#সেই_রজনী_দর্শনে🌙 |৮|
#তাসনিম_জাহান_মৌরিন
রাত বারোটা বাজতে আর পাঁচমিনিট বাকি। রজনী বিছানায় পা দুলিয়ে বসে গল্পের বই পড়ছে, রাফিন আজকে ঘুমিয়েছে হালিমার সঙ্গে। নাতি আবার তার ভীষণ আদরের,ছেলে বলে কথা!
ঘরের দরজা খোলাই ছিলো,সবসময় খোলাই থাকে। রজনী মনোযোগী বই পড়ার ক্ষেত্রে। ঠিক তখনই গুটিগুটি পায়ে ঘরে প্রবেশ করলো দর্শন। হাত দুটো দ্বারা পিছনে কিছু আড়াল করেছে সে। রজনীর দৃষ্টি তখনো বই এর দিকে, মুচকি হাসলো দর্শন। কেক এর বক্স টা সাবধানতার সাথে টেবিলে রেখে দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে দিলো সে। এবারে ধ্যান ভাঙলো রজনীর,পাশ ফিরে তাকালো, তবে দর্শনকে দেখার আগেই হঠাৎ ঘরের লাইট নিভে গেলো, অন্ধকারে ছেয়ে গেলো চারিপাশ। ফ্যান বন্ধ হওয়া দেখে বোঝা গেলো কারেন্ট চলে গিয়েছে।
আকস্মিকভাবে ভীষণ ভয় পেয়ে যায় রজনী, কারণটা শুধুই অন্ধকার নাকি অন্যকিছু তা দর্শনের জানা নেই। কাপাকাপা পায়ে উঠে দাঁড়ায় রজনী, পিছনে এগোতে এগোতে বলে,
_”ক কে ওখানে? দরজা আটকালে কেন?”
রজনীর ভয়ার্ত কণ্ঠ শুনেই তারদিকে এগিয়ে আসে দর্শন। সামনে এসে তার হাত ধরে কিছু বলবে তার আগেই ছিটকে দূরে সরে যায় রজনী। দর্শন ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলে,
_”রজনী, আমি। ভয় পাস না।”
দর্শনের কণ্ঠ যেন কানেই গেলোনা রজনীর। অতিরিক্ত ভয় পেয়ে গেলে তার আকস্মিক শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে যায়। রজনী জোরেজোরে নিঃশ্বাস নিয়ে বললো,
_”এদিকে এগোবে না, চ চলে যাও প্লিজ।”
ভ্রুযুগল কুঁচকে নিলো দর্শন। রজনী কি তাকে চিনতে পারছে না? তার কণ্ঠে এবার আরো বিচলিত হলো দর্শন। দ্রুত পকেট থেকে নিজের ফোনটা বের করে ফ্ল্যাশ লাইট জ্বালালো সে। ফোনটা উল্টো করে বিছানায় ছুড়ে ফেলে রজনীর দিকে এগোলো। তার দু কাঁধে হাত রেখে বললো,
_”রাতপাখি, রিল্যাক্স। অন্য কেউ নেই এখানে, আমি আছি। চিনতে পারছিস না আমাকে?”
সামান্য আলোয় দর্শনকে চিনতে পারলো মুহূর্তের মাঝেই, তবুও যেন তার অস্থিরতা কমলো না। ঠোঁটজোড়া কাঁপছে তার,জোরেজোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে তখনো। দর্শন দ্রুত তাকে বিছানায় বসালো। তারপর নিজে ওর সামনে বসে একটা হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললো,
_”তুই শান্ত হ আগে, কাম ডাউন। কিচ্ছু হয়নি, কিচ্ছু না। টেইক আ ডিপ ব্রিথ।”
দর্শনের কথামতো শান্ত হওয়ার চেষ্টা করলো রজনী, জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে ভেজা ঢোক গিললো সে। সম্পূর্ণরূপে শান্ত হতে পারলো না তখনো। এদিক ওদিক নজর দিয়ে বললো,
_”দ দরজাটা খুলে দাওনা ভাইয়া।”
বিস্মিত চোখে রজনীর দিকে তাকালো দর্শন। রজনী তাকাচ্ছেনা তার দিকে,অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে কথাটা বললো সে। তার গালে হাত দিয়ে নিজের দিকে ফেরালো দর্শন, ধীর কণ্ঠে বললো,
_”রাতপাখি? আমাকে ভয় পাচ্ছিস তুই? কি হয়েছে তোর, বল আমায়।”
উত্তর দিলোনা রজনী, সে তখনো অদ্ভুত দৃষ্টিতে দরজার দিকে তাকানোর চেষ্টা করছে। দর্শন দেড়ি করলোনা,সঙ্গে সঙ্গে উঠে দরজা খোলার জন্য পা বাড়ালো। তবে এক কদম পা বাড়াতেই আলো জ্বলে উঠলো ঘরের। এগোলো না দর্শন, ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো রজনীর দিকে।
রজনী বুকে হাত দিয়ে লম্বা নিঃশ্বাস ছাড়লো এবার। তবুও শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক হচ্ছেনা তার। দ্রুত বেডসাইড টেবিলের ড্রয়ার থেকে কাপাকাপা হাতে ইনহেলার টা বের করলো রজনী। ইনহেলার নেওয়ার কয়েক সেকেন্ড পর ধীরেধীরে স্বাভাবিক হতে পারলো সে, চোখ বন্ধ করে রাখলো তখনো। ধীরেধীরে চোখ খুলতেই দেখলো দর্শন তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কিঞ্চিত ঘাবড়ে গেলো সে, সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাড়াতেই দর্শন পুনরায় বসিয়ে দিলো তাকে। মেঝেতে হাটু ভাজ করে বসে রজনীর পানে চেয়ে বলে,
_”ঠিক আছিস এখন?”
মাথা নাড়ায় রজনী, নিচের দিকে তাকিয়ে বলে,
_”হঠাৎ কারেন্ট চলে গিয়েছিল তো,তাই ভয় পেয়ে গেছিলাম ভাইয়া।”
_”কি মনে হয় রাতপাখি? কতটা চিনি আমি তোকে?”
_”হুম?”
দর্শন তার দৃষ্টি স্থির রাখলো। কিছুক্ষন নিচের দিকে তাকিয়ে পুনরায় উপরে চেয়ে বললো,
_”যেই পরিস্থিতি ই হোক, তুই আমাকে ভয় পাবি! এটা মানতে পারলাম না। কাকে ভয় পাচ্ছিলি তুই?”
_”আমি কাউকে ভয় পাবো কেন? অন্ধকার..”
রজনীর গালে হাত রাখলো দর্শন,থামলো রজনী। দর্শন স্মিত হেসে বললো,
_”এতটুকু তোকে চিনে থাকলে, এটা স্পষ্ট বলতে পারি, আমার থেকে অনেক বড় কিছু লুকোচ্ছিস তুই। আমি যদি অন্তর পড়তে পারতাম,তাহলে খুব ভালো হতো রে।”
_”কিছু লুকোচ্ছিনা ভাইয়া,তুমি ভুল ভাবছো।”
নিচের দিকে তাকিয়ে বললো রজনী। এমন সময় ফোনের টাইমার বেজে উঠতেই দুজনে তাকালো সেদিকে। দর্শন একহাতে ফোন নিয়ে সেটা অফ করে তাকালো রজনীর দিকে। ওষ্ঠাধর প্রশস্ত করে বললো,
_”শুভ জন্মদিন রাতপাখি”
রজনী অবাক চোখে তাকালো, দর্শন উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
_”এবার বল,ভুলেই গিয়েছিলি।”
_”ভুলিনি, কিন্তু আমি ভাবছিলাম আজকে ২৮ তারিখ।”
_”সে যাই হোক,ফার্স্ট উইশ আমার তাহলে?”
হাসলো রজনী,উত্তরে বললো,
_”আর কতজন ই বা আছে উইশ করার?”
কথা বারালো না দর্শন। নিঃশব্দে পাশ থেকে চেয়ার টা এনে সামনে রাখলো, এরপর টেবিল এর উপর থেকে কেকটা এনে চেয়ারের উপর রাখতেই রজনী বলে উঠলো,
_”এসব কেন আনলে ভাইয়া? জানো তো, দাদু বা আব্বু টের পেলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। আমাকেই আবার..”
_”হুশ.. চুপ থাক। ফার্স্ট অফ অল, তারা কেউ কিছু দেখতে পায়নি আর পাবেও না। আর দেখতে পেলেও, কি করবে? তোর আগে আমাকে বকবে, সিম্পল।”
_”কিচ্ছু বলবেনা তোমাকে, যা বলার আমাকেই বলবে।”
_”বললে বলবে, তোর কান দুটো তো। একটা দিয়ে শুনে অন্যটা দিয়ে বের করে দিবি,এবার কেকটা কাট।”
কেকের দিকে তাকালো রজনী। উপরে লেখা, “Happy birthday dear night bird”। মুচকি হাসলো রজনী। ছোট নিঃশ্বাস ছেড়ে দর্শনের হাত থেকে ছুড়িটা নিয়ে কেক কাটলো এবার।
_____
_”স্যার,লিখা শেষ।”
খাতা হাতে দাঁড়িয়ে কথাটা বললো রজনী। ধ্যান কাটলো না দর্শনের, সে একদৃষ্টিতে হাতের মার্কারটা ঘুরিয়ে কিছু ভেবে চলেছে। রজনী কিছুটা সময় অপেক্ষা করে আবারো বললো,
_”স্যার..”
বাস্তবে ফিরলো দর্শন। দু সেকেন্ড সময় নিয়ে বললো,
_”হুম.. শেষ? নিয়ে আ..”
থামলো দর্শন,পুনরায় বললো,
_”এদিকে নিয়ে এসো।”
খাতা নিয়ে সামনে এলো রজনী। দর্শন তাকালো তার দিকে, খাতাটা টেবিলের উপর রাখলো রজনী। দর্শন সেটার দিকে তাকিয়ে ডান হাতটা সামান্য উঁচু করতেই চোখ মুখ খিঁচিয়ে নিলো সে। আস্তেধীরে হাত কয়েকবার নাড়ানোর চেষ্টা করলো। রজনী ক্ষীণ স্বরে বললো,
_”থাক,সাইন করতে হবেনা।”
_”পেন দে..”
দর্শন ও আস্তে বললো কথাটা,বাকিদের কানে তা যায়নি। রজনী কলম এগিয়ে দিতেই দর্শন বাম হাতে নিলো কলমটা। বাম হাতেই পৃষ্টা উলটে দেখলো, তারপর ছোট করে টিক দিয়ে কলমটা ফিরিয়ে দিলো।
_”ঠিক আছে।”
খাতাটা নিয়ে চলে গেলো রজনী। দর্শন ধীরেধীরে হাত ভাজ করার চেষ্টা করছে তখন। বাকিদের লেখা হয়নি তখনো,আর সারা সেই কখন থেকে কেবল খাতায় আঁকিবুঁকি করে চলেছে। রজনী পাশে এসে বসতেই সে স্বল্প স্বরে বলে,
_”মিস্টার নুডুলস এর এফবি আইডির নামটা কি রে?”
_”কে মিস্টার নুডুলস?”
ভ্রু কুঁচকে বললো রজনী, সারা নিজের কপালে চাপড় মেরে বললো,
_”আরে, ঐযে তোর কাজিন। এসেছিল বাইরে.. তার।”
_”ইনাম ভাইয়া?”
_”হ্যা হ্যা উনি ই”
_”তুই ওর এফবি আইডি দিয়ে কি করবি?”
_”এত প্রশ্ন করিস না তো। খাতায় লিখে দে আইডির নামটা।”
কথাটা বলেই সারা খাতাটা এগিয়ে দিলো, রজনী আর কিছু না বলে লিখে দিলো আইডির নামটা।
ক্লাস চললো আরো কিছুক্ষন। ছুটি হওয়ার পর সবাই বেরিয়ে গেলো একে একে। ক্লাসে থাকলো কেবলই রজনী আর দর্শন। এখন অপেক্ষা করতে হবে ইনাম এর জন্য। রজনী এগিয়ে এসে সামনের বেঞ্চ এ বসলো এবার। দর্শন তখনও হাত স্বাভাবিক ভাবে নাড়াতে পারছিলো না। রজনী তার দিকে তাকিয়ে বললো,
_”বেশি প্রবলেম হলে ডাক্তার এর কাছে যাও।”
দর্শন বিরক্তির ভাব নিয়ে হাতটা বেঞ্চের উপর রেখে বললো,
_”ধুর, কি করবে সে?”
কিছু বললোনা রজনী, হালকাভাবে ম্যাসেজ করতে লাগলো সে, এই অভ্যাস তার আছে অনেক আগে থেকেই। ছোটখাটো ডাক্তারি করতে ভালোই লাগে, তবে ডাক্তার হওয়ার শখ তার কোনোকালেই ছিলো না।
প্রায় পাঁচমিনিট আলতো হাতে ম্যাসেজ করলো রজনী, দর্শন একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তার দিকে। সেদিকে তাকালে হয়তো আটকে যেত রজনী নিজেও, তবে সে নিজের কাজে মনোযোগী। পরিশেষে চোখ তুলে বললো,
_”ঠিক আছে এবার? ছেড়ে দেবো?”
_”যদি না বলি?”
কথাটা বলে পরমুহূর্তেই আস্তেধীরে হাতটা সরিয়ে নিলো দর্শন। এখন একটু স্বাভাবিকভাবে নাড়াতে পারছে হাতটা। দু তিনবার হাত ভাজ করে দেখলো দর্শন। রজনী শান্ত স্বরে বললো,
_”কিছু বলছিলে..”
স্মিত হাসে দর্শন। রজনীর দিকে তাকিয়ে বলে,
_”শুনতে চাস? সিওর?”
কথাটা বলেও রজনীকে উত্তর দেওয়ার সুযোগ দিলোনা দর্শন। একহাতে তার গাল টেনে দিয়ে হাসলো সামান্য। রজনী ভ্রুকুঞ্চিত করে বলে,
_”সবাই আমার গাল টেনে কি শান্তি পাও ভাই?”
_”সরি সরি,দেরি হয়ে গেলো একটু।”
ক্লাসে প্রবেশ করে বলে ইনাম। রজনী তৎক্ষণাৎ দাঁড়িয়ে বলে ওঠে,
_”আরেকটু দেরি করতে,রাতে খেয়েদেয়ে যেতাম।”
ইনাম মাথা চুলকে সামনে এগিয়ে আসে। এরপর রজনীর গাল টেনে দিয়ে বলে,
_”সরি বোনু।”
রজনী একবার ইনামের দিকে তাকিয়ে আবার দর্শনের দিকে তাকায়। দর্শন কিছুক্ষন নিরব থেকে হো হো করে হাসতে শুরু করে। হাসতে হাসতে উঠে দাড়িয়ে বলে,
_”আরেক গ্রুপ এখনো বাড়িতে অপেক্ষা করছে শুনলাম। তোর গালের মাগফেরাত কামনা করি।”
#চলবে?