#সূর্যকরোজ্জ্বল
পর্বসংখ্য-০৮
ফারিহা জান্নাত
ভোর পাঁচটা, পৃথিবীর সকল মানুষ এখনো জাগে নি। পাখির কলকাকলিতে মত্ত প্রকৃতি। পৃথিশার হাতে প্লাস্টার করে দেওয়া হচ্ছে। ভোর বেলায় একবার বাসার দিকে গিয়েছিল সে। আসার সময় সিএনজির ধাক্কায় পড়ে হাত মচকে গিয়েছে, যেহেতু সে জার্নি করবে তাই হাতটা আপাতত প্লাস্টার করে দেওয়া হচ্ছে। কিছুসময় পরই পৃথিশা ডাক্তারের কেবিন থেকে বেরিয়ে মণিদীপার কেবিনে ঢুকলো। গতকাল রাতের পর থেকে মণিদীপা পুরো শান্ত হয়ে গেছে। কারো সাথে কোন কথা বলছে না। মণিদীপা চোখ বন্ধ করে হেলান দিয়ে বসে আছে। পৃথিশা তার দিকে এগিয়ে গেলো। কপালে হাত বুলিয়ে ধীর স্বরে ডাকতেই চোখ মেললো। তারা এখনই গ্রামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিবে। মণিদীপা বেশি হাঁটতে পারবে না তাই তাকে হুইল চেয়ারে নেওয়া হবে। তার গলায় ও ঘাড়ে কামড়ের দাগ, মাথায়,হাতে,পায়ে ব্যান্ডেজ। এই অবস্হায় তাকে বাহিরে নেওয়ার ইচ্ছা ছিলো না পৃথিশার।কিন্তু আজ না গেলে কথা উঠবে, মণিদীপাও যাওয়ার জন্য জেদ করছিলো। পৃথিশা ওড়না দিয়ে তার মুখ, গলা ঢেকে দিলো। শক্ত করে পিনআপ করে দিলো যাতে না সরে। পৃথিশাদের সাথে তার মামা যাবে।
দীর্ঘ জার্নি শেষে অবশেষে তারা গ্রামে পৌঁছালো। তাদের আসতে দেখে পৃথিশার চাচা নাফিজ চৌধুরী দৌড়ে আসলেন। বাড়ির উঠোনের সামনে রান্না হচ্ছে। মণিদীপা হুইল চেয়ারে দেখে সবাই ছুটে এলো। এক এক করে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিতে লাগলো তাদের দিকে। পৃথিশা মণিদীপার দিকে বলল,
– রাস্তায় এক্সিডেন্ট হয়েছিলো। পড়ে গিয়ে হাত-পায়ে ব্যাথা পেয়েছে তাই হুইলসচেয়ারে। এজন্যই সেদিন আসতে পারি নি।
– আমাদের একটাবার খবর দিলি না?
পৃথিশার চাচী বলে উঠলেন। পৃথিশা কোন উত্তর দিলো না।হুইল চেয়ারটা ঠেলে মণিদীপাকে নিয়ে চললো বাড়ির থেকে একটু সামনে। যেখানে তাদের পারিবারিক ক”ব”র”স্হান। নিজের বাবার ক”ব”রের সামনে এসে হুইলচেয়ারটা রাখলো পৃথিশা। চোখ থেকে অঝোরে পানি পড়ছে। মণিদীপা কাঁপা শরীরে উঠার চেষ্টা করলো।পৃথিশা সাহায্য করলো তাকে। কিছুটা দুরত্ব রেখে দাঁড়ালো। মণিদীপা কান্নারত স্বরে বলে উঠল, ‘বাবা’। পরপরই হাউমাউ করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। পৃথিশার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়লো রাস্তার উপর। পাগলের মতো বিলাপ করতে লাগলো সে।
– তোমার মণির উপর এত অভিমান করলে বাবা যে তাকে রেখে চলে গেলে। একটাবার শেষ দেখাও দেখতে দিলে না বাবা। আমার কি হবে বাবা।আমি কি করব, কোথায় যাবো বাবা। যদি ফিরে আসতে বাবা, যদি আসতে আর যেতে দিতাম না। আমি তোমাকে ছাড়া কীভাবে থাকবো বাবা,কীভাবে থাকবো?দয়া করো বাবা, ফিরে আসো, ফিরে আসো।
পৃথিশা বোনকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। মণিদীপা থেকে থেকে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠছে। হুট করে পৃথিশার দিকে তাকিয় বলল, ‘আমাদের আর কেউ থাকলো না রে পৃথি,কেউ থাকলো না।’
___________
সময় বহমান। সময়ের স্রোতে সবকিছুই ফিকে হয়ে যায়। পৃথিশারা নতুন বাসা নিয়েছে। মণিদীপাকে সে বাসায় আনা হয়েছে। মণিদীপাকে নিয়ে পৃথিশা পুরোনো এলাকায় যায় নি। মণিদীপা আপাতত ভার্সিটিতে যায় না। পৃথিশা এবারের ভর্তি পরীক্ষার্থী ছিলো।কিন্তু এতসব ঝামেলার মাঝে সে কোন প্রস্তুতি নিতে পারেনি। আপাতত তারা রাশেদুল চৌধুরীর পেনশনের টাকায় চলছে।কিন্তু এই দ্রব্যমূল্যের বাজারে তা দিয়ে চলা মুশকিল। পৃথিশা ছোটবেলায় নাচ শিখতো,একটা সময় তা ছেড়ে দিয়েছিলো।তবে আজ এতবছর পর সেটাকেই হাতিয়ার করেছে সে। একটা একাডেমিতে পার্ট টাইম টিচার হিসেবে জয়েন করেছে। কাজটাতে যদিও পরিশ্রম বেশি টাকার তুলনায় তবে এই পরিস্থিতিতে ওটাই তাদের জন্য ভরসা। মণিদীপা আগের থেকে অনেক চুপচাপ হয়ে গেছে। শরীরের ক্ষতগুলো শুকিয়ে গেলেও কালসওটে দাগ পড়ে আছে।পৃথিশা ভেবেছিলো ওই ছেলেগুলোর বিরুদ্ধে মামলা করবে কিন্তু মণিদীপার নিশ্চুপতা দেখে তা জিজ্ঞাসা করার সাহস পায়নি।
আজ পৃথিশার এইচএসসির রেজাল্ট দিবে। এতগুলো দিন ব্যস্ততায় কেটে যাওয়ায় এ নিয়ে ভাবার সুযোগ পায় নি। আজ সকাল থেকেই মণিদীপার কোলে গুটিয়ে আছে। মণিদীপা বিরক্ত হয়ে কয়েকবার ঠেলেছে তাকে। বার বার বিরক্ত গলায় বলছে,
– পৃথি এত ঘেষাঘেষি করছিস কেন? দূরে গিয়ে বস। যা পরীক্ষা দিয়েছিস তাই হবে রেজাল্ট। এ নিয়ে চিন্তার কি আছে?
পৃথিশা মন খারাপ করে সরে গেলেই আবার মণিদীপার মন নরম হয়। আদুরে গলায় বোঝাতে শুরু করে। পৃথিশা বোনকে স্বাভাবিক হতে দেখে স্বস্তির শ্বাস ফেলে। ভয়ে সে মণিদীপার ভার্সিটি যাওয়ার কথা তুলতে পারে না। কিন্তু খুব করে চায়,সব স্বাভাবিক হয়ে যাক।
বারোটা বেজে গেছে।অনলাইনে রেজাল্ট এতক্ষণে বের হয়ে গেছে। পৃথিশা রেজাল্ট বের করার সাহস পাচ্ছে না। তার রেজাল্ট মণিদীপা ও রাশেদুল চৌধুরী বের করে দেয় সবসময়। মণিদীপার কোলেই মুখ গুজে শুয়ে ছিলো সে। মণিদীপা তখন ব্যস্ত হাতে মোবাইলে টাইপ করে যাচ্ছে। কাঙ্ক্ষিত জিনিসটা পেতেই মুখ উজ্জবল হয়ে উঠলো তার। পৃথিশাকে হাত দিয়ে ঠেললো বারকয়েক। ঝুমঝুম কন্ঠে বলল,
– এই বাবু উঠ, তোর রেজাল্ট দেখ।
পৃথিশা মোবাইলের স্ক্রিনে তাকালো।
Prithisha Chowdhury
Result: passed
GPA: 5.00
– তুমি যদি থাকতে বাবা!
_______
রেজাল্ট দিবে বলে আজকের দিনটা ছুটি নিয়েছিল পৃথিশা। এখন বাসায় বসে সময় কাটাতে বিরক্তি বোধ হচ্ছে পৃথিশার। চা হাতে বারান্দায় বসে ছিলো সে। হুট করেই মণিদীপা রুমে ঢুকে জিজ্ঞাসা করলো,
– পৃথি তোর আদিদের সাথে কথা হয়েছিলো?
পৃথিশা হকচকিয়ে গেলো।মণিদীপার কন্ঠস্বর তীক্ষ্ণ। কোন কিছু নিয়ে রেগে আছে সে। পৃথিশা থতমত হয়ে বলল,
– হ্যাঁ হয়েছিল,যখন তুই হাসপাতালে ছিলি। ভাইয়া অনেকবার ফোন দিয়েছিলো তাই..
– তুই তাকে সব বলেছিস?
– রিপোর্ট দেখিয়েছিলাম। কিছু বলেনি। আমি বলেছিলাম পরে উত্তর জানাতে।
– আমার সাথে জিজ্ঞাসা না করে এ সিদ্ধান্ত কীভাবে নিতে পারিস তুই? আমাকে একটাবার বলিস-ও নি এ কথা।
– সে তোমার উডবি আপু। তাকে এ কথা বলন না কেন? আর আমি তো যেচে যাই নি। সে নিজেই এসেছিলো।তুমি তখন কথা বলার অবস্হায় ছিলে না, ভাইয়াকে দেখলে আরও ভেঙ্গে পড়তে তাই আমি তোমাকে কিছু বলি নি।
মণিদীপা রেগে গেলো। হাতের ফোনটা আছড়ে ফেলে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বলল,
– আমার জীবনটা খেলা বানিয়ে ফেলেছে সবাই। কোন কিছুতে আমার কথার মূল্য নেই।
পৃথিশা মণিদীপার আচরণে অবাক হলো না। সেই ঘটনার পর থেকে মণিদীপার আচরণে বেশ পরিবর্তন এসেছে।হুট করেই রেগে যায় আবার হুট করে ঠিক হয়ে যায়। কিছুসময় পরই মণিদীপা তার রুমে আসলো। পৃথিশা কাছে এসে নিম্নস্বরে বলল,
– সরি বাবু, বেশি রাগ দেখিয়ে ফেলেছি।কি যে হয়েছে আমার।
পৃথিশা কিছু বলল না। বোনকে জড়িয়ে তার সাথে মিশে থাকলো। হুট করেই মণিদীপা বলল,
– আমি থানায় কেস করতে চাই পৃথি।
চলবে,,