#সেই_তুমি
Sumon Al-Farabi
#১ম_পর্ব
বসার ঘরে ঢুকে মাথা থেকে পাগড়িটা খুলে বিছানায় তাকাতেই দেখি বউ দু’হাতে শক্ত করে পেট চেপে বসে আছে। তার মুখে স্পষ্ট ফুটে উঠেছে প্রচন্ড ব্যাথায় কুঁকড়ে যাচ্ছে শুধু চিৎকার করতে পারছে না। তাড়াতাড়ি তার পাশে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম – আপনার কি খুব কষ্ট হচ্ছে!
মেয়েটা প্রচন্ড শক্ত করে আমার হাত চেপে ধরলো। কাঁপা কাঁপা গলায় বললো- আমায় একটু গরম পানি এনে দিতে পারবেন! ওয়াটার ব্যাগ বা বোতল করে।
– আচ্ছা আমি নিয়ে আসছি।
আমি দ্রুত রুম থেকে বেরিয়ে রান্না ঘরে চলে আসলাম। বিয়ের বাড়ি জন্য বাসায় মানুষ ভরা থাকার কথা থাকলেও আজ আমাদের বাড়িতে খুব বেশি মানুষের সমাগম নেই। এর কারণ টা একটু পরেই বলছি। যদিও বা কয়েকজন আছে তারা নিজেদের রুমের মাঝে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে।
বাসায় মাঝে মাঝে আসা হয় এই জন্য কোথায় কি রাখা আছে ঠিক বলতে পারবো না। তাই ওয়াটার ব্যাগ খোঁজার পিছনে সময় নষ্ট না করে হাতের কাছে একটা কাচের বোতল ছিলো সেটাতেই পানি ভরে নিয়ে আসলাম।
মেয়েটা আমার হাত থেকে বোতল নিয়ে পেটের মাঝে চেপে শুয়ে পড়লো। কিন্তু ব্যাথা যেন কিছুতেই কমছে না।
কিছুটা সময় যাওয়ার পর ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে শুরু করলো। হয়তো ব্যাথা কিছুটা কমেছে। এতক্ষণ আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অবাক চোখে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে ছিলাম। কি অসহ্য যন্ত্রণা সহ্য করছে চুপচাপ। নারী জাতির মাঝে এই অসহ্য যন্ত্রণা সহ্য করার ক্ষমতা আছে জন্যই হয়তো তারা সভ্যতার জন্ম দেয়।
আমি তার পাশে বসলাম- ব্যাথা কমলো কিছুটা?
মেয়েটা করুন চোখে আমার দিকে তাকালো। মুখে হালকা ছিপছিপে পানি জমে আছে। দুই বার মাথা নাড়িয়ে বললো হ্যা।
– আপনাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে। যদি কিছু মনে না করেন তবে আমি পানির বোতল টা ধরছি আপনি ঘুমানোর চেষ্টা করুন। তাতেই সারাদিন অনেক কিছুর মাঝে ছিলেন।
মেয়েটা সম্মতি সূচক মাথা নাড়ালো।
মেয়েটি আমার উরুতে মাথা দিয়ে শুয়ে আছে। কিছু সময়ের মাঝেই মেয়েটি একবারেই নিশ্চুপ হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে ব্যাথা কমে গেছে তাই ঘুমিয়ে পড়ছে। বোতলের মাঝে পানিগুলো ও শীতল হয়ে আসছে। এদিকে বসে থাকতে থাকতে কোমড়েও খিল ধরে আছে।
মেয়েটার মাথাটা বালিশে দিয়ে কি আমি শুয়ে পড়বো?
না থাক। আর কিছুটা সময় যাক। এখন সরাতে গিয়ে যদি জেগে যায়। এমনটা ভাবতে ভাতবেই আমি কখন ঘুমিয়ে পড়ছি বুঝতেই পারিনি।
– এই যে শুনছেন!
কথাগুলো কানে আসার চোখ মেললাম। কিন্তু চোখ মেলে নিজেকে অদ্ভুত এক ব্যাথার রাজ্যে বন্দী দশায় খুঁজে পেলাম। সেই থেকে বসেই ছিলাম আর এরমাঝে কোমড়ের অবস্থা, আমার মুখ দিয়ে প্রথম যে কথাটা বের হলো সেটা হচ্ছে- ওহ শীট।
– কি হলো!
– আমার কোমড়! আমার কোমড় খিল ধরে আছে আমি উঠতে পারছি না।
– আমি আপনাকে ধরছি দাঁড়ান।
– আপনার ব্যাথা কমেছে!
– এখন নেই তেমন।
– আচ্ছা তাহলে ধরুন।
মেয়েটার সাহায্য নিয়ে কোনো রকমে উঠে দাড়ালাম।
– আপনি কি বোকা নাকি!
– কেন আমি আবার কি করলাম!
– আপনি সারা রাত বসে কাটিয়ে দিলেন। আমি যখন ঘুমিয়ে পড়ছি তখন আপনিও ঘুমিয়ে পড়তেন
– ঘুমাতে চেয়েছিলাম কিন্তু ভাবলাম যদি আপনার ঘুম ভেঙে যায় আবার যদি ব্যাথা শুরু হয়। তাই আর সরানো হয়নি।
– এখন যে নিজেই ব্যাথায় কাতরাচ্ছেন!
– আপনার চোখে আমি যে ব্যাথার আবেশ দেখেছি সেই ব্যাথার তুলনায় কম আছে।
– সকাল হয়ে গেছে আপনার আম্মু ডাকতে এসেছিল। আপনি তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে আসুন আমি বাইরে গেলাম।
মেয়েটি চলে যাচ্ছে। আমি আবার পিছনে থেকে ডাকলাম।
– কিছু বলবেন!
– আমি আমার আম্মু আব্বুর একমাত্র ছেলে এটা তো জানেন তাই না!
– হ্যাঁ।
– আপনার কাছে আমার একটাই অনুরোধ আজকের পর থেকে যাতে তারা কখনো মেয়ে সন্তানের অভাব বুঝতে না পারে।
মেয়েটি মাথা নিচু করে হ্যাঁ বলে চলে গেলো।
এতক্ষণ উপদেশ দিতে ব্যাস্ত ছিলাম তাই বুঝতে পারি নি কিন্তু আমার কোমড় এখনো ভালো হয় নি।
তখন থেকে মেয়েটি বলে যাকে সম্মোধন করে যাচ্ছি উনি আমার অর্ধাঙ্গিনী। ওনার নাম অবন্তী। বিয়ের আগে শুধুমাত্র একবার ওনার ছবি দেখেছিলাম। তারপর আর না করতে পারিনি।
– কি হয়েছে খাওয়া বাদ দিয়ে বসে বসে কি ভাবছিস?
আম্মুর কথায় মাথা তুলে আম্মুর দিকে তাকালাম – তেমন কিছু না। খেতে ইচ্ছে করছে না।
– বিয়ে তো হঠাৎ করেই হয়ে গেলো এখন বড় করে একটা অনুষ্ঠান তো করতেই হবে। আত্মীয়রা সবাই আছে।
– সুমন কি বলো কবে অনুষ্ঠান করলে ভালো হয়?
আমি এবার আব্বুর দিকে তাকালাম। কিছুক্ষণ আম্মু আব্বু নিজেদের মাঝে কথা বলবে এরপর সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে সময় আমায় জিজ্ঞেস করবে। সব সময় এমনটাই হয় কিন্তু আজ এতো তাড়াতাড়ি জিজ্ঞেস করবে এটা আমার ভাবনায় ছিলো না।
– আমি তো বেশি ছুটি নিয়ে আসি নি। আমায় দুই একদিনের মাঝেই আবার চলে যেতে হবে। নয়তো কলিগের উপর অনেক প্রেসার পড়বে।
– তাহলে!
– আমরা তো হারিয়ে যাচ্ছি না। কিছু দিন যেতে দাও তারপর আমরা অনুষ্ঠান করবো।
– অবন্তী কে সাথে নিয়ে যাবি?
– উনি নতুন বউ কিছুদিন বাসাতেই থাক। পড়ে সময় করে নিয়ে যাবো।
অবন্তী বেডে বসে জহির রায়হান এর বরফ গলা নদী বইটা পড়ছে। ওকে পড়তে দেখো আমি কিছু না বলে বাইকের চাবিটা নিয়ে বের হবো তখন অবন্তী বললো- ধন্যবাদ।
– আমায় বললেন!
– হ্যাঁ।
– হঠাৎ ধন্যবাদ কেন?
– এই যে আপনি আমায় নিয়ে যাচ্ছেন না তাই। আমি কখনো বাসা থেকে দূরে থাকিনি। ওখানে গেলে তো আমি মরেই যেতাম।
আমি মুচকি হেঁসে বললাম- পড়ে যদি স্বেচ্ছায় যেতে চান তখন ও কিন্তু নিয়ে যাবো না।
– আমি কখনো যেতেই চাইবো না। কিন্তু আপনি এখন কোথায় যাচ্ছেন!
– বাইরে একটু কাজ আছে ।
বিকেলের দিকে বাসায় ফিরলাম। রুমে কেউ ছিলো না। তাই শপিং ব্যাগ গুলো বেডের মাঝে রেখে বারান্দায় আসলাম।
হঠাৎ রুমের ভিরত থেকে উচ্ছ্বাস ভরা হাসির শব্দ কানে আসলো। একটা ব্যাগে চকলেট ছিলো। মনে হচ্ছে অবন্তী সেটাই খুঁজে পেয়েছে। ইচ্ছে করেই আরও খানিকটা পরে রুমে আসলাম। ততক্ষণে অলরেডি তিন চারটে চকলেট শেষ হয়ে গেছে। বারান্দার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আমি অবাক চোখে অবন্তীর দিকে তাকিয়ে আছি। মনে হচ্ছে পাঁচ বছরের ছোট্ট একটা মেয়ে বসে বসে চকলেট খাচ্ছে। হঠাৎই অবন্তীর নজর আমার দিকে পড়লো- আপনি এগুলো আমার জন্য নিয়ে আসছেন তাই না?
অবন্তীর এমন হাসিহাসি মুখ দেখে কিছুটা মজা করতে ইচ্ছে হলো- কই না তো। ওগুলো তো আমার বন্ধু কিনেছিল ওর বউয়ের জন্য। আমায় বাসায় পৌঁছে দিতে বলেছে।
এই মুহুর্তটা অবন্তীর মুখ দেখার মতো হয়েছে। একদম ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেছে।
– কিন্তু আমি ভেবেছি এগুলো আমার জন্য এনেছেন তাই জন্য কয়েকটা খেয়েও নিয়েছি।
– কি বলছেন! এখন তো ও আমাকে বকবে।
– এখন কি করবেন?
– কি আর করার আপনার পেট কেটে সব চকলেট বের করতে হবে।
মেয়েটা সহজ সরল এটা জানতাম কিন্তু এতটা সহজ সরল সেটা বুঝতে পারি নি। আমার কথাটা সিরিয়াসলি নিয়েছে। দুচোখে পানি টলমল করছে।
– আচ্ছা কান্না করতে হবে না। আপনি খেয়ে নেন আমি নতুন করে কিনে দিয়ে আসবো।
এক মুহূর্তে চোখের টলমল ভাব উধাও হয়ে গেলো।
সন্ধ্যায় ছাঁদে দাঁড়িয়ে ফেসবুকিং করছি। হঠাৎ অপরিচিত একটা আইডি থেকে কয়েকটা পিক আসলো যেগুলো দেখার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। কিন্তু অবন্তী কে তো এমন মনে হচ্ছে না। ঠিক সেই সময় পিছনে অবন্তীর কন্ঠ- আম্মু আপনাকে খেতে ডাকছে।
আমি অবাক চোখে অবন্তীর দিকে তাকিয়ে রইলাম।
চলবে।