#সেই_রজনী_দর্শনে🌙 |৬| [বোনাস পর্ব]
#তাসনিম_জাহান_মৌরিন
_”ছাঁদে গিয়েছিলি কেন?”
ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে ক্ষীণ স্বরে জিজ্ঞেস করলো দর্শন। রজনী দরজা আটকে দিলো, সেও শান্ত কণ্ঠে উত্তর দিলো,
_”আকাশ দেখতে,হাওয়া খেতে।”
দরজার থেকে সরে দর্শন এর সামনে দাড়িয়ে বললো,
_”ফ্রে..শ হাওয়া..”
কিছুটা টেনে বললো রজনী। দর্শন দু সেকেন্ড বাদে এই কথার অর্থ বুঝতে পেরে বলে,
_”আররেহ, ইনাম এর সাথে ছিলাম।”
_”বুঝলাম তো, ফুপ্পি বলেছিল। দুজনের ই অকালে লাংস নষ্ট করার শখ জেগেছে সেটাও বুঝতে পারছি।”
দর্শন মাথা চুলকে বলে,
_”শাসন করছিস আমাকে?”
_”ভালো কথা বললেই শাসন হয়ে গেলো? যাকগে,ওসব বলে কাজ নেই আমার। তুমি বলো আসল কথা।”
_”কোন আসল কথা?”
_”ভাইয়া কোথায়? না নিয়েই চলে এলে? একটু জোর করতে পারো না?”
দর্শন বিরক্তি নিয়ে বলে,
_”তোরা কি শুরু করলি আমার সাথে? আচ্ছা আমি করবো টা কি? কোলে তুলে নিয়ে আসবো ওকে? বাচ্চা ও?”
দর্শন এর বিরক্তিমিশ্রিত কথাতেও যেন মজা পেলো রজনী, মুখ চেপে হাসলো হামান্য। দর্শনের উদ্দেশ্যে বললো,
_”জীম করেছিলে না কদিন? চাইলে আনতেই পারো।”
অবাক হলো দর্শন, তবে শান্তিও পেলো। বিস্মিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
_”রজনী, কি হলো বল তো? তোর না মুড অফ ছিলো? ঠিক হয়ে গেলো?”
রজনী আবারো স্মিত হেসে বলে,
_”ওতো একটুখানি। আম্মু এসে সুন্দর করে কথা বললো, তাতেই মন খারাপ দূর হয়ে গেছে। তারপর একটা বই পড়তে নিলাম, এত্ত সুন্দর বইটা! মন আপনাআপনি ভালো হতে বাধ্য।”
দর্শনের চিন্তাটা দূর হলো নিমিষেই। প্রশান্তির নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো ভিতর থেকে। মেয়েটা কত অল্পতেই খুশি হয়ে যায়! জগতের নিয়ম ই হয়তো এমন, যেই মানুষগুলো খুব অল্পতেই আনন্দ পায়, তাদের জীবন থেকে সেই স্বল্প আনন্দটুকুও হারিয়ে যেতে চায়।
_”তুমি আমার কথা শুনো।”
দর্শন গিয়ে সোফায় বসে বললো,
_”শুনছি তো”
দর্শন এর পাশে এসে বসলো রজনী, হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে মুখে কিছু বললো, দর্শনকে বোঝানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে। বলা শেষ হতেই জিজ্ঞেস করলো,
_”বুঝতে পেরেছো?”
_”তুই এতক্ষন এটা বলার জন্য জেগে ছিলি?”
গালে হাত দিয়ে বললো দর্শন। রজনী উঠে দাঁড়িয়ে উত্তর দেয়,
_”না না আমি সত্যিই আকাশ দেখতে গিয়েছিলাম। চাঁদটা খুব সুন্দর লাগছিলো তাই।”
_”ভয় পাসনি?”
_”একটু একটু,খুব বেশি না।”
_”রাত খুব পছন্দ তোর, তাইনা?”
রজনীর পানে নজর রেখে বললো দর্শন, রজনী মুচকি হেসে উত্তর দেয়,
_”রাত কার না পছন্দ হয়? কেন,তোমার পছন্দ না?”
_”ভীষন, আমার সবচেয়ে প্রিয়।”
কেমন এক অদ্ভুত স্বরে কথাটা বলে দর্শন। মনে পরে যায় প্রায় পনেরো বছর আগের এক ঘটনা। রজনী সবে এক বছর পূর্ণ করেছে, আর দর্শন তখন দশ বছর বয়সী ছেলে। এই বয়সে মনে অনেক প্রশ্ন আসে, তেমনি দর্শন এর ও এসেছিল। তার চিন্তাটা অদ্ভুত, তার ভাবনা ছিলো নাম নিয়ে। সেই কৌতূহল থেকেই একদিন প্রশ্ন করেছিল আফিয়ার কাছে। রজনী তখন গুটিগুটি পায়ে হাঁটতে পারে, দর্শন তারই পিছন পিছন হাটছিলো। এতটুকু বাচ্চা, যদি হাঁটতে গিয়ে পরে যায়? মামিকে দেখে নাম নিয়ে একই প্রশ্ন মাথায় আসে, রজনীকে কোলে তুলে নিয়ে আফিয়ার কাছে গিয়ে বলে,
_”রজনী মানে কি,মামি?”
আফিয়া কাজ করছিলো তখন। দর্শনের উৎকণ্ঠা নজর দেখে হাসিমুখে উত্তর দেন,
_”রজনী মানে হলো রাত।”
দর্শন রজনীর দিকে একবার তাকিয়ে পুনরায় প্রশ্ন করে,
_”রাত? তাহলে ওর নাম রাত কেন রাখলে?”
_”রাত তো সবার পছন্দ হয়, কেন তোমার পছন্দ নয়?”
_”না তো। রাত কেন সবার পছন্দ হয়?”
আফিয়া কিছুটা ভেবে উত্তর দেন,
_”উম..কারণ রাতের বেলা চাঁদ দেখা যায়।”
মেনে নিলো দর্শন, অন্য প্রশ্ন মাথায় আসতেই জিজ্ঞেস করলো,
_”ওহহহ..তাহলে আমার নামের মানে কি?”
_”দর্শনের মানে হলো দেখা।”
জাহিদের ডাক পরতেই হাত মুছে ঘরের দিকে যান আফিয়া। দর্শন দু মিনিট ভেবে আবিষ্কার করে এক নতুন বিষয়। রজনীর দিকে তাকিয়ে অনেক উৎসাহ নিয়ে বলে,
_”মজার তো খুব। রজনী মানে রাত, দর্শন মানে দেখা। আর রাতের বেলাই তো চাঁদের দেখা পাওয়া যায়!”
রজনী কি বুঝেছে,আদতেও কিছু বুঝেছে কিনা তা সম্পূর্নই অজানা। তবে সে হেসেছিল তখন,আর তার হাসি দেখে হেসেছিলো দর্শন নিজেও। কোলে বেশিক্ষণ থাকেনি রজনী, জোর করে নেমে যায় সে, এখন তার হাঁটার বয়স। কোলে মোটেই থাকতে চায়না, দু একবার পড়বে, তবুও হাটবে সে।
_”দর্শন ভাই, কোথায় হারিয়ে যাও তুমি?”
পলক ফেলে দর্শন, চোখ নামিয়ে নেয়। কথা সত্য, ছোটবেলায় রাত একদমই পছন্দ ছিলোনা তার, কেমন চারিদিক অন্ধকার হয়ে থাকে, খেলতে বের হওয়া যায়না, বাসার ভিতর থাকতে হয়। সবটাই ঝামেলা।
তবে কি করে বুঝবে সে? দিনের চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে আধারে ঢেকে থাকা সময়টুকুই তার সবচেয়ে প্রিয় হয়ে উঠবে! যতটা রাত তার প্রিয়, তার চেয়ে অনেকগুণ বেশি প্রিয় হয়ে উঠবে নামের সাথে নামের সম্পর্ক জুরে দেওয়ার সঙ্গী মেয়েটি। সেদিন মজার ছলে কথাটা মাথায় এলেও, এখন তা বাস্তবে মিলিয়ে ফেলে দর্শন। রাত ব্যাতীত যেমন চাঁদ দেখা যায়না, তেমনি রজনী বিহীন দর্শনকেও হয়তো খুজে পাওয়া যাবেনা, তারা যেন একে অপরের পরিপূরক।
_”রাত অনেক হয়েছে রাতপাখি, ঘুমোতে যা।”
চোখ তুলে বললো দর্শন। রজনী জিজ্ঞেস করলো,
_”ক’টা বাজে?”
_”দুটোর কাছাকাছি।”
রজনী চোখ বড়বড় করে বলে,
_”এত বেজে গেছে! যাই আমি, দাদি দেখে ফেললে..”
কথা শেষ করতে পারলোনা রজনী। দর্শন উঠে দাড়িয়ে বললো,
_”নানুর জন্য বলিনি। ঘুম প্রয়োজন তোর,তাই বলেছি। সকালে আবার স্কুল আছে না?”
_”হুম”
চলে যেতে নিয়েই আবার থেমে যায় রজনী। আবারো দর্শন এর সামনে এসে বলে,
_”যা বলেছি মনে আছে তো?”
দর্শন মৃদু হেসে রজনীর মাথায় আলতো গাট্টা মেরে বলে,
_”হ্যা হ্যা মনে আছে। ঘুমোতে যা এবার, গুড নাইট। আমার আর আজকে ঘুম নেই, পড়তে বসবো এখন।”
_”আমি বুঝিনা,সারাদিন বাদ দিয়ে তুমি রাতেই কেন পড়তে বসো ভাইয়া?”
_”এটাতো এখন বুঝবি না, ভার্সিটি লাইফ এ গেলে নিজেও এমন ই করবি।”
রজনী চোখ ছোটছোট করে বলে,
_”খাবে কিছু? চা বানিয়ে দিয়ে যাবো?”
_”আমি কি অকর্মণ্য নাকি? নিজেই বানিয়ে নিতে পারবো, তুই যা এখন।”
_”ওকে, গুড নাইট।”
কথাটা বলেই নিজের ঘরে চলে গেলো রজনী। দর্শন সেদিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে রান্নাঘরে গেলো। নিজেই চা বানিয়ে ঘরে নিয়ে এলো, কদিন বাদে এক্সাম, তাই বাধ্য হয়েই পড়তে বসতে হচ্ছে।
তবে ঘরে এসেই পড়তে বসলোনা দর্শন,ব্যালকনি তে চায়ের কাপটা নিয়ে বসলো আগে। ঘুম কাটাতে হবে প্রথমে, তারপর বাকিসব। চায়ে চুমুক দিয়ে চেয়ারে হেলান দিলো দর্শন। আজকে রজনীকে করা একটা প্রশ্ন ছিলো,”তোর রাত খুব পছন্দ?”। এই প্রশ্নটা দর্শন আগেও করেছে।
রজনী তখন খুব একটা বড় নয়, বয়স আট ছুঁইছুঁই। দর্শনের তখন পনেরো বছর বয়স,অনেকটাই বড়, বোঝার বয়স হয়েছে তার। রজনীর আবদারেই তাকে নিয়ে ছাঁদে এসেছিলো দর্শন। পাশাপাশিই বসে ছিলো তারা। সেদিনও একই প্রশ্ন করেছিলো দর্শন,
_”তোর রাত খুব পছন্দ, রজনী?”
রজনী হাসিমুখে উত্তর দিয়েছিলো,
_”হ্যা খুব খুব পছন্দ।”
_”কেন বল তো।”
_”কারণ রাতে আব্বু বাড়িতে থাকেনা, আমাকে বকাও দিতে পারেনা।”
কথাটা বলতেই দু হাতে মুখ চেপে ধরে রজনী,মুখ ফসকে বলে ফেলেছে কথাটা। তবে এই কথাটা তখন তার মনের কথা ছিলো, দর্শন যেন নির্বাক হয়ে যায় সেই মুহূর্তে। বুকে গিয়ে লাগে যেন কথাটা। জাহিদ আর্মিতে চাকরি করতেন, বেশিরভাগ সময় নাইট ডিউটি থাকতো তার, রাত আটটার পরপর খেয়েদেয়ে বেরিয়ে যেতেন আর আসতেন ভোরবেলায়। তিনি রিটায়ার্ড করেছেন এই দু বছর এর কাছাকাছি হলো,তারপর ই জয়েন্ট করেছেন নতুন চাকরিতে।
সাত বছরের একটা বাচ্চা মেয়ের নিষ্পাপ মনে এমন একটা চিন্তা কি করে আসতে পারে? বাবাকে কতটা ভয় পেয়ে মেয়েটা এমন কথা বলছে বুঝতে সময় লাগলোনা দর্শন এর। রজনী ভয় পাচ্ছিলো হয়তো মনেমনে,যদি দর্শন কথাটা বলে দেয় অন্য কাউকে?
দর্শন রজনীকে বলার মতো কিছুই খুজে পেলোনা, কেবল তার মুখ থেকে হাত সরিয়ে বললো,
_”ভয় পাসনা,আমি কাউকে বলবো না।”
কথা রেখেছে দর্শন, কথাটা কাউকেই জানায়নি সে। হয়তো রজনী ভুলেও গেছে তার বলা সেই কথাটা,তবে মনে রেখেছে দর্শন। অনেক কিছুই সে ভুলতে পারেনি, বারবার মনে পড়ে কথাগুলো। কথাগুলো এখন যেন আরো জোরালোভাবে হৃদয়ে আঘাত করে। রজনী চেষ্টা করলেই হয়তো বুঝতে পারতো,তবে সে বোঝেনি। বুঝতে চায়নি, না বুঝুক। সে আরেকটু বড় হোক, সময় হলে দর্শন নিজে থেকেই বলবে তাকে, বলবে মনে পুষে রাখা সমস্ত কথা।
চায়ের কাপে আরো একবার চুমুক দিলো দর্শন। কল্পনা করে সে, রজনীর দুহাত মুঠোতে নিয়ে চোখে চোখ রেখে সেদিন আর্জি জানাবে,
_”রাতপাখি, তুই আমার মনপাখি হয়ে যা, প্লিজ!”
#চলবে?