#সে_আমারই
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ১৬
বেশ কদিন যাবত কলেজে আসে না পায়েল। ফোনও রিসিভ হয় না। দৃষ্টি চিন্তায় পড়ে আছে। কিছু হলো না তো? সে-ই একমাত্র জানে পায়েলের বাড়ির অবস্থা। উঠতে বসতে তার উপর অত্যা’চার করা হয়। খেতেও দেওয়া হয় না ঠিক মতো। পায়েল বলেই টিকে আছে, সে হলে এতো দিন হয়তো সহ্য করতে না পেরে বাড়ি ছাড়ত।
দৃষ্টি ঠিক করল পায়েলের বাড়ি গিয়ে তার খোঁজ নেবে আর দ্যাখা করে আসবে। ভাবনা অনুযায়ী রেডি হয়ে নিচে নামল। অসময়ে মেয়েকে তৈরি হয়ে বের হতে দেখে মিসেস সীমা জিজ্ঞেস করলেন,
“এই সময়ে কোথায় যাচ্ছিস, দৃষ?”
“মা, আমি একটু পায়েলের বাড়িতে যাব। অনেক দিন হলো কলেজে আসে না। আর ফোনেও পাচ্ছি না।”
“সে কি! মেয়েটা সুস্থ আছে তো? ঠিক আছে যা। তোর ভাইকে সাথে নিয়ে যা। এখন একা যাস না।”
দৃষ্টি ঘাড় কাত করে সম্মতি দেয়। ভাইয়ের রুমে গিয়ে বলে,
“ভাইয়া আমার সাথে চলো তো একটু।”
ফারদিন ল্যাপটপে কিছু করছিল। সে মুখ তুলে বলল,
“কোথায় যাবি?”
“পায়েলের বাড়ি।”
ফারদিন আর কোনো প্রশ্ন না করে ল্যাপটপ বন্ধ করে উঠে দাঁড়ায়। টেবিলের উপর থেকে বাইকের চাবি নিয়ে বলে,
“চল।”
দৃষ্টি অবাক হলো। কোনো জায়গায় যাবার কথা বললে কোথায় যাবি, কেন যাবি, কতক্ষণ লাগবে ইত্যাদি ইত্যাদি প্রশ্ন করে দৃষ্টির মাথা ঘুরিয়ে দেয়। আর আজ! কোনো প্রশ্ন ছাড়াই চল?
পায়েল দের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে দরজায় কড়া নাড়ে দৃষ্টি। কিছুক্ষণ পর দরজা খুলে দেয় এক মধ্য বয়স্ক মহিলা। ইনি পায়েলের বড় চাচী, দৃষ্টি চেনে। মহিলা ভ্রু কুঁচকে বললেন,
“কাকে চায়?”
দৃষ্টি ভদ্রতার খাতিরে সালাম দিল। মহিলা তোয়াক্কা করলেন না। সে নম্র কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
“পায়েল আছে আন্টি? আসলে ও অনেক দিন ধরে কলেজ যাচ্ছে না। আর ফোনও বন্ধ।”
মহিলা তাকে আগাগোড়া পর্যবেক্ষণ করলেন। খড়খড়ে কন্ঠে বললেন,
“কদিন যাচ্ছে না বলে হ্যাং’লার মতো চলে এলে!”
দৃষ্টি ধাক্কা খেল। তবে নিজেকে সামলে নিল দ্রুত। পাশে চোখ রক্তিম হতে থাকা ভাইয়ের হাত চেপে ধরল। নাহলে কি ঘটিয়ে বসবে কে জানে? মহিলা আবারও বললেন,
“পায়েল আর কলেজ যাবে না। তোমরা এবার যেতে পার। নির্লজ্জ কোথাকার!”
মহিলার সরাসরি অপমানে ধপ করে জ্ব’লে উঠল ফারদিন। কপালের রগ দপ দপ করছে তার। হাত মুঠো হয়ে এসেছে নিজের অজান্তেই। দৃষ্টি ভয়ার্ত মুখে ভাইয়ের দিকে তাকাল। ভাইকে না নিয়ে এলেই ভালো হতো। ফারদিন ঠান্ডা অথচ তেজী কন্ঠে বলে,
“পায়েল কোথায়?”
মহিলা ক্ষেপে গেলেন। ওই বাইরের মেয়ের জন্য এতো ঝামেলা তিনি পছন্দ করছেন না। ঝাঁঝালো কন্ঠে বললেন,
“বললাম তো পায়েল আর কলেজ যাবে না। তো আবার কি? চলে যাও। দাঁড়াও দাঁড়াও! তুমি আবার ও’র কোনো না’গর নও তো? বাহ্! কদিন কলেজ গেল কি গেল ন না’গর জুটিয়ে ফেলল। এজন্যই আমি ও’র পড়ালেখা বন্ধ করে দিতে চাচ্ছিলাম।”
ঘৃণায় গা গুলিয়ে উঠল দৃষ্টির। তবে ফারদিন ভয়’ঙ্কর রেগে গেল। মহিলাকে ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করল। দৃষ্টি চেঁচায়,
“ভাইয়া!”
ফারদিন হাত উঁচিয়ে তাকে থামায়। হুংকার দিয়ে ওঠে,
“আপনি গুরুজন বলে এতোক্ষণ সহ্য করেছি। আমার ধৈর্য শক্তি খুব কম। ভালোই ভালোই বলে দিন পায়েল কোথায়?”
মহিলা চেঁচিয়ে বাড়ির লোক এক জায়গায় করলেন। ছোট চাচী বললেন,
“কি হয়েছে?”
“আরে দ্যাখ! এই বেয়াদব ছেলে আমাকে ধাক্কা মে’রে বাড়িতে ঢুকে পড়েছে।”
ফারদিন চোখ লাল করে প্রত্যেক কে দ্যাখে। একে তো বোনকে আজে বাজে কথা বলেছে, তার উপর পায়েল কে নিয়ে তার সাথে! সোহেল বাড়িতেই ছিল। ফারদিন কে দেখে এগিয়ে বলে,
“এই কে তুই? আমার মায়ের গায়ে হাত দিয়েছিস! এতো বড় সাহস তোর!”
সে এগিয়ে মা’রতে যায়। ফারদিন উল্টো তাকে ধরে নাকে এক ঘু’ষি দেয়। পিছিয়ে যায় সে। ব্যথায় কুঁকড়ে উঠে নাক চেপে ধরে। বড় চাচী আর্তনাদ করেন,
“মেরে ফেলল গো! আমার কলিজার টুকরা কে মেরে ফেলল।”
অবস্থা বেগতিক। ফারদিন ডাইনিং টেবিলের উপর পানি ভর্তি কাঁচের বোতল দেখতে পায়। তা হাতে নিয়ে টেবিলে এক ঘায়ে ভাঙে। ভাঙা বোতল উঠিয়ে একবার তাক করে বড় চাচীর দিকে, তো একবার সোহেলের দিকে। শান্ত কন্ঠে বলে,
“পায়েল কোথায়? আমি আবারও জিজ্ঞেস করছি পায়েল কোথায়?”
ভয় থরথর করে কাঁপে মহিলা। এ ছেলে সুবিধের নয়, তা তিনি বুঝেছেন। ছোট চাচীও এক কোণে চলে গেলেন। বাড়িতে সোহেল ছাড়া আর কোনো পুরুষ মানুষ নেই। কিন্তু এই ছেলে তো সোহেলকেই কাত করে দিল। বড় চাচী কাঁপতে কাঁপতে বললেন,
“উ উপরে। উপরের ঘরে আছে।”
ফারদিন হুকুম দেয়,
“দৃষ! উপরে যা।”
দৃষ্টি দেরি করে না। ছুটে যায়। পায়েলের রুম বাইরে থেকে লক করা। সে দ্রুত দরজা খুলে প্রবেশ করে। বিছানায় অচেতন অবস্থায় প্রিয় বান্ধবী কে পড়ে থাকতে দেখে তার বুক কেঁপে ওঠে। ছুটে গিয়ে মাথার কাছে বসে। গালে হাত দিয়ে ডাকে,
“পায়েল! এই পায়েল!”
পায়েল চোখ মেলে না। দৃষ্টি খেয়াল করে হাতে পায়ে অসংখ্য দাগ। মুখে দাগ, ঠোঁটের কোণে কাঁ’টা। মুখটা বর্ণহীন, র’ক্তহীন। সে বাইরে যায়।
“ভাইয়া! পায়েল! তুমি তাড়াতাড়ি উপরে এসো।”
ফারদিন চোখ রাঙিয়ে সকলকে শাসায়। বলে,
“কেউ এক পাও নড়বে না এখান থেকে।”
ভয় গাট হয়ে সকলে দাঁড়িয়ে থাকে। এ কোন গু’ন্ডার কবলে পড়ল তারা?
ফারদিন রুমে এসে পায়েলের বিধ্বস্ত অবস্থা দ্যাখে। পালস রেট মেপে দ্যাখে খুবই ধীরে চলছে তা। সে তাকে পাঁজাকোলা করে তুলে নেয়,
“ইমিডিয়েটলি হাসপাতালে নিতে হবে। চল।”
দৃষ্টি ভাইয়ের পেছনে পেছনে ছোটে। ফারদিন বাড়ি থেকে বের হবার আগে সকলের চেহারা থেকে দৃষ্টি আরও একবার ঘুরিয়ে নেয়,
“পায়েলের কিছু হয়ে গেলে আমি কাউকে ছাড়ব না। চৌদ্দ শিকের পেছনে পাঠিয়ে তবেই ছাড়ব। মাইন্ড ইট।”
তারা চলে গেল। বড় চাচী আটকে রাখা শ্বাস ছাড়লেন। ক্রুদ্ধ কন্ঠে বললেন,
“কে এই ছেলে? পায়েলের কি হয়? এতো দরদ কীসের?”
সোহেল নাক চেপে ধরে দাঁড়িয়ে আছে এখনও। মায়ের কথায় দাঁত চেপে বলে,
“খোঁজ নিতে হবে।”
পরক্ষণেই বড় চাচী গদগদ কন্ঠে বললেন,
“আমার ছেলেটার কি অবস্থা করে দিয়ে গেল! ভালো হবে না ওই মেয়ের, দেখে নিস। চল বাবা তোর নাকে ওষুধ লাগিয়ে দেই।”
—
হাসপাতালের শুভ্র বিছানায় শুয়ে আছে পায়েল। সেলাইন দেওয়া হয়েছে তাকে। কলেজের হাসপাতালেই আছে সে। তীব্র ফিনাইলের গন্ধে অসহ্য লাগছে। শুয়ে থাকতেও ভালো লাগছে না। অথচ তাকে একটু নড়তেও দেওয়া হচ্ছে না। দৃষ্টি তার পাশেই বসে আছে। ফারদিন বাইরে গিয়েছে। পায়েল তার দিকে করুণ দৃষ্টিতে চেয়ে বলল,
“আমার আর শুয়ে থাকতে ভালো লাগছে না, দৃষ। উঠি একটু? ট্রাস্ট মি তোর গু’ন্ডা ভাই আসার আগেই আবার শুয়ে পড়ব।”
দৃষ্টি চোখ পাকিয়ে তাকায়। হাজার টা প্রশ্ন করেও উত্তর পায় নি যে পায়েলের এই অবস্থা কি করে হলো? মেজাজ চটে আছে তার। দৃষ্টি কিছু বলার আগেই গম্ভীর কন্ঠস্বর শোনা গেল,
“একটু নড়লেই তোমার হাড্ডি ভেঙে আবার ভর্তি করব। ইউ নো না? আমি একজন গু’ন্ডা।”
পায়েল থতমত খায়। ফারদিন কে চেনা থেকেই তাকে গু’ন্ডা বলে সম্বোধন করে আসছে সে। যে তেজ, যে রাগ! আর যে মা’রপিট করতে দেখেছে, তাতে এই নামটাই তার মানানসই লেগেছে। সে মুখ ঘুরিয়ে নিল। এভাবে ধরা পড়ে যাবে ভাবেনি। ফারদিন আফরান কে সাথে করে নিয়ে এসেছে। আফরানই পায়েলের চিকিৎসা করছে। আফরান তার প্রেশার মেপে, পালস রেট চেক করল। বলল,
“প্রেশার অনেকটা লো। তবে এখন ঠিক আছে। আপনি কদিন ধরে খান না, মিস পায়েল? আপনার মতো দুর্দান্ত স্টুডেন্ট এভাবে অসুস্থ হয়ে পড়া মানায় না। আর হাতে পায়ের দাগ গুলো কীসের? শুনলাম পিঠেও দাগ আছে। আপনি কি জানেন? ঠিক সময়ে আপনাকে হাসপাতালে না নিয়ে এলে কিছু হয়ে যেতে পারত? ইজ এনিথিং রং?”
চলবে,
#সে_আমারই
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ১৭
পায়েল মুখে কুলুপ এঁটে শুয়ে আছে। পারিবারিক বিষয় নিয়ে কি বলবে সে? খামোখা কেন সে এতো লোকের চিন্তার কারণ হবে? অতএব সে চুপ করেই রইল। আফরান সূক্ষ্ম শ্বাস ফেলে বলল,
“ওকে ফাইন। আপনাকে কিচ্ছু বলতে হবে না। আজ রাতটা এখানেই থাকতে হবে। আগামীকাল রিলিজ পাবেন।”
পায়েল বলতে চায়ল,
“কিন্তু স্যার..”
“থাকবে ভাই। শুধু আজ রাত কেন দরকার পড়লে হাসপাতালেই পুরোপুরি শিফট করে দেব। থাকবে সারাজীবন।”
কথার মধ্যে ফারদিনের কড়া কন্ঠে চুপসে গেল সে। আর কিছু বলার সাহস পেল না। সে এখনও জানে না বাড়িতে কি হয়েছে? সে কীভাবে এখানে পৌঁছাল? আফরান বেরিয়ে গেল। সাথে ফারদিন প্রেসক্রিপশন নিয়ে বের হলো। ওষুধ কিনতে হবে। সাথে রাতের খাবারটা ও। আবার বাড়িতেও জানিয়ে দিতে হবে দৃষ্টির হাসপাতালে থাকার বিষয়টা।
তারা চলে গেলে পায়েল দৃষ্টির দিকে তাকায়। দুর্বল কন্ঠে বলে,
“বল না? আমাকে কীভাবে নিয়ে এলি?”
দৃষ্টি মুখ কুঁচকে বলল,
“তুই কি বলেছিস যে তোর এই অবস্থা কীভাবে হলো? তাহলে আমি বলব কেন? আমি তো তোর কেউ না। আমাকে বলতে যাবি কেন?”
শেষে তার কন্ঠ হতে অভিমান ঝরে পড়ে। পায়েল কাতর কন্ঠে বলে,
“তুই ছাড়া আমার আর আপন কেউ নেই রে, দৃষ। আমার আপন মানুষও আমার আপন নয়।”
চোখে অশ্রু জমে তার। ঢোক গিলে বলা শুরু করে,
“ভাইয়া যেদিন আমাকে বাঁচিয়ে ছিল সেদিন ভাইয়ার একটা শার্ট আমার কাছে থেকে গিয়েছিল। আমি সেটা যত্ন করে লুকিয়ে রেখেছিলাম। ভেবেছিলাম পরে সুযোগ বুঝে ফিরিয়ে দেব। জানতাম যে এই শার্ট কারো চোখে পড়লে কেলে’ঙ্কারি হবে। যে ভয়টা পাচ্ছিলাম সেটাই হলো। সোহেল ভাই নানা রকম কথা বলে বড় চাচীর কান ভাঙালেন। আমার বাইরে কোনো ছেলের সাথে সম্পর্ক আছে, আমি তাদের না থাকার সুযোগ নিয়ে বাড়িতে ছেলে নিয়ে আসি ইত্যাদি। বড় চাচী রেগে গেলেন খুব। আমার ঘরে এসে ঘর ওলোটপালোট করে হন্যে হয়ে প্রমাণ খুঁজলেন। পেয়েও গেলেন ভাইয়ার শার্ট। বরাবরের মতোই গায়ে হাত তুললেন। মুখের তিক্ত কথা দিয়ে অন্তর জ্বালিয়ে দিলেন, বাবা মা তুলে কথা বললেন। আমি সহ্য করতে পারলাম না। মুখের উপর বলে দিলাম কয়েকটা কথা। এতে আরও রেগে গেলেন। উনুন থেকে জলন্ত কাঠ নিয়ে এসে মা’রলেন। জানিস দৃষ? কেউ এগিয়ে আসেনি আমাকে বাঁচাতে। সকলে দাঁড়িয়ে মজা দেখছিল এবং আরও উস্কে দিচ্ছিল। ছোট চাচা বাড়িতে ছিলেন না। মা’রতে মা’রতে হাঁপিয়ে গিয়ে মা’রা থামিয়ে ছিলেন। তারপর ঘর বন্ধ করে রাখলেন। ম’রার মতো পড়ে থাকলাম। নড়ার শক্তি প্রর্যন্ত ছিল না। ম’রে আছি কি বেঁচে আছি কেউ আসেনি খোঁজ নিতে। কখন যে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম জানি না। ছোট চাচা কেও চাচী আসতে দেননি। খুব করে চাইছিলাম আমি ম’রে যাই। বাবা মায়ের কাছে চলে যাই। আর পারছি না আমি।”
দৃষ্টি ফুঁপিয়ে উঠল। জাপ্টে ধরল তাকে। তবে পায়েলের চোখের কোণে জল মুখে হাসি। দৃষ্টি ভেজা কন্ঠে বলে,
“তুই এতো কিছু সহ্য করেছিস! আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। খুব কষ্ট হচ্ছে।”
পায়েল হাসে। এই মেয়েটি তার কষ্টে কষ্ট পায়। তাই তো পায়েলের একমাত্র আপন জন এই মেয়েটি। দৃষ্টির মাথায় হাত রেখে বলে,
“কাঁদিস না, দৃষ। এসব আমার সহ্য হয়ে গিয়েছে। যত দিন বাঁচব তত দিন তো সহ্য করতেই হবে। ম’রে গেলে তো সব শেষ।”
দৃষ্টি চুপ করে তাকে জড়িয়ে ধরে থাকে। কেন এতো কষ্ট পায়েলের? কেউ কি আসবে না ও’কে এই নরক থেকে বের করতে?
ফারদিন নীরবে দরজা থেকে সরে গেল। সে এসেছিল তারা কি খাবে সেটা শুনতে। তবে পথিমধ্যে পায়েলের কন্ঠ শুনে তার পা জোড়া থেমে গিয়েছিল। পায়েলের প্রতিটা কথা শুনে ক্ষণে ক্ষণে র’ক্ত ছলকে উঠছিল তার। দ্রুত পায়ে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে গেল। এখন একটা সিগারেট দরকার।
—
আজ দৃষ্টি হাসপাতালে আছে। আর রাতটাও এখানে থাকবে। দৃষ্টির সাথে টাইম পাসের ভালো একটা সুযোগ পাওয়া যাবে, ভাবটাও জমানো যাবে। তা ভেবে মৃন্ময় আজ নাইট ডিউটি তে থাকতে চায়ল। আফরানের কাছে গিয়ে বলল,
“ডক্টর ইততেয়াজ, আজ আমি ডিউটিতে থাকি। আপনি বাড়িতে যান।”
“সেটা কি করে হয়, ডক্টর আহমেদ? আপনি এক টানা এতো দিন নাইট ডিউটি করলেন। আমিই রেস্ট নিলাম। তারপর আবারও যদি আপনি আজ নাইট ডিউটি নেন তাহলে আমার ভীষণ খারাপ লাগবে। ভীষণ গিল্টি ফিল করব আমি।”
কন্ঠ হতে তার ঝর ঝর করে মধু ঝরে পড়ল। মৃন্ময় মৃদু হেসে বলে,
“ইটস্ ওকে, ডক্টর ইততেয়াজ। আপনি নাহয় আগামীকাল থেকে ডিউটি করবেন। আজ দিনটা আমি থেকে যাই।”
আফরান তীব্র বিরোধিতা করে বলল,
“এটা হয় না। আজ আমিই ডিউটি করব আর আপনি রেস্ট নেবেন। বিবেক বলে তো আমার কিছু আছে, নাকি? প্লিজ ডক্টর আহমেদ আপনি আজ বাড়িতে যান।”
আফরানের সাথে পেরে উঠল না মৃন্ময়। সে বাধ্য হয়ে বাড়িতে চলে গেল। তার প্রস্থানের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল আফরান। মৃন্ময় কি মনে করেছে? সে কিছু জানে না? দৃষ্টির সাথে ভাব জমানোর জন্য আজ হাসপাতালে থাকতে চায়ছে তা আফরান খুব ভালো করেই বুঝেছে। আফরানের ব্যক্তিগত সম্পদের দিকে তাকাবে আর সে মেনে নেবে? কক্ষনো না।
—
“হ্যাঁ, হ্যালো দৃষ? পায়েলের কি অবস্থা এখন?”
“ভালো, মা।”
“যাক আলহামদুলিল্লাহ। যখন থেকে ফারদিনের কাছে শুনলাম তখন থেকেই মেয়েটাকে নিয়ে চিন্তা হচ্ছিল। কি করছে এখন?”
দৃষ্টি এক পলক পায়েলের দিকে তাকাল। ক্লান্ত দ্যাখাচ্ছে তাকে।
“ঘুমিয়ে পড়েছে।”
“আচ্ছা বেশ। থাকতে পারবি? নাকি আমি বা নাজ আসব?”
“পারব মা। তাছাড়া ভাইয়া তো আছেই। তোমরা আর চিন্তা করো না।”
আরও কিছু কথা বার্তা বলে ফোন রাখল সে। দীর্ঘশ্বাস ফেলল কি ফেলল না বলিষ্ঠ দু হাত তাকে পেছন থেকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরল। হকচকিয়ে গেল সে। হৃদপিণ্ড কেঁপে উঠল। পরক্ষণেই পরিচিত সুগন্ধি টের পেতেই শান্ত হলো। শক্ত কন্ঠে বলল,
“আমি আপনার গার্লফ্রেন্ড কিংবা বউ নই যে এভাবে হুটহাট জড়িয়ে ধরবেন!”
আফরান দৃষ্টির কাঁধে থুতনি ঠেকায়। ফিসফিসিয়ে বলে,
“হতে কতক্ষণ?”
দৃষ্টি কেঁপে ওঠে। কি ছিল কন্ঠটায়? যা তাকে কাঁপিয়ে দিল? সে তাকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে বলে,
“এখানে পায়েল আছে। আর যেকোনো সময় ভাইয়া চলে আসতে পারে।”
“তবে কি তুই চাচ্ছিস যে আমি কোনো নিরিবিলি জায়গায় তোকে জড়িয়ে ধরি?”
কন্ঠে তার দুষ্টুমি। দৃষ্টি মেকি রাগ দেখিয়ে বলে,
“দেখুন, একদম মশকরা করবেন না।”
“ঠিক আছে। পায়েল ঘুমের মেডিসিনে ঘুমোচ্ছে আর ফারদিন কে আমি আমার কেবিনে একটু রেস্ট নিতে রেখে এসেছি। কোনো চাপ নেই। এবার একটু আমাকে শান্তি দে।”
দৃষ্টি চুপচাপ পড়ে রইল তার বন্ধনে। আফরান একই ভাবে তাকে জড়িয়ে রাখে। বুকের মধ্যে অদ্ভুত শান্তি অনুভব হয়। কিছুক্ষণ পর দৃষ্টি জিজ্ঞেস করে,
“আপনার আর কোনো কাজ নেই? এখানে এভাবেই থাকতে হবে?”
“রাখ তোর কাজ। তোর থেকে কাজ বড় হলো নাকি?”
পরক্ষনেই আঙুল আকাশের দিকে তাক করে বলে,
“দ্যাখ দৃষ! এক ফালি চাঁদ কি সুন্দর দ্যাখাচ্ছে তাই না? আর ওই যে দেখছিস একদম পাশাপাশি, কাছাকাছি যে তারা দুটো আছে একটা ছোট একটা বড়! ওগুলো কারা জানিস?”
দৃষ্টি দ্যাখে। সত্যিই খুব সুন্দর দ্যাখাচ্ছে নক্ষত্র সজ্জিত কৃষ্ণবর্ণের গগণ। আফরান তার কানের নিকট মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে,
“ওটা তুই আর ওটা আমি।”
আফরান পুনরায় আঙুল তাক করে দ্যাখায়। দৃষ্টির দেহ শিরশির করে। তবে সে নড়ে না একটুও। এক দৃষ্টিতে চেয়ে রয়। নক্ষত্র তো সব সময় এক জায়গায় থাকে না। আজ কাছাকাছি আছে তো কাল দূরে। ওই দুটো যদি সে এবং আফরান হয় তবে তো বিচ্ছেদ নিশ্চিত। আফরান কি তার থেকে দূরে চলে যাবে? নাকি সে আফরানের থেকে?
চলবে,