সূর্যকরোজ্জ্বল পর্ব-১০

0
111

#সূর্যকরোজ্জ্বল
পর্বসংখ্যা-১০
ফারিহা জান্নাত

সকাল বেলা কলিংবেলের আওয়াজে পৃথিশার ঘুম ভাঙলো। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখলো আটটা বাজে। এদিকে অনবরত কলিংবেল বেজেই চলছে। গায়ে ওড়না জড়িয়ে পৃথিশা বেরোলো। মায়ের ঘরের দিকে তাকিয়ে দেখলো তিনি এখনো ঘুমিয়ে আছেন,পৃথিশা খানিকটা অবাক হলো। তার ঘরের দিকে যাওয়ার আগেই আবারও কলিংবেল বেজে উঠলো। পৃথিশা বিরক্তি নিয়ে দরজা খুলতেই দেখলো বাড়িওয়ালা দাঁড়িয়ে আছেন।পৃথিশা অবাক হলো খানিকটা। বাড়িওয়ালা সাধারণত কারো বাসায় যায় না পৃথিশা শুনেছে। অবাকের রেশ কাটিয়ে পৃথিশা তাকে ভিতরে আসার জন্য বললো। তিনি গম্ভীর মুখে ভিতরে ঢুকলেন। সোফায় বসে আশপাশটা দেখতে লাগলেন। পৃথিশা তাকে জিজ্ঞেস করলো,

– কোন সমস্যা আন্টি?

– তোমার বোনের নামে পুরো এলাকায় যে খবর রটেছে এটা জানো? বাসা ভাড়া নেওয়ার আগে আমাদের তো জানালে না কিছু।

পৃথিশা হতভম্ব হয়ে গেলো। কোনমতে বললো,

– কি হয়েছে আন্টি? আপনার কথা বুঝলাম না।

কি হয়েছে বুঝতে পারছে না? নাটক করো? তোমার বোন যে কদিন কান্ড করে হাসপাতালে ভর্তি থাকলো, এখন আবার ওটা নিয়ে কেসও করেছো। ঢং দেখে বাঁচিনা তোমাদের। সেই ছেলে এসে আমাদের হুমকি দিয়ে গেছে। বাসা ছেড়ে দাও তোমরা, তোমাদের জন্য আমরা এত ঝামেলা পোহাতে পারব না।

পৃথিশা বিস্মিত হয়ে গেলো। অপরাধ তারা করেছে,আবার সেই বড় গলায় হুমকি দিচ্ছে। মহিলাটিকে কিছু বলার আগেই তিনি বেরিয়ে গেলেন দরজার সামনে গিয়ে বললে,

– বাসা দুইদিনের মধ্যে ছেড়ে দেওয়ার চেষ্টা করবে। অগ্রিম দেওয়া টাকা ফিরিয়ে দিবো নে।

পৃথিশা থম মেরে সোফায় বসে রইলো। বাসা ছেড়ে দিলে কোথায় যাবে, কীভাবে কি করবে বুঝতে পারলো না। দীর্ঘশ্বাস নিয়ে নিজের রুমে গিয়ে ফ্রেশ হলো। মণিদীপার রুমের দিকে তাকালে দেখলো দরজা এখনো বন্ধ। পৃথিশা হাত-মুখ ধুয়ে মায়ের রুমের দিকে এগোলো। তিনি ঘুমাচ্ছেন।পৃথিশা পর্দা সরিয়ে দিয়ে বলল,

– আম্মু এখনো ঘুমাচ্ছো যে,শরীর খারাপ লাগছে নাকি? সকাল হয়ে গেছে তো।

পৃথিশার মায়ের কোন জবাব নেই। পৃথিশা অবাক হলো খানিকটা। তার দিকে এগিয়ে কপালে হাত দিতেই শরীর কেঁপে উঠলো তার। শরীর ছিটকে সরে গেলো সে। কাঁপা স্বরে ডাকলো, ‘আম্মা!’
বিছানায় বসে মায়ের মাথাটা নিজের কোলে নিলো। মাথায় হাত বুলালো। ক্লান্ত স্বরে বলল, ‘আম্মা, উঠো।তোমার কি ঠান্ডা লাগছে?’ পৃথিশার মায়ের মলিন মুখটা তার কোলে পড়ে আছে। পৃথিশা এবার অধৈর্য হয়ে বলল,

– তোমরা সবাই কি আমার জীবনটা খেলা পেয়েছো? সব মজা আমার সাথেই করো কেন? মা,আমি কিন্তু এবার বিরক্ত হচ্ছি।

পৃথিশা ক্লান্ত শ্বাস ফেললো। সে মনে হচ্ছে একটা ঘোরে আটকে আছে। পৃথিশা হাতটা মায়ের নাকের কাছে নিতেই শরীর কাঁপিয়ে কেঁদে উঠলো সে। মায়ের মুখটা হাতের মধ্যে নিয়ে পাগলের মতো কান্না করতে করতে বলল,

– আম্মা, এই আম্মা চোখ খুলো। আমার সাথে এমন কেন করছো আম্মা? ও আম্মা কথা শুনো না তুমি। কথা বলো না আম্মু, কথা বলো, কথা বলো।

পৃথিশা মণিদীপার রুমে যাওয়ার জন্য বিছানা থেকে নামলো। তার পা টলছে।পৃথিশা মণিদীপার দরজায় হাত রাখতেই তা খুলে গেলো। তার মানে দরজা লাগানো ছিল না। পৃথিশা রুমে ঢুকতেই চিৎকার দিয়ে মাটিতে বসে পড়লো। মণিদীপা ফ্যা’নের সাথে ঝু”লছে। পৃথিশা দৌড়ে গেলো, মণিদীপাকে ধরে নামানোর চেষ্টা করলো। শরীরে যেন কোন জোর নেই। শেষ পর্যন্ত ফ্যানের সাথে থাকা ওড়নাটা কেটে দিতেই মণিদীপার দেহটা নাম নিচে পড়ে গেলো। পরপর ধাক্কায় পৃথিশা যেন অবশ হয়ে গেছে। মণিদীপার কাছে গিয়ে তাকে ভালোভাবে বিছানায় শোয়ালো। গালে দুইটা থাপ্পড় দিয়ে বলল,

-‘বুবু,এই বুবু। বুবু কথা বল। আমার সাথে তোরা কেন এমন করছিস সবাই মিলে।আমি তো বলেছিলাম সব সামলে নিবো তাহলে…

আর বলতে পারলো না পৃথিশা। কান্নায় লুটিয়ে পড়লো সে। মণিদীপার দেহটা বুকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো,

– সবাই ছেড়ে গেলি আমাকে।তোরা সবাই চলে গেলি। আমার কথা কেউ ভাবলি না। আমি কীভাবে থাকব তা নিয়ে তোদের কোন মাথা ব্যাথা নেই।আমাকে নিয়ে তোদের কোন চিন্তা নেই। সবাই নিজেদের মুক্ত করে চলে গেলি।

পৃথিশার চোখ গেলো মণিদীপার টেবিলে। সেখানে কালো কাগজ রাখা। পৃথিশা মণিদীপাকে কাঁথা দিয়ে ঢেকে দিলো। পৃথিশা কাগজটা হাতে নিতেই দেখতে পেলো একটা চিঠি। পৃথিশার জানে, মণিদীপার খুব মন খারাপ হলে সে কালো কাগজ ব্যবহার করে। পৃথিশা চিঠিটা পড়তে শুরু করলো-

পৃথিশা,

বোন আমার। এই স্বল্প পরিসরের জীবনে আমার প্রিয় প্রাপ্তি হচ্ছিস তুই। তোকে পুতুলের মতো বড় করেছি আমি, আমার খেলার পুতুলের মতো যত্ন করেছি। মাঝেমাঝে মনে হয় তুই আমার বাচ্চা। আমি সবসময় চাইতাম তোকে সকল কঠোরতা থেকে আগলে বড় করব। আমি তা পারিনি, বাবু। আমি আর পারছি না পৃথিশা। আমি জীবন ভালোবাসা মেয়ে। এই পৃথিবী দেখার শখ ছিলো অনেক।কিন্তু আমি আর পারছি না পৃথি। সৃষ্টকর্তা আমাকে এতোটা ধৈর্যশক্তি দিয়ে পাঠায়নি। নিজেকে আয়নায় দেখলে আমার ঘৃণা হয়। মন আমাকে বারবার বলে, ‘তুই অ/পবিত্র হয়ে গেছিস।’ আমার জন্য তোদের এত সমস্যা। আমার জন্যই বাবা আজ তোদের সাথে নেই। আমি হাল ছাড়তে চাই নি বিশ্বাস কর। আমি সবরকম চেষ্টা করেছি।কিন্তু পারি নি শেষ পর্যন্ত। আমার এই জীবন আর কিছু চাওয়ার নেই। আমাকে মাফ করে দিস।
তুই খুব ভালো থাকিস বাচ্চা। ইউ ডিজার্ভ দ্যা বেষ্ট। বুবু লাভস্ ইউ।

__________

পৃথিশার সামনে দু’টো খাটিয়া। একটাতে তার মা রানী আহমেদ, অন্যটাতে মণিদীপা। পৃথিশাকে তার খালা ধরে রেখেছেন। পৃথিশা পাথর হয়ে আছে। কয়েকদিনের ব্যবধানে নিজ পরিবারকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ সে। পৃথিশা তার মায়ের খা”টিয়ার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। শেষ বারের মতো মায়ের মুখটা দেখে নিলো সে। মায়ের সাথে তার খুব যে সখ্যতা ছিলো তা না। তবে মা’কে ছাড়া একটা দিনও কল্পনা করতে পারতো না সে। মায়ের কপালে হালকা করে হাত রাখলো সে। মলিন স্বরে বলল,

– তোমাকে কখনোই কিছু দিতে পারি নি মা। তুমি সবসময় ভালোটা ডিজার্ভ করো, তা দিতে পারি নি । আমাকে মাফ করে দিয়ো মা, একটু দোয়া করো আমার জন্য যাতে তাড়াতাড়ি তোমার কাছে যেতে পারি।

পৃথিশার কন্ঠস্বর রোধ হয়ে এলো। তার খালা রাহনুমা আহমেদ তাকে পেছন থেকে ধরলো। পৃথিশা তার কপাল থেকে হাত সরালো না। তার চোখ বেয়ে অনবরত পানি পড়ছে। কান্নারত স্বরে রাহমুনাকে বলল, ‘ আম্মা তো ঠান্ডা হয়ে খালা’।
পরপরই পৃথিশা জ্ঞান হারিয়ে ফেললো। সারািনের এত ধকল শরীর নিতে পারলো না। পৃথিশার দাদাবাড়ির সাথে তাদের সম্পর্ক তেমন ভালো না। রানী আহমেদ অনেক আগেই বলে দিয়েছিলেন তাকে যেন মৃত্যুর পর তার শ্বশুরবাড়িতে না নেওয়া হয়। তাই মণিদীপা ও তাকে পৃথিশার নানাবাড়িতেই দা”ফন করা হবে। পৃথিশাকে তার খালা সঙ্গে করে নিয়ে যাবেন। পৃথিশার চাচারা কেউই তাকে রাখতে ইচ্ছুক না তেমন। কিন্তু পৃথিশা তার সাথে যেতে চাইছে না। তার এক জেদ সে তাদের বাসায় যাবে। অবশেষে তার জেদের কাছে হার মেনে পৃথিশার সাথে রাহনুমা আহমেদ তাদের বাসায় আসলেন। আপাতত কিছুদিন এখানে থেকে পরবর্তীতে পৃথিশাকে নিয়ে তাদের বাড়িতে যাবেন।

বাসায় ঢুকতেই পৃথিশা মণিদীপার রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো। মণিদীপার খাটে তার পড়নের ওড়না ছিলো। পৃথিশা সেটা হাতে জড়িয়ে বসে রইলো। এই মূহুর্তে বিশাল এই পৃথিবীতে তার কেউ নেই। সে একা,একদম একা। একটা ঘটনা মানুষের সম্পূর্ণ জীবন কীভাবে পাল্টে দেয়। পৃথিশা ইহজগতেও চিন্তা করেনি মণিদীপা এমন কোন কাজ করতে পারে। তার মায়ের মৃ’ত্যুর কারনও তার কাছে স্পষ্ট নয়। সবকিছুর মূলে দায়ী ওই ঘটনা। পৃথিশা বুঝতে পারলো না দোষট কার। কিসের জন্য তার জীবনের আজ এই পরিণতি।

চলবে,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে