সূর্যকরোজ্জ্বল পর্ব-১৬

0
24

#সূর্যকরোজ্জ্বল
পর্বসংখ্যা-১৬
ফারিহা জান্নাত

মারুফের কেবিনের হুইল চেয়ারে বসেই ঘুমিয়ে আছে পৃথিশা। ইনজেকশন দেওয়া লেগেছিল ব্যাথার জন্য। দেওয়ার কিছুক্ষণ পরেই সে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে যায়। পরে মারুফ তাকে নিজের কেবিনে নিয়ে আসে। রুমে এসি চলছে। ঠান্ডায় পৃথিশা হালকা কাঁপছে। শীত লাগায় কিছুসময় ওরই তার ঘুম ভেঙে যায়। বসে বসে ঘুমানোর কারনে ঘাড় ব্যাথা করছে। গায়ের ওড়না ঠিক করে রুমের আশেপাশে তাকালো।তবে কাউকে দেখতে পেলো না সে। ঘড়ির দিকে নজর দিতেই চোখ কপালে তার। তিন ঘন্টা হয়ে গেছে। বাসায় নিশ্চয়ই হুলস্থুল পড়ে গেছে। পৃথিশা ধীরে ধীরে পা ফেললো। ব্যাথা আগের থেকে অনেকটাই কমে এসেছে। আস্তেধীরে দাঁড়ালো সে। আশে পাশে নিজের ব্যাগটা খুঁজতে শুরু করলেই মারুফ কেবিনে ঢুকলো। পৃথিশাকে দাঁড়াতে দেখে তার দিকে এগিয়ে এসে বলল,

– আপনি ঠিক আছেন এখন?

– ঠিক আছি, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

পৃথিশা আবারও ব্যাগ খুজতে ব্যস্ত হয়ে গেলো। মারুফ তার টেবিলের সাথে লাগোয়া ড্রয়ারটা খুলে ব্যাগ বের করে পৃথিশা অবাক দৃষ্টিতে তাকায়।

– অনেকেই কেবিনে যাওয়া-আসা করে বার বার। তাই ঢুকিয়ে রেখেছিলাম। আপনার ঔষধগুলোও এতে আছে।

পৃথিশা মৃদু হেসে ব্যাগটা নিলো। মানুষটাকে কিভাবে ধন্যবাদ দিবে সে জানে না। সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে কেবিন থেকে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতেই মারুফ বলল,

– আসলেই আপনার ফ্যামিলির কেউ আসে নি? মা কিংবা বাবা?

পৃথিশা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। আসলেই আজ যদি বাবা- মা থাকতো পুরো হাসপাতাল উঠিয় ফেলতো। মনিদীপার তো কথাই নেই। পৃথিশা শান্ত স্বরে বলল,

– তারা এই পৃথিবীতে নেই।

চার শব্দের ছোট্ট একটা কথা। কিন্তু এটা বলতে গিয়ে পৃথিশার বুক কাঁপিয়ে কান্না এলো। নজর লুকাতে দ্রুত কেবিন থেকে বের হয়ে গেলো সে। বহুকাল আগে কল্পনা করা একটা দৃশ্য চোখে ভেসে উঠলো। সে রুমে একা জ্বরে কাহিল,কেউ নেই তার সাথে। তারপর হুট করে মণিদীপা আসলো,তার পেছন পেছন রাশেদুল চৌধুরী। ওয়ার্ড বয়ের ধাক্কায় বাস্তবে ফিরলো পৃথিশা। হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এসে জায়গাটা চিনতে পারলো না সে। সাইনবোর্ড দেখে বুঝলো এটা মিরপুর ১০। এখান থেকে মঈনুল রোড যেতে অনেক সময় লাগবে। আদেও কোন রিকশা যাবে কিনা কে জানে।
বিকাল হয়ে আসছে, খুব একটা রিকশা নেই। পৃথিশা যাদের জিজ্ঞেস করলো তাদের কেউই যেতে ইচ্ছুক না। কি করবে বুঝতে না পেরে রাস্তায়ই দাঁড়িয়ে রইলো বেশ খানিকটা সময়। কিছুসময় পরই মারুফ বেরিয়ে এলো হাসপাতাল থেকে। হাতে অফিস ব্যাগ, মনে হয় ডিউটি আওয়ার শেষ। পৃথিশাকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার দিকে এগিয়ে আসলো।

– কোথায় যাবেন আপনি?

পৃথিশাকে বলতে না দিয়ে আবার নিজেই বলল,

– ও হ্যাঁ,আপনি তো বলেছিলেন মঈনুল রোডে যাবেন। রিকশা তো পাবেন না মনে হয়। আমার সাথে আসুন।

এতক্ষণ থেকে পৃথিশা বুঝেছে লোকটা খারাপ নয়। কিন্তু বারনার একজনের কাছেই সাহায্য চাওয়াটা ভালো দেখাচ্ছে না। তাই না করে দিল,

– সমস্যা নেই, সিএনজি করে যেতে পারব আমি। আপনাকে ধন্যবাদ।

মারুফ কিছু বলতে নিলেই তার ফোনে কল আসে। ফোনটা নিয়ে একটু দূরে চলে যায়। পৃথিশা আবারও রিকশার খোঁজ করা শুরু করে কিন্তু কোন রিকশাই সে পাচ্ছে না। এদিকে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার জন্য পায়ে ব্যাথাটাও আবার শুরু হয়েছে। কিছুসময় পরই মারুফ কথা শেষ করে ফিরে এলো।পৃথিশাকে বলল,

– সরি আমার ফিয়ন্সের ফোন ছিলো তাই কথার মাঝখানে চলে গিয়েছিলাম।দেখলেন,আপনি এখনো রিকশা, সিএনজি কিছুই পান নি আমার সাথে চলুন আমার বাসা ওইদিকেই।

পৃথিশা আর প্রতিবাদ করলো না। আসলেই অনেক দেড়ি হয়ে গেছে। আর লোকটা যেহেতু নিজে থেকেই সাহায্য করতে চাচ্ছে,তাই আর না বলল না। চুপচাপ গাড়িতে উঠে বসলো। পিছনের সিটেই বসলো পৃথিশা। মারুফ গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে বলল,

– এসি অন করি? আপনার এসিতে সমস্যা হবে না তো?

– না, সমস্যা হবে কেন? আপনি অন করুন এসি।

– আসলে তখন দেখছিলাম এসির ঠান্ডায় ঘুমের মধ্যেই কাঁপছিলেন।

পৃথিশা আর কিছু বলল না। মানুষটার দৃষ্টি ও বিচক্ষণ শক্তি খুব প্রখর। সবকিছুই খেয়াল করে। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তারা পৌঁছে গেলো। পৃথিশার বাসার ঠিকানা পুরোপুরি জেনে বাাসর সামনেই নামালো তাকে। পৃথিশা বারবার ধন্যবাদ দিলো তাকে। পৃথিশা গাড়ি থেকে নামতেই রায়ান কোথা থেকে ছুটে এলো। মারুফ তখন পৃথিশাকে নামতে সাহায্য করছিলো। রায়ান এসে পৃথিশার হাত ধরে নিজের দিকে ফিরালো। পৃথিশা হকচকিয়ে গেলো হুট করে এমন করায়। রায়ান জেরা করা শুরু করলো পৃথিশাকে,

– কোথায় ছিলে এতক্ষণ? কখন ছুটি হয়েছে কোচিং?আমি গিয়ে পেলাম না কেন? কথা বলছো না কেন?

মারুফ বিরক্ত হলো রায়ানের ব্যবহারে। মেয়েটার হাতে-পায়ে থাকা কি ব্যান্ডেজ তার চোখে পড়ছে না? পৃথিশাকে চুপ থাকতে দেখে সে নিজেই বলল,

– আপনি একটু থামুন। তিনি অ্যাকসিডেন্ট করেছিলেন,পরে তাকে আমি হাসপাতালে নিয়ে যাই। এজন্যই তার দেড়ি হয়েছে। আপনাার তো তাকে একবারও খোঁজলেন না।

রায়ান মারুফের দিকে তাকিয়ে বিরক্তির স্বরে বলল,

– আপনি কে?

– ডা. মারুফ আহমেদ।

পৃথিশা তাদের থামালো। মারুফের দিকে তাকিয়ে বিনীত স্বরে বলল,

– আপনাকে আবারো অনেক ধন্যবাদ। বাসায় আসুন প্লিজ।

মারুফ পৃথিশার দিকে তাকলো। হলুদ রঙের কামিজ পড়া, রোদে মুখ লাল হয়ে আছে। মারুফ নাকচ করে দিলো,

– অন্য আরেকদিন আসবো। আপনি নিজের যত্ন নিবেন। আসি।

মারুফ কিছু বলার সুযোগ দিলো না। গাড়ি নিয়ে হুট করে কেটে পড়লো। মারুফ যেতেই পৃথিশা রায়ানের দিকে তাকালো। পৃথিশার ডান হাতটা তার মুঠোয় ধরা। পৃথিশা হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে হাঁটা ধরলো। রায়ান-ও পিছু পিছু এসে তার হাত ধরে তাকে আটকালো।

– তুমি ওই লোকটাকে চিনো পৃথিশা? মাফুজ না কি নাম যেন বলল?

পৃথিশার দৃষ্টি তাদের হাতের দিকে। রায়ান প্রায়ই হুটহাট স্পর্শ করে বসে। শান্ত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বলল,

– হাতটা ছাড়ুন।

রায়ান হাত ছেড়ে দেওয়ার আগেই পৃথিশা হাত ছাড়িয়ে অনেকটা তাড়াতাড়িই হেঁটে চলে গেলো। রায়ন আটকানোর সুযোগ পেলো না। রাগে মাটিতে পা দিয়ে আঘাত করলো সে।

_____

মেডিকেলে পরীক্ষার বেশিদিন বাকি নেই।পৃথিশা সব ভুলে পড়তে বসেছে।কিন্তু পড়া হচ্ছে না ঠিকমতো। একটার পর একটা ঝামেলা লেগে আছে। গত দুইদিন আগেই রায়ান তাকে বলেছে সে পৃথিশাকে পছন্দ করে। পৃথিশা মুখের উপর না করে দিয়েছে।এসব সম্ভব না। রায়ানের ব্যবহারে আগেই সে বুঝেছে। হুট করেই বাহিরে হইচইয়ের আওয়াজ শোনা গেলো।পড়া থামিয়ে উঠতে হলো তাকে। দরজা খুলে বাহিরে তাকাতেই দেখতে পেলো মারুফকে সাথে আরো কয়েকজন অপরিচিত মানুষ।

চলবে,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে