সূর্যকরোজ্জ্বল পর্ব-২৯ এবং শেষ পর্ব

0
39

#সূর্যকরোজ্জ্বল
পর্বসংখ্যা-২৯
ফারিহা জান্নাত

কোর্টে বসে আছে মারুফ-পৃথিশা। অবশেষে দীর্ঘ দুই মাস পর জাহিন ধরা পড়েছে। অপেক্ষার প্রহর যেন কাটতে চায় না কোনভাবেই। অবশেষে জাহিনকে আনা হলেই পৃথিশা নড়েচড়ে বসলো। তার হাত মারুফের হাতের মুঠোয় বন্দি। এই দু’টো মাস মারুফ প্রতিনিয়ত তাকে সাহস দিয়েছে। নিজের সকল চেনা-পরিচিত সোর্স দিয়ে জাহিনকে খুঁজে হাজির করেছে। সাথে আরও একজন সাহায্য করেছে তাকে, আদিদ। কোন কিছুতেই যখন কূলকিনারা পাচ্ছিলো না তখন দেখা মেলে আদিদের। নিজের সর্বাত্নক সহযোগিতা সে করেছে। শুনানি শুরু হলো, আসামী পক্ষের আইনজীবী প্রথমেই বলে উঠলেন,

– মণিদীপা চৌধুরী ছিলেন মানসিক বিকারগ্রস্ত,সেই সাথে মাদক পাচারকারী। নাহলে একজন মেয়ে হয়ে তিনি এরকম অন্ধকার জনমানবহীন গলিতে যাবেন কেন? মাদক পাচারে ধরা পড়ায় জনমানুষের কাছে মার খেয়ে তিনি রাস্তায় পড়ে থাকেন। সেই সময় জাহিন সাহেব সেখান দিয়ে গেলে তাকে দোষারোপ করা হয়। জাহিন সাহেব সম্পূর্ণ নির্দোষ।

কি নিদারুণ মিথ্যা। পৃথিশার রাগে গাঁ কাঁপতে থাকলো। মিথ্যা বলার তো একটা লিমিট থাকে। তবে তা টিকলো না। তৌসিফ দ্রুতই মোড় ঘুরিয়ে ফেললো। সব খেলা নিজের হাতে নিয়ে নিলো। অবশেষে সময় এলো বিচারকের রায়ের।

– জাহিন রহমানের দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় তার ফাঁসির রায় দেওয়া হলো।

মূহুর্তেই গগনবিদারী কান্নায় মুখরিত হলো আদালতের কার্যালয়। মিথ্যার কালো অন্ধকার সরিয়ে ন্যায় ও সত্যের জয় হলো অবশেষে, বহুক্ষণ পর। সব হারিয়ে সর্বশান্ত হওয়ার পর বিচার পেলো তবে দীর্ঘ পথের সেই যুদ্ধে সামিল হবার সুযোগ হলো না মণিদীপার।

________

চোখের সামনে নিজের প্রিয় মানুষের ক/বর। এতটা পথ সাহস নিয়ে পাড়ি দিলেও আজ যেন পৃথিশা ভেঙ্গেচুড়ে গেছে। এতগুলো দিন পেরিয়ে যাবার পরও পৃথিশা কোনদিন মণিদীপার কাছে আসার সাহস পায় নি। আজ এসেছে,এতগুলো দিন পর। আর এসে যেন নিজেকে সামলাতে পারছে না। হাঁটু ভেঙ্গে রাস্তায় বসে পড়লো সে। কান্না জড়িত স্বরে বলল,

– বুবু,আমি আমার কথা রেখেছি। দেখ তোর পৃথি আজ কত বড় হয়ে গেছে। নিজে সব সামলাতে পারছে। আর তাকে সর্বক্ষণ পাশ থেকে সাহায্য করছে একজোড়া হাত। বুবু জানিস, তোর কথা খুব মনে পড়ে। তুই আমায় কত যত্ন করতি, জানিস তোর পছন্দের চুলগুলো কত লম্বা হয়ে গেছে এখন। তোকে খুব মিস করি বুবু। কেন তুই থাকলি না। আমার বুবু তো স্ট্রং ছিলো, সে কেন এমন একটা কাজ করলো। আমি আর কিছু জানতে চাই না বুবু, আর কিছু নেয়ার শক্তিও আমার নেই। পুরো দুনিয়া ঠিকভাবে চলছে, অথচ আমার বুকের ভিতরা দুমড়ে-মুচড়ে ভেঙ্গে যাচ্ছে প্রতি ক্ষণে ক্ষণে। মধ্যরাতে ঘুম ভেঙে, চোখ খুলে সবার প্রথমে তোর কথা মনে পড়ে বুবু। তুই নেই, অথচ যেন সর্বক্ষণ আছিস আমার সাথে, আমার পাশে।পৃথিবীর কঠোরতা সহ্য করতে করতে আমি ক্লান্ত। তোর আর বাবা-মায়ের ছায়া মাথার উপর থেকে চলে যাওয়ার পর আমি একরাতও শান্তিতে ঘুমাতে পারি নি। তোর বিচার না পাওয়া পর্যন্ত আমি শান্তি পেতাম না বুবু। আজ যেন আমার সকল অপেক্ষার অবসান ঘটলো। আজ থেকে আমি মুক্ত,বুকেভারী বোঝা নিয়ে আমি শ্বাস নিতে পারতাম না। বিধাতা বোধ হয় আমায় এবার শ্বাস নেবার সুযোগ দিবে। তুই খুব খুব ভালো থাক বুবু, আমি তোর জন্য দোয়া করি।

পৃথিশা আর বলতে পারল না কিছু। কান্নায় কন্ঠ রোধ হয়ে এলো। মারুফ পাশে বসে বুকে জড়িয়ে নিলো তাকে। কাঁধে থাকা শক্ত পুরুষালি হাতটা বুঝিয়ে দিলো, আমি আছি।

পৃথিশাদের থেকে খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে আদিদ। তার চোখ জ্বলছে, মায়ের আদেশে বিয়ে করেছে একমাস হলো। অথচ মণিদীপাকে ভুলতে পারছে না কোনভাবেই। তাইতো ছুটে এসেছিলো পৃথিশার কাছে সাহায্য করতে। সৃষ্টিকর্তার পরিকল্পনা সবসময়ই অন্যরকম, তার হাতেই সব। তাও আমরা নিজ পরিকল্পনায় মেতে থাকি সারাক্ষণ।

পৃথিশার চান্স হয়েছে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে। পৃথিশা সেখানে গেছে ঠিকই কিন্তু মারুফ ঢাকায়ই আছে। আজ সে এসে নিজেদের পুরোনো বাসায় উঠেছে। অনেকদিন পর নিজ শহর,চেনা পরিবেশে এসে যেন প্রাণভরে শ্বাস নিতে পারলো পৃথিশা। বুক ভরে শ্বাস নিয়ে আকাশ পানে বলল,

– প্রিয় শহর, আমি আমার কথা রেখেছি। আমার সকল ওয়াদা সম্পূর্ণ করেই আমি এই মাটিতে পা দিয়েছি। এই শহর আমার সব কেড়ে নিয়েছে, অথচ এই শহরই আমায় পরিপূর্ণতা দিয়েছে। ওহে পৃথিবী, তুমি জানিয়ে দিয়ো সত্য সবসময় সূর্যের সেই আলোর মতোই চিরন্তন ও অনিবার্য সত্য যা ক্ষণিকের জন্য মেঘে ঢাকলেও কখনো চাপা পড়ে যায় না।

রাত বারোটায় বাসার বেল বাজতেই অবাক হলো পৃথিশা। এতরাতে এখানে কে আসবে। বাসায় একা থাকায় ভয়ও হতে লাগলো। দোয়া-দুরুদ পড়ে দরজা খুললেও কাউকে দেখতে পেলো না। ভ্রু কুঁচকে দরজা লাগাতেই কেউ এসে মুখে চেপে ধরে ঘরের ভিতর নিয়ে গেলো। ঘটনা এত দ্রুত ঘটলো যে কিছুই বুঝে উঠতে পারলো না। আত্নার সব পানি যেন শুকিয়ে গেছে। শক্তিশালী হাতটা মুখ ছেড়ে দিতেই লম্বা শ্বাস টেনে পিছনে ঘুরলো সে।
মারুফ দাঁড়িয়ে। মেজাজ খারাও হওয়ার সাথে সাথে অবাকও হলো। মারুফ পেছন থেকে সাদা গোলাপ গোলাপের তোড়া বের করতেই রাগে ভাটা পড়লো। ফুলের তোড়া নেওয়ার জন্য হাত বাড়াতেই মারুফ কাছে টেনে নিলো তাকে। একটা ফুল কানের পাশে গুঁজে দিয়ে বলল,

– হ্যাপি বার্থডে টু দ্যাট গার্ল হু হ্যাভ বিউটি উইথ ব্রেইন। অলসো হ্যাপি বার্থডে টু মাই লাভ। তোমার জন্মদিনে আল্লাহ আমাকে তৌফিক দান করুক যাতে তোমায় সব বিপদ, কঠোরতা থেকে আগলে রাখতে পারি।

-সমাপ্ত

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে