#সূর্যকরোজ্জ্বল
পর্বসংখ্যা-১৯
ফারিহা জান্নাত
দুশ্চিন্তায় হাঁত কাঁপছে পৃথিশার। এখন পর্যন্ত একটা বাসার খোঁজ পায় নি সে। ঢাকায় তার তেমন কোন বন্ধু-ও নেই যাদের কাছে সাহায্য চাইতে যাবে। নিস্তব্ধ রাত। হুটহাট এক-দুইটা গাড়ির আওয়াজ ব্যতীত কোন শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। ঘড়ির কাঁটাটা জানান দিচ্ছে সময় তখন রাত এগারোটা। উপায় না পেয়ে মোবাইলের কন্ট্যাক্ট লিস্ট ঘাটতে বসলো পৃথিশা যদি কাউকে পাওয়া যায় যে সাহায্য করতে পারবে এই মূহুর্তে। অনেক ঘাটাঘাটি শেষে পৃথিশা তার পুরোনো একজন শিক্ষকের নাম্বার পেলো যিনি এখন ঢাকায় থাকেন। নাম্বার পেয়ে যাওয়ার পরও সংকোচ হতে লাগলো পৃথিশার, হুট করে ফোন করে এভাবে সাহায্য চাওয়াটা বেমানান। উনার সাথে পৃথিশার শেষ কথা হয়েছে এক বছর আগে। অবশেষে উপায় না পেয়ে ফোন করলো সে। প্রথমবারে কেউ ধরলো না, বরং কেটে গেলো ফোনটা। হতাশ হয়ে গেলো পৃথিশা। এবার আর কোন উপায় হাতে থাকলো না তবে। তবে কিছুসময় পরই ফোনের রিংটোনে বিছানাশুদ্ধ কেঁপে উঠলো। সেই ম্যামের নাম্বার, খুশিতে ফোনটা ধরতেই পুরুষালি গলা শুনে হকচকিয়ে গেলো সে। ফোনের ওপাশ থেকে তখন ক্রমাগত আওয়াজ আসছে,
– কে বলছেন, হ্যালো?
নিজেকে সামলে জবাব দিলো পৃথিশা। খবর পেলো ম্যাম মারা গেছেন মাস ছয়েক হবে। মনটা খারাপ হয়ে গেলো তার। পছন্দের মানুষ বলেই কি তারা এত তাড়াতাড়ি চলে যায়। ফোনের ওপাশে থাকা লোকটা ম্যামের ছেলে। কেন ফোন দিয়েছে জানতে চাইলেই পৃথিশা উশখুশ করা শুরু হলো। একবার ভাবলো এই লোকের কাছে কি সাহায্য চাবে, পরক্ষণেই আবার দুশ্চিন্তা ভর করলো মাথায়। অবশেষে অনেকটা বাধ্য হলেই একটা বাসা ভাড়ার কথা বলতেই লোকটা বলল তাদের একটা স্টুডিও ফ্ল্যাট খালি হয়েছে এক সপ্তাহ আগে,এখনো ভাড়া হয় নি। পৃথিশা চাইলে থাকতে পারে। খবর পেয়ে খুশি হলেও চিন্তা গেলো না পৃথিশার। একজন অপরিচিত লোকের কথায় এভাবে যাওয়াটা ভালো মনে হচ্ছে না। তবুও উপায় না পেয়ে ঠিকানা জেনে রাখলো। কিছু না পেলে সেখানেই যাবে।
ফোন রেখে ব্যাগ গুছাতে বসলো সে। এই বাসায় এসেছে অনেকদিন অথচ তার একটা লাগেজ এখনো বের করাই হয় নি। সেই লাগেজ ভর্তি শুধু শাড়ি। বেশির ভাগই মণিদীপার,কয়েকটা মায়ের। একেকটা শাড়ির একেকটা গল্প কিন্তু খুলার সাহস হয় নি কখনো, ভয় হয় খুললেই যে কেঁদে ভাসাবে। আলমারি থেকে কাপড়চোপড়গুলো বের করে লাগেজে রাখছিলো। হুট করেই রাতের থমথমে নিস্তব্ধতা বিরাজমান পরিবেশে গানের শব্দ শুরু হলো। শব্দটা রায়ানের রুম থেকে আসছে। পৃথিশা ঘড়িতে তাকিয়ে দেখলো রাত বারোটা বাজে। এত রাতে এত জোরে গান বাজানোর মানে কি। তবক কিছু বলল না সে, রায়ানের রুম ও তার রুম পাশাপাশি। তাই গানের শব্দটা কানে একটু বেশিই আসছে। ইংরেজি গান বাজছে ক্রমাগত।
– Darling I am a nightmare dress like e daydream…
– ইউ ওয়ার অ্যাকচুয়েলি অ্যা নাইটমেয়ার।
সকাল আটটা বাজতেই বরাবরেই মতোই দরজায় টোকা পড়লো। গতরাতে এমনিতেই গানের শব্দে ঘুমাতে বেশ দেড়ি হয়েছে এখন আবার সকাল সকাল ঘুম ভেঙে যাওয়ায় মাথা ব্যাথা শুরু হয়ে গেলো। এই বাসায় আবার নিয়ম মেনে সকাল আটটায় ব্রেকফাস্ট করে ফেলা হয়। বিরক্ত হয়ে ফ্রেশ হতে গেলো পৃথিশা,রোজ রোজ এই জ্বালা সত্যিই নেওয়া যাচ্ছে না। আয়নায় নিজেকে দেখতেই বিরক্তিটা আরও বেড়ে গেলো যেন।রাতে চুলে বেণী করে ঘুমিয়েছিলো, কিন্তু এখন চুলের দফারফা অবস্হা। বড় চুল দেখতে যেমন সুন্দর লাগে তেমনি সামলাতেও ঝামেলা পোহাতে হয়। খাবার টেবিলে আসতেই দেখতে পেলো রায়ান ও রাহনুমা বেগম বসে। তারই অপেক্ষা করছিলো যেন। খিচুড়ির ঘ্রাণ ঘরময় ছড়িয়ে গেছে। পৃথিশা প্লেট উল্টো করতে করতে বলল,
– কি ব্যাপার? শাহী খানাপিনা কেন, বিদায় উপলক্ষে নাকি?
কথার মাঝে সূক্ষ খোঁচাটা রায়ানের বুঝতে সমস্যা হলো না। চোখ রাঙিয়ে পৃথিশার তাকাতেই পৃথিশা তাকে দেখিয়ে কাবাবের টুকরো’টায় বড়সড় একটা কামড় বসালো। তাকে বিন্দুমাত্র পাত্তা না দিয়ে রাহনুমা বেগমের দিকে তাকিয়ে বলল,
– সেই বানিয়েছো খালা। তোমার হাতের রান্না মানেই বেস্ট।
রাহনুমা বেগম পৃথিশার মাথায় হাত বুলালেন, মেয়েটাকে নিজের কাছে রাখার জন্য এখানে এনেছিলেন। কিন্তু ভাগ্য, কি এক ঝামেলার জাঁতাকলে পড়লেন।একদিকে নিজের আপন ছেলে, অন্যদিকে পৃথিশা। রায়ানের সাথে কথা বলেছিলেন তিনি কোন অজ্ঞাত কারনে রায়ান কোন কিছু মানতে নারাজ। তার একমাত্র চাওয়া পৃথিশাকে সে দেখতে চায় না এখানে। তিনিও পাল্টা কিছু বলার সুযোগ পায় নি। তার চিন্তার সুতো কাঁটলো রায়ান প্লেটের শব্দে। খাবারগুলো প্লেটে নিয়ে সে নিজের রুমে দিকে যেতে যেতে বলল,
– রুমে খাবো আমি।
রাহনুমা বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। কিসের এতো দ্বন্দ্ব তাদের মাঝে। পৃথিশা রায়ানের দিকে চোখ তুলে তাকালো না, তার সম্পূর্ণ মনোযোগ খাওয়ার দিকে কবে আবার খালার হাতের রান্না খেতে পারবে কে জানে।
সকালের খাওয়া শেষ করেই পৃথিশা বের হয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। বেশি দেড়ি করা যাবে না। সে আপাতত প্ল্যান বি হিসেবে একটা হোটেলে উঠার চিন্তা করেছে। মোবাইলে একটা উবার বুক করে শেষ বারের মতো জিনিসপত্রগুলো গুছিয়ে নিলো সে। নিজ বাড়ি ছেড়ে আসার পর এখন তার অন্য কিছু ছাড়তে কষ্ট হয় না। উবার আসার কল পেতেই ব্যাগ নিয়ে রুম থেকে বের হলো সে। ড্রয়িং রুমে রাহনুমা বেগম বসে টিভি দেখছিলেন,সোফায় রায়ান বসে চা খাচ্ছে। পৃথিশাকে ব্যাগ নিয়ে বের হতে দেখে রাহনুমা দৌড়ে এলেন। পৃথিশা তাকে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো। মূহুর্তেই কন্ঠ রোধ হয়ে আসলো তার। মা তুল্য খালার স্নেহ, ভালোবাসার ঋণ শোধ সে করতে পারবে না কোনদিন। রাহনুমার কন্ঠস্বর কান্নামিশ্রিত,
– তুই কোথায় যাস পৃথি? তোকে না বললাম তুই আমার সাথে থাকবি?
পরিস্থিতি সামলানো যতটা সহজ হবে ভেবেছিলো পৃথিশা ততটা সহজ মনে হলো না। রাহনুমা বেগম তাকে ছাড়তেই চাইছে না। রায়ানের মুখও হতভম্ব, সে হয়তোবা পৃথিশা সত্যিই চলে যাবে।
– খালা, আমি বললাম তো তোমার সাথে দেখা করবো আমি নিয়ম করে। কিন্তু আমি এখানে থাকতে পারবো না। তুমি আমাকে চেনো। ঢাকায় এসেছি শুধু তোমার জন্য, এখন আমাকে বিদায় দাও হাসিমুখে। খুব শীঘ্রই দেখা হবে। তোমার পিছু এত দ্রুত ছাড়ছি না সুন্দরী।
কোনভাবেই পৃথিশাকে আটকানো গেলো না। রাহনুমাকে ছেড়ে পৃথিশা রায়ানের সামনে গেলো। মুখে কিছু বলার ইচ্ছা ছিলো না তেমন। তবুও কিছু কথা না বললেই নয়।
– মিস্টার রায়ান হোয়াটএভার, আপনার পুরো নামটাও জানি না দেখুন। অথচ আপনি আমরা হিস্ট্রি জানতে চেয়েছিলেন। কিছু বলার নেই, শুধু বলব জেলাসিটা একটু কমান নাহলে নিজেই জ্বলেপুড়ে ছাড়খার হয়ে যাবেন যেমনটা এখন হচ্ছেন।
পৃথিশাকে শেষ পর্যন্ত আটকানো গেলো না। সে চলে গেলো নিজ গন্তব্যের উদ্দেশ্যে।
ঠিকানায় পৌঁছাতেই পৃথিশা চার তলায় চলে গেলো। চার তলায়ই ফ্ল্যাটটা ফাঁকা হয়েছে শুনেছিলো সে। ‘এ’ ফ্ল্যাটটা ম্যামের বাসা, অন্য ফ্ল্যাটটা খালি। সেই ফ্ল্যাটে গিয়ে কলিংবেল বাজাতেই দরজা খুলে বেরিয়ে এলো একজন পুরুষ। মুখটা দৃশ্যমান হতেই পৃথিশার মুখটা আপনাআপনি হা হয়ে গেলো।
চলবে,