#সেই_রজনী_দর্শনে🌙 |১২|
#তাসনিম_জাহান_মৌরিন
রজনী চোখ সরিয়ে নেয় দর্শনের থেকে। দর্শন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে এগিয়ে এসে বারান্দার দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়ায়। মাথা সামান্য বাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,
_”মনে কোনো প্রশ্ন আসেনা তোর? এত কিছু বলি,সব অর্ধেক কথা। পুরোটা জানার ইচ্ছে হয়না রাতপাখি?”
রজনীর হৃদস্পন্দন ক্রমান্বয় বাড়লো বইকি কমলো না। তাকাতে পারলো না দর্শনের দিকে,দৃষ্টি নামিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। দর্শন পাশে তাকিয়ে মুচকি হাসলো কেবল। কিছুক্ষন পর পা বারিয়ে ঠিক রজনীর সামনে এসে দাঁড়ালো। তার শরীরে জড়িয়ে রাখা ওড়নাটা পিছন থেকে নিয়ে মাথায় তুলে দিলো। অবাক হয়ে তাকালো রজনী, দর্শন পিছিয়ে গেলো কয়েক কদম। মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে বললো,
_”শুনেছি মেয়েদের নাকি খোলা চুলে দারুণ লাগে, আরো বেশি রূপবতী লাগে তাদের। দ্বিমত পোষণ করলাম এই কথার সঙ্গে, কিছু কিছু মেয়েকে মাথায় ওড়না দেওয়া অবস্থায় অধিক থেকে অধিকতর সুন্দর লাগে। যেমন আমার প্রিয়তমা, পূর্ণিমার আলোয় ওড়নায় আবৃত তার মায়াময় মুখশ্রী, একবার তাকালে চোখ সরাতে ইচ্ছে হয়না। মন চায় যেন একইভাবে তাকিয়ে থাকি তার পানে। তার এই রূপটা আড়ালে থাকুক,নজর লেগে যাবে যে!”
এই প্রথমবারের মতো রজনীর মনে সাধ জাগলো, একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে খুব ইচ্ছে হলো,
_”কে তোমার প্রিয়তমা? মাঝেমধ্যেই তোমার মুখে তার কথা শোনা যায়, এমন নিষ্পাপ ভালোবাসা! আমিও জানতে চাই, কে সেই ভাগ্যবতী।”
প্রশ্নটা করতে পারেনা রজনী, মনে হয় উত্তরটা তার জানা। তবে এই উত্তরটা তার কিশোরী মন সহ্য করতে পারবে তো? অনুভূতির জোয়ারে ভেসে বাস্তবতা ভুলতে বসবে না তো?
_”বড্ড কথা লোকানো শিখেছিস রাতপাখি। মনের মধ্যে প্রশ্ন চেপে যাচ্ছিস কেন?”
রজনী চোখ সরিয়ে ক্ষীণ স্বরে বললো,
_”এই প্রশ্নের উত্তর তো তুমি কাউকে দেওনা দর্শন ভাই।”
_”কাউকে দেইনা? তোকেও দেবোনা, এটাই ভেবে নিলি?”
দর্শন আজ সব দিক থেকেই ঘিরে ধরছে রজনীকে। যেন তার মাথায় চেপে বসেছে, অনেক করেছে লুকোচুরি, আর নয়। রজনীর থেকে উত্তর না পেয়ে এগিয়ে এলো দর্শন। হুট করেই তার ডান হাতটা সামনে এনে বললো,
_”কি হয়েছে হাতে?”
_”আরু খামচি দিয়েছিলো কাল।”
হাতটা কিছুটা উপরে আনলো দর্শন, চামড়া উঠে গেছে কিছু জায়গার, দু জায়গায় লাল হয়ে আছে, বাচ্চাদের খামচি বলে কথা। সযত্নে সেখানে হাত বোলালো দর্শন। রজনী চোখ সরালো আবারো। আজ কেমন অদ্ভুত লাগছে তার, দর্শনকে অন্যরকম মনে হচ্ছে। অন্যদিকে চোখ সরিয়েই ধীর গলায় বললো,
_”ঠিক আছে.. ছাড়ো।”
_”যদি না ছাড়ি রাতপাখি? ধরে রাখতে চাই আজীবনের জন্য? অসন্তুষ্ট হবি তবে?”
লম্বা নিঃশ্বাস নিয়ে চোখ বন্ধ করলো রজনী, দাঁতে দাঁত চেপে শক্ত ঢোক গিললো সে। দমবন্ধ লাগছে যেন, বন্ধ চোখজোড়া থেকে দু ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পরলো গাল বেয়ে। দর্শন ব্যস্ত হলোনা, সে চাইলো তার প্রেয়সীর অনুভূতি পরখ করতে।
চোখ খুললো রজনী, দর্শন তার হাতটা ছেরে দিতেই ছুটে বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে। এই কথাটা কেন বললো দর্শন? না বললে কি খুব ক্ষতি হয়ে যেত? অনুভূতিকে অপ্রকাশিত রাখতেই পারতো সে চাইলে, তাহলে বললো কেন?
দর্শন দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে রইলো কিছুক্ষন। আটকাতে চাইলো না রজনীকে, থাকুক একটু নিজের মতো। এখনো ছোট সে, দর্শনের সামান্য কথার ভার অনেকটা, এটা স্বিকার করতে তার একটু সময় লাগতেই পারে।
আপাতত রজনীর টেবিল থেকে তার নির্দিষ্ট একটি ডায়েরী হাতে নিলো দর্শন, নিজের পছন্দের বইগুলোর নাম রজনী এখানে লিখে রাখে। দর্শন সেই নামের একটা ছবি তুলে নিলো ফোনে।
জাহিদ বাড়িতে নেই। আফিয়া আর ফাহমিদা একই ঘরে বসেছিলেন। ফাহমিদা কাথা সেলাই করছেন চোখে চশমা দিয়ে, আর আফিয়া বিছানায় বসে আছেন, টুকটাক কথাও বলছে দুজন। রজনী ঘরে এসেই ছুটে এলো মায়ের কাছে। বিছানায় এসে আফিয়ার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পরলো সে। আফিয়া আর ফাহমিদা দুজনেই অবাক হলেন। আফিয়া মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,
_”কি হয়েছে মা, এভাবে ছুটে এলে যে।”
রজনী উত্তর দেয়না। তার কানে কেবল একটা কথাই বেজে চলেছে, “সারাজীবন এর জন্য যদি ধরে রাখতে চাই?”
চোখ খিঁচে বন্ধ করে নেয় রজনী। আফিয়ার উদ্দেশ্যে বলে,
_”কিছু হয়নি। কেন,কিছু না হলে আমি আসতে পারিনা তোমার কাছে? এখন আর কিছু জিজ্ঞেস করোনা প্লিজ, এভাবেই থাকতে দাও কিছুক্ষন।”
ফাহমিদা আর আফিয়া একে অপরের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করে,হঠাৎ কি হলো মেয়েটার। তবে এর উত্তর পায়না কেউ, আফিয়া আর কথা বাড়ালেন না। এমনিতেই মেয়েটার মন খারাপ সকাল থেকে, মায়ের কাছেই তো এসেছে, থাকুক কিছুক্ষন।
_____
মায়ের কোলে শুয়ে কখন ঘুমিয়ে পরেছিলো তা আর খেয়ালই করেনি রজনী। ঘুম ভাঙে তার মাগরিব এর আযান শুনে, নামাজ পরতে পারবেনা বলে আফিয়া ডাকেনি আগে। ঘুম ভাঙার পর নিজের ঘরে চলে আসে রজনী, এখনো তার মন অশান্ত। অদ্ভুত লাগছে,এমন নয় যে দর্শনের কথায় সে খুব বেশি অবাক হয়েছে। এতটাও ছোট নয় সে, দর্শন প্রতিনিয়ত তার আচার-আচরণ এর মাধ্যমে নিজের মনের কথা বোঝাতে চেয়েছে। তবে সরাসরি তো কিছু বলেনি, আজ তাই বললো। না বললেই পারতো, শুধুশুধু রজনীর মনটাকে অশান্ত করার কি প্রয়োজন ই বা ছিলো?
হাত মুখ ধুয়ে আসতেই রজনীর চোখ যায় টেবিলের উপর।
তিনটে নতুন বই দেখেই পা বারায় সেদিকে, নিশ্চিত এগুলো দর্শন ই এনে দিয়েছে। এই এক ক্ষেত্রে প্রচুর দূর্বল রজনী, মন খারাপ হোক বা যাই হোক না কেনো, বই পেলে সে সবকিছু ভুলে যাবে।
প্রথম বইটা খুলে দেখতেই তার ভিতর থেকে একটা চিরকুট নিচে পরে যায়, রজনী ভ্রু কুঁচকে সেটা খুলতেই দেখে কালো কালিতে কিছু লেখা, হাতের লেখাটা দর্শনের।
“কিছুই তো বললাম না, এতেই আমার থেকে পালিয়ে যাচ্ছিস রাতপাখি? এখনো তো আরো শতশত মনভোলানো বাক্য শোনা বাকি তোর আমার থেকে। এভাবে পালিয়ে গেলে তা বলবো কি করে?”
কাগজটা ভাজ করে আয়নার সামনে দাঁড়ালো রজনী। অবাক হলো, সে হাসছে কেন? সেই বাক্য কি শুনতে ইচ্ছে করছে তার? লজ্জা লাগছে? নাহ,লজ্জা পাওয়ার মতো তো দর্শন কিছুই বলেনি। যা বলেছে তা কেবলই ভালো লাগার। তাহলে মনটা এমন ফুরফুরে হয়ে গেলো কেন হুট করে? হৃদয়ে শান্তির বাতাস বয়ে গেলো, নাকি প্রেমের বাতাস?
বইগুলো গুছিয়ে রেখে রান্নাঘর এর দিকে গেলো রজনী। আফিয়া আর ফাহমিদা সন্ধ্যার নাস্তা বানাচ্ছে। রজনীকে দেখেই ফাহমিদা তাকে ডেকে হাতে দুটো পায়েসের বাটি ধরিয়ে বললো,
_”কালকের পায়েস,ফ্রিজ এ ছিলো। তোরা তো আবার ঠান্ডা পায়েস পছন্দ করিস। রাফিনকে আগেই দিয়েছি, দর্শনকে দিয়ে আয় আর নিজেও খেয়ে নে এবার। ঘুম ভালো হয়েছে?”
মাথা নাড়লো রজনী। ফাহমিদার কথামতো পা বারালো দর্শনের ঘরের দিকে। আচমকা পা থেমে যেতে চাইলো তার, তা উপেক্ষা করে দরজার সামনে গিয়ে বললো,
_”আসবো?”
দর্শন খাটে হেলান দিয়ে বসে ফোন স্ক্রোল করছিলো। রজনীর গলার আওয়াজ পেয়ে ফোনটা রেখে সোজা হয়ে বসলো সে। শান্ত গলায় বললো,
_”আয়..”
রজনী ভিতরে এলো। এক হাতের বাটি দর্শনের দিকে এগিয়ে দিলো, তবে তার দিকে তাকালো না। দর্শন মনেমনে হেসে বাটিটা নিতেই রজনী পুনরায় বেরিয়ে যাওয়ায় জন্য পা বারায়। তাকে থামিয়ে দেয় দর্শন, পিছন থেকে বসে ওঠে,
_”কোথায় যাচ্ছিস? বোস এখানে।”
রজনী বসলো খাটের এক পাশে। পায়েসের বাটিতে চামচ দিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগলো সে। দর্শন আবারো হেলান দিয়ে বললো,
_”বই পছন্দ হয়েছে?”
_”হুম।”
_”আর আমাকে?”
_”হুম?..”
বড়বড় চোখে তাকায় রজনী। দর্শন তার দিকে এগিয়ে বসে বলে,
_”চুপ করে আছিস কেন? অতি লজ্জা ভালো নয়। লজ্জা পাওয়ার কিছু না বলতেই যদি কথা বলা বন্ধ করে দিস তাহলে..”
_”বলছি তো কথা।”
মুচকি হাসলো দর্শন। পায়েসের বাটিটা পাশে নিয়ে রাখলো। রজনীর দিকে তাকিয়ে বললো,
_”বেশ, অনেক কথা বলছিস। তবে এবার আমি কিছু কথা বলবো, মন দিয়ে শুনবি। তাকা এদিকে..”
রজনী তাকালো দর্শনের দিকে। দর্শন ঠোঁটের কোণে হাসির রেখে বজায় রেখে বললো,
_”আমি জানি তুই অবুঝ না, আর এটাও জানি তুই কেন আমার থেকে পালাতে চাইছিস। ঠিক এই কারণে কথাগুলো তোকে বলতে চাইছিলাম না পাখি। এবার জিজ্ঞেস কর, কেন বললাম তাহলে? সেটাও তোর জন্যই। খুব ইচ্ছে না তোর, সবাই তোকে ভালোবাসবে? এই ইচ্ছেটা হয়তো আমি মেটাতে পারবো না কখনো। তবে সকলের ভালোবাসার ঘাটতি মেটাবার চেষ্টা আমি করতেই পারি। স্পষ্টভাবে এটাই জানান দিলাম তোকে, বেঁচে থাকার একটা কারণ বারিয়ে দিলাম।
আমি তোর থেকে কোনো উত্তর চাইনি রাতপাখি, না চেয়েছি তোর ভালোবাসা। তার জন্য অনেক সময় পরে আছে। তুই বুদ্ধিমতী, অনুভূতিকে প্রাধান্য দিতে বারণ করবোনা। তবে তার ভারটা যেনো নিজের স্বপ্নের উর্ধে না চলে যায়। কথাগুলো বললাম, যেন নিজের মাঝে তৈরি হওয়া জড়তাগুলোকে শুরুতেই এক সাইডে সরিয়ে রাখতে পারিস।”
আরো কিছুটা এগোলো দর্শন, মৃদু হেসে বললো,
_”আমার থেকে লুকিয়ে থাকা, লজ্জা পাওয়ার সময় হলে, তা আমি নিজেই বলবো। কেমন?”
রজনীকে কোনো প্রতিত্তর করার সুযোগ দিলোনা দর্শন। মুহূর্তেই সরে এলো সে। রজনীর হাত থেকে পায়েসের বাটিটা নিয়ে নিলো। এক চামচ পায়েস তার মুখের সামনে তুলে ধরে বললো,
_”নে, আমিই খাইয়ে দিচ্ছি। বইগুলো পরে সামারি বলিস আমাকে, অতকিছু পড়ার ধৈর্য নেই আমার।”
পায়েসটুকু মুখে নিলো রজনী। একদৃষ্টিতে দর্শনের দিকে তাকিয়ে স্মিত হাসলো সে। তার মধ্যে আর কিছুক্ষন আগের জড়তাটুকু কাজ করছে না, তবে নিজেকে এই মুহূর্তে ভীষন ভাগ্যবতী মনে হচ্ছে। কারণটা হয়তো তার সামনে বসে থাকা ব্যক্তি, যে তাকে মন থেকে ভালোবাসে।
#চলবে?