#সূর্যকরোজ্জ্বল
পর্বসংখ্যা-২৫
ফারিহা জান্নাত
কান্না থেমে গেছে পৃথিশা। এখনও থেমে থেমে নাক টানছে। তার মাথতা মারুফের বুকের কাছে। পৃথিশার কান্নায় শার্ট ভিজে গেছে কিছুটা। নিজের অবস্হান খেয়াল করতেই লজ্জায় পড়ে গেলো পৃথিশা। হালকা নড়াচড়া করতেই মারুফ হাতের বাঁধন হালকা করলো। পৃথিশা সরে এসে ওড়নায় নাক মুছলো। কেউই কিছু বলছে না। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে মারুফ বলে উঠলো,
– তোমার কোল্ড অ্যালার্জি আছে পৃথিশা? নাক টানছো কেন এতো? দেখি এদিকে আসো।
রিমোট নিয়ে এসিটা অফ করে দিলো মারুফ। পকেট থেকে রুমাল বের করে পৃথিশার হাতে দিয়ে ইশারা করলো নাক মুছে নিতে। পৃথিশা রুমাল হাতে নিয়ে বসে রইলো। নিজের প্রতি কেমন বিরক্ত লাগছে। কি এমন হয়েছিলো যে পৃথিশাকে কেঁদে ফেলতে হলো, এরথেকে বড় আঘাত কি সে পায় নি নাকি!পেয়ছে তো, তাহলে আজ কেন মারুফের সামনে কেঁদে ফেললো। পৃথিশার ভাবনার সুডতা কাটলো মারুফের কন্ঠস্বরে।
– তুমি কফি খাও? এখানে চা পাওয়া যায় না।
– আমি বাসায় যাবো।
– পরে যাবে,আমার সাথে।এখন বসো এখানে চুপচাপ।
– আমি এখানে থেকে কি করবো? অযথা সময় নষ্ট, আমার পড়া আছে।
মারুফ চেয়ার টেনে পৃথিশার মুখোমুখি হলো। পৃথিশর দিকে মাথা ঝুঁকালে পৃথিশা ভ্রুঁ কুঁচকে তাকায়।
– আমাকে দেখো বসে বসে, যেহেতু তোমার কোন কাজ নেই।
চোখ বড় বড় হয়ে গেলো পৃথিশার। নিজের চেয়ারটা টেনে পিছিয়ে গেলো খানিকটা। গলা ঝেড়ে বলল,
– কফি খাবো।
সশব্দে হেসে দিলো মারুফ।
– আমার সাথে কথা ঘুরিয়ে তুমি পার পাবে না পৃথিশা।
পৃথিশা কেবিনের এক কোণায় বসে পড়ছে। এদিকে মারুফ তার নিজের কাজ করছে।পৃথিশা বুঝে পেলো না ওকে বসিয়ে রেখে মারুফের লাভ কি হচ্ছে। মারুফ হুট করেই উঠে পৃথিশাকে বলল,
– পড়া বন্ধ করো। আমার সাথে এসো।
পৃথিশা ভাবলো বাসায় যাবে বোধহয়। কিন্তু না মারুফ পৃথিশাকে নিয়ে গেলো টেস্ট করাতে। পৃথিশা না করলেও শুনলো না। পরপর এতগুলো টেস্ট করে ক্লান্ত হয়ে গেলো পৃথিশা। মেজাজ চটে গেলো তার। টেস্ট করা শেষে মারুফ তাকে এনে গাড়িতে বসিয়ে আবার কোথাও যেন চলে গেছে। কিছুসময় পরই মারুফ গাড়িতে বসলে পৃথিশা দাঁত চিবিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
– আপনার টাকা কি বেশি হয়ে গেছে?
– কেন? কি হলো?
– এতগুলো টেস্ট করালেন কেন?
– বউয়ের পিছনে খরচ করছি, তোমার গায়ে লাগছে কেন?
পৃথিশা হতভম্ব। এই লোক বিরাট চালু। রাগ উঠে গেলো তার।গাড়ির দরজা খুলার চেষ্টা করে বলল,
– আচ্ছা, আপনি তাহলে আপনার বউ নিয়েই থাকেন। আমি যাই।
মারুফ পৃথিশার হাত টেনে আবার গাড়িতে বসিয়ে দরজা লক করে দিলো। পৃথিশার ফুলো ফুলো গাল দু’টো টেনে বলল,
– আহারে, থাক রাগ করে না।
আর রেগে থাকতে পারলো না পৃথিশা। মুখ ঘুরিয়ে ফেললো, চাপা হাসিতে ছেয়ে গেলো তার মুখ।
– এতগুলো টেস্ট করানোর সত্যি কি কোন দরকার ছিলো?
– প্রেশার,সুগার সব তলানিতে রেখে এসে জিজ্ঞেস করছো কেন টেস্ট করিয়েছি? খাওয়া-দাওয়া করতে কি কষ্ট হয়ে যায় খুব বেশি? সারাক্ষণ অনিয়ম শুধু।
মারুফের গলার স্বর হুট করেই গম্ভীর হয়ে গেলো। পৃথিশা বিপরীতে কিছু বলার সুযোগ পেলো না। বাসায় পৌঁছাতেই পৃথিশা নিজের বাসায় ও মারুফ তার বাসায় চলে গেলো। পৃথিশাকে মারুফ থাকতে বললেও পৃথিশা না করে দেয়। নিজেকে তার এখন সামলানো প্রয়োজন।
_____
অনবরত কলিংবেলের আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেলো পৃথিশার। বুঝে নিলো মারুফই এসেছে। এক সপ্তাহ হতে চললো বিয়ের। পৃথিশা এখনো আলাদাই থাকে। দরজা খুলতেই দেখলো মারুফ হাতে বাজার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ঘুমে এখনো চোখ খুলতে পারছে না পৃথিশা। মারুফ দরজার পাশে বাজারের ব্যাগ রেখে বলল,
– পৃথিশা আমার খালারা আসছে আজ। তারা বিয়ের খবর পেয়েছে কোনভাবে। আমার সাথে বাসায় চলো, ওনারা আলাদা দেখলে খারাপ ভাববে।
কথাগুলো পৃথিশার কানে গেলো না মনে হয়। সে তখনো ঘুমে ঢলছে। দীর্ঘশ্বাস ফেললো মারুফ, কপাল গুণে বউ পেয়েছে যার ঘুম পেলে দিন-দুনিয়ার হুঁশ থাকে না। পৃথিশাকে টেনে নিজের বাসায় নিয়ে পৃথিশার বাসাটা লক করে দিলো সে। এসে দেখলো পৃথিশা সোফায় বসে ঢুলছে। পৃথিশাকে নিয়ে বেডরুমে রেখে নিজে রান্নার কাজে লেগে পড়লো।
ঘন্টাখানেক পর পৃথিশার ঘুম ভাঙলে নিজেকে এই বাসায় দেখে অবাক হলো। ঘুমের ঘোরে থাকায় তখন কিছুই টের পায় নি। গায়ে ওড়না জড়িয়ে বাহিরে গিয়ে দেখলো মারুফ রান্নাঘরে কি যেন করছে। চোখে-মুখে পানি দিয়ে সেদিকে যেতেই দেখলো এলাহি কান্ড। মারুফ নাস্তা বানিয়ে একপাশে রেখেছে। রোস্টে করার জন্য মাংসগুলো ভেজে তুলে রাখছিলো তখন। গায়ে কিচেন এপ্রোণ পড়া। গরমের তাপে চোখ-মুখ লাল হয়ে আছে। পৃথিশা বিস্মিত হয়ে দেখলো তাকে, এই ছেলে সবকিছুতে এক্সপার্ট! “বাহ্ পৃথিশা, কি সুন্দর ভোলাভালা জামাই তোর” নিজেই নিজেকে বাহবা দিলো পৃথিশা। পরক্ষণেই নিজের চিন্তায় অবাক হলো। মারুফ এতক্ষণ পর পৃথিশাকে খেয়াল করলো। চুলার আঁচ কমিয়ে পৃথিশাকে বলল,
– তুমি এখানে গরমের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছো কেন? নাস্তা করো নি তো, এসো নাস্তা করবে।
– আপনি এতসব করছেন কেন? আজ কি কিছু আছে? আমি এখানে এলাম কিভাবে?
মারুফ পৃথিশার অবুঝ চাহনি দেখে বুঝলো তার বউয়ের কিছুই মনে নেই। নাস্তার প্লেটটা হাতে নিয়ে পৃথিশাকে রান্নাঘর থেকে নিয়ে যেতে যেতে বলল,
– ওমাহ্, তোমার কিছুই মনে নেই? আমরা যে একসাথে থাকলাম সারারাত। সব ভুলে গেলা? হ্যাঁ?
মারুফের কন্ঠস্বর কৌতুকময়। পৃথিশা রেগে মারুফের পেটে গুঁতা দিলে, শব্দ করে হেসে দিলো সে।
– আমি নিয়ে এসেছি বউ। এখন কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ নাস্তা করো।
মারুফ কথা বলতে না বললেও পৃথিশা থামলো না। আবারও জিজ্ঞেস করলো,
– আপনি এত আয়োজন করছেন কেন? কে আসবে?
– আমার খালারা আসবে।কাছের আত্মীয় বলতে তারাই আছে। আমি আসলে জানাই না কাউকে বিয়ের খবরটা। কিন্তু বাড়িওয়ালার কাছ থেকে যেন খবর পেয়ে গেছে। এখন আজকে তারা আসছে। তোমাকে আলাদা থাকতে দেখলে কথা বলবে নানা রকম,তাই তোমাকে নিয়ে এলাম।
পৃথিশা আবারও কিছু বলতে চাইলে মারুফ পাউরুটি তার মুখে ঢুকিয়ে দিয়ে বলল,
– আর কোন কথা না।
খাওয়া শেষ করে পৃথিশা এসে দেখে মারুফ এখনো রান্না করছে। পৃথিশা প্লেটটা সিঙ্কে রেখে এগিয়ে গেলো তার দিকে। তাকে ঠেলেঠুলে সরানোর চেষ্টা করে বলল,
– আপনি সরুন,অনেক করেছেন।এবার আমি করি। সরুন না, উফ্ এত ভারী কেন আপনি?
হাজার চেষ্টা করেও মারুফকে সরাতে পারলো না পৃথিশা। শেষমেষ মুখ ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। মারুফ হেসে বলল,
– কি ব্যাপার,শক্তি শেষ?
পৃথিশা কথা বলল না। টিস্যু বক্স থেকে টিস্যু এনে মারুফের দিকে এগিয়ে দিলে মারুফ ইশারায় জিজ্ঞেস করে কি করবে। পৃথিশা বলল,
– ঘাম মুছে নিন।
মারুফ মাথা ঝুঁকিয়ে দিলো যার অর্থ তুমি মুছে দাও। পৃথিশা ইতস্তত করে ঘামটুকু মুছে দিয়ে বলল,
– অনেক তো হলো।এবার আমাকে করতে দিন, আপনি ক্লান্ত হয়ে গেছেন। আমি পারব তো।
পৃথিশার জোরাজুরিতে অবশেষে মারুফ সরলো। আসলই অনেক ক্লান্ত লাগছিলো। রান্নাঘর থেকে বেরোনোর আগে পৃথিশাকে বলে গেলো,
– চুলার আঁচ বেশি বাড়াবো না। ওড়না সামলে রাখবে, আর ছুঁড়ি ধরবে না। দূরে দাঁড়িয়ে কাজ করো।
মারুফের দিকে হাতশ হয়ে তাকালো পৃথিশা। লোকটা তাকে কি মনে করে? বাচ্চা নাকি সে? একা একা থাকে, নিজের রান্না তো নিজেকেই করতে হয়। তবুও পৃথিশার বহুদিন পর এই শাসন পেয়ে ভালো লাগলো।ভদ্র বাচ্চার মতো মাথা নাড়িয়ে বলল,
– আচ্ছা, আপনি এখন যান তো।
মারুফ চলে গেলো। তবে বেশিক্ষণ রেস্ট নিলো না, আধ ঘন্টা পরই আবারো ফিরে আসলো। অতঃপর দু’জনে মিলে রান্নাটা শেষ করে নিলো। এখন বাকি শরবত বানানো। পৃথিশা এটার জন্য বটি দিয়ে লেবু কাটতে নিলেই মারুফ হালকা স্বরে চিৎকার করলো। চমকে উঠলো পৃথিশা। মারুফ দ্রুত এগিয়ে এসে পৃথিশাকে সরিয়ে ধমকে বলল,
– তোমাকে না বললাম এগুলো ধরবে না। তাও কেন ধরেছো?
পৃথিশা কিছু বলল না। বিস্মিত হয়ে মারুফের দিকে তাকিয়ে রইলো।মারুফ আবারো জিজ্ঞেস করলো,
– কোথাও কেটেছে? কথা বলছো না কেন?
– আমি ছোট বাচ্চা না, এগুলো করে অভ্যাস আছে আমার। আপনি হাইপার হয়ে যাচ্ছেন কেন?
মারুফ শান্ত হলো খানিকটা। পৃথিশাকে সরিয়ে বললো,
– আচ্ছা, তুমি এখন যাও। বাকিটা আমি করে নিচ্ছি। ওরা এসে পড়বে। গোসল করে নাও।
পৃথিশা আর কথা না বাড়িয়ে চলে যেতেই মারুফ তাকে থামিয়ে বললো,
– আচ্ছা, একটু দাঁড়াও। আমিও আসছি।
হতভম্ব হয়ে গেলো পৃথিশা। আমিও আসছি মানে কি? লোকটার কি গরমে মাথা খারাপ হয়ে গেলো। মারুফ এগিয়ে আসলে পৃথিশা দু’কদম পিছিয়ে গেলো। মারুফ বুঝলো না কিছুই।
– কি হয়েছে?
– কি হবে? কিছুই হয় নি।
পৃথিশার কথা আটকে যাচ্ছে। মারুফের চোখ দেখে বুঝলো পৃথিশা যা ভেবেছে মারুফ সেটা মিন করে বলে নি। পৃথিশা চুপচাপ সোফায় ফ্যানের নিচে গিয়ে বসলো। এত গরম পড়েছে, রান্নাঘরে যেন দম বন্ধ হয়ে আসছিলো। মারুফ একটা প্যাকেট নিয়ে পৃথিশার সামনে আসলে পৃথিশা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়। মারুফ তার হাতে এটা দিয়ে বলে,
– এটা আমার দাদীর শাড়ি। আম্মু পেয়েছিলো উত্তরাধিকার সূত্রে। বাড়ির বউকে দেখতে আসলে এই শাড়ি পড়তো।
পৃথিশা চুপচাপ হাত বাড়িয়ে প্যাকেটটা নিয়ে নিজের বাসায় যেতে নিলেই মারুফ বললো,
– তোমার সমস্যা হলে পড়া লাগবে না।
– আমি কি একবারও বলেছি আমার সমস্যা হবে?
চলবে,
সূর্যকরোজ্জ্বল
পর্বসংখ্যা-২৬
ফারিহা জান্নাত
বাড়িভর্তি মামুষের মাঝে অতি পরিচিত ঘৃণিত মানুষের মুখশ্রী দেখে মাথাটা যেন ঘুরে উঠলো পৃথিশার। কোনমতে টলমলে পায়ে বাড়ির গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই মারুফ তাকে দেখে বলল,
– এই তো পৃথিশা এসে পড়েছে।
পৃথিশার পড়নে মারুফের দেওয়া শাড়ি, চুলগুলো আলগা করে খোপা করা, চুলের পানিতে ব্লাউজ ভিজে গেছে খানিকটা। মাথায় আঁচল টেনে পৃথিশা মারুফের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। সবার সাথে কুশল বিনিময় শেষে খাওয়া-দাওয়ার পর্ব শুরু হলো। পৃথিশা বুঝতে পারছে না কিন্তু এখন পর্যন্ত কেউ তার পরিবার সম্পর্কে কোন কিছু জানতে চায় নি। ব্যাপারটা তার কাছে বিস্ময়কর ঠেকছে। পুরো বাসা মানুষে ঠাসা। খাবার টেবিল এমনিতেই ছোট, পুরো সোফার রুম জুড়ে মানুষ বসেছে। কাজ করার মধ্যেও এত মানুষের ভীড়ে পৃথিশার চোখ বারবার কাঙ্খিত মানুষটাকে খুঁজছে। তবে পেলো না কোথাও। অবশেষে আস্তে ধীরে মানুষ যাওয়া শুরু করলে পৃথিশা মারুফকে খুঁজে পেলো। মারুফ তাকে দেখেই দূর থেকে জিজ্ঞেস করলো, কি হয়েছে? পৃথিশা উত্তর দিলো না। মারুফের কাছে গিয়ে তার পাঞ্জাবি মুঠ করে ধরে দাঁড়িয়ে রইলো চুপচাপ। খুব অস্হির লাগছে তার।
মারুফ বুঝে উঠতে পারলো না কি হয়েছে হুট করে। তবুও পৃথিশাকে নিজের সাথেই রাখলো পুরোটা সময়।
সবাই চলে যাওয়ার পর পৃথিশা ও মারুফ খেতে বসলো। এতক্ষণ সুযোগ হয় নি। খেতে বসেই মারুফ জিজ্ঞেস করলো,
– পৃথিশা? কি হয়েছে? কেউ কিছু বলেছে?
– হু?
পৃথিশা অন্যমনস্ক ছিলো। মারুফের কথা খেয়াল করে নি ঠিকমতো। মাথায় অন্যকিছু ঘুরছে। একটু আলাদা থাকতে চায় সে। সেজন্যই বলল,
– আচ্ছা, আমি পরে খাই। পেট ভরা ভরা লাগছে।
– চুপচাপ বসো। এক পা-ও নড়বে না।
মারুফ প্লেটে খাবার বাড়ার জন্য হাত উঠাতেই পৃথিশার নজরে এলো হাতের তালু জুড়ে থাক বড় ব্যান্ডেজ। হকচকিয়ে মারুফের দিকে তাকাতেই মারুফ তার দৃষ্টি অনুসরণ করে নিজের হাতের দিকে তাকালো। পরপরই হাতটা নিচে রেখে মিইয়ে যাওয়া স্বরে বলল,
– কিছুই হয় নি।
পৃথিশা শুনলো না। হতভম্ব হয়েই হাতটা জোর করে নিজের দুই হাতের মাঝে নিলো। বটি দিয়ে কিছু কাটতে গিয়ে পুরো তালু কেটে গেছে নিশ্চয়ই। মূহুর্তেই চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে গেলো পৃথিশার। কপট রাগ দেখিয়ে বলল,
– আমাকে না বললেন আমি পারব না, এগুলো যাতে না ধরি। আপনি কি করেছেন এটা?
মারুফ উত্তর দিতে পারলো না। মেয়েটার কান্না দেখে সে নিজেই অবাক হয়ে গেছে। বড় বড় চোখ দুটোতে পানি আসলে এত সুন্দর দেখায়। পৃথিশা চোখের পানি মুছে ফেললে মারুফের মনে হলো সে আরেকটা হাত কেটে নিয়ে এসে আবারও তাকে কান্না করাক। তার সেই কল্পনা অবশ্য বাস্তবে পরিণত হলো না পৃথিশার কথায়। সে অনবরত মারুফকে ধমকেই যাচ্ছে।
ঠোঁটের উপর শক্ত পুরুষালি হাতের স্পর্শ টের পেতেই শক্ত হয়ে গেলো পৃথিশা। চোখজোড়া আপনাআপনিই বড় আকার ধারণ করলো, হৃদপিণ্ডের গতি হলো লাগামছাড়া। কিছু বলার শক্তি পেলো না আর।
– কথাটা একটু বন্ধ রাখেন মহারানী, ইচ্ছা করে কাটি নি তো।
মারুফ ঠোঁট থেকে হাত সরালে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলো পৃথিশা। নিজেই খাবার বাড়তে শুরু করলো। তবে মারুফের ডান হাত কাটায় কিভাবে খাবে তা নিয়ে বেশ বিড়ম্বনায় পড়তে হলো। শেষমেশ পৃথিশা নিজেই প্লেট থেকে খাবার তুলে মারুফের মুখের সামনে ধরলো। ইশারায় মুখ খুলতে বলতেই বাধ্য ছেলের মতো পৃথিশার হাতে খেয়ে নিলো সে।
______
বাহিরে মুষলধারে বৃষ্টি। ক্ষণে ক্ষণে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বিকালের দিকেই নিজের ফ্ল্যাটে ফিরে এসেছিলো পৃথিশা। এখন রাত প্রায় দশটা বাজতে চললো। হুট করে কারেন্ট চলে গেলে ভয় পেয়ে গেলো পৃথিশা। বাসায় একটা মোমবাতিও নেই যে জ্বালাবে। অগত্যা মারুফের ফ্ল্যাটেই যেতে হলো তাকে।
কয়েকবার বেল বাজানোর পরও দরজা খুললো না কেউ। পৃথিশার চিন্তা হলো, মারুফ তো একবার বেল বাজালেই দরজা খুলে দেয়। পৃথিশার কাছে একটা এক্সট্রা চাবি ছিলো, মারুফ দিয়েছিলো যাতে প্রয়োজনে ব্যবহার করতে পারে। সেটা দিয়েই দরজা খুলে ভিতরে ঢুকলো সে। বাসায় আইপিএস আছে, তাই এখানে বোঝার উপায় নেই যে কারেন্ট গেছে। ঘরের লাইট-ফ্যান সব ছাড়া। পৃথিশা সেগুলো অফ করে মারুফের রুমের দিকে গেলো। দরজা লাগানো, নব মোচড়ে ভেতরে ঢুকতেই গা হিম হয়ে এলো তার। ঘুটঘুটে অন্ধকার,এসি ছেড়ে পুরো রুম ঠান্ডা করে রাখা হয়েছে। পৃথিশা জলদি এসি অফ করে লাইট জ্বালালো। কম্বল গায়ে শুয়ে আছে মারুফ। মাথাটা পর্যন্ত কম্বলের ভিতর ঢুকানো। পৃথিশা এগিয়ে কপালে হাত রাখতেই মনে হলো যেন আগুনের তাপ লেগেছে গায়ে। হুট করে মারুফের এত জ্বরের কারন বুঝতে পারলো না সে। কয়েকবার ডাকলেও মারুফ যখন সাড়া দিলো না তখন বুঝলো জ্বরে জ্ঞান হারিয়েছে।
চটজলদি জ্বরপট্টি দেওয়ার ব্যবস্হা করলো সে। কিন্তু জ্বর না কমায় মাথায় অনবরত পানি ঢেলে গেলো। অবশেষে আধঘন্টা পর শরীরের তাপমাত্রা কমলে স্বস্তির শ্বাস ফেললো সে। মগ, বালতি সরিয়ে মারুফকে ঠিকমতো শুয়িয়ে
দিলো। পড়নে এখনো শাড়ি, আঁচলের দিকটা ভিজে গিয়েছে।
মারুফকে এবার কয়েকবার ডাকতেই চোখ মেলে তাকালো সে। ঠিকমতো চোখ মেলতে পারছে না তবুও আধো আধো স্বরে বলল,
– পৃথি?
– হু, এত জ্বর এলো কীভাবে আপনার?
মারুফ উত্তর দিলো না। হাত বাড়িয়ল পৃথিশাকে ছোঁয়ার চেষ্টা করলো। পৃথিশা মুখটা একটু এগিয়ে নিলে মারুফ হালকা করে ছুঁয়ে বলল,
– সত্যি তুমি?
– সত্যিই আমি। এবার আপনি উঠুন, ঔষধ খেতে হবে।
মারুফ উঠলো না। গা ছেড়ে পড়ে রইলো। পৃথিশা তাড়াতাড়ি হালকা খাবার এনে মারুফকে খাওয়ানোর জন্য উঠাতে চাইলো। কিন্তু মারুফ শরীর শক্ত করে আছে। সে উঠবেই না। পৃথিশা মাথা ঝুঁখিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
– কি সমস্যা আপনার?
পৃথিশা আরও কিছু বলার আগেই ঠোঁটজোড়া আটকে গেলো। মারুফের জ্বর যেন এবার পৃথিশার মধ্যেও ছড়িয়ে পড়লো। শরীরে সমস্ত শক্তি যেন শেষ হয়ে গেছে। ভারসাম্যহীন হয়ে যেতেই আরও আঁকড়ে ধরলো মারুফ। খানিকক্ষণ পর মারুফের গম্ভীর স্বরে বলল,
– পৃথিরানী?
পৃথিশা জবাব দিতে চাইলো, গলায় মারুফে গভীর স্পর্শ পেতেই চুপ হয়ে গেলো পুরোপুরি।
চলবে,