সেই তুমি পর্ব ০৩

0
4690

#সেই_তুমি?
#পর্ব_০৩
#Tabassum_Kotha

আমাকে ক্লাসরুমের দেয়ালে ঠেস্ দিয়ে রাগী দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে তুর্য। চোখ দুটো অসম্ভব লাল হয়ে আছে, তাকাতে পারছি না ঐ চোখের দিকে। মাথা নিচু করে ভয়ে কাপছি। কালো একটা হুডি পরে এসেছে তুর্য, হয়তো নিজের পরিচয় গোপন করতে এমনভাবে এসেছেন। কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে সামনে আসা চুল গুলো পিছন দিকে দিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

— এতোদিন ভার্সিটি আসো নি কেনো?

তুর্যর এই অদ্ভুত প্রশ্নে কপাল কুচকে তাকিয়ে আছি তার দিকে।

— কি হলো বলো? জ্বর হয়েছিল? বাসায় গিয়ে আবারো ঝর্ণার পানিতে বসে ছিলে বুঝি?

তুর্যর প্রশ্নগুলো বারবার অবাক করছে আমাকে। সে কিভাবে জানলো আমি ভিজেছিলাম আর জ্বর হয়েছিল।

— চুপ করেই থাকবে? আচ্ছা থাকো চুপ করে। আমি যেই কাজে এসেছি সেটা করে নেই।

এখনও কপাল কুচকে আগের ভঙ্গিতেই তাকিয়ে আছি আর বুঝার চেষ্টা করছি সে কি বলতে চাইছে।

— সো কথা হলো আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই আর সেটা এখনি। তুমি আমার সাথে এখনি কাজী অফিসে যাবে।

তুর্যর কথা শুনে মাথা হ্যাং হয়ে গেছে, ঠিক কিভাবে রিয়েক্ট করবো বুঝতে পারছি না। আমার এভাবে তাকিয়ে থাকা দেখে হয়তো সে কিছু বুঝেছে যার জন্য আমার হাত ধরে টানতে লাগলো। এবার যেনো আমি হুশ ফিরে পেলাম।

— কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমায়? ছাড়েন বলছি। আর আমি যদি মরেও যাই তবুও আপনাকে বিয়ে করবো না। আপনি আমার অপরাধী। আমার জীবন টা আপনার জন্য নষ্ট হয়েছে। আপনি ভাবলেন কি করে যে আমি আপনার মতো একটা ধর্ষককে বিয়ে করবো?

কথাগুলো বলতেই তুর্য আমার গাল চেপে ধরলো। আর দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

— তুমি আমাকেই বিয়ে করবে। আমি তোমার কাছে অনুমতি চাই নি, আমি তোমাকে আমার সিদ্ধান্তু শুনিয়েছি।

— সিদ্ধান্ত শুনিয়েছেন মানে কি? জীবনটা আমার সেটা কি আপনি ভুলে যাচ্ছেন? ভুলে যাবেন না এটা আমার জীবন। আমি কাকে বিয়ে করবো নাকি করবো না এটা আমার সিদ্ধান্ত হবে। আর আমি আমার জীবন থাকতে কখনই আপনাকে বিয়ে করবো না।

— লুক হীর বিয়ে তো আমি তোমাকে করবোই, at any cost. এতোক্ষণ ভালোয় ভালোয় বলছিলাম শুনো নি। তাই এখন নিজের আসল রূপে ফিরে আসতে হচ্ছে।

— কি বলতে চাইছেন?

— তুমি যদি আজকে এবং এই মুহূর্তে আমাকে বিয়ে না করেছো তাহলে একটা ভিডিও ক্লিপ ভাইরাল করতে আমি বাধ্য হবো।

— ভিডিও ক্লিপ! কিসের ভিডিও ক্লিপ?

— তোমার আর আমার সেদিনকার রোমান্টিক কিছু মুহূর্তের ভিডিও ক্লিপ।

তুর্যর কথায় আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পরলো। বলছে কি লোকটা! একটা মানুষ কতোটা নিকৃষ্ট হলে এসব কিছু করতে পারে। সেদিন আমার সাথে এতোরড় অন্যায় করার পরেও লোকটার শান্তি হয় নি। এখন সে ভিডিও ক্লিপ ভাইরাল করতে চাচ্ছে। ছিঃ!

— আপনি কি জানেন আপনি একটা মানুষরূপী জানোয়ার। কতোটা নিকৃষ্ট আপনি আপনার ধারণা আছে?

— সে তোমার যা ইচ্ছা বিয়ের পর বলতেই পারো। কিন্তু এখন আমার টাইম ওয়েষ্ট করো না। ইউ নো, টাইম ইজ মানি।

— আপনি ভাবলেন কি করে যে আমি আপনার হুমকি শুনে আপনাকে বিয়ে করে নেবো? আপনি ভিডিও ক্লিপ ভাইরাল করতে চান, ইউ আর মোষ্ট ওয়েলকাম। করেন। সবাই কথা শুনাবে, আমার বদনাম হবে এইতো? আমিই যখন এই দুনিয়াতে থাকবো না তখন এই বদনামের আবার ভয় কিসের আমার।

তুর্যর কপালের রগটা হঠাতই ফুলে উঠলো, চোখ দুটোও রক্তবর্ণ ধারণ করেছে।
ভীষণ ভয় করছে আমার কিন্তু তুর্যর সামনে নিজেকে আমি দুর্বল দেখাতে পারবো না।

— ভুলটা আমি সেদিনই করেছি। সেদিন যদি নিজেকে শেষ করে দিতাম তাহলে আজ আপনার মতো একটা মানুষের হাতের পুতুল হয়ে থাকতে হতো না। তবে সেদিন যেটা করতে পারি নি আজ করবো। আমি যদি না ই থাকি তাহলে আমার বদনাম দেখবো কিভাবে। আজ এই বিল্ডিং এর ছাদ থেকে লাফ দিয়েই মারা যাবো আমি, এই টর্চার আর সহ্য করতে পারছি না।

ক্লাস রুম থেকে বের হতে গেলে তুর্য আমার হাত ধরে টেনে তার সামনে এনে আমার গালে সজোরে একটা চড় বসিয়ে দেয়। আর দুই বাহু ধরে ঝাকিয়ে বলে,

— খুব শখ মরার তাই না। আচ্ছা তাহলে মেরেই দেই। আসলে এই ভালো হওয়া জিনিস টা আমার সাথে একদমই যায় না। তোমাকে ভালো মতো বলেছিলাম শুনলে না। ভয় দেখালাম তাও কাজ হলো না। এবার শেষটাই করি।

— কি বলতে চান আপনি?

— Wait a minute babe. সব বুঝতে পারবে।

তুর্য ফোনটা বের করে কাকে যেনো ফোন করলো।

— জন, হীরের মামা-মামি আর রাহিকে gun পয়েন্টে নিয়ে নাও। তোমাদের হীর ম্যাডাম বিয়ের জন্য রাজী না, তাহলে এরা শুধু শুধু দুনিয়াতে থেকে কি করবে।

—–

— নিয়ে নিয়েছো? এখন ভিডিও কল করো। ম্যাডাম শেষ বারের মতো এদের চাঁদমুখ খানা দেখতে চাইবে নিশ্চয়।

— আপনি কি বলছেন এসব? মামা-মামি, রাহিকে gun পয়েন্টে মানে? ওদের ছেড়ে দিন, ওদের সাথে আপনার কোনো শত্রুতা নেই। ওদের ছেড়ে দিন।

তখন তুর্যর মোবাইলে ভিডিও কল এলো আর মোবাইলটা তুর্য আমার সামনে ধরলেন। মামা-মামি, রাহি সবাই অবচেতন অবস্থায় আছে আর ৪/৫ জন গার্ড ওদের মাথায় পিস্তল ধরে দাড়িয়ে আছে তুর্যর একটা ইশারার অপেক্ষায়। আমি কি করবো বুঝতে পারছি না। ছোট বেলায় মা বাবা কে হারানোর পর থেকে এই মানুষগুলোই আমার সব। আমার নিজের স্বার্থের জন্য আমি এই মানুষগুলোকে মরতে দিতে পারি না। আর কিছু না ভেবে কাঁদতে কাঁদতে তুর্যর পায়ে পরে গেলাম।

— ওদের প্লিজ কিছু করবেন না আমি আপনার সব কথা মানতে রাজী। প্লিজ ওদের ছেড়ে দিন তুর্য।

— জন, তোমরা gun টা নামিয়ে ম্যাডামের মামা বাড়িতেই পিকনিক করো। আজকে তোমাদের স্যার আর ম্যামের বিয়ে। এনজয়।

তুর্য কলটা কেটে দিয়ে আমাকে তার পা থেকে তুললো। পুনরায় হাত ধরে টানতে টানতে ক্লাসরুমের বাইরে নিয়ে গেলো। এবার আর হুডি টা মাথায় তুললো না। কলেজের সবাই হা হয়ে তাকিয়ে আছে আমার আর তুর্যর দিকে। রকষ্টার তুর্য আহমেদ চৌধুরীর সাথে আমাকে দেখে মেয়েরা তো মেয়েরা ছেলেদেরও যেনো মুখ বন্ধ হচ্ছে না। সিড়ি দিয়ে টেনে নামানোর সময় ব্যালেন্স না থাকায় পা মুড়ে নিচে পরে গেলাম আমি। ব্যথাও পেয়েছি অনেক। তুর্য আবারো আমার হাত টানছে উঠে দাড়ানোর জন্য। কিন্তু এই মুহূর্তে হাটা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি তুর্যর দিকে। হয়তো তুর্য কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছেন। আচমকাই আমাকে কোলে তুলে নিলেন সে। এখন আমার সত্যি মরে যেতে ইচ্ছে করছে লজ্জায় আর ক্ষোভে। মনে করে কি সে নিজেকে। এভাবে সবার সামনে কোলে নিয়ে হাটছে, সবাই ফ্রিতে তামাশা দেখছে। অনেকে এরই মধ্যে আমাকে আর তুর্যকে নিয়ে কানা-ঘুসা শুরু করে দিয়েছে। তাদের ঠাট্টার শব্দ আমার কান পর্যন্ত আসছে কিন্তু তুর্যর কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই সেদিকে।

আমাকে গাড়িতে বসিয়ে সিট বেল্ট লাগিয়ে দিয়ে কার ড্রাইভ করা শুরু করলো তুর্য। কিছুক্ষণের মধ্যেই কাজী অফিসের সামনে এসে পরেছি। দুচোখ বেয়ে পানি পরছে। আপনজনদের বাঁচানোর জন্য জীবনের শেষ বাজি খেলতে যাচ্ছি।
তুর্য গাড়ি থেকে নেমে আবারো আমাকে কোলে তুলে নিয়ে ভিতরে গেলেন। সেখানে আরো মানুষ উপস্থিত আছে। মধ্য বয়স্ক দুজন পুরুষ, দুজন মহিলা, আমার বয়সি একটা মেয়ে আর তুর্যর বয়সি একটা ছেলে। এদের কাউকেই আমি চিনি না। আমাকে বসিয়ে দিয়ে তুর্য বিয়ে শুরু করতে বললেন। ব্যাস আর কি করার পড়ে নিলাম কবুল, হয়ে গেলো বিয়ে। এমন একটা মানুষের সাথে যাকে আমি ঘৃণা করি, প্রচন্ড ঘৃণা করি।

বিয়ে শেষে আমি কাজী অফিসেই একটা চেয়ারে বসে আছি আর তুর্য কাকে যেনো ফোন দিচ্ছে। বুঝতে পারছি না কি হচ্ছে। মাথা নিচু করে বসেছিলাম তখন তুর্য ব্যথার স্প্রে এনে আমার পায়ে দিয়ে দিলো। এবারো কোলে করে গাড়িতে বসিয়ে ড্রাইভ শুরু করলো। গন্তব্যটা আমার পরিচিত, আমার মামার বাড়ি যাচ্ছে। আমি আন্দাজ করতে পারছি কি হতে চলেছে।

বাড়ি আসতে তুর্য আমাকে কোলে নিয়েই কলিং বেল বাজালেন। মামি দরজা খুলতেই অবাক হয়ে হা করে আছেন। আমি কিছু বলতে যাবো তার আগেই তুর্য বললো,

— রাহি হীরকে ওর ঘরে নিয়ে যাও আর ওর প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো প্যাক করে দেও। আমরা এখনি বের হবো। হীর, তোমার কাছে জাষ্ট ১০ মিনিট সময় আছে যা দরকার নিবে। ১০ মিনিটের এক সেকেন্ড সময় বেশি হলেও এর ফল ভালো হবে না।

তুর্যর কথায় আমি অনেক ভয় পেয়ে যাই আর রাহিকে ধরে ধরে রুমে গিয়ে জিনিস গোছাতে থাকি আর সব বলতে থাকি রাহিকে। রাহি তেমন রিয়েক্ট না করলেও বাইরে থেকে অনেক চেচামেচির শব্দ আসছে। নিশ্চিত মামি সব জেনে গেছে। মামিরই বা কি দোষ, কালকে পর্যন্ত তার ছেলের সাথে আমার বিয়ে ঠিক ছিল আর আজকে আমি অন্যকারো বউ। তাদের কাউকে না জানিয়ে একা বিয়ে করে নিয়েছি, তারা অনেক কষ্ট পেয়েছে জানি। কিন্তু আমি যে নিরুপায় ছিলাম। কোনো কিছু না বলে বেরিয়ে এলাম।

ঠাসস্ করে একটা চড় পরলো গালে, চড়টা মামিই দিয়েছে। আমার কিছুই বলার নেই, মাথা নিচু করে আছি। মামি আরেকবার হাত উঁচু করলেন চড় মারার জন্য কিন্ত সেটা গালে পরার আগেই তুর্য মামির হাত ধরে ফেললেন।

— Don’t you dare. এখন হীর শুধু আপনার ভাগ্নী নয় আমার বউ, মিসেস হীর তুর্য আহমেদ চৌধুরী ও। আর মিসেস তুর্যর গায়ে হাত তোলার সাহস এই তুর্য আহমেদ কাউকে দেয় নি। আপনাদের কাছে দোআ নিতে এসেছিলাম, যেটা হয়তো এখন আর পাবো না তাই এখানে সময় নষ্ট করে কোনো লাভ নেই। চলো হীর।

তুর্য আমার হাত টা ধরে বাড়ির বাইরে নিয়ে গেলো আর আমার জিনিসগুলো তুর্যর গার্ড অন্য গাড়িতে রাখলো। সারা রাস্তা আর তুর্যর দিকে তাকাতে পারলাম না। এতো ঘৃণা হচ্ছে এই লোকটার প্রতি যে, মনে হচ্ছে এর সাথে থাকার চেয়ে গলায় দড়ি দেওয়া অনেক ভালো।

গাড়ি এসে থামলো বিরাট বড় একটা বাড়ির গেইটে। কিন্তু এই বাড়িটা সেই বাড়ি না যেটায় সেদিন আমাকে তুলে আনা হয়েছিল। বাড়ির দরজার সামনে অনেকগুলো মানুষ দাড়িয়ে আছে,, এই মানুষগুলোই কাজী অফিসে ছিল। হয়তো এরাই তুর্যর পরিবার। তুর্য আমাকে কোলে নিয়ে বাড়ির ভিতর ঢুকলো।

চলবে..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে