#সূর্যকরোজ্জ্বল
পর্বসংখ্যা-১৫
ফারিহা জান্নাত
বাহিরে কাঠফাটা রোদ। কোচিং থেকে পরীক্ষা দিয়ে বেরোলে রায়ানকে দেখলো না পৃথিশা। দাঁড়িয়ে বেশ কিছুসময় অপেক্ষা করলেও তার দেখা মেলে না। এদিকে গরমে নাজেহাল অবস্হা। ব্যাগে থাকা পানিটাও গরম হয়ে আছে। আশেপাশে তাকিয়ে পৃথিশা রিকশা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। আজ প্রথম পরীক্ষা ছিলো। রায়ানকে বলা ছিলো যেন তাকে নিতে আসে। পৃথিশা নতুন তাই রাস্তাঘাট খুব একটা চেনে না। বাসার ঠিকানা জানে, তাই অনেকটা সাহস করেই রিকশা নিয়ে নিলো। রাস্তায় বিশাল জ্যাম। রিকশাওয়ালা তাড়াতাড়ি যেতে রং সাইড ব্যবহারের চেষ্টা করলো। তবে কিছু পথ যাওয়ার পরপরই পাথরের সাথে রিকশার চাকা আটকে রিকশা উল্টে গেলো। আকস্মিক ঘটনায় হতভম্ব হয়ে গেলো পৃথিশা। রিকশার চাকা পায়ে উঠে পড়েছে। ওড়নাটা চাকায় পেঁচিয়ে গেছে, পড়ে যাওয়ার হাতে আঘাতের কারনে ছিলে গেলো বেশ খানিকটা চামড়া। আশ-পাশ থেকে মানুষ এগিয়ে পৃথিশার গায়ের উপর থেকে রিকশা সরালো। কোনমতে একজন মহিলার সাহায্য নিয়ে উঠলো পৃথিশা। পা ফেলতে পারছে না, ব্যাথায় দম আটকে আসছে। লোকজন নিজেদের মতো কথা বলে চলে যাচ্ছে। পৃথিশা হাঁটার শক্তি-টাও পাচ্ছে না। রিকশাওয়ালাও বেশ আঘাত পেয়েছে। তিনিও রিকশা চালিয়ে পৃথিশাকে নিয়ে যেতে পারবেন না। মাটিতে পড়ে থাকা ব্যাগটা কোনমতে তুলে রিকশাওয়ালাকে ভাড়াটা দিয়ে দেয় সে। চোখ বুজে ব্যাথাটা হজম করে হাঁটার চেষ্টা করতেই মুখ থুবড়ে রাস্তায় পড়ে যায় সে। লজ্জায়,ব্যাথায় অশ্রু গড়িয়ে পড়ে কপোল বেয়ে।মূহুর্তেই একজন এসে তার হাত ধরে টেনে তুলে। ব্যাক্তিটি কে তা না দেখেই তার উপর গায়ের ভর ছেড়ে দেয় পৃথিশা। এই পা নিয়ে হাঁটার ক্ষমতা নেই তার।
কিছুসময় পর ধাতস্থ হয়ে মাথা তুলে মানুষটির দিকে তাকানোর চেষ্টা করে। নাকে জেন্টস পারফিউমের কড়া গন্ধ নাকে এসে লাগছে। পৃথিশার বেণী করা চুলগুলো লোকটার কাধে পড়ে আছে। নিজেকে লোকটার কাছ থেকে কিছুটা দূরে সরিয়ে নিলো সে। শ্যামবর্ণের মুখটা রোদে লাল হয়ে আছে।
– আপনি একা,আপনার সাথে কেউ নেই?
প্রশ্নকর্তার মুখের তাকালো পৃথিশা। ভ্রু কুঁচকে তিনি পৃথিশার দিকে তাকিয়ে আছেন,বয়স খুব করে ২৪/২৫হবে বোধহয়। পৃথিশা উত্তর দেওয়ার অবস্হায় নেই। ব্যাথায় মুখ নীল হয়ে যাচ্ছে।পৃথিশার অবস্হা দেখে তিনি এগিয়ে পৃথিশার ব্যাগটি নিজের হাতে নিয়ে বলল,
– আপনি কথা বলার অবস্হায় নেই।একটু কষ্ট করে আমার সাথে আসুন। ওদিকেই আমার গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে।
পৃথিশা না বলার করার সুযোগ পেলো না। তার আগেই তাকে ধরে গাড়ির দিকে এগিয়ে নিয়ে গেলো মানুষটা। পৃথিশাও কথা বলার সুযোগ পেলো না। চুপচাপ তার গাড়িতে বসে পড়লো। এই মূহুর্তে ভালো -খারাপ চিন্তা করার অবস্হায় নেই সে।
গাড়িতে এসি চলছে। ঘর্মাক্ত শরীরে ঠান্ডা বাতাস লেগে গা শিরশির করছে পৃথিশার। কোল্ড অ্যালার্জী আছে ছোট থেকেই।তবুও মনে হয় শীতকালই ভালো, এই অসহ্য গরমকালের চেয়ে। ওড়নার আঁচলে ঘাম মুছে ড্রাইভারের সিটে তাকালো। যিনি এই মূহুর্তে মনোযোগ সহকারে পৃথিশার পা’য়ের দিকে তাকিয়ে আছে।পৃথিশা অস্বস্তিতে পড়ে গেলো। চেনা নেই জানা নেই এমন একজনের গাড়িতে হুট করে বসে পড়েছে। একবার ভাবলো নেমে যাবে,কিন্তু পায়ের ব্যাথায় পরমুহূর্তেই চিন্তাটা বাদ দিলো। লোকটা এত ভালো মানুষ, বাসার ঠিকানা বললে নিশ্চয়ই নামিয়ে দিয়ে যাবে। পৃথিশা নিম্ন স্বরে বলল,
– আমার জন্য আপনি ঝামেলায় পড়লেন। আমি দুঃখিত। আমাকে একটু কষ্ট করে মঈনুল রোডে নামিয়ে দিয়ে যাবেন প্লিজ।
লোকটা মাথা তুলে তার দিকে তাকালে পৃথিশা তাকে সম্পূর্ণরূপে দেখতে পেলো। উজ্জ্বল গৌরবর্ণের মুখ,কপালের একপাশে দাগ। পৃথিশার দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিলো। আগুন্তক বলে উঠল,
– আমি মারুফ আহমেদ,একজন ডাক্তার। আপনার পা দেখে এতটুকু বুঝতে পারছি ভালোই ব্যাথা পেয়েছেন। হাসপাতালে যেতে হবে তাড়াতাড়ি। পরে নাহলে বাড়িতে গেলেন।
পৃথিশা কথা বলতে চাইলে মারুফ আবার বলে উঠল,
– বাড়িতে কাউকে ফোন করে জানিয়ে দিন। ভয় পাবেন না আমাকে।
পৃথিশা কিছু বলল না আর। সিটে মাথা এলিয়ে দিলো। ঠান্ডায় গা কাঁপছে। ওড়না শরীর জড়িয়ে নিতেই এসিটা অফ হয়ে পাশের জানালাগুলো খুলে গেলো। পৃথিশা অবাক চোখে মারুফের দিকে তাকালো যে এখন সামনে তাকিয়ে একমনে গাড়ি চালাতে ব্যস্ত।
কিছু সময় পর কারো ডাকে চোখ খুললো পৃথিশা। আরাম পেয়ে সে ঘুমিয়ে পড়েছিলো। তাকে চোখ খুলতে দেখে মারুফ মৃদু হেসে বলল,
– একটু কষ্ট করে হাতটা ধরুন, হুইল চেয়ারে বসতে হবে।
পৃথিশা জড়তা নিয়ে হাতটা বাড়ালো। মারুফের শক্তপোক্ত হাতের মাঝে তার হাতটা দেখতে ছোট লাগছে। পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াতেই ব্যাথায় চোখ-মুখ কুঁচকে গেলো তার। মারুফ খেয়াল করলো সেটা। হাতের বন্ধনে আরেকটু জোর দিয়ে বলল,
– একটু সহ্য করুন, দুই পা হাঁটতে হবে শুধু।
ফাঁকা ঢোক গিলে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে পা বাড়ালো। তবে পায়ে ব্যাল্যান্স রাখতে পারলো না। এতক্ষণ বসে থাকায় পা আরো ফুলে গেছে। হুমড়ি খেয়ে পড়তে নিলেই মারুফ পৃথিশাকে কোলে নিয়ে হুইল চেয়ারে বসিয়ে দিলো। হতভম্ব চোখে মারুফের দিকে তাকালো সে। মারুফ হুইল চেয়ারটা টেনে নিয়ে যেতে যেতে বলল,
– সরি, আপনাকে টাচ করার কোন ইন্টেনশন আমার ছিলো না। কিন্তু পায়ের যে অবস্হা আেনার আপনি হাঁটতে পারতেন না।
পৃথিশা কোন কথা বলল না। আসলেই সে হাঁটতে পারতো না। পা ব্যাথায় টনটন করছে। হাত-ও জ্বলছে অনেক।এতক্ষণ পা ব্যাথায় হাতের কথা মনে ছিলো না।
ইমারজেন্সি বিভাগে পৃথিশাকে এনে রাখা হলো। অল্প সময়ের মধ্যেই একজন নার্স তার হাতের র’ক্ত পরিষ্কার করে তা ব্যান্ডেজ করে দিলো। এদিকে পৃথিশার মনে হচ্ছে পা ব্যাথায় সে এই মূহুর্তেই মা’রা যাবে। মারুফ-ও আশেপাশে নেই। পৃথিশা কাউকে কিছু বলতেও পারছে না। কিছুসময় পরই মারুফ এসে সরাসরি তার সামনে বসে পায়ে হাত দিলে পৃথিশা আঁতকে উঠে,
– আরে, পায়ে হাত দিচ্ছেন কেন?
মারুফ শান্ত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকায়। ওই দৃষ্টিতে কি ছিলো পৃথিশা জানে না,তবে এরপর আর কিছু বলল না সে। তার পা’টা খানিকক্ষণ দেখে উঠে গিয়ে একজন নার্সকে ডাকলো সে। তাকে কিছু একটা বুঝিয়ে দিতেই তিনি পৃথিশার পা ধরে তা বেঁকিয়ে দিলেন। ব্যাথায় চিৎকার করতে গিয়েও থেমে গেলো পৃথিশা। চোখে পানি চলে এসেছে, ব্যাথাটা কমে যেতেই চোখ খুললো সে। মারুফ তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। পৃথিশাকে এক পলক দেখে প্রেসক্রিপশন রেডি করলো সে। তারপর সেটা পৃথিশার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
– ঔষধ নিয়মিত খাবেন। পা যেভাবে মচকে গেছে, এই ব্যাথা চলে যাবার পরও বেশি লোড নিলে আবার শুরু হবে। এই এক সপ্তাহ চলাফেরার সময় পায়ে বেল্ট ব্যবহার করবেন।
পৃথিশা মৃদু স্বরে ‘আচ্ছা’ বলে প্রেসক্রিপশনটা হাতে নিলো।তারপর কিছু একটা ভেবে মারুফের দিকে তাকিয়ে বলল,
– এই হসপিটালে ফার্মেসী থাকলে কাউকে বলে এই ঔষধগুলো আনিয়ে দিবেন প্লিজ, আমি টাকা এনে দিচ্ছি।
মারুফ অবাক হয়ে গেলো,
– কেন? আপনার ফ্যামিলির কেউ এখনো আসে নি?
পৃথিশা কঠোরতার সহিত বলল,
– আমার ফ্যামিলি নেই,তাই আসে নি। কেউ না পারলে সমস্যা নেই আমিই যাচ্ছি।
পৃথিশা উঠতে নিলেই মারুফ তাকে থামিয়ে দিলো। বলল,
– উঠবেন না, পায়ের ব্যাথা আরো বাড়বে। আমি আনিয়ে দিচ্ছি, আপনি বসুন।
– ধন্যবাদ।
চলবে,