সেই রজনী দর্শনে পর্ব-০৪

0
460

#সেই_রজনী_দর্শনে🌙 |৪|
#তাসনিম_জাহান_মৌরিন
_”মন ভালো করার উপায় বল, চেষ্টা করে দেখি।”
গালে হাত ঠেকিয়ে বলে দর্শন। রজনী কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বলে,
_”মন খারাপ, তা কি বলেছি? ওসব আর খুব বেশি হয়না এখন।”

_”আমার থেকে লুকোচ্ছিস? আমার থেকে?”

_”বলতে ইচ্ছে হয়না।”

_”আর আমার চুপচাপ দেখতে,তোকে। একদমই ইচ্ছে হয়না। বল কি চাই.. বই?”

চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে রজনী বললো,
_”ঐ এক জায়গায় কোনো না নেই। যত মন চায় বই গিফট করতে পারো, খুশি বইকি অখুশি হবোনা।”

ইষৎ হাসলো দর্শন, রজনী এবার টেবিলে থাকা খাতাটা দর্শন এর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,
_”এখন আপাতত এই অঙ্কটা বুঝিয়ে দিলেই চলবে।”

দর্শন সোজা হয়ে বসে একবার খাতার দিকে তাকায়। তারপর চেয়ারে হেলান দিয়ে বলে,
_”এত পড়ে হবে টা কি?”

হুট করেই হেসে দিলো রজনী, টেবিল থেকে বই নামাতে নামাতে বললো,
_”প্রফেসর.. প্রফেসর রজনী।”

রজনীর চুলগুলো পিছনে ক্লিপ দিয়ে আটকানো ছিলো, ওড়না শরীরে জড়িয়ে রাখা। বারান্দার দড়জাটা খোলা, হঠাৎ দমকা হাওয়া ছুটে আসতেই চোখের সামনে চুল এসে বিরক্ত করে রজনীকে। পুনরায় সব চুল একসাথে খোঁপা করে ওড়নাটা টেনে মাথায় দেয় রজনী,উঠে যায় বারান্দার দড়জাটা আটকে দিতে। দর্শন টেবিলে দু হাত রেখে ঝুকে আসে কিছুটা,হাতের উপর থুতনি ঠেকিয়ে তাকিয়ে থাকে রজনীর দিকে। দড়জা আটকে নিয়ে চেয়ারে এসে বসে রজনী, দর্শন ঠোঁটজোড়া প্রশস্ত করে বলে,
_”সাবধানে থাক রাতপাখি, কবে যেন আমারই নজর লেগে যায়।”

সূক্ষ্ম চোখে তাকায় রজনী, চোখের পলক ফেলে বলে,
_”কি হলো? অঙ্ক বোঝাবে না?”

চোখ নামিয়ে মুচকি হাসে দর্শন। কথাটা সে বলেছে ঠিকই, তবে মনে মনে। চেয়েছিল মুখে বলতে, বলা হলো না। নিচের দিকে তাকিয়ে থাকতেই দর্শনের চোখ যায় রজনীর পায়ের দিকে। আর একটু খেয়াল করে বলে,
_”পা’টা সামনে আন তো।”

ছোট নিঃশ্বাস ছেড়ে পা সামনে আনে রজনী,বাম পায়ের একপাশে সুন্দর করে মেহেদী দেওয়া। একটু আগেই দিয়েছে,শুকিয়ে গেছে এতক্ষনে। দর্শন চোখ তুলে বললো,
_”হাত খালি রেখে পায়ে মেহেদী দেওয়ার লজিকটা বুঝলাম না।”

_”সর্বক্ষণ হাতে মেহেদী থাকাও একপ্রকার ঢং,জানোনা?”

মুখভঙ্গি গম্ভীর হয় দর্শনে। দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
_”নানু বলছে?”

দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে রজনী। পায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
_”ভালো লাগছিলো না,তাই দিলাম। দাদু বলেছে ঠিকই, তবে সেটা কারণ নয়। হাতে সবসময় মেহেদী রাখতেও ভালো লাগেনা ইদানিং,তাই পায়ে দিলাম। কদিন পর হয়তো সেটাও বন্ধ করে দেবো।”

_”মানলি তাহলে, মন খারাপ।”

_”অস্বাভাবিক?”

উত্তর দিলোনা দর্শন। রজনী এবার করুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
_”আম্মু আমাকে একবারো জিজ্ঞেস করলোনা জানোতো? এতই বিরক্তির কারণ আমি দর্শন ভাই?”

দর্শন কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে বললো,
_”তোর চোখে এক ফোঁটাও জল নেই,রাতপাখি।”

চোখ সরিয়ে হাসলো রজনী,বলে উঠলো,
_”সামান্য বিষয়, চোখে জল আসবে কেন?”

_”বড় হয়ে যাচ্ছিস।”

_”ভালোই তো, ভালো না? যেমন এখন অল্পতে কাঁদছি না, পরবর্তীতে এর চেয়ে বড় বিষয়েও কাঁদবো না।”

কিঞ্চিত হেসে হাত বারায় দর্শন, আলতো হাতে রজনীর গাল টেনে দিয়ে বলে,
_”বড়দের মতোই কথা বলছিস,এটা আরো বেশি ভালো। আই ওয়ান্ট টু সি ইউ স্ট্রং,নট উইক।”

_”দেখতে পেলে তো..”

থামলো রজনী, মুখ ফিরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো। ভ্রুযুগল কুঁচকে নিলো দর্শন,কয়েক সেকেন্ড সেভাবে তাকিয়ে রইলো। মুখে কঠিন আভা ফুটে উঠলো তার, ভয় গ্রাস করলো পুরো হৃদয় জুড়ে। এতক্ষনের নরম স্বর মুহূর্তেই কঠিনে রুপান্তরিত হলো। এলোমেলো কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
_”রজনী, ইনডিরেক্টলি কি বোঝাতে চাইলি তুই?”

নিচের দিকে মাথা ঝুকিয়ে চোখ বন্ধ করলো রজনী,দর্শন পুনরায় বললো,
_”লুক এট মি, কি বলতে…”

_”কিছুই বোঝাইনি আমি। অঙ্ক করতে ইচ্ছে করছেনা আর। ঘুমোবো আমি, তুমি যেতে পারো।”

পাশে তাকিয়ে কয়েকবার বড়বড় নিঃশ্বাস নিলো দর্শন, শান্ত হয়ে বললো,
_”এদিকে তাকা আগে।”

দর্শনের দিকে ফিরে তাকালো রজনী। দর্শন চেয়ার নিয়ে এগোলো কিছুটা, একদৃষ্টিতে রজনীর চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,
_”মনে যা ঘুরছে,মুখ ফসকে তাই বলতে যাচ্ছিলি। আমি আপত্তি করবোনা, যে কথা মনে আসে তাই বলতে পারিস। কিন্তু তা কেবলই বলা অবধি, বুঝতে পারছিস আমি কি বলছি?”

এতক্ষন স্বাভাবিক থাকা রজনীর চোখ টলমল করে উঠলো এবার,সঙ্গেসঙ্গে চোখ নামিয়ে নিলো সে। দর্শন ব্যাস্ত হয়ে বলে,
_”আবার কাঁদছিস কেন? আমি বকেছি তোকে? কিছু বলিনি তো।”

কষ্ট করে কান্না আটকে রাখলো না রজনী,লুকোতেও চাইলো না। কার থেকে লুকোবে? যার সামনে ছোটবেলা থেকে কেঁদেছে,তার থেকে আবার লুকোনোর কি আছে?

_”চোখ মোছ রজনী। মামির ব্যবহারে কষ্ট পাচ্ছিস তাই তো? বড় হয়েছিস না তুই? একটু বুঝতে চেষ্টা কর, অনেক সময় মানুষ প্রশ্নের মুখোমুখি হতে চায়না। তোর প্রশ্নগুলো এড়াতেই হয়তো মামি কথা বলেনি।”

_”আমিতো প্রশ্ন করতাম না ভাইয়া।”

_”সেটা হয়তো মামি বুঝতে পারেনি। আচ্ছা আমি কথা বলে নেবো মামির সঙ্গে, চোখ মোছ এবার।”

ভেজা ঢোক গিলে চোখ মুছলো রজনী। দর্শন তাকে স্বাভাবিক করার উপায় হিসেবে অঙ্ক করাকেই বেছে নিলো। আর যাই হয়ে যাক, পড়ার ক্ষেত্রে মনোযোগী থাকবে রজনী। খাতাটা নিয়ে একবার অঙ্কটা দেখলো দর্শন, এরপর কলমটা হাতে নিয়ে বললো,
_”একটু প্যাঁচানো। আমি করছি, মনোযোগ দিয়ে দেখ।”

হলোও তাই। কান্না ভুলে অঙ্কের দিকেই মনোযোগ দিলো রজনী। সে যেন পন করে নিয়েছে, দুনিয়া উলটে গেলেও তার প্রভাব পড়ার উপর পরতে দেবেনা সে। একবার বোঝাতেই অঙ্কটা বুঝে গেলো রজনী, দর্শন আর বসলো না সেখানে। রজনী এখন একাএকা পড়বে আরো কিছুক্ষন, মাঝে বেশি কষ্ট হলে হয়তো দু এক ফোঁটা অশ্রু বিসর্জন দেবে। তারপর ঠিকই ঘুমিয়ে পরবে। দর্শন পাশে থাকলে বরং ঝামেলা বেশি, কথা না বলে সে থাকতে পারবেনা, তাই বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। নিজের ঘরে এসে ফোন চেক করতেই দেখলো ইনাম পাঁচ মিনিট আগে কল দিয়েছিলো দু’বার। রাত বারোটার কাছাকাছি বাজে, দর্শন কল ব্যাক করলো সাথেসাথেই। কল রিসিভ করতেই দর্শন কড়া গলায় বলে,
_”তোরে আমি কল দিছিলাম সন্ধ্যা ছয়টায়,তুই কল ব্যাক করোস বারোটার সময়?”

_”মামা চেতিস না তো, একটু মাঠের পাশে আয়।”

দর্শন অবাক হয়ে বলে,
_”তুই..”

_”আসছি আধা ঘন্টা,খাওয়া দাওয়া করে বসে আছি। আয় একটু আড্ডা দেই।”

_”তুই আগে বাড়িতে আয়।”

_”হুদাই এক কথা বারবার বলিস না তো। ওয়েট করতেছি, আয় তুই।”

ফোন কেটে দিলো ইনাম। দর্শন এর বড় মামা আর রজনীর বড় চাচার ছেলে সে। তারা পরিবার নিয়ে বরিশাল শহরেই থাকে, পটুয়াখালী নিজেদের বাড়িতে কেবল জাহিদ ই থাকেন। বাকি দুই ভাই ভিন্ন শহরে, বিয়ের পরই আলাদা হয়ে গিয়েছিলেন তারা।
বাইকের চাবিটা নিয়ে বেরিয়ে যায় দর্শন, ফাহমিদা পানি খেতে ড্রইং রুমে এসেছিলেন। ভালোই হয়েছে,তিনিই দরজা আটকে দিয়েছেন। ইনাম এ বাড়িতে আসেনা প্রায় চার বছর হতে চললো। হাজারবার বলা হয়েছে তাকে, কোনো লাভ হয়নি। এমনকি রজনীর সাথে বিশেষ দিন ব্যাতীত কথাও বলে না সে। আগে এমনটা ছিলো না, সবার সাথেই মজার সম্পর্ক ছিলো তার। হুট করে কি এমন হলো তা দর্শন এর ও অজানা।

মাঠের পাশে এসে বাইক থামায় দর্শন। সেখানেই একটা মোটা পাইপের উপর বসে আছে ইনাম। পাশে ল্যাম্পপোস্ট, আলোকিত জায়গাটা। মূলত এখানে বন্ধুমহল নিয়ে এসে ছেলেরাই আড্ডা দেয়। বিকেলের দিকে ফুটবল,ক্রিকেট খেলে অনেক সময়।
ইনাম পরিপাটি বরাবরের মতো,তবে চুলগুলো নুডুলস এর ন্যায় প্যাঁচানো। ছোট বেলা থেকেই এমন, তার চুল এক ভেজা অবস্থায় ছাড়া কখনোই ঠিক রাখা যায়না। চুলের কারণে কম পঁচানি খেতে হয়নি তাকে, আবার অনেকে বলে তাকে এভাবেই মানায়।

ফোনের দিকেই নজর ছিলো ইনাম এর। দর্শন বাইক থেকে নামতেই সেও বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। দুই বন্ধুর দেখা অনেকদিন পর, অনেকদিন বলতে এই একমাস।

#চলবে?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে