল,

“আমরা কোথায় যাচ্ছি, স্যার? কারো কি কিছু হয়েছে? কোনো রোগীর বাড়িতে যাচ্ছি?”

আফরান জবাব দেয় না। কেবল শ্বাস নেয় ঘন ঘন। দৃষ্টি পাশে বসেই দ্যাখে তার অস্থিরতা। শান্ত মানুষ এমন অশান্ত হয়ে উঠল কেন হঠাৎ?

বেশ কিছুক্ষণ পর গাড়ি থামল। পায়েল মুখ বাড়িয়ে বাইরে তাকাল। কাজী অফিস দেখেই তার চক্ষু চড়কগাছ! আফরান নিজে নেমে টেনে দৃষ্টিকে নামাল। পায়েলও নামল। দৃষ্টি কাজী অফিস দেখে জিজ্ঞাসা সূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,

“আমরা এখানে কেন এলাম, আফরান ভাই?”

“ভেতরে গেলেই বুঝবি।”

শক্ত করে হাত চেপে ধরে সে তাকে ভেতরে নিয়ে যায়। ভেতরে অনেক অপরিচিত মুখ। তার মধ্যে একটাই পরিচিত মুখ দেখতে পেল, সে হলো তূরাগ। তাছাড়া দুজন মেয়ে ও দুজন ছেলে। আফরান একটা টেবিলের সামনে পাশাপাশি দুটো চেয়ারের একটাতে দৃষ্টিকে বসিয়ে অপরটাতে নিজে বসল। বলল,

“দ্রুত কাজ শুরু কর। সময় নেই একদমই।”

বোরখা পরিহিত মেয়েটি এগিয়ে এসে বলে,

“তাড়াতাড়ি বললে কীভাবে হবে আফরান? শাড়িটা পরবে না?”

আফরান বিরক্তিতে মুখ কুঁচকে বলে,

“রাখ তোর শাড়ি। লাল ওড়নাটা মাথায় দিয়ে দে। তাতেই হবে।”

মেয়েটি সূক্ষ্ম শ্বাস ফেলে আফরানের কথা মতো টুকটুকে লাল রঙা ওড়নাটি দৃষ্টির মাথায় সুন্দর করে মেলে দিল। হতভম্ব দৃষ্টি ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইল। কি হচ্ছে এখানে? আফরান ক্ষণে ক্ষণে চেঁচিয়ে ওঠে,

“এই শা’লা কাজী কোথায়? ম’রছে নাকি?”

“আফরান তুই একটু শান্ত হ ভাই। কাজী এক নম্বর সারতে গিয়েছে। চলে আসবে এক্ষুনি।”

দুজন ছেলের মধ্যে একজন বলে। আফরান তেতে ওঠে,

“শা’লার এখনই এক নম্বর পেতে হলো? কিছুক্ষণ পর বলবে আমার দু নম্বর পেয়েছে।”

এসব কথা বার্তায় দৃষ্টির কান গরম হয়ে আসে। এ কাদের পাল্লায় পড়ল সে। ধপ করে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

“কি হচ্ছে এখানে? আফরান ভাই? এখানে কি হচ্ছে? এসব কাজী, লাল ওড়না! কি এগুলো?”

আফরান তার হাত টেনে পুনরায় বসায়। ঝাঁঝালো কন্ঠে বলে,

“মেজাজ আমার ভীষণ চটে আছে, দৃষ। চুপচাপ বসে থাক। আমি যা বলব তাই করবি। বাড়তি একটা কথাও শুনতে চাই না আমি।”

আফরান এক হাতে চুল খামচে ধরে। ইতোমধ্যে ঘেমে খুব বাজে অবস্থা। কিছুক্ষণের মধ্যেই কাজী হাজির হয়। পান খাওয়া লাল দাঁত বের করে হাসে একটু। আফরান দাঁত কিড়মিড় করে বন্ধুদের দিকে তাকায়। তা দেখে তার একজন বন্ধু এগিয়ে বলে,

“কাজী সাহেব! আমাদের আরও কাজ আছে তো নাকি? দয়া করে আপনি শুরু করুন।”

আফরানের শক্ত মুখ দেখে কাজী দ্রুত কাজ শুরু করে।

“কন্যার নাম?”

“দৃষ্টি আবরার।”

“কনের পিতা এবং মাতার নাম?”

“ফাহাদ আবরার, মিসেস সীমা আবরার।”

“বরের নাম?”

“আফরান ইততেয়াজ।”

দৃষ্টি থমকায়। এতক্ষণ সব বুঝতে পারলেও বিশ্বাস হচ্ছিল না তার। আবারও উঠে দাঁড়ানো চেষ্টা করে সে । তবে পারে না, আফরান শক্ত করে হাত চেপে ধরে আছে। তার কোমল হাত যেন ভেঙে যাবে! সে চেঁচিয়ে উঠে বলে,

“এই বিয়ে আমি করব না। আফরান ভাই বন্ধ করুন এসব। মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে আপনার?”

“আমার মাথা আর গরম করিস না দৃষ। চুপচাপ বোস।”

“বললাম তো না। এসব হবে না।”

“দৃষ!”

“এ অন্যায়। ছাড়ুন আমাকে।”

হঠাৎ শব্দে পরিবেশ থমথমে হয়। পায়েল মুখে হাত চেপে ধরে। দৃষ্টি গালে হাত দিয়ে ছলছল চোখে আফরানের দিকে তাকায়। আফরান ভাই! তার আফরান ভাই প্রথমবারের মতো তার গায়ে হাত তুলল। আফরানের চোয়াল শক্ত। তার দুই জন বান্ধবী এসে দৃষ্টিকে আগলে নেয়। আর্তনাদ করে বলে,

“আফরান! পাগল হয়ে গেলি নাকি? মা’রলি কেন মেয়েটাকে? একটু বুঝিয়ে বললেই তো হতো।”

আফরান চেঁচায়,

“বুঝবে না ও। কোনো কিছুই বুঝবে না। আমি যে ম’রে যাচ্ছি তাও বুঝবে না। ছেড়ে দে ও’কে।”

তারা তাকে ছেড়ে সরে দাঁড়ায়। আফরান গম্ভীর কণ্ঠে বলে,

“কাজী সাহেব আপনি শুরু করুন।”

এসব দেখে ভীতু কাজী ভয় পেল। হড়বড়িয়ে সব বলা শেষে বলল,

“রাজি থাকলে বলুন মা কবুল?”

দৃষ্টি শক্ত হয়ে বসে থাকে। কাজী আবারও বলে, তাও দৃষ্টির মুখ ফোটে না। আফরান ধমক দেয়,

“বোবা হয়ে গিয়েছিস? বল কবুল। কবুল বল দৃষ্টি।”

শেষের দিকে কন্ঠ ঠান্ডা হয়ে আসে। দৃষ্টি তার দিকে তাকায়। চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ে এতক্ষণের জমা অশ্রু। আফরানের প্রতি ভীষণ রাগ, ক্ষোভ, অভিমান নিয়ে তিন বার কবুল বলে। আফরানও দ্রুত শেষ করে। শেষে রেজিস্ট্রি পেপারে সই করে। সাক্ষীর জায়গায় সই করে সকলে। বাদ যায় না পায়েলও। সে কাঁপা হাতে সই করে দেয়। এভাবেই দু’জনে পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে গেল ধর্মীয় এবং আইনগত ভাবে একে অপরের সাথে, সারা জীবনের জন্য।

চলবে,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে