#সেই_রজনী_দর্শনে🌙 |৯|
#তাসনিম_জাহান_মৌরিন
সদর দরজা থেকে ভেতরে ঢুকতেই তিন বছরের একটা বাচ্চা মেয়ে দৌড়ে এসে রজনীর পা জড়িয়ে ধরলো। রজনী চওড়া হেসে সঙ্গেসঙ্গে কোলে তুলে নিলো তাকে। তার গালে চুমু খেয়ে সামনে তাকাতেই মনটা আরো ভালো হয়ে গেলো তার। বাড়িটা একদম গমগম করছে, এমনিতে সবসময় যেন ম’রা বাড়ি মনে হয়। তবে আত্মীয়রা এলে সবাই কত্ত হাসিখুশি থাকে।
সোফা থেকে ইরা উঠে এসে ইনামের কাঁধে চাপড় মেরে বললো,
_”আপনি অবশেষে এলেন জনাব।”
ইনাম হাসলো সামান্য। ইরা এগিয়ে এসে তার মেয়ে আয়রার মাথায় হাত বুলিয়ে রজনীর গাল টেনে বললো,
_”কেমন আছিস বোনু? কোনো খবর ই তো পাওয়া যায়না তোর,থাকিস কোথায়?”
রজনী মুচকি হেসে বলে,
_”পড়াশোনা নিয়েই ব্যস্ত থাকি আপু, তুমি কেমন আছো? ভাইয়া আসেনি?”
_”এসেছে তো, এই একটু বাইরে গেলো।”
ইরা রজনীর পাশে দাড়িয়ে থাকা দর্শনের মাথায় গাট্টা মেরে বলে,
_”তোমাকে তো ঝাঁটাপেটা করা উচিৎ, এখন বলো তুমিও পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকো। খোজ নেওয়ার সময় কোথায়!”
দর্শন বিপরীতে ইরার কান টেনে ধরে বলে,
_”আমায় বলা না? নিজে সারাদিন বাসায় বসে কি করিস হুম? একদম আরুর বাহানা দিবিনা..”
_”আহ ভাইয়া ছাড়ো তো।”
দর্শন খানিক ধাক্কার ন্যায় কান ছেড়ে দিয়ে সোফায় গিয়ে বসলো। ইফতি সেখানে মনের আনন্দে বসে গেমস খেলছে, ইরার ছোট ভাই সে, এইতো এবার ক্লাস সেভেন এ উঠলো।
রজনী আয়রা কে কোলে নিয়ে এগিয়ে আসতেই সে কি বুঝে দু হাতে গাল টেনে দিলো রজনীর। রজনী অবাক হয়ে কাঁদোকাঁদো মুখ করে বললো,
_”আরু তুইও!..”
উপস্থিত সবাই হাসতে লাগলো এবার। ইনাম আর ইরা দুদিকে এসে আবারো রজনীর দু’গাল টেনে দিলো। ইরা হাসিমুখে বললো,
_”উফ,তোর গাল এত সফট কেন? দেখলেই গাল টানলে ইচ্ছে করে, দোষ কিন্তু আমাদের না।”
দর্শন সোফায় আরাম করে বসে বলে,
_”বলেছিলাম, আজকে তোর গাল শেষ। থ্যাংক ইউ বল, আমি অন্তত এতটাও বিরক্ত করিনা তোকে।”
_”বাকি আছো কেন? শুরু করে দাও, আমার গাল তো সরকারি জায়গা তাইনা?”
_”নাহ থাক, আমার অতো গাল টানার শখ নেই।”
“তবে অন্যকিছু করতেই পারি” এই কথাটুকু মনেই চেপে রাখলো দর্শন। রজনী আয়রা কে দর্শনের কোলে বসিয়ে দিয়ে ঘরে গেলো হিজাব খুলতে। বড়রা কেউ আসেনি, কেবল ছোটরাই এসেছে, ইরা,ইফতি, ইরার হাজবেন্ড আয়ান আর আয়রা, এখন এলো ইনাম সঙ্গে দর্শন আর রজনী তো আছেই। বলতে গেলে এই হলো তাদের কাজিন সমাজ, যোগাযোগ টা খুব গাঢ় না হলেও একসঙ্গে হলে তারা ভালোই মজা করে থাকে।
দু মিনিট বাদেই রজনী চলে এলো, হিজাব খুলে ওড়না মাথায় জড়িয়েছে এখন। এটা তার ছোটবেলার অভ্যাস, ওড়না মাথায় দেওয়ার অভ্যাস হয়ে গেছে, মাঝেমধ্যে সাধারণভাবে গলায় জড়িয়ে রাখে।
রজনী এসে সোফায় বসেই আয়রাকে কোলে নিলো। ইফতি এখনো ফোনে মগ্ন,তার এসব গল্পের দিকে কোনো মনোযোগ নেই। ইরা রজনীর হাতের দিকে খেয়াল করে বলে,
_”কিরে রজনী? তোর হাত খালি? সিরিয়াসলি! অদ্ভুত লাগছে।”
_”ঐতো, টাইম পাইনি।”
ক্ষীণ স্বরে উত্তর দিলো রজনী। এরই মাঝে আয়ানও উপস্থিত হলো সেখানে,হাতের প্যাকেটে আইসক্রিম নিয়ে। দর্শন আর ইনাম গিয়ে প্রথমেই হাত মেলালো তার সাথে। আয়ান সোফায় এসে বসতেই দর্শন প্রশ্ন করে বসে,
_”তোমার এই বউকে সামলাও কেমনে ভাই? একটুতো নম্র ভদ্র হতে পারলো না এখনো।”
ইরা ভেংচি কেটে বলে,
_”হাহ, আমিও দেখবো তোমার বউ কতো নম্র ভদ্র হয়।”
দর্শন সোফায় বসে বেশ ভাব নিয়ে বললো,
_”হাজারগুণে নম্র ভদ্র হবে আমার বউ। তোর মতোন তিড়িংতিড়িং করা মেয়ে নয় ও।”
ইনামও সঙ্গ দিয়ে বললো,
_”এদিক দিয়ে একমত মামা।”
আয়ান দর্শনের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করলো,
_”বাহ ভাই, মেয়ে ঠিক করে রেখেছো নাকি? তা বিয়ে খাচ্ছি কবে?”
_”উমম.. দু বছর পর।”
_”এতদিন! কেন?”
দর্শন একনজর রজনীর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে,
_”অকালে জেলে যাওয়ার শখ নাই আমার।”
_”কবে থেকে শুধু সেই মেয়ের প্রশংসাই তো শুনতেছি। মিলিয়ে নিও, ঐ মেয়ে তোমাকে পছন্দও করবে না।”
ইরার এমন কথায় আবারো হাসলো দর্শন,প্রতিত্তরে বললো,
_”করবে না? ডোন্ট ওরি, পছন্দ করিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব আমার।”
_”আচ্ছা আচ্ছা কথা পরে, আগে আইসক্রিম টা তো বের করো।”
ইরা গিয়ে আইসক্রিম বের করে সবার হাতে দিলো। তারপর নিজেও সোফায় গিয়ে বসলো। তবে এরই মধ্যে কান্না জুড়ে দিলো আয়রা। তারও এবার আইসক্রিম চাই, রজনী তাকে নিজের আইসক্রিম দিতে চাইলেই ইরা বাঁধা দিয়ে বলে,
_”আরে ওকে দিসনা রজনী, ছোট বাচ্চা আইসক্রিম খেতে হবেনা ওর।”
_”আপু সমস্যা নেই। জানোই তো,আমার এমনিতেই ঠান্ডার সমস্যা। কদিন বাদেই আবার প্রি টেস্ট, এই সময় ঠান্ডা লাগলে মহা ঝামেলায় পরে যাবো।”
রজনী নিজের আইসক্রিম টা হাসিমুখে আয়রা কে দিয়ে দিলো এবার। দর্শন তৎক্ষণাৎ বলে ওঠে,
_”ভালো কথা মনে করিয়েছিস, কাল রাতে এমনিতেই নাক বন্ধ হয়ে ছিলো। এখন আইসক্রিম খেয়ে গলা নষ্ট করে আর কাজ নেই ভাই।”
আফিয়া আর ফাহমিদা রান্নাঘরে পকোরা বানাচ্ছিলেন, আফিয়া তা নিয়ে আসতেই দর্শন আইসক্রিম টা তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,
_”এটা ফ্রিজ এ রেখে দাও তো মামি, আয়রাকে পরে দিও।”
ইনাম আড়ালে হাসলো সামান্য, দর্শন এর কোনোকালেই ঠান্ডার সমস্যা ছিলোনা এটা সে ভালো করেই জানে। রজনী আর তাকালো না দর্শনের দিকে, এমনটা সে আগেও করেছে। নতুন কিছুই নয়। আফিয়া আইসক্রিম টা নিয়ে যেতেই দর্শন পকেট থেকে একটা চকলেট বের করে তা অর্ধেক করে বলে,
_”আমরা বরং অন্য কিছু খাই, নে ধর..”
বলেই অর্ধেক চকলেট এগিয়ে দিলো রজনীর দিকে, রজনী মৃদু হেসে নিলো সেটা। দর্শন নিজের চকলেটটুকু মুখে পুরতেই ইরা বলে ওঠে,
_”সঙ্গে চকলেট নিয়ে ঘোরা হচ্ছে? হুম হুম, ভালো ভালো।”
_”জীবনে তো একটা টিউশনি ও করিয়ে দেখলি না। টিচার দের এমন সাথে কয়েকটা চকলেট রাখতে হয় গিফট হিসেবে,তুই বুঝবি কি করে?”
_”তুমি সবসময় খোঁটা দাও কেনো আমাকে? জামাই এর টাকা খরচ করাও একটা আর্ট। তাইনা?”
আয়ানের উদ্দেশ্যে বললো ইরা,আয়ানও সম্মতি জানিয়ে বলে,
_”অবশ্যই।”
হাসলো সকলে। আগেই সকলে আইসক্রিম খাওয়া শেষ করলো। আয়রা ঘুমিয়ে পরলো তার মাঝেই,ইফতিও ঘুমিয়ে পরেছে। বাকিরা এবার কোয়েশ্চেন এন্সার গেইম খেলবে, রজনী ইরার হাতে মেহেদী দিতে বসলো। এটাও ফিক্সড হয়ে গেছে, ইরা এই বাড়িতে এলেই রজনী হাতে মেহেদী দিয়ে দিতে হবে।
বোতল ঘোরানো হলো এবার। প্রথমেই তা গিয়ে থামলো দর্শন এর দিকে, ইরা খুশি হয়ে তাকে প্রশ্ন করলো,
_”আর কিচ্ছু জানতে চাইনা। শুধু আমাদের হবু ভাবির নামটা বলে দাও।”
দর্শন গা ছাড়া ভাব নিয়ে বলে,
_”ওটা বলা যাবেনা।”
_”এটা ঠিক না, আচ্ছা একটা হিন্ট তো দাও।”
_”উমম,একটা গান গাই। তার মধ্য থেকে নাম খুজে বের করতে পারলে কর।”
সোফায় হেলাম দিয়ে বসলো দর্শন,একহাতে মাথা ঠেকিয়ে গেয়ে উঠলো,
“পূর্ণিমা সন্ধ্যায়, তোমার রজনীগন্ধায়
রূপসাগরের পাড়ের পানে উদাসী মন ধায়,
পূর্ণিমা সন্ধ্যায়, তোমার রজনীগন্ধায়
রূপসাগরের পাড়ের পানে উদাসী মন ধায়,
তোমার প্রজাপতির পাখা,
তোমার প্রজাপতির পাখা
আমার আকাশ চাওয়া মুগ্ধ চোখের
রঙিন স্বপন মাখা,
তোমার চাঁদের আলোয়..
মিলায় আমার দুঃখ-সুখের সকল অবসান।
তোমার হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান
ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান,
আমার আপনহারা প্রাণ,
আমার বাঁধন ছেঁড়া প্রাণ
তোমার হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান
ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান।”
ইরা হতাশ শুরে বললো,
_”এতগুলো লাইন থেকে একটা ওয়ার্ড কি করে খুজে বের করবো?”
_”সেটা তুই ভালো জানিস।”
_”পূর্নিমা?”
_”অবশ্যই না।”
_”সন্ধ্যা?”
_”নোপ..”
ইরা এবার রজনীকে উদ্দেশ্য করে বলে,
_”তুই কিছু বল।”
রজনী মেহেদী দেওয়াতেই মনোযোগী ছিলো, ইরার দিকে তাকিয়ে বলে,
_”আমি পারবো না গেস করতে, এমনিতেই আমার কোনো ধারণা মিলেনা।”
দর্শন শান্ত করে বলে,
_”ধারণা করলে তো মিলবে!”
ইনাম ফোনটা হাতে নিয়ে তার দিকে নজর দিয়ে বললো,
_”পারবিনা পারবিনা। কেউ পারবিনা।”
_”আরে তুমিতো আরেকজন, জেনেও বলছোনা কিছু। দেখবো দেখবো,বিয়েতে সব কাজ কে করে সেটাও দেখবো।”
বলেই ফোস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো ইরা, পরক্ষনেই হাসিমুখে বললো,
_”তোমার ঐ ব্রাউন হেয়ার ক্রাশ এর মতো দেখতে নাকি?”
_”ছ্যাহ..কালো চুলের উপরে কিচ্ছু নেই। এন্ড সি ইজ দা সেকেন্ড মোস্ট বিউটিফুল গার্ল ইন মাই আইজ।”
ইনাম ফোনের থেকে চোখ সরিয়ে বলে,
_”বোনু? তুই বল, কেমন ভাবি চাই।”
রজনী মুচকি হেসে বলে,
_”কালো চুল হোক আর লাল চুল,তা দিয়ে আমি কি করবো? আমাকে ভালোবাসবে,আদর করবে, স্নেহ করবে এমন একজনকে নিয়ে এলেই চলবে।”
দর্শন তাকালো রজনীর দিকে, শান্ত স্বরে বললো,
_”তোকে ভালোবাসবে, আদর করবে, স্নেহ করবে এমন একজনকেই এনে দেবো,প্রমিজ..”
ইনাম ডাটা অন করতেই দেখলো একটা আইডি থেকে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট, টু মিউচুয়াল ফ্রেন্ড, আইডির নাম সাহারা ইয়াসমিন,নিকনেইম এ দেওয়া সারা। রিকুয়েস্ট এক্সেপ্ট করতেই দটো মেসেজ স্ক্রিনে ভেসে উঠলো। প্রথমে বানরের লজ্জা পাওয়া ইমোজি, তারপর এর টা,
_”হেলো মিস্টার নুডুলস, জলদি রিকুয়েস্ট এক্সেপ্ট করুন, নাহলে সত্যি সত্যিই নুডুলস হয়ে যাবেন,আমিন।”
এরই মাঝে বোতল ঘোরানো হলো আবার,এবার প্রশ্ন করা হবে ইনাম কে। ইরা সরাসরি বলে উঠলো,
_”তুমি এই মুহূর্তে কার আইডিতে আছো সেটা বললেই চলবে।”
ইনাম বিরক্তি নিয়ে ক্ষীণ স্বরেই বলে ওঠে,
_”এক খাপছাড়া মেয়ে..”
_”মেয়েএএএএ!”
বেশ টেনে বললো ইরা। ইনাম ফোন থেকে চোখ তুলে দেখলো সবাই হা করে তাকিয়ে আছে তার দিকে। ভ্রুযুগল কুঁচকে নিলো সে। শতভাগ নিশ্চিত,কিছু না হতেই এবার তাকে পঁচানি খেতে হবে..
#চলবে?