সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্টের উপর আমাদের অনেকেরই ট্রেনিং নেই। অ্যামেরিকায় যেকোন প্রতিষ্ঠানে কাজ শুরু করার প্রথম দিকেই কিছু অবশ্যম্ভাবী ট্রেনিংয়ের একটি হচ্ছে এই সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট ট্রেনিং। একেক কোম্পানি একেকভাবে ট্রেনিং দেয়, কিন্তু সবারই মূল বক্তব্য এক – অফিসে যদি কেউ কখনও কারও উপর যৌন নির্যাতন চালায়, তখন কিভাবে সিচুয়েশন হ্যান্ডল করতে হবে, তা নিয়েই আলোচনা।
এই ট্রেনিংয়ের ফলে আমরা জানতে পারি সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট নানান প্রকারের হতে পারে। কোন মেয়ের গায়ে হাত দেয়া, টেবিলের নিচে দিয়ে পা ঠুকা থেকে শুরু করে একই ঘরে একজন নারীর উপস্থিতিতে দুই পুরুষের অশ্লীল কথাবার্তা পর্যন্ত সবকিছুই এর আওতায় পড়ে। কোন নারী/পুরুষকে নিয়ে অশালীন মন্তব্য তাই ধর্ষণের সামিল। এরা এই ব্যপারে খুবই সিরিয়াস!
প্রমোশনের প্রলোভন অথবা চাকরি কেড়ে নেয়ার ভয় দেখিয়ে বসের সাথে ডেটিংয়ে যাওয়ার প্রস্তাবনা আমাদের দেশে খুবই কমন। এই দেশের বস এই কাম করলে এইচ.আর (হিউম্যান রিসোর্স) এক্কেবারে ‘চাঙ্গে’ তুলে দিবে। এইসব আশ্বাস এই ট্রেনিংই দেয়।
আমাদের অফিসের ট্রেনিংয়ে একটা সীন ছিল এরকম।
ধর তোমার নাম টম এবং একদিন কাজ থেকে বেরোতে তোমার অনেক দেরী হয়ে গেছে। তুমি বেরুতে গিয়ে দেখ তোমার বস হেলেন ঘরের দরজা লাগিয়ে তোমাকে বলল “এসো।”
তখন তুমি কী করবে?
বাস্তবের ছেলেরা কী করবে সেটা বাদ দিয়ে আমরা যাই ট্রেনিং কী বলে। ট্রেনিং অন্তত বলে যে, এই পরিস্থিতিতে বসকে বলতে হবে, “আমি দুঃখিত, তোমার সাথে এই সম্পর্ক স্থাপনে আমি অপারগ। তুমি যদি আমাকে ছেড়ে না দাও, এবং শুধরে না যাও, তবে আমি এইচ.আরকে নালিশ করবো।”
বাংলাদেশের এক অতি বিখ্যাত একটি মাল্টিন্যাশনালে দুইবছর কাজ করার সৌভাগ্য(!!) আমার বউয়ের হয়েছিল। তাঁর কিছু অভিজ্ঞতা এখানে বলা যাক। আমি নিশ্চিত, বাংলাদেশে অফিসে কাজ করেন, এমন হাজারটা মেয়ের সাথে গল্পগুলো মিলে যাবে।
তিন্নির কিছু কলিগ ছিল দুর্দান্ত বদমাইশ। একজনের নাম ছিল, ধরা যাক, শাহীন। বিবাহিত। প্রেমের বিয়ে। স্ত্রী সুন্দরী এবং তখন অন্তঃসত্বা ছিলেন।
সেই বদ, অফিসের যে কোন মেয়ের সাথেই ফ্লার্ট করে বেড়াতো। খুব গর্বের সাথে বলে বেড়াতো শহরের অনেক মেয়ের সাথেই সে বিছানায় গিয়েছে। কর্পোরেট প্রষ্টিটিউটরা তার নখ দর্পণে।
অফিসের অনেক মেয়েই তার সাথে হ্যাংলামি করতো। লাঞ্চে যেত, লং ড্রাইভে যেত এবং জানিনা আর কী কী করতো। এসব তারা কেন করতো সেটা সেসব মেয়েরাই ভাল বলতে পারবে। নিজেদের শস্তায় বিক্রি করলে কার কিই বা বলার থাকে?
তো এই ভদ্রলোক(!?) তিন্নিকে প্রায় প্রতিদিন তার সাথে লাঞ্চে যেতে বলতো। বলতো অফিস শেষে তাকে বাড়িতে নামিয়ে দেয়ার কথা। তিন্নি বিনয়ের সাথেই প্রতিবার তাকে ফিরিয়ে দিয়েছে। তারপরে একদিন সে সরাসরিই বলেছে, “আপনার বাসায় স্ত্রী আছে শাহীন ভাই।”
সে দাঁত কেলিয়ে বলেছে, “ও জানবেই না।”
তিন্নি খুবই মেজাজ খারাপ করলো এবং বলল, “আমি ম্যারেড। আমার স্বামী অন্তত খুব রাগ করবে।”
সে তখন আরেকটু দন্ত বিকশিত করে বলল, “তোমার স্বামীকেই বা জানাবার দরকার কী?”
সে এইচ.আরকে জানালো যে এই যন্ত্রণা সহ্য হচ্ছে না।
এইচ.আর তাকে বলল, “আপনি কোন প্রমাণ দেখাতে পারবেন?”
“প্রমাণ বলতে কী প্রমাণ চাইছেন?”
“লিখিত প্রমাণ।”
তিন্নি লিখিত প্রমাণ দেখালো। সেখানে অফিস ইনস্ট্যান্ট ম্যাসেঞ্জারে ছেলেটা যে তার সাথে ফ্লার্ট করছে সেই প্রমাণ একদম স্পষ্ট।
এইচ.আর তখন বাঙ্গালি সমাজের চিরায়ত ডায়লগখানা পুনঃ ডেলিভারি দিল, “এত মানুষ থাকতে আপনার সাথেই কেন সে ফ্লার্ট করছে? আপনি কী করেছেন?”
তিন্নি বলল, “সবার সাথেই করে। আমি কমপ্লেইন করছি।”
এইচ.আর তখন বলল, “চাকরি করতে গেলে এমন ঘটনা কতই ঘটবে। অ্যাডজাস্ট করে চলতে হবে। বুঝেনইতো।”
সে যখন এই ঘটনা আমাকে বলছিল, আমার রক্ত তখন কাজী নজরুলের মতন টগবগ করে ফুটছে। আমি বললাম, “মিডল ফিঙ্গার দেখায় চাকরি ছেড়ে আসলে না কেন?”
সে বলল, “নতুন চাকরি না পেয়ে এইভাবে চাকরি ছাড়া কী ঠিক হবে?”
“আলবাৎ হবে! তাদের বলবা তোদের এই জবে থুথু মারি। তোর মুখে থুথু মারি। তারপর রেজিগনেশন লেটার তাদের মুখের উপর ছুড়ে ফেলে চলে আসবা। ও আচ্ছা, ‘… ইউ’ বলতে ভুলবা না।”
তিন্নি এই কাজটা করেছিল কিনা জানিনা, তবে চাকরি ছেড়ে দিয়েছিল।
বাংলাদেশের প্রায় সব স্থানেই এমনই কাজের পরিবেশ। বুড়া বুড়া একেকটা বস, বাচ্চা কাচ্চা বড় হয়ে গিয়েছে – তারাও যুবতী মেয়ে মানুষ দেখলে লোভ সামলাতে পারেনা। টিবিলের নিচে দিয়ে ফুটবলের ল্যাং মেরে মুচকি মুচকি হাসে। ইশারা ইঙ্গিত দেয়।
জওয়ান পোলাগুলির কথাতো বাদই দিলাম।
একবার আমার কিছু বন্ধু মেয়েদের সাথে ফ্লার্ট করছিল। আমি অস্বস্তি বোধ করায় ওরা আমাকে বলেছিল, “তুই কী মাইয়া নাকিরে? ‘লেডিস’ কোথাকার!”
তখন আমার বয়স ছিল কম। মেজাজ খারাপ হতো দ্রুত। তাই আমিও পাল্টা জবাব দিয়েছিলাম, “তোর বোনকে আমার ঘরে পাঠায় দিস, দেখায় দিব আমি কেমন মর্দ!”
বন্ধু খুব ক্ষেপে উঠেছিল। কিন্তু হুবহু একই শব্দ সে কিছুক্ষণ আগে ঐসব মেয়েদের উদ্দেশ্যেই বলছিল। “যাবে নাকি আমার বাড়ি? রাতে হবে একটু বাড়াবাড়ি! হিহিহি।”
এমন না যে আমরা অশ্লীলতা করতে জানিনা। সেদিন আমি এবং বন্ধুরা অনেক চিন্তা ভাবনা করেও একটাও ‘ভদ্র’ জোকস মনে করতে না পেরে শেষে বলেছিলাম, “Ok, admit it, আমরা একেবারে নষ্ট হয়ে গেছি!”
কিন্তু তাই বলে অপরিচিত অথবা স্বল্প পরিচিত অথবা মোটামুটি ভাল পরিচিত মেয়ে বন্ধুরাও বলতে পারবে না কখনও তাদের সাথে অশালীন মন্তব্য বা ইঙ্গিত করেছি। আমার কী পুরুষত্ব কমে গেল তাতে?
অ্যামেরিকাকে অতি ভদ্র জাতি আমি বলবো না। এখানের অনেক দম্পতি পরকিয়া করে। একজন সাধারণ অ্যামেরিকান যুবক বিয়ের আগে কমসে কম আটটি মেয়ের সাথে ডেটের নাম করে বিছানায় যায়। ছেলে মেয়েদের একসাথে রাত কাটানো যেন পেশাব পায়খানার মতোই অতি সাধারণ ব্যাপার। এখানকার রাস্তা দিয়েও মেয়েরা হেঁটে গেলে ইভ টিজিংয়ের শিকার হয়। কিন্তু এখানে অন্তত বিচার দিলে মেয়েরা বিচার পায়। আমাদের দেশের মতন তাঁদের শুনতে হয়না, “এত মানুষ থাকতে আপনাকেই কেন টিজ করা হলো? নিশ্চই আপনিই উস্কানি দিয়েছেন।”
আমরা দাবী করি পশ্চিমারা অতি বর্বর, অতি অশ্লীল এবং অসভ্য জাতি। এখানে বাবা মারাই মেয়েদের অতি উৎসাহের সাথে সাজিয়ে গুজিয়ে ডেটিংয়ে পাঠান। ভাইয়ের সামনেই বোনের বয়ফ্রেন্ড মেক আউট করে।
উল্টোদিকে আমরা অতি ভদ্রলোক। আমরা নিজেরা চিপায় গিয়ে অন্য মেয়ের সাথে টাঙ্কি টুংকি মারলেও নিজের বোনের দিকে কেউ চোখ তুলে তাকালেও তার চোখ উপড়ে ফেলি। ভুলে যাই, আমাদের ‘শিকারও’ কারও না কারও বোন, কারও মেয়ে।
আমরা যদি রক্ষণশীলতার বড়াই করি, তাহলে প্রথমেই এইরকম বদমাইশগুলিকে ঝেঁটিয়ে দূর করার ব্যবস্থা নিতাম। চেপে যাওয়া কোন অবস্থাতেই কোন রোগের চিকিৎসা হতে পারেনা, বরং ১০০% সম্ভাবনা থাকে রোগ বৃদ্ধির।
আমাদের কালচার, আমাদের ধর্ম অতি “ভদ্র” হলেও আমরা ভিতরে ভিতরে অত্যন্ত বদ! ‘বোরখার তলে বিকিনি’ বলে একটা উপমা কোথায় যেন শুনেছিলাম। আমাদের ক্ষেত্রে এইটা প্রযোজ্য।
আসলে ভুল বললাম, বোরখার নিচে বিকিনি পড়লে সমস্যা ছিল না। বোরখা সব কিছুই ঢেকে রাখে। আমরা সুপার ওম্যানের মতন বোরখার উপর বিকিনি পড়া জাতি। ভিতরে ভিতরে রক্ষণশীল মূল্যবোধ ধরে রেখে বাইরে বাইরে প্রগতিশীল হবার ভান করি। দুই নৌকায় দুই পা দিয়ে মাঝ বরাবর শুধু প্রস্রাবই করা হচ্ছে। এই দ্বিমুখী নীতি আমাদের কোথাও যেতে দিচ্ছে না।
কিছুদিন আগে আমাদের এক ফ্যাশন ডিজাইনার নারী মডেলকে শাড়ির উপর ব্লাউজ পরিয়ে বেশ সমালোচিত হয়েছিলেন। আসলে সেটি অতি বিচক্ষণ একটি আইডিয়া ছিল, আমরাই নাদান, তাঁকে ভুল বুঝেছি।