#সূর্যকরোজ্জ্বল
পর্বসংখ্যা-২৭
ফারিহা জান্নাত
গতকাল রাতের বৃষ্টির আবেশ এখনো যায় নি। পরিবেশে এখনো ঠান্ডা আবহাওয়া বিরাজ করছে। এই ঠান্ডার মাঝেই গরমে ঘুম ভেঙে গেলো পৃথিশার। গলার গরম শ্বাস পড়ছে অনবরত। মারুফের ভাড়ে চিড়ে-চ্যাপ্টা হয়ে যাচ্ছে সে। মারুফের কপালে হাত দিতেই বুঝলো জ্বর হালকা আছে এখনো। নিজেকে কোনমতে ছাড়িয়ে উঠতেই দেখলো শাড়ির বেহাল দশা।ভাগ্যিস তার আগে ঘুম ভেঙেছে। শাড়ি সামলিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো পৃথিশা। আজ সারাদিনে মারুফের সামনে আসবে না সে।
বাসায় গিয়ে ফ্রেশ হয়ে পড়তে বসলো পৃথিশা। হাতে মনে একসপ্তাহের মতো আছে পরীক্ষার। অথচ তার পড়াই হচ্ছে না ঠিকমতো। কিছুসময় পড়ার পরই কলিংবেল বাজতে শুরু করলো, একবারও থামছে না। অনবরত বেজেই যাচ্ছে। হকচকিয়ে উটলো পৃথিশা, দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলতে মারুফ হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়লো। পড়নে গতরাতের টিশার্ট, মুখ ভেজা,চোখে-মুখে উদভ্রান্ত ভাব। পৃথিশা কিছু বলার আগেই মারুফ বলতে শুরু করলো,
– আমি আমি সরি পৃথিশা। কি যেন হয়ে গেলো, আমি সরি। আমার লিমিটে থাকা উচিত ছিল কিন্তু..
পৃথিশা হতভম্ব। মারুফ ঘনঘন শ্বাস ফেলছে। মারুফ আবারও কিছু বলার আগেই পৃথিশা এগিয়ে তার মুখে হাত দিয়ে থামিয়ে দিলো।
– আমি কি আপনাকে কিছু বলেছি?
মারুফ আড় চোখে পৃথিশার দিকে তাকালো। মেয়েটার কন্ঠস্বর লাজুক। কিছু না বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো।পরিস্হিতি স্বাভাবিক করতে পৃথিশা নিজেই বলল,
– আপনার জ্বর কমেছে? ফ্রেশ হয়ে আসুন, আমি নাস্ত বানাচ্ছি।
মারুফ চলে গেলো ফ্রেশ হতে। পৃথিশাও নিজের ফ্ল্যাট লক করে মারুফের ফ্ল্যাটে গেলো।
নাস্তা বানানোর সময় পৃথিশা গতকালকে দেখা ছেলেটার কথা মনে এলো। কাজের চাপে ভুলেই গিয়েছিলো সে। ছেলেটা মারুফের কি হতে পারে এই চিন্তাটা মাথায় হানা দিলো।
নাস্তার টেবিলে বসে পৃথিশা অন্য কোন কথায় না গিয়ে সরাসরি মারুফকে জিজ্ঞেস করলো,
– জাহিন আপনার কে হয়?
মারুফ খাওয়া থামিয়ে অবাক চোখে তাকালো।
– তুমি ওকে কি করে চিনো?
– আপনি আমার প্রশ্নের উত্তর দিন আগে।
– আমার দুঃসম্পর্ক খালাতো ভাই হয় কেন? কিছু হয়েছে?
পৃথিশা মারুফের চোখের দিকে তাকিয়ে শক্ত কন্ঠে বলল,
– আপনি কোনদিন আমার পরিবার নিয়ে জানতে চান নি। কেন?
– কারন হসপিটালে তুমি নিজেই বলেছিলে আঙ্কেল-আন্টি মারা গিয়েছে।
– আপনার একবারও মনে হলো না আমি একা থাকি কেন,কেন আমার কোন আত্নীয়ের বাসায় থাকি না?
– আমার এসব নিয়ে কৌতুহল হয় নি কখনো।
– কেন হয় নি?
মারুফ খাওয়া থামিয়ে পৃথিশার দিকে তাকালো। চোখে-মুখে অবাকের রেশ অথচ পৃথিশার মুখ কঠোর।
– তুমি এসব নিয়ে পড়লে কেন এখন?
পৃথিশা হুট করে বলা শুরু করলো,
– আমার একটা বোন ছিলো। আমার থেকে বছর ছয়েকের বড়। তাকে আমি বুবু বলে ডাকতাম। আমার বুবু এত সুন্দর ছিলো,এত নরম মনের মানুষ ছিলো সে। বাবার রিটায়ার্ডের পর নিজেই সংসারের হাল ধরলো। বাচ্চা একটা মেয়ে এখানে-ওখানে দৌড়াদৌড়ি করে টিউশনি করিয়ে বেড়ায়, নিজের পড়াশোনাও সামলায়। একদিন সন্ধ্যায় বুবু বাসায় আসলো না। সময় গড়ায় কিন্তু বুবু আসে না।
পৃথিশার গলা ধরে এসেছে। মারুফ পরবর্তী ঘটনার খানিকটা আঁচ করতে পেরে আঁতকে উঠছে। টেবিলে থাকা পৃথিশার হাতটা আলতো করে ধরলো সে। পৃথিশা থামলো না আবারও বলতে শুরু করলো,
– এলাকার এক ছেলে সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে বুবুকে বিরক্ত করতো মাঝে মাঝে। কেউ পাত্তা দেই নি আমরা। সন্ধ্যায় গড়িয়ে রাত হলে আমি আর বাবা বুবুকে খুঁজতে বের হই। জানেন, আমার বুবু দেখতে অনেক সুন্দর। এত সুন্দর মানুষ আমি আর কখনো দেখি নি। সেই বুবুকে যখন রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখি বিবস্ত্র অবস্হায় তখন আমার পায়ের নিচের মাটি সরে গিয়ছিলো। আমি বিশ্বাসই করতে পারি নি এমন কিছু হবে। বুবু আমাকে সেল্ফ ডিফেন্স শিখিয়েছিলো। রাস্তার ঝোঁপে লুকিয়ে থাকা ছেলেটা যখন আমার দিকে এগিয়ে এসেছিলো আমি ছুঁড়ি দিয়ে মেরে দেই তাকে।বুবুর শোকে বাবা হার্ট অ্যাটাক করলো, আর আমি গ্রেফতার হলাম সেই ছেলেকে মারার অপরাধে। সকালে যখন আমি জেল থেকে ছাড়া পাই ততক্ষণে বাবা দুনিয়া ছেড়েছে।
পৃথিশার কান্নায় গলা ভেঙ্গে এসেছে। মারুফ উঠে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরলো। আদুরে গলায় বলল,
– কাঁদে না সোনা, সব ঠিক হয়ে যাবে।
পৃথিশা চোখ মুছে আবারও বলা শুরু করলো,
– জানেন আমি কখনো ভাবতেই পারি নি বাবা আমাকে ছেড়ে চলে যেতে পারে। এই জিনিসটা আমার কল্পনারও বাইরে ছিলো। বাবা চলে যাওয়ার পর আমি যেন আমার রূপকথার জগত থেকে বাস্তবে ছিটকে পড়লাম। আমার সবসময় শক্ত থাকা বুবু জ্ঞান ফিরার পর ভেঙ্গে গুড়িয়ে গেলো। আত্নীয়-স্বজন কাউকে কাছে পাই নি জানেন। মা তো নিজেই ভেঙ্গে পড়েছিলো, আমি সব সামলাতে চেষ্টা করলাম। এলাকা পাল্টালাম, বাসা চেঞ্জ করলাম। আমার এত প্রচেষ্টা,এত আয়োজন সব এক নিমিষে ভেঙ্গে বুবু আ/ত্ন/হ/ত্যা করলো এক রাতে। যে রাতে বুবু এই জঘন্য কাজটা করলো সেদিন রাতেও সে আমাকে ভাত খায়িয়ে দিলো, চুল আঁচড়ে মাথায় তেল দিয়ে দিলো,বাঁচতে শিখালো। বিধাতা বোধহয় আমাকে একসাথে শূন্য করে দিতে চেয়েছিলো তাইতো বোধহয় মা আর বুবু একসাথেই চলে গেলো। আমার কথা কেউ ভাবলো না। এতদিন পুতুলের মতো যত্নে বড় করে, আমাকে ফেলে চলে গেলো তারা। এত ভালোবাসার মানুষ,আমার পরিবার, আমার জীবন সব এক ধাক্কায় পাল্টে গেলো শুধুমাত্র একটা ঘটনাকে কেন্দ্র করে।
পৃথিশা কাঁদছে, তার কন্ঠস্বর যেন সবকিছুকে ছাপিয়ে গিয়েছে। নিজেকে মারুফের থেকে ছাড়িয়ে পানি খেয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলো সে। তারপর বলল,
– এইসব কিছুর কেন্দ্রে যে সে হলো আপনার দুঃসম্পর্কের আত্মীয় জাহিন। আমার বোনের মৃত্যুর কারণ সে, আমার পরিবার ধ্বংসের কারন৷ জাহিনের মামা এলাকার এমপি,তার ভয়ে কেউ আমাদের মামলা নিতে চায় নি। তার জন্য কোন অপরাধ না করেও আমি জেলে ছিলাম।
মারুফ হতভম্ব। সে পৃথিশাকে বুঝানোর স্বরে বলল ,
– পৃথিশা,তোমার মনে হয় কোথাও ভুল হচ্ছে। আমার কথাটা..
পৃথিশা থামিয়ে দিলো তাকে,
– এই পৃথিবীতে আমি যে মানুষটাকে সর্বোচ্চ ঘৃণা করি, তাকে চিনতে আমার ভুল হবে না কোনদিন। এই ব্যাপারে আমি কোন এক্সপ্লেইনেশন শুনতে চাই না, আপনার কোন মতামত-ও চাই না। আপনাকে জানানোর দরকার ছিলো তাই বললাম। খুব শীঘ্রই আমি আবার কেসটা রি-ওপেন করবো। শুধু পরীক্ষাটা শেষ হোক।
– যদি তোমার ভুল হতে থাকে তবে?
রাগের পারদটা তরতরিয়ে ভেড়ে গেলো পৃথিশার। টেবিলে বাড়ি দিয়ে চিৎকার করে বলল,
– আমার পরিবারের খুনিকে চিনতে আমার ভুল হবে? ডা. আহমেদ, আপনি হয়তোবা ব্যাপারটার গভীরতা এখনো বুঝে উঠতে পারেন নি নয়তো বুঝেও না বুঝার ভান করছেন কারন যার বিরুদ্ধে অভিযোগ সে আপনার ভাই।
– তুমি চিৎকার করছো কেন পৃথিশা। আমি তোমার কথা বিশ্বাস করেছি, কিন্তু এই বিষয়ে আমি এখন কোন কথা বলতে চাই না। রেডি হতে যাও,তোমার পরীক্ষা আছে।
মারুফ কথা না বাড়িয়ে রুমে চলে গেলো। মারুফ যেতেই পৃথিশা দেয়াল ঘেঁষে বসে পড়লো, চোখ দিয়ে পানি পড়ছে অনবরত। মারুফের এহেন আচরণ তার আশাযোগ্য ছিলো না। মারুফকে বিচক্ষণ ভেবেছিলো সে, ভেবেছিলো মারুফ ব্যাপারটা খতিয়ে দেখবে কিন্তু তার কথায় ধোঁয়াশা।
– বুবুর বিচারের জন্য যদি আপনাকে ছাড়তে হয় সেটাতেও আমি রাজি আছি ডাক্তার, কত কিছুই তো হারিয়েছি এবার নাহয় আপনাকে ছাড়লাম।
চলবে,