#সেই_রজনী_দর্শনে🌙 |১০+১১|
#তাসনিম_জাহান_মৌরিন
বাকিরা রাতে খাওয়াদাওয়া শেষ করেই চলে গেলো, থাকলো কেবল ইনাম। তাও হালিমা আর জাহিদ জোর করেছে বলেই সে থাকতে বাধ্য হয়েছে। দর্শন আর ইনাম একসঙ্গেই থাকবে আজকে। ইনাম আবার পরেছে মহা যন্ত্রণায়, অনলাইন এ এলেই সারা মেসেজ এর বন্যা জুরে দিচ্ছে। ইনাম না পারছে ওকে ব্লক করে দিতে আর না পারছে এগুলো সহ্য করতে। অনেক্ষন বাদে মেসেজ চেক করলো ইনাম, প্রায় পনেরো টা মেসেজ জমা হয়ছে। শেষের মেসেজ এ লেখা,
“আপনি রিপ্লাই দেবেন না তাই তো? ছেলেরাও এতো ভাব দেখায়? এগুলো মেয়েলি স্বভাব.. এই এই, আপনার কোনো সমস্যা নেই তো?”
চোখ বড়বড় করে মেসেজের দিকে তাকিয়ে রইলো ইনাম, দ্রুত টাইপ করলো,
_”সমস্যা মানে? কি বোঝাতে চাইছো তুমি হ্যা? আমাকে দেখে কোন অ্যাঙ্গেল এ…”
মেসেজ টা সেন্ড করার কয়েক সেকেন্ড এর মধ্যেই সারা রিপ্লাই দিলো,
_”এইতো মিস্টার নুডুলস,আপনি রিপ্লাই দিয়েছেন। নাহ, তার মানে বোঝা গেলো আপনি একদম ঠিকঠাক আছেন।”
_”বেশি পেকে গেছো তাইনা? সবে তো ক্লাস ১০ এ পড়ো, এত রাতে ফোন ইউজ করছো, কেউ কিছু বলেনা?”
_”আম্মু তো আমার পাশেই ঘুমোচ্ছে। আমি আবার ভীষণ গল্প পড়ি, অনেক ডায়লগ ও মুখস্ত করে রেখেছি। শুনবেন?”
_”আজ্ঞে না, আপনার বাস্তব ডায়লগ গুলোই যথেষ্ট।”
_”আরে এত প্রশংসা করতে পারেন আপনি,মিস্টার নুডুলস! যাহ,লজ্জা লাগে তো আমার। “(সঙ্গে বানর এর লজ্জা পাওয়া ইমোজি)
ইনাম ভ্রু কুঁচকে রিপ্লাই দেয়,
_”প্রশংসা? কখন?”
_”আপনার কথা এতো তেঁতো কেনো হ্যা? আপনি বললেন আর আম্মু জেগে গেলো। এখন ই ফোন নিতে চাইবে।”
_”ভালো তো, পিচ্চি মেয়ে এতো রাতে ফোন ইউজ করতে হয়না।”
_”তা পারবো ও না।”
পুনরায় সারাই মেসেজ করলো,
_”শুনুন মিস্টার নুডুলস..”
_”না জিজ্ঞেস করে কতো কিছুই তো বলছো..”
_”আপনি না খুব কিউট, একদম ক্রাশ ম্যাটারিয়াল। রিপ্লাই দিয়ে রাখুন,সকালে উঠে দেখবো। গুড নাইট..”
মেসেজটা দেখে আনমনেই হাসলো ইনাম। মেয়েরাও এভাবে ফ্লার্টিং করতে জানে, এই মেয়েকে না দেখলে বুঝতেই পারতো না। তবে একটা বিষয় অদ্ভুত, সারার সঙ্গে কথা বলে খারাপ লাগলোনা ইনাম এর, বরং মনটা ফুরফুরে হয়ে গেলো।
ইনাম আবার বেশ ঘুমকাতুরে, ফোন রেখে শুতে দেরি তার ঘুমিয়ে পরতে দেরি নেই। দর্শন টেবিলে সামনে চেয়ার দিয়ে বসে আছে। মাথায় এতো চিন্তা, সবটাই রজনীকে নিয়ে। মেয়েটা খুব বেশি কথা তার থেকে লুকোয় না, তবে কিছু লুকোতে চাইলে দর্শন তা জানার জন্য জোর করেনি কখনো। তবে জন্মদিন এর বিষয়টা এখনো ভাবাচ্ছে দর্শনকে।
দুঃখজনক বিষয়, রজনীর জন্মের দিন বিকেল বেলাই তার দাদা মারা যায়। একেতো সে মেয়ে, এই যুগে এসেও জাহিদ এবং তার মা হালিমা সর্বদা ছেলে চাইতেন, মেয়ে মানুষ মানেই বোঝা,এই কথাতেই তারা আজও বিশ্বাসী, সেই কারণে ছোট থেকে রজনীকে কম অবজ্ঞা সহ্য করতে হয়নি। তার উপর এই ঘটনায় হালিমা ক্ষিপ্ত হন কঠোরভাবে, এই মেয়েই যেন পরিবার এর অভিশাপ, সে এই দুনিয়াতে এসেই তার দাদাকে মে’রে ফেললো। এমন কথা ছোট বেলা থেকে শুনতে হয়েছে রজনীকে। প্রতিনিয়ত জাহিদের ব্রেইন ওয়াশ করে গেছেন হালিমা, তার যেন একটাই উদ্দেশ্য, রজনীকে সে খুশি থাকতে দেবেনা। নির্দোষ রজনীকে তিনি আজও নিজের স্বামীর খু’নি মনে করে। আর তাই ছোটবেলা থেকে কখনো এই বাড়িতে রজনীর জন্মদিন উৎযাপন করা হয়নি। কিছু বছর যাবৎ দর্শন রাতে লুকিয়ে কেক নিয়ে আসতো, গতবছর দুর্ভাগ্যবশত হালিমার চোখে পরে যায় তা। এই নিয়ে তিনি কম কথা শোনায়নি রজনীকে, মেয়েটাকে জন্মদিন এর দিনও কাঁদিয়ে রেখেছেন তিনি। ওর কান্না দেখে বোধ হয় আত্মতৃপ্তি পান হালিমা।
তবে এই সবকিছুর সাথে রজনীর ওভাবে ভয় পাওয়ার বিষয়টা মেলাতে পারলো না দর্শন। বাধ্য হয়ে হাল ছাড়লো সে, ঘর থেকে বেরোতেই হালিমাকে ছাঁদে যেতে লক্ষ্য করলো সে। রাতের বেলা তো রজনী আর দর্শন ছাড়া কেউ ছাঁদে যায়না সচরাচর। হালিমা যেতেই দর্শন ও তার পিছুপিছু ছাঁদে গেলো। তার আগে একবার রজনীর ঘরে উঁকি দিয়ে দেখলো সে ঘরে নেই, বুঝতে পারলো রজনীও ছাঁদেই আছে। ছাঁদের দরজার সামনে গিয়েও ভিতরে প্রবেশ করলো না দর্শন পাশেই দাড়িয়ে রইলো।
রজনী আজ বেশ আনন্দ নিয়েই ছাঁদে এসেছিলো, মনটা ভালোই আছে আজ। ঠিক তখনি হালিমা এসে তার কাধে হাত রেখে নিজের দিকে ঘোরালেন,তার চোখমুখ কোঁচকানো। রজনী আকস্মিকভাবে ভয় পেলেও তা সামনে নিয়ে বলে,
_”দাদু তুমি ঘুমোও নি?”
_”ক্যান রে? আমি ঘুমাইলে তোর এইখানে আইসা পিরিত করতে সুবিধা হইবো?”
বিস্মিত চোখে তাকায় রজনী, দর্শনের চোয়াল শক্ত হয়ে আসে মুহূর্তেই। রজনী অবাক কণ্ঠে বলে,
_”দাদু আমিতো এমনিই এসেছিলাম।”
_”হ তুমিতো এমনেই আইবা, পাগল মনে হয় আমারে? ঐযে পোলাডা কতক্ষন ধইরা তাকায় আছে এদিকে, দেখোস নাই?”
হালিমার কথা অনুযায়ী সোজা তাকাতেই রজনী খেয়াল করে চারতলার বারান্দায় একটা ছেলে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছে। রজনী প্রতিবাদ জানিয়ে বলে,
_”দাদু উনি তো ফোনে কথা বলছে, আমার দিকে তাকাবে কেনো?”
_”একদম নাটক করবিনা। পোলারা তাকায় থাকলে খুব ভালো লাগে তাইনা? কে জানে রাস্তাঘাটে আরো কি কি কইরা বেরাও তুমি! আমাগো মান ইজ্জত ডুবার আগে কইছিলাম জাহিদরে, মাইয়ার বিয়ার ব্যবস্থা করতে। তা আবার আরেকজন হইতে দিতো না, মেয়ের নাকি বয়স হয়নাই।”
চোখ থেকে দু ফোটা জল গড়িয়ে পরে রজনীর। অহেতুক হালিমা তাকে এতগুলো কথা শুনিয়ে দিচ্ছে। হালিমা এবার তার হাত ছেড়ে দিয়ে বলে,
_”আমি কালকেই আবার জাহিদের লগে কথা কইতাম। মাইয়া মানুষ অতো পড়াশোনা কইরা কি করবো?”
কষ্ট ভুলে গিয়ে ভয়ে আবদ্ধ হয় রজনীর মন। তৎক্ষণাৎ হালিমার হাত ধরে আকুতির স্বরে বলে,
_”দাদু প্লিজ, আব্বুকে এমনটা বলোনা। তুমি বললে আমি আর ছাঁদে আসবোনা, তারপরও আমার পড়াশোনা নিয়ে কিছু বলোনা প্লিজ।”
হালিমা এক ঝটকায় ছাড়িয়ে নেন হাতটা। রাগী কণ্ঠে বলে,
_”সর তো, তোর কান্না নিয়ে থাক তুই। আমিও তোর বিয়া দিয়াই ছাড়ুম, এই কইয়া দিলাম।”
কথাটা বলেই চলে গেলেন হালিমা, দর্শন লুকিয়ে পরায় তাকে আর দেখতে পায়নি তিনি। দর্শন দাঁতে দাঁত চেপে কেবল নিজেকে নিয়ন্ত্রনে রেখেছে, ইচ্ছে করছিলো তাকে ক’টা কথা শুনিয়ে দিতে। তবে এতে রজনী রাগ করবে, কথা বলবেনা কয়েকদিন। তার মতে হালিমা গুরুজন, সে যাই বলুক না কেন তাকে কোনোভাবে অপমান করা যাবেনা। দু মিনিট ধরে নিজেকে শান্ত করলো দর্শন। দরজার সামনে এসে রজনীর দিকে দৃষ্টি যেতেই হৃদয়ে জোরালো আঘাত এসে লাগে তার, মেয়েটার কষ্টগুলো কোনোভাবে যদি নিজের করে নিতে পারতো!
রজনী দাড়িয়ে আছে একইভাবে। চোখ থেকে অশ্রুকণা বিসর্জন দিচ্ছে নিরবে। মাথা এবং শরীরে শালীনভাবে ওড়না জড়িয়ে রাখা। হালিমা কিনা ইচ্ছে করে তার চরিত্রর দিকেও প্রশ্ন তুললো আজ!
চোখ বন্ধ করে শুকনো ঢোক গিলে দর্শন। সে সামনে গেলেই রজনী নিশ্চিৎ কান্নার পরিমান বারিয়ে দেবে এবার। মেয়েটা বড্ড ভালোবাসার কাঙাল, কারো এতটুকু ভালোবাসা পেলেই সে খুশিতে আত্মহারা হয়ে যায়। তবে নিজের দুঃখ ভাগ করে নেওয়ার সঙ্গী হিসেবে অধিকাংশ সময় সে দর্শনকেই পেয়েছে।
দর্শন এগিয়ে এলো, দাড়ালো রজনীর সম্মুখে। তা টের পেয়ে চোখ বন্ধ করলো রজনী,একহাতে চোখ মুছে নিলো সে, দর্শন শুনেছে সব কথা,এ বিষয় নিশ্চিত সে। দর্শন ছোট নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,
_”চুপ করে কেন থাকিস রাতপাখি? নিজে না বলতে পারলে অন্তত আমায় অনুমতি দে।”
দর্শনের প্রশ্নে পাত্তা দিলোনা রজনী। সে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
_”আর কি বাকি আছে ভাইয়া? লেখাপড়া নিয়ে তো দাদু আরো বছরখানেক আগে থেকে পরে আছে। এবার আমার ছাঁদে আসাতেও বাঁধা। আচ্ছা, দাদু যদি আমার বই পড়াটাও বন্ধ করে দেয়?”
শেষের কথাটা ভয়ার্ত কণ্ঠে বলে রজনী। দর্শন দুদিকে মাথা নাড়াতেই সে পুনরায় বলে ওঠে,
_”আমি তো বেঁচেই আছি বইগুলোর জন্য ভাইয়া। আজ একদম সত্যি কথা বলছি, অন্য কোনো কারণে আমার আর বাঁচতে ইচ্ছে করেনা। যদি আমার বই পড়া, লেখাপড়াও বন্ধ হয়ে যায়… আমি বাঁচতে পারবোনা।”
দর্শনের ধারণাই সঠিক হলো, কান্নার বেগ বারলো রজনীর। তার প্রতিটি কথা ভীতির জন্ম দিলো দর্শনের মনে। কিছুটা এগিয়ে রজনীর দু’কাধে হাত রেখে বললো,
_”এভাবে বলেনা পাখি, তুইতো স্ট্রং। এত সহজে ভেঙে পরবি? এখনো তো পুরো জীবন বাকি, নামের আগে প্রফেসর ট্যাগ পাওয়া বাকি তোর। বাঁচতে চাইবিনা এগুলোর জন্য?”
রজনী দর্শনের চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,
_”ইচ্ছেতো করেনা ভাইয়া,কি করবো আমি?”
_”আমি বুঝতে পারছি তো। আসলে কি বলতো, এই বয়সে অনেক কিছুই সহ্যের বাহিরে চলে যায়। মাথায় সব দুশ্চিন্তা ই আসে, এগুলোকে তো ওভারকাম করতে হবে।”
রজনী চোখ নামিয়ে বলে,
_”আমি আর বাচ্চা নই ভাইয়া। এসব মোটিভেশন পেতে আর ভালোলাগে না আমার, বিরক্ত হয়ে যাচ্ছি আমি জীবন থেকে।”
_”আমার দিকে তাকা রাতপাখি।”
রজনী তাকালো দর্শন এর দিকে। দুজনের দৃষ্টি এক হলো এবার। দর্শন শান্ত কণ্ঠে বলে ওঠে,
_”তুই নিজের জন্য বাঁচবি, জীবনকে ভালোবেসে, নিজের স্বপ্ন পূরনের জন্য। তবুও যদি কখনো জীবনের প্রতি বিরক্তি চলে আসে, সেই মুহূর্তে নাহয় অন্য কারোর জন্য বেঁচে থাকতে চাইবি। যারা তোকে ভালোবাসে,তাদের কথা একবার মনে করবি, অন্তত মামির কথা..”
অশ্রুসজল চোখে তাকিয়ে রইলো রজনী। দর্শন যেন আটকে গেলো ঐ চোখ দুটির মোহে। ধীর কণ্ঠে বললো,
_”তোর এখনো অনেক ভালোবাসা পাওয়া বাকি রাতপাখি। ভেবে দেখ, কেউ হয়তো চায়, তোকে তার ভালোবাসার চাদরে মুরিয়ে রাখতে, যেখানে কোনো কষ্টেরা থাকবে না। সেই ভালোবাসা পাওয়ার জন্য হলেও তোকে বাঁচতে হবে।”
_”আশা দেখিওনা, আমার কোনো স্বপ্ন তো পূরণ হয়না ভাইয়া। মিছে স্বপ্ন দেখে কষ্ট বারিয়ে লাভ কি?”
দর্শন এবার তার একহাত রাখলো রজনীর গালে, চোখের পলক ফেলে বললো,
_”আমি তোকে মিথ্যে আশা দেখাবো পাখি? তেমনটা মনে হয় তোর? এটুকু বিশ্বাস রাখবি না আমার উপর?”
নিরব রইলো রজনী তবে তার অশ্রুধারা বাঁধ মানলো না। দর্শন করুন স্বরে বলে,
_”আর কাঁদিস না প্লিজ। শরীর খারাপ করবে তো।”
দর্শনের হাতটা সরিয়ে দিলো রজনী। চোখ মুছে রেলিং এর দিকে এগিয়ে বললো,
_”হবেনা। তুমি যাও ভাইয়া..”
দর্শন এগিয়ে এসে ঠিক রজনীর পাশে দাঁড়ালো। প্রশ্ন করে বসলো,
_”কেন যাবো? নিঃসঙ্গতা খুব ভালোলাগছে আজকাল?”
_”জানিনা।”
_”এই অভ্যাস কখনো করতে বলিনি।”
_”হুম, এখন পর্যন্ত বই আমার সঙ্গ ছাড়েনি তো, ভবিষ্যৎ এও থাকবে হয়তো।”
_”আরো কেউ থাকবে হয়তো।”
দর্শনের দিকে একনজর তাকালো রজনী। চোখ সরিয়ে দুদিকে মাথা নাড়ালো সে,তাচ্ছিল্যের সূরে হাসলো সামান্য। সে তো কখনো কারো বিশেষ সঙ্গ চায়নি। কেবল চেয়েছে একটা পরিবার, সবার ভালোবাসা। সেটা কখনোই পায়নি রজনী,হয়তো পাবেও না। দর্শন দাঁড়িয়ে রইলো চুপ করেই, রজনীও নিশ্চুপ। কিছুক্ষন পরপর তবুও জল গরাচ্ছে তার চোখ থেকে, নিজেই মুছে নিচ্ছে সেটা। দর্শন একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো কেবল, এছাড়া বিশেষ কিছুই করার নেই তার। তবে আজ প্রথমবারের মতো দর্শনের মনে হলো, রজনীকে নিজের মনের কথা বলে দিলে বোধ হয় ভালো হতো। অন্তত মেয়েটা বেঁচে থাকার একটা ইচ্ছে খুজে পেতো, অপূর্ণ চাওয়াগুলোর মাঝেও একজন তাকে পাগলের মতো ভালোবাসে, এটা ভেবে হয়তো খুশি থাকতে পারতো সে।
______
দর্শনের কথাই সত্যি হলো, বেশি কান্নাকাটির ফলে সেই ঠান্ডা লেগেই গেলো রজনীর। আজ আর স্কুলে যেতে পারলো না সে। মন খারাপ করে সারাক্ষণ ঘরেই বসে থাকলো। এরই মাঝে হালিমা জাহিদের কান ভাঙানো ও শুরু করে দিয়েছেন।
দুপুরের খাওয়াদাওয়া শেষে নিজের ঘরে গিয়ে তৈরি হলো দর্শন, একটু বেরোবে সে। সকাল থেকে অনেকবার চেষ্টা করে রজনীর মন ভালো করার, কাজ হয়নি। এবার কিছু বই এনে দেবে, তাতে যদি মেয়েটার মন ভালো হয়।
বেরোনোর আগে রজনীর ঘরে এলো দর্শন। বাকিরা নিজেদের ঘরে ঘুমোচ্ছে। আফিয়াও বুঝতে পেরেছেন রজনীর মন খারাপের কারণ, তবে আজকাল মেয়েকে সান্ত্বনা দেওয়ার মতোও কিছু খুজে পাননা তিনি। কেবল একটাই প্রার্থনা করেন, মেয়েটা যেন একজন ভালো মানুষকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পায়। যে তার ইচ্ছের গুরুত্ব দেবে,তাকে ভালো রাখবে।
রজনীর ঘরে এসে দাঁড়িয়ে রইলো দর্শন। তার সামনে দাঁড়িয়ে রজনী নিজের চুল কাটার চেষ্টা করছে। এটা সে আগেও করেছে,তবে সফল হয়নি।
_”আচ্ছা,চুল ছোট করে ফেললেই কি ছেলে হওয়া যায়না?”
বামপাশে এনে রাখা নিজের খোলা চুলের দিকে তাকিয়ে অদ্ভুতস্বরে কথাটা বললো রজনী। সামনে ড্রেসিং টেবিলের বড় আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে পাচ্ছে সে, সঙ্গে তার পিছনে ভ্রু কুঁচকে দাঁড়িয়ে থাকা দর্শনকেও দেখতে পাচ্ছে। রজনীর ডান হাতে মাঝারি আকৃতির কেচি।
এই একই কথা আগেও বলেছে রজনী। মানসিকভাবে অধিক বিষন্ন হয়ে চুল কাটার চেষ্টা করে সে। প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে প্যান্টের পকেটে দু’হাত গুঁজে চুপ করে রইলো দর্শন। রজনী একবার নিজের চুলের দিকে আরেকবার আয়নার দিকে তাকালো। কাপাকাপা হাতে কেচিটা এগিয়ে নিলো নিজের চুলের দিকে। আয়নার দিকে তাকিয়ে হাতটা আরো কিছুটা এগিয়ে নিতেই অশ্রুজল গড়িয়ে পরলো তার চোখ থেকে।
দর্শন এবার ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো তার দিকে। রজনীর ঠিক পিছনে দাঁড়িয়ে আয়নায় তাকিয়ে বললো,
_”কাঁদছিস কেন এখন?”
হাতে থাকা কেচির দিকে তাকিয়ে রজনী বললো,
_”মায়া লাগছে খুব।”
হাতটা সামনের দিকে এনে কেচিটা নিয়ে নিলো দর্শন। রজনী চোখ মুছে তার দিকে ঘুরে বললো,
_”কি অদ্ভুত না? সামান্য চুলের জন্য আমার এত মায়া হয়, অথচ গোটা একটা মানুষের জন্যই কারো মনে এতটুকু মায়া নেই!”
কেচি টা ড্রেসিং টেবিলের উপর রেখে দিলো দর্শন। বুকে হাত গুঁজে বললো,
_”দোষটা তোর।”
রজনী অবাক হয়ে বলে,
_”আমার দোষ?”
_”সবার থেকে মায়া আশা করাটাই তোর দোষ। রাতপাখি,বড্ড লোভি হয়ে যাচ্ছিস দিনদিন।”
তাচ্ছিল্যের সুরে হেসে ঘুরে দাঁড়ায় রজনী। বারান্দার দরজার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে,
_”তুমি বুঝবেনা দর্শন ভাই।”
হাত সোজা করে দু কদম এগিয়ে আসে আসে দর্শন। তবুও তাদের মাঝে দূরত্ব খুব একটা কম নয়। আচমকা বাতাসে রজনীর খুলে রাখা চুলগুলো সামান্য উড়তে লাগলো, কিছুটা চোখে মুখে এসে বিরক্ত করলো তাকে। রজনী হাতের সাহায্যে সরিয়ে দিলো সেগুলো। দর্শন তার পানে চেয়ে বলে,
_”তুই চাস, আমি বুঝি?”
ঘাড় ঘুরিয়ে দর্শন এর দিকে দৃষ্টি স্থাপন করে রজনী। দর্শন চোখ নামিয়ে কিঞ্চিৎ হেসে বলে,
_”যেদিন তুই চাইবি, তোকে সবচেয়ে ভালো আমিই বুঝবো রাতপাখি। কথা দিলাম..”
#চলবে?