#সূর্যকরোজ্জ্বল
পর্বসংখ্যা-১৪
ফারিহা জান্নাত
পৃথিশা রায়ানের কাছে পড়তে এসেছে। কিন্তু রায়ান বেশ কিছুক্ষণ সময় ধরে ফোনে কি যেন করছে। পৃথিশা দুইবার ডাকলেও জবাব দিয়ে আবার চুপ করে যায়। একটা সময় অতিষ্ঠ হয়ে উঠলো পৃথিশা। বিরক্তিতে বই গুছিয়ে চলে যেতে নিলেই হাতে টান পড়লো তার। রায়ান তার হাত টেনে আবার বিছানায় বসিয়ে দিয়েছে। রায়ানের দিকে তাকিয়ে দেখলো সে ফোন পাশে রেখে দিয়েছে। পৃথিশা বই খুললো। রায়ান তাকে প্রয়োজনীয় কয়েকটা জিনিস দাগিয়ে দিয়ে পড়তে বললো। পৃথিশা নিজের রুমে গিয়ে পড়তে চাচ্ছিলো।রায়ানের সামনে পড়তে তার অস্বস্তি লাগছে। রায়ানের চোখের দৃষ্টি অন্যরকম। পৃথিশা বই গুছিয়ে নিচ্ছে দেখে রায়ান জিজ্ঞেস করলো,
– কি ব্যাপার? পড়বে না?
– রুমে গিয়ে পড়ি।
রায়ান ভ্রু কুঁচকালো।ময়েটা এখানে পড়বেনা কেন,আজব। বলল,
– কেন,এখানে পড়তে কি সমস্যা? আমি কি তোমাকে বিরক্ত করছি?
– আমি কি একবারও বলেছি আপনি আমাকে বিরক্ত করেন? আমি থাকলে আপনি নিজেই বিরক্ত হবেন আপমার পড়ার শব্দে।তাই চলে যেতে চেয়েছিলাম।
– তুমি থাকলে আমি কখনোই বিরক্ত হবো না পৃথিশা।
পৃথিশা চুপ হয়ে গেলো। বই খাতা হাতে নিয়ে খানিকক্ষণ বসে থেকে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। রায়ান পৃথিশার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। মেয়েটা এত কঠিন মনের কেন!
পৃথিশা নিজের রুমে এসে পড়ছে। কিন্তু পড়ায় মন বসছে না। বারবার রায়ানের কথা মাথায় আসছে। রায়ানের চাহনি, কথা সে বুঝে। কিন্তু এসব করার সময় এখন না। পৃথিশা এসবে জড়াতে চায় না। কিন্তু রায়ানকে পাল্টা কিছু বলার সুযোগ সে পাচ্ছে না। এসব অযাচিত ভাবনা রেখে পড়রায় মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করলো পৃথিশা। মেডিকেলে চান্স হয়ে গেলে সে চলে যাবে এখান থেকে। এভাবে মানুষের বোঝা হয়ে থাকার কোন ইচ্ছা তার নেই।
______
পৃথিশার চুলে তেল দিয়ে দিচ্ছেন রাহনুমা। পৃথিশা আরামে চোখ বন্ধ করে হেলান দিয়ে বসে আছে রাহনুমার গাঁয়ে। আগে মণিদীপা এভাবে তার মাথায় তেল দিয়ে দিতো। এতো বড় চুলে তেল লাগানোর মতো ইচ্ছা থাকতো না পৃথিশার,মণিদীপাই সবসময় তেল লাগিয়ে দিতো নিয়ম করে। আজ তার চুলগুলো উশকো-খুশকো দেখে রাহনুমা তেল লাগিয়ে দিচ্ছেন। রাহনুমা পৃথিাশাকে অনেক যত্নেই রেখেছেন।পৃথিশা এই মানুষটার জন্যই এখানে আছে। নাহলে নিজ শহর ছেড়ে এখানে আসার কোন ইচ্ছা তার ছিলো না। তার জন্যই পৃথিশা এই বাসা থেকে যেতে পারছে না,নাহলে কবেই চলে যেত।
পৃথিশার মাথার চুলগুলো দু’ভাগ করে বেণী করে দিলেন রাহনুমা। চুলের আগাগুলো আঁচড়ে দিয়ে বললেন,
– এত বড় চুল সামলাতে কষ্ট হয় না? একটু ছোট করে কোমড় সমান করে নিলেই তো পারিস। হাঁটু পর্যন্ত বড় চুল রেখে কি করবি।
– বুবু আমার চুল শখ করে বড় করেছিলো খালা। তার ইচ্ছা ছিলো আমার চুল বড় থাকবে। আমি সেই চুল কাটি কি করে।
রাহনুমা কিছু বললেন। যে উদ্দ্যেশ্যে পৃথিশাকে ঢাকায় এনেছেন তা পূরণ হয় নি। পৃথিশার মানসিক অবস্হা আগের মতোই আছে। এখনো কারো সাথে স্বাভাবিক হতে পারে নি। পৃথিশা রুম থেকে বেরিয়ে যেতে নিলেই রায়ানের মুখোমুখি হলো। পৃথিশার ছোটখাটো গোলগাল মুখটা তেলেতেলে হয়ে আছে। রায়ান একবার তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিলো। সোজা রুমে ঢুকে গেলো সে। পৃথিশা রায়ানের কাজে খানিকটা অবাক হলেও পাত্তা দিলো না। আগামীকাল তার পরীক্ষা কোচিংয়ে সেটার প্রিপারেশন নিতে হবে। সময় নষ্ট করার মতো সময় তার হতে নেই।
পৃথিশা রুমে গিয়ে পড়তে বসতেই দেখলো তার প্রয়োজনীয় একটা বই নেই। রায়ানের রুমে থালতে পারে এটা ভাবতেই সে আবার রুম থেকে বের হয়। রায়ান তখন রাহনুমার রুম থেকে বের হয়ে কোথাও যাচ্ছিলো।পৃথিশার সাথে ধাক্কা লেগে তার হাতে থাকা কাগজগুলো পড়ে ছড়িয়ে গেলো। পৃথিশার দিকে তাকিয়ে রায়ান বিরক্ত গলায় বলল,
– দেখে চলতে পারো না তুমি? সারাক্ষণ ধুপধাপ করে বেড়াও।
পৃথিশা উত্তর দিলো না। তার চোখ কাগজগুলোর দিকে।পৃথিশা কাগজগুলো হাতে দেখলো মণিদীপার মেডিকেল রিপোর্ট। এগুলোর কপি রায়ানের কাছে কীভাবে গেলো তা বুঝতে পারলো না। এগুলো তো তার কাছে ছিলো। পৃথিশা রায়ানের দিকে তাকালে দেখতে পেলো রায়ানের চোখের দৃষ্টি অন্যরকম, কেমন যেন তাচ্ছিল্য মেশানো।পৃথিশা কাগজগুলো তুলে জিজ্ঞেস করলো,
– আপনি এগুলো কোথায় পেয়েছেন?
– তা জেনে তোমার কাজ কি? কাগজগুলো আমাকে দাও।
– আমি জিজ্ঞেস করেছি কোথায় পেয়েছেন এগুলো? উত্তর দিন আমাকে।
পৃথিশার গলার স্বর উচ্চ।রাহনুমা চৌধুরী তার গলার স্বর পেয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এসেছে।।পৃথিশা রিপোর্টগুলো দেখিয়ে বলল,
– তোমার কাছে এগুলো কীভাবে গেলো খালা?
রাহনুমা কি বলবেন ভেবে পাচ্ছেন না। পৃথিশার লাগেজ থেকে রিপোর্টগুলো তার নিই সরিয়ে রেখেছিলেন। এইসব ব্যাপার ধামাচাপা দিতে চাচ্ছিলেন তিনি। পৃথিশা এসব নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করলে তিনি নিজেও ঝামেলায় পড়বে ভেবে তিনি কাগজগুলো সরিয়ে ফেলেছিলেন যাতে কোন প্রমাণ না থাকে। পৃথিশা এসব জানলে এখনই বাসা থেকে বেরিয়ে যাবে তিনি জানেন।তাও তিনি বুঝানোর স্বরে বললে,
– আমি এগুলো নিজের কাছে রেখেছিলাম। তুই এসব নিয়ে মন খারাপ কর আমি চাই না।
পৃথিশা শান্ত হলো খানিকটা। দমে না গিয়ে বলল,
– ভাইয়ার হাতে এগুলো কেন গেলো?
রাহনুমা ফ্যান চলাকালীন সময়েও ঘামছেন। রায়ানকে দিয়ে বলেছিলেন যাতে এগুলো নিচে গিয়ে ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে আসে। পৃথিশার মুখোমুখি এভাবে হবে তিনি ভাবেননি। রায়ান কিছু বলতে চাইলেই রাহনুমা তাকে থামিয়ে দিলেন। পৃথিশার দিকে এগিয়ো মাথায় হাত বুলিয়ে আদুরে গলায় বললেন,
– ও বোধহয় ভুলে তার কাগজ নাম তে গিয়ে এগুলো নিয়ে গেছে। আমি দেখিনি ঠিকভাবে।
পৃথিশা পাল্টা প্রশ্ন করতে গিয়েও থেমে গেলো। চুপ চাপ নিজের রুমে এসে দরজা লাগিয়ে দিলো। রাহনুমা চৌধুরী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। রায়ানকে রুমে যেতে বলে তিনি নিজেও চলে গেলেন।
পৃথিশা রুমে এসে নিজের আলমারির চাবিটা দেখলো সঠিক জায়গায় আছে কিনা। চাবিটা ঠিক জায়গায় দেখে সে বুঝতে পারলো রাহনুমা বেগমের কাছেও ডুপ্লিকেট চাবি আছে। তা না হলে তিনি আলামরি থেকে এই কাগজ নিতে পারতেন না। রাহনুমার চিন্তার কারন পৃথিশা বুঝতে পেরেছে। কেউই নিজের ঘাড়ে ঝামেলা নিতে চায় না। পৃথিশা ঠিক করলো গ্রাম থেকে নিজেদের রুমের টেবিলেটা এখানে আনাবে।সেটার চাবির ডুপ্লিকেট নিশ্চয়ই রাহনুমার কাছে থাকবে না। প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো তাকে সামলে রাখতে হবে। মণিদীপা শখ করে পৃথিশাকে সেটা বানিয়ে দিয়েছিলো।মণিদীপার কথা মনে আসতেই দীর্ঘশ্বাস ফেললো পৃথিশা। ক্লান্ত স্বরে বলল,
– আমি তোকে ছাড়া একেবারেই থাকতে পারতাম না বুবু, অথচ তোর আর আমার মাঝে এখন কত দুরত্ব। এই বিশাল পৃথিবীতে আমার জন্য কেউ নেই। আমাকে বুঝার কেউ নেই। কাকে বিশ্বাস করব আমি। সবই স্বার্থপর। আমাকে তোদের সাথে নিয়ে গেলি না কেন বুবু। আয়নায় নিজেকে দেখতে আমার ঘৃণা হয়। পরাজিত মুখটা নিয়ে আমি আয়নার সামনে দাঁড়াতে পারি না। কান্না গলায় দলা পাঁকিয়ে আসে, কাঁদতে পারি না। তোরা সবাই পালা করে আমাকে ছেড়ে গেলি,কেন? কেন?
চলবে,