#সেই_রজনী_দর্শনে🌙 |৭|
#তাসনিম_জাহান_মৌরিন
ঘড়িতে সকাল সাতটা বাজে। রজনী স্কুল ড্রেস পরে ডাইনিং টেবিলে বসে আছে, হিজাবটা শুধুই মাথায় দেওয়া, এখনো বাঁধা হয়নি। হাতের বামপাশে জীববিজ্ঞান বই, তার দিকে দৃষ্টি রজনীর। আফিয়া ডিম আর পরোটা এনে টেবিলে রেখে বললেন,
_”অনেক পড়া হয়েছে, এবার খেয়ে নাও তো। স্কুলে দেরি হয়ে যাবে নাহয়।”
রজনী বইটা বন্ধ করে হাত ধুয়ে এলো, এরপর খাওয়া শুরু করলো। দু মিনিট বাদে সেখানে উপস্থিত হয় দর্শন। এতো তাড়াতাড়ি তার ঘুম থেকে ওঠার কথা নয়, এমনকি বাড়ির কেউই এখনো ঘুম থেকে ওঠেনি। ফাহমিদার শরীরটা ভালো নেই, তাই শুয়ে আছেন এখনো, নাহলে উঠে পরতেন। হালিমা নামায পরে পুনরায় ঘুমোতে যান, আর জাহিদ ওঠেন আটটার দিকে।
দর্শন এসে অপর পাশের এক চেয়ারে বসতেই আফিয়া প্রশ্ন করলেন,
_”কি ব্যাপার, আজ এতো তাড়াতাড়ি উঠে গেলে?”
_”ঘুমোই নি তো মামি।”
রজনী আগেই আন্দাজ করেছিল, নাহয় দর্শন এতোটাও ভদ্র ছেলে নয় যে সকাল সকাল উঠে পরবে। রজনী খাওয়ার মাঝেই বলে ওঠে,
_”কেন? হাতে ব্যাথা ছিলো?”
দর্শন তাকায় রজনীর দিকে। ঠিকই বুঝে গেলো মেয়েটা। কি করে বুঝলো? তার চোখেমুখে কাতরতার ছাপ দেখে? বুঝতেই পারে, অন্য কোনো চিন্তা মাথায় এনেও আনলো না দর্শন। এক বাড়িতেই তো থাকছে ছোটবেলা থেকে, এতটুকু ধারণা এমনিতেও করতে পারে।
ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে মাথা নাড়লো দর্শন। এই হাতে ব্যাথা তাকে ছয় বছর ধরে ভোগাচ্ছে। ইন্টার পরিক্ষা দেওয়ার পরপরই একটা এক্সিডেন্ট হয় দর্শন এর। শরীরের খুব বেশি ক্ষতি না হলেও,হাত ভেঙেছিল বাজেভাবে। দুবার অপারেশন ও করানো হয়েছে, ছয়মাস এর বেশি সময় লেগেছে এই হাত ঠিক হতে। তাও ছিলো ডান হাত, একবছর গ্যাপ গিয়েছিল তার কারণেই। এখনও অনেক্ষন লিখতে গেলে সমস্যা হয় হাতে, তাছাড়াও মাঝেমধ্যে ব্যাথা হয়,অনেক ক্ষেত্রে কয়েক ঘণ্টা আবার কিছু ক্ষেত্রে তা দু তিন দিনও স্থায়ী হয়। তেমন ই হয়েছিল কাল রাতে। পড়তে বসেছিল ঠিকই, তবে এক ঘন্টা পড়তেই হাতে ব্যাথা শুরু হয় তার। ঔষধ খেয়ে নিলে তাড়াতাড়ি ই কমে যেতো, তবে অতো রাতে আর বেরোতে ইচ্ছে করেনি।
বেশ অনেক্ষন টেবিলে মাথা ঠেকিয়ে রাখলো দর্শন, হাতে ব্যাথা কমেছে খানিকটা। এখন ঘুম পাচ্ছে, আবার পাচ্ছেনা এমন এক অবস্থা। রজনী খাওয়া শেষ করে হিজাবটা বেধে নিলো। এরপর ব্যাগ নিয়ে এসে দর্শন এর উদ্দেশ্যে বললো,
_”হাতে ব্যাথা নিয়ে পড়াতে হবেনা আজকে, ক্যানসেল করবে?”
মাথা তুললো দর্শন। চোখ টেনে বললো,
_”উম হু, সমস্যা হবেনা। পড়াবো আমি।”
_”তাহলে যা বলেছি..”
_”জি ম্যাম, মনে আছে। আপনার কথামতোই কাজ করছি। আপনি নিশ্চিন্তে বিদ্যালয়ে যাত্রা শুরু করতে পারেন।”
অতি শুদ্ধভাবে বললো দর্শন, রজনী হাসলো সামান্য। আফিয়া জিজ্ঞেস করলেন,
_”কিসের কথা?”
_”সেটাতো সারপ্রাইজ আম্মু। কিন্তু, আজকে আমি ইনাম ভাইয়াকে বাড়িতে নিয়ে আসবোই। এটা রজনীর প্রমিস। আসছি হ্যা, টাটা..”
বেরিয়ে গেলো রজনী। দর্শন উঠে ঘরে চলে গেলো এবার, ঘুমোতে হবে এখন, নাহলে কোনো কাজে মন বসবে না।
_____
রজনীর কথামতোই কাজ করলো দর্শন। পাঁচটার আগেআগে ব্যাচ এর সামনে আসতে বললো ইনামকে। উদ্দেশ্য একটাই, ইনামকে রজনীর সামনে দাড় করানো। তারপর বাকিটা রজনী দেখে নেবে।
দর্শন এক্ষেত্রে একটু মিথ্যে বলেছে, আজকে কোনো ব্যাচ পড়াবেনা বলেছে,তবে পাঁচটা বাজেই রজনীদের ব্যাচ পড়তে আসবে এ কথা ইনামকে জানায়নি সে। ইনামও সাড়ে চারটার দিকেই চলে এলো ব্যাচ এর সামনে। দর্শন বাহিরেই বাইকে হেলান দিয়ে দাড়িয়েছিলো,তবে আশ্চর্যজনক ভাবে তার একটু পাশে রজনীও দাঁড়িয়ে ছিলো। মহা বিপদে পরলো ইনাম। এখান থেকে চলে যাওয়াও সম্ভব হচ্ছে, আবার অতীতের এক অজানা কারণে রজনীর সম্মুখে দাঁড়াতেও ইচ্ছে করছেনা। রিক্সাভাড়া মিটিয়ে নেমে দাঁড়ালো ইনাম। দৃষ্টি তার এদিক ওদিক বিচরণ করছে, যেন সে পণ করেছে রজনীর দিকে তাকাবেই না।
দর্শন একনজর রজনীর দিকে তাকিয়ে ইশারায় জিজ্ঞেস করলো এখন কি করবি? রজনীও চোখের ইশারায় বোঝালো আগে ক্লাসের ভিতরে বলো। দর্শন হাসমুখে ইনানের উদ্দেশ্যে বললো,
_”সারপ্রাইজটা ভালো না?”
ইনাম রেগে যেতে পারতো, চোখ গরম দিতে পারতো। তবে সে কোনো কিছুই করলো না, কেবল তাকিয়ে রইলো অন্যদিকে। কারণটা দর্শন না বুঝলেও রজনী বুঝেছে ভালো করেই।
বিষয়টা অপরাধবোধ এর,লজ্জার , আর এই চারবছর ধরে সি লজ্জাবোধ থেকেই রজনীর দিকে চোখ তুলে তাকানোর সাহস পায়নি ইনাম। চেষ্টা করেও পারেনি বলা চলে।
_”এখানে দাঁড়ায় থাকবি মামা? ভিতরে চল। স্টুডেন্ট আসবে আরো বিশমিনিট পর।”
নিঃশব্দে ক্লাসে গিয়ে বসলো ইনাম। সামনের বেঞ্চে বসলো রজনীও। দর্শন চাবিটা টেবিলের উপর রাখতে রজনী বলে উঠলো,
_”ভাইয়া, কিছু খাওয়াবে না? এমনি এমনি বসে থাকবো? চিপস,চানাচুর কিছু নিয়ে আসো।”
রজনী সচরাচর কিছু খাওয়ার আবদার করেনা। দর্শন বেশ ভালোই বুঝতে পারলো সে ইনামের সাথে কথা বলবে বলেই দর্শন কে যেতে বলছে। দর্শন ও, “যাচ্ছি” বলে বেরিয়ে গেলো।
ইনামের নজর এখনো নিচের দিকেই। রজনী মৃদু হেসে বলে,
_”তাকাবেও না আমার দিকে? সাধারণ খোজ খবর টুকুও নেবে না? মানুষ তো দুঃসম্পর্কের বোনের সাথেও এমন করেনা ভাইয়া, আমি তার থেকেও পর?”
চোখ বন্ধ করে নিলো ইনাম। কিভাবে বোঝায় এই মেয়েকে? তার দিকে তাকালেই যে লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে। তবুও মিথ্যে হাসি মুখে এনে রজনীর দিকে তাকিয়ে বললো,
_”আমি বলেছি তা? ছাড়, কেমন আছিস?”
_”কেমন থাকি আমি? তেমন ই আছি। ভালোও বলা চলেনা। আবার অতিমাত্রায় খারাপও বলা চলেনা, কারণ আমার চেয়েও অনেক খারাপ অবস্থায় মানুষ থাকছে।”
ইনাম আবারো চুপ করে গেলো। রজনী শান্ত কণ্ঠে বললো,
_”আমাকে ভালোবাসার মানুষের খুব অভাব ভাইয়া। তুমি জানো সেটা, তাও সব জেনেশুনে সেই সংখ্যাটাকে আরো কমিয়ে দাও কি করে?”
_”তুই ভুল ভাবছিস বোনু, আমি তেমনটা চাইনি।”
_”কেউ কিছুই চায়না, বিশেষ করে আমাকে চায়না। আমি থাকলে কি আর না থাকলেই বা কি? বলতে পারো, গত একবছরে ঈদ মোবারক জানানো ব্যাতীত একটা কথাও তুমি বলেছো আমার সাথে? আরে দূরের আত্মীয়দের ও মানুষ খোজ খবর নেয়, তুমিতো তাও নেওনা।”
ইনাম নিরবতা বজায় রাখলো,বলার মতো কিছু নেই তার কাছে। রজনী কিছুক্ষন থেমে বললো,
_”নিতে হবেনা আমার খোজ, কথাও বলতে হবেনা আমার সাথে। সবাই আলাদা করেই রাখো আমাকে, কোনো সমস্যা নেই। তুমি শুধু বাসায় চলো একবার..”
_”ঐ বাড়িতে পা রাখার ইচ্ছে হয়না বোনু, একটু বোঝার চেষ্টা কর।”
_”তাহলে, সব দোষ আমার। সেটাই বলছো তো?”
ইনাম ব্যতিব্যস্ত হয়ে বললো,
_”না না বোনু, তোর দোষ কেন হতে যাবে?”
_”সর্বোচ্চ দোষি তো আমিই ভাইয়া। জন্মটাই তো ভুল, মেয়ে হয়ে জন্মানোটা আরো বড় ভুল।”
রজনীর কণ্ঠ কাঁপলো একবার। ইনাম কিছু বলার আগেই সে পুনরায় বললো,
_”তুমি যদি আজকে বাসায় না যাও, তাহলে আমি ওটাই বুঝবো। আসল দোষি আমি..”
_”ব্লাকমেইল করছিস আমাকে,বোনু?”
রজনী হেসে বলে,
_”ব্লাকমেইল করে সবার ভালোবাসা পাওয়া গেলে,খুব ভালো হতো ভাইয়া। আপাতত তোমাকে বাসায় নেওয়া সম্ভব হলেই চলবে।”
ইনাম উঠে দাড়ালো। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রজনীর সামনে এসে দাড়ালো,হাত বুলিয়ে দিলো তার মাথায়। মুচকি হেসে জানান দিলো সে যাবে। রজনী তার ভারি আদরের, তাকে নাম ধরে কয়বার ডেকেছে তাও ঠিক মনে পরেনা ইনাম এর। ছোটবেলা থেকে এতো মিষ্টি দেখতে মেয়েটা! সবাই মিলে ওর গাল টানতো শুধু, বিশেষ করে ইনাম আর ইরা। ইরাও তাদেরই চাচাতো বোন,মেজো চাচার মেয়ে। কাজিন গ্রুপে, কারো বাড়িতে যাওয়ার খুব বেশি অনুমতি রজনীকে দেওয়া হয়নি। তাই ভাইবোনেদের সঙ্গে তার যোগাযোগ ও খুব একটা গভীর নয়। তাদের মধ্যে ইনাম আর দর্শন ই ব্যতীক্রম ছিলো। দর্শন এখনো আছে, তবে ইনাম তো বদলে গেলো সেই চারবছর আগেই। রজনী যেন জন্মেছেই এই ভাগ্য নিয়ে, সবার ভালোবাসা নিয়ে বাঁচার অধিকার তাকে দেওয়াই হয়নি।
দর্শন এলো হাতে তিন প্যাকেট চিপস নিয়ে। চারবছর আগে ঠিক কি হয়েছিল, তা দর্শনের অজানাই রয়ে গেলো। রজনীও বলেনি, না ইনাম বলেছে। এক পর্যায় বাধ্য হয়ে জানার ইচ্ছেই ত্যাগ করলো দর্শন। শুধু একটাই ইচ্ছে, ইনাম স্বাভাবিক হয়ে যাক। ক্লাসে এসে ইনামকে রজনীর সঙ্গে কথা বলতে দেখে এতটুকু বুঝতে পারলো, একটু হলেও স্বাভাবিক হচ্ছে ইনাম। নইলে তাকে ধরে বেধেও রজনীর সাথে কথা বলাতে পারেনি সে।
দশমিনিট বাদে দু তিনজন স্টুডেন্ট আসতেই রজনী উঠে পিছনের বেঞ্চে চলে গেলো। ইনামও চলে গেলো ক্লাস থেকে। তবে বলে গেছে, ছয়টার দিকে আসবে, একসাথেই বাড়ি যাবে।
দরজা থেকে বেরোতেই ইনাম দেখতে পায় একটা মেয়ে দ্রুত পায়ে আসছে এদিকে, কাধে ব্যাগ নিয়ে। একটু লক্ষ্য করতেই চেনাচেনা মনে হলো মেয়েটাকে, অনেক আগে দেখেছিলো এক দুবার, রজনীর ছোটবেলার বান্ধবী বোধ হয়।
ইনাম ঠিকঠাক চিনতে না পারলেও সারা যেনো পুরোপুরি চিনতে পারলো তাকে। অতিমাত্রায় খুশি হওয়ার ভঙ্গিতে তার সামনে এসে বললো,
_”হায় মিস্টার নুডুলস! আপনি ফাইনালি এসেছেন? আমি কিন্তু রজনীর মুখে আপনার কথা শুনেছি, চুল দেখেই চিনতে পেরে গেছি।”
কোকড়া চুল বলে কিনা মিস্টার নুডুলস বানিয়ে দিলো? ইনাম বিরক্তির স্বরে বললো
_”আমি রজনীর ভাই, সেই হিসেবে তোমারও ভাই। সম্মান দিয়ে কথা বলো মেয়ে..”
_”এতো ভাই দিয়ে কি হবে জীবনে? দু তিনটে তো জামাই ও দরকার।”
_”কিহহহ!”
সারা জীভে কামড় দিয়ে বলে,
_”ওপ্স সরি, একটা তো জামাই ও দরকার। বাই দা ওয়ে, আ’ম সারা।”
_”বোঝাই যায়। নামও যেমন সারা,কথাবার্তাও তেমনি খাপছাড়া”
ইনামের কথায় পাত্তা দিলোনা সারা। ক্লাসের সময় হয়ে গেছে,ভিতরে যেতে হবে। সারা দ্রুতগতিতে বললো,
_”সে যাই হোক, আপনার চুলগুলো কিন্তু ভীষণ কিউট মিস্টার নুডুলস। লাইক, একবার দেখলেই যে কেউ চুলের প্রেমে পরে যাবে।”
ছুটে ক্লাসে চলে গেলো সারা। ইনাম কিছুক্ষন অবাক চোখে সেদিকে তাকিয়ে মাথায় হাত দিয়ে বলে,
_”এই মেয়ে তো দেখছি আসলেই খাপছাড়া!”
#চলবে?