#সেই_রজনী_দর্শনে🌙 |৫|
#তাসনিম_জাহান_মৌরিন
মোটা পাইপের উপর বসে আছে ইনাম আর দর্শন। ইনামের একহাতে সিগারেটে,অন্যহাতে ফোন। মনোযোগ সহকারে কোনো এক নিউজ পড়ছে সে।
দর্শনের ফোন তার পকেটেই আছে। বাম হাতে থাকা সিগারেটে টান দিয়ে দু হাতের ভর রাখলো পাইপের উপর। মাথা কিছুটা পিছনের দিকে ঝুঁকিয়ে তাকিয়ে রইলো আকাশ পানে। এই রাতের আকাশের দিকে তাকালেও কত সুন্দর দৃশ্য তার কল্পনায় আসে। এইতো, দুদিন আগে কুয়াকাটায় রাত দুটোর দিকে সমুদ্রের তীরে দাঁড়িয়ে ছিলো সে, অর্ধচন্দ্র টাও বেশ সুন্দর লাগছে। হঠাৎ ই মনে হলো পাশে রজনী দাঁড়িয়ে আছে। পাশ ফিরতেই তাকে দেখতে পেলো দর্শন, আকাশি রঙের জামা পরিহিত মেয়েটির মাথায় সুন্দর করে ওড়না দেওয়া। ঠোঁটের কোণ হাসির রেখা ফুটে ওঠে দর্শন এর, সেই মুহূর্তে রজনীও তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে, এই হাসিতে বড্ড মানায় তাকে। রজনী পুনরায় তাকালো আকাশের দিকে, হাসিমাখা কণ্ঠে বললো,
_”ভাইয়া, চাঁদটা খুব সুন্দর লাগছে তাইনা?”
দর্শন ও তাকালো সেদিকে। পিছনে দু’হাত গুঁজে বললো,
_”হুম,ভালোই লাগছে।”
_”আমার থেকেও বেশি সুন্দর?”
নিচের দিকে তাকিয়ে হাসে দর্শন, কল্পনা বলেই রজনী এই কথা বলছে। বাস্তব হলে কখনোই বলতো না। তবুও কল্পনা কে প্রাধান্য দিলো দর্শন, রজনীর দিকে তাকিয়ে উত্তর দিলো,
_”চাঁদের সঙ্গে তোর তুলনা করিনা আমি রাতপাখি। আমার কাছে চাঁদ নয়, বরং পুরো রাতের আকাশটাই তুই। আর তার মাঝে আলোর দর্শনটা হলো আমার ভালোবাসা। চাঁদ তো প্রতিদিন নিজের রূপ বদলায়,তবে আমার ভালোবাসা তেমন নয়, তা সর্বোক্ষন পূর্নিমার ন্যায় উজ্জ্বল। রাতের আকাশেই যেমন চাঁদের অবস্থান, তেমনই তোর মাঝেই আমার ভালোবাসার অবস্থান রাতপাখি।”
হাসি বজায় রাখলো রজনী,কপালে পড়া দু একটা চুল নিজ দায়িত্বে সরিয়ে নিলো। দর্শন এগোলো না এক পা’ও। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখলো তার কল্পনায় আসা কিশোরীকে। তাকে স্পর্ষ করলো না দর্শন,এগিয়ে এসে তার দু’গালে হাত রাখলো না, কপালে ঠোঁট ছোঁয়ালো না। কারণ দর্শন জানে, ছুতে গেলেই তার কল্পনা ভেঙে যাবে, তা চাইলো না সে। থাক না, কল্পনাতেই দেখুক আজ প্রেয়সী কে। এই কল্পনা যেদিন বাস্তবে রূপ নেবে, সেদিন নাহয় এগোবে দর্শন। চুলগুলো নিজ হাতে সরিয়ে দেবে, অনেকটা কাছে টেনে নেবে তাকে, নানান কথা বলে লজ্জায় ফেলতে চাইবে প্রিয়তমাকে, গভীরভাবে জড়িয়ে নেবে নিজের সঙ্গে।
এসব কথা মনে করতেই পুনরায় মনে শান্তির বাতাস বয়ে গেলো যেন, সিগারেটে আরো একবার টান দিয়ে সামনের দিকে হাত ছড়িয়ে বসলো দর্শন। ইনাম ফোনটা পাশে রাখলো, দর্শনের কাঁধে হাত রেখে বললো,
_”কিরে ভাই? সাইলেন্ট হয়ে বসে থাকার জন্য ডাকছি তোরে? এমন এক লুক নিয়ে আছিস, যেন বড়সড় ছ্যাকা খাইছোস।”
ইনাম হেসেই বলে কথাটা,দর্শনও মৃদু হেসে সিগারেট এর ধোয়া ছেড়ে বলে,
_”জীবনে ক্রাশ খেলাম একবার, সবে অনার্সে ভর্তি হয়েছি। ব্যাস,ভাল্লেগে গেলো এক সিনিয়র আপুকে। দুদিন বাদে জানলাম, তার নাকি চার মাসের এক বেবি আছে। আহা, কি বড় ছ্যাকাটাই না খেলাম। ঘুমই উড়ে গেলো চোখ থেকে, কষ্ট ভুলে মন শান্ত করতে গেলাম ছাঁদে। ক্ষনিকের অশান্ত মন শান্ত হওয়ার বদলে অশান্ত হয়ে গেলো সারাজীবনের জন্য। ভুল করেছিলাম, মস্ত বড় ভুল। সেই অমাবস্যার রজনীতে ছাঁদে যাওয়াটাই ছিলো আমার সবচেয়ে বড় ভুল, তবে সেটাকেই আমি বলি জীবনের সর্বোত্তম ভুল।”
ঠোঁটে হাসি নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো দর্শন। ইনাম তার পিঠে দুবার চাপড় মে’রে বললো,
_”আহা..কি প্রেম! একটা প্রেম করা উচিৎ ভাই।”
_”সব করবি, বাসায় চল আগে।”
হাসি মিলিয়ে গেলো ইনাম এর। হাত সরিয়ে নিয়ে সিগারেট এ টান দিয়ে বললো,
_”মাফ কর ভাই, এই একটা জিনিস আল্লাহর ওয়াস্তে আর বলিস না।”
_”বলবো না, কিন্তু কারণটা তো জানাবি নাকি?”
_”আরে ছাড় তো, আমারে দিয়ে কাজ কি? তুই বল, সবাই কেমন আছে? আর রজনী..”
_”কেন রে? ওর কথা তোর জিজ্ঞেস করা মানায়না। কে ও তোর? আদতেও কেউ হয়? বছরে কদিন মেয়েটার খোজ নিস তুই?”
কিছুক্ষন চুপ করে থাকে ইনাম। একপর ঠোঁট প্রশস্ত করে বলে,
_”তুই খোজ নিলেই চলবে।”
_”শা’লা মাথা গরম করায় দিস তুই। বাট আই সোয়ার, এবার তোকে বাড়িতে আমি নিয়েই ছাড়বো।”
_”পরে দেখা যাবে। এবার বল, বাসার কি অবস্থা?”
দর্শন কঠিন স্বরে উত্তর দেয়,
_”কেমন থাকে? ইদানিং আরো বেশি খারাপ হয়ে যাচ্ছে, টলারেট করা যায়না এগুলো। কবে যে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাই আমি, আল্লাহ মাবুদ জানে।”
_”তো আছিস কেন? চলে যা, রজনীকে সাথে নিয়ে যা তাহলেই হয়।”
_”হাহ,এত্ত ইজি? পরে ওর বাপ আমারে পুলিশ এ দিক তাই তো? দাঁতে দাঁত চেপে ওখানে পরে আছিতো শুধু ওর জন্যই। আম্মুকে নিয়ে চাইলেই চলে যেতে পারি, তাও যাচ্ছিনা। কোনোভাবে দুটো বছর পার হোক। আই প্রমিস, এক সেকেন্ড ও রজনীকে ঐ বাড়িতে থাকতে দেবোনা আমি।”
_”আর ততদিন? লুকোচুরি খেলবি?”
হাসলো দর্শন,পাশে তাকিয়ে বললো,
_”কে খেলছে লুকোচুরি? তুই নিজেও জানিস, লুকোনো জিনিসটা আমায় দিয়ে হয়না। আর আমি অতো সিরিয়াসভাবে কিছুই লুকোই নি। রজনীর জায়গায় অন্য মেয়ে হলে এতদিনে কিছু আন্দাজ করেই ফেলতো, ও নিজেই ভাবতে চায়না কিছু। আই অ্যাপ্রেশিয়েট দ্যাট, সি ইজ মোর ম্যাচিউর দ্যান আদার্স। তবে হ্যা, নিজে থেকে জানতে চাইলে আমি কিছু লুকোবো না।”
হাসলো ইনাম ও। দর্শন সিগারেট টা ফেলে দিয়ে লাফ দিয়ে পাইপ থেকে নেমে দাঁড়ালো। ইনামের উদ্দেশ্যে খানিক শান্ত কণ্ঠেই বললো,
_”চল না ভাই।”
_”মাফ কর। যা তুই, আমিও যাই হোটেলে। দুদিন থাকবো, কালকে দেখা হবে।”
বিপরীতে কিছু বললোনা দর্শন। নাছোড়বান্দা ছেলে ইনাম, দর্শনের চেয়ে মাত্র বিশদিন এর ছোট সে। নিজে না চাইলে তাকে জোর করে কোনো কাজ করানো সম্ভব নয় তা দর্শনও ভালো করেই জানে।
অত:পর বিদায় নিয়ে নিজেদের পথে গেলো দুজন। বাড়ি ফিরতে চারমিনিট লাগলো দর্শন এর। এখন আরেক ঝামেলা। রাত একটার বেশি বাজে, দরজা ধাক্কানো যাবেনা। ফাহমিদা কে ফোন করবে ভেবেই পকেট থেকে ফোন বের করতে যাচ্ছিলো দর্শন। কানে গুনগুন গানের আওয়াজ আসতে মাথা উঁচু করে দোতলার ছাঁদের দিকে তাকায় সে। ছাঁদের পাশেই একটা বেঞ্চ বসানো, তার উপরই পা তুলে বসে আছে রজনী। গুনগুন করে গান গাইছে,সঙ্গে পায়ে হাত দিয়ে মেহেদী তুলছে হয়তো।
ফোনটা নামিয়ে তার দিকে তাকালো দর্শন। রাতের আধারে যেন আরো বেশি মায়াবী লাগে মেয়েটিকে। রাতের আধারে মেয়েটা ভয় পায়,আবার কখনো কখনো পায় না। এত রাতে ছাঁদে একাএকা বসে আছে,অথচ তার মাঝে ভয়ের রেশমাত্র নেই। আবার কখনো কখনো ভয় পায় সে, প্রচণ্ড ভয়ে গুটিয়ে যায়। ছোট থাকতে রাতের বেলা ছাঁদে যেতে ইচ্ছে করলে প্রথমে মায়ের কাছে আবদার করতো, তারপর ফাহমিদার কাছে। তারা কাজে ব্যস্ত থাকলে সর্বশেষে যেতো দর্শন এর কাছে। তার পিছুপিছু ঘুরে বেরাতো খানিকক্ষণ, তারপর জিজ্ঞেস করতো সে এখন ব্যস্ত কিনা। উত্তরটা না হলে আবদার জুড়ে দিতো ছাঁদে যাওয়ার জন্য, অধিকাংশ সময় তার আবদার রেখেছে দর্শন, আবার কখনো কখনো রাখেনি। হয়তো সে মন খারাপ করেছে তখন,তবে কোনো অভিযোগ করেনি।
একটু বড় হওয়ার পর থেকে আর এই আবদার করেনা রজনী। নিজেই সাহস করে আসে, আর ভয় পেলে আসেনা। তবে মন খারাপ থাকলে তার ভয়টা কেটে যায়, তখন অনেক রাতেও সে একাএকা ছাঁদে চলে আসে। দর্শন দেখতে পেলে নিজেও আসে পিছন পিছন। দাঁড়িয়ে থাকে চুপচাপ, কখনো টুকটাক কথা বলে, গান গায়। এতে রজনীর মন ভালো হয় কিনা পুরোপুরি জানা নেই, তবুও চেষ্টা করে দর্শন।
আপাতত সেসব ভুলে অনেকটা সময় সেই মায়াভরা মুখটির দিকে তাকিয়ে রইলো দর্শন। এমন এক রজনী দর্শনেই তো তার মায়ায় পরে গিয়েছিলো সে। সেই মায়া কাটেনি, বরং বেড়েছে অনেকগুণ।
রজনী এখনো তাকায়নি নিচের দিকে। মা’কে আর ফোন করলোনা দর্শন। দু তিনবার তুড়ি বাজাতেই পাশ ফিরে নিচের দিকে তাকায় রজনী। দর্শন হাতের ইশারায় তাকে দরজা খোলার কথা বলতেই নেমে দাঁড়ায় সে। দ্রুত পায়ে নেমে আসে দরজা খোলার উদ্দেশ্যে।
#চলবে?