#সূর্যকরোজ্জ্বল
পর্বসংখ্যা-২৮
ফারিহা জান্নাত
পৃথিশা নিচে রেডি হয়ে নামতগেই দেখলো মারুফ গাড়ি বরে করেছে। পৃথিশাকে দেখেই তাড়া দিলো,
– তাড়াতাড়ি, লেট হয়ে যাবে।
পৃথিশার এই মূহুর্তে মারুফেরসাথে যাবার কোন ইচ্ছা নেই। কিন্তু নতুন করে কোন ঝামেলা করলো না। সে মারুফের চিন্তাভাবনা বুঝতে চায়,সে কি আসলেই তার কথা বিশ্বাস করেছে কিনা এ নিয়ে সন্দিহান সে।
– কি হলো? দাঁড়িয়ে এত কি ভাবছো?
পৃথিশা চুপচাপ গাড়িতে বসলো। আজ মনে হয় রাস্তাটা দ্রুতই পেরোলো। পৃথিশাকে নামিয়ে চলে যাওয়ার সময় মারুফ বলল,
– আমি নিতে আসতে পারবো না। তুমি চলে যেও।
পৃথিশা অবাকই হলো খানিকটা। এতগুলো দিনে মারুফই তাকে দিয়ে যেতো আবার নিয়ে আসতো। পৃথিশা কিছু না বলে ভিতরে পরীক্ষা দিতে চলে গেলো।
হাজার চেষ্টা করেও পরীক্ষায় মনোযোগ দিতে পারলো না আজ। অগত্যা আগেভাগেই বের হয়ে আসলো। বাহিরে বেরিয়ে আসতেই দেখলো মারুফ গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মাঝে মাঝে আশেপাশে তাকাচ্ছে। পৃথিশাকে দেখেই এগিয়ে আসলো,কপালে হাত রেখে জিজ্ঞেস করলো,
– আজ তাড়াতাড়ি এসে পড়লে যে? শরীর খারাপ লাগছে?
পৃথিশা রোদে তাকাতে পারছে না, তবুও মুখ তুলে মারুফের দিকে তাকালো। এই লোকটাকে সে বুঝতে পারে না। কেমন ধোঁয়াশা লাগে। মারুফ আবারো প্রশ্ন করলে উত্তর দিলো, না ঠিক আছি আমি।
গাড়িতে বসে মারুফ খানিকটা শান্ত স্বরেই জিজ্ঞেস করলো,
– পৃথিশা,কেসটা রি-ওপেন কবে করতে চাচ্ছো?
চমকে উঠে মারুফের দিকে তাকালো পৃথিশা। অবাক হয়ে বলল,
– আপনি..
কথা শেষ করলো না সে। বিস্ময় কাটছে না। সে ভাবেনি মারুফ তার কথা বিশ্বাস করবে। পৃথিশাকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে মারুফ বলল,
– হে, আমি। কি হলো বলো?
– আপনি আমার কথা বিশ্বাস করেছেন?
– আমি তোমাকে কখনো অবিশ্বাস করি নি পৃথিশা।
ছোট্ট একটা কথা, পৃথিশার মনে চলতে থাকা সব দ্বিধাবোধ কাটিয়ে দিলো।
– পরীক্ষাটা শেষ হোক, তারপর নাহয়।
– আমার একজন পরিচিত লইয়ার আছে, তার হেল্প নিতে পারো।
– আচ্ছা, সময় হলে বলব।
গাড়ি অন্য রাস্তায় যেতেই পৃথিশা অবাক হলো। অবশেষে যে বাসার সামনে থামলো তা দেখে মারুফের দিকে তাকালে মারুফ বলল,
– আর কতদিন এভাবল ভুল বোঝাবোঝি চলবে? খালার সাথে সবটা ঠিক করে নাও। নামো তাড়াতাড়ি।
পৃথিশা নামলো। অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে নামতেই দেখা হয়ে গেলো রায়ানের সাথে। পৃথিশাকে মারুফের সাথে দেখে ভ্রু কুঁচকে এদিকে আসতে গিয়েও কি মনে করে থেমে গেলো। পৃথিশা রায়ানকে দেখে মারুফের বাহু ঘেঁষে দাঁড়ালো। মিনমিনিয়ে বলল,
– ঢুকতে দেবে না।
– দেবে, আমি কথা বলেছি খালার সাথে। আসো তো।
কলিংবেল বাজাতেই রাহনুমা বেগম এসে দরজা খুলে দিলো। পৃথিশাকে দেখতে পেয়েই জড়িয়ে ধরলো। পৃথিশা হতভম্ব। রাহনুমা বেগমের কন্ঠস্বর কান্নাজড়িত,
– সরি বাচ্চা, আমি বুঝতে পারি নি তুই এতো ঝামেলার মধ্যে পড়ে যাবি।
– আই মিস ইউ খালা।
গতকাল পৃথিশার পরীক্ষা শেষ হয়েছে। আজই সে পুরোনো মামলার কাগজ নিয়ে বসেছে। মারুফ বলল,
– একটু রেস্ট নাও, এ কয়েকদিন তো অনেক দৌড়ঝাঁপ করলে। কিছুদিন পর নাহয় শুরু কর।
– এমনিতেই অনেক দেড়ি হয়ে গেছে, আমি আর দেড়ি করতে চাইছি না।
মারুফ বুঝলো পৃথিশাকে বুঝিয়ে লাভ হবে না।
– আচ্ছা, আপনার না কোন বন্ধু ছিল? তার সাথে আমি দেখা করতে চাই। আজ করা যাবে?
মারুফ পৃথিশার হাত থেকে কাগজগুলো সরিয়ে তাকে নিজের কাছে টেনে আনলো। পৃথিশা বুঝলো না হুট করে কি হয়েছে।
– পৃথিশা শোন,হাইপার হবে না। আমার কথা শোনো আগে।
– কি হয়েছে?
– জাহিন দেশ থেকে পালিয়ে গিয়েছে দুইদিন আগে। কোনভাবে খবর পেয়েছিলো তুমি মামলা করবে, সেজন্যই কাউকে না জানিয়ে চলে গিয়েছে। আমি আজ সকালে জানতে পেরেছি।
হতভম্ব হয়ে গেলো পৃথিশা। কি বলবে কথা খুঁজে পেলো না। বলল,
– ওকে খুঁজে আনা যাবে না?
– যাবে তো জান, সময় লাগবে। এছাড়া তুমি একা মামলা চালিয়ে গেলেই তো হবে না। আসামী পলাতক থাকলে রায় হলেও কার্যকর হবে কীভাবে?
পৃথিশা আর কিছু বলল না। মনটাই খারাপ হয়ে গেলো। মারুফ বুঝলো সেটা। পৃথিশার চুলগুলো গুছিয়ে দিতে দিতে বলল,
– এভাবে ভেঙে পড়লে কি চলে পৃথি? এতগুলো দিন চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছো, এখন এসে হাল ছেড়ে দিলে হবে। আমরা আমাদের সব রকম চেষ্টা করবো। ডিফেন্সের লোকজনের সাহায্য নিলে ওকে সহজেই খু্ঁজেমপাওয়া যাবে। আমার পৃথি তো স্ট্রং, সে সব পারে।
_______
একটা ক্যাফেতে বসে আছে পৃথিশা,তার পাশে মারুফ। মারুফের পরিচিত লইয়ার তৌসিফের সাথে দেখা করতে এসেছে। কিছুসময় পরই তার দেখা মিললো। মারুফ উঠে গিয়ে হাত মিলালো তার সাথে। ইন্টার লাইফে বন্ধু ছিলো দু’জন, তারপরই আলাদা হয়ে যায়। আজ এত বছর পর দরকারে দেখা হলো দু’জনের। দ্রুতই কাজের কথা উঠলো। সবরকম ডকুমেন্টস দেখে তৌসিফ বলল,
– মামলা সাজানো কঠিন হবে না। তুই একদম চিন্তা করিস না মারুফ, আসামীকে যত ধরনের মামলায় জড়ানো যায় সবটাই আমি দেবো।
মারুফ মাথা নাড়লো। মাঝখান দিয়ে কথা বলে উঠলো পৃথিশা,
– কেন? হি ইজ অ্যা রে//পি//স্ট। এটা কি যথেষ্ট নয় তার শাস্তি হওয়ার জন্য? অন্যান্য মামলা দিতে হবে কেন? আমি পুরো ব্যাপারটা স্বচ্ছ চাই, কোন ছিঁটেফোঁটা মিথ্যা যাতে এখানে না থাকে।
শেষ কথাটা মারুফের উদ্দেশ্য বলল সে। মারুফ নিজেও সহমত, তৌসিফকে বলল,
– ও যা বলে তাই কর।
– কাজ হয়ে যাবে দ্রুতই।
তৌসিফের কথামতো কাজ আসলেই দ্রুত হলো। সেই সাথে খবরও ছড়ালো দ্রুত। মামলা করার তিনদিনের মাথায়ই মারুফের আত্মীয়-স্বজনের ফোন আসা শুরু করলো ঘটনা জানার জন্য। ব্যাপারটা কোনমতে সামলাতে পারলেও সামলানো গেলো না জাহিনের মা’কে। তিনি নিজের ভাইকে নিয়ে হাজির হলেন মারুফের বাসায়।
বাসায় অতিথি আসলে তাকে অবশ্যই আপ্যায়ন করতে হবে। পৃথিশা তাদের বসতে বলে চা আনতে গেলো, মারুফ বাসায় নেই। পৃথিশা জানে ঘটনা অন্যদিকে মোড় নিতে পারে। তাই মারুফকে ফোন করে তাদের আসার কথাও জানিয়ে দিলো। তাদের নাস্তা দিলেও তারা সরাসরি কথায় গেলেন। প্রথমেই মুখ খুললেন জাহিনের মামা, পৃথিশা অনেকদিন পর দেখলো তাকে। ভাগ্নের জন্য সদূর ময়মনসিংহ থেকে তিনি এসে পড়েছেন।
– মামলাটা তুলে নাও।
– কেন তুলবো?
জাহিনের মামা বিরক্ত হলেন। কড়া স্বরে বললেন,
– বোন তো মরে ভূত হয়েছে সেই কবে। এখনো এত তেজ কিসের তোমার? ভালোয় ভালোয় বলছি মামলা তুলে নাও, নাহলে
– নাহলে কি? কি করবেন? আমার অবস্হাও বুবুর মতো করবেন নাকি? অবশ্য একই জাত বলে কথা, কর্মও তো একই হবে।
– মুখ সামলে কথা বলো মেয়ে।
তার থেকেও দ্বিগুণ জোরে চিৎকার করে উঠলো পৃথিশা,
– আপনারা কি মানুষ? নিজের ছেলে বলে এত বড় একটা অপরাধ কিভাবে ক্ষমা করেন আপনারা? আপনার তো মেয়ে আছে শুনেছি, তাকে রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখলে মানতে পারবেন? আপনাদের ছেলে মানুষ হয়, পশুর চেয়েও অধম। সে মানসিকভাবে অসুস্হ, তাই বলেই এরকম জঘন্য কাজ করতে পেরেছে।
পৃথিশার চিৎকারে তারা থেমে গেছে।পরিস্হিতি থমথমে। মারুফ কখন দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে খেয়াল করেনি। মারুফকে খেয়াল করে তারা কিছু বলতে চাইলে মারুফ শান্ত স্বরে বলল,
– আপনারা এবার আসুন।
মুখের উপর অপমানিত হওয়ার তারা চলে গেলেন চুপচাপ। দরজা লাগিয়ে পৃথিশার কাছে আসলো মারুফ। তাকে বুকে জড়িয়ে ক্লান্ত স্বরে বলল,
– কাঁদো।
মূহুর্তেই ঝড়ঝড়িয়ে কেঁদে ফেললো পৃথিশা। বুকের কাছের শার্টটা মুচড়ে ধরে বলল,
– তারা এমন করে কেন?
চলবে,