#সূর্যকরোজ্জ্বল
পর্বসংখ্যা-১৭+১৮
ফারিহা জান্নাত
১৭
– সরি আন্টি,ভুলে চলে এসেছি। আসলে আমরা ভেবেছিলাম এটা প্রিয়তাদের বাসা।
রুম থেকে বেরিয়ে আসার আগেই মারুফের কন্ঠস্বর শুনে দাঁড়িয়ে পড়লো পৃথিশা। রায়ানও ততক্ষণে রুম থেকে বেরিয়ে এসেছে। পৃথিশার দিকে দৃষ্টি তার। মারুফরা অতি দ্রুতই বিদায় নিয়ে চলে গেলো। পৃথিশাও নিজের রুমে এসে পড়া শুরু করলো। দুই ঘন্টা পর তার একটা পরীক্ষা আছে,অথচ এখনো দুইটা চ্যাপ্টার রিভিশন বাকি। কিছুসময় পরই রায়ান এলো তার রুমে। ইদানীং পৃথিশা নিজেকে রায়ানের থেকে সরিয়ে নিয়েছে। অকারণে সামনে যায় না, রুমে তো একেবারেই না। রায়ানকে দেখেওনা দেখার ভান করলো সে।
– মারুফ তোমার সাথে দেখা করতে এসেছিল তাই না?
পৃথিশা উত্তর দিলো না। বইয়ে মুখ বুজে থাকলো।
– উত্তর দাও পৃথিশা। রাগ বাড়াবে না। মারুফের জন্যই আমাকে রিজেক্ট করেছো?
পৃথিশা নিরুত্তর। কথাগুলো হজমের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। রায়ান যে আরও বিষাক্ত কিছু বলবে, তার জন্যও নিজেকে প্রস্তুত রাখলো।
– বাহ্, ঢাকায় এসেছো দুই দিনও হয় নি অথচ এর মধ্যেই বয়ফ্রেন্ড জুটিয়ে ফেললে। পারফেক্ট মা..
– আপনাকে কথা বলার সুযোগ দিয়েছি বলে এর মানে এই না যে যা খুশি তাই বলবেন। ঘরে থাকতে দিয়েছেন বলে যে আপনার সব কথা শুনতে হবে এটাও না। আপনি আপনার অনুভূতি জানিয়েছেন আমি আমার টা। পারলে সম্মান করবেন না করতে পারলে নাই। কিন্তু বারবার এটা নিয়ে ঝামেলা করবেন না। আর রইলো উনার কথা, একজন মানুষ হিসেবে আমাকে সাহায্য করেছেন এবং এতটুকুই আমাদের পরিচয়। এর বাহিরে কিছু না। আমি তাকে এর আগে কখনও দেখিও নি।
পৃথিশা থামলো। রায়ানের চোখ-মুখ থমথমে। যেন এখনই আবার কিছু বলবে। হলোও তাই,
– বেশি কথা শিখে গিয়েছো দেখছি। যার টা খাও,যার টা পড়ো তার উপরেই কথা। আর যাওয়ার জায়গা কোথায় তোমার?
সঠিক জায়গায় তীর ছুঁড়লো রায়ান। তীরটা বুকে ডেবে বসলো তো বসলোই, একেবারে ফাঁলা ফাঁলা করে দিলো। ‘যাওয়ার জায়গা’ কথাটা দুইবার উচ্চারণ করলো পৃথিশা। তৎক্ষনাৎ রায়ানকে কোন জবাব দিতে পারলো না। কিয়ৎক্ষণ পর কাঁপা গলায় বলল,
– আমি এখানে কখনোই আসতে চাই নি। কখনোই না। তার কারন আপনার মতো এখানকার মানুষগুলো। যতক্ষণ আপনাদের কথামতো পুতুল হয়ে থাকবো ততক্ষণ আমি ভালো, আপনিও ভালো। কিন্তু যখনই নিজের মত দেবো তখনই আমি খারাপ,আশ্রিতা তাই না? খালা আমাকে জোর করে এখানে এনেছে, আমার থাকার জায়গার অভাব হতো না। বুবুর ব্যাংক অ্যাকাউন্টের পিন,বাবার অ্যাকাউন্ট সবই আমার জানা। বুবু আমার নামে অ্যাকাউন্ট খুলে টাকাও জমাতো। আমার অভাব হতো মানুষের। তাই আমি এসেছিলাম খালার সাথে।
চোখের কোণে জমা পানিটা মুছলো পৃথিশা। রায়ানের দৃষ্টি তখনও তার দিকে। কিছু বলার পূর্বেই পৃথিশা তার মোবাইল বের করে রায়ানের সামনে ধরলো। রায়ানের দিকে ইশারা করলো স্ক্রিনে তাকাতে।
– দেখতে পাচ্ছেন এগুলো কি? থাক আমিই বলি, আপনার বাগদত্তার ম্যাসেজ। কোথা থেকে আমার নাম্বার জোগাড় করেছে কে জানে। আমি যেন আপনার থেকে দূরে থাকি। আরে আমি আপনার কাছেই গেলাম কখন? আপনার চাল আমি বুঝতে পেরেছি বহু আগেই। এতটাও গাধা নই যে মানুষের দৃষ্টি বুঝবো না। একসাথে কয় জনকে লাগে আপনার?
রায়ান চুপ। কোন কথা বলছে না। পৃথিশা আবারো বলল,
– এটা ফার্স্ট ও লাস্ট ওয়ার্নিং মিস্টার রায়ান, যদি কখনো আমার কাছ ঘেঁষার সুযোগ খুঁজেছেন আপনাকে আমি দেখে নিব।আর কিছুক্ষণ আগে যে খোঁটাটা দিলেন না? যে আমি আপনাদের খাই,আপনাদের পড়ি। খুব দ্রুতই এখান থেকে চলে যাবো,মানুষের বোঝা হয়ে থাকার মতো পরিস্থিতি এখনো আসে নি। এখন রুম থেকে বের হোন।
রায়ান আর কোন কথা বললো না। চুপচাপ রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। রায়ান চলে যেতেই পৃথিশা বই নিয়ে বসলো আবারও। তবে চোখের পানিতে অক্ষরগুলো দেখতে পাচ্ছে না। টুপটাপ পানি ফোঁটা ক্রমশ বইটা ভিজিয়ে দিতে থাকলো।
কোচিংয়ের উদ্দেশ্য বের হয়েছে পৃথিশা। আজ রায়ানের সাথে আসে নি। একাই এসেছে। ক্যান্টনমেন্টের ভিতরে সাধারণত রিকশা কিংবা সিএনজি কখনোই থাকে না। তাই বাধ্য হয়েই এই কড়া রোদের মধ্যে হাঁটা শুরু করেছে সে। মন-মেজাজ খুবই বিক্ষিপ্ত। আগে মেজাজ খারাপ থাকলে যেই কথা বলতে আসতো তার উপর রাগটা ঝেড়ে দিতো।এই কাজটা সবথেকে বেশি করতো মণিদীপার উপর। পৃথিশা এই কয়েকদিনে উপলব্ধি করেছে মণিদীপা তার জীবনের কতটা জুড়ে ছিলো। তার প্রত্যেকটা কাজে মণিদীপার হাত ছিলো, এখন পর্যন্ত মণিদীপাকে ছাড়া কোন সিদ্ধান্ত সে নিয়েছে বলে মনে পড়ে না। চুপচাপ হাঁটার অভ্যাস পৃথিশার নেই। এই মূহুর্তে তার গান শুনে হাঁটতে ইচ্ছা করছে কিন্তু দুইদিন আগেই হেডফোনটা নষ্ট হয়ে গেছে। এক কানে শোনা যায়,আরেক কানে শোনা যায় না। হাঁটার মাঝেই কারো ধাক্কা খেয়ে পিছিয়ে গেলো সে। চোখের থাকা চশমাটা ঠিক করে সামনে তাকাতেই দেখতে পেলো একজন মেয়ে সাথে মারুফ। মেয়েটার সাথেই পৃথিশা ধাক্কা খেয়েছে। পৃথিশা সরি বলার আগেই মেয়েটা মারুফের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আসি তাহলে।’
মারুফ মাথা নাড়াতেই মেয়েটা চলে গেলো। পরপরই পৃথিশার দিকে তাকালো মারুফ। মৃদু হেসে বলল,
– কেমন আছেন আপনি? পায়ের অবস্হা কেমন?
মারুফের সাথে কথা বলতে ইচ্ছা করছিলো না পৃথিশার। তার জন্যই আজ রায়ানের কাছে এতগুলো কথা শুনেছে সে। পৃথিশা ধীরেসুস্থে জবাব দিলো,
– জি ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?
– ভালো। কোথায় যাচ্ছেন এই সময়ে?
কথা বাড়ানোয় বিরক্ত হলো পৃথিশা। তবুও মুখে তা প্রকাশ করলো না,
– কোচিংয়ে যাচ্ছি, পরীক্ষা আছে একটা। আচ্ছা আমার দেড়ি হয়ে যাচ্ছে,আমি আসি।
পৃথিশা যাওয়ার সুযোগ খুঁজছিলো। কিন্তু মারুফ তা হতে দিলো না।
– এতদূর যাবেন আপনি কীভাবে? পায়ের উপর প্রেশার দেওয়া যাবে না বলেছিলাম।
পৃথিশা উত্তর দিলো না। মারুফ নিজে থেকেই আবার বলল,
– আমার সাথে আসুন।আমি পৌঁছে দিচ্ছি।
সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করে উঠলো পৃথিশা।
– না না কোন দরকার নেই। আমি যেতে পারবো।
মারুফ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো তার দিকে। পৃথিশা খানিকটা থমকে গেলো। এতগুলো দিন পর কেউ তার দিকে শাসনের দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। কেউ তার ভালোর জন্য বলছে। পৃথিশাকে না করার সুযোগ দিলো না মারুফ। তাকে এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে বলে কিছুটা দূরে রাখা গাড়িটা নিয়ে আসলো দ্রুত।
আজও পৃথিশা পেছনের সিটেই বসেছে। মারুফ পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে। পৃথিশা ব্যাগ থেকে বই খুলে পড়ার চেষ্টা করলো। হুট করে মারুফের প্রশ্নে চমকে উঠলো সে। মারুফ সেটা লক্ষ্য করে আবার বলল,
– শান্ত হোন, আমি নাম জিজ্ঞেস করেছি শুধু।
– পৃথিশা, পৃথিশা চৌধুরী।
– মেডিকেল পরিক্ষার্থী?
পৃথিশার হাতের বইটা দেখে প্রশ্ন করলো মারুফ।
– জি।
জড়শড় ভঙ্গিতে জবাব দিলো পৃথিশা। মারুফ আবারও প্রশ্ন ছুঁড়লো,
– সত্যিই মেডিকেলে পরীক্ষা দিবেন?
এবার খানিকটা অবাকই হলো পৃথিশা। এই প্রশ্নের মানে কি?
– যদি পরীক্ষা না দেই, তাহলে পড়ছি কেন?
– আমি জিজ্ঞেস করেছি নিজ ইচ্ছাতে দিবেন নাকি?
পৃথিশার মনে হলো তার মনের ভিতর কেউ একটা বোমা ফেলেছে। সামনের মানুষটা যেন তার তীক্ষ্ণ চোখ দু’টি দিয়ে পৃথিশার মন অনায়াসে পড়ে নিচ্ছে। ঢোক গিলে নিজেকে স্বাভাবিক করলো সে।
– নিজ ইচ্ছাতেই না দিলে পড়ব কেন? আজব!
– মাঝে মাঝে প্রশ্নের উত্তর দিবেন। এতে লক্ষ্য সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়।
পৃথিশা কথা পাল্টানোর চেষ্টা করলো,
– আপনি কিসের ডাক্তার?
মারুফ শব্দহীন হাসলো।
– কথা ঘুরানোর চেষ্টা করছেন পৃথিশা? আমি এতটাও বোকা নই।
পৃথিশা জিব কাঁটলো, ধরা পড়ে গিয়েছে। তাও দমে না গিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
– আসলেই জানতে চাইছি, বলুন না।
– কার্ডিওলজিষ্ট।
পৃথিশা আর কথা বাড়ালো না। তারা গন্তব্যে এসে পড়েছে। পৃথিশা গাড়ি থেকে নেমে যাওয়ার সময় মারুফ বলে উঠল,
– নিজের মনে বিরুদ্ধে যেতে নেই পৃথিশা, এতে ভালো থাকা যায় না। নিজের খেয়াল রাখবেন,ভালো থাকবেন।
পৃথিশা উত্তর দেওয়ার আগেই মারুফ চলে গেলো। রাস্তায় হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো পৃথিশা। মনে কোণে প্রশ্ন জমেছে, ‘মানুষটা আমায় এত নিপুণভাবে পড়লো কি করে?’
চলবে,
সূর্যকরোজ্জ্বল
পর্বসংখ্যা-১৮
ফারিহা জান্নাত
– তা প্রেমকাহিনী শেষ করে বাসায় আসার সময় হলো?
দরজায় পা রাখতে না রাখতেই এমন প্রশ্নে চমকে উঠলো পৃথিশা। প্রশ্নকর্তা রায়ান, তার হাতে চায়ের কাপ। রাহনুমা বেগম-ও রায়ানের পিছনেই সোফায় বসে ছিলেন। রায়ানের কথা শুনে তিনি ধমক দিয়ে বললেন,
– এসব কি কথা রায়ান? মেয়েটা মাত্র আসলো।
রাহনুমা বেগম পৃথিশার দিকে এগোতে চাইলে রায়ান আটকে দিলো।
– থামো মা, বাহিরে একা কোথায় যায় কি করে বেড়ায় জানো?
পৃথিশা চুপ করে আছে। সে আজ দেখতে চায় রায়ান কতদূর যেতে পারে। রাহনুমা বেগম ছেলের আচরণে অবাক হলেন। রায়ান আবারও বলল,
– পৃথিশাকে জিজ্ঞেস করো মা, সে আজ মারুফের গাড়িতে যায় নি? বলো?
রাহনুমা বেগম মারুফকে চিনেন না। তিনি বিভ্রান্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
– মারুফ কে?
পৃথিশা কিছু বলার আগেই রায়ান বলল,
– তোমার সো কল্ড আদরের পৃথিশার প্রেমিক। দুইদিনেই জোগাড় করে ফেলেছে।
রাহনুমা বেগম পৃথিশার দিকে তাকালেন,সে এই মূহুর্তে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। হাত মুঠ করা। তিনি পৃথিশাকে শুধালেন,
– রায়ান কি বলছে এসব পৃথিশা? তুই অন্য কোন ছেলের গাড়িতে গিয়েছিস?
এবারও রায়ান আগ বাড়িয়ে কথা বলল,
– গাড়ি দিয়ে না গেলে কীভাবে গেলো? আমিও তো নিয়ে যাই নি,এখানে রিক্সাও পাবে না। তোমার মনে হয় ওর ব্যাথা পা নিয়ে সে এত দূর হেঁটে যেতে পেরেছে।
রাহনুমা বেগম মনে হয় রায়ানের কথা বিশ্বাস করলো।তার চোখ-মুখ শক্ত হয়ে গেলো, কড়া গলায় জিজ্ঞেস করলো,
– এসব কি পৃথিশা? চুপ থাকবে না উত্তর দেনআমাকে?
– উত্তর দেওয়ার মুখ ওর আছে নাকি? আমি মিথ্যা বললে আগে থেকেই তো প্রতিবাদ করতো, চুপ থাকতো না।
ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে গেলো পৃথিশার। নিজের সম্পর্কে সাফাই গাওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নেই তার। অনিচ্ছা সত্ত্বেও বলার চেষ্টা করলো,
– গত কয়েকদিন আগে আমি যখন রাস্তায় অ্যাকসিডেন্ট করেছিলাম, ডাক্তার মারুফ আমাকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন পায়ের অবস্হা খারাপ ছিলো বলে। হাসপাতাল থেকে আসার সময় সিএনজি, রিকশা কিছুই পাচ্ছিলাম না। পরে তিনি আমাকে বাসায় পৌঁছে দেন। আজকেও সেরকমই হয়েছে। রায়ান ভাইয়া নিয়ে গেলেন না,তাই নিজেই হেঁটে যাচ্ছিলাম।পরে হুট করে উনার সাথে দেখা,তার হাসপাতাল-ও সেদিকে সেই সুবাদে লিফ্ট দেন আমায়। এতটুকুই, এর বাহিরে কিছু নেই। তাও বিশ্বাস না হলে আমার কিছু করার নেই।
পৃথিশা থামলো। বাহির থেকে আসার কারনে মাথাটা ব্যাথা করছে।এতক্ষণ ধরে এরা কাহিনী করছে। রায়ান তেঁতে উঠলো,
– মিথ্যা কথা সব, বানিয়ে বলছে এসব। আমি নিজে ওদের প্রেমলীলা দেখেছি।
পৃথিশা এগিয়ে রায়ানের গালে চড় মারলো। রায়ান অপ্রস্তুত ছিল, পৃথিশার এমন কাজে তার হাত থেকে চায়ের কাপ ছিটকে পড়লো। রাহনুমা বেগমও হতভম্ব। রায়ান ব্যাপারটা হজম করতে বেশ সময় নিলো। তুতলিয়ে বলল,
– তুমি… তুমি কি করলে এটা?
– যেটা আরো আগেই করা উচিত ছিলো। একের পর মিথ্যা বলতে বিবেকে বাঁধলো না আপনার? কি ক্ষতি করেছি আমি আপনার? হ্যাঁ? কি করেছি যে আমার চরিত্র নিয়ে কথা বলছেন?
রায়ানের শরীর রাগে কাঁপছে। পৃথিশার রিজেক্ট সে মেনে নিতে পারে নি। পৃথিশাকে মারার জন্য হাত তুলতে গেলে রাহনুমা বেগমের চিৎকারে থামলো সে।
– রায়ান, ভুলেও পৃথিশার গায়ে হাত তুলবি না। ভুলেও না।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুমের দিকে যেতে নিলে রায়ান চিৎকারে থামতে হলো।
– এই মেয়ে এই বাড়িতে থাকলে আমি থাকবো না এখানে।
– তুই কি সব আজেবাজে বকছিস রায়ান? মেয়েটা পুরো ঘটনা ক্লিয়ার করলো।
রাহনুমা বেগমের ক্লান্ত কন্ঠস্বর। পৃথিশার বড্ড মায়া হলো তার জন্য।
– আমি যখন বলেছি থাকবো না, মানে থাকবো না।
খাবার টেবিলে থাকা গ্লাসগুলো তুলে আছাড় মেরে ফেলে দিলো সে। বিকট শব্দে কানে তালা লেগে যাওয়ার জোগাড়। পৃথিশা এক মূহুর্ত কিছু একটা ভাবলো। তারপর রায়ানের সামনাসামনি এসে বলল,
– আচ্ছা, চলে যাব আমি। তবে দুইটা দিন সময় আমাকে দিন। তারপর নাহয়..
তার কথার মাঝপথে তাকে থামিয়ে দিলো রায়ান,
– নো, ইউ হ্যাভ অনলি টুয়েন্টি ফোর আওয়ার। এর মাঝেই তুমি যাবে।
পৃথিশাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই রায়ান নিজের রুমে চলে গেলো।পৃথিশা রাহনুমা বেগমের দিকে তাকালো। তিনি হতভম্ব হয়ে আছেন। নিজের ছেলের এই রূপ বিশ্বাস করতে তার কষ্ট হচ্ছে। পৃথিশার কিছু বলতে ইচ্ছা করলো না। সে চুপচাপ রুমে চলে এলো।
বিছানায় গাঁ এলিয়ে দিতেই চাপা কষ্টগুলো বেরিয়ে এলো। শরীর কাঁপিয়ে কান্না এলো তার। বালিশে মুখ গুজে কান্নার শব্দ আটকাতে চাইলো। দরজায় করাঘাত শুনতেই উঠে চোখ মুছলো সে। রাহনুমা বেগম এসেছেন। তিনি বিছানায় এসে বসলেন। কি বলবেন,কিছু বুঝতে পারছেন না। পৃথিশা ফ্লোরে বসে তার কোলে মাথা রাখলো। বেশ অনেকটা সময় চলে যাওয়ার পর রাহনুমা বেগম মুখ খুললেন,
– তুই কোথাও যাবি না।
পৃথিশা মুখ তুলে তাকালে তিনি আবারও বললেন,
– তুই কোথাও যাবি না। তুই আমার মেয়ে। যার যাওয়ার ইচ্ছা সে যাবে।
-তা কি হয় খালা? তোমার নিজের ছেলে, সে কেন নিজের বাড়ি-ঘর ছেড়ে যাবে।আমি বাহিরের মেয়ে। আমার জন্য কেন সে সমস্যায় পড়বে খালা।
রাহনুমা বেগমের চোখে জল। পৃথিশাও কান্না আটকে রেখেছে, ঠোঁট চেপে নিজেকে সামলানোর আপ্রাণ চেষ্টা।
– তুই আমার মেয়ে পৃথি,তুই কোথাও যাবি না। কোথাও না।
পৃথিশাকে নিজের বুকে চেপে ধরলেন তিনি। মায়ের সমতুল্য খালার পেট জড়িয়ে বড় একটা শ্বাস নিলো সে। কেমন মা মা একটা গন্ধ। কিন্তু এখানে সে থাকতে পারবে না। আশ্রিতার মতো অনুভূতি নিয়ে সে থাকতে চায় না। পৃথিশা মুখ তুললো। চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া পানি মুছে বলল,
– কিন্তু আমি এখানে থাকতে পারবো না খালা। তুমি আমার জন্য অনেক করেছো, এর ঋণ আমি কখনো শোধ করতে পারবো না। বাকিটা পথ আমার একাই চলতে হবে। রায়ান ভাইকে নিয়ে তুমি ভালো থাকো যেভাবে এতদিন ছিলে। আমি এর মাঝে আসতে চাই না। তুমি আমাকে অনুরোধ করো না,কারন আমি শুনবো না। তুমি তো আমাকে চিনো খালা।
রাহনুমা বেগম কিছু বলতে পারলেন।কান্নায় কণ্ঠ রোধ হয়ে আসলো তার। বারবার অস্ফুট স্বরে বললেন,
– হুট করে কি এমন হলো। কি হলো?.
পৃথিশা কিছু বলল না আর। জামা-কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো গোসলের উদ্দেশ্যে। গোসল সেরে রুমে রাহনুমা বেগমকে দেখতে পেলো না। টেবিলের উপর ঢাকনা দিয়ে খাবার রাখা। ক্ষুধা নেই তার,খাওয়ার ইচ্ছা মরে গেছে। আলমারি খুলে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র বের করলো, ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে হবে। বিছানায় বসতেই মনে পড়লো বাসা কিভাবে খুঁজবে সে। এই ক্যান্টনমেন্টের আশেপাশে তো ভুলেও বাসা পাবে না। সে তো কিছু চিনেও না, কারো কাছ থেকে যে সাহায্য নিবে সে সুযোগও নেই তার। চিন্তায় মাথা নষ্ট হয়ে যাওয়ার জোগাড় হলো যেন। মোবাইল নিয়ে অনলাইনে কয়েকটা গ্রুপে খোঁজ চালালো বাসার জন্য। মোবাইলটা রেখে কাগজ নিয়ে বসতেই দরজায় কেউ আঘাত করলো।ভাবলে রাহনুমা বেগম এসেছে বোধহয় তাই মাথা না তুলেই ভেতরে আসতে বলল সে। তবে রায়ানের গলার স্বর পেয়ে চমকে গেলো, দ্রুত বালিশের পাশ থেকে ওড়না গায়ে জড়িয়ে নিলো।
– এখন কেমন লাগছে পৃথিশা? কোথায় যাবে তুমি? কার কাছে যাবে? বলেছিলাম না আমায় রিজেক্ট করে ভুল করেছো।
ঘৃণায় চোখ-মুখ কুঁচকে গেলো পৃথিশার।
– তোর মতো ফকিররে আমি গুনায়-ও ধরি না বুঝলি। তুই থাক তোর বা/লের রিজেকশন নিয়া। তোর মতো মানুষরে আমি নিজের চারপাশেও দেখতে চাই না। প্রপোজ যেমন স্বাভাবিক, রিজেকশন-ও সরকমই স্বাভাবিক। সেটা তুই মানতে না পারলে আমার কিছু করার নাই। শালা, কু**
পৃথিশার গালি শুনে হতভম্ব হয়ে গেলো রায়ান। এই মেয়েকে সে শান্ত মনে করেছিলো, এমনিতে তো শান্তই দেখা যায়। রায়ানকে কথা বলতে না দেখে রাগ আরও বাড়লো পৃথিশার।
– এখনও দাঁড়ায় আছেন কেন? আরও শুনবেন?
আর কোন শব্দ করলো না রায়ান,চুপচাপ রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। রাগে মাটিতে পরপর দু’বার পা দিয়ে আঘাত করলো পৃথিশা। পরক্ষণেই ব্যাথায় চোখ-মুখ কুঁচকে এলো তার। ব্যাথা পাত্তা না দিয়েভেজা চুলগুলো ছড়িয়ে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিলো, শরীর মন খুব ক্লান্ত।
চলবে,