সূর্যকরোজ্জ্বল পর্ব-১১

0
93

#সূর্যকরোজ্জ্বল
পর্বসংখ্যা-১১
ফারিহা জান্নাত

মধ্যরাত, বাহিরে অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে। ক্ষণে ক্ষণে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বাজ পড়ার প্রচন্ড আওয়াজে ঘুম ভাঙলো পৃথিশার। শুয়ে থাকতে থাকতে কোন সময় যে ঘুমিয়ে পড়েছে খেয়াল করেনি। নিভু নিভু চোখজোড়া খুলতেই দেখতে পেলো সিলিং ফ্যানে কেউ ঝুলছে।তার পা দুটো ঠিক তার মুখের কয়েক ইঞ্চি উপরে। চিৎকার করে বালিশে মুখ গুজলো সে। বৃষ্টির শব্দের কারনে তার চিৎকার বাহিরে পৌঁছালো না। বালিশ থেকে মুখ তুলতেই সেই রাতের মণিদীপার রক্তাক্ত মুখস্রী ভেসে উঠলো চোখের সামনে। তাড়াহুড়ো করে বিছানা থেকে নামতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়লো সে। দেয়ালের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে হাঁটুতে মুখ গুজে কেঁদে উঠলো সে। মস্তিষ্ক যেন বলছে, তুই দায়ী সবকিছুর জন্য,কাউকে আগলে রাখতে পারলি না। চিৎকার করে পাশে থাকা ল্যাম্পটা ছুড়ে ফেললো সে। সে শব্দে পাশের রুম থেকে তার খালা দৌড়ে আসলো। দরজা বন্ধ থাকায় রুমে আসতে পারলো না। পদরজা ধাক্কাতেই পৃথিশা চিৎকার করে উঠল,

– চলে যাও সবাই। কেউ আসবে না আমার কাছে কেউ না।

বেশ কিছুক্ষণ দরজা ধাক্কানোর শব্দ শোনা গেলেও পরে আর শোনা গেলো না। পৃথিশা হু হু করে কেঁদে উঠলো। বিড়বিড়য়ে বলল,

– সবাই চলে যায় আমাকে রেখে। সবাই। কেউ থাকলো না আমার সাথে কেউ না।

পরমুহূর্তেই চোখ মুছে উঠে দাঁড়ালো সে। প্রচন্ড আক্রোশে বলল,

– তুই হেরে গেছিস বুবু,তোর লড়াই করার কথা ছিলো কিন্তু তুই হার মেনে নিলি। আমি হার মানবো না বুবু, ওদের মৃত্যু না দেখলে আমি শান্তি পাবো না।

পৃথিশা উন্মাদের মতো দরজা খুললো। বাহিরে যাওয়ার জন্য হাঁটা ধরতেই পেছন থেকে তার খালা এসে ধরলেন তাকে,

– এতরাতে কোথায় যাচ্ছিস তুই পৃথিশা?

পৃথিশা ঝাড়া মেরে হাত সরিয়ে নিলো। চিৎকার করে বলল,

– আমাকে ছাড়ো খালা, ঝামেলা করবে না।

– শান্ত হ মা,বস তুই। একটু শান্ত হ।

পৃথিশা শুনলো না। তার জ্ঞান- বুদ্ধি সব লোপ পেয়েছে। পৃথিশার খালা বয়স্ক মানুষ। তার শরীরে এত জোর নেই। পৃথিশা সহজেই তাকে সরিয়ে বের হয়ে গেলো। পৃথিশার খালা তার পেছন পেছন গেলেন। বাহিরে ঝড়ো হাওয়া সাথে তুমুল বৃষ্টি। পৃথিশা বাহিরে বের হলো, তবে বৃষ্টির কারনে আশ-পাশ কিছুই দেখা যাচ্ছে না। চোখের পানি বৃষ্টির সাথে মিশে একাকার হয়ে গেছে। এই গ্লানি কি শেষ হবার…

________

ঘুম ভাঙতেই নিজিকে বিছানায় আবিষ্কার করলো পৃথিশা। মাথা প্রচন্ড ভার হয়ে আছে। কাল রাতের ঘটনার কিছুই তার মনে নেই। পাশের টি-টেবিলে পানি ও রুমাল রাখা। বাহিরে বের হওয়ার পর থেকে আর কোন ঘটনাই তার মনে নেই। বিছানা থেকে নেমে ফ্রেশ হয়ে নিলো সে। রুম থেকে বের হতেই দেখতে পেলো বাসায় বাড়িওয়ালা এসেছে,তার সাথে তার খালা কথা বলছে। পৃথিশা সেদিকে এগিয়ে গেলো। তাকে দেখে বাড়িওয়ালা চুপ হয়ে গেলো। কিছু না বলে উঠে গেলেন উঠে গেলেন তিনি।পৃথিশা তার খালাকে জিজ্ঞেস করলো,

– কি হয়েছে? তিনি আসলেন কেন?

পৃথিশার খালা কথার উত্তর না দিয়ে পৃথিশার দিকে এগিয়ে মাথায় হাত রাখলেন, স্বস্তির শ্বাস ফেলে বললেন,

– অবশেষে জ্বর কমেছে, ভয় পায়িয়ে দিয়েছিলিস তুই। এখন কেমন লাগছে?

– উনি এখানে এসেছিলেন কেন?

– বাসা ছাড়তে হবে না বললেন।

তাচ্ছিল্য হাসলো পৃথিশা। যাকে নিয়ে সমস্যা ছিলো সে তো এখন নেই,তাই সমস্যাও হওয়ার কথা নয়। পৃথিশার খালা তার কাছে এলেন। এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে দিলেন। নরম গলায় বুঝাতে চেষ্টা করলেন,

– এখানে থাকলে তোর প্রতিনিয়ত ওদের কথা মনে পড়বে। তুই আমার সাথে চল। তুই তো আমারই মেয়ে, আমার সাথে থাকবি তুই এখন থেকে।

পৃথিশা কথা বলল না,নিজের রুমে এসে বসলো সে। মণিদীপার রুমে যাওয়ার সাহস তার নেই। কাল রাতের ঘটনা মস্তিষ্কে ভাসছে। এরই মাঝে মনে হলো কেউ যেন কানের পাশে বলছে, ‘আমি পারি নি, আমি পারি নি।’
কান চেপে ধরলো পৃথিশা। মাথা নাড়ালো বার’কয়েক। মনে হচ্ছে মণিদীপা দেখছে ওকে।পৃথিশার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে এলো। মূহুর্তেই মনে পড়লো সে কালকে এই সময়ে যে দু’জন মানুষের সাথে ছিলো তারা আজ নেই,মৃ/ত তারা। পৃথিশা আর ভাবতে পারলো না কিছু। বিছানায় শুয়ে কানে বালিশ চেপে ধরলো সে। নিজেকে শান্ত করার আপ্রাণ চেষ্টা চালালো।

– মেয়েটার বারবার গা কাঁপিয়ে এমন জ্বর আসছে কেন? কিভাবে কি করব আমি।

রাহনুমা বেগনের কন্ঠস্বর চিন্তিত। তিনি বড় ভাইকে ফোন দিলেন। পৃথিশা তখন নিভুনিভু চোখ খুলছে। তিনি পৃথিশার মাথায় জলপট্টি দিতে লাগলেন দ্রুত। পৃথিশা বিড়বিড়িয়ে কিছু একটা বলছে।তিনি পৃথিশার মুখের কাছে মাথা নিলেন, পৃথিশার তার হাত শক্ত করে আঁকড়ে ধরেছে। পৃথিশা ভাঙা স্বরে বলছে, ‘আমি তোকে ভয় পাচ্ছি বুবু,তুই চলে যা।’
রাহনুমা চৌধুরী বোকা নন।পৃথিশা যতই কঠোর হোক না পরপর এতগুলো শকে সে হতভম্ব হয়ে গেছে। নিজেকে শান্ত করতে সময় লাগছে তার। মণিদীপা তার খুব কাছের। বোনকে এভাবে হারিয়ে সে নিজেকে সামলাতে পারছে না। ধীরে ধীরে সেই কষ্ট মানসিক অবসাদে রূপ নিচ্ছে। তিনি ঠিক করলেন কালকের মধ্যেই পৃথিশাকে নিয়ে এখান থেকে চলে যাবেন। এখানে থাকলে পৃথিশা অসুস্থ হয়ে পড়বে। বাসার ফার্নিচারগুলো তিনি গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্হা করবেন৷ তিনি সাথে সাথে নিজের ছেলেকে ফোন দিয়ে আসতে বললেন। খুব দ্রুতই সব ব্যবস্হা করে ফেললেন পৃথিশার মামার সাহায্যে। সকাল হলেই তহওয়ার নি পৃথিশাকে নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিবেন।এখন অপেক্ষা নতুন সকালের।

পৃথিশার ঘুম ভাঙলো খুব ভোরে। চারপাশে তখনও আলো ফোটেনি। পাশে তার খালা নামাজ পড়ছেন।পৃথিশাকে উঠতে দেখে তিনি বললেন,

– ভালো লাগছে এখন মা? হাত-মুখ ধুয়ে নিজের ব্যাগ গুছিয়ে নে। আমরা আলো ফুটলেই বের হবো।

পৃথিশা অবাক হলো। বিস্মিত স্বরে জিজ্ঞাসা করলো,

– কোথায় যাবো এত সকালে?

– ঢাকায় যাবি তুই আমার সাথে।

রাহনুমার কন্ঠস্বর কড়া। পৃথিশা বিস্মিত ভাব কাটিয়ে দ্রুত বলল,

– আমি কোথাও যাবো না। আমি এখানেই থাকবো।

– আমি তোর মতামত জানতে চাইনি পৃথিশা। তুই আমার সাথে যাবি মানে যাবি। আর কোন কথা শুনতে চাই না আমি।

পৃথিশা কিছু বলার সুযোগ পেলো না। রাহনুমা নিজেই পৃথিশার ব্যাগ গুছাতে শুরু করলো। পৃথিশার উদ্দেশ্যে বলল,

– ফার্নিচারগুলো সব গ্রামে পাঠিয়ে দিবো ভেবেছি। তুই কোনটা রাখতে চাস?

পৃথিশা উত্তর দিলো। রুম থেকে বেরিয়ে গেলো চুপচাপ। রাহনুমা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।পৃথিশা তার সাথে কথা বলবে না তিনি জানেন। মেয়েটা অনেক জেদি। কিন্তু পৃথিশার ভালোর জন্য তাকে কঠোর হতেই হবে। তিনি পৃথিশাকে এভাবে গুমড়ে গুমড়ে মরতে দেখতে পারেন না।

সকাল হতেই তিনি পৃথিশাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। পৃথিশার কোন কথাই তিনি আর শুনলেন না। বাসার চাবি পৃথিশার মামার কাছে দিয়ে আসলেন। গাড়ি কিছু সময় পরই পৃথিশাদের আগের বাসাটা পেরিয়ে গেলো। চোখ থেকে দু’ফোঁটা পানি পড়লো পৃথিশার। নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর যে বিশ্বাসটা ভেঙেচুড়ে গুড়িয়ে গেছিলো বুকের ভিতর সেই বিশ্বাসটা আবারও দানা বাঁধতে শুরু করলো। এই এলাকায় প্রতিশোধ নিতে আসার এক অদম্য ইচ্ছা মনে ঘুরপাক খেতে লাগলো।

চলবে,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে